চোখ মেলে গতরাতের ঘুমটাকে বিদায় জানিয়ে বিছানায় শুয়েই আমিনা জানালা দিয়ে আকাশটাকে দেখতে লাগল। বলা ভালো সেই দিকেই হঠাৎ করে তার চোখ আটকে গেলো। কি পরিষ্কার, সুনীল আকাশ! গাঢ নীল রঙ্গের প্যাস্টেলের মতো।সেদিন স্কুলে ড্রয়িং ক্লাসে যেমন এঁকেছিল তেমন! তার ওপর তুলো তুলো মেঘগুলো কেমন ভাসছে, যেন মনে হচ্ছে নীল বেডকভারে কয়েকগাছা তুলো কেউ ছড়িয়ে দিয়েছে।
আমিনা ভেবে পায় না মেঘ থেকেই কি তুলো হয়, নাকি তুলোগুলোই পেঁজা পেঁজা হয়ে উড়ে গিয়ে আকাশে মেঘ হয়ে জমাট বাঁধে।
সে চোখ রগড়ে মশারি ডিঙ্গিয়ে উঠে পড়ে।অন্যদিন হলে মায়ের ধ্যাতানি খেতে হতো। আজ সে নিজে থেকেই উঠে বসেছে। তার কারণ, আজ স্কুলে ছুটি পড়ছে। পুজোর ছুটি। পরশু বুধবারই মহালয়া গেছে। আসছে মঙ্গলবারই মহাসপ্তমী।
ভাবতেই বুকটা কেমন দুরুদুরু করে উঠল। তার মানে আর পাঁচদিন পড়েই…।
মায়ের হাঁকটা একবার কানে পৌঁছাল, তবে সেদিকে হুঁশ নেই। সে তখন বাড়ির সামনের ডালপালার ওপর রোদের সোনালী আস্তরণ দেখতেই ব্যস্ত। তাদের উল্টো দিকে ফুলজান চাচীদের শিউলি গাছ তলায় একরাশ মনি মুক্তোর মতে ছড়িয়ে আছে আর সেই ফুলগুলোর জোড়াল গন্ধ তাকে যেন হাতছানি দিচ্ছে, “এসো আমিনা, আমাদের তোলো।” আমিনারও বারবার ইচ্ছে করছিল ছুটে গিয়ে তার শিউলি ফুলের মতো নরম এবং শিউলি পাপড়ির মতো নরম হাতদুটো দিয়ে ফুলগুলোকে জড়ো করে তুলতে। গাছটা ঝাকা দিলেই তো ফুলের বৃষ্টি হবে সে জানে, কিন্তু শিউলির গাছে খুবই শুঁয়োপোকা থাকে, একবার হাতে রোঁয়া লেগে গেলে আর দেখতে হবে না। আমিনা ভাবে, এই শিউলি ফুলের রস খেয়েই বুঝি শুঁয়োপোকারা প্রজাপতিতে পরিণত হয়! আর জানে, শিউলি আর পদ্ম ছাড়া দুর্গাপুজো অসম্পূর্ণ। তাঁর সাথে সাথে এও আমিনা জানে, এই দুর্গাপুজো নিয়ে মায়ের তেমন কোন উৎসাহ নেই। বলে, দুর্গাপুজো নাকি তাদের উৎসব না । তাদের ধর্ম আলাদা। মায়ের সাথে সাথে আমিনার দিদি ও দাদাও তাই বলে। কিন্তু বাবা বলে না। বাবার কথা অনুযায়ী “উৎসব কারোর জন্য আলাদা হয়ে না। মনে আনন্দ থাকলেই উৎসব।”
সত্যি তো! এই যে পুজো আসছে, আসছে ভাব, চারপাশে সবার মধ্যে উত্তেজনা, স্কুলে লম্বা ছুটি। বন্ধুদের মধ্যে এতো কথাবার্তা এসবের থেকে কি করে সে নিজেকে আলাদা রাখবে?
কিন্তু না- তাকে আলাদা থাকতে হবে যে!
শুধু তাকেই নয়, তাদের গোটা পাড়াটাই কেমন দুর্গাপুজোর ব্যপারে উদাসীন। যেন এটা এমন কিছু ব্যপার নয়, বা তাদের ভাবনা-চিন্তার বাইরের ব্যাপার, অতো মাথা না ঘামালেও চলবে।
ছোট্ট আমিনার মনে হাজার প্রশ্নের পশরা কিন্তু কেউ সে প্রশ্নের জবাব দিতে প্রস্তুত নয়। দাদা সামসুদ্দিন বলে,
“ তুই এখন ও ছোট আছিস বোন, তুই এসব কিছু বুঝবি না! বড়দের কথা শুনে চ’!”
আমিনা ছাড়ে না, “তাহলে দুর্গাপুজো কি আমাদের না?”
সামসুদ্দিন বলে, “দূর পাগলি, তাই আবার হয় নাকি! আলাদা জনের আলাদা পুজো! দুর্গা, কালী, শিব-এনারা সব হিন্দুদের। আমাদের তো আল্লাহতালাহ্ !”
আমিনা প্রায় তেড়ে ওঠে, “ধ্যাত, এমন আবার হয় নাকি?”
সামসুদ্দিন কঠিনভাবে জবাব দেয়, “এমনটাই হয়, এটাই নিয়ম।”
পাল্টা প্রশ্ন আমিনার, “কে বানিয়েছে এমন নিয়ম?”
সামসুদ্দিন থতমত খেয়ে যায়। বলে, “সে আমি কি জানি, নিয়ম তাই নিয়ম। আম্মা–আব্বা মেনে এসছে। তাঁদের আম্মা–আব্বারাও মেনে এসছে তাই আমাদেরও মানতে হবে। তুই নিয়ম না মানার কে? তুই বোকা আছিস, বাচ্চা আছিস- তুই বুঝবি না।”
আমিনা দমে যায় না, আগের মতোই তেড়ে ওঠে, “আমি বোকা আছি না রে! তাই তো ক্লাসে ফার্স্ট হই, তুই বেশি চালাক বলেই তো এইটে উঠতেই দুবার ফেল করলি!”
সামসুদ্দিন অপ্রস্তুতে পড়ে যায় বোনের কথা শুনে। কোন রাখঢাক নেই মেয়েটার, মুখে কিছু আটকায় না! সেও পালটা বলে, “রাখ– রাখ! বেশি পড়াশুনা জানলেই কি চালাক হওয়া যায় নাকি! একে তুই মেয়েমানুষ, তার ওপর দুনিয়ার কোন খবর রাখিস না! জানিস মেয়েরা বেশি পড়লে পাগল হয়ে যায়!” বলে মুখ বেঁকিয়ে বোনকে ভেঙ্গায়।
আমিনাও পালটা ভ্যাঙ্গানি দিয়ে বলে, “তুই তো পড়াশুনো না করেই পাগল হয়ে গেছিস, তাই উলটোপালটা বকছিস।”
সামসুদ্দিনের মুখ থেকে হাসি মিলিয়ে যায়।একটা থমথমে, অন্ধকার ভাব এসে যায়। সে বলে “না রে আমিনা, সময় এখন আগের মতো নেই। মানুষজন সব কেমন বদলে যাচ্ছে! দেখিস না, আগে শ্যাম কাকা, হরি কাকা কেউ আমাদের আগের মতো ভালোবাসে না। কাকিমারাও এখন মায়ের সাথে কথা বলে না। সবাই আমাদের আলাদা ভাবতে শুরু করে দিয়েছে। কেউ আমাদের আর ভালো বাসে না রে, উলটে দু’-চারটে কথা শুনিয়ে দেয়।”
আমিনার বুক জুড়ে তখন অবাক হবার ঢেউ, সে বলে, “কেন, আমরা পাশাপাশিই তো থাকি, আলাদা ভাববে কেন?”
সামসুদ্দিন গম্ভীর হয়ে জবাব দেয়, “তা আমি কি করে জানব কেন ভাবে? বলছি তো, তুই ছোট আছিস, তাই বাইরের খবর তোর কাছে পৌছায় না। তুই কি জানিস, আমাদের গ্রামে কয়েকদিন আগে একটা বড় দাঙ্গা হয়ে গেছে হিন্দু- মুসলিমদের মধ্যে? রামনবমীর দিন হয়েছে ব্যপারটা। আমাদের সেদিন মহরম ছিল। দুজন দুদিক দিয়ে মিছিল বের করেছিল, পুবপাড়ার রাস্তায় দুজন একসাথে আসার পরই ঝামেলা বাঁধে, তারপরই শুরু হয় মারামারি। আমাদের মইন জেঠার ছেলে আব্বাসভাই সেদিন মারপিট করতে গিয়ে কাকে ছুড়ি মারে, যাকে মেরেছিল তাকে হাসপাতালে ভর্তি করলেও সে বাঁচেনি। তুই তো ছোট, তাই তোকে এসব বলা বারণ। তাও বলছি, সে সময় পুলিশ এসে গেছিল বলে আর বেশি ঝামেলা হয়নি, নইলে আর অনেক লোক মারা যেতে পারতো! আব্বাসভাই যেমন একটা হিন্দুর ছেলেকে ছুড়ি মেরেছে, তেমনই আমাদের বক্তিয়ারভাই, জামশেদ ভাইদেরও মাথা ফেটেছে। আমি বুঝে পাইনা, কেন এতো মারামারি হল, বড়রা কি ভুলে যায় যে হিন্দু-মুসলমান দুজনেই মানুষ! যাই হোক, সেদিনের পর থেকে নাকি পঞ্চায়েতে ঠিক করা হয়, মুসলমান পাড়ার সঙ্গে হিন্দু পাড়া কথা বলবে না। আমরাও ওদের কোন পরবে যোগ দিতে পারব না। ওরা হিন্দু, দলে ভারী, তাই ওদের কথাও কেউ ফেলতে পারেনি! আব্বা, ওয়াসিম কাকাও তো সেখানে ছিল।তারা মুসলমান পাড়ার হয়ে সবার কাছে ক্ষমাও চেয়েছিল, কিন্তু ওরা কেউ শোনেনি।উলটে তাঁদেরকে যা নয় বলে অপমান করেছে। ওরা আমাদের একঘরে করে দিয়েছে বোন। তুই ছোট তো, তাই তোকে বলা বারণ! দেখছিস না, বাজারে আগে মনিরুদ্দিন চাচার খাসির দোকানে লোক ভেঙ্গে পড়ত। ভিড়ে কোথাও জায়গা ছিল না। এখন চাচার দোকান ফাঁকা পড়ে থাকে, ব্যবসাও মার খাচ্ছে। মোতালাফ চাচা এবার পুজোতে একটা কাপড়েরও অর্ডার পায়নি তাঁদের অবস্থা ভাব।”
আমিনার সরল মনে এসব কথা তোলপাড় করে। সে অনেককিছু ভাবার চেষ্টা করে কিন্তু মনের মধ্যে কোন কথা ভেসে ওঠে না। এতদিন একটা নিয়মের মধ্যে বড় হয়েছে, এখন তার বিচ্যুতি ঘটলে অবাক তো হবেই।
সামসুদ্দিন আবারও বলে, “শুধু আমাদের পাড়াতেই নয় রে, গোটা দেশেই নাকি এমনটা চলছে। কেউ আমাদেরকে ভালোবাসছে না, মুসলমান হওয়াটা যেন আমাদের পাপ হয়েছে।”
খানিকক্ষণ থেমে থাকার পর সে বলে ওঠে,” তবে বাবা যে বলে, হিন্দু–মুসলমান ভাই-ভাই?”
সামসুদ্দিন বলে, “সে তো আমিও ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, স্কুলেও তাই পড়নো হয়। কিন্তু সবাই তা মানে না। উল্টে ভাইয়ে–ভাইয়ে বিবাদ করে। এ ওকে মারে, ও তাকে কাটে।”
শিশু আমিনার মনে এতো সব কথা জট পাকিয়ে যায়। সে ব্যপারটার গুরুত্ব বোঝার চেষ্টা করে।
“তাই আমি বলছি , এইসব দুর্গাপুজো–টুজো নিয়ে মাতামাতি করিস না। আমাদের যখন বারণ করেছে, তখন আমরাই বা মানব কেন?”
দাদার কথাগুলো মনে আসতেই চারপাশের আন্নদোচ্ছল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যয়ও কেমন ম্লান হয়ে গেলো। তার মানে দুর্গাপুজো কি ওর আনন্দের বিষয় নয়? কে কি নিয়ে খুশি থাকবে, তা নিয়েও নিয়ম আছে? ভারি আশ্চর্য লাগে আমিনার। দুর্গাপুজো, কালিপুজো তাদের জন্য নয়। আমিনাদের জন্য শুধু ঈদ, মহরম এইসব। তাই যদি হয় তাহলে প্রত্যেক ঈদে হরিকাকা, শ্যাম কাকাদের বাড়িতে ডেকে খাওয়ায় কেন বাবা–মা! যেমনটা মনিরুল, ইরফান চাচাদের খাওয়ায়?
এই কথাগুলো মনের মধ্যে আন্দোলিত হতে থাকে। তখনই মায়ের হাঁক শোনা যায়, “আমিনা, এখনও মুখ ধোঁয়া হয়নি। স্কুলে যাবি না নাকি?”
[ ২ ]
আজ শেষদিন বলে কোন ক্লাস হল না। সবাই নিজেদের মধ্যে আড্ডা মেরে কাটালো। কার ক’খানা জামা হয়েছে, কে কলকাতায় ঠাকুর দেখতে যাবে এইসব।
আমিনা যেন এই আনন্দ মুহূর্তের সঙ্গে নিজেকে জড়াতে চাইছিল না। সকালের কথাগুলো ঘুরে-ফিরে আসছিল। যেন এই আনন্দে ভাগ নেওয়া তার অপরাধ। ইচ্ছে হলেও মনের মধ্যে দাবিয়ে রাখতে হবে।
স্কুলেও আজ তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেলো। ছুটির পর তিন বন্ধু আমিনা, স্বরলিপি আর ঋতিকা মিলে সোজা পথে না গিয়ে জেলেপাড়ার রাস্তা দিয়ে ফিরছিল। সে পথে সোজা হাঁটলেই রায়চৌধুরীদের চণ্ডীমণ্ডপ পড়বে। গ্রামের সবথেকে বড় পুজা হয় এই চণ্ডীমণ্ডপে। এককালে জমিদার ছিলেন রায়চৌধুরীরা। চণ্ডীমণ্ডপেই ঠাকুর তৈরি হয় প্রতিবছর। সেটা নিয়ে গ্রামের বাচ্চা-কাচ্চারা বেশ উৎসাহিত থাকে। আজও তেমনই যাচ্ছে তারা।
তারা গিয়ে দেখে, প্রতিমার গায়ে রং পড়ে গেছে, তবে ইঁদুর আর ময়ূরে কয়েক পোঁচ বাকি। এবারের ঠাকুর গতবারের থেকে কয়েকফুট বড় হয়েছে।
“অসুরটা কিন্তু আগের বারের চেয়ে রোগা!” ঋতিকা মুখ টিপে হেসে বলে।
“ডায়েটিং করছে। নয় পেটে প্রবলেম হয়েছে তোর মতো!” স্বরলিপি হেসে জবাব দেয়। তিনবন্ধুর মধ্যে হাসির রোল ওঠে।
ঋতিকা আবার বলে, “জানিস, ইন্দ্রাণীকে এবার কুমারী মা বানাবে রায়দিদারা। প্রত্যেকবারই তো ওদের বাড়িতে কুমারী পুজো হয়, আবার ওরা ইন্দ্রাণীকে বেছেছে। ইশ্, ইন্দ্রাণী কি লাকি বলত, সবাই ওকে পুজো করবে, কত্ত গিফট পাবে।”
স্বরলিপি বলে, “হ্যাঁ রে, সেই কোন ছোট্টবেলায় আমি একবার হয়েছিলেম। ঠিক মনে নেই, কিন্তু অনেক গিফট পেয়েছিলাম জানিস?”
ঋতিকা আপসোস করে বলে, “ইস, খালি আমারই হওয়া হল না! ধুর, ভাল্লাগে না।”
কুমারীপুজো নিয়ে আমিনার মনেও একটা লুকনো বাসনা আছে। যে রায়চৌধুরীদের চণ্ডীমণ্ডপের সামনে তারা দাঁড়িয়ে কথা বলছে, তারাই প্রতি পুজোর অষ্টমীর দিন কুমারী পুজো হয়। বাচ্চা মেয়েকে দেবী দুর্গা রূপে পুজো করা হয়। আমিনার কাছে সেটা ভারী রোমাঞ্চকর ব্যপার। যারা কুমারী পুজো করে, সেই রায়বাড়ি প্রত্যেক বছর তাদের গ্রাম থেকেই ছোট-ছোট মেয়ে বাছাই করে কুমারী মা সাজায়। এই আমিনা, ঋতিকাদের বয়সী মেয়ে বা তার থেকেও ছোট। আমিনা দু’একবার সেই পুজো রায়বাড়িতে হতে দেখেছে। সে জানে, যে বাচ্চা সে বছর কুমারী মা হয়, তার ভাগ্য খুলে যায়। পুজোতে সেই মেয়ে এতো উপহার, দানসামগ্রী পায় যে কুলিয়ে ওঠা যায় না। আমিনারও অনেক দিনের ইচ্ছে, যদি রায়চৌধুরীরা তাকে কোনবার কুমারী মা সাজায়, তাহলে কতো উপহারই না সে পাবে।
“কিরে আমিনা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি ভাবছিস?” ঋতিকা প্রশ্ন করে ওঠে। তার প্রশ্নে হুশ ফেরে আমিনার।
“এবার পুজোয় আমাদের সঙ্গে বেরুবি তো আমিনা?” স্বরলিপি হঠাৎই প্রশ্ন করে। তাতে কি জবাব দেবে তা ভেবে পায় না আমিনা। সে বুঝে পায়না, তার কি আদৌ বেরুনো উচিত?
“বাবা বলেছে আমাদের তিনজনকে একদিন কলকাতায় ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যাবে। কি মজাটাই না হবে!” স্বরলিপি উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে।
“এই- তাড়াতাড়ি কর। আমার আবার ছটা থেকে টিউশন আছে। পুজোর আগে লাস্ট টিউশন। না গেলে মা বকবে!” ঋতিকা মাঝখান থেকে বলে ওঠে।
“উফ! এই পুজোর আগে পড়তে ভালো লাগে! “বিরক্ত হয়ে স্বরলিপি বলে, “চ’ যাবার আগে ঠাকুরটাকে ভালো করে দেখে নি !”
বাকি দুজন চণ্ডীমণ্ডপের ভেতরে ঢুকে পড়ে। যায়না শুধু আমিনা। তার মনে হয় ওরা যা করতে চলেছে তা ওর করা উচিত নয়। কিসে যেন আটকায় ওকে।
“কি হল আমিনা, কি ভাবছিস?” স্বরলিপি প্রশ্ন ছোঁড়ে।
“তোরা যা, আমি যাবো না।” আমিনা সন্ত্রস্ত হয়ে জবাব দেয়।
“পাগলের মতো কথা বলিস না। আয় তো! বলে সে আমিনার হাত ধরে তাকে চণ্ডীমণ্ডপের ভেতরে নিয়া আসে। আমিনার পা আটকে যায়। এক অজানা আশঙ্কায় তার শরীর-মন দুই কেঁপে ওঠে। স্বরলিপি আর ঋতিকা দুজন ছুটে প্রতিমার সামনে চলে যায়। কর্মরত মৃৎশিল্পীরা ওদের দিকে বিরক্তভাবে তাকায়। কাজের সময় বাচ্চারা এসে বিরক্ত করবে এটা তারা মোটেই চায় না। আমিনা একদৃষ্টিতে প্রতিমার দিকে তাকায়-রং লেগেছে, চক্ষুদান হয়নি, তাই কেমন ফ্যাঁকাসে পাণ্ডুর লাগছে।
“কি ব্যাপার তোমরা এখানে কি করছ?” প্রধান শিল্পী মহাদেব পাল বলে ওঠে।
“ঠাকুর বানানো দেখতে এসছি।” ঋতিকা জবাব দেয়।
মহাদেব গম্ভীর হয়ে বলে, “ঠাকুর বানানো এখনও বাকি। তোমরা এখন এসো আমাদের কাজ করতে দাও।”
“আরে, একটু দেখেই তো চলে যাবো।” স্বরলিপি বলে, তারপর আমিনার দিকে তাকিয়ে বলে, “কিরে , এদিকে আয়!”
মহাদেবের দৃষ্টি আমিনার দিকে পড়ে, বলে- “ও ইউসুফের মেয়ে না, ও এখানে কেন?”
আমিনা প্রমাদ গোনে, স্বরলিপি বলে , “ও তো আমাদের সঙ্গেই এসেছে, একসাথে ঠাকুর দেখে চলে যাবো।”
মহাদেব রেগে গিয়ে বলে, “দেখাচ্ছি তোমায় ঠাকুর!” তারপর আমিনার সামনে গিয়ে বলে, “ব্যাটা মোল্লার জাত, খুব শখ হয়েছে ঠাকুর দেখার! বাজারে যখন ঝামেলা করিস, তখন মনে থাকে না!”
আমিনা ভয়ে এতোটুকু হয়ে যায়। সে মুখ দিয়ে অস্ফুটে কয়েকটা শব্দ বের করে।তক্ষুনি সজরে একটা চড় নেমে আসে ওর গালে। সে মাটিতে পড়ে যায়। চারিদিকে অন্ধকার দেখে সে। দু চোখ ছলছল করে ওঠে।
“কি হল, ওকে মারলে কেন? ও কি করেছে? “স্বরলিপি চিৎকার করে ওঠে।
“চুপ, আবার জানতে চাওয়া হচ্ছে কি করেছে? “গোটা চণ্ডীমণ্ডপ কাঁপিয়ে মহাদেব বলে ওঠে, “ব্যাটা মুসলমান! কোন সাহসে মায়ের জায়গা অপবিত্র করতে এসেছিস?খবরটা একবার যদি বড়কর্তার কানে পৌঁছায়!
“তার আর দরকার হবে না,” সবাইকে অবাক করে দিয়ে চণ্ডীমণ্ডপের পেছন দিয়ে মন্থরগতিতে চৌধুরীদের কর্তা এসে হাজির। অশতীপর হয়েও এখনও ঋজু, সমর্থ শরীর। তিনি আসতেই মহাদেব অনুগত ভৃত্যর মতো নমস্কার ঠুকল।
কর্তা একবার মাটিতে পড়ে থাকা আমিনার দিকে তাকালেন। সেই দৃষ্টি আমিনার ভেতরটা শুকিয়ে দিলেও সে বুঝতে পারে, এই দৃষ্টিকে ভরসা করা যায়। কর্তা তারপর মহাদেবকে জিজ্ঞেস করেন, “ওইটুকু মেয়েটাকে মারলে কেন?”
মহাদেব তেড়ে উঠে বলে “কর্তা, ও কিনা একটা মুসলমানের মেয়ে! কোন সাহসে ও আপনার চণ্ডীমণ্ডপে ওঠে! বলে কিনা ঠাকুর দেখতে এসছি- কি আস্পর্ধা ভাবুন!”
“তো! আমি কি কাউকে দেখতে বারণ করেছি?” চৌধুরীমশাই নির্লিপ্ত গলাতে জবাব দিলেন।
“কি বলছেন?” মহাদেবের যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। মুসলমানের মেয়ে হয়ে হিন্দুদেবীর স্থানে ঢুকবে? যারা কথায়-কথায় আমাদের ছেলেদের পেটে ছুড়ি মারবে, তাঁদের ঘরের মেয়েদের দুর্গামূর্তির সামনে আসতে দেবো? এতে আমার পাপ হবে না!”
“আর তুমি সেই দুর্গামূর্তিরই সামনে ঈশ্বরের অংশ একটি শিশুকে মারলে সেটা বুঝি খুব পূণ্যের কাজ হল!” বজ্রগম্ভীর গলাতে চৌধুরীমশাই বলে উঠলেন। “যে মেয়ের মধ্যে স্বয়ং মা রয়েছেন তাকে অবহেলা করে তুমি মায়ের প্রতি ভক্তি দেখাতে চাও? আর একজন কি করল বলে গোটা জাতটাকে দুষবে তুমি?”
মহাদেবের মুখে কথা আটকে গেলো। সে কর্তার দিকে চেয়ে রইল শুধু!
“তুমি আজই তোমার টাকা নিয়ে চলে যেও। মূর্তির কাজ তো প্রায় শেষ- বাকি যেটুকু আছে সেটা অন্য শিল্পী দিয়ে করিয়ে নেবো। আমি চাইনা, যে হাতে তুমি মেয়েটাকে মেরেছো, সেই অপবিত্র হাত মায়ের গায়ে পড়ুক।”
মহাদেব চৌধুরীকর্তার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ভয়ে-ভয়ে বলল, “মুশকিলে পরে যাবেন কর্তা! আপনি জানেন, গোটা গ্রাম ওদের ওপর কেমন ক্ষেপে রয়েছে। তারা যখন শুনবে, আপনি একটা মুসলমান মেয়েকে চণ্ডীমণ্ডপে তুলেছেন, তখন?
কর্তা বললেন, “কে কি বলবে সেটা আমাকেই বুঝে নিতে দাও মহাদেব। আমিও দেখি, কার এতো বুকের পাটা যে রায়চৌধুরীদের ওপর কথা বলে। জেনে রেখো, সবাই আমরা মায়ের সন্তান। হিন্দু-মুসলিম আলাদা কিছু না।” তারপর আমিনার দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই মেয়েকে নিয়েই এবার কুমারী পুজো করব, এটাই আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। দেখি গ্রামের কোন মাতব্বর আছে আমার ওপর কথা বলে। কি রে মেয়ে, রাজী তো?”
আমিনার মুখে হাসির ঝিলিক দেখা যায়। সে চৌধুরীমশাইয়ের বিশাল আকৃতি দুচোখ দিয়ে ধরবার চেষ্টা করে। তারপরই সে তাকায় প্রতিমার দিকে। আশ্চর্যভাবে মূর্তির তিনটে চোখই তখন প্রকট হয়ে ওঠে , মায়ের গা সেজে ওঠে নানা রকমের অলঙ্কারে। চারপাশে সে শুনতে পায় ঢাকের বাদ্যি আর উলুর শব্দ …।
জন্মস্থান : আগরপাড়া, উত্তর চব্বিশ পরগনা, পশ্চিমবঙ্গ। পেশা : গবেষণা। কৈশর থেকে কবিতা লেখা শুরু, প্রথম কবিতা প্রকাশ স্কুল ম্যাগাজিনে,প্রথম গল্প প্রকাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্ত্রিকায়। প্রথম শারদীয়ায় গল্প প্রকাশ “নবাঙ্কুর শারদীয়া সংখ্যা ২০১৫”তে । বিভিন্ন লিটিল ম্যাগাজিন ও বানিজ্যিক প্ত্রিকায় লেখা প্রকাশিত। লেখালিখির জন্য প্রাপ্য সম্মান- নবাঙ্কুর সেরা সাহিত্য সম্মান, ২০১৫, তাছাড়া ২০১৮ সালে আয়োজিত “স্ক্রিন সট ফেস্ট” এ “বেষ্ট কন্টেন্ট রাইটিং” প্রতিযোগিতায় সেরা দশ জনের মধ্যে জায়গা করে নেওয়া। শখ : বইপড়া, ঘোরাঘুরি, সিনেমা দেখা, খেলাধুলো।