| 25 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

একাকীত্ব       

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com
আমি অদিতি,বহুবছর পর আজ একাই চলেছি বেড়াতে।না ঠিক একা নয়,সঙ্গী-সাথী অনেকই রয়েছে কিন্তু সকলেই অপরিচিত,হয়ে যাবে পরিচয় এই যাত্রাপথেই। লোকাল ট্র্যাভেল এজেন্সি ‘মহারাজ ট্রাভেলস’ বেশ সুনাম কিনেছে এই তিনবছরে,লোকমুখে শুনে তাই ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বেরিয়ে পড়লাম এবার। এভাবে কখনো কোথাও যাব ভাবিনি। বিয়ের পর সুমন ছাড়া কারো সঙ্গেই কোথাও যাইনি। কত বেরিয়েছি সুমনের সঙ্গে। প্রতিবছর একটা বিদেশ ট্রিপ তো হতই বেশিরভাগ পুজোর সময়,এছাড়া ডিসেম্বরেও একটা বড় ট্রিপ হত দেশের মধ্যেই। আর ছোটখাটো ট্রিপ তো দু-তিনদিন ছুটি পেলেই টুক করে একটা হয়ে যেত কাছেপিঠে। এমন অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল কিছুদিন অন্তর না বেরোলে যেন হাঁফিয়ে উঠতাম। কিন্তু রিটায়ারমেন্টের পর হঠাৎ করে সুমন চলে গেলে চোখে আঁধার ঘনিয়ে এল। না বলে কয়ে এসে পড়া এই হঠাৎ মৃত্যু মেনে নিতে পারছিলাম না কিছুতে। সবে দু’মাস তখন রিটায়ার করেছে,বরাবরই ভোজনরসিক,বাজার যাবার সময় বলে গেল,”আজ চিতলমাছ পেলে নিয়ে আসব,ভাল করে মুইঠ্যা রান্না কোরো তো,জমিয়ে খাব”। মাছ-বাজারে ব্যাগ ভর্তি করেও আর বাড়ি ফিরে চিতল মাছের মুইঠ্যা খাওয়া হল না মানুষটার। তীব্র বুকের যন্ত্রণায় বাজারের মধ্যেই বুক চেপে ধরে বসে পড়েছিল,সেখান থেকেই সোজা হাসপাতাল। দুদিন টানাপোড়েনের পর বাড়িতে ফিরল তার মৃতদেহটা। কত টাকার মেডিক্লেম করা ছিল দুজনেরই,বুড়োবয়সে লাগবে বলে। বলতো,”একটু বেশি অ্যামাউন্টই থাক,বুকে বড় বল ভরসা যোগায়। বুড়োবয়সে কখন কার কিজন্য লাগে বলা তো যায় না।” “লাগল না তো সুমন,সবদিক গুছিয়ে এত সুব্যবস্থা করে রেখেছিলে কাজে তো লাগল না।” হ্যাঁ,আমার আজ তাই কোনো অসুবিধা নেই,সুমন গুছিয়ে দিয়ে গেছ‌ে বলে টাকাপয়সার কোনো চিন্তা নেই। তবে,লোকবল আমার তেমন নেই,কিছু চেনা পরিচিত বন্ধুবান্ধব তারাই সঙ্গ দেয়,পাশে দাঁড়ায়। 
হ্যাঁ,আমরা নিঃসন্তান,বিয়ের কয়েকবছর পরেও সন্তান না হলে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ি। ডাক্তার-ঘর শুরু হয়। প্রথম দফায় আমার সবরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা হলে জানা যায় আমার দিক থেকে তেমন কোনও অসুবিধা নেই। তবে কি সুমন? হ্যাঁ তাই। সুমনের বাবা হবার ক্ষমতা নেই। জানা গেলে অবসাদ সুমনকে গ্রাস করতে লাগল। আমি প্রমাদ গুণলাম। সুমনকে ভালো রাখার তাগিদে নিজের অবসাদ উধাও হয়ে গেল। আমিই সুমনের কাউন্সেলিং করতে লাগলাম। প্রথম প্রথম শুধু ঘুরে বেড়াতাম,তাতেও দেখতাম সুমনের মতো অমন ফুর্তিবাজ মানুষ ততটাও উপভোগ করতে পারছিল না। এসব দেখে ভাবলাম একটা বাচ্চা দত্তক নিই,কথাটা সুমনকে বলতে ও যেন লুফে নিল। আমায় বলল,”আমি অনেকদিন থেকেই ভাবছিলাম, তোমায় বলতে পারছিলাম না,তুমি কিভাবে নেবে,সায় দেবে কিনা”। এরপর অনাথ আশ্রমের দ্বারস্থ হই আমরা। কিন্তু অত সহজে সেখান থেকেও বাচ্চা পাওয়া গেল না,দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হল। আমরা একটা মেয়ে চেয়েছিলাম। সময়মত আমাদের ডাক পড়ল,ছোট্ট একটা পুতুল নিয়ে আমরা ঘরে ফিরলাম। ওকে ঘিরে কত উত্তেজনা আমাদের,সারাক্ষণ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ওর ছোট্ট ছোট্ট হাত-পা নাড়া,হাসি,খেলা, খাওয়া সব উপভোগ করতাম। বড় মায়া লাগত,আহা রে এমন একটা জ্যান্ত পুতুলকে কি করে তার মা ছেড়ে দিয়ে গেল! আদর করে নাম রাখলাম সোনালী,ও যে আমাদের ঝিমিয়ে পড়া দিনগুলোকে ঝলমলে সোনালী করে দিয়েছিল। সুমন অফিস থেকে ফেরার সময় রোজ কিছু-না-কিছু হাতে করে নিয়ে ফিরত মেয়ের জন্য, কখনও জামাকাপড়,কখনও খেলনা। একদিন একটা দোলনা নিয়ে এল,তাতে মেয়েকে শুইয়ে আমাদের দুজনেরই সে কি আনন্দ। একবারও মনে হত না আমাদের নিজেদের সন্তান নয়। আদরে,যত্নে দিব্যি ফুটফুটে হয়ে উঠতে লাগল ও। একপা একপা করে হাঁটতে লাগল,বোল ফুটল,ওর আধো আধো বুলিতে আমরা ভীষণ আহ্লাদিত হয়ে উঠলাম। পড়াশুনা শুরু হল আমার কোলে বসে। প্রতিটি মুহূর্তকে আমরা ভীষণভাবে উপভোগ করছি তখন। বইমেলায় ওকে নিয়ে গিয়ে বাচ্চাদের ছবির বই,এবিসিডির বই কিনেছি। তখন ওর খুশিই আমাদের খুশি। পৃথিবীর সব মায়েরা যেমন সন্তানের খুশিতে খুশি হয়,আনন্দ পায়,আমারও তেমন হত। ওকে না দেবার কিছুই ছিল না আমাদের। ছোট্ট ছোট্ট হাত দুটো দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে যখন হামি দিত,মনে হত এর থেকে সুখ বুঝি আর কিছুতে নেই।
             
পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে ওকে গান,আঁকা,সাঁতার সব শেখালাম,সবেতেই ও বেশ চৌখস হয়ে উঠতে লাগল। খুশিতে মনটা ভরে উঠল আমাদের। বড় হতে লাগল সোনালী,কলেজে গেল ও,জানতেও পারেনি কখনও যে ও আমাদের নিজের সন্তান নয়।। মাথাভর্তি কালো চুল,টকটকে গায়ের রং,সোনালী আমার রূপসী হয়ে উঠতে লাগল। ইকোনমিক্স,ম্যাথামেটিক্স নিয়ে গ্র‍্যাজুয়েশন করতেই চাকরি পেয়ে গেল। আমাদের ইচ্ছা ছিল আরও পড়াশোনা করুক,কিন্তু খুব ভালো চাকরি পাওয়ায় ওর তখন চাকরি করার ইচ্ছে। ওর ইচ্ছেয় আমরা বাধা দিইনি,কোনদিনই দিতাম না। কর্পোরেট জব,ভীষণ খাটুনি,অনেকটা সময় দিতে হত। সুমন অফিস থেকে ফিরে আসারও অনেকটা পর সোনালী ফিরত। আমরা দুজনেই ও না ফেরা পর্যন্ত ছটফট করতাম,ভালো লাগত না। এরমধ্যে ওর চোখমুখ দেখে আমার একটু অন্যরকম ঠেকতে লাগল। আমি মা,মেয়ের অভিব্যক্তি বোঝার ক্ষমতা আমার আছে। কিছুদিন পর রবিবারের এক সন্ধ্যায় দেবদত্ত এল আমাদের বাড়িতে। মেয়ে আলাপ করিয়ে দিল ওর অফিস কলিগের সঙ্গে। দেবদত্ত ইঞ্জিনিয়ার,দেখতে বেশ ঝকঝকে,স্মার্ট কথাবার্তা,সহজেই আমাদের মন জয় করে নিল। বুঝলাম ওদের মন দেয়া-নেয়া হয়ে গেছে।
             
এর মাসখানেক পর দেবদত্তের বাবা-মা আমাদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন ছেলের বিয়ের ব্যাপারে। সোনালীকে ওরা পুত্রবধূ করে নিয়ে যেতে চান। ওনারা সবাই আমাদের বাড়ি এলেন। দেবদত্ত একই মাত্র সন্তান। আমরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলতে লাগলাম,দেবদত্ত ও সোনালী পাশের ঘরে নিজেদের মধ্যে গল্প করতে গেল। সুমন আর আমি ঠিক করে রেখেছিলাম সব সত্যি জানিয়ে আমাদের সোনালীর বিয়ে দেব যাতে এ নিয়ে পরবর্তীতে কোনো কথা না ওঠে। সেইমত আমরা সব জানাতে প্রথম দফায় দেখলাম দেবদত্তের বাবা-মা যেন একটু দমে গেলেন। সোনালী আমার চোখ জুড়ানো মেয়ে আর তাছাড়া ওর জন্মের দায় তো ওর নয়। ওনারাও সবই বোঝেন, তাও এটা যেন সোনালীর জীবনের একটা বড় খুঁত,কিন্তু নিজের ছেলের সুখের জন্য তাঁরাও সব মেনে নিলেন। তাঁরাই বললেন, “কথাটা পাঁচকান করার দরকার নেই,ওটা আমাদের মধ্যেই থাক”। ওদের জানালাম,”সোনালী কিন্তু একথা জানে না, জানলে খুব কষ্ট পাবে।” ওঁরা বললেন,”দেবদত্ত বা সোনালী কেউই এই চরম সত্য জানবে না কোনদিন”।
             
ধুমধাম করে বিয়ে দিলাম সোনালীর। গয়নায় গা মুড়ে দিলাম। সুমন খুব প্ল্যান করে চলত,তাই ওর প্রতিটি জন্মদিনে, পুজোয়,নববর্ষে ওর জন্য গয়না গড়িয়ে রাখত। তাতেই ওর প্রচুর গয়না হয়ে গিয়েছিল,বিয়ের সময় আলাদা করে আর গড়াতে হয়নি। সোনালী শ্বশুরবাড়ি চলে গেলে আমরা দুজন একাকীত্বের ঘেরাটোপে বাস করতে লাগলাম  কিন্তু ও খুশি দেখে আমরাও খুশি মনে সেই একাকীত্ব মেনে নিয়েছিলাম। একবছর পর মেয়ে সন্তানসম্ভবা হলে আমাদের খুশি আর ধরে না। যথাসময়ে একটি কন্যাসন্তানের জন্ম দিল সোনালী। নবজাতিকাকে সবাই সাদরে গ্রহণ করবে কি,চমকে উঠল দেখে। বাপ-মা ছাড়া সন্তান,কালো কুচকুচে,নিগ্রোদের মত।সোনালী দেখেই কেঁদে ফেলল। নার্সিংহোম থেকে মেয়ে ও নাতনিকে আমার কাছে নিয়ে আসতে চাইলে দেবদত্তর মা দুম করে বলে বসেন,”নাতনিকে আপনিই রাখুন আপনার কাছে, ওকে আর আমাদের বাড়ি পাঠাবেন না। কার না কার সন্তান সোনালী,বাচ্চা তাদের কারও রূপ পেয়েছে নির্ঘাৎ। এইজন্যই মানুষ বংশ দেখে বিয়ে দেয়”। সোনালী সব জেনে গেল। আমাদের ওপর দুরন্ত অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিল সে। তার কালো মেয়ে নিয়ে শ্বশুরবাড়ীতে ফিরে গেল আমাদের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করে। এ ধাক্কাটাই সুমন মেনে নিতে পারল না,চলে গেল চিরতরে,আর আমি রইলাম আমার একাকীত্ব নিয়ে।  

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত