| 29 মার্চ 2024
Categories
সময়ের ডায়েরি

সময়ের ডায়েরি: ইফতারি জার্নাল । মুম রহমান

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট
মুসাচি’র ২১ সূত্র
এই সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আর জনপ্রিয় লেখক ইউভাল নোয়া হারারি’র সাম্প্রতিককালের একটা বই ‘একুশ শতকের জন্য একুশটি শিক্ষা’। এই বইটি আমাদের পড়ুয়া সমাজের অনেকেই পড়েছেন। তবে আমি আর তার বই নিয়ে কথা বলবো না। কথা বলবো প্রায় চারশ বছরের পুরনো একটি বই নিয়ে যে বইতেও একুশটি নিয়ম বা সূত্র দেয়া আছে। বইটির নাম ‘দুকোদ্দো বা একাকীত্বের পথ’। বইটি লিখেছেন জাপানের সামুরাই ওস্তাদ মিয়ামোতো মুসাচি (১৫৮৪-১৬৪৫)। তিনি এই বইতে একুশটা নিয়মের কথা বলেছেন। মুসাচি নেহাতই একজন সামুরাই ওস্তাদ ছিলেন না, তিনি একজন দার্শনিক, লেখক এবং শিল্পীও ছিলেন। মুসাসি ছিলেন একজন পরিব্রাজক যোদ্ধা, জাপানী ভাষায় রোনিন। রোনিন হলো স্বাধীন সামুরাই। তারা নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ান। প্রয়োজনে ভাড়ায় লড়াই করেন। বিভিন্ন গোষ্ঠীর নেতা বা যোদ্ধাদের সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধ করে নিজের আধিপত্য বিস্তার করেন। এটা ছিলো তাদের পেশা। জাপানে সামুরাই, রোনিনদের একটা ঐতিহ্য ছিলো। বলা হয়ে থাকে, মুসাচি তার জীবনে ৬১টি দ্বন্দ্ব যুদ্ধ বা ডুয়েল লড়েছেন। এই যলড়াইগুলো হলো জীবন-মরণ লড়াই। যোদ্ধাদের একজনের মৃত্যু না-হওয়া কিংবা পরাজয় না-স্বীকার করা পর্যন্ত লড়াই চলবে। কাজেই ৬১টি দ্বন্দ যুদ্ধ করা ছেলে খেলা নয়। মুসাচি লড়াই করতেই দুই তলোয়াড় দিয়ে। একসাথে দুটো তরবারি চালাতে সিদ্ধহস্ত মুসাসি তার মৃত্যুর বছর দুটো বই লেখেন একটি হলো ‘দ্য বুক অব ফাইভ রিংস’ আরেকটি হলো ‘দুকোদ্দো বা একাকীত্বের পথ’। বলা হয়ে থাকে শেষ বইটি মৃত্যুর সাতদিন আগে তিনি প্রিয় শিষ্য তেরাও ম্যাগোনোজোকে দিয়েছিলেন। ফাইভ রিংসে তিনি তার ঘরাণার যুদ্ধ রীতি নিয়ে লিখেছেন অন্যদিকে দুকোদ্দোতে লিখেছেন অতি সংক্ষেপে জয়ী যোদ্ধা হওয়ার ২১টি পন্থা বা সূত্রের কথা। এই নিয়মের অধিকাংশ হলো যোদ্ধাদের জন্য। কিন্তু এই নিয়ম আমাদের কাজে লাগবে না তা কিন্তু নয়। কারণ জীবনটা তো একটা যুদ্ধই, সামুরাইগণ তরবারি দিয়ে যুদ্ধ করতেন আমরা অন্য কোন অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করি। দিনশেষে লড়াইটা সবাইকেই করতে হয়। এমনকি ঢাল-তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দারকেও লড়তে হয়। আর আমার মনে হলো ইফতারি জার্নাল যারা নিয়মিত পড়ছেন তাদের জন্য মুসাসির ২১ সূত্রও বড়ই কাজের হবে। কাজেই আর কথা না বাড়িয়ে মিয়ামোতো মুসাচি ’র একুশ সূত্রের দিকে রজর ফেরানো যাক। বলা দরকার, মুসাসির এই সূত্রগুলো একেবারেই সংক্ষেপে লেখা। আমি মূল সূত্রের সঙ্গে আমার নিজের কিছু ব্যখা দিয়েছি। এই ব্যাখাটা আমাদের সময়ে তার সূত্রের প্রাসঙ্গিকতাকে তুলে ধরবে আশা রাখি।
১. যেমন আছো তেমন ভাবেই সব কিছুকে গ্রহণ করো।
এটা আসলে জেন বৌদ্ধদের অন্যতম সাধনার দিক। তারা নিজ থেকে কোন কিছুকে বাধা দিতে চান না। আজকের কোভিডগ্রস্থ পৃথিবীর প্রেক্ষিতে বলতে পারি, রোগ-শোক-মৃত্যু এগুলো থাকবেই। জীবনের মতো মৃত্যু, দুঃখ, বেদনা অনিবার্য। কাজেই এগুলোকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করার মানসিকতা থাকতে হবে একজন যোদ্ধার। যোদ্ধার জীবন মানেই নিরাপত্তাহীনতা আর অনিশ্চয়তা। কিন্তু এই অনিশ্চয়তা আর নিরাপত্তাহীনতাকে গ্রহণ করতে হবে। এতে করে স্থিরতা আসবে। আর স্থিরতা বরাবরই লড়াইয়ে জেতার জন্য দরকার।
২. কেবল আনন্দের জন্য আনন্দ কোরো না।
আজকের দিনে আমরা অবশ্য তাই করছি। নেহাতই নিজেকে খুশি করতে বৈষয়িক আনন্দ-ফূর্তিতে আমরা মেতে উঠছি। উদ্দেশ্যহীন আনন্দ দিন শেষে ক্ষতিই করে আর যে আনন্দ বড় কিছু করার মধ্যে আছে তাই আসল আনন্দ। আজকে আমরা কেউ টাকার মধ্যে আনন্দ খুঁজছি তো কেউ আনন্দ খুঁজছি নেশার মধ্যে। অথচ সৃজনশীল কোন কাজে আনন্দ খুঁজে পেলে সে আনন্দ ছড়িয়ে পড়বে বৃহৎ পরিসরে।
৩. কোন পরিস্থিতিতেই আংশিক অনুভূতির উপর নির্ভর করো না।
এটা আসলে পরিপূর্ণতার প্রসঙ্গ। ধারণা করা যায় যে মুসাচি ‘আংশিক অনুভূতি’ (partial feeling) বলতে এমন কোন অনুভূতির কথা বলছেন যা পরিপূর্ণ নয়। আকস্মিক কোন অনুভূতি, অসম্পূর্ণ কোন অনুভূতি নিয়ে কখনোই জয় আসে না। আংশিক বা অসম্পূর্ণ বা দ্বিধা বিভক্ত চিন্তা হ্যামলেটের সেই ‘টু অর নট টু বি’ পরিস্থিতিই তৈরি করেন।
৪. নিজের কথা লঘুভাবে ভাবো আর জগতের কথা গভীরভাবে।
আমরা নিজেকেই নিয়ে মত্ত। সব সময় ‘আমাকে’ নিয়েই ভাবছি আমি। নেহাত একটা মোবাইল ফোন কিংবা সোস্যাল মিডিয়াতেও সারাক্ষণ আমি কে, আমি কি প্রচারে ব্যস্ত আমরা। জগতের কথা যদি একটু ভাবি তবে কিন্তু আমাদের জীবনও আরো অর্থবহ হবে।
৫ পুরো জীবন ধরে কামনা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকো।
কামনা-বাসনার মধ্যে থাকাই এই বস্তুগত সভ্যতার মূল মন্ত্র। কিন্তু মানুষের কামনা-বাসনা কোনদিন ফুরায় না। একটা গাড়ি হলে দুটো গাড়ি চায়, দুটো বাড়ি হলে পাঁচটা বাড়ি চায়। চাওয়ার কোন শেষ হয় না। অথচ কামনা-বাসনার তাড়া থেকে আমরা মুক্ত হতে পারলে বহু কাঙ্খিত শান্তিই পেতে পারি।
৬. যা করেছেন তা নিয়ে অনুশোচনা করবে না।
অনুশোচনা, অনুশোচনা একটা বিষাক্ত ব্যাপার। গতস্য শোচনা নাস্তি। যা ঘটেছে তা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। কাজেই আফসোস, অনুতাপ না-করে এগিয়ে যাওয়াই ভালো।
৭. কখনো ঈর্ষান্বিত হয়ো না।
প্রত্যেকের জীবন, প্রত্যেকের চলার পথ আলাদা। কাজেই একজনের সাফল্য কিংবা উন্নতি দেখে ঈর্ষান্বিত হওয়ার কিছু নেই। নিজের লক্ষ্যে, নিজের পথে এগিয়ে যাওয়াই আসল। তুলনা করতে গেলেই ঈর্ষা নামের পোকা আপনাকে ওথেলো’র মতো ট্র্যাজিডিতে নিয়ে ফেলবে।
৮. কোন বিচ্ছেদে বিষাদাক্রান্ত হবেন না।
সাধারণ মানুষের জন্য এটা মানা কঠিন। তবে একজন যোদ্ধা আসলে কখনোই কোন বিচ্ছেদে কাতর হয় না। ভুলে গেলে চলবে না, মুসাচি ছিলেন একজন পরিব্রাজক যোদ্ধা। একস্থানে থেকে নিত্য অন্য স্থানে যেতেন। কাজেই ‘যেতে নাহি দিব’ ক্রন্দন শোনার সময় তার ছিলো না। অন্যদিকে কোন সম্পর্ক, কোন মিলনই অন্তহীন নয়। তবে আজকের দিনে এটা আমাদের পক্ষে মেনে নেয়া কঠিন। আমরা পরিবার-পরিজন নিয়ে বাঁচি। তবু যদি কেউ হারিয়ে যায়, চেষ্টাটা করতেই হবে বিষাদ থেকে ওঠে আসতে। বিষাদ তো কখনোই সমাধান নয়।
৯. অসন্তোষ আর অভিযোগ নিজের জন্য বা অন্যের জন্যও ঠিক নয়।
কোন বিষয়ে বা ব্যক্তির উপর অসন্তোষ আর অভিযোগ কখনোই কোন সুফল বয়ে আনে না। আপনার আমার অভিযোগ আর অসন্তোষ শোনার বা দেখার সময় জগতের কারো নেই। আর আমাদের অভিযোগ-অসন্তোষ দিয়ে জগতের কোন উপকারই হবে না।
১০. কামনা বা প্রেম দ্বারা নিজেকে পরিচালিত হতে দিও না।
এই বক্তব্যের অর্ধেকটা আজকের দিনে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জন্য প্রযোজ্য, বাকী অর্ধেকটা নয়। শুরুতে বলি প্রযোজ্য অংশের কথা। প্রেম অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং বড় জিনিস। যদিও কেবল প্রেমে ভেসে গেলে হবে না, তবু প্রেম বড় দরকারী। আমাদের জন্য দরকারী হলেও যুদ্ধের ময়দানে নয়। আর কামনা, যুদ্ধের ময়দানে বা আমার সাধারণ জীবনেও অদরকারী। বলার দরকার যে, মুসাচি কামনা বলতে এখানে যৌন আকাঙ্খাকেই বুঝিয়েছেন। যৌন তাড়না কোন যুদ্ধেই জয়ের বিষয় হতে পারে না।
১১. সকল বিষয়ে বাছার সুযোগ নেই।
এটা তো জানা কথাই জীবন আমাদের কাছে কোন রেঁস্তোরা না, এখানে কোন ওয়েটার বা বেয়াড়া মেন্যু কার্ড নিয়ে সামনে আসে না। কাজেই চাইলেই আমাদের পছন্দ মতো চাহিদা এখানে সকল ক্ষেত্রে পূরণ করতে পারবো না। কাজেই মনটাকে খোলা রাখতে হবে। সবসময় বাছ-বিচার করা যাবে না। নতুনকে গ্রহণ করতে হবে, ক্ষেত্রবিশেষে যা পাওয়া যায় তাকেই বেছে নিতে হবে।

আরো পড়ুন: সময়ের ডায়েরি: ইফতারি জার্নাল (পর্ব-৭)


১২. তুমি যেখানেই থাকো সেখানটা সম্পর্কে নির্বিকার থাকো।
আপনি কোথায় থাকেন তারচেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হলো আপনি কিভাবে বাঁচেন। আমরা প্রায়শই অভিযোগ করি, এই গ্রামে নয়, শহরে জন্মালে সুযোগ বেশি পেতা, এই দেশে নয়, বিদেশে জন্মালে ভালো হতো। কোথায় থাকছি তা নিয়ে বরং উদাসীন, নির্বিকার হওয়া ভালো। বরং কীভাবে বাঁচছি, কী করছি সেদিকেই মনোযোগ দেয়া দরকার।
১৩. খাবারের স্বাদের পেছনে ঘুরবে না।
এটা এ সময়ের জন্য দারূণভাবে প্রাসঙ্গিক। আমরা এখন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জাঙ্ক ফুড, ফাস্ট ফুড খাই। জিভ বা রসনার দিকেই আমাদের যতো মনোযোগ। অথচন খাবার গ্রহণ করা উচিত খাদ্য মান, পুষ্টিগুণ ইত্যাদি বিবেচনা করেই।
১৪. দরকার নেই এমন জিনিস জমিয়ে রাখবে না।
আমাদের আজকের জীবন বাহুল্যময়। প্রচুর অপ্রয়োজনীয় সম্পদ আর সম্পত্তি পেছনে আমরা দৌঁড়াই। অনেক সময় ভেবেও দেখি না, এটা আদৌ আমার দরকার আছে কি না। যতো কম বোঝা ততো হাল্কা জীবন।
১৫. গতানুগতিক বিশ্বাসে চলবে না।
জগতের সকল লোকই নিজের মতো করে ভেবেছে, নিজের পথ খুঁজে নিয়েছে। প্রচলিত ধ্যান-ধারণা দিয়ে নতুন লড়াই জেতা যায় না।
১৬. প্রয়োজনের বাইরে কোন অস্ত্র জমিয়ো না, সেগুলোকে ব্যবহারও করো না।
এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ। লক্ষণীয় যে মুসাচি’র মতো একজন যোদ্ধা যিনি কোন যুদ্ধেই পরাজিত হয়নি, তিনি আমাদের জানাচ্ছেন, বাড়তি অস্ত্র রাখার দরকার নেই। এখন অস্ত বলতে কি আমরা কেবল তরবারি আর গোলা-বন্দুক বুঝি? কোন যুদ্ধে প্রয়োজনের অতিরিক্ত অস্ত্র ব্যবহার কি সমীচিন?
১৭. মৃত্যুকে ভয় পেয়ো না।
খুব প্রয়োজনীয় কথা। কিন্তু আমরা মানতে পারি না। সাধারণ মানুষ মৃত্যু ভয়ে তটস্থ থাকে। যোদ্ধাকে মৃত্যু ভয় নিয়ে থাকলে হয় না। মৃত্যু অনিবার্য। তার মানে অবশ্য এই নয় যে আমরা মরণের দিকে ঝাঁপ দিবো, কিন্তু সদাই মরার ভয়ে কাতর থাকবো সেটা তো নয়!
১৮. বৃদ্ধকালের জন্য জায়গা-জমি, সম্পত্তি জমিয়ে রেখো না।
আমি এই সূত্রটির ব্যাখায় শুধু একটা প্রশ্ন করছি : আচ্ছা, কে নিশ্চিত? বৃদ্ধকাল পর্যন্ত বাঁচবে?
১৯. বুদ্ধকে শ্রদ্ধা করো আর দেবতাদের, তবে তাদের সাহায্যের আশা নয়।
এটা আমাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। মানে মুসলিম কিংবা খ্রিস্টান কিংবা সনাতনের ক্ষেত্রেও। আল্লাহ, ঈশ^র, ভগবানের উপর আমরা শ্রদ্ধা রাখবো। শ্রদ্ধা রাখবো তার প্রেরিত পুরুষের উপর। কিন্তু এমন ভাবার কোন কারণ নেই যে তারা সরাসরি আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসবেন। আমাদেরকে নিজের কাজটুকু নিজেরই করতে হবে। আস্থা আর বিশ^াস অটুট রেখেই এগিয়ে যেতে হবে। ‘আল্লার মাল আল্লাই দেখবো’ এমন ভাবার মধ্যে প্রাপ্তমনস্কতা নেই বোধহয়। বিধাতার উপর ভরসার করে নিজের কাজে ফাঁকি দিলে হবে না।
২০. তুমি হয়তো দেহ ছেড়ে যাবে কিন্তু অবশ্যই নিজের সম্মান রাখবে।
জাপানী সামুরাই নিজের সম্মানের জন্য প্রাণ দিতেও কুণ্ঠা বোধ করতো না। মানুষ মরণশীল, আমরা কেউই থাকবো না। কিন্তু জীবিতকালে যেটুকু সম্মান আমরা অর্জন করবো তা ক্রমশই বর্ধিত হবে। সম্মান হলো আসল বংশধর, সেটাই অবশিষ্ট থাকবে।
২১. কখনো পথ থেকে চ্যুত হয়ো না।
চড়াই-উৎরাই থাকবে, বাধা-বিপত্তি আসবে, কিন্তু আমাদের কখনোই উচিত হবে না তার কারণে নিজের পথ থেকে সরে দাঁড়ানো। পথভ্রষ্টের সহানুভূতি থাকতে পারে, কিন্ত কোন প্রাপ্তি থাকে না।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত