Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,bangla sahitya shishu 3

সময়ের ডায়েরি: একখণ্ড শৈশব (পর্ব-১) । জাহীদ রেজা নূর

Reading Time: 2 minutes

একটু সকাল সকাল পৌঁছে যেতাম বায়তুল মোকাররম সুপার মার্কেটে। নিউ ইস্কাটন থেকে রিকশায় করে পুরো পথ। শামীম ভাইয়ের রেডিমেড কাপড়ের দোকান ছিল সেখানে। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের মাঝামাঝি। দোকানের একমাত্র সেলসম্যান মান্নান ভাই যখন দোকান খুলতেন, বড় ভাই যখন ক্যাশে গিয়ে বসতেন, তখন দোকান ছেড়ে বেরিয়ে পড়তাম আমি। স্কুল ফাঁকি দেয়ার কাজ সু-সম্পন্ন হয়েছে, এখন পুরো দিন অবকাশ। সদ্য ঘুম থেকে জেগে ওঠা মার্কেটের দোকানগুলোর সামনে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রাতর্ভ্রমণ সারতাম।। শাটার উঠানোর আওয়াজ, দোকানির হাসি ঠাট্টা, স্টেডিয়ামের দিককার খাবারের দোকানটা খুলেছে কিনা, সেটাও দেখে আসতাম। জানতাম, চাইলেই এই দোকানের বার্গার, চিকেন রোল কিংবা সিঙ্গারা আমার ভাগ্যে জুটবে না, তাই বলে সুস্বাদু সস দিয়ে কারো প্লেটে ভালো ভালো খাবার ঢেলে দিচ্ছে দোকানি, সে দৃশ্য দেখা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করবো কেন? এরপরের আকর্ষণ ছিল গনি। হ্যাঁ, ক্যানভাস করার সময় ‘আমি গণি’ বাক্যটি বহুবার উচ্চারণ করতেন তিনি। ঘনঘন সেই ক্যানভাসারের আসরে উপস্থিত হওয়ায় কিছুদিনের মধ্যেই আমি আবিষ্কার করলাম, প্রতিদিন টেপ রেকর্ডার এর মতো একই কথা আউড়ে যান গনি। দিনে তিন থেকে চারবার তার আসর বসে। ‌প্রতিবারই গোল হয়ে নতুন নতুন দর্শক-শ্রোতা চকচক চোখে গনির কথা শোনে। গনির সামনে যে তিনটি বাক্স, তাতে তিন ধরনের তিনটি সাপ। শুরুতে সেই সাপের খেলা চলার মধ্য দিয়েই গনির আবির্ভাব হয়। সাপ ঘুরতে থাকে গনির আশপাশে, গনি বলতে থাকেন কোন পাহাড়ের চূড়ায় উঠে সাপ ধরেছেন তিনি। পরম শ্রদ্ধা নিয়ে বলতে থাকেন গুরুর কথা। সবাই তনময় হয়ে শুনতে থাকে। এই সাপ দিয়ে একটু পরেই খেলা দেখাবেন, সে কথা বলে একের পর এক গল্প বলে যেতে থাকেন। ‌ গল্পগুলো এতটাই বিশ্বাসযোগ্য যে, কেউ সেই চক্কর থেকে বেরিয়ে আসে না। এরপর গনির কথাবার্তা চলে আসে স্বাভাবিক জীবনে। আসরে যারা সামিল হয়েছেন, তাদের অনেকেই যে স্ত্রীর সঙ্গে রাত্রিবেলা স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারেন না, সেই ইঙ্গিত দিয়ে একটি বয়াম থেকে কাগজে মোড়া বেশকিছু ওষুধ বের করেন গনি। ওষুধ মানে কালোজিরার চেয়ে একটু বড় গোল গোল দানা। প্রতিটি কাগজে প্যাঁচানো আছে ৫ থেকে ৬ টি করে দানা। এই দানা নাকি একজন পুরুষকে সিংহ করে তোলে। সেই শৈশবে সিংহ করে তোলার অর্থ না বুঝলেও সমবেত জনতার কেউ কেউ উৎসাহী হয়ে পড়ছেন, সেটা বেশ বোঝা যেত। বহুদিন এই আসরে শামিল হয়ে সাপ খেলা দেখার চেষ্টা করেছি বলে এর পরের ঘটনাগুলো আমার চোখের সামনে অবিকল একই রকমভাবে ঘটতে থাকে। বুড়ো বয়সে যৌবন ফিরে পাবার ইচ্ছে থাকলেও ভরা হাটে প্রকাশ্যে মধ্যবয়সি বা বুড়োরা এই যৌবনবর্ধক বড়ি কিনে নেবেন, ব্যাপারটা এত সহজ নয়। ফলে শুরুতে বিক্রি-বাট্টা কম হতো। এ সময় দারুণ নিখুঁত বর্ণনায় গনি সেইসব যুবককে চিহ্নিত করে ফেলতেন, যারা তাঁর স্ত্রীকে কিংবা সঙ্গিনীকে তৃপ্ত করতে পারেন না। এখন বুঝতে পারি, এই তালিকাটিও নির্ঘাত কম বড় নয়। এবার ছিল চমক। আগে থেকেই তৈরি থাকা নানা বয়সের গোটা ছয়েক‌ গনির শিষ্য টাকা দিতে থাকেন গনির হাতে। বলতে থাকেন ‘আমাকে দিন আমাকে দিন:। তখন গনি বলেন, ‘এতে লজ্জার কিছু নেই। সংসারে সুখী হওয়াটাই সবচেয়ে জরুরি। আপনারা সমস্যা বোধ করলেই এই অল্প দামে ওষুধ কিনে নিন।’ এরপর শুরু হয়ে যেত কেনাবেচা। ‌ আমি অপেক্ষা করতাম কখন অজগর সাপ টা গিলে খাবে সামনের ইঁদুরটাকে। কিংবা বেজি আর সাপের যুদ্ধ আবার দেখবো কখন। সেটা আর দেখা হতো না। প্রতিবারই ওষুধ বিক্রির মাধ্যমে শেষ হয়ে যেত সর্পরাজ গনির আসর। সেই মুখ চেনা ৬ জন সাজানো ক্রেতা ছড়িয়ে পড়তো এদিক ওদিক, আবার নতুন আসর বসলে প্রতিদিনই নতুন মানুষ হয়ে বসে পড়তো সাপের খেলা দেখতে, তারপর মাহেন্দ্রক্ষণ এলে আবার বলতে শুরু করতো, ‘আমাকে দিন, আমাকে দিন!’

(চলবে)

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>