| 19 এপ্রিল 2024
Categories
গদ্য সময়ের ডায়েরি

বিজয় দিবস : জিতে আসা মানুষের দিন

আনুমানিক পঠনকাল: 2 মিনিট

একটা মুখ। অপমানে আতঙ্কে কালো হয়ে গেছে। অনিশ্চয়তায় উদভ্রান্ত তার চোখ। মৃত্যু-রক্ত-বিভৎসতা-আর্তনাদে সে বধির। স্থবিরও। সেই মুখে হঠাৎ জেগে উঠলো একটা স্বস্তির রেখা, আতঙ্কের কালো পর্দা ফাঁক করে সন্দেহ আর অবিশ্বাস মাখা একটুকরা আশা এবং তালা লাগা কান হঠাৎ খুলে যাওয়ার পরে যে উচ্চকিত পৃথিবী সামনে এসে দাঁড়ায়—তার মতো একটা দিনের আভা। এই দিনটাই আমাদের বিজয় দিবস।

বিজয় দিবসে আমি আনন্দের চেয়েও বেশি কান্না দেখি, মুক্তির চেয়েও বেশি যন্ত্রণা দেখি, শব্দের চেয়েও বেশি নিঃশব্দকে পাই। একটা দমবন্ধ করা অবস্থা একটা দিনে কি কাটানো যায়? একটা শ্মশানে কি আনন্দের বাজনা বাজানো সম্ভব? তারপরও একটা অসম্ভব আতঙ্ক—যা এর আগে এইভাবে কখনো আমাদের জীবনে আসেনি—তার হাত ফসকে বেরিয়ে আসাটা স্বস্তি এবং আনন্দের বৈকি! তবে সেই আনন্দের স্বাদ নেবার ক্ষমতা সেদিন অনেকেরই ছিল না। ফলে বিজয় দিবস যখন প্রথমবার দেখা দিয়েছিল আমাদের জীবনে—তখন তাকে বিজয় দিবস হিসাবে চেনা ছিল খুবই কঠিন।

তারপর দিন গেছে, পার হয়েছে একটা একটা করে বছর আর আমাদের স্মৃতি থেকে বিদায় নিয়েছে আতঙ্ক, আর্তনাদ আর মৃত্যু-রক্ত-বিভৎসতার গন্ধ। সেইসাথে স্পষ্ট হয়েছে বিজয় দিবস এবং এর উজ্জ্বলতা। আমরা টের পেয়েছি এক বিরাট পালাবদল ঘটে গেছে ওই দিনটাতে—এমন এক পালাবদল যা আমাদের অস্তিত্বকেই দিয়েছে বদলে। আর এই উপলব্ধি আমাদের ভুলিয়ে দিতে পেরেছে বেদনার সবটুকু ব্যথা। ফলে আমরা আনন্দ করতে শিখেছি, গর্ব করতে শিখেছি, উৎসব করতে শিখেছি।

আরেকদিক থেকে যতোই দিন যাচ্ছে—বিজয় দিবস ততোই যেন নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছে। তার জন্মের দিনটাতে যেসব সঙ্গীসাথীকে সে পেয়েছিল—সেইসব ঘর্মাক্ত যোদ্ধা, স্তব্ধ হাতিয়ার, ধর্ষিত গ্রাম আর সব হারানো মানুষের দল—আস্তে আস্তে বিদায় নিচ্ছে তার চারপাশ থেকে এবং নতুন সময়ের নতুন মানুষেরা—যাদের কাছে সে একটা উপলক্ষ্য মাত্র, ভিড় বাড়ছে তাদের। এইসব নতুন মানুষের কাছে বিজয় দিবস মিউজিয়ামে রাখা একটা মমির মতো—বিস্মৃতির কাপড়ে জড়ানো একটা অনেক পুরানো শব, গবেষকরাই যার পরিচয় এবং অর্থ উদ্ধার করতে পারে। আর যারা দেখতে আসে তাকে, সেই নতুন মানুষের দল পায় ছুটির মজা, বন্ধুদের নিয়ে হৈহৈ পিকনিকের স্বাদ, দৈনন্দিন রুটিনের বাইরে পা ফেলার আনন্দ। মিউজিয়ামের অদক্ষতায় তাদের ইতিহাস চেতনা আর বাড়ে না। কেবল নিঃসঙ্গ বিজয় দিবসের নিঃসঙ্গতা আরো বাড়ে।

ষাট সত্তর দশকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির চরিত্রই আমাদের বিজয় দিবস নামে একটা দিবস উপহার দিয়েছিল। আর এর দাম আমরা চুকিয়েছিলাম আমাদের রক্ত-মাংস-হাড়-সম্মান দিয়ে, আমাদের সাহস আর শৌর্য দিয়ে। আজ  যদি আবার ওই পরিস্থিতির সামনে পড়ি আমরা—যদি আবার আমাদের চোকাতে হয় এরকম কোনো দায়ের দাম—আন্তর্জাতিক রাজনীতির ঋণ যেমন আমাদের জুটবে না, তেমনি মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে নিজের অধিকার আদায়ের প্রয়োজনে যে জোটবদ্ধতার জাগরণ হয়েছিল আমাদের—তাও আর হবে না। এখন আমরা অনেক কিছুতে বিভক্ত যেমন, তেমনি স্বাধীনতারও সেরকম প্রয়োজন আর হচ্ছে না আমাদের। এখন আমরা সুখী দাসজীবনেই বেশি স্বচ্ছন্দ, বেশি বিশ্বাসী। এখন স্বাধীনতা যেন একটা বোঝা।

আমাদের জীবন এখন বদলে গেছে অনেক। এখন দেশ আর আমাদের মধ্যে কোনো আবেগ তৈরি করে না। ভাষা আর পারে না আমাদের সব অনুভূতিকে প্রকাশ করতে। আমরা আর শিকড়ের মুখাপেক্ষী না। জীবনের এই বদল সমসাময়িক সঙ্গের অভাবে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়া বিজয় দিবসকে আরো একা, আরো ক্লান্ত করে ফেলেছে। তাই যাকিছু তার পরিচয়, যাকিছু নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে বিজয় দিবস—তারা আর তার কাছে ঘেঁষতেই পারে না। এক অচেনা পরিমণ্ডল যেন তাকে রাঙাচ্ছে এমন এক অচেনা রঙে—যা মঞ্চ কাঁপায়, শরীর দোলায় কিন্তু হৃদয় আকুল করে না। অথচ তার ছিল আপাদমস্তক শিহরিত করার ক্ষমতা।

ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায় বর্তমানকে দাঁড় করায় তার নিজস্ব ভিত্তির ওপর। আর সেইসব অধ্যায় থেকে অর্জিত জ্ঞান জোগায় সামনে পা বাড়ানোর সাহস। বিজয় দিবস আমাদের সেই ভিত্তি আর সাহস হতে পারতো হয়তো।

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত