আজ ১৫ জানুয়ারী কবি ভাগ্যধন বড়ুয়ার শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।
নদীর নিজস্ব ঘ্রাণ
মাতামুহুরীর কথাই বলছি;যার একান্নবর্তী সংসার ভরে আছে জল, জাল, মাতাল তরঙ্গ আর প্রবহমাণ করতালি।…রাত যখন ক্রমশ আঁধার হয়ে আসে তখন অস্পষ্ট স্বর নিরবতায় মাদক ঢালে আর ঢুলুঢুলু চোখে চারদিকের আয়োজন দেখে; ভয় নাকি পরাজয়!… বেদনা না প্রণোদনা!
কারা সঙ্গ দিতে আসে রাতে নদীর বুকে? তারা, সংসার বৈরাগী, ঘর ভাঙ্গা মানুষ নাকি আত্মহন্তারক? যার যার মতো সময়ের বিন্যাসে আসে তারা, জলতরঙ্গে ভাসে; কাঁদে বা হাসে!…তার পরের হিসাব নদীও মনে রাখে না।
তবে প্রতি শীতের সকালে নদী তার নিজস্ব ঘ্রাণে বাস্প বানায় আর জানান দেয়; সারারাত ধরে প্রবাহিত পাঁজরের তাপ।
রাতের সঙ্গম শেষে শীতের ভোরে যারা মাতামুহুরীর জলে স্নান সেরেছেন তাদের শরীরে অনুভূত তাপই সাক্ষ্য দিবে নদী ও নারীর ঘ্রাণ সম্পূর্ণ মৌলিক।
চোরাবাঁশি
বাঁশিও তরঙ্গ তোলে জলে আর মনে
চোরাবাঁশি টান মারে বেনামী প্রহরে
প্রকাশ্যে নিখুঁত দেহ ভেতরে অঙ্গার
বনের আগুন যেন বাতাসের বেগে জ্বলে !
সন্ধ্যায় একাকী হলে মনোব্যথা জাগে
নীরব কম্পন তোলে সুরের মায়ায়
এমন আনন্দী রাগ আগেতো শুনিনি
এমন পাঁজর নাড়া কখনো বুঝিনি!
জলের আয়নায় দেখি তার মুখ ভাসে
কাঁপা কাঁপা ঢেউ মিলে চোখ-মুখ-ছবি
যত চাই জোড়া দিতে ততই তরঙ্গ
তৃষ্ণার্ত দরিয়া রাগে অসহ্য জোয়ার!
গভীর আকুতি জমা অন্তরিক্ষ মাঝে
বাঁশির বয়ান লিখি কাগজের ভাঁজে
আঁচলের গিঁট
চাল নেই বাজার নেই; মায়ের গলায় এই রেওয়াজ শুনতে শুনতে বড় হয়েছি অভাবের গৃহছায়ায়; মনে হতো আমার মা পৃথিবীর সেরা অভাবী আর আমার বাবা স্বীয় স্বভাবে এইসব কথা এক কান দিয়ে ঢুকায় আর অন্য কান দিয়ে বের করে। টানাটানির সংসারে কোন কিছুই বেশী ছিল না বলে যা খাবার পেতাম কম কম করে মিলেমিশে সবাই মজা করে খেতাম ধীরে ধী…রে শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত; শুনেছি অভাবের টানে মমতা বাড়ে। কিন্ত এখন তা বিশ্বাস করি…
এখন অভাবহীন সংসারে বাবার অভাবেই দিন কাটে আর আমার মাকে আর বলতে শুনি না তেল নেই নুন নেই!
সংসারের চাবি বণ্টন হতে হতে মায়ের হাতে শুধু আঁচলের গিঁটটাই রয়ে গেছে যেখানে মায়াবন্ধনে বেঁধেছিল পুরো
অভাবী সংসার…
কর্ণফুলি
কর্ণফুলি’র দু’পাড় জানে গল্প-গাথা কানের দুল
জলই জানে অতল কত চোরাবালি মনের ভুল।
নদীর বুকে এলো গেল উজান-ভাটা জোছনা-ভোর
সাম্পান নাইয়া টেনেই চলে বৈঠা হাতে স্বপ্ন-সুর।
পাহাড়-সাগর মিলন হলে জন্ম হবে ভাটির গান
কিনার ধরে নরম কাদায় বপন করি মায়াটান।
চন্দ্রাবতীর নয়নজলে কম্প তোলে ভরা বুক
লুসাই পাহাড় মুক্ত মুড়া অশ্রুজলে বাড়ায় দুখ।
ভাটির দেশে চরাচরে আমার বাড়ি মায়ের ডাক
পুষ্পভদ্রা গতিপথে নাম হারিয়ে ভিন্ন বাক।
শ্যামের গলা স্বাক্ষী রেখে বাঁশি তোলে জলের গান
দূরে গেলে কালুর ব্রীজ মনে তোলে কলতান।
শীতের সই কাল
গত শীতে আমার সই ছিল; এই বছর শীত কই! দূর্বাঘাসের সাথে শিশিরবিন্দুর যৌথজীবনের মতো রৌদ্রযাপন কালে দেহে তরঙ্গ তুলেছিল তাপ, মনোমিটারের লাফালাফি তখনও থামেনি; তারপরের পরিণাম জেনে গেলে চোখে কুয়াশা প্রাচীর।
শীত মানে সই কাল; যুথবদ্ধ প্রণয়ে লেপের ওম।
স্কুল সিরিজ: এক
স্কুলের দপ্তরি যখন শেষ ছুটির ঘণ্টা বাজাতেন তখন শুরু হতো আমার প্রেমের প্রস্তুতি; তোমার হাতের সংকেতে বুঝে যেতাম সময় ও আস্তানা। নলকুপের মুখে হাত-মুখ লাগিয়ে এক ঢোক জল পান করে বন্ধুদের অগোচরে ছুটে যেতাম মাতামুহুরীর পাড়ে। তুমিও দেবীর মতো গাছের আড়াল থেকে বের হয়ে আমাকে অবাক করে দিতে ; আলিঙ্গনে যেতে হাত বাড়ালে তুমি ভরশূন্য বেগে বুকে জড়াতেই তরঙ্গিত হতো রক্তস্রোত। উড়ন্ত দিনের এসব কাহিনি নিচু থেকে উঁচু ক্লাসে খুব দ্রুত রটেছিল আর দেয়ালে দেয়ালে অজানা ঈর্ষায় শোভাবর্ধন করেছিল বি প্লাস ডি হোল স্কআর; তখন সবেমাত্র বীজগণিত পড়া শুরু করেছি, জ্যামিতির পরিমিতিবোধে সন্নিহিত মন তখনও ভালমতো রপ্ত করিনি !
একদা স্কুলের পাঠ শেষ হলো;
এখন মনে গেঁথে আছে শুধু হোল স্কআর আর ছুটির ঘণ্টা…
মাতামুহুরী ; প্রাণে ও বানে
মাতামুহুরীর পাড় ভাঙ্গে;
ক্ষেত্রপাল মন্দিরের শরীরে কামড়
মন্ত্রপাঠ ভেসে গেলো ঢেউতোলা জলে
বিগত বানের ক্ষত এখনও শরীরে;
উঠোনে বকুল বৃক্ষ শোকের প্রতীক
জলস্রোতে মুছে ঘর-গ্রাম-হাজিয়ান বিল
যে জল খোরাক দিতো উপোসের মাসে
সে জল অভুক্ত রাখে বরষার রোষে
জলে ডুবে পলিমন। শীতার্ত বসতি!
মাতামুহুরীর বুকে;
কদলীভেলায় ভাসা নদী পার বেলা
মেলা শেষে হেসে খেলে ভিজে হই সারা
বালুচরে বালি খুঁড়ে বানাতাম কুয়া
জলের আয়না জানে ঋতুর ম্যাজিক!
মাতামুহুরীর দুঃখ;
ঘুনিয়া বিলীন হলো খুনিরূপ বানে
বদরের বিল বলে কিছু নেই আর
মৈষের দইয়ের হাট পুঁথির পাতায়
ব্রিটিশের ব্রিজ ভাঙে ক্ষয়-বেদনায়!
কতো বান এলো-গেলো জানের ওপর
তবুও টানে ভরসায় মাতামুহুরীর চর
জীবন বাঁধা গোলকধাঁধায়
জীবন বাঁধা ;
নাড়ির কাছে দাঁড়ের কাছে
পার হতে হয় পথের নদী
অজানাতেই অতিক্রান্ত কয়েক ক্রোশ
থামলে শুরু গদ্য-পদ্য-কান্না-হাসি;
জোয়ার-ভাটার গতি-নীতি পরিণতি
একটু হোঁচট, কপাল মাপে রাশিফলে।
জীবন বাঁধা ;
গোলকধাঁধায়
মরীচিকা, চিকার আওয়াজ
রক্তশূন্য পাণ্ডুলিপি, রক্ত ভাসে পদ্মা জলে
ছেঁড়া নাড়ি আঁধার রুমে ভস্মীকৃত ছাইয়ের ঢিবি
খবর বেরোয় গল্প-চিত্রে চিত্রকল্প পরাভূত
আশা নড়ে কচুপাতার জমা জলে অস্থিরতায়!
জীবন বাঁধা ;
প্রীতির কাছে,জন্মজালে
সবই নয়তো চড়ুইভাতি!
স্বপ্নগতি কাঁপুনিতে ছিন্নভিন্ন লুপ্ত বয়ান
হবেই যদি
কোথায় যাবো নির্ভরতায় ঝড়ের রাতে-সুনামীতে
বটবৃক্ষের ছায়া কোথায় রক্তধারায়?
হাত-পা বাঁধা ; নীরবতা
গোঙানিতে ফেনা বাড়ে সাগরজলে…
জীবন বাঁধা ;
ঘরের উঠোন,জন্মভিটায়
তুলসীতলায় জোনাক আলোয়
একটু জিরাই, মুক্তবাতাস
যুক্ত করি জীবনধারায়!
অরণ্য আশ্রম
কান খাড়া করে বার্তা শুনি
শিশিরের রাত জাগা পাতার বয়ান
বৃক্ষ কথা,আশ্রিত পাখির কথা
তক্ষকের কথা,জোছনার কথা
ঘরহারা, ঘরছাড়া মানুষের কথা
গোলীয় বৃত্তের একপ্রান্তে দাঁড়াই
আর দৃষ্টি প্রক্ষিপ্ত করি দূরের সীমায়
সন্দেহভর্তি অন্ধকার ;
অগ্রসর আমার দিকে গোঁয়ার শুয়োরের মতো!
আমিও আশ্রয় খুঁজি অরণ্য গভীরে
স্টেশন
শুরুতে স্টেশন আর শেষে প্লাটফর্ম ।
যেতে হবে অগোচরে
কিন্তু হর্ন ব্যক্ত করে আগমন ও অতিক্রমণ।
সবার যাত্রার অভিমুখ স্টেশনের দিকে…
কী হয় সেখানে!
জানার বাসনা যাদের তাদের বলে রাখি এই সুযোগে ;
সবই হয় স্টেশনে – পরিচয়, প্রেম, প্রসাধন,
পরিণয় কিংবা সিনেমার শেষদৃশ্যের শেষ পরিণতি…
ইমোশনটা বেশি বাড়ে স্টেশনে
তাই রিলেশানটা রিলে দৌড়ের ক্রীড়াবিদের মোশন ;
হুইসেল.. গতি…সীমারেখা…সময়ের কাউন্ট ডাউন সবই!
শুরু কিংবা শেষে স্টেশনের টেনশান বাড়ে
কারণ শুরুটা ইতিহাস
আর শেষটা বিদায়ের বেদনা কিংবা নিষ্ঠুর পরিহাস…
ইশারায় আশা
ফিরে যেতে যেতে দ্বীপ ছোট হয়ে যায়
ক্ষত ছোট হতে থাকে দিন পার হলে
দুরত্ব বাড়ালে হয় পুরুত্বের ক্ষয়
গুল্মলতা তোলে ঢেউ বুকের বদ্বীপে…
তালিকা চিহ্নিত করে উপস্থিতি নাম
কালের পাথর জানে আমিও ফসিল
সরে যাও দূরে যাও; সবাই বদ্বীপ
একাকী নক্ষত্র তোলে প্রতিবিম্ব জলে
সমুদ্রফেনার নুন বেদনায় গড়ে ঢেউ
কেউ মিশে যায় জলে কেউ মিলে যায় ভুলে
মনে থেকে যায় লবনের ধক অতীত সুদিন
জলকলমী ফুলগুলো ডাকে ; ইশারায় আশা!
বিন্দু মায়া রয়ে যায় ছোট তারা হয়ে
চুমকির ঝিলিক আর বেদনার্ত চর ;
বালিবুকে জমা রাখে পদচ্ছাপ,
হাতে আঁকা প্রিয় নাম
…গোলাপ পাঁজর আর চোখের কাজল!
দুরত্ব কমে না আর…
রূপান্তর
জীবনসমগ্র থেকে ক্রমান্বয়ে সরে যাই
কুয়াশায় ঘেরা ;
জবা রাঙা ভোর, সোনালু দুপুর, ধূপজ্বালা সন্ধ্যা।
নগর মালীকে বিনয়ে জানাই
খুব ভোরে এত ফুল গেল কই?
অদ্ভুত বিস্ময়ে জানালো সে,
প্রশ্ন অবান্তর !
দেখো দেয়ালে
শরমে কুঁকড়ে আছে
পলিথিনে মোড়া প্লাস্টিক গোলাপ!