| 23 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ভ্রান্ত পথ

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

বাবা আমার চিরকালই ভীষণ গোঁয়ার। যা ভাববেন তাই…

রাত অন্ধকার। ঘরঘোর বিজলী চমকায়। লালমাই পাহাড়ের কোলের এই শহরতলিটাতে এমনিতেই সূর্য ডোবার কিছু পরই গা ছমছম করা অন্ধকার। সন্ধে রাতেই ডেকে ওঠে গাছে গাছে তক্ষক। বেজে ওঠে বাদুরের ডানার পাখোয়াজ। গভীর পেয়ারা বনে পাহাড়ি টিয়া আর বাদুরের ঝাপট আমাদের নিত্য জানা। অভ্যেস হয়ে গেছে। যখন থেকে বুঝতে শিখেছি তখন থেকে আমি লালমাই পাহাড়ের কোলের কাছে। কিন্তু মনে হয়, যেন জন্মেই দেখেছি ওই বনপাহাড় আর টিলা। সবুজ ঘাসে ছাওয়া মধুরতা। খুব একটা বিদ্যুৎ বিভ্রাট তখন ছিল না। বয়স আমার কত হবে। পাঁচ কি ছয়। কালেভদ্রে কখনো বিদ্যুৎ প্রবাহ বিচ্ছিন্ন হলে কোটবাড়ির সরকারি কলোনিতে নেমে আসতো প্রেতের অন্ধকার। তখন আইপিএস-এর যুগ নয়। দূরের গ্রামগুলোতে তখনও লাগেনি ইলেকট্রিসিটি। তাই ওখানে এমনিতেই জ্বলে কুপিবাতি। যখন কলোনির আলোও জ্বলা বন্ধ তখন পুরোটা শহরতলি এক ঘনঘোর আবছায়া। একটা মাত্র হ্যারিকেন। জ্বালিয়ে রাখা মাঝখানে। আর চারপাশে গোল হয়ে বসেছি আমরা ছ’ভাইবোন। মা বলছেন চোখের সামনে দেখা একটা সত্য…

– তখন পাকিস্তানি হায়নাদের ভয়ে পুরো কলোনির সব লোক গ্রামে পাড়ি জমিয়েছে। তোদের বাবা গোঁয়ার। সে কোথাও যাবে না। তোদের চার ভাইবোনকে নিয়ে আমি একা এই বিরাণ কলোনিতে। শামিম শাহিন সেলিম। তোদের তিনজনের বয়স তখন সাড়ে নয়, আট, আর সাড়ে ছয়। পাপড়ি আরও ছোট। দেড় বছর বয়স ওর। শাপলা মুকুলের তখনও জন্ম হয়নি। হঠাৎ কোন কোনদিন অতর্কিতে বিমানে বোমা ফেলা শুরু হলে কানে তুলো গুঁজে দিয়ে শামিম শাহিন সেলিমকে খাটের তলে পাঠিয়ে দিই। পাপড়িকে বুকে তুলে নিই। বিমানগুলো দূরে উড়ে গেলে সবাইকে আবার বের করে আনি। তখন রাত প্রায় ১২টা। তোরা সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিস। হঠাৎ কিছু মানুষের হট্টগোল শুনে আমি নিজেকে লুকিয়ে জানালার পর্দা সরাই। আলগোছে তাকাই। দু’টো জলপাই রং জিপ এসে থামে। সুরমা পাড়ের পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের কলোনিতে-

– ইধার মে লে আও। হ্যা হ্যা। ইধার। ঠেরো। ইধার ঠেরো।

– হাত দু’টো পিছমোড়া করে আর মুখে কালো কাপড় বাঁধা ২৫/২৬ বছরের একটি বাঙালি ছেলেকে ধরে নিয়ে এসেছে। জিপ থেকে ওকে টানতে টানতে নামায় আট দশজন পাকিস্তানি আর্মি। সাথে পাজামা পাঞ্জাবি পরা এক বাঙালি। রাজাকার। মুখটা খুলে দিয়ে কিছু জানতে চায় বোধকরি। কথা বের করতে পারে না। এলোপাতাড়ি মার শুরু করে। বুট দিয়ে লাথি চলতে থাকে এলোপাতাড়ি। বন্দুকের বাঁট দিয়ে পায়ের হাঁটুতে কয়েক ঘা দেবার পরও ওই ছেলে মুখ খোলে না। হাঁটু ভেঙে আধো বসে পড়ে মাটিতে। পাক হানাদার চিৎকার করে ওঠে। খানিক শুনতে পাই খানিক আন্দাজ করে নিই।

– তু জানতা হ্যায়, ক্যায়সা করেঙ্গা হাম তেরেকো তবিয়াত? বোল সালা। প্ল্যান বোল তেরা? কৌন হ্যায় তেরা লিডার। বোল? সব কুছ বোল দে?

– আমি বলবো না। কী করবে? জান নিয়ে নেবে আমার? দেখ তাকিয়ে কত বাঙালি জান দেবার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। দেখ…

– আচ্ছা। হা হা । এ্যায়সা মর্দ! হি হি। হ্যায়! হ্যায়না? দেখ হাম কিয়া করেঙ্গা তেরা। ক্যায়সা চিজ তু বনেগি তামাম বাঙালি কে পাস।

সাথে সাথে কথা যোগ করে আরও একজন বাঙালি রাজাকার

– আচ্ছাসে শাস্তি দে দো সাহাব। উসকো জিন্দেগি বরবাদ করদো না সাহাব …

– এই শব্দগুলো আবছা শুনতে পাই। বাকিগুলো আন্দাজ করে নিই। অস্থির হয়ে উঠি আমি। তী করবে ওরা ছেলেটাকে নিয়ে!

– হাতের বাঁধনগুলো খুলে দেয় কেউ একজন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ‍বাঙালি মুক্তিবাহিনীর কোনো একজন জওয়ানকে ধরে এনেছে। আমি খানিক উদগ্রিব হই। চিনতে চেষ্টা করি ছেলেটার অস্পষ্ট ছায়াটা। আমার কাছে যে মুক্তিরা আসে তাদের কেউ কি না, বোঝার চেষ্টা করি। বোঝা যায় না অত দূর থেকে। রাজাকারটাই আগ বাড়িয়ে চারপাশে চারটা খুঁটি পুতে দেয়। রাজাকারটাকে চিনতে পারি তার গায়ের কাপড় দেখে। অন্যগুলোর গায়ে পাকিস্তানি মিলিটারি পোশাক। জিপ গাড়ি সাথে। ছেলেটাকে উপুড় করে শুইয়ে দেয় কয়েকজন ধরে। ওর চার হাত পা চারদিক থেকে টান করে বেঁধে ফেলে। আমি যতদূর সম্ভব তাকিয়ে থাকি-

– লে আও। হ্যা। উস হাতিয়ার মে ইধারসেলে আউ।

দূরে আলসে বসে সিগারেট খাচ্ছিল কতগুলো সিপাহী। চিৎকার শুনে জিপ থেকে নামিয়ে কি যেন সব নিয়ে আসে। তার থেকে বেছে নেয় একটা। একজনের হাতে। কিছু একটা চকচক্ করে ওঠে। চাঁদের আলোয় জোছনার ফলার মতো একটা ধাতব জিনিসের প্রতিফলন এই হা অন্ধাকার পার হয়ে আমার চোখ দুটো যেন ধাঁধিয়ে দিল। তবু আমি তাকিয়ে থাকি। আমার ভেতরে কী এক অদ্ভুত জেদ কাজ করতে থাকে-

– হ্যা?ছুরি? হ্যা হ্যা ছুরিই তো! বিশাল আকারের একটা ছুরি! কোরবানীর ঈদে গরু জবাইয়ের সময় ব্যবহার করা হয় এরকম। বুঝতে পারি ভয়ংকর এক বীভৎসতা দেখতে হবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। জবাই? উফ…

একটা আর্তনাদ বের হয়ে আসে মা’র গলা দিয়ে। একটু থেমে পড়েন। বুঝি আর পেরে উঠছেন না। উদভ্রান্ত চোখ। মায়ের বর্ণায় মনে হচ্ছে এখন এই এখন এইখানে চোখের সামনে আমি দেখছি সব। আমি মাকে খুঁজে পাই না। তার সমস্ত মুখটা অদ্ভুত এক বিষণ্নতায় আর্দ্র

– তোর বাবা আমাকে ধমক লাগায়

– কী কর? দেখো নাতো এসব। সরে এসো জানালাটা ছেড়ে। সইতে পারবে না।

– আমি সরে আসতে তো পারি না। মুখে শাড়ির আঁচলটা চাপা দেই। যেন অস্ফুট শব্দগুলো বের না হয়ে ওদের কানে চলে না যায়। চোখের জল কী করে ধরি!

– হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে এক সিপাহি ওর মুখের কাছে। বিশালাকার ছুরিটার আগাটা দিয়ে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা ছেলেটার থুতনিতে একটা খোঁচা দিয়ে কিছু একটা বলতে গেছিল মনে হয় পাক আর্মিটা। অমনি যতটুক আন্তাজ করতে পারি, আর্মিটার মুখে থুথু ছিটিয়ে দেয় ছেলেটি। আর সাথে সাথে ঝেটিয়ে ওঠে পাক হানাদার। প্রচন্ড রোষে লাফিয়ে ওঠে। ঝটিতি উঠে বসে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা ওর পিঠের ওপর।

– করুণ এক আর্তনাদ আমার মা’র বুক ফেটে বেরিয়ে আসে। অদ্ভুতভাবে কাঁদতে থাকেন তিনি। আমরা ছ’ভাইবোন কোনদিন দেখিনি এমন। চিনতে পারি না মাকে। তবু কোন কথা বলবার সাহস পাই না

– দেখ শালা। তেরা বাংলাদেশ কুছ নেহি জানা পারেগা। হাম তেরা সবকুছ্ ইয়ে সুরমাকো পানিমে ছুপালেঙ্গা। হা হা হা হা। তেরা দেশপ্রেম তেরা অ্যায়সা তিয়াগ কুছ্ বাঙালি নেভার উইল বি নোন্ । হা হা

– ঘাড়ের কাছে খাঁড়া করে ছুরিটা ঢুকিয়ে দেয়। তারপর একটানে নামিয়ে আনে কোমড়ের নিচ পর্যন্ত মেরুদন্ড বরাবর

– মা আ আ আ আ। মাগো ও ও ও ও ও ও

– যন্ত্রণায় কুঁকড়ে ওঠে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা ছেলেটি। দেখতে দেখায়, ঠিক যেন উড়ে যেতে থাকা একটা এরোপ্লেন। দড়িতে আটকানো হাতেই যেন খামচে ধরতে চায় মাটি ভয়ঙ্কর আক্রোশে। সে কি তার গর্জন। আকাশ বাতাস কেঁপে ওঠে…

– মা মা করে ডাকছে। হায়রে মা। কই। কই কোথায়? ওর মা? আহারে সোনা মানিক। এই যে আমি। আমি আমি আমি। আমিই তোর মা। আমি তাকিয়ে দেখছি। আমার কিছু করবার নেই রে সোনা যাদু ধন মানিক। কে বললে কেউ জানবে না তোর ত্যাগ। এই যে আমি, তোর মায়ের পাতা সবুজ ধান ক্ষেত, বিলের শাপলা আর নদীর জল সব সব সবই জানবেরে সোনা তোর কথা… আহারেরররররররররররর

মা’র চোখ ভেসে যায় জলে। যন্ত্রণায় কুঁচকে যায় কপাল আর মুখের শতশত রেখা। নিস্তব্ধ রাত। পিনড্রপ সাইলেন্স। আমাদের চোখে ঘুম নেই। মুখে কোন কথা নেই। বাবা অন্য ঘরে মোম জ্বালিয়ে বোধকরি ছাত্রদের পরীক্ষার খাতা দেখছেন। তখন মধ্যরাত পার হয় হয়। ঐ যে বাদুর ডানা ঝাপটায়। স্পষ্ট শুনতে পাই তার শব্দ। লালমাইএর উঁচু টিলা থেকে সমতলে নেমে এসেছে বাঘডাস। তিনতলার ঝুলন্ত বারান্দার দিকেই প্রতিদিনের মতো মাথা উঁচু করে ডেকে ওঠে। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে খান খান- ঘাসের বুকে শিউলি ফুল ঝরে পড়ছে তখন। আমি নিশ্চিত জানি। ভোর বেলা তার সাথে আমার দেখা হবেই…

– আমি বিড়বিড় করতে করতে কাঁদি। তোর বাবার চোখ মুখ চোয়াল শক্ত হতে থাকে টের পাই। কিন্তু আমার মতো বিলাপ করতে পারে না। ছেলেমানুষ। ওদের তো চোখে অত সহজে জল আসবার নয়। আমার মত ঠায় একটানা বসে থাকে না জানালায়।আবার উঠে অস্থির পায়চারি করতে থাকে সারা বাড়ি। হঠাৎ প্রশ্ন করে তোর বাবা

– আচ্ছা পাকিস্তানি আর্মিগুলো গতকাল যে বিস্কিটের টিনগুলো দিয়ে গেছিল সেগুলো কই বলতো?

– আমি জানালা থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই বলি, আছে। রান্নাঘরে রাখা আছে, দেখো।

– আর পাপড়ির জন্য যে দুধের কৌটাগুলো দিয়ে গেল?

– সবই এক জায়গায় আছে।

বাবা আমার সরকারি পলিটেকনিক্যাল ইন্সটিটিউটে চাকরি করেন। খাস বাঙালি তবুচমৎকার উর্দু বলতে পারেন। তাই ডিউটিরত পাক হানাদারেরা বাবাকে খুব পছন্দ করতো। খানিকটা বিশ্বাসও কি করতো! বাবাকে ওরা ভেবেছিল কি? নিঃশব্দে রাজাকার? ছোট ছোট ভাই বোনদের জন্য মাঝে মাঝে নাকি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পাক সৈন্যদের জন্য আনা বিশালাকার বিস্কিটের টিন, দুধের কৌটা দিয়ে যেত। কিছু পুরানো টিন এখনও আছে আমাদের বাড়িতে। আমি দেখেছি। মা ওগুলোতে চাল মুড়ি রাখে। ওরা কি জানতো বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে রাতের অন্ধকারে আমাদের বাড়িতে ঢুকতো মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা। না। কেউ জানেনা। কেউ জানতও না।

মা গল্প বলছেন দেশ স্বাধীন হবার আরও ৯ বছর পর। আমি যুক্ত হই লালমাইয়ের এই নিবিড় অন্ধকারে বসেই। ১৯৮০ সালে বসে দেখি ১৯৭১। দেখি সুরমা নদীর পাড়ে বীভৎস অন্ধকার। শুনি পাকিস্তানি হায়েনাদের কুৎসিত হাসি আর উৎসবের গীতবাদ্য বাজনা। যেন বা চোখে দেখতে পাই বাবার শক্ত চোয়ালেরও সবগুলো হাড়। রাতের অন্ধাকারে গা ঢাকা দেওয়া মুক্তিসেনার দল। একমনে দেখে যাই। আজন্ম – আমিও সেই বিকট সন্ধ্যায় সুরমী নদীর পারে মায়ের পাশে বসে থাকি জানালার ধারে-

– আ আ আ আ আ আ মা আ আ আ আ আ মাগো গো গো ও ও ও

– চিৎকার শুনে আবার দৌড়ে আসি জানালার কাছে। ছোট একটা মোম জালানো ছিল ঘরে।

– বলা যায় না, মোমেন ক্ষীণ আলো দেখে হায়নারা যখন উন্মত্ত তখন হঠাৎ চোখে পড়লে ক্ষেপে উঠতে পারে। এখানেও চলে আসতে পারে।

-বলতে বলতে মোমটা বন্ধ করে দেয় তোর বাবা। বিকট অন্ধকার ঘরটায়। পুরো কলোনিটায়। অথচ আকাশে তখন চমৎকার জোছনা। সেই আলোতে সব স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়।

মার চোখ দিয়ে এখনও, স্বাধীনতার এত বছর পরও গল্প বলতে বলতে গড়িয়ে পড়ে জল। সেই জল যেন হিম ঝরণা হয়ে ছলছল এক বেদনার শব্দ তুলে বয়ে যায় আমারও বুকের কোন এক গভীর খাদে।

– চোখে তাকানো যাচ্ছে না আর। পুরো শরীরটা ছিলে ফেলেছে ছেলেটার। মানুষের মাংসের লালচে গোলাপি আভা রাতের অন্ধকারকে মাতাল করে তোলে। হায়নাগুলো আরও মাতাল হয়ে পড়েছে বোধকরি। আমি আস্তে আস্তে বলি

– আল্লাহ এবার ছেড়ে দিক না ছেলেটাকে। কোন মায়ের বুকের ধন। আর কত নিলে তোদের শান্তি হবেরে কুত্তার দল। কত খেলে মানুষের মাংসের স্বাদ মিটবে তোদের?

– মেটে না। স্বাদ মেটে না। মেটে নারে মাংসের স্বাদ।পুরো শরীরটা ছেলেটার ছিলে ফেলেছে ততক্ষণে। গোলাপী মাংশের রঙে জোছনার রুপালি মিলেমিলে….. আহ হা..

চিৎকার করে ওঠে এক আর্মি

– বালতি কো লে আও।

– কী করবে? আর কি বাকি আছে কাজ? কী আছে বালতিতে? আগুন ধরাবে নাকি ছেলেটার গায়ে!

– না না না। আগুন নয়। আগুন নয়। আহ হারে। অন্য কিছু। অন্য কিছু!

মাকে কেমন ভুতে পাওয়া মানুষের মতো লাগে। বির বির করে নিজেই কিছু বলেন। অদ্ভুত এক দ্রুতরূপ দেখি তার গল্প বলার ছলে

-চাঁদের আলোয় ঝকঝক্ করে ওঠে বালতি ভরা সাদা জোছনার মতো লবণ। এক বালতি লবণ থেকে মুঠো মুঠো  হাতে নিয়ে কয়েকজন উৎসব করতে করতে ঘষতে থাকে ওর ছিলানো গায়ে। আকাশ বাতাস জ্বলতে নিভতে থাকে চিৎকারে। হাত পায়ের বাঁধন ততক্ষণে খুলে দিয়েছে। কয়েকজন উঠিয়ে দাঁড় করায় গোলাপের মতো গোলাপি মানুষের শরীর। মুক্তিসেনার ছিলানো দেহ। সুরমার পাড়ে উঠে দাঁড়ায় বাঙলা মায়ের দামাল ছেলে। শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে যেন আক্রমণ করতে চায় প্রতিপক্ষকে। কিন্তু সব শক্তি তখন টেনে নিচ্ছে বাতাস আর লবণ। এপিডার্মিস নেই শরীরে। লালচে গোলাপি শরীরটা মাতালের মতো ঘুরপাক খেতে থাকে। এর তার গায়ে ধাক্কা খায়। ওরা আবার ওকে ধাক্কা দিয়ে ছুঁড়ে দেয় অন্যের কাছে। যেন কানামাছি ভোঁ ভোঁ খেলছে কিছু বয়স্ক পশু। কিছুক্ষণ আজানা পথের দিকে টলতে টলতে এবড়ো থেবড়ো হাঁটতে থাকে ছেলেটা। হোঁচট খায়। আর

-মা মাগো

বলে চিৎকার, মা ছাড়া আর কোন কথা নেই মুখে তার।

মার চোখে একটানা গড়িয়ে পড়ে জল।সেই মুক্তিযোদ্ধার চিৎকার আকাশে বাতাসে ধ্বনি প্রতিধ্বনি তুলে এসে জায়গা নেয় আবার আমারই কানে। আমারই বুকের ভেতর নীরব এক স্বাধীনতার প্রতিভূ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ভাইবোনেরা সব নির্বাক। উৎসুক। তাকিয়ে থাকি মায়ের মুখের দিকে। বুঝতে পারি মা এখন বর্তমানে নেই। তাঁর বুকের ভেতর তীব্র যাতনা। নিজেকে সইয়ে নিতে কিছুটা সময় নেন। ছেলেটি মরবে এই তো। আমার সবচেয়ে ছোট ভাই ওর তখন বয়স কতো হবে চার কি সাড়ে চার। প্রশ্ন করে

– মা ও কি তারপর মরে গেল?

মা তার প্রশ্নে মা কেমন যেন ঝাঁঝিয়ে ওঠেন –

– না না নাহ্। মরেনি মরেনি মরেনি। মরবে কেন? ও বেঁচে আছে। এখনও বেঁচে আছে। ওই তো। ওই তো দেখতে পাচ্ছি। পেছনের দরজা দিয়ে মুখ ঢেকে ঢুকলো আমার ঘরে। কী সুন্দর কাঁচা-কচি মুখ। ভাত নিয়ে গেল দলের ছেলেরা। পেছনে সে। একটু ইচ্ছে করেই বাকিদের থেকে পেছালো। জানালায় আচাড়ের বয়াম দেখে হাসলো। এমন লজ্জিত স্বরে হাত দিয়ে ঈশারা করে দেখালো যেন দেশের জন্য যুদ্ধ করছে বলে আচার খাওয়াটা বড় অপরাধ

– চাচি। একটু… আচার…

পরক্ষণেই মা আবার ফিরে আসেন বাস্তবে

– হ্যাঁ হ্যাঁ মরেছে। মরেছে। না হলে কী করে পেলাম এই বাংলাদেশ! এই স্বাধীনতা? আহ। কী বীভৎস এ মরণ। কী মর্মান্তিক এর দায়।

আমি আর চুপ করিয়ে রাখতে পারিনা নিজেরে। বড় ভাই বোনেরা সব নির্বাক।

– তারপর? তারপর তী হলো বল না মা?

মা বেশ কিছুক্ষণ নীরব থাকবার পর একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। বছরের পর বছর বলতে বলতে আর যাতনাগুলো পুষে রাখতে রাখতে তিনি ক্লান্ত।

– তারপর। হায়নাগুলো ছেলেটির একটি হাতের সাথে একটি হাত, একটি পায়ের সাথে আর একটি পা বেঁধে দিল। কয়েকজন হাতেপায়ে ধরে দোলাতে দোলাতে দারুণ উৎসব করতে করতে ওকে ছুঁড়ে দিল জলে। সুরমার কালো জলে বারকয়েক ঘুরপাক খায় দেহটা। উথাল পাথাল হয় জল। হাত পা বাঁধা তবু মৃত্যুর মুহূর্তেও শেষ চেষ্টা করে কিছু বলবার। চেষ্টা করে বুঝি মরণের আগে দেশের বাতাসে বুকটা ভরে নেবার। তোর বাবা আমাকে ডাকতে থাকে-

– এবার সরে যাও তো।

– আমি যাইনা। আমি চোখ সরাই না। পর্দার এককোনা উঠিয়ে নীরবে তাকিয়ে থাকি জলে। অন্ধকারে যতক্ষণ দেখা যায়, দেখি জলের উথাল পাথাল আর চেয়ে থাকি। ধীরে ধীরে জলের আঙন শান্ত হয়ে আসে। পুরো জলের আন্দোলন থেমে গেলে আরও ঘণ্টা খানেক পর মৃত্যু নিশ্চিত বুঝতে পেরে হানাদারটা হৈ হুল্লোড় করতে করতে সুরমা নদীর পাড় ছেড়ে যায়। ওদিকে কী হয়েছে জানি না। কোন শোধ বোধ নেই আমার। তারা কি খুব সন্তর্পণে ঘরে এসেছিল? কার যেন গায়ের গন্ধ পাই আমার বদ্ধ ঘরের বাতাসে। দেখি বিস্কিট আর দুধের টিনগুলো জায়গামতো নেই। ওদিকে সুবেহ সাদিক। দিনের প্রথম আলো জন্ম নিচ্ছে অন্ধকারের গর্ভে।

– আসসালাতু খাইরুম মিনাননাউম…

– দরজায় ভীষণ রোষে কড়া নাড়ে কেউ একজন। দরজা খুলতেই একটা বেয়োনেট তোর বাবার বুকে ঠেকিয়ে ঢুকে পড়ে এক পাকিস্তানি হানাদার। পেছনে পুরো ট্রুপ। আমাদের চেনা ওরা। এ অঞ্চলেই ওদের ডিউটি। প্রায়ই আসে বাসায়। তোর বাবার সাথে খাস উর্দুতে বাতচিত করে। আজ তার অন্য রূপ। মাতালের মতো উন্মত্ত লালচে ঝাঁঝালো চোখ। এক ঝটকায় বেয়োনেটটা তোর বাবার বুকে আর একটু জোরে চেপে ধরে গর্জন করে ওঠে-

– তুম বাঙালি বেঈমান হো।তুম বেঈমান। তুম মুক্তি কো সাহারা দিয়া

তোদের বাবার দিকে আমি প্রশ্ন চোখে চেয়ে রই। কী হবে এখন? একবার আমার দিকে তাকায় তোর বাবা। দেখি, আজ চোখে তারও আগুন ঝরে পড়ছে। অন্য এক রুদ্র মূর্তি দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যাই। কী করবো। কী করা উচিত। কী বলবো। কী বলা উচিৎ ভেবে পাচ্ছি না। তাকিয়ে আছি অপেক্ষায়। স্বীকার করবে? ওরা কি আসলে সব দেখে ফেলেছে! মুক্তিরা এখানে আসে, কিছুক্ষণ আগেও এসেছিল, জানতে পেরে গেছে কি! যদি জেনে এসে থাকে তবে তো মিথ্যা বললেও যা সত্য বললেও তা। উহ্। এক রূদ্ধশ্বাস অপেক্ষা। কিন্তু না। ঘটনা উল্টো ঘটতে শুরু করে। তোর বাবা আস্তে করে বেয়োনেটটা শক্ত করে ধরে ফেলল নিজের মুঠোর ভেতর। কি ছিল জানিনা সেই ধরে থাকা মুঠোর শক্তি কিংবা তেজ। নিজের বুকের থেকে খুব ধীর গতিতে নামায় বেয়োনেটটা। চোয়ালে হাড়গুলো গজরাতে থাকে। কি রোষে যেন ফেটে পড়ছে সে। আমার দিকে একবার তাকায়। আমি সে দৃষ্টির ভাষা পড়তে পারি আবার পারিনা।আস্তে করে বাম হাতের তর্জনী তুলে ঠিক উল্টো দিকে ইশারা করেমুক্তিবাহিনী যেদিকে চলে গেছে তার ঠিক উল্টো দিকে

– বাঙালি বেঈমান নেহি হ্যায়। মুক্তিবাহিনী… উধার পাস…

– পাক হানাদাররা এ ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকায়। অবিশ্বাস করতে পারে না তোর বাবার দৃষ্টি কিংবা কণ্ঠস্বরকে। কী জানি কী ছিল তাতে। বোধ হয় এতক্ষণ ছেলেটির মৃত্যুর যে বীভৎসতা দেখেছে তারই রোষ। প্রতিশোধের আগুনও:

– কালবিলম্ব না করে শত্রুসেনারা ছুটে চলে তোর বাবার দেখানো ভ্রান্ত পথে…

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত