আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট
আজ ০২ সেপ্টেম্বর কবি ও কথাসাহিত্যিক আঞ্জুমান রোজীর শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।
জিসান দুর্দান্ত তার্কিক; বাকপটু এক ছেলে। সারাক্ষণ পড়াশোনাতে ডুবে থাকা যার নেশা! লেখালেখিতে সিদ্ধহস্ত! যেকোনো বিষয়ে তার লেখালেখি ছিল প্রশংসাতীত। বামরাজনীতির একজন সক্রিয় কর্মীও সে। পার্টির জন্য নিত্যনতুন চিন্তা-চেতনা নিয়ে গবেষণামূলক লেখায় এবং বক্তৃতায় জিসান ছিল দুর্দান্ত পারঙ্গম। তার সম্মোহনী ক্ষমতায় সবার দৃষ্টি পড়তো খুব সহজে। জীবনের একটাই লক্ষ্য ছিল তার– মানুষের মাঝে সমতা ফিরিয়ে আনা। কোনো বৈষম্য থাকতে পারবে না। সমবণ্টনের রাষ্ট্র; অর্থাৎ সমাজতন্ত্রের বাস্তবায়ন দেখা ছিল তার প্রাণের স্বপ্ন। তারজন্য জিসান নিবেদিত প্রাণ-মন নিয়ে রাতদিন খেটে কাজও করে যাচ্ছিলো! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় পড়াশুনার পাট চুকিয়ে পুরোদমে সমাজতান্ত্রিক পার্টির জন্য কাজ শুরু করে দেয়।
সমাজতন্ত্রের বিষয়গুলো এবং ধারণাগুলো জিসানকে খুব ভাবাতো। সেই অনুসারে মৌলিকেও বিষয়টা বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে যেত। যদিও মৌলি এসবের ধারধারে না। কিন্তু জিসান চাইতো, কেউ একজন তার পাশে বসে তার কথাগুলো মন দিয়ে শুনুক এবং বুদ্ধি পরামর্শের এক আশ্রয়স্থল হোক। অথচ মৌলি ছিল অন্যধাঁচের চিন্তা-চেতনার মানুষ; বলতেগেলে, অনেকটাই রক্ষণশীল। তারপরেও জিসাল হাল ছাড়েনি। নিবিষ্ট চিত্তে সমাজতন্ত্রের বিষয়গুলো বলেই যেত। আর মৌলিও বিরক্তভরা মন নিয়ে কান পেতে বসে থাকতো। জিসান বলতে শুরু করে, “সমাজতন্ত্র এমন একটি সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা; যার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে উৎপাদনের উপকরণে সামাজিক মালিকানা এবং অর্থনীতির একটি সমবায়ভিত্তিক ব্যবস্থাপনা।”
মৌলি কথা শুনছে এমন একটা ভাব করে জিজ্ঞেস করে, “তারপর?” জিসান আবার শুরু করে, “একইসঙ্গে এটি একটি রাজনৈতিক মতবাদ এবং আন্দোলনও। যার লক্ষ্য হচ্ছে– এমন একটি সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা; যেখানে সম্পদ ও অর্থের মালিকানা সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন; অর্থাৎ কোনো ব্যক্তিমালিকানা থাকবে না। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনসাধারণের প্রয়োজন অনুসারে পণ্য উৎপাদন হবে এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে একটি দেশের কলকারখানা, খনি, জমি ইত্যাদি সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি হিসেবে পরিগণিত হবে।”
মৌলি হাফ ছেড়ে বলে উঠে, “বাব্বাহ! কী কঠিন বিষয়! সবকিছু মাথার উপর দিয়ে চলে গেলো।” জিসান অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, ” কি বলো, বুঝোনি? শুনো, তাহলে আবার ‘বলছি’। কিছুক্ষণ চুপ থেকে মৌলির দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘বলবো?’ মৌলিও জানে জিসানের কথা মন দিয়ে শুনা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। তাই মাথা এলিয়ে নিরব সম্মতি জানায়। জিসান বলতে শুরু করে,”সমাজতন্ত্র ব্যক্তিগত মালিকানার উৎখাত ঘটায় এবং মানুষে মানুষে শোষণ, অর্থনৈতিক সংকট ও বেকারত্বের বিলোপ ঘটায় এবং উন্মুক্ত করে উৎপাদন শক্তির। সমাজতন্ত্রে সামাজিক উৎপাদনের লক্ষ্য হলো; জনগণের সচ্ছলতা বৃদ্ধি ও সমাজের প্রতিটি মানুষের সার্বিক বিকাশ সাধন। অর্থাৎ সমাজতন্ত্রের মুলনীতি হলো; প্রত্যেকে কাজ করবে তার সামর্থ্য অনুযায়ী এবং প্রত্যেকে গ্রহণ করবে তার প্রয়োজন অনু্যায়ী।” মৌলি হঠাৎ করে হাতপা ঝেড়ে বলে ওঠে, ” আর পারছি না নিতে। মাথা ভারী হয়ে গেছে। চলো অন্য কোথাও যাই।” জিসান হতাশ দৃষ্টিতে মৌলির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়। কোনো কথা না বলে বিফল মনোরথে মৌলির পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করে।
জিসানের স্বপ্ন, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের। এর উপরেই তার বিশ্বাস ছিল প্রবল। ছাত্রজীবন থেকে জিসানের অধ্যাবসায়ের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল এমনই, যা তার আরাধনাও ছিল। লেলিনবাদ, মার্ক্সবাদে আক্রান্ত হয়ে জিসান এমন স্বপ্নে বিভোর থেকে দেশটাকে স্বপ্নরাজ্যে কল্পনা করে যেতো। এই বিষয় নিয়ে জিসান গবেষণামূলক কাজও চালিয়ে যাচ্ছিলো। তার সব লেখাতে এর প্রতিফলন ঘটতো চূড়ান্তভাবে । কিন্তু দিনের পর দিন জিসানের চিন্তাশক্তিতে ভাটা পড়তে লাগলো। সময় খুব খারাপ যেতে শুরু করলো। এমন মানসিকতায় ঘোর লেগেছে যেনো। কোনো এক অমাবস্যা এসে ছেয়ে দিচ্ছে সবকিছু। কোনোকিছুতেই মনটাকে স্থির করতে পারছে না। এক অসহনীয় যন্ত্রণা শরীর, মনকে ঘিরে আছে। জিসানের ভেতর এতদিন যে ইচ্ছাশক্তি প্রবলভাবে কাজ করছিল, তা আজ ঝিমিয়ে পড়ছে। আত্মবিশ্বাস ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে। যে প্রগতির পথ ধরে এতদিন হেঁটেছিল আজ তা ধীরেধীরে অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কেন? কেন এমন হচ্ছে? আজকাল কিছু উদ্ভট প্রশ্ন জিসানকে অস্থির করে তোলে । সেসব প্রশ্নের কোনো উত্তরও খুঁজে পায় না ।
মৌলিকে পাওয়ার পর থেকেই জিসানের ভেতর বিরাট পরিবর্তন আসে। একধরণের অন্যমনস্কতা জিসানের উপর ভর করে। মৌলি ডানপন্থী ঘরানার মেয়ে। চিন্তা-চেতনায় কিছুটা রক্ষণশীলতা থাকলেও অবলীলায় মিশে যেতে পারতো সকল মতাদর্শের মানুষের সঙ্গে। সাবলীল আচরণে মানুষকে কাছে টানার এক অলৌকিক শক্তি ছিল তার। তার ওপর অপূর্ব সুন্দরী এবং বিদুষী। পিঠে খোলাচুল এলিয়ে, মিষ্টি হেসে আলতো করে ছুটে চলা এক শরতকন্যা। শরতের আকাশের মতই স্বচ্ছ; নীলাম্বরী আদরমাখা তার পুরো মুখোয়বে।
প্রথম দেখাতে জিসান মৌলির প্রতি মোহগ্রস্থ হয়ে পড়ে। পাবলিক লাইব্রেরির সামনে জটলা পাকানো লোকের ভিড়ে মৌলিকে মনে হচ্ছিলো সদ্যফোঁটা রজনীগন্ধা। সাদা শাড়িতে অপ্সরীর মতো লাগছিল। এতো ভিড়ের মাঝেও অন্যরকম, অন্যরূপা। জিসান আগ বাড়িয়ে কথা বলতে গিয়েও বলেনি। কিছুটা লাজুক প্রকৃতির বলে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিল। কিন্তু বুকের ভেতর ঠিকই কাল বৈশাখী ঝড় বয়ে যায়। কথার ফুলঝুরি চারদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে মৌলি। কী নিয়ে এতো কথা বলছে? জটলা পাকানো মানুষগুলোও খুব মন দিয় শুনছে তার কথা। জিসান কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। শুধু দূর থেকে পলকহীন চোখে মৌলিকে দেখতে থাকে। এভাবে প্রতিদিন মৌলিকে একটু দেখার জন্য পাবলিক লাইব্রেরির সামনে অধীর হয়ে অপেক্ষা করতে শুরু করে । কে মৌলি, কোথাকার মৌলি জিসান তার কিছুই জানে না।
মৌলি আসে বিকেলে বিকেলে। ধীরেধীরে জিসানও বিকেলের কাছে নিজেকে সমর্পন করে দিলো। এমনি করে একদিন জিসানের অপেক্ষার প্রহর ভেঙ্গে গেলো। মৌলি ধীরেধীরে পা বাড়িয়ে জিসানের কাছে আসে। তার স্বভাবসুলভ মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে বলে,” আপনি জিসান চৌধুরী!
পত্রিকায় আপনার কলামগুলো নিয়মিত পড়ি। খুব ধারালো যুক্তি দিয়ে লেখেন বটে!” জিসান এমন কথা মৌলির মুখে শুনে একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। আনত-নয়নে স্মিতহাস্যে বলে, “আরে না, এমনকিছুই না।” মৌলিও আগবাড়িয়ে একডিগ্রী গলাউঁচু করে বলে, “কিছুই যে না; তাতো আমি ভালো করেই বুঝতে পারছি।” এই বলে পাবলিক লাইব্রেরির ক্যান্টিনের দিকে পা-বাড়িয়ে বললো, “চলুন, চা খেতে খেতে কথা বলি।” লোভনীয় প্রস্তাবে জিসান সাড়া দিয়ে মৌলির সাথে পা মিলিয়ে হাঁটতে শুরু করে। এর পরেই প্রতিদিন পাবলিক লাইব্রেরীর সিঁড়ি থেকে শুরু করে ওদের গন্তব্য হয়ে যায় দূরে কোথাও, যেখানে হারিয়ে যাওয়ার সুপ্ত বাসনা উঁকিঝুঁকি দেয়!
একমাসের মাথায় জিসানের সাথে মৌলির মতের অমিল হতে শুরু করে। মৌলি বলে, “পুঁজিবাদী সমাজে সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখা একটি অলীক ব্যাপার বটে। সমতার রাষ্ট্র এই তৃতীয়বিশ্বে যে সম্ভব না; তা তোমার মতো স্বপ্নবাজেরা কখনো বুঝবে না।”
জিসান ঠিক ততটাই জোরগলায় বলতো, “স্বপ্ন একদিন বাস্তবায়ন হবেই।” তাদের দুজনের কথোপকথনে কখনই কোনো সমাধান আসতো না। যুক্তিতর্কের মারপ্যাঁচে কেউ যেনো কারো কাছে হার মানছে না। জিসান যেখানে উদার মানসিকতা নিয়ে পৃথিবীটাকে দেখতে চায়; সেখানে মৌলি ততই জিসানকে চারদেয়ালের মাঝে বন্দী করতে চায়। গোঁড়া রক্ষনশীল মানসিকতা আর প্রথা মেনে চলা মৌলি জিসানের অনেক কথার অর্থ খুঁজে পেতো না। এতে জিসান খুব হতাশ হলেও মৌলি কিন্তু হাল ছাড়ছিলো না। তারপরেও তাদের সম্পর্কের রেশ থেকেই যেতো।
এভাবে চলতে চলতে জিসানের ভেতর একধরণের আবেগের মোহ কাজ করতে শুরু করে। কাণ্ডজ্ঞান মাঝেমাঝে লোপ পেতে থাকে। কারণ, মৌলির চুলের গন্ধ আর শরীরের উষ্ণতা জিসানকে উতলা করে দিতো। জিসান আর মৌলির টানাপড়েনের সম্পর্ক এভাবে আরো বছরখানেক গড়ালো। এরমধ্যে জিসানের কিছু বন্ধু মৌলির ব্যাপারে সাবধানও করেছিলো। বলেছিল, “এই মেয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডের মেয়ে, সাবধানে থাকিস।” কিন্তু জিসান মৌলির ক্যামিস্ট্রিতে আষ্টেপৃষ্ঠে আটকা পড়ে গেলো। ভুলে গেলো তার এতদিনের চিন্তা-চেতনা ও সাধনার ফসল বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কথা। ভুলে গেলো নিজ অবস্থানের কথা। বিসর্জন দিলো নিজ ব্যক্তিত্ব। শুধু মৌলিকে কাছে পাওয়ার জন্য। ঠিক তখনই মৌলি বিগড়ে গেলো। জিসানের অবুঝ মন মৌলিকে আরো কাছে পেতে পাগলপ্রায় হয়ে যায়। ওদিকে মৌলিও ধীরেধীরে দূরে সরতে থাকে। এমনি করে একদিন মৌলি বলেই ফেললো,
-শোনো, সমাজতন্ত্র, সমাজতন্ত্র করে জীবন চলবে না। জীবনের জন্য চাই আরো অনেককিছু।
জিসান একরকম অস্থির হয়েই জিজ্ঞেস করলো,
-কী কী করতে হবে বলো!
-সেটা তুমি বুঝবে না। তোমার মাথায় তো শুধু সমাজতন্ত্র, সমাজতন্ত্র। জীবনের জন্য আরোকিছুর যে প্রয়োজন আছে, তা তোমার মাথাতেই নেই।
বলেই ঝাপটামেরে উঠে দাঁড়ালো। বললো,
-আমাকে আর খুঁজবে না। আর কখনো যোগাযোগ করবে না।
বলেই দ্রুতগতিতে পা চালিয়ে চলে গেলো। আর জিসান হতবিহ্বল হয়ে মৌলির চলে যাওয়ার দৃশ্য দেখতে লাগলো।
তারপর থেকে জিসান, মৌলির আর দেখাসাক্ষাৎ নেই। এদিকে জিসানের পুরো পৃথিবী শূন্য হতে শুরু করে। চারদিকে দিকভ্রান্ত দৃষ্টি মেলে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে শুধু। এখন সে অপ্রকৃতিস্থ। হঠাৎ করে পাওয়া প্রেম জিসানকে যে এতটা এলোমেলো করে দিতে পারে; তা তার বন্ধুরাও ভাবতে পারেনি।
জিসান মানসিক হাসপাতালে বন্দি। মৌলি মূলত এসেছিল জিসানের চিন্তা-চেতনার জায়গায় খড়গ বসাতে। মনোরাজ্যে বসে কুপিয়ে কুপিয়ে নস্যাৎ করে দিলো সমাজতন্ত্রের স্বপ্নজাল। ডানপন্থী গ্রুপের এজেন্ট হয়ে মৌলি একাজ করে গেলো। আর জিসান বাকহীন হয়ে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে সময় কাটায়। যেন মধ্যাহ্নের সূর্য মধ্যাহ্নেই ডুবে গেলো।
১৯৯২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। বর্তমানে তিনি কানাডা প্রবাসী। এ পর্যন্ত তার তিনটি কবিতাগ্রন্থ এবং একটি গল্পের বই প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম কবিতার বই, ‘এক হাজার এক রাত’ (২০১১), এবং গল্পের বই ‘মূর্ত মরণ মায়া'(২০১২) সাকী পাবলিশিং ক্লাব থেকে প্রকাশিত হয় । ২০১৩ ও ২০১৫ তে নন্দিতা প্রকাশ থেকে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় কবিতার বই ‘বৃষ্টির অন্ধকার’ এবং তৃতীয় কবিতার বই ‘নৈঃশব্দ্যের দুয়ারে দাঁড়িয়ে’। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি আবৃত্তি শিল্পের সাথেও জড়িত আছেন। বাংলাদেশের আবৃত্তি সংগঠন- ‘কন্ঠশীলন’ এবং বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটারভুক্ত নাঠ্যসংগঠন- ‘নাট্যচক্র’র সাবেক সদস্য।
Related