| 29 মার্চ 2024
Categories
এই দিনে গদ্য সাহিত্য

বিদায় শঙ্খ ঘোষ: পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ । জাহীদ রেজা নূর

আনুমানিক পঠনকাল: 2 মিনিট
 
 
শরীরটা বহুদিন ধরেই খারাপ ছিল তাঁর। কথা বলতে কষ্ট হতো। যা বলতেন, তাও জড়িয়ে যেত জিহ্বায়। আক্ষেপ করে বলেছিলেন সনজীদা খাতুন, ‘শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে কিছু কথা ছিল, ও তো আর কথা বলতে পারছে না।’
 
এরপর ১২ এপ্রিল থেকে খুসখুসে কাশি। ‌ জানা গেল করণায় আক্রান্ত হয়েছেন কবি। হাসপাতালে যেতে চাইছিলেন না। কলকাতার বাড়িতেই আইসোলেশনে চলছিল চিকিৎসা। সেখানেই জীবনাবসান ঘটল তাঁর আজ ২১ এপ্রিল সকালে।
দুঃসংবাদটা ধেয়ে আসছে, বুঝতে পারছিলাম বেশ কিছুদিন ধরেই। ‌ আজ তা সত্য হলো।
 
এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় পিকেটিংয়ের পাশাপাশি বিকেল-সন্ধ্যায় টিএসসিতে যখন কবিতার সঙ্গে মিতালী, তখনই প্রথম শঙ্খ ঘোষের নাম ও কাজের সঙ্গে পরিচয়। শঙ্খ ঘোষের শ্রেষ্ঠ কবিতা থেকে ‘দিনগুলি রাতগুলি’ কবিতাটি পড়ে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিলাম কন্ঠশীলনের প্রাণপুরুষ বিপ্লব বালার দিকে। তিনিই আমাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন শঙ্খ ঘোষ। এরপর গদ্যে এবং পদ্যে ধীরে ধীরে আপন হওয়া শুরু করেন শঙ্খ ঘোষ। তার অবাক করা সরল বাকভঙ্গিতে সাহিত্য জগতের কত দিকেই না নিয়ে গেলেন তিনি! ‘ছেঁড়া ক্যাম্বিসের ব্যাগ’ বইটি পড়া শেষ হওয়ার পরপরই বুঝতে থাকি, সাহিত্য জগতের বহু মানুষের প্রতিকৃতি পেয়ে যাব শঙ্খ ঘোষে। বুদ্ধদেব বসু, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শম্ভু মিত্রসহ আরো কত খ্যাতিমান মানুষ মূর্ত হয়ে উঠেছেন শঙ্খের কলমের কালিতে, তা বলে শেষ করা যাবে না। এই তালিকায় রয়েছেন আমাদের আনোয়ার পাশা, সনজীদা খাতুন ওয়াহিদুল হক, শামসুর রহমান প্রমুখ। ছায়ানট প্রসঙ্গ এসেছে বারবার। আবু সয়ীদ আইয়ুবের সঙ্গে তার চিঠি চালাচালি, কথাবার্তা অন্য এক জগতের সন্ধান দিয়েছে আমাদের। তাঁর ‘জার্নাল’ বইটি যে কত মানুষকে উপহার দিয়েছি, তার ইয়ত্তা নেই।
 

আরো পড়ুন: দুরূহতাই কবিতা নয়, কিন্তু কবিতা অনেক সময়েই গূঢ়ার্থে দুরূহ: শঙ্খ ঘোষ

 
দুবার দেখা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। দুবারই নাহাস ভাইয়ের (স্থপতি নাহাস খলিল) বাসায়। ধানমন্ডির অরণি স্কুল সেই বাসাতেই। ভারী ভরাট কন্ঠে শঙ্খ ঘোষ যা বলতেন, তার সব কিছুরই গুণমুগ্ধ শ্রোতা ছিলাম আমি। কেউ কেউ এসে শোনাচ্ছে গান, কেউ কেউ কবিতা, জিয়ন কাঠির লিনা পরিবেশন করলো রবীন্দ্রনাথের স্ত্রীর পত্র। সবটাতেই আনন্দ পেলেন। ‌ গানগুলো শুনলেন তনময় হয়ে। স্ত্রীর পত্রের দু এক জায়গায় তার নিজের ধারণা পেশ করলেন।
 
শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকায় ৪০ বছর বয়সেই বুড়ো হয়ে যাওয়ার একটা আক্ষেপ কাজ করেছিল। বুদ্ধদেব বসুর সেরকম একটি পংক্তি তুলে দিয়ে তিনি প্রশ্ন রেখে ছিলেন, তাহলে কি যবনিকাপাতের সময় হয়েছে?
সে প্রসঙ্গটি তার সত্তরোর্ধ্ব বয়সে মনে করিয়ে দিতেই কিছু কথাবার্তার পর হেসে বলেছিলেন, ‘এখন তো নিজেকে বাচ্চা বাচ্চা মনে হয়!’ আনন্দ বুকে নিয়ে ফিরেছিলাম বাসায়।
 
শঙ্খ ঘোষের পরিচয় দেওয়ার আমি কেউ নই। শুধু বলতে পারি, শঙ্খ ঘোষের গদ্যসংগ্রহ থেকে এমন অনেক বিষয়েই নিজেকে ঋদ্ধ করা যাবে, যেগুলো এত সহজ ভাষায় আর কোথাও পাওয়া যায় না। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে এত গভীর বিশ্লেষণ, বিশেষ করে ভাষাশৈলীর কারণে মন কেড়ে নেয়। ৫ম থেকে ৭ম খন্ড শুধুই রবীন্দ্রনাথ। খেয়াল করলে দেখা যায়, সেখানে রবীন্দ্র স্তুতি নেই, সফলতা এবং দুর্বলতা মিলে যে রবীন্দ্রনাথ, তাকেই তুলে এনেছেন শঙ্খ ঘোষ।
তাঁর ‘শব্দ আর সত্য’, ‘নিঃশব্দের তর্জনী’ বই দুটি কবিতা বিষয়ে গভীরতম ভাবনার উৎস। ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’ বইটির ছোট ছোট স্তবকগুলোয় অনুভূতির প্রখরতা মুগ্ধ করে তোলে।
 
তার কন্ঠে আবৃত্তিও ছিল শোনার মতো। আবৃত্তিতে আরোপিত আবেগ একেবারেই ছিল না তাঁর।
 
১৯৩২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি কবি জন্মেছিলেন বাংলাদেশের চাঁদপুরে। বংশানুক্রমিকভাবে পৈতৃক বাড়ি ছিল বরিশাল জেলার বানারীপাড়া গ্রামে। ‌ দেশভাগের পর তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পড়িয়েছেন বঙ্গবাসী কলেজ সিটি কলেজ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৯২ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নিয়েছেন। লেখালিখি থামাননি কখনো। তাঁর পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিল চিত্তপ্রিয় ঘোষ।
শঙ্খ ঘোষ চলে গেছেন আবার যানওনি। তাঁর লেখাতেই তো আমরা পাই, ‘আমার জন্মের কোন শেষ নেই।’
 
 
 
 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত