রোদের তাপে ঘেমে ভিজে গেছে সাহেবালী। এক ফোঁটা ঘাম গিয়ে মাটিতে পড়তেই ভিজে বিন্দুটি মুহুর্তে মিলিয়ে যায়। ঘরের পেছনে মাঠের দিকে চোখ যায় তার। পুড়ে ফেটে গিয়ে নানা আকার ধারণ করেছে। পানি না হলে জমি চাষ করা যাবে না। জ্যৈষ্ঠ যায়। বৃষ্টির দেখা নেই।
মাথা নাড়াচ্ছে গরুটি। আর খড় নেই। অনেক কষ্টে কিছু খড় যোগাড় করেছিল সাহেবালী । বৃষ্টি নেই, ঘাসও শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে সবখানে। খড়ের মজুত আর কদিন থাকে। কষ্টের দিন এসে গেছে। গরুটিকে ভাল করে বাঁধে সে। গলা, পিঠ মোছে কোমর থেকে গামছা খুলে। হাটবার আজ। ঘরে কিছু লাউ আছে। বিক্রি করে চাল কিনতে হবে। নইলে রাতে উপোস।
উঠোন পেরোতে গিয়ে লাউয়ের ঝাঁকাটি ভাল করে লক্ষ করে। বাঁশের কঞ্চিগুলো এদিক ওদিক বেঁকে আছে। সবুজ চ্যাপটা পাতায় বাদামী ছোপ। বোঝা যায়, তার অনুপস্থিতে অযত্ন হয়েছে। দুদিনের জন্য সদরে গিয়েছিল সে। এক মামলার সাক্ষী হয়ে। কিন্তু বাড়ীতে নুরজাহান ছিল। কিছুটা বিরক্তি নিয়ে ডাক দেয়, অ নুরজাহান।
ঘর থেকে বেরিয়ে আসে নুরজাহান। স্বামীকে গাছ পরখ করতে দেখে বলে, ওডা কী দেখতিছেন, পানি খাতি না পারলে গাছ বাচে?
সাহেবালী তেতে ওঠে। ভেংচি কেটে বলে, গাছ বাচে? এটুকুন গাছের জন্যি কত গোষ্ঠির পানি লাগবি তোর আবাগীর বেটি?
স্বামীর কথায় নুরজাহানের মেজাজ চড়ে। বলে, খবরদার কচিচ, গাল দেবেন না, আমি একলা মানুষ কদ্দিক সামলাবো, এ্যা। পুকুর শুইকিয়ে গেলে পানি কোথায় পাবো, বলেন দিনি। বলি খাবার পানি পাচ্ছিনে তো গাছের পানি। খসে পড়া আঁচল এক ঝটকায় টেনে মাটি কাঁপিয়ে ঘরের পেছন চলে যায় সে। বাচ্চাটি কেঁদে কেঁদে উঠছে। নিশ্চয় আবার ক্ষিদে পেয়েছে।
সাহেবালী স্ত্রীর চলে যাওয়া দেখে। পায়ের কাছে মোরগটি অনেক্ষণ ধরে হেলেদুলে হাঁটছিল। অকারণে সেটিকে লাথি কষাল সে। হঠাৎ উপদ্রবে মোরগটি কঁকাতে কঁকাতে ডানা ঝাপটিয়ে ছুট দিল দিগি¦দিক।
ঘরের পেছনে তাদের শোবার জায়গা। সেটি লাগোয়া এক চিলতে ডোবার মতন একটি বড় গর্ত। এ ঘরটি তোলার সময় মাটি খোঁড়া হয়েছিল। বর্ষায়, কারণে অকারণে বৃষ্টিতে সেটির ভেতর পানি জমে। যদিও শীতের সময় তাতে পানি একদমই থাকে না। উপরন্তু এবার মৌসুমে বৃষ্টি হয়নি। ডোবা শুকোতে দেরি হয়নি। এতদিন কাজ চলেছে টিউবওয়েলের পানিতে। সেই পানি আবার আনতে হতো দুমাইল হেটে তহশীল অফিসের সামনে থেকে। সপ্তাহখানেক হলো সে টিউবওয়েলেরও মাথা চুরি গেছে।
ছেলেটা এখনো কেঁদে চলেছে। সাহেবালীর বিরক্তি বাড়ে। আজকের দিনটি ভাল যাবে না। আবার চেঁচিয়ে ডাকে, অ নুরজাহান, বলি ছাওয়ালডা এ্যাতো কাদে কেনে? মাই দিতে পারিস না?
ভেতরে নুরজাহান কিছু একটা করছে। সেটি করতে করতে খেঁকিয়ে ওঠে সে, পারব না। রাক্ষস একটা।’ তার গলায় রাত্রি জাগরণের ক্লান্তি।
সাহেবালী অবসন্ন বোধ করে। সে এতক্ষণ উঠোনে ছিল। এবার রোদ বাঁচিয়ে একটি জারুল গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। কপাল থেকে ঘাম সরাতে সরাতে তাকায় সামনে।
ঝাঁ ঝাঁ রোদ। গত মাঘের শেষে কিঞ্চিৎ বৃষ্টি হয়েছিল। সেই শেষ। এরপর ফাগুন চৈত্র, বোশেখ জ্যৈষ্ঠ- এখনো বৃষ্টির দেখা নেই। বোশেখের শুরুতে আকাশ দুএকবার চোখ গরম করলেও তেমন কিছু বর্ষণ হয়নি। ফলে বোরো ওঠার পর এখনো কেউ আমন রুইতে পারেনি। এদিকে ডিপ-এর পানির খরচাও বেড়ে গেছে। যাদের জমি আছে তারাও একটু রয়ে সয়ে জমির কাজে হাত দিতে চাচ্ছে। ফলে সাহেবালীর মতো অনেক কামলাই বসে আছে এখন। যদিও তার অবস্থা আগে এতো খারাপ ছিল না। নানা কারণে মহাজনের কাছে জমি বন্ধক দিয়ে সে জমি আর ছাড়াতে পারেনি সে। এখন সম্বল এ ভিটেটুকু। সেটিও হয়তো ভবিষ্যতের চোরাবালিতে একদিন হারিয়ে যাবে। ভাবতে ভাবতে তার বুকের পাশে কেমন চাপ অনুভব করে।
এ সময় বাড়ীর উত্তর দিক থেকে শিশুদের সম্মিলিত চিৎকার শোনা যায়। নানা কিছু ভাবতে ভাবতে যেন একটু ঝিমুনি মতো এসেছিল তার। বিরক্ত হয়ে উঠে সাহেবালী। তার ঘরের লাগোয়া ইদ্রিস আলীর ঘর।
ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে ইদ্রিস। জেলা সদরে এক বিস্কুট ফ্যাক্টরীর সুপারভাইজর। ফ্যাক্টরিতে বেতন ভাতা বাড়ানোর জন্য আন্দোলন হয়েছিল। মালিকের আবার ব্যাংকের দেনা। সেটি তখনো শোধ হয়নি নাকি হয়েছে তেমনটাই বলা হয়েছিল তাদের। কিন্তু হঠাৎ বিনা নোটিশে মালিক পক্ষ লে-অফের নোটিশ দিয়ে সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। কাজ হারিয়ে বাড়ীতে এসে ইদ্রিস বিয়ে করে বসে। এখন শ্বশুড়ের ঘাড়ে সব চাপিয়ে নিজে ধোয়া শার্টপ্যান্ট পরে বাজারে তাস পিটিয়ে সময় কাটায়।
ইদ্রিস এগিয়ে আসে। বলে, ও মেয়া ভাই, গুড়াগাড়াগুলান অত চেল্লাপাল্লা করে কেনে, বাড়িত কী মুরুব্বী নাই?
ইদ্রিসের দেখাদেখি সাহেবালীও এগোয়। তাদের কাছে আসতে বোঝা গেল ব্যাপারটি। আশপাশে ঝোপঝাড়। জমির সীমানার দিকে, গাছের ছায়ার নিচে ধানখেতে জায়গায় জায়গায় ইঁদুরের গর্ত। সেখান থেকেই সাপটি বেরিয়েছে। সাপের ফনার পেছনে এবং গলার কাছে কালো কালো ছোপ। জাত কেউটে। গর্তের কাছে গিয়ে ইদ্রিস খেয়াল করে ভেতরে, অন্ধকারে ডিমের মতো কিছু রয়েছে। চেঁচিয়ে ওঠে ইদ্রিস, খবরদার, ভেতরে ছানা পোনাও আছে মনে হসসে। সা-ব-ধা-ন।
তার সতর্ক হাঁকডাকে ছেলেপেলের দল যেন আরো জড়োসরো হয়ে যায়।
রোদ লেগে মা-কেউটের ধূসর কালো শরীর চকচক করছে। জমিতে নেমে ফোঁস ফোঁস করছে সেটি। সম্ভবত: পালিয়েই যেত ওটি। তবে চারপাশে মানুষগুলোর নড়াচড়ায় যেন নিজের বিপদ টের পেয়েছে। ফলে আত্মরক্ষার চেষ্টায় বারবার ফণা তুলে সবাইকে ভয় দেখানোর প্রবল চেষ্টা করছে সেটি।
ছেলের দল ততক্ষণে দূরে সরে গেছে। কিছুদিন আগেই ধান কাটা হয়েছে। জমি এখন খোলা, পড়ে আছে। খোলা জায়গা পেয়ে মহাআনন্দে শিশুর দল হা-ডু-ডু খেলছিল। ভাগ্য ভালো কাউকে কামড়ায়নি।
সাহেবালী দৌড়ে ঘরের বারান্দায় যায়। তার বাচ্চাটি ঘরের পেছনে বিছানায় শুয়ে থাকে। তাই আশে পাশে এরকম বিষধর প্রাণী থাকা ঠিক নয়। বারান্দার কোনে লাকড়ি স্তুপ। সেখান থেকে দ্রুত বড় একটি লাকড়ি বেছে নেয়। তারপর দৌড়ে সে নেমে আসে নীচে।
রোদের তাপে জমিতে পা দেয়া যায় না। জমিতে নেমে লাকড়ি হাতে সাবধানে কেউটেটির চারদিক এক পাক ঘুরে নিল সে। ভাল করে বুঝে নেয় তার অবস্থান। এর আগেও বহুবার সাপের মুখোমুখি হয়েছে সাহেবালী । তবে সেগুলোর অধিকাংশই ঢোঁড়া জাতীয়। তার কোনটিই এটার মতো নয়।
কেউটের জিহ্বাটি ঘনঘন বের হচ্ছে, ঢুকছে। স্পষ্টই সাপটি উত্তেজিত। বাবা বলতেন, বাপধন, সাপ তোকে ভয় না দেখালে যেমনটি সে চায়, তেমনি তাকে যাতি দিও।’ কিন্তু সাপটি এখানে থাকলে সবাইকে কামড় দিবে। সেটি সাহেবালী চায় না।
ইদ্রিস কোথা থেকে একটা মাছ ধরার বর্শা নিয়ে এসেছে। তবে তার নিজের সাহস হয় না। সেটি বাড়িয়ে ধরে সাহেবালীর দিকে। হাতের লাকড়িটি ফেলে সাহেবালী সেটিই শক্ত করে ধরে। সরিসৃপটি সরসর করে গর্তের দিকে এগোয়।
সাহেবালীও সুযোগ খুঁজে। এটিকে পালাতে দেওয়া যাবে না। ইদ্রিসকে ইশারা করে সে। এবরো খেবড়ো শুষ্ক জমিতে, গর্তগুলোর চারপাশে ঝুরঝুরে মাটির স্তুপ। ইদ্রিস একমুঠো মাটি নিয়ে পলায়নপর প্রাণিিটর মুখের দিকে ছুঁড়ে দেয়। সে ফাঁকে তার হাতের বর্শাটি গেঁথে ফেলল কেউটের ফনার পেছন দিক। বিদ্ধ হয়ে বেচারি সরিসৃপটির লেজ এক ঝটকায় শূন্যে উঠে জমির গায়ে আছড়ে পড়ল।
সাহেবালী হাঁপাতে থাকে। কিছুক্ষণ নিচু হয়ে হাঁটুতে হাত রেখে দম নেয়। এরপর মৃত সাপটিকে বর্শাবিদ্ধ অবস্থায় শূন্যে তুলে ধরে। প্রায় চার হাত লম্বা জাত কেউটে। রোদ ঠিকরে পড়ে তার চকচকে শরীরে। কিছুটা দূরে একটি বড় গর্তে সাপটিকে ফেলে আসে। সেসাথে গর্ত খুঁড়ে ভেতরের ডিম বের করে আনে। ডিম ভেঙে কয়েকটি সাপের ছানা উকিঁঝুঁকি দিচ্ছিল। সেগুলোও কোদালের আঘাতে শেষ করে।
ছেলের দল দূরে দাঁড়িয়ে হৈ হৈ করে ওঠে। ইদ্রিস পেছন ফিরে দাতমুখ খিঁচে কড়া ধমক কষালো তাদের। তারপর সাহেবালীর দিকে ফিরে বলে, সব শ্যাষ। আর মারতি হবে না।
ঘরে ঢুকে সাহেবালী দেখতে পায়, নুরজাহান শুয়ে আছে। চাটাই বিছিয়ে নিয়েছে মাটিতে। কোলের বাচ্চাটি ঘুমুচ্ছে পাশে। বোধহয় খাওয়ানো হয়ে গেছে। স্বামীকে দেখে উঠে বসে। সাহেবালী কোমরের গামছাটি খুলে তার ঘামে ভেজা উদোম শরীর মুছে নেয়। তারপর ধপ্ করে বসে পড়ে চাটাইয়ে ।
নুরজাহানের কন্ঠ এখন অনেকটাই নরম। বলে, বায়রে ছাওয়ালগুলার চেল্লাচেল্লি শুনতে পালাম। কী হইয়েছেলো গো?
সাহেবালী বিরক্তির সাথে বলে, কিছু নয়, একটা সাপ। রদের তাপ সয্যি করতে পারেনি, বেরিয়ে এইয়েছেলো। মেইরে ফেলেছি। সে চাটাইয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে দুহাত মেলে দেয় দুদিক। তারপর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে পানি চায়।
নূরজাহান উদ্বিগ্নবোধ করে। বলে, কি গো শরীর খারাপ লাগিছে?’
সাহেবালী কোন জবাব দেয় না। শুধু ঘরের কোনে রাখা পানির কলসিটির দিকে হাতের ইশারা করে।
নুরজাহান পানি এনে দেয় স্বামীকে। কলসটি প্রায় খালি। পানি আনতে বেরোতে হবে। সাহেবালী তৃপ্তির সাথে ঢকঢক করে পানি খায়। তারপর তাকায় স্ত্রীর দিকে। কিছুক্ষণ আগে বাচ্চাকে খাইয়েছে। ফলে নুরজাহানের বুকের একপাশ উন্মুক্ত। সেদিকে তাকিয়ে সাহেবালীর কন্ঠ নরম হয়ে আসে। অনুচ্চ কন্ঠে বলে, তখন বকেছি বলে কষ্ট পাছিস?
নুরজাহান কপট রাগে মাথা ঝাঁকায়। তার বুকের আঁচলের দিকে খেয়াল নেই। বলে, আর ঢং করতি হবে না। হাটে যাতি হবে। এ বেলা খাবার কিছু নাই।
সাহেবালী নুরজাহানকে দেখে। বাচ্চা হওয়ার পর যেন তার রূপ আরো খুলেছে। কথার উত্তর না দিয়ে স্ত্রীকে নিজের দিকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে।
হাটে সবগুলো লাউ বিক্রি হয়ে গেল সাহেবালীর। তাতে খোরাকির চাল হলো। তবে ফজু মাঝির কাছ থেকে কুচো চিংড়ি নিল ধারে। মাছ দেওয়ার আগে ফজু মাঝি মনে করিয়ে দিল, তোমার কাছে অহনও গত হাটের একশ আট ট্যাকা পাই, ঢালীর পো। সাহেবালী মাছ বেধে নিতে নিতে বলে, মনে আছে গো। অত কতি হবে না। সামনের হাটে পায়া যাবে মিয়া।
রোদ কিছুটা মিইয়ে এসেছে। আকাশে মেঘের কিঞ্চিৎ আনাগোনা শুরু হয়েছে। দুদিন আগেও একইভাবে আকাশ মেঘলা হয়ে উঠেছিল। তবে বৃষ্টি হয়নি। পুরোমাস ধরে এভাবেই চলছে। হাটের লোকজন নিস্পৃহ চোখে আকাশ দেখে।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় রাত হয়ে যায়। বাজার শেষে একটু কাজেরও তদ্বির করে এসেছে সাহেবালী। হানিফ তালুকদার এ সপ্তাহেই জমির কাজে হাত দিবে। আমন রোপনের এখনই সময়। তার কামলা লাগবে অনেক। সাহেবালী শুধু নিজের জন্যও নয়, ইদ্রিস, ইদ্রিসের এক বেকার শ্যালক সবার কথাই বলে এসেছে। সেসব শেষ করতে করতেই দেরি হয়ে যায় তার। বিকেলের দেখা হালকা মেঘ ততক্ষণে জমাট, গাঢ় পাথুরে রঙ ধারণ করেছে। থেকে থেকে বাতাস বইছে।
ঘরের সামনে উঠোনে কুপি হাতে দাঁড়িয়ে নুরজাহান। এ গ্রামে অনেকের ঘরেই এখন বৈদ্যুতিক বাতি। কারো কারো ঘরে সোলার বাতিও রয়েছে। সাহেবালী এর কোনটাই আনতে পারে নি। বাতাসে কুপির সলতের আলো এদিক ওদিক সরে যাচ্ছে। সে আলোয় নূরজাহানকে কেমন অপার্থিব দেখায়।
এতো দেরি হলো কেনে?’ নূরজাহান প্রশ্ন করে। সাহেবালী ফিরে আসায় একই সাথে স্বস্থিবোধ করে।
কাজ ছেল।’ ছোট করে উত্তর দেয় সাহেবালী। স্ত্রীলোকের সব কথার উত্তর দিতে নেই, ভাবে সে।
অন্ধকারে, কালো আকাশের দিকে তাকাতে তাকাতে নূরজাহান বলে, ভাল বৃষ্টি হবি মনে হতিছে। ওই যে, বাজ চমকায় দ্যাখো।
সত্যিই বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আকাশ কালো কুচকুচে। মেঘ এখন দলেবলে আরো ভারি হয়ে উঠেছে। বৃষ্টির জন্য দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেছে সবাই। বৃষ্টি হলে মাটি নরম হবে। তাতে চাষবাসে, চারারোপণে সুবিধে। বসে থাকা মানুষগুলো তখন কাজ পাবে। আশেপাশের ঘরগুলো থেকে এরমধ্যে অনেকে উঠোনে নেমে এসেছে।
স্ত্রীর শুকনো মুখটির দিকে তাকিয়ে সাহেবালী হঠাৎ বলে, এবার ভাল ধান হলি পরে একটা নাকফুল গড়িয়ে দেবনি তোকে।
নুরজাহান স্বামীর হাত থেকে হাটের জিনিষপত্রগুলো নেয়। নিতে নিতে বলে, অয়েছে, অত চ্যাংরামি করতি হবি না। এবার ঘরে চলো দিকিন।
বিয়ের সময় সাহেবালী তাকে একটি সোনার হার আর হাতের দুটো বালা গড়িয়ে দিয়েছিল। গত বছর সেগুলো বিক্রি করে মহাজনের ধার শোধ করেছিল সাহেবালী। বিয়ের জিনিস, এভাবে হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় ভারী কষ্ট হয়েছিল নূরজাহানের।
কুপির আলোয় রাঁধে নুরজাহান। লাউ দিয়ে চিংড়ি কুচোর ঝোল। দুই বাহুর পেছনে মাথা রেখে চাটাইয়ে শুয়ে সাহেবালী স্ত্রীর রান্না শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করে। গরম ভাতের গন্ধ নাকে আসছে। বিকেলে হাটে ডালপুরী আর চা খেয়েছিল। তাও হজম হয়ে গেছে বহু আগে। দুপুরের ক্ষিদে ফিরে এসেছে আবার। বলে, কই, আরো দেরি হবি?
নুরজাহান চুলোয় ফুটতে থাকা ডালে বাগাড় দিতে দিতে বলে, এইতো আর এট্টুখানি। ঘরের ভাঙ্গা জানালা দিয়ে হু হু বাতাস ঢুকছে এখন ঘরে। দমকা বাতাসে কুপি নিভে আসছে।
নুরজাহান বিরক্ত হয়ে উঠল, বৃষ্টি অলে হবে, মরার বাতাস ক্যানে?
বাতাস যেন হঠাৎ দিক পরিবর্তন করে। ঘরের চালা নড়তে থাকে। বাইরে ইদ্রিসের চিৎকার শোনা যায়, আসমানের অবস্থা ভাল না সাহেব ভাই। তুফান আসবি মনে হচ্ছে। সা-ব-ধা-ন। ’
ইদ্রিসের চিৎকার শেষ হতে হতেই বাতাসের একটা প্রবল ঝাপটা নেমে আসে পূব দিক দিয়ে। তাতে ঘরের জীর্ণ চালা মুহূর্তেই উড়ে যায়। মড় মড় করে ঘরের পাশের জারুল গাছটি ভেঙ্গে আছড়ে পড়ে নিচে। কিছু শুকনো পাতা উন্মাদের মত শূন্যে চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে সাহেবালীর উদোম ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে।
অনেক্ষণ পরে সাহেবালী চেতন এবং অচেতনধরণের মাঝামাঝি একটি ঘোরের ভেতর ফিরে আসে। কিছু একটা আঁকড়ে ধরতে চায়। কিন্তু পারে না। ঝোড়ো বাতাস আর ঘুটঘুটে অন্ধকারের প্রাবল্যের ভেতর নুরজাহানকে দেখতে পায়না। শুধু ঝাপসা চোখে দেখতে পায় বর্শাবিদ্ধ কিছু সরিসৃপ ছায়া যেন তার মুখের ওপর দুলছে।
কবি ও গল্পকার। জন্ম ১৯৬৩ সালে, ঢাকায়। ইংরেজী সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। সাংবাদিকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু হলেও পরবর্তীতে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কাজের সংগে সম্পৃক্ত হন। মূলস্রোতের পত্রিকাগুলোর সাহিত্যপাতায় কবিতা ও ছোটগল্প লিখেছেন ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত। মাঝখানে দীর্ঘ বিরতি। আবার লেখালেখি শুরু করেছেন। এখন নিয়মিতভাবে লিখছেন লিটল ম্যাগাজিনসহ অনলাইন সাহিত্য পত্রিকায়।