Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,bangla sahitya shishu 3

সময়ের ডায়েরি: একখণ্ড শৈশব (পর্ব-৩) । জাহীদ রেজা নূর

Reading Time: 3 minutes

এরকম ঘটনা আর কারো জীবনে আছে কিনা আমার জানা নেই। ‌ হঠাৎ করেই হাঁটতে থাকা কোন রমণী কিংবা রিকশায় বসে থাকা নারীকে মনে হয়েছে নিজের মা। ‌ চিৎকার করে তার দিকে ছুটে গিয়ে অন্য মানুষকে দেখে বিমূঢ় হয়েছি। জীবনের একেবারে শুরুর দিককার এই ঘটনা আজই প্রথম প্রকাশ করছি। সে কথা বলার আগে তারও কিছু আগের কথা বলে নিতে হয়। না হলে হঠাৎ করে সবখানে আম্মাকে দেখায় মাজেজা বোঝা যাবে না। আব্বাকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ‌আর আলবদরের দল অপহরণ করেছিল ৫ নং চামেলীবাগের বাড়ি থেকে। আমি তখন একেবারেই ছোট। ‌ আমার ছোট ভাই তৌহিদের বয়স তখন ৩। ‌ আমার ৫। আব্বা কে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় আমরা সাতভাই ছিলাম বাড়িতে, বড় ভাই গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে।‌ তিনি কলকাতা থেকে ফিরেছিলেন প্রবাসী সরকারের সঙ্গে একই বিমানে, অর্থাৎ সেই বিমানের যাত্রী ছিলেন তাজউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলামরা। আমার এখনো মনে আছে, শামীম ভাই যে সময় ফিরলেন, আম্মা সে সময় নামাজ পড়ছিলেন। মোনাজাতের পর বড় ভাই এবং আম্মার যে হাহাকার করা কান্না দেখেছিলাম, তা আজও ভুলতে পারিনি। সেই চামেলীবাগ থেকে আমরা চলে এসেছিলাম ১৯ নং নিউ ইস্কাটনের বাড়িতে। শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারদের থাকার জন্য বঙ্গবন্ধু বাড়ি দিয়েছিলেন। ‌ আব্বা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনকে প্রচারের মাহাত্ম্য দিয়েছিলেন সিরাজুদ্দীন হোসেন। এ নিয়ে আলাদা লেখা হবে পরে। নিউ ইস্কাটনের দোতলা বাড়ির উপরতলায় ছিলাম আমরা। ‌ নিচতলায় ছিলেন সংগীতশিল্পী আপেল মাহমুদ। তার গাওয়া ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’ তখনো খুব জনে জনে ছড়িয়ে। এই বাসায় আসার পর আমরা আবিষ্কার করলাম, সেখানে আরো দুজন মানুষ থাকেন। ‌ স্বপ্না রায় ও তাঁর মা। স্বপ্না রায় জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী। ‌’এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ তার কণ্ঠেই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ‌ ধীরে ধীরে জানতে পারলাম, মা ও মেয়ে স্বেচ্ছায় এখানে আসেননি। তাদের জোর করে রেখে দেওয়া হয়েছে। ডাল মে কুচ কালা হ্যায়! এখনো কানে ভেসে আসে, রাতের বেলায় মা ও মেয়ের কান্নার শব্দ। ‌ কোন পাড় মাতালের চিৎকার! বাড়ির সামনে একটা তুলসী গাছ ছিল, স্বপ্না রায়ের মা সেখানে পূজা করতেন। স্বপ্না রায় খুবই সুশ্রী ছিলেন। ‌হাসলে মুক্তো ঝরে–সম্ভবত এরকম মানুষের হাসি থেকেই উপমাটা এসেছে। কিন্তু মাঝে মাঝে তার চোখে ভয় ভর করত। বড় ভাইদের আলোচনা থেকে আমরাও ততদিনে বুঝে নিয়েছি, স্বপ্না রায় এবং তার মা কোন কারণে এখানে আটকা পড়েছেন। একদিন নিচতলায় অনেক চিৎকার চেঁচামেচি শোনা গেল। ‌ পরিষ্কার হলো, স্বপ্না রায় তার মাকে নিয়ে সেখান থেকে পালিয়েছেন। কিছুদিনের মধ্যেই আপেল মাহমুদকে সেই বাড়ি থেকে চলে যেতে হলো।‌ সেখানে এলেন শহীদ বুদ্ধিজীবী আবুল কালাম আজাদের পরিবার। শহীদ আবুল কালাম আজাদের মা, তিন ভাই, দুই বোন এবং ছোট ভাইয়েরর স্ত্রীকে নিয়ে পুরো পরিবারটি। আবুল কালাম আজাদ এর ছোট ভাই হাবিবুল বাশার পত্রিকায় চাকরি করতেন। ‌ আব্বার অধীনেও কাজ করেছেন। স্বাধীনতার পর মর্নিং পোস্ট (নাকি ইভনিং পোস্ট!) আর স্যাটারডে পোস্ট নামের দুটো পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তিনি। দ্বিতীয় পত্রিকাটি ছিল সাপ্তাহিক। একটু একটু করে তাদের সঙ্গে চেনাজানা হতে থাকল। বাড়ির পেছনে সার্ভেন্ট কোয়ার্টারে থাকতো সতীশদার পরিবার। সেই পরিবার আর পরিচারিকা ফরিদার পরিবার নিয়ে পরে বড় করে লিখব। যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, এবার সেখানে ফিরে আসি। ‌ চলে এসেছি নিউ ইস্কাটনে, মন পড়ে আছে চামেলীবাগে। তাই প্রতিদিনই বড় ভাইদের কাছে আবদার করি, ‘চামেলীবাগে নিয়ে চলেন।’ তাদেরও সব বন্ধু-বান্ধব চামেলীবাগে থাকতো। সেখানে বড় বড় আড্ডা হতো। মেজ ভাই শাহীন রেজা নূর সেই আড্ডা’র মধ্যমণি ছিলেন। শান্তিনগরের হক রেস্তোরাঁ, মিনারা রেস্তোরাঁ আর লাবু ভাইদের বাসার সামনের মোড় ছিল আড্ডাস্থল। ছাড়াবাড়ির সিঁড়িতেও (৬ নং চামেলীবাগ) বিকেলের দিকে আড্ডা বসত। তাই তারাও মাঝেমাঝে আমাদের নিয়ে যেতেন চামেলীবাগে। সেখানে আমরা আমাদের বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলতাম অথবা গোল্লাছুট, বৌছি। টিলো এসপ্রেসও ছিল খুব পছন্দের খেলা। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, সেসময় চামেলীবাগে আমাদের বাড়ি নেই। ক্লান্ত হয়ে গেলে দৌড়ে বাড়িতে গিয়ে শুয়ে পড়বো বিছানায়, এরকম সম্ভাবনা ছিল না। চাইলেই একা একা চলে যাব নিউ ইস্কাটনে, সেরকম উপায় ছিল না। অপেক্ষা করতে হতো বড় ভাইদের জন্য। কখন তারা বাড়ি যাবেন সেটা জানার কাজটা ছিল সবচেয়ে জরুরি তখন। এরকম সময় প্রবলভাবে আম্মাকে চাইতাম। ‌ ঘুরেফিরে তিনি ছিলেন সকল আশ্রয়ের কেন্দ্রবিন্দু। ‌ তার কাছে ফিরতে ইচ্ছে করতো। আর তখন দূর থেকে আসা যেকোনো নারীকেই মনে হতো আম্মা বুঝি আমাকে নিতে এসেছেন। ফলে দৌড়ে যেতাম তার দিকে। কিছুদূর যাওয়ার পরই বুঝতাম ভুল জায়গায় এসেছি। কিন্তু বারবার সেই ভুল হতেই থাকল। এটা অবশ্য দুই-একদিন পর কেটে গিয়েছিল। চামেলীবাগে যাওয়ার তাড়নাও কমে গিয়েছিল। নিউ ইস্কাটনেই আমরা নতুন বন্ধুদের পেয়ে যাই এবং খেলাধুলার পূর্ণ আনন্দ পেতে থাকি। তো, ভাইয়েরা আড্ডা শেষ করার পর রিক্সা করে ফিরতাম বাড়ি। আমি শাহীদ আর তৌহিদ, তিনজনই যেতাম। বাড়ি ফেরার পর বেড়াল ছানার মতো আমরা আম্মাকে জড়িয়ে ধরতাম। এরকম নির্ভরতা আগে-পরে কখনো আর কেউ ছিল না।

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>