Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,bangla sahitya shishu 3

সময়ের ডায়েরি: একখণ্ড শৈশব (পর্ব-২) । জাহীদ রেজা নূর

Reading Time: 3 minutes

বায়তুল মোকাররম সুপার মার্কেটের আশপাশেই হাঁটাচলা চলত দুপুর অবধি। এরপর ছিল রোমাঞ্চকর সময়। ‌ কারণ দুপুরে দোকানে ফিরলে ক্যাশ থেকে বড় ভাই বের করে দিতেন টাকা। টিফিন ক্যারিয়ারে করে বড় ভাইয়ের জন্য বাড়ি থেকে খাবার পাঠিয়ে দিতেন আম্মা, খাওয়ার টাকা বাঁচানোর জন্যই। কিন্তু আমার জন্য ছিল অন্য ব্যবস্থা। ‌ স্টেডিয়ামের কোন রেস্তোরাঁয় দুপুরের খাবার ছিল নির্ধারিত। বড় ভাইয়ের সঙ্গে মার্কেটে যাবার ক্ষেত্রে সেটা ছিল একটা বড় আকর্ষণ। তবে এমন নয় যে, দারুণ কিছু খেতাম। ‌ মোটামুটি নির্দিষ্ট ছিল, পূর্ব গ্যালারির নিচে, ভিআইপির পাশে ছোটখাটো একটা রেস্তোরাঁ। সেখানে মুগ ডাল দিয়ে খাসির মাংস রান্না হতো। তিন টাকা চার আনা ছিল ভাত ও মাংসের দাম। এখনো সেটা মনে আছে। আমি যেহেতু সবচেয়ে পছন্দ করতাম মাংস, তাই খুব কম সময়ে এই খাদ্যের বাইরে অন্য কোন খাবার খেয়েছি। কখনো জিজ্ঞেস করা হতো, মাছ খাব কিনা, কোনোরকম ভাবনা ছাড়াই বলে দিতাম, একেবারেই না! বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আমার খাদ্যাভ্যাসে নানা ধরনের পরিবর্তন এসেছে ঠিকই, কিন্তু গরু ও খাসির মাংস এবং চিংড়ি মাছের ক্ষেত্রে ভালোবাসার হেরফের হয়নি একটুও।‌ আগে মোটেই ভাল লাগত না টেংরা মাছ কিংবা পুঁটি মাছ। ‌ এখন ভালো লাগে। বাতাসি মাছ কিংবা মলা মাছও এখন ভালো লাগে। ‌ আগে এগুলো দেখতেই পারতাম না। ছোট্ট এক টুকরো মাংস, দুটো আলু থাকলে এক থালা ভাত উজাড় করে দিতে পারতাম মুহূর্তে। বড় ভাইকে কম জ্বালাইনি। বলে রাখি, মুক্তিযুদ্ধে আব্বা শহীদ হওয়ার পর বড় ভাই শামীম রেজা নূর আমাদের পুরো পরিবারটির দায়িত্ব হাতে নিয়েছিলেন। তার কাঁধে সংসারের বড় দায়িত্ব থাকায় আম্মা কিছুটা নিশ্চিন্তে থাকতে পারতেন। ‌ মেজ ভাই শাহীন রেজা নূর সে সময় আমাদের ভবিষ্যৎ লক্ষ্য নির্ধারণের চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। সে প্রসঙ্গে পরে নিশ্চয়ই কখনো লিখব। এখানে স্কুল ফাঁকি দিয়ে মার্কেট ভ্রমণের সময় ঘটে যাওয়া আরেকটি ছোট্ট কাহিনীর উল্লেখ করি। সবাই জানেন, বায়তুল মোকাররম আর স্টেডিয়ামের একপাশে ছিল মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। ফুটবলাররা তখন আমাদের আইডল। ক্রিকেট তখনও হালে পানি পায়নি। ‌ মূলত আউটার স্টেডিয়ামের তিনটি মাঠে খেলা হতো। ‌ ফুটবলের জন্য নির্দিষ্ট ছিল ঢাকা স্টেডিয়াম। পরে ভেবে দেখেছি, ঢাকা স্টেডিয়ামটি যে আকারে তৈরি করা হয়েছে, সেটা আসলে ক্রিকেটেরই যোগ্য। ‌ এই স্টেডিয়ামে ছেলেবেলার বেশকিছু মজার অভিজ্ঞতা আছে, পর্যায়ক্রমে সেগুলো বলব। যে সময়ের কথা বলছি, সে সময় মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে বেশ কয়েকজন তারকা ফুটবলার‌ ছিলেন। ‌ জাকারিয়া পিন্টু, মঞ্জু, আইনুল, প্রতাপ হাজরা, টিপু এবং মেজর হাফিজের কথা মনে পড়ে। ক্লাবের কাছাকাছি গেলে কোন এক ফাঁকে এই তারকাদের কাউকে না কাউকে দেখে ফেলব, এরকম একটা আসা জেগে থাকতো বুকে। ‌ কিন্তু খুব কম সময়ে সংরক্ষিত এলাকা থেকে ফুটবলাররা বেরিয়ে আসতেন। একবার শুধু দেখেছিলাম খালি গায়ে শুধু হাফপ্যান্ট পরা আইনুল ভাই শুয়ে আছেন, আর তার শরীর দলাই-মলাই করছে ক্লাবের দূই অ্যাসিস্ট্যান্ট। এরকমই একদিন মোহামেডান ক্লাব থেকে ভেসে এলো মোরগ পোলাওয়ের ঘ্রাণ। তাতে আমার খাদ্য পরিকল্পনা পাল্টে গেল। দ্রুত দোকানে এসে বড় ভাইকে বললাম, ‘পোলাও খাব।’ তিনি বললেন, ‘পোলাও খাওয়ানোর মতো পয়সা নেই!’ বললাম, ‘আমার পোলাও খেতে ইচ্ছে করছে!’ ‘টাকা না থাকলে খাবি কি করে?’ ‘কেন, একদিন একটু বেশি টাকা খরচ করলে কী হয়? (আমার এ ধরনের মুর্খামীর কথা ভাবলে এখন সত্যিই সজল হয়ে ওঠে চোখ)। ‘আমার কাছে থাকতে হবেতো টাকা! আজ বেচাকেনা বেশি হয়নি!’ বড় ভাই তিন টাকা চার আনা বের করে দিয়েছিলেন আমাকে। আমি সে টাকা না নিয়ে রেগেমেগে বেরিয়ে গিয়েছিলাম আবার। হাঁটতে হাঁটতে চলে গিয়েছিলাম মীর জুমলার কামানের কাছ পর্যন্ত। সেখানে সম্ভবত পূর্ণিমা নামে একটি জিলাপির দোকান ছিল। বড় বড় জিলাপি পাওয়া যেত। কেনার মুরোদ না থাকলেও মানুষ কিনে খাচ্ছে, সেটা দেখেও আনন্দ পেতাম। ‌ এদিকে শামীম ভাইয়ের তো মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। না খেয়ে কোথায় গেছি, সেটা তিনি জানেন না। দোকানে মান্নান ভাইকে রেখেই তিনি বেরিয়ে পড়েছেন আমাকে খুঁজতে। ‌ কোথায় খুঁজবেন সেটাও জানেন না! তবে এদিক-ওদিক ঘুরে আবার স্টেডিয়ামের সামনে দিয়ে সুপার মার্কেটের দিকে ফিরছিলাম। সেখানেই দেখা হয়ে গিয়েছিল বড় ভাইয়ের সঙ্গে। সম্ভবত ততক্ষণে তাঁর মন ভরে গেছে কষ্টে। তিনি সারা জীবনই নিজেকে কষ্ট দিয়ে অন্যের চাহিদা পূরণ করে গেছেন, (এখনো তা করে যাচ্ছেন)। আমাকে দেখার পর দেখলাম তার ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এসেছে সুন্দর গজদন্তটি। তাতে বোঝা গেল, তিনি আমার ওপর রেগে নেই। বললেন, ‘চল!’ আমি মুখ ভার করেই বললাম, ‘আমি ভাত খাব না!’ শামীম ভাই হেসে বললেন, ‘পোলাও তো খাবি!’ আমি বললাম, ‘না, পোলাও খাবো না। আপনার কাছে টাকা নাই।’ হাসিমুখেই তিনি বললেন, ‘টাকা ধার করেছি! চল, খাবি।’ এরপর স্টেডিয়ামের একটি রেস্তোরাঁয় মোরগ পোলাও খেলাম আমি। বড় ভাই পুরোটা সময় হাসি হাসি মুখ করে আমার খাওয়া দেখলেন। আমার মনে খুব অপরাধ বোধ হলো।‌ কিন্তু সেদিন তাকে সেটা জানতে দিই নাই। শুধু মনে মনে ঠিক করেছিলাম, আর কোনদিন দোকানে এসে অযৌক্তিক আবদার করবো না। আমি আমার কথা রাখতে পেরেছিলাম।

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>