| 19 জানুয়ারি 2025
Categories
গল্প সাহিত্য

অতৃপ্ত আত্মা

আনুমানিক পঠনকাল: 11 মিনিট
অন্ধকারাবৃত মেঘলা আকাশ। বাতাসে মন কেমন করা উদাস কান্নার সুর। রোজকার মত নিয়ম করে সূর্য উঠলেও গোটা শহর ঘুমিয়ে আছে। লোরকার ভাষায় ‘স্লিপলেস সিটি’ নিউইয়র্ক শহর করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হবার পর থেকে যেন রাতদিন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। রাস্তাঘাট ফাঁকা, মানুষজন নেই। ল্যাম্পপোস্টগুলো পথের দু’পাশে সারিবদ্ধভাবে বুক চিতিয়ে সাহসী মানুষের মতো দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ীর অপ্রয়োজনীয়, বিরক্তিকর টুংটাং শব্দ নেই। গাছের ফাঁকফোকর গলে পাখীদের কিচিরমিচির শব্দ ছাড়া অন্য কোন শব্দ নেই বললেই চলে। প্রকৃতিতে মধুর বসন্ত হাওয়া বইছে। ফুল ফুটেছে, জোড়া ঘুঘু বাসা বাঁধছে ভালোবেসে। সবুজের সমারোহে ছেয়ে আছে চারপাশ। এত এত সৌন্দর্যের ভীড়েও মানুষের কোলাহল ছাড়া সবকিছু শূন্য শূন্য লাগছে।  বর্ণহীন ফ্যাকাসে দিন হলেও প্রকৃতির বসন্ত আমেজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নাবালক সকালটির পরতে পরতে। 
 
প্রকৃতির আদরে বেড়ে উঠা শোভা বোধ জ্ঞান হবার পর থেকে দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করে, মুখ ছাড়া আয়না যেমন অকেজো তেমনি মানুষ ছাড়া প্রকৃতির রূপও অর্থহীন। 
 
সম্পূর্ণ অন্যরকম একটি দিন আজ। শোভার অকাল প্রয়াণে প্রকৃতি, আসমান-জমিন সহ চারপাশ মনমরা হয়ে আছে। খানিক আগে কান্না হয়ে ঝরলো আকাশ। কেঁদে কেঁদে প্রকৃতি যেন কিছুটা হাল্কা হয়েছে।
 
শোভার দেহ থেকে আত্মা মুক্তি লাভ করেছে গত রাতে। যদিও শোভা সময়ের ভারে ক্লান্ত বোধ করলে মাঝেমধ্যে জীবন থেকে মুক্তির প্রার্থনা করতো, তবে ও কোনভাবেই  চায়নি এখুনি ইহজগৎ ছেড়ে পরজীবনে চলে যেতে। ওর উপর অর্পিত একমাত্র সন্তান পিয়ালের সকল দায়িত্ব পালন শেষে শান্তিতে চিরনিদ্রায় যেতে চেয়েছিল। জীবনের  অন্য অনেক ইচ্ছের মতো শোভার এই ইচ্ছেটিও পূর্ণতার মুখ দেখেনি। জীবনভর স্বপ্নদের টুটে যেতে দেখেছে। বেশীরভাগ স্বপ্ন ভেঙে যাওয়াই ছিল ওর জীবন। 
 
জীবদ্দশায় প্রায়শই শোভার মনে হতো, জীবন আসলে স্রষ্টা প্রদত্ত কঠিন পরীক্ষা বৈকি আর কিছুই নয়। পরীক্ষায় হেরে যাওয়া অসহায় মানুষগুলো গোপনে কাঁদে, অত্যাচারিত হয়, বিজয়ী কিংবা সবলের কাছে। দূর্বলভাবে হেরে যাওয়া মানুষ জীবন সায়াহ্নে এসে অশ্রু মুছে বলে- সবি নিয়তি! আর এই নিয়তির নীতিমালা ইচ্ছেমতো নির্ধারণ করেন সৃষ্টিকর্তা। তাঁর মর্জিমাফিক বাঁচতে হয়, তাঁর ইচ্ছেতে মরতে হয়। হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ সবই তাঁর হাতে। 
 
বৃষ্টি থেমেছে খানিক আগে। বৃষ্টি শেষে আশপাশের ঝাপ্সা অবস্থা কেটে সূর্য তেতে উঠলেও ঠান্ডা বাতাস বোধ হচ্ছে। ত্রস্ত পৃথিবী সূর্যের রুপালি আলোয় স্নান করে কিছুটা স্নিগ্ধ হয়ে উঠেছে। শোভার হাতে অফুরন্ত অবসর। স্মৃতির অরণ্যে বিলি কাটতে কাটতে ও চোখ বন্ধ করে চলে যায় ছোটবেলার খাঁটি আলোমাখা দিনগুলোতে। পৌষ- মাঘের শীতের সকালে যখন এমন ঠান্ডা বাতাস বয়ে যেত, তখন শোভা মায়ের বুকের সঙ্গে গাব গাছের আঠার মতো লেপ্টে থাকতো, মা কে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরতো। সরল-সুন্দর মায়ের বুকের ওমে ঘুমিয়ে পড়তো। 
 
চোখ মুদে নিংড়ে নিংড়ে অনুভব করছে শোভা ফেলে আসা জীবনের সুখ। মায়ের আদর শোভাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় আমেরিকা থেকে হাজার হাজার মাইল দূরের দেশ বাংলাদেশে, সে ছোট্ট গ্রামে। যে গ্রামের আম, জাম, কাঁঠাল, কলা, তাল, কামরাঙ্গা, চালতা, বরই, বাতাবিলেবু আর, অতি প্রিয় হাস্নাহেনা, বেলি ফুলের মন মাতানো ঘ্রাণ এসে লাগছে এখন শোভার নাকে। পরিচিত সব ঘ্রাণের তীব্রতায় শোভার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠে। ওর ভীষণ ইচ্ছে করে শিশির ভেজা সবুজ ঘাসে খালি পায়ে মায়ের হাত ধরে হাঁটতে, বাবার চাদরের ওমে সাইকেলে বসে স্কুলে যেতে। 
 
বাবা-মায়ের সঙ্গে কাটানো জীবনের শ্রেষ্ঠ সুন্দর খাঁটি সোনার দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ছে ওর। আলোয় ডুবানো ছেলেবেলার স্মৃতিরা রিলের ছবির মতো শোভার চোখের সামনে ভাসতে থাকে। 
 
শোভার মনের আকাশজুড়ে অনবরত স্মৃতির ঝড়-ঝাপটা বয়ে চলছে। মেঘে ঢাকা আকাশের বিদ্যুৎ চমকানোর মত ওর মনেও স্মৃতিরা গর্জন তুলছে। স্মৃতি মানুষের জীবনের এক অতি মূল্যবান সঞ্চয়। স্মৃতি হাসায়, স্মৃতি কাঁদায়। স্মৃতি আবার ভাসিয়েও নিয়ে যায়। স্মৃতির ভেলায় ভাসতে ভাসতে মানুষ যে কোথা হতে কোথায় চলে যায়, সে নিজেও জানেনা। মানুষ অনেক সময় স্মৃতি ভুলতে বসলেও পারিপার্শ্বিকতা সেটি হতে দেয় না। জীবনের বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে মানুষ চোখ বন্ধ করে স্মৃতির মহাসাগরে ডুবে যায়। 
 
স্মৃতির অরণ্যে কেউ অতীতকে খোঁজে, কেউ খোঁজে বর্তমানকে! যেমন শোভা এখন খুঁজছে অতীতকে। ওর চোখের পর্দায় স্বপ্নের মত ভেসে এলো শোভনের মুখোচ্ছবি আর বৃষ্টি ভেজা মধু মাখা কিশোরী বেলা। 
 
স্কুল ছুটি হলে যদি কোনদিন মনে হতো আকাশে মেঘ জমেছে কিংবা বৃষ্টি হবে, সেদিন শোভন ছাতা হাতে রাস্তার উপর গাছের নিচে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতো। শোভাকে দেখামাত্র ছাতা এগিয়ে দিয়ে বলতো, ‘এই নে ছাতা! একদম বৃষ্টিতে ভিজবি না কিন্তু! এত দেরি করলি কেন! অনেকক্ষণ ধরে তোর জন্য দাঁড়িয়ে আছি!’ 
 
শোভা বৃষ্টিভেজা জুবুথুবু শোভনের মুখের দিকে তাকিয়ে তার চোখের ভাষা অনুবাদ করতে থাকে! শোভনের ভেজা চোখজোড়া জুড়ে শুধু শোভার ছবি ফুটে উঠেছে। শোভার মুখের রং বদলে যায় ভালোলাগার অপার আনন্দে। বন্ধুদের সঙ্গে খোলা আকাশের নিচে চড়ুইভাতি খেলা, কবিতা, গান আর পুতুলের বিয়ে নিয়ে মেতে থাকতো শোভা। শোভনের ভরাট কন্ঠের কবিতা পড়ার ধ্বনি এখনো কানে বাজে। শোভনের সকল ব্যস্ততা থাকতো শোভাকে ঘিরে, সারাক্ষণ ওর মাঝেই ডুবে থাকতো। জনারণ্যেও অপলক শোভার দিকে তাকিতে থাকতো। যেন শোভার মন যুগিয়ে চলাই ছিল শোভনের জীবনের একমাত্র ব্রত। 
 
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে সবাই ছুটিতে আরাম আয়েশে দিনাতিপাত করছে। হঠাৎ একদিন শোভার গা কাঁপিয়ে জ্বর আসে, জ্বরে পুড়তে থাকা কপালে হাত রেখে শোভন বলেছিলো, ‘তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠ! বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কোচিং করতে শহরে যাওয়ার আগে সবাই মিলে আবার চড়ুইভাতি খেলবো, পুতুলের বিয়ে দেব, মাংস -পোলাও খাবো। চতুর্দিক আলোকিত করে হাসবো, গাইবো, কবিতা পড়বো! ‘ 
 
শোভা যখন সুস্থ হয়ে উঠে, ততদিনে শোভন শহরে চলে যায়। শোভনের উদ্দেশ্যে লেখা কাঁচা হাতের কবিতাগুলো ওকে শোনানোর জন্য শোভা অস্থির হয়ে উঠে। চাল, ডাল, আলু, তেল!  শোভনের দেয়া ঝর্ণা কলম দিয়ে চড়ুইভাতির ফর্দ বানাতে থাকে, আর অপেক্ষা করতে থাকে শোভা। শীতলপাটি বিছানো  দক্ষিণমুখী বারান্দায়, চড়ুইভাতির ফর্দ হাতে নিঃসীমতায় চেয়ে থেকে, শোভনের অপেক্ষায় শোভার মন বিরহের আগুনে পুড়তে থাকে। 
 
ওদের আর কোনদিন দেখা হয় না। বেঁচে থাকার সময়েও শোভনের জন্য সদা মন পুড়তো। জীবন শেষেও তাকেই মনে পড়ছে! শোভার বিশ্বাস দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান শেষে দ্রুতই শোভনের সাথে দেখা হবে ওর! নতুন ব্রহ্মান্ডে ওরা ভালোবাসায় ডুবে আনন্দঘন জীবন শুরু করবে! 
 
স্মৃতি হলো চাপা কলের মতো। হাতল ধরে যত চাপতে থাকে ততই জলের মত উপচে পড়ে। জীবন নামক অদৃশ্য কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে, শোভার এখন সমুদ্র সম অবসর মিলেছে। অবসরে ও চাপা কলের হাতল ধরে চাপছে আর কঠিন জীবন বেলায় কাটানো স্মৃতির জাবর কাটছে। 
 
নিউইয়র্কের হাসপাতালে শোভার মৃতদেহ ঘিরে থাকা মানুষগুলোর কাউকে ও চেনে না। তাঁরা কেউ ওর আপনজন-পরিবার বা আত্মীয়-স্বজনও নয়। তবুও তাঁরা শোভার মুখের দিকে তাকিয়ে কাঁদছে। গত দু’দিন ধরে ওকে ছায়ার মত ঘিরে রাখা, ওকে বাঁচানোর সব চেষ্টা করা, ডাক্তার, নার্সরা ওর মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। মায়া খুব খারাপ জিনিস। না চাইলেও এটি মানুষকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখে। শোভার দেহ হাসপাতাল থেকে মর্গে নেয়ার ব্যবস্থা চলছে। 
 
মানুষ মরণশীল। মানুষ মারা যাবে এটি জগতের অন্যতম ধ্রুব সত্য! প্রতিটি জীবনকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। মৃত্যু জীবনের অতি স্বাভাবিক অবধারিত প্রক্রিয়া। এ থেকে পরিত্রাণের কোন পথ নেই জীবনে। মৃত্যুতে জীবন পূর্ণতা পায়। মৃত্যু আদতে মানব জীবনের স্বাভাবিক পরিপূর্ণ চক্র বৈকি আর কিছু নয়৷ কার জীবনের সমাপ্তি কখন, কিভাবে, কোথায় ঘটবে, তা কেউ জানে না। 
 
যেমন গত দু’দিন আগেও শোভা জানতো না, হাসপাতালের পথে বাসা থেকে এটাই ওর জীবনের শেষ যাত্রা। আর কোনদিন সে বাসায় ফিরে আসতে পারবে না। একমাত্র পুত্র পিয়ালকে বুকে জড়িয়ে ধর‍তে পারবে না। সংসার, আদরের সন্তান, এই বর্ণিল পৃথিবী ফেলে ওকে বিদায় নিতে হবে। 
 
করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত শোভার দেহ সৎকারের অপেক্ষায় আরো অনেক মৃত দেহের সঙ্গে লাইনে পড়ে আছে। নিউইয়র্ক শহর তথা গোটা বিশ্বে মৃত্যুর মিছিল চলছে। এত এত মৃতদেহ, হাসপাতাল, ফিউনারেল হোম, সর্বত্র শোকে ভেঙে পড়েছে সবাই। বাতাসে হু হু কান্নার ধ্বনি।  
 
নভেল করোনা ভাইরাস বা কোভিড -১৯ এর বিস্তার রোধ করার অন্যতম উপায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার অংশ হিসেবে, সীমিত আনুষ্ঠানিকতায় শোভার দেহ সমাধিস্থ করার সিদ্ধান্ত  ইতিমধ্যেই চূড়ান্ত হয়ে গেছে। 
 
মায়ের মুখ দেখার জন্য, মাকে একটু স্পর্শ করার জন্য শোভার একমাত্র সন্তান পিয়ালের আহাজারিতে আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ হলেও দেখার কোন সুযোগ নেই। মায়ের মুখ শেষবারের মতো দেখতে না পারার কষ্টে, পিয়াল মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে মারাত্মকভাবে। দুনিয়ায় সবকিছুর মোটামুটি একটি নিয়মনীতি জানা থাকলেও এই করোনা ভাইরাসের নির্দিষ্ট কোন ধর্ম এখনো জানা যায় নি। এই মহামারি ভাইরাস মা থেকে সন্তানের কাছে যায়, সন্তান থেকে মায়ের কাছেও আসে। আপন পর মানে না। ধনী-দরিদ্র, রাজা- উজির কাউকে ছাড় দেয় না। টিকে থাকার একমাত্র উপায় দূরত্ব মেপে চলা।  দূরে থাকা। অদৃশ্য এই ভাইরাস আপনজনদের মাঝখানে দূরত্বের এক অদৃশ্য রেখা এঁকে দিয়েছে। মনের গভীরে ঢেলে দিয়েছে একরাশ অন্ধকার।   
দেহ এবং আত্মা দুটো আলাদা জিনিস। দেহ মরে যায়, পঁচে যায়। দেহ লোকালয় হতে বিচ্ছিন্ন হয় কিন্তু আত্মা বিচ্ছিন্ন হয় না। শোভার মৃত্যু তাকে পরিবার, সন্তান থেকে আলাদা করে দিলেও, তার আত্মা সবার মাঝেই ঘুরছে। দেহ থেকে আত্মা সরে যাওয়ার পর থেকে শোভা সবাইকে দেখছে, সবকিছু দেখছে, কিন্তু ওকে কেউ দেখছে না। 
 
পিয়ালের কষ্টে শোভার মন পুড়ছে। জীবনের কঠিন অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতার দিনগুলোতে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ও বেঁচে ছিলো। নিজে কষ্টে পুড়ে ছাই হলেও কোনদিন ছেলেকে কষ্ট দেয় নি। কত স্বপ্ন ছিল শোভার! ছেলে বড় হয়েছে, ছেলেকে নিয়ে ও বিশ্বের নানান দর্শনীয় জায়গাগুলোতে বেড়াতে যাবে। দায়িত্বের কাদাজলে নিমজ্জিত জীবন থেকে ছুটি নিয়ে প্রজাপতির মতো উড়ে উড়ে খুব আনন্দে বেড়াবে ছেলের সঙ্গে । নদী, পাহাড়ের কোল ঘেঁষে, রৌদ্র মাখা সবুজে পাখী হয়ে উড়বে। দিগন্ত ছোঁয়া নীল আকাশের বুকে, মেঘের নিচে সুখের ভেলায় সমুদ্র ছুঁয়ে পেজা তুলোর মতন উড়বে। পৃথিবী যখন চাঁদের আলোয় স্নান করবে, শোভা তখন ছেলের সঙ্গে আকাশে খই এর মতো ফুটতে থাকা তারা গুনবে। মা- ছেলে মিলে আনন্দের সাগরে হাবুডুবু খাবে। কত বর্ণিল স্বপ্ন ছিল চোখে। 
জীবন ওদেরকে সে সুসময় দেয় নি। এসব শুধুই আজ কল্পনা। আদতে, সুসময়ের সঙ্গে সম্ভবত মানুষের দেখা হয় না। সুসময় বিমূর্ত। সুসময়কে ধরা, ছোঁয়া যায় না। সুসময়ের আশায় মানুষ বেঁচে থাকে ; কিন্তু সুসময়কে  উপভোগ করতে পারে না।       
 
শোভার স্বামী আনোয়ার হোসেন একজন অন্য গোছের মানুষ। বিয়ের আগে শোভার ধারণা ছিল নেশা বলতে মদ-জুয়া এসবকেই বুঝায়, কিন্তু বিয়ের পর ও বুঝতে পারে মদ-জুয়া ছাড়াও জগতে আরো অনেক ধরণের নেশা রয়েছে। যে কোন নেশা-ই ভয়ংকর। একটি নেশা থেকে আরেকটি নেশা কোনভাবেই কম বিধ্বংসী নয়। প্রতিটি নেশাই জীবনের সুখ-শান্তি কেড়ে নেয়। আনোয়ারের অপ্রয়োজনীয় অর্থ সম্পদের নেশা কেড়ে নিয়েছিলো শোভার জীবনের সুখ-শান্তি, হৃদ স্পন্দন। 
 
অর্থের জন্য এমন নেশাতুর মানুষ শোভা আগে কোনদিন দেখে নি। আনোয়ারের একেবারে অপ্রয়োজনীয় অর্থের নেশা দেখতে দেখতে শোভার মনে হতো, অর্থ আনোয়ারকে কিনে ফেলেছে। ও আসলে অর্থের মালিক হতে পারেনি। কারণ অর্থ জীবনের জন্য, অর্থের জন্য তো জীবন নয়। 
যে অর্থ জীবনের সুখ কেড়ে নেয় সেটি আসলে অনর্থ! 
 
অর্থের পেছনে রাতদিন দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লান্ত  হয়ে পড়া আনোয়ার স্ত্রী- পুত্রের  খোঁজ রাখার সময় পেতো না একদম। সংসার বয়ে চলে প্রবাহমান সময়ের মতো। শোভার ব্যক্তিগত ধারণা-সংসার বিষয়টি সম্ভবত জীবনের একটা সময় এসে অভ্যাসে পরিণত হয়। তখন চাওয়া -পাওয়া গৌণ হয়ে পড়ে। বেঁচে থাকাটা মুখ্য হয়ে উঠে। 
 
শোভা আজন্ম ভালোবাসার কাঙ্গাল। বোধ জ্ঞান হবার পর থেকে ও স্বপ্ন দেখতো, আদর-ভালোবাসায় আগুন যেভাবে উনুনে জড়িয়ে থাকে, শ্যাওলা যেমন করে পুকুরের জলে ভেসে থাকে, ঠিক তেমনিভাবে সেও স্বামীর বুকে মিশে থাকবে। কিন্তু স্বামীর অপরিসীম ব্যস্ততার কাছে মুখ থুবড়ে পড়ে শোভার ইচ্ছেগুলো। একটা সময় এসে স্ব জ্ঞানে শোভা আর স্বপ্ন দেখতো না। জীবনকে ও ভাসিয়ে দিয়েছে সময়ের স্রোতে।  
করোনা ভাইরাস আতঙ্কে গোটা বিশ্ব যখন দুঃশ্চিন্তায় কাঁপছে, শোভা তখন  জীবন থেকে ছুটি পেয়ে সবার নাগালের বাইরে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্তে আনন্দে আছে। মুক্ত বাতাসে প্রাণভরে শ্বাস নিচ্ছে।  
 
ঘরের সঙ্গে লাগোয়া বারান্দায় আরাম কেদারায় বসে আনোয়ার কি যেন বিড়বিড় করে চলছে আপনমনে। শোভার মৃতদেহ শক্ত কফিনের আবেস্টনিতে পড়ে আছে। ওর আত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে বাড়ীর আনাচ-কানাচে, পরিবারের মানুষদের মাঝে। আনোয়ার কি বলছে তা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারছেনা ও। প্রচন্ড রাগী মানুষটাকে করোনা ভাইরাসের মত অদৃশ্য অনুজীবের কাছে নুয়ে পড়তে দেখে শোভা অবাক হয়। ওর বিস্ময় কাটে না। আজ শোভার আত্মা আনোয়ারকে খুব কাছে থেকে দেখছে। মূলতঃ তাকে চিন্তাগ্রস্ত দেখে ও পাশে যায়। আনোয়ারের মাথায় চুল নেই বললেই চলে। যে কয়েকটি আছে সেগুলোও ধবধবে সাদা হয়ে গেছে। চোখের ভারী চশমা দেখে বুঝা যায় কাচের পুরুত্ব অনেক বেড়েছে৷ উপরের মাড়ির দাঁতগুলো ঠিকঠাক থাকলেও, নিচের মাড়ির কয়েকটি দাঁত পড়ে গেছে। নকল দাঁত বসালেও স্পষ্ট বোঝা যায়। হাত, মুখের চামড়া ভেদ করে কালচে শিরা গুলো স্পষ্ট দেখা যায় বেশ দূর থেকেই। লালচে মুখ দেখে মনে হচ্ছে প্রেসার বেড়েছে। ওকে খুব ভীত দেখাচ্ছে। শোভার করুণা হয় ওর জন্য।  
 
শোভা আপনমনে ভাবছে-আত্মকেন্দ্রিক  মানুষ কী ভীত হয়? বাইরের জগতে অর্থের মোহে বুঁদ হয়ে থাকা আনোয়ার আজ মনের দিক হতে একলা হয়ে গেছে। শোভার জানামতে ওর এমন কোন স্মৃতি নেই যা এখন একটু স্বস্তি দেবে। সুখস্মৃতি গড়ার জন্য পাশের জনকে সময় দিতে হয়, যা ও দেয় নি। আজ হয়ত আনোয়ার জীবন বেলার শেষাংশে এসে একাকীত্ব উপলব্ধি করছে, কিন্তু ততক্ষণে বেলা যে ফুরিয়ে গেছে।    
 
আনোয়ারের এমন বেহাল দশা দেখে হুড়মুড়িয়ে শোভার অনেক কথা মনে পড়ে যায়। একটু জ্বর হলেই শোভাকে কি যে যন্ত্রণা দিতো। মাঝরাতে ক্লান্ত শোভাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে ফেলতো, ঘুমাতে দিতো না আর। কতক্ষণ বলতো পা টিপতে, কতক্ষণ মাথা, এমন করে শোভার আর ঘুম হতো না। 
কিন্তু শোভার শরীর খারাপে ও ভ্রুক্ষেপহীন থাকতো। শোভা একা একা খেতো, ঘুমাতো। ছেলেকে নিয়ে একা বাইরে বেড়াতে যেত। প্রথমদিকে এতে শোভার মন খারাপ লাগলেও পরের দিকে গা সওয়া হয়ে যায়; কিংবা অন্য কোন উপায় না থাকায় সহ্য করে নিতে বাধ্য হয়।
 
প্রকৃতি কখনো কাউকে ছাড় দেয় না। প্রকৃতি তার হিসেব কড়ায় গন্ডায় বুঝিয়ে দেয় সময়মতো। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত বিষন্ন পৃথিবীর মন খারাপের এই সময়ে, ঘরের সব বাতি নিভিয়ে অন্ধকারে বসে অনুশোচনার আগুনে জ্বলছে আনোয়ার। তার মুখে হাসি নেই, চোখে স্বপ্ন নেই, মনে শক্তি নেই। হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে এখন আইসোলেশনে আছে। 
 
বাড়ী-গাড়ী, অর্থ-বিত্ত সবকিছু থাকার পরেও কোনকিছু আজ প্রয়োজনে আসছে না তার। তাকে নিরাপত্তা দিতে পারছে না। সে উপভোগ করতে পারছে না। কিছুই তাকে শান্তি দিতে পারছে না। তার পাশে কেউ নেই। কবরস্থানের নিঃস্তব্ধতা ঘিরে রেখেছে তাকে আষ্টেপৃষ্টে। 
 
কোথাও কোন সমস্যা হলেই সব দোষ শোভার উপরে চাপিয়ে দেওয়া আনোয়ার আজ হতাশার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। তার সবকিছু  মুখ বুঁজে সহ্য করার মানুষ শোভা আজ ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। 
 
শোভা আজ জাগতিক সব হিসেব নিকেশের উর্ধ্বে। শোভার আত্মা মনের সুখে বসন্তের হালকা বাতাসে উড়ছে আর গলা ছেড়ে প্রিয় রবীন্দ্রসংগীত গাইছে –  “এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়, আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে, দেহমনের সুদূর পাড়ে হারিয়ে ফেলি আপনারে, গানের সুরে আমার মুক্তি উর্ধ্বে ভাসে…।”
সুর মুগ্ধ করে। শোভার সুরের মূর্ছনায় গলা মিলিয়ে গাইছে ভ্রমর, পাখি, প্রজাপতি। তিরতির বাতাসের শরীরজুড়ে তাদের সুর উড়ছে, খেলছে। গানপাগল শোভা কান পেতে বিভোর হয়ে শুনছে প্রকৃতির চমৎকার সুরেলা পরিবেশনা। 
 
সুরের ইন্দ্রজালে নিমজ্জিত শোভা, জোস্না ভেজা প্রান্তরে আচমকা পরিচিত কন্ঠস্বর শুনতে পায়। কে এভাবে আদর করে ডাকছে ওকে নাম ধরে! ও ব্যকুল হয়ে ছুটতে থাকে সে শব্দের পিছে পিছে। ও যত কাছে যায় শব্দ তত দূরে সরে। ভীষণ চেনা ঘ্রাণ এসে লাগে নাকে। বাবা-মায়ের গায়ের ঘ্রাণ শোভা এবার চিনতে পারে। বাবা-মায়ের বুকে যাওয়ার জন্য ও ছটফট করতে থাকে। 
রাতজাগা একটা পাখী শোভার সামনে দিয়ে উড়ে যায়, পাখীর ডানার বাতাসে ওর নাক থেকে বাবা-মায়ের ঘ্রাণ হারিয়ে যায়। বাবা-মায়ের কাছে  ওপাড়ে যাওয়ার জন্য ও অস্থির হয়ে উঠে, অপেক্ষার প্রহর গুণতে থাকে  তাঁদের  সঙ্গে বহুল আকাংঙ্খিত মিলনের জন্য। 
 
‘মৃত্যুর পর যত দ্রুত সম্ভব আমার লাশ বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিও, আমার বাবা-মায়ের কবরের পাশে আমাকে দাফন করো।’ 
 
মায়ের বলা কথাগুলো এবং মায়ের জীবনের শেষ ইচ্ছের কথা পিয়াল ভাবছে আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে অনবরত কাঁদছে। অনেক চেষ্টা করেও পিয়াল মায়ের মৃতদেহ বাংলাদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারেনি। করোনাক্রান্ত এই সময়ে এটি অনেকটা অসম্ভব। এখন বাংলাদেশ কোনভাবেই মৃতদেহ গ্রহণ করবে না। বিদেশ থেকেও যেতে দিবে না। পিয়ালকে হাউমাউ কাঁদতে দেখে শোভার কষ্ট হয়। পিয়াল খুব একা কাঁদছে। কেউ পাশে নেই স্বান্তনা দেয়ার। কেউ নির্জনে থেকে একা, আবার কেউ ভীড়ে থেকেও একা। শোভা নির্জনে একা, পিয়াল স্বজনে থেকেও একা। মা ছাড়া এই একাকী বৃত্তে পিয়াল যেন দ্রুত নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে, শোভা কায়মনোবাক্যে সে প্রার্থনাটি করে। পিয়ালের অশ্রু সাগরে শোভা ডুবে যেতে থাকে, একা এবং একা।
 
মৃত্যুর পর বাবা-মায়ের সঙ্গে পাশাপাশি চিরনিদ্রায় শায়িত হওয়া-এটি ছিল শোভার জীবনের শেষ ইচ্ছে। করোনা ভাইরাসের কারণে জীবনের শেষ ইচ্ছেটাও অপূর্ণ থেকে যেতে দেখে তার খুব খারাপ লাগে। মৃত্যুর আগে যেভাবে প্রচন্ড জ্বর এবং শ্বাস কষ্টের মাঝে একটু বাতাসের জন্য ছটফট করছিলো, তেমনিভাবে এখন শোভার আত্মা ছটফট করছে বাবা-মায়ের পাশে শায়িত হওয়ার জন্য। 
 
করোনা ভাইরাসের আধিপত্যের কাছে গোটা বিশ্বের ইতিহাস যেখানে বদলে যাওয়ার পথে, তখন শোভার শেষ ইচ্ছে যে আলোর মুখ না দেখবেনা, তা সে নিশ্চিত জেনে গেছে। ওর বুকের পাঁজর ভেদ করে  দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। অভিমান হয় আনোয়ারের উপরে। কত অনুনয় করে বলেছে, বাইরে না যেতে। বুঝিয়ে বলেছে, এইসব অবরুদ্ধ দিন একদিন শেষ হবে, আলোর দিন বেশি দূরে নয়, সহসাই খুলে দেয়া হবে সমস্ত শৃঙ্খল। আনোয়ার শুনেনি কোন কথা। লকডাউন মানে নি। প্রতিদিন বাইরে গিয়েছে, অফিস করেছে। ভাইরাস নিয়ে ঘরে ফিরেছে। শোভা সংক্রমিত হয়েছে। 
 
শক্ত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অধিকারী আনোয়ার, ছেলে পিয়াল বেঁচে গেলেও, দূর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পূর্ণ শোভা বাঁচতে পারে নি করোনার সঙ্গে যুদ্ধ করে। 
 
নিঃস্তব্ধতার বাহুতে চেপে রাত্রি আরো গাঢ় হয় চুপসে যাওয়া সময়ের আঙিনায়। শোভার বুকের গহীন হতে দীর্ঘশ্বাস মিছিলের মত সারিবদ্ধভাবে  বেরিয়ে আসে। অন্তর্দাহ বেড়ে চলছে। আকাশের দিকে তাকায় শোভা। খানিক আগের উড়তে থাকা হালকা মেঘেরা ঘন হয়ে আসে। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি নামে। 
এ কি শোভার দীর্ঘশ্বাস নাকি শুধুই বৃষ্টি! কে জানে!
 
শোভার তেষ্টা পায়। তবে এই তেষ্টা জলের জন্য নয়। ওর বুকজুড়ে অন্য তেষ্টা ভর করে। মন খারাপ হয়। শোভাকে যদি যথাসময়ে হাসপাতালে নেয়া হতো, হয়তোবা এই করোনা সময়ের দুর্দিনে ও বেঁচে যেত৷ ওর আফসোস হয় আজ জীবন এবং সুস্থ সময়ের জন্য। স্বাভাবিক সময়ে প্রাণ বিয়োগ হলে বাবা-মায়ের পাশেই তো শেষ ইচ্ছানুসারে শায়িত হতে পারতো। ইচ্ছেটিও পূর্ণতা পেতো। 
 
গভীর বেদনাবোধে নিমজ্জিত শোভার আত্মা কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে আপনমনে আওড়াতে থাকে-একলা আসা একলা যাওয়া, মাঝখানের সময়টুকু শুধুই ভ্রম, মায়া। কি তুচ্ছ এই মানবজীবন। অদেখা এক ভাইরাসের কাছে স্বঘোষিত শ্রেষ্ঠ মানুষ জাতি আজ বন্দী হয়ে পড়েছে। অতি ক্ষুদ্র এক শক্তির কাছে মানুষ কত অসহায়। তবুও তাঁদের দম্ভের শেষ নেই। 
 
রাতের নিকষ কালো অন্ধকার আস্তে আস্তে হালকা হয়ে আসছে। অন্ধকারের পাহাড় ডিঙিয়ে আলোর রেখে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। শোভা মুগ্ধ হয়ে পৃথিবীর বদলে যাওয়া রুপ দেখছে। তার বিদায়ী মুহূর্ত খুব সন্নিকটে। বিদায়ের মুহূর্তটি খুব কষ্টের, ভারী লাগছে। 
 
জীবনভর একা পথচলা,  জীবনের ভার একা বয়ে যাওয়া শোভা কেন জানি বিদায়ের মুহূর্তে খুব ভেঙে পড়েছে। নিজেকে সামাল দিতে পারছে না। প্রচন্ড অসহায় বোধ করছে। 
 
মায়া জিনিসটাই খারাপ। জীবন সবসময় নীরবে মায়ার খেলা খেলে যায়। জীবদ্দশায় মানুষ সবচেয়ে বেশি জড়ায় সম্পর্কে। সম্পর্ক মানে মায়া তৈরি হওয়া। জীবনে গড়ে উঠা সম্পর্কগুলো প্রয়োজন মেটাতে তৈরি হয়, সে প্রয়োজনকে মাকড়সার জালের মত বেঁধে  রাখে  মায়া। প্রয়োজন শেষ হয়ে গেলে সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়, পড়ে থাকে মায়া। 
পিয়াল মায়ের হাত ছাড়া খেতে চাইতো না, রাতে মায়ের হাতের আদর ছাড়া ঘুমাতো না। ঘরে ফিরেই মা মা বলে চিৎকার করে গোটা বাড়ীতে হৈ চৈ ফেলে দিতো। মা কে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেতো। একদিন পিয়াল বাইর থেকে ঘরে এসে দেখে মা বাথরুমে। ছেলের স্বভাব ঘরে ফিরেই মা কে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরা। ছেলের চিৎকারে শোভা বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে ভেজা কাপড়ে ওকে জড়িয়ে ধরে। পিয়ালের কাপড়চোপড় ভিজে যায়। এমতাবস্থায় মা- ছেলে একসঙ্গে হেসে উঠে। শোভার মনে পড়ছে সে মধুর দৃশ্যের কথা। 
 
মানুষ একমাত্র প্রাণী যাকে স্মৃতির ভারি বোঝা বয়ে বেড়াতে হয় জনমভর।
 
মা পাগল পিয়াল গত চার দিন থেকে মা কে ছাড়া একা একা বাঁচতে শিখে গেছে। মানুষের শোকের আয়ু খুব অল্প হয়। শোক, দুঃখ মানুষ খুব লম্বা সময় ধরে বয়ে বেড়াতে পারে না। বেশি সময় ধরে দুঃখ বয়ে বেড়ালে মানুষ বেসামাল হয়ে উঠবে। পরিস্থিতির সঙ্গে বদলে যাওয়া, স্বাভাবিক হওয়া মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট। জগতে কারো জন্য কিছু আটকে থাকে না। পিয়াল অঝোরে কাঁদছে বলে, বিদায়বেলায় শোভার খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু শোভা জানে কিছুদিন পর পিয়াল ভুলে যাবে তাকে; ঠিক যেমন করে মৃত্যুর কয়েক মাস পরে শোভা ভুলে গিয়েছিলো তার মা কে। 
 
অন্য আরো অনেকের সঙ্গে শোভার মৃতদেহ ছুটছে অচেনা গোরস্থানের পথে। বুকে আগুন জ্বলে – ছোটবেলায় মায়ের মুখে এই কথাটি শুনেছিলো শোভা। তখন কথাটির অর্থ না বুঝলেও বড় হয়ে বুঝেছে। বাইরের আগুন দেখা যায়, বুকের আগুন দেখা যায় না। উনুনের আগুনের চেয়েও বুকের আগুন জ্বালায় বেশি। বুকের আগুনে জ্বলে মানুষ শেষ হয়ে যায়। জীবন নামক শৃংঙ্খল থেকে অবশেষে শোভা মুক্তি পেলেও, বাবা-মায়ের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হতে না পারার কষ্টে ওর বুকে এই বিদায়ী মুহূর্তেও   আগুন জ্বলছে। আত্মা শেষ বেলায় এসেও ছটফট করছে। 
 
”একটি জীবন পোড়ে, শুধুই পোড়ে 
আকাশ মেঘ বৃষ্টি এবং ঝড় 
ফুলছে নদী যেন তেপান্তর 
চতুর্দিকে শীতল সর্বনাশে 
পেয়েছে যাকে পায়নি কোনদিনও 
একটি জীবন পোড়ে, কেবল পোড়ে
আর যেন তার কাজ ছিল না কোনো…”
 
পৃথিবী যখন শোভাকে বলছে –  বিদায়! 
তখন শোভার বুকের গহীনে ঝর্ণার মত শক্তি চট্টোপাধ্যায়ে’র কবিতাটি করুণ সুরে বাজতে থাকে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত