| 25 এপ্রিল 2024
Categories
ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধ

একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ড

আনুমানিক পঠনকাল: 18 মিনিট

সহুল আহমদ

 

এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাইদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে এক আলোচনায় বলেছিলেন, বুদ্ধিজীবী ছাড়া যেমন বড় ধরনের কোন বিপ্লব সংঘটিত হয় নি, তেমনি তাদের ছাড়া কোন বিপ্লববিরোধী আন্দোলনও সংঘটিত হয় নি। এক কথায়, তারাই হচ্ছেন ‘বিপ্লব’ এর প্রাণ। অন্যভাবে বলা যায়, শাসকগোষ্ঠীর টিকে থাকার জন্যে যেমন একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী প্রয়োজন, তেমনি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কথা বলার জন্যেও আরেক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীদেরকে শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়তে হয়। এ কারণেই দেখা যায় যে, গত শতাব্দীর শুরুতেই আর্মেনিয়ায় গণহত্যা শুরু হয়েছিল ২৫০ জন বুদ্ধিজীবীকে গ্রেফতার ও হত্যার মাধ্যমে। হিটলার ও তার নাৎসি বাহিনীও পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবীদেরকে হত্যা করেছিল। এই দিক দিয়ে বিবেচনা করলে ১৯৭১-এ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ঘটনা মোটেই নতুন কিছু নয়, বরং প্রকৃতিগত দিক হতে পূর্বের গণহত্যাগুলোর সাথে এটা সাদৃশ্যপূর্ণই বটে।

পাকিস্তানিরা কেন বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল – এ আলোচনা শুরুর প্রারম্ভেই পরিষ্কার করে নেয়া উচিত, এখানে ‘বুদ্ধিজীবী’ বলতে কাদেরকে বোঝানো হচ্ছে? বাংলা একডেমি প্রণীত ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ’ গ্রন্থ অনুযায়ী, ‘বুদ্ধিজীবী অর্থ লেখক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, কণ্ঠশিল্পী, সকল পর্যায়ের শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি ও বেসরকারী কর্মচারী, চলচ্চিত্র ও নাটকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সমাজসেবী ও সংস্কৃতি সেবী’। ২৫ শে মার্চের রাত থেকেই শুরু হয় মূলত বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ এবং ১৪ ডিসেম্বর সেটার চূড়ান্ত রূপ প্রকাশ পায়। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি, তবে বাংলাপিডিয়ার সূত্রমতে, এঁদের মধ্যে ছিলেন ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২ জন আইনজীবী, ৯ জন সাহিত্যিক ও শিল্পী, ৫ জন প্রকৌশলী,এবং অন্যান্য ২ জন।

একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের কারণ উদঘাটন করতে হলে পাকিস্তান আমলের সেই পঁচিশ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকাকে ভালো করে অনুধাবন করতে হবে। ১৯৪৭ থেকে ৭১ – এ সময়ের মধ্যে বাঙালিরা বিভিন্ন পর্যায়ের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের গণ্ডি থেকে বের হয়ে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদে’ প্রবেশ করে। এবং, বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের দ্বারা এই জাতীয়তাবোধের যে উন্মেষ ঘটেছিল, পরবর্তীতে সেটার অগ্রগতিতে মূল অবদান ছিল তৎকালীন বুদ্ধিজীবীদেরই। আইয়ুব খানের সামরিক শাসন আমলে প্রথমে আঘাত আসে সংবাদপত্রের ওপর, শাসকচক্রের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে সাংবাদিকরা দমন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, জেলে গিয়েছেন। সামরিক শাসনবিরোধী সাংবাদিকদের বিদেশ গমনেও বাধা দেয়া হয়। তবু ‘ইত্তেফাক’ কিংবা ‘সংবাদ’ ক্ষমতাসীনদের কাছে খুব একটা নতি স্বীকার করেনি। তৎকালীন সামরিক শাসক চক্র বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির ওপর সর্বাধিক নোংরা আক্রমণ চালায়; পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান – এই দুই অঞ্চলের সংহতি বৃদ্ধির অজুহাতে রোমান হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব করা হয়। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তখন এই ভাষা সংস্কারের তীব্র প্রতিবাদ জানান। রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সাহিত্যের ওপর আসে সাম্প্রদায়িক আক্রমণ; তাঁকে চিহ্নিত করা হয় হিন্দু কবি এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসেবে। এই ‘হিন্দুয়ানী’র অভিযোগ তুলে নজরুলের কবিতা থেকেও ‘হিন্দুয়ানী’ শব্দ বাদ দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়। ‘সজীব করিব মহাশশ্মান’ এর স্থলে লেখা হলো সজীব করিব গোরস্থান” ছাত্রীদের কপালে টিপ দেয়ার ওপর বিধিনিষেধ জারী করা হয়, কেউ টিপ দিয়ে গেলে তাকে কর্তৃপক্ষের হাতে হেনস্থা হতে হত। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকীতে সামরিক সরকার আকারে ইঙ্গিতে প্রকাশ করে যে, রবীন্দ্রনাথ আসলে পাকিস্তান আদর্শ বিরোধী। প্রতিবাদস্বরূপ এগিয়ে আসেন বুদ্ধিজীবীরা। বিভিন্ন জায়গায় রবীন্দ্রজয়ন্তী কমিটি গঠন করে অনুষ্ঠান আয়োজন করা শুরু হয়। মেয়েরা কপালে টিপ দেয়া শুরু করেন। রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সনজিদা খাতুন, ওয়াহিদুন হকের উদ্যোগে গঠিত হয় ‘ছায়ানট’। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বুদ্ধিজীবী মহলের এমন সাহসী প্রতিবাদ জাতীয়তাবাদী চিন্তার বিকাশে সাহায্য করেছিল তুমুল ভাবে। [১ক]

১৯৬৭ সালে মুসলিম লীগের খান এ সবুর ১লা বৈশাখ ও রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপনকে বিদেশী সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বলে মন্তব্য করেন। তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিনও এরকম মন্তব্য করেন এবং বলেন যে পাকিস্তানি আদর্শের সাথে না মিললে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার বন্ধ করে দেয়া হবে। তাদের পক্ষে তখন সক্রিয় হয়ে ওঠে পাকিস্তানপন্থী বুদ্ধিজীবীরা। দৈনিক আজাদ তখন লিখে: “রবীন্দ্রনাথ বহু সঙ্গীতে মুসলিম তমুদ্দনকে অবজ্ঞা প্রদর্শন করিয়া হিন্দু সংস্কৃতি জয়গান গাহিয়াছেন। সুতরাং পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম দিন হইতেই এই সকল সঙ্গীতের আবর্জনা হইতে রেডিও – টেলিভিশনকে পবিত্র রাখার প্রয়োজন ছিল। তাই বিলম্বে হইলেও সরকার এই সঙ্গীত পরিবেশন বন্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়া জনগণের প্রশংসাভাজন হইয়াছেন।” এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে ১৮ জন বুদ্ধিজীবী তখন একসাথে বিবৃতি দিয়েছিলেন। [২ক] ১৯৬৭ সালের আগস্ট মাসে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি জনাব হামুদুর রহমান আরবি হরফে বাংলা ও উর্দু লেখার সুপারিশ করলে সেটারও প্রতিবাদ জানান বুদ্ধিজীবীরা। এই ঘটনাগুলোর প্রেক্ষিতে গবেষক মুনতাসির মামুন বলেন, ‘রাজনৈতিক ফ্রন্টের ঘটনাবলীর সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও এ সময় এমন কিছু ঘটনা ঘটে যা পূর্ব বঙ্গবাসীর বাংগালিবোধকে তীব্র ও সংহত করে তোলে এবং এ ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেন সাংস্কৃতিক কর্মী এবং বুদ্ধিজীবীরা” [১খ]

অনেকটা একই রকম মন্তব্য করেন গবেষক বদরুদ্দীন উমরও। তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান আমলে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সালের গোঁড়া পর্যন্ত এদেশের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সুবিধাবাদী লোক থাকলেও তাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশের মধ্যে শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের অভাব ছিল না। সেটা না হলে সেই পর্যায়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন অগ্রসর হতো না এবং স্বাধীনতা আন্দোলন দানা বাঁধতো না’ [৩]

প্রাসঙ্গিক কারণেই এর পাশাপাশি সে সময়ের বাম রাজনীতি নিয়েও কিছু কথা বলা প্রয়োজন। আহমদ ছফা তাঁর এক প্রবন্ধে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশি রাজনীতি সংস্কৃতির যা কিছু উজ্জল অংশ তাঁর সিংহভাগই বামপন্থী রাজনীতির অবদান। ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে বামপন্থী রাজনীতির উত্তাপ থেকেই বাঙ্গালী সংস্কৃতির নবজন্ম ঘটেছে। সামন্ত সংস্কৃতির প্রভাবমুক্ত একটি নতুনতর সংস্কৃতির উন্মেষ বিকাশ লালনে বামপন্থী সংস্কৃতিসেবীদের যে বিরাট সাফল্য এবং ত্যাগ; তিল তিল করে সংস্কৃতির আসল চেহারাটি ফুটিয়ে তোলার কাজে বামপন্থী সংস্কৃতিকর্মীরা যে শ্রম, মেধা এবং যত্ন ব্যয় করেছেন যে কাহিনী এখন প্রায় বিস্মৃতিতে বিলীন হতে চলেছে। … বাঙালি জাতীয়তার প্রাথমিক সোপানগুলো বামপন্থী রাজনীতির নেতাকর্মীরাই নির্মাণ করেছিলেন। সেজন্য তাঁদের জেল, জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন কম সহ্য করতে হয় নি’। [৪]

পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পূর্ববাংলায় বাম রাজনীতির তৎপরতা ছিল সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার জন্যে খুব বড় মাথা ব্যথার কারণ। পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী গোলাম মোহাম্মদের উদ্ধৃতি দিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছিল, পেটে খাবার ও ইসলাম – এই দুই জিনিস তাদের কমিউনিজম থেকে দূরে রাখবে’। [৫ক] কমিউনিস্টদের তৎপরপরতা ঠেকাতে ১৯৫০ সালে আমেরিকা ‘পূর্ব বাংলায় কমিউনিস্ট রুখতে একটি সমন্বিত কর্মসূচি’ নামে এক গোপন কর্মপন্থা হাতে নেয় যার মূল উদ্দেশ্যই ছিল ‘কমিউনিস্ট – প্রভাব দূরীভূত করা এবং পাকিস্তানের নতুন ভাবাদর্শের প্রতি সমর্থনসূচক একটি কর্মসূচি তৈরি করা’। গোপন সেই দলিলে বিভিন্ন রকমের টার্গেট গ্রুপ নির্ধারণ এবং তাদের কাজের ধরণ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা আছে। সে টার্গেট-গ্রুপ থেকে শিক্ষাক্ষেত্র, শ্রমিক শ্রেণী, সেনাবাহিনী কিছুই বাদ ছিলনা। নথিতে ‘বিশেষ প্রকল্প’ এর মধ্যে ছিল রেডিও, সংবাদপত্র, চলচ্চিত্র এবং ধর্মীয় নেতা ও গ্রুপগুলো। ‘ধর্মীয় নেতা ও গ্রুপগুলো’ প্রকল্পে বলা আছে, ধর্মীয় মঞ্চ থেকে যাতে কমিউনিস্ট বিরোধী প্রচারণা চালানো যায় সে উদ্দেশ্যে ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌছাতে হবে। এ ক্যাম্পেইনের লক্ষ হবে এই কথা বোঝান, যেহেতু কমিউনিজম ধর্মবিরোধী, ফলে সে ইসলামবিরোধী। [৫খ] উল্লেখ্য, ভাষা আন্দোলনকেও আমেরিকা কমিউনিস্ট প্রভাবিত আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করে। [৫গ] বামধারার রাজনীতি সম্পর্কে এই আলোচনা প্রাসঙ্গিক কেননা, ১৪ ই ডিসেম্বর পাকিস্তানের দালাল আলবদর এর হাতে প্রাণ হারানো বুদ্ধিজীবীদের এক বিশাল অংশ ছিল কমিউনিস্ট রাজনীতিতে খুবই সক্রিয়।

১৯৭১ বুদ্ধিজীবী হত্যা নিয়ন আলোয় neon aloy

কমিউনিস্টদেরকে শুরু থেকেই ইসলামের শত্রু হিসেবেই চিহ্নিত করা হত। সেই সাথে পাকিস্তানি ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের শিকল থেকে বের হয়ে সেক্যুলার বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী উত্থানটাকে পাকিস্তানি শাসকরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের ষড়যন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করে। সেটা যেমন ভারতের হিন্দু তেমনি স্থানীয় হিন্দুদের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ তোলা হয়। দাবি করা হয় যে, দেশ ভাগের সময় অনেক হিন্দু শিক্ষক দেশ ত্যাগ না করে থেকে যায়, এবং এই শিক্ষকরাই পূর্ববাংলার মুসলমানকে প্রভাবিত করেন ও ছেলেমেয়েদের মনে বিচ্ছিন্নতার বীজ রোপণ করেন। [৬] তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষক সমাজের প্রতি ছিল তাদের প্রবল আক্রোশ। রাও ফরমান আলী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি স্বাধীন দ্বীপের সাথে তুলনা করেছিলেন। [৭]

এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এবং বামপন্থী আন্দোলন – দুটোই মূলত পাকিস্তানি শাসক চক্রের বিরুদ্ধেই যাচ্ছিল। তাই এর সাথে সক্রিয় সদস্যদের প্রতি শাসকদের তীব্র ক্ষোভ জমা হওয়াটাও ছিল অনেকটা স্বাভাবিক। ১৯৭১ এর নয়মাস জুড়ে পাকিস্তান শাসক কর্তৃক বুদ্ধিজীবীদের পরিকল্পনামাফিক হত্যাকাণ্ডের এটাই ছিল মূল কারণ।

পাকিস্তানিদের এই ক্রোধের পাশাপাশি হত্যাকাণ্ডের পিছনে লুকিয়ে ছিল আরো একটা কারণ। পূর্বেই উল্লেখ করেছি, যে কোন জাতির বিবেককে জাগ্রত করার জন্যে যেমন প্রয়োজন বুদ্ধিজীবীর, তেমনি জাতিকে নির্জীব করার জন্যে প্রয়োজন বুদ্ধিজীবীশূন্য করে দেয়া। যদি বাঙালিরা যুদ্ধে জিতেও যায় তবে যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে সেটাও ছিল তাদের বুদ্ধিজীবী নিধনের অন্যতম উদ্দেশ্য। তাই পরাজয় যখন নিশ্চিত তখন শাসকচক্র বেপরোয়া হয়ে ওঠে – যার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৪ ই ডিসেম্বর ঘটনায়। গ্রেফতারকৃত এক আলবদর দাবি করেছিল আরো কিছু দিন সময় পেলে সকল বুদ্ধিজীবীদেরকেই হত্যা করে ফেলা হত। [৮ক] তবে, যুদ্ধের মাত্র ১০ বছরের মাথায় পাকিস্তানি আদর্শে বিশ্বাসী এবং গণহত্যায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা লোকজনের রাজনীতিতে আবার সক্রিয় হয়ে ওঠা প্রমাণ করে যে, জাতিকে মেধা শূন্য করার মাধ্যমে যে পরিকল্পনা তারা নিয়েছিল তা অনেকাংশে সফল হয়েছিল।

দায়ী কারা?

বলেছি যে, ২৫ শে মার্চ রাত থেকেই বুদ্ধিজীবী নিধন শুরু হয়। ফলশ্রুতিতে, অনেকেই দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন, আবার অনেকেই বিভিন্ন কারণেই থেকে যান আক্রান্ত ভূখণ্ডের মাঝেই। যেমন, জহির রায়হান যখন চলে যান দেশ ছেড়ে। শহীদুল্লাহ কায়সার বলেছিলেন, ‘ও সীমান্তে থাকবে। সেখানে ওর প্রকৃত কাজ আছে। আমার কাজ এখানে।’ তাঁর কাজ কি ছিল এখানে? ‘বাংলাদেশের সব মানুষ কি ওপারে যেতে পারবে? পারবে না। যারা যেতে পারবে না, তারা প্রতিদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকবে। আতঙ্কে রাত কাটাবে, বিনিদ্র রাত যাপন করবে। তাদের সে- যন্ত্রনার কথা লিখব আমি’। [৯ক] আবার সিলেট মেডিকেল কলেজের প্রধান শল্য চিকিৎসক অধ্যাপক ডা: শামসুদ্দিন আহমদ বলেছিলেন, ‘আমরা ডাক্তার। রোগী ফেলে আহত মানুষ ফেলে আমরা তো কোথাও যেতে পারি না’। [২খ] তাকেও হত্যা করা হয়েছিল এপ্রিল মাসেই।

১৪ ডিসেম্বরের আগেও দেশে অবস্থানরত বুদ্ধিজীবী, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী দমন নিপীড়ন করেছে। কিন্তু বিজয়ের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে ১৪ ডিসেম্বরে যে হত্যাকাণ্ডের সংঘটিত হয় তার মূল পরিকল্পনায় কারা ছিল? পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার এ আর সিদ্দিকী একাত্তরে আন্তঃ বাহিনী জনসংযোগ দফতরের পরিচালক ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমার ধারণা রাও ফরমান আলীই সেই ব্যক্তি। কেননা ফরমান সেই ব্যক্তি যার উপর কর্তৃপক্ষের আস্থা ছিল সবচেয়ে বেশী। ফরমানই পারত নিঝুম নীরবতাকে প্রচণ্ড শক্তিশালী, সরব করে তুলতে। ফরমান হলেন সেই ব্যক্তি যিনি আপনার বক্তব্য শুনবেন, যার চেহারায় ধরে রাখা আছে একটা বৈদগ্ধ্যের ছাপ’। [১০ক]

জেনারেল নিয়াজী বলেন, ‘বুদ্ধিজীবীরা আমার কাছে কোন তাৎপর্যের অধিকারী ছিলেন না। আমার ছিল অস্ত্রধারী দুশমনদের নিয়েই মাথাব্যথা। তবে আলতাফ গওহর এ কথা উল্লেখ করেছেন যে, কেউ একজন আমাকে জানায় যে, ফরমানের কাছে বুদ্ধিজীবীর একটা তালিকা রয়েছে। আমি সেটার সত্যতা যাচাইয়ের করার জন্য কোন একজনকে পাঠাই আর তার অনুরোধে রাও ফরমান ঐ তালিকা থেকে দুটি নাম কেটে বাদ দেন। আমি বিষয়টা জানতাম না। আমি এটি আলতাফ গওহরের কাছ থেকে জেনেছি।’ [১০খ]

এই দুই পাকিস্তানির অভিযোগই ফরমান আলীর দিকে যাচ্ছে; এবার তাই শোনা উচিৎ এই রাও ফরমান আলী এ বিষয়ে কি বলেন! ঢাকা পতনের পর গভর্নমেন্ট হাউসে যেসকল লিখিত দলিল পাওয়া যায় তন্মধ্যে ফরমান আলীর লেখা বুদ্ধিজীবীদের একটা তালিকাও ছিল। তালিকায় যাদের নাম ছিল অধিকাংশকেই ১৪ ডিসেম্বরের পর আর খুঁজে পাওয়া যায় নি। আবার তাদের কাছে সঠিক ঠিকানা ছিলনা বলে অনেক শিক্ষক বেঁচেও গিয়েছিলেন। এই তালিকা সম্পর্কে ফরমান আলীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল; জবাবে রাও উত্তর দিয়েছিলেন, ঐ সময় অনেকে আমার কাছে এসে নানা জনের কথা বলত। যাদের বিরুদ্ধে বলত তাদের নাম আমি শুধু টুকে রেখেছিলাম।” কেন বলত? এই প্রশ্নের উত্তরে রাও জানাচ্ছেন,“কারণতারা ছিল পাকিস্তান বিরোধী। তাই ওদের ওসব আমি রেখে দিতাম বটে তবে সেগুলির ওপর একশন নিতাম না’ [১০গ] তিনি নিজেই এই তালিকার কথা স্বীকার করে এটাও জানাচ্ছেন যে তালিকাভুক্তরা ছিল পাকিস্তান বিরোধী। যদিও তিনি হত্যাকাণ্ডের কথা কৌশলে অস্বীকার করছেন, তবে এটার সাথে যে ওতপ্রোতভাবে জড়িত সেটা নিশ্চিন্তে বলা যায়। বাংলাপিডিয়াতে বলা আছে, পাকবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজীর সার্বিক নির্দেশনায় নীলনকশা বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেন ব্রিগেডিয়ার বশির, লেফটেন্যান্ট কর্নেল হেজাজী, মেজর জহুর, মেজর আসলাম, ক্যাপ্টেন নাসির ও ক্যাপ্টেন কাইউম।

ফরমানের এই ছোট কথোপকথনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে দালাদের কথা, যারা তার কাছে এসে অভিযোগ জানাত। দালাল বলতে শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামসকে বুঝানো হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে আলবদর ছিল আক্ষরিক অর্থেই ডেথ স্কোয়াড। তারা সরাসরি মাঠে ময়দানে গিয়ে লড়েনি, বরং পরিকল্পনা অনুযায়ী টার্গেট কিলিংই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে তারাই ছিল সবচেয়ে বেশী তৎপর এবং এদের সাহায্যেই পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরি করেছে, তারাই এসে বাসা থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছে এবং পরিশেষে হত্যা করেছে। এতে নেতৃত্ব দিয়েছে নিজামী মুজাহিদরা। আলবদর সম্পর্কে হুসেইন হাক্কানি বলেন,

” Two separate wings called Al-Badr and Al-Shams were organized. Well educated and properly motivated students from the schools and madrasas were put in Al-Badr wing , where they were trained to undertake ‘Specialized Operations,’ while the remainder were grouped together under Al-Shams, which was responsible for the protection of bridges, vital points and other areas ……. Bangladeshi scholars accused the Al-Badr and Al-Shams militias of being fanatical. They allegedly acted as the Pakistan army’s death squads and ‘exterminated leading left wing professors, journalists, litterateurs, even doctor. ” [১১]

১৯৭১ বুদ্ধিজীবী হত্যা নিয়ন আলোয় neon aloy

পাকিস্তানি দালাল গোষ্ঠী, মানে রাজাকার, শান্তি কমিটি, আলবদর, আল শামস – সকলের মনমানসিকতার সাথে আশ্চর্যজনক ভাবে পাকিস্তানি শাসকচক্রের চরম মিল বিদ্যমান। তারাও সর্বত্র ভারতীয় হিন্দু এবং দেশীয় হিন্দুদের ষড়যন্ত্র খুঁজে পেত। মনে রাখা প্রয়োজন পাকিস্তান সৃষ্টিতে বাঙালি মুসলমান অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল; কিন্তু যে স্বপ্ন নিয়ে পাকিস্তানের জন্যে আন্দোলন করেছিল তার সাথে বাস্তবতার বিরাট ফারাক দেখে এই বাঙালি মুসলমানের প্রতিবাদী অংশ পাকিস্তান তত্ত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। অপর দিকে পাকিস্তান কায়েমের ফলে যারা ফুলে ফেঁপে উঠেছিলেন তারা নিজেদের স্বার্থেই পাকিস্তান তত্ত্বকে আঁকড়ে ধরে রইলেন। ক্ষমতার স্বার্থের কারণেই জামায়াতে ইসলামীর মতো ধর্মীয় দলগুলো পাকিস্তানী সামরিক সরকারকে গণহত্যায় সাহায্য করে যেতে থাকে। উল্লেখ্য, ১৯৫০ সালের আমেরিকার গোপন নথি অনুযায়ী এই ইসলামী দলগুলো ছিল আমেরিকান মদদ পুষ্ট। একাত্তরের শুরু থেকেই বুদ্ধিজীবীদের প্রতি এই দালালগোষ্ঠীর আক্রোশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মোহাম্মদপুরে শান্তি কমিটির এক সংশ্লিষ্ট কমিটি আগস্টের ৯ তারিখ যে সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণ করে তার মধ্যে একটা ছিল, বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতির কারণে বাঙ্গালী সরকারি কর্মচারীবুদ্ধিজীবী ও ব্যবসায়ীদের ওপর ২৪ ঘণ্টা নজর রাখতে হবে (পরে তাদের সামরিক বিচার করে হত্যা করতে হবে)’ [১২]

আলবদর বাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যার কিছুদিন আগ থেকেই ঢাকার বুদ্ধিজীবীদের কাছে হুশিয়ারিমূলক বিভিন্ন চিঠি পাঠাতে শুরু করে। চিঠিটা ছিল এরকম-

‘শয়তান নির্মূল অভিযান
ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুদের যে সব পা চাটা কুকুর আর ভারতীয় ইন্দিরাবাদের দালাল নানা ছুতানাতায় মুসলমানদের বৃহত্তর আবাসভূমি পাকিস্তানকে ধ্বংস করার ব্যর্থ চেষ্টা করছে তুমি তাদের অন্যতম।তোমার মনোভাব, চালচলন ও কাজকর্ম কোনটাই আমাদের অজানা নেই। অবিলম্বে হুঁশিয়ার হও, এবং ভারতের পদলেহন থেকে বিরত হও, না হয় তোমার নিস্তার নেই। এই চিঠি পাওয়ার সাথে সাথে নির্মূল হওয়ার জন্য প্রস্তুত হও। – শনি’ [১৩]

জামায়াত ইসলামের মুখপাত্র দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় নভেম্বরের ১২ তারিখে প্রকাশিত ‘রোকেয়া হলের ঘটনা’ শিরোনামের সম্পাদকীয়তে সরাসরি বুদ্ধিজীবীদের হত্যার উপদেশ দেয়া হয়। এতে বলা হয়, “বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তর থেকে যারা এ দুষ্কর্মকে সহায়তা করছে তাদেরকে যদি খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয় তবে সেটাই সঠিক পদক্ষেপ হবে বলে আমরা মনে করি। সেই সাথে বুদ্ধিজীবীদের ‘ছদ্মবেশী দুষ্কৃতিকারী’ আখ্যা দিয়ে তাঁদেরকে উচ্ছেদের আহ্বান জানানো হয় এবং আশা করা হয় যে, এর মাধ্যমেই ‘হিন্দুস্তানি চরদের সকল চক্রান্ত নস্যাৎ করে’ দেয়া সম্ভব হবে। [১৪]

ধর্মান্ধ আলবদর হত্যাকাণ্ডগুলো সম্পাদন করেছিল ঠিকই, তবে পাকিস্তানীদের পাশাপাশি এর আড়ালে কলকাঠি নাড়ছিল সাম্রাজ্যবাদী আরেক শক্তি। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের কথা বলতে হয়। একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদের সাথে তাঁর বড় ভাই আরেক প্রখ্যাত সাহিত্যিক শহীদুল্লাহ কায়সারকেও আলবদর বাহিনী ধরে নিয়ে যায় এবং পরবর্তীতে তাঁর আর কোন খোঁজ পাওয়া যায় না। বিজয়ের পর কলকাতা থেকে দেশে ফিরেই জহির রায়হান বুদ্ধিজীবী হত্যা ও গনহত্যার তথ্য অনুসন্ধান ও ঘাতকদের ধরার জন্যে এশতেহাম হায়দার চৌধুরী, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, ব্যারিস্টার মওদুদ, ডঃ সিরাজুল ইসলাম সহ আরো অনেককে নিয়ে ‘বুদ্ধিজীবি হত্যা তদন্ত কমিটি’ নামে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করেন। এই কমিটিতে কাজ করতে গিয়ে তিনি আলবদর ও রাজাকারদের অনেক গোপন তথ্যও উদ্ধার করেছিলেন। বুদ্ধিজীবিদের হত্যার পিছনে কারা জড়িত ছিলেন এবং হত্যাকারীদের অনেকেরই গোপন আড্ডাখানা সম্পর্কেও তথ্য উদঘাটন করেছিলেন জহির রায়হান। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, ‘আলবদরদের কার্যকলাপ অনুসন্ধান করতে যেয়ে আমরা এই সাথে অপরাধীদের প্রকৃত উদ্দেশ্য বুঝবার জন্য নানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছি। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে যখন নিহত বাবা ও ভাইয়ের দেহের অবশেষ ঢাকায় বধ্যভূমিতে খুঁজে ফিরছিলেন তখন আমাদের ধারণা ছিল যে দখলদার পাকিস্তানি শাসকদের নিশ্চিত পরাজয় উপলধ্বি করে সন্ত্রস্ত গোঁড়া ধর্মধ্বজী পশু ক্রোধান্ধ হয়ে কাপুরোষোচিত হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে প্রতি হিংসাবৃত্তি চরিতার্থ করেছে। কিন্তু পরে বুঝেছি ঘটনা তা ছিল না। কেননা এই হত্যাকাণ্ডের শিকার যারা হয়েছে তারা বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের স্থানীয় প্রতিনিধি এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মনোভাবের জন্যে সুপরিচিত ছিলেন’। [৮খ]

এখানে দুটো নাম সামনে আসে – হেইট ও ডুসপিক। হেইট মার্কিন সেনাবাহিনীতে চাকরি করত এবং পরবর্তীতে সামরিক গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করে। অন্যদিকে ডুসপিক ছিল সিআইএ’র এজেন্ট এবং এই দুজন রাও ফরমান আলীর সাথে মিলে প্রায় তিন হাজার বুদ্ধিজীবীর একটা তালিকা তৈরি করে। এছাড়াও বুদ্ধিজীবীদের হত্যার কাজে বিদেশী মুখোশ, ছদ্ম পোশাক ও ছোরা ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। [৮গ] এটাই প্রমাণ করে যে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার জন্যে আলবদরের সাথে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আমেরিকাও জড়িত ছিল ওতপ্রোতভাবে। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে বুদ্ধিজীবী যাদেরকে মারা হয়েছিল তাদের অধিকাংশই বাম রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। তাদেরকে নির্মূল করার সাম্রাজ্যবাদীদের এই আক্রমণ মোটেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং ১৯৫০ সালে কমিউনিস্ট প্রভাব রখতে গৃহীত কর্মসূচিরই আরেক রূপ।

পাকিস্তানিরাও তাদের ক্রোধের কারণে বুদ্ধিজীবীদের সহ্য করতে পারত না, আবার অন্যদিকে আমেরিকাও সাম্রাজ্যবাদী নীতির কারণে বুদ্ধিজীবীদের দেখতে পারত না; ফলস্বরুপ দুই দলই চেয়েছে এই হত্যাকাণ্ড এবং এতে সহকারী এবং কার্যসম্পাদনকারী হিসেবে পেয়েছিল স্থানীয় দালালদেরকে, যাদের ভয়াবহতা দেখে এক বিদেশী সাংবাদিক বলেছিলেন, ‘It’s not only utterly shocking but we are ashamed that we belong to human race which is capable of doing this’.

তবে কি বুদ্ধিজীবীরা ‘নির্বোধ’ ছিলেন?

পঁচিশ মার্চ রাতে পাকিস্তানিরা যখন ঢাকা সহ সারা দেশে আক্রমণ করলো, তখন অনেকে বুদ্ধিজীবীই মারা যান; পরবর্তীতে অনেকেই দেশ ছেড়ে কলকাতায় আশ্রয় নিয়ে বিভিন্ন উপায়ে মুক্তিযুদ্ধে সহযোগীতা করেন এবং কেউ কেউ সরাসরি মুক্তিযুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেন। আবার তাদের মধ্যে অনেকেই কর্মস্থলে থেকে যান; এখন অনেকেই প্রশ্ন করেন এই বুদ্ধিজীবীরা কেন এমতাবস্থায় পড়ে রইলেন কর্মস্থলে? কিভাবে সহকর্মীর বুকের রক্তের উপর দিয়ে কর্মস্থলে যোগদান করতে পারলেন? কেন তারা দেশে ছেড়ে চলে গেলেন না? দেশ ছেড়ে চলে গেলেতো আর মরতে হতো না; তাহলে কি তাঁরা ‘নির্বোধ’ ছিল? এই প্রশ্নগুলো কিছুদিন যাবত অহরহ শোনা যাচ্ছে। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর, মানে এই বুদ্ধিজীবীদের অবদান খোঁজার পূর্বে আরো কিছু বিষয়ে আমাদের ধারণা স্পষ্ট করতে হবে।

এটা পরিষ্কার যে, ১৯৬৬ এর পর থেকেই ধীরে ধীরে তুমুল জাগরণের সৃষ্টি হচ্ছিল এবং আন্দোলনে সমাজের সকল শ্রেনীর মানুষের অংশগ্রহণও বাড়ছিল। এমনকি, ২৫শে মার্চের রাতের ক্র্যাকডাউনের পর জনসাধারনের মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়াটাও ছিল স্বতঃস্ফুর্ত। তবে, এটাও মনে রাখা উচিত সবাই একটি ফুলকে বাঁচানোর জন্যে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েনি। জহির রায়হানের ‘সময়ের প্রয়োজন’ ছোটগল্পে দেখা যায় সেক্টর কমান্ডার যখন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশ্ন করছেন, ‘কেন যুদ্ধ করছ?’, একেকজনের উত্তর ছিল একেকরকম। কেউ বলছেন মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য, কেউ বলছেন মা-বোনদের হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য, কেউ বলছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করছি, কেউ বলছেন ওদের শোষন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য, কেউ বলছেন গুন্ডা, বদমাশ, মহাজন, ধর্ম-ব্যবসায়ীদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য। আবার কেউ বলছেন, সময়ের প্রয়োজনে লড়ছি। ‘আমাদের মাটি থেকে ওদের তাড়াতে হবে। এটাই এখনকার প্রয়োজন’। [১৫]

জহির রায়হানের ছোটগল্পটার কথা গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করলাম কেননা সেটা সে সময়েই রচিত হয়েছিল এবং যেহেতু যুদ্ধের সাথে নানাভাবেই তিনি জড়িত ছিলেন, তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা সেখানে স্থান পাবে সেটাই স্বাভাবিক। জনগনের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্য যেমন বহুমাত্রিক ছিল তেমনি তাদের ‘অবদান’ ছিল বহুমাত্রিক;। উদাহরণস্বরূপ, মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান নিয়ে কথা বলতে গেলে বৃহৎ পরিসরে চিন্তা করতে হবে। নারীকে আমরা যেমন পাচ্ছি সম্মুখ যুদ্ধে, তেমনি তাদেরকে পাচ্ছি সেবিকা হিসেবে যিনি আহতদেরকে সেবা-সুশ্রুষা করছেন, যিনি শরণার্থী শিবিরে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন শিক্ষিকা ও নার্স হিসেবে, তেমনি তাদেরকে পাচ্ছি রাধুনী হিসেবে যিনি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে রান্না করে দিচ্ছেন। সে সাথে নারীকে পাচ্ছি নির্যাতিতা হিসেবে যিনি পাকিস্তানিদের লালসার স্বীকার হচ্ছেন এবং পরবর্তীতে আমাদের কাছেই সামাজিকভাবে নিগৃহীত হচ্ছেন। আবার, নারীদের বিশাল অংশ পাচ্ছি যারা পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করছেন একজন সাহায্যকারী মা, স্ত্রী এবং বোন হিসেবে। একদিকে তারা স্বামী-সন্তান-পিতাকে হারিয়েছেন, অন্যদিকে তারাই গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে আশ্রয় দিচ্ছেন, খাবার দিচ্ছেন এবং যুদ্ধকালীন সময়ে বাচ্চা ও বৃদ্ধদের দেখভাল করছেন। এই নারীদের কেউ কেউ পরিবার হারিয়েছেন, সম্পদ হারিয়েছেন, জীবিকা হারিয়েছেন। পিতৃতান্ত্রিক এই সমাজে পুরুষ যেখানে পরিবারের প্রধান সেখানে স্বামী-সন্তান-পিতাকে হারিয়ে অভিভাবকহীন কিংবা নিঃস্ব হয়ে পড়া নারীদের যন্ত্রনাটুকুকেও নারীর অবদানের মধ্যেই রাখতে হবে। উল্লেখ্য, একারণেই যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ‘নারী প্রধান’ পরিবারের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল নাটকীয়ভাবে। [১৬] এখানে নারীর অবদানের বহুমাত্রিকতা পাওয়া যাচ্ছে।

মূল আলোচনা অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের অবদান প্রসঙ্গে কথা বলার পূর্বে আমাদেরকে ‘অবদান’ বিষয়ে সংকীর্ণ মানসিকতা ঝেড়ে এর বিস্তৃত পরিসরের বিষয়টা পরিষ্কার করে চিন্তা করতে হবে। সবাই যে একভাবে কিংবা নির্দিষ্ট কিছু উপায়ে যুদ্ধে সামিল হবে – এটা ভ্রান্ত ধারণা। যে যার জায়গা থেকে লড়বে এবং লড়েও গিয়েছে, অনেকটা শেখ মুজিবের আহ্বানের মতো, যার কাছে যা কিছু আছে তা নিয়ে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়। আবার জনগনের সবাই যে সর্বাত্নক যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়বে সেটাও হয় না। ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক ভূমিকা পালন না করেও যুদ্ধকালীন সময়ে অনেককেই ব্যস্ত থাকতে হয় জীবন ধারণের জন্যে, বেঁচে থাকার জন্যে। তারা কখনো আশ্রয় নিয়েছে শরণার্থী শিবিরে, কখনোবা দেশের ভেতরেই গোপনে যুদ্ধকালীন সময় অতিবাহিত করেছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, বাঙালিরা শুধুমাত্র সামরিক দিক থেকেই সংগ্রাম করেনি, বরং সেটা ছিল সর্বক্ষেত্রে। একাত্তরের পূর্ব থেকেই সাংস্কৃতিক ফ্রন্টে যে আন্দোলন চলছিল একাত্তরের পাকি বর্বরতার নয়মাস জুড়েও সেটা বহাল ছিল। একেকটা গান কবিতা ছিল বারুদের মতো; উদ্ধুদ্ধ করেছে, প্রেরণা দিয়েছে, সাহস জুগিয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের। ‘চরমপত্র’র কথা সর্বজনবিদিত। এ ধরনের অবদানের পাশাপাশি জনসাধারণের একটা বিশাল অংশ পরোক্ষভাবে অবদান রেখে যাচ্ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। তারা মুক্তিযোদ্ধাদেরকে গোপনে আশ্রয় দিয়েছেন, বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছেন, শত্রু সম্পর্কে তথ্য দিয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র লুকিয়ে রাখতে সাহায্য করছেন, গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করে দিয়েছেন ইত্যাদি। সেলিনা হোসেনের ‘হাঙ্গর নদীর গ্রেনেড’ উপন্যাসে একজন মা’কে পাওয়া যায় যিনি মুক্তিযোদ্ধাদেরকে বাঁচাতে নিজের প্রতিবন্ধি ছেলেকে পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দিয়েছেন। উপন্যাসটা তিনি রচনা করেছিলেন একটা সত্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে। [১৭] সিলেটের চা বাগানে এরকম নিদর্শন পাওয়া যায়, যেখানে শ্রমিকরা মুক্তিযোদ্ধাদের চলাচলের জন্যে বাগানের মধ্য দিয়ে রাস্তা তৈরী করে দিয়েছেন। [১৮] মূল কথা হচ্ছে, যদিও পরোক্ষ অবদানের জন্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় কোন স্বীকৃতি মিলে না, তবু মু্ক্তিযুদ্ধে অবদান প্রসঙ্গে কথা বলতে হলে এই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অবদান দুটোকেই আলোচনার মধ্যে না রাখলে আলোচনাটা সম্পূর্ণ হবে না।

একাত্তরের নয়মাসের ভূমিকার ওপর ভিত্তি করে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের আমরা মোটাদাগে দুইভাগে ভাগ করতে পারি; এক, পাকিস্তানপন্থী অর্থাৎ পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী এবং দুই, বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। প্রথম পক্ষ মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে এবং অন্য পক্ষ মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই পচিশে মার্চ রাতের আক্রমনেই শহিদ হন। এবং পরবর্তীতে তাদের কিছু অংশ ভারতে চলে যান এবং সেখানে মুজিবনগর সরকারকে বিভিন্ন উপায়ে সাহায্য করেন ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে লড়েন। কেউ কেউ থেকে যান দেশের ভেতরে। অর্থাৎ, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকাকে আবারো মোটা দাগে দুই ভাগে বিভক্ত করা যায়, এক, দেশের বাইরে এবং দুই, দেশের ভেতর। [১৯] দেশের ভেতরের বুদ্ধিজীবীদের একটা অংশ সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন এবং আরেকটা অংশ থেকে যান তাদের কর্মস্থলে। কর্মস্থলে থেকে যাওয়া অংশের ভূমিকা নিয়েই আমাদের মূল আলোচনা।

পাকিস্তানপন্থী বুদ্ধিজীবীদের কর্মকান্ড নিয়ে শুরুতেই কিছুটা আলোচনা করা উচিৎ, কেননা তারাও যেমন নয়মাস কর্মস্থলে ছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের বুদ্ধিজীবীরাও তেমনি কর্মস্থলে ছিলেন। দুই গ্রুপের কর্মকান্ডকে স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা উচিৎ, নাহলে দুটো ভিন্নধারার কর্মকান্ডকে গুলিয়ে ফেলা হয়ে যেতে পারে যা বর্তমানে হচ্ছে এবং যার কারণেই এই লেখার অবতারণা।

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, স্বপ্নের সাথে বাস্তবতার বিরাট ফারাক দেখে বাঙালি মুসলমানদের প্রতিবাদী অংশ যখন পাকিস্তান তত্ত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছিল তখন অপর দিকে পাকিস্তান কায়েমের ফলে যারা ফুলে ফেঁপে উঠেছিলেন তারা নিজেদের স্বার্থেই পাকিস্তান তত্ত্বকে আঁকড়ে ধরে রইলেন। এবং তাদের মন মানসিকতার সাথে পাকিস্তানি জেনারেলদের চিন্তাধারা ও মন মানসিকতার ভয়ংকর মিল পরিলক্ষিত হয়। পাকিস্তানপন্থী এমন বুদ্ধিজীবীরা একাত্তরে সক্রিয়ভাবেই পাকিস্তানিদের সাহায্য করেছেন; যুদ্ধকালীন সময়ে রচিত আনোয়ার পাশার ‘রাইফেল রোটি আওরাত’ উপন্যাসে এর কিছুটা পরিচয় পাওয়া যায়। তারা পাকিস্তানিদের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন, পাকিস্তানিদের গণহত্যার কথা অস্বীকার করে বিশ্ব মিডিয়াতে বিবৃতি দিয়েছেন, গণহত্যাকে ও ধর্ষনকে জায়েজীকরণের চেষ্টা করেছেন, বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা প্রণয়নে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেছেন। যুদ্ধকালীন নয়মাস জুড়ে বুদ্ধিজীবীদের ওপর যে গ্রেফতার-দমন-পীড়ন চলে সেখানেও তাদের ছিল সরব ভূমিকা। পাকিস্তান পন্থী বুদ্ধিজীবী তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্য ড সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন ও ইতিহাসের অধ্যাপক ড মোহর আলী ৮ জুলাই ‘লন্ডন টাইমস’ পত্রিকায় এক পত্রে ‘পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদের জীবনের নিরাপত্তা নেই’ কথাটার প্রতিবাদ জানান। গণহত্যার কথাও অস্বীকার করেন তারা। [২০ক] উল্লেখ্য, গ্রন্থাগার বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আহমদ হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের সামনে জনসম্মুখেই বলেছিলেন,“পাকিস্তানি বাহিনী যদি বাঙালী নারীদের শ্লীলতাহানি করে তবে তাদের কোন পাপ হবে না, কারণ ইসলাম রক্ষার জন্য জিহাদে নিয়োজিত। তাদের জন্য এই কাজ ‘মুতা’ বিবাহের পর্যায়ে পড়ে”। [১৩খ] এই বুদ্ধিজীবীদের কারো কারো সাথে রাও ফরমান আলির সরাসরি যোগাযোগ ছিল এবং রাওয়ের নির্দেশে অনেকেই কাজ করতেন। সেই সাথে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বুদ্ধিজীবীদের নামের তালিকা প্রণয়নেও সাহায্য করতেন তারা। [২০খ ] সারকথা হচ্ছে, একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পিছনে এই পাকিস্তানপন্থী বুদ্ধিজীবীদের এক বিরাট ভূমিকা রয়েছে।

পূর্বেই উল্লেখ করেছি, কর্মস্থলে যেমন এই পাকিস্তানিপন্থীরা থেকে গিয়েছিল, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের অনেকেও থেকে যান। গোপনে সেখান থেকে তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করতে থাকেন। তাদের কাজের ধরণটা ছিল এরকম – মুক্তিযুদ্ধের জন্যে অর্থ সংগ্রহ করেছেন, গেরিলাদের আশ্রয়দান করেছেন, সেবা সুশ্রুষা করেছেন, লুকিয়ে ঔষধপত্র বিতরণ করেছেন ও তথ্য সরবরাহ করেছেন। তাদের কাজের কিছু নমুনা উল্লেখ করা যেতে পারে।

ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক গিয়াসউদ্দীন আহমেদ প্রত্যক্ষভাবেই জড়িত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। প্রাণের মায়া ত্যাগ করে সর্বাত্নক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে। আত্নীয় -স্বজন ও পরিচিতজনদের কাছ থেকে গোপনে অর্থ, বস্ত্র, খাদ্য জোগাড় করে পৌছে দিতেন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। তার এমন কর্মকান্ডের কারণে নভেম্বর মাসে পাকিস্তানি বাহিনী আরো কয়েকজন অধ্যাপকের সাথে তাকে গ্রেফতার করে এবং পরবর্তীতে জিজ্ঞাসাবাদের পর ছেড়ে দেয়। তার কাজের উল্লেখ পাওয়া যায় কবি সুফিয়া কামালের মন্তব্যে, ‘ভুলবো কি করে গিয়াসউদ্দীনের কথা? মাথায় গামছা বেধে লুঙ্গি পরে গিয়াস প্রায়ই রাতে চুপিসারে পিছনে পথ দিয়ে দেয়াল টপকে আসতো রিকশাওয়ালা সেজে। চাল নিয়ে যেত বস্তায় করে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে। প্রতিবেশী অনেকেই ঢাকা ছেড়ে যাবার আগে আমার কাছে রেশন কার্ড রেখে গিয়েছিলেন। সেই কার্ডে আমি চাল চিনি উঠিয়ে রাখতাম। সেগুলো গিয়াস নিয়ে যেত। গিয়াসের ওপর পাক সেনা রাজাকারদের চোখ ছিল অতন্দ্র। ১৪ ডিসেম্বর ওকেও রাজাকাররা হত্যা করেছে’। [ ২১ ]

বিখ্যাত উপন্যাস ‘রাইফেল রোটি আওরাত’র লেখক অধ্যাপক আনোয়ার পাশা গোপনে প্রচার-পত্রিকা প্রকাশ করে বিলিয়ে দিয়ে মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষে নতুন টাইপরাইটার কিনেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে চাঁদা পাঠাতেন নিয়মিত। একাত্তরের সেই উত্তাল সময়ে বসেই তার উপন্যাসে তিনি ধারণ করতে পেরেছিলেন সে সময়টাকে। [ ২২ক ]

সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর পর্যন্ত সমকালীন প্রতিটা আন্দোলনের সাথেই মুনীর চৌধুরীর সম্পৃক্ততা ছিল। যদিও দাউদ পুরষ্কার লাভ এবং পাক সরকারের বিদেশ সফরের তালিকায় তাঁর নাম থাকা নিয়ে তাঁকে প্রচন্ড সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল তবুও ১৯৬৭ সালের দিকে পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্র বিরোধী প্রচার শুরু করলে তিনি তার তীব্র প্রতিবাদ জানান। সেই প্রতিবাদলিপির প্রথম স্বাক্ষর প্রদানকারী ব্যক্তি ছিলেন মুনীর চৌধুরী। [২৩ক] পরের বছর সংস্কারের নামে বাংলা বর্ণমালা বিলোপের উদ্যোগ নেওয়া হলে তিনি তারও প্রতিবাদ করেন। ১৯৭১ সালের মার্চে অসহযোগ আন্দোলনের সাথে একাত্নতা ঘোষনা করে ১৯৬৬-তে পাকিস্তান সরকারের দেওয়া সিতারা-ই-ইমতিয়াজ খেতাব বর্জন করেন। [২৪] খেতাব বিসর্জনের এই প্রতিবাদ স্বাধীনতার উষালগ্নেই কি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তাঁর সমর্থনকে জানান দেয় না? তবু উপরোক্ত সে সমালোচনার দিকে ইঙ্গিত করে মুনীর চৌধুরীর মৃত্যুর পর অনেকেই প্রশ্ন করেছিলেন, তাঁকে কেন মারল? সে জবাবে আনিসুজ্জামান বলেছিলেন, ‘আপনাদের চেয়ে ওরা তাঁকে ভালো চিনেছিল বলে।’ [২৩খ]

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যারা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে ছিলেন এবং এমন কর্মকান্ডের সহিত জড়িত ছিলেন তারা স্বাভাবিকভাবেই শাসকদের রোষানলে পড়েন। আগস্ট মাসের দিকে পাঁচজন শিক্ষককে গ্রেফতার করে মানসিক নির্যাতন চালানো হয়। তারা হলেন- ড আবুল খায়ের, অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, অধ্যাপক কে এম সাদউদ্দিন, অধ্যাপক আহসানুল হক ও অধ্যাপক শহিদুল্লাহ। পরবর্তীতে অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ এবং অধ্যাপক জহুরুল হককে গ্রেফতার করে ছেড়ে দেয়া হয়। এছাড়াও টিক্কা খান প্রফেসর মুনীর চৌধুরী, ড নীলিমা ইব্রাহিম, ড সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ও ড এনামুল হককে সাবধান করে দেন। [ ২০গ ] আলবদরেরা যে তালিকা ধরে ধরে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল সেখানে অন্যদের সাথে ড সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীও ছিলেন। তিনি বলেন, ‘তালিকাতে আমার নামও ছিল, ঠিকানা জানতো না বলে বেঁচে গেছি। [ ২৫ ] ড মুহম্মদ হাবিবুল্লাহকে পদচ্যুত করা হয় এবং ড মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানকে পদচ্যুত ও ছয় মাসের আটকাদেশ দেয়া হয়। পাকিস্তানি দালাল বুদ্ধিজীবীরা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের এই বুদ্ধিজীবীদেরকে ‘যমদূত’ নামে চিঠি দিয়ে নিয়মিত হুমকি প্রদানও করতেন। [২০ঘ]

বিখ্যাত সাংবাদিক শহিদুল্লাহ কায়সার দেশে থেকে গিয়েছিলেন শুধুমাত্র মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার জন্যেই। যুদ্ধকালীন সময়ে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে নিয়মিত পাঠাতেন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। শহিদুল্লাহ কায়সারই তাজউদ্দীন আহমদের কাছে এপ্রিলের দিকে কিছু উপদেশ ও নির্দেশনা প্রেরণ করার জন্য মইদুল হাসানকে ভারত পাঠিয়েছিলেন। সেখানে যাওয়ার পর এই মইদুল হাসানের ওপর আরো বড় দায়িত্ব ন্যাস্ত হয়েছিল; তাঁর ভাষায়, ‘যা আমার চিন্তা ও কর্মসূচি আপাদমস্তক পাল্টে ফেলে’। [২৬]

উল্লেখ করতে হয় এখানে ‘শিলালিপি’ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক সেলিনা পারভীনের কথা। ১৪ ডিসেম্বর তিনিও শহিদ হয়েছিলেন আলবদরের হাতে। তৎকালীন সময়ে তাঁর পত্রিকা স্বাধীনতার স্বপক্ষে বলিষ্ট ভূমিকা রেখেছিল এবং ‘শিলালিপি’ পত্রিকার বিক্রয়লদ্ধ টাকা দিয়ে তিনি সাহায্য করতেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের; কখনো খাবার পাঠিয়ে, কখনো ওষুধ পাঠিয়ে, কখনোবা অর্থের যোগান দিয়ে। [২৭]

ডা আলীম চৌধুরী, ডা ফজলে রাব্বীরা বিদেশের মাটিতে আশ্রয় না নিয়ে দেশে নিজেদের কর্মস্থলে থেকে যান। তারা গোপনে একটা হাসপাতাল করে সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করতেন। ডা আলীম চৌধুরীর কর্মকান্ড সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় তাঁর স্ত্রীর বক্তব্যে, “মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা ছিলো তাঁর একটা বড় রকমের দায়িত্ব। প্রায়ই ছেলেরা, মুক্তিযোদ্ধারা বাসায় আসতো। আবার আলীম নিজেও যেতো ওদের চিকিৎসা করতে। ওদের গোপন হাসপাতাল ছিল। ডাক্তার ফজলে রাব্বি এবং আরও অনেকেই ওখানে গিয়ে ওদের চিকিৎসার কাজ করতেন। … আসলে কারফিউ ঊঠে গেলেই আলীমের কাজ আরম্ভ হতো। গাড়ির বনেট ভর্তি করে ও ওষুধ সংগ্রহ করতো বিভিন্ন ফার্মেসি আর ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে। এগুলো আবার গোপন ঘাটিতে নিয়ে গিয়ে পৌছে দিয়ে আসতো। মুক্তিবাহিনীর জন্য ও বহু টাকা চাঁদাও তুলেছে। কিন্তু গোপনে এতো যে কাজ করতো, সে কথা ও কারো কাছে বলতো না। এমনকি আমার কাছেও না। আলীমের মৃত্যুর পর ওর ডাক্তার বন্ধু-সহকর্মীরা এসে আমাকে এসব বলেছেন”। [২৮ক]

ডা আলীম চৌধুরী তাঁর প্রতিবেশীর অনুরোধে যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে নিজ বাসায় আশ্রয় দিয়েছিলেন এক অসহায় ব্যাক্তিকে। পরবর্তীতে দেখা যায় সে ‘ব্যাক্তি’টিই আলবদরের নেতা মাওলানা মান্নান। মান্নান ও তার শিষ্যদের হাতে ১৪ ডিসেম্বর শহীদ হন ডাক্তার আলিম চৌধুরী। [২৮খ]

১৯৭১ বুদ্ধিজীবী হত্যা নিয়ন আলোয় neon aloy

আলোচনার খাতিরে শুধুমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা ঢাকা শহর কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীদের অল্প কিছু কর্মকান্ডের দিকে নজর দিয়েছি। কিন্তু অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবদান ছিল এরকমই। সেই সাথে আইনজীবী, ডাক্তার, সাহিত্যিক, শিল্পী – সবাই যার যার অবস্থান থেকে লড়ে গিয়েছেন। এমনকি দেশের বিভিন্ন স্কুল কলেজের শিক্ষকেরাও গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে বিভিন্ন উপায়ে সাহায্য করেছেন, কখনো আশ্রয় দিয়ে কখনো আর্থিক সাহায্য দিয়ে। বিভিন্ন এলাকাতে সাধারন মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে এই শিক্ষকদের অবদান অনস্বীকার্য। উদাহরণস্বপরুপ, কুষ্টিয়া দর্শনা কলেজের অধ্যক্ষ লতাফত হোসেন মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদে সীমান্ত পার হতে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করতেন, নিজের বাসা ও কলেজকে যোদ্ধাদের আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ দিতেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে বিভিন্ন খবর ও খাবার দুটোই সংগ্রহ করতেন। [২২খ] এ জন্যেই যুদ্ধের নয়মাসের বিভিন্ন সময়ে তারা পাকিস্তানিদের আক্রমনের শিকার হয়েছেন, শহিদ হয়েছেন।

বুদ্ধিজীবীদের এ ভূমিকাকে কি আমরা কোনভাবে অস্বীকার করতে পারব? না। তাহলে বর্তমানে কেন প্রশ্ন উঠছে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে? সহজ ভাষায় বলতে গেলে, যখন আপনি মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রাখার উপায়টাকে নির্দিষ্ট কিছু কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রেখে দেন তাহলেই সমস্যার উদ্ভব হয়। আমরা যখন ধরে নিচ্ছি যে পাকিস্তানিদের আক্রমণ করার পর সকলেই প্রতিবাদস্বরুপ চাকরি ছেড়ে দিবেন কিংবা ভারতে চলে যাবেন কিংবা সরাসরি অস্ত্র হাতে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়বেন তখনই প্রশ্নগুলো ওঠে। তাই শুরুতেই বলেছিলাম ‘অবদান’ এর বিস্তৃত পরিসরের কথা। একটা বিষয় উল্লেখযোগ্য, বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশ কাজই করতেন গোপনে; অনেক সময়ে পরিবারের মানুষ জানতেন না। ডা আলিম চৌধুরীর কর্মকান্ড সম্পর্কে তাঁর স্ত্রী জানতে পারেন তাঁর মৃত্যুর অনেক পরে। হয়তোবা অনেক বুদ্ধিজীবীর অনেক কাজই আমাদের আড়ালে রয়ে গেছে এখনো। এটাও বুঝতে হবে, এই বুদ্ধিজীবীদের অবদান আমি আপনি জানি আর নাই জানি পাকিস্তানিরা ঠিকই জানত, নিয়মিত খবরও রাখত। তাই দেখা যাচ্ছে তাদেরকে নিয়মিত নোটিশ দেয়া হয়েছে, হুমকি দেয়া হয়েছে এবং পরিশেষে তালিকা করে মেরে ফেলে দেয়া হয়েছে বধ্যভূমিতে।

তথ্যসূত্রঃ

১) মুনতাসির মামুন ও জয়ন্তকুমার রায়, মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিঃ সিভিল সমাজের সংগ্রামের ২৫ বছর ।
২) স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র
৩) বদরুদ্দীন উমর, বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের সামাজিক খুটি বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা , সংস্কৃতি, ২০১৬।
৪) আহমদ ছফা, সাম্প্রতিক বিবেচনাঃ বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস ।
৫) হাসান ফেরদৌস, ১৯৭১ বন্ধুর মুখ শত্রুর ছায়া ।
৬) মুনতাসির মামুন, পাকিস্তানি জেনারেলদের মন।
৭) রাও ফরমান আলী খান, বাংলাদেশের জন্ম

৮) মুনতাসির মামুন, আলবদর ১৯৭১ ।
৯) পান্না কায়সার, মুক্তিযুদ্ধঃ আগে ও পরে ।
১০) মুনতাসির মামুন ও মহিউদ্দিন আহমেদ, পাকিস্তানিদের দৃষ্টিতে একাত্তর ।

১১) Husain Haqqani, Pakistan Between Mosque and Military
১২) মুনতাসির মামুন, শান্তি কমিটি ১৯৭১

১৩) শাহরিয়ার কবির. আহমদ শরীফ. কাজী নূর-উজ-জামান, একাত্তরের ঘাতক ও দালালেরা কে কোথায়
১৪) আলী আকবর টাবী, মুক্তিযুদ্ধের দৈনিক সংগ্রামের ভূমিকা

১৫) জহির রায়হান, ‘সময়ের প্রয়োজনে’
১৬) Angela Debnath, The Bangladesh Genocide: The Plight of women
১৭) সেলিনা হোসেন, ‘হাঙ্গর নদীর গ্রেনেড’ মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা উপন্যাস, দৈনিক যায় যায় দিন

১৮) দীপংকর মোহান্ত, মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের চা শ্রমিক
১৯) অজয় রায় , আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
২০) রফিকুল ইসলাম, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
২১) সুফিয়া কামাল, মুক্তিযুদ্ধ মুক্তির জয়
২২) খোদেজা খাতুনমুক্তিযুদ্ধে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের ভুমিকা
২৩) সরকার সোহেল রানা , মুনীর চৌধুরী, দৈনিক বনিক বার্তা

২৪) বাংলাপিডিয়া
২৫) সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, একাত্তরের যুদ্ধ ও জাতীয়তাবাদের সীমা, নতুন দিগন্ত

২৬) মইদুল হাসান, উপধারা একাত্তরঃ মার্চ-এপ্রিল
২৭) শহীদ বুদ্ধিজীবী সেলিনা পারভীন স্বারক গ্রন্থ

২৮) শ্যামলী নাসরীন চৌধুরী, একাত্তরের শহীদ ডাঃ আলীম চৌধুরী

 

কৃতজ্ঞতা: নিয়ন আলো

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত