| 19 এপ্রিল 2024
Categories
ইতিহাস লোকসংস্কৃতি

বাঙালির খাবার দাবার

আনুমানিক পঠনকাল: 12 মিনিট

।।মাহবুব আলম।।


বাঙালির চিরকালের পরিচয় ‘ভেতো বাঙালি’। অর্থাৎ যাদের প্রধান খাদ্য হলো ভাত। এই অভ্যাসের উৎস আদি অস্ট্রেলীয় জনগোষ্ঠী। প্রশান্ত মহাসাগরের প্রান্তে অবস্থিত বাংলাদেশে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের খাদ্যাভাসের প্রভাব থাকাই স্বাভাবিক। প্রাচীনকালে গরিব বাঙালির মুখে শোনা যেত দুঃখের কাঁদুনী, ‘হাড়িত ভাত নাহি নিতি আবেশী’ (চর্যাপদ)। মানে ‘ঘরে ভাত নেই তবু অতিথির আসা যাওয়ার কমতি নেই’। তবে ধনী-নির্ধন সব বাঙালির প্রিয় খাদ্য গরম ভাতে গাওয়া ঘি। যারা দিন আনে দিন খায়, তাদের চরম প্রাপ্তি হলো—পান্তা ভাতে বাইগন পোড়া। পণ্ডিতরা বলেন, প্রকৃত বাঙালির মনমতো খাবার ছিল কলাপাতায় ‘ওগ্গারা ভত্তা গাইক ঘিত্তা’, অর্থাৎ গাওয়া ঘি আর ফেনা ভাত। দুধ আর সরু চাল মিশিয়ে পায়েস বড়মানুষের প্রিয় খাদ্য।
‘নৈষধী চরিত’-এর রচয়িতা শ্রী হর্ষ দ্বাদশ শতকের কবি (অনুবাদক ড. করুণাসিন্ধু দাস, কলকাতা, ১৯৮২)। এই কাব্যকথায় খাদ্যের বৈচিত্র্য এবং রন্ধনশিল্পীদের নৈপুণ্যের অনেক তথ্য রয়েছে, তবে শ্রী হর্ষের দেয়া ভাতের বর্ণনাটিও উপভোগ করার মতো—লোকেরা সাগ্রহে ভাত খেলেন, তাতে ধোঁয়া উঠছিল, ভাত মোটেই ভাঙ্গা নয়, গোটা, পরস্পর আলাদা, কোমল ভাব হারায়নি, সুস্বাদু, সাদা, সরু, সুগন্ধযুক্ত। এরকম ভাত রাঁধাতে এলেম দরকার, যে ভাত রান্না এখনও বাঙালি গৃহিণীদের নৈপুণ্যের পরীক্ষা স্বরূপ এবং এই পরীক্ষায় সফল হলে ভোজনরসিকের বাহবা মেলে পরীক্ষার্থীর। শ্রী হর্ষের উপমা ক্ষমতা প্রশংসনীয়। বাঙালি জেনে খুশি হবেন যে, তার লেখায় তাদের আরেকটি প্রিয় খাবার দইকে বলা হয়েছে, ‘অমৃতের হ্রদ থেকে তুলে পাঁকের মতো…।’
আবার আগের প্রসঙ্গে ফিরে যাই, ভাত খাওয়া হতো কী দিয়ে? খাওয়া হতো শাক এবং অন্যান্য ব্যঞ্জন দিয়ে। দরিদ্র ও পল্লী অঞ্চলের মানুষের প্রধান খাদ্যই ছিল শাক-ভাত। নালিতা বা পাটশাকের উল্লেখ আছে ‘প্রাকৃত পৈঙ্গল’-এ। মইলি বা মৌরলা মাছ বাঙালির প্রিয় খাদ্য।
তবে শাক ছাড়াও অন্য ব্যঞ্জনের কমতি ছিল না মোটেই, বিশেষ করে বিয়েবাড়ির খাদ্যে। এত রকম তরকারি দেয়া হতো যে, সবগুলো চেখে দেখা সম্ভব হতো না। এটা নাকি সে যুগের কন্যাপক্ষের চালাকি ছিল। তরকারি খেয়ে পেট ভরিয়ে ফেললে মাছ-মাংস কম খাওয়া হবে। কী ধরনের তরকারি ব্যবহার করা হতো তার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যাবে বিজয় গুপ্তের ‘মনসামঙ্গল’ অথবা অন্যান্য মঙ্গলকাব্যে।
বাঙালির আনুষ্ঠানিক ভোজে নাকি খাদ্য অপচয়ের চূড়ান্ত হতো—এমন কথা লিখে গিয়েছেন চীনা পরিব্রাজক ইিসং। তার দেখা ব্যঞ্জনের তালিকায় রয়েছে দই আর রাই সরষে দিয়ে রান্না করা পদ। যা খেয়ে অতিথিদের মাথা ঝাঁকাতে ও মাথা চাপড়াতে হতো তীব্র ঝালের আক্রমণে।
প্রাচীন বাঙালির প্রিয় খাদ্য ছিল হরিণের মাংস। সম্ভবত এজন্যই চর্যাপদে লেখা হয়েছে—আপনা মাংসে হরিণা বৈরী। হরিণের মাংস সুস্বাদু বলে সবাই বনে এসে আগে হরিণ মারত।
বাঙালির বিয়ের ভোজে হরিণের মাংস অনিবার্যভাবে অতিথিদের পাতে পরিবেশিত হতো। সঙ্গে থাকত ছাগ ও পাখির মাংস। বাঙালিদের মধ্যে আর্যদের মতো গোমাংস খাওয়ার চল ছিল না। তাই বিকল্প হিসেবে রাখা হতো মাংসের স্বাদযুক্ত সুস্বাদু ব্যঞ্জন, কচি কাঁঠালকে এখনও হিন্দু সমাজে বলা হয় ‘গাছ পাঁঠা’। শেষ পাতে মিষ্টি আর দই। পায়েস বা পরমান্ন খাওয়ার তাগিদ থাকত শুধু বড়লোকদের। আর আহারের পর মসলাযুক্ত পানের খিলি।
ভাত ও মাছ চীন, জাপান, বার্মা, পূর্ব-দক্ষিণ এশিয়ার দেশ-দীপপুঞ্জ ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশে চিরকালই প্রধান খাদ্য। মাংসের প্রতি বিরাগ বাঙালির কোনোদিনই ছিল না। কালকেতুর শিকার করা পশুমাংস ব্যাধ রমণী ফুল্লরা বাজারে বিক্রি করে সংসার চালাত। কালে কালে উত্তর ভারতে জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবে মাংস আহার নিষিদ্ধ হয়।
আর্য-ব্রাহ্মণ ভারত ক্রমেই নিরামিষ আহারে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে এই প্রবণতা আংশিক কার্যকর হয়েছিল। বহুদিন আমিষ খাওয়ার অভ্যাস থাকায় বাঙালির নিরামিষ খাবারে মুখ দিতে বেশ সময় লেগেছিল।
দুই.
এই গেল ডাল-ভাতের কথা। এবার মত্স ভোজের দিকে মন দেওয়া যাক। কথায় বলে, মাছের নামে গাছও হা করে। বাঙালি সাধারণত স্বল্প কথায় খাওয়ার উল্লেখ করে তখন বলে ‘ডাল-ভাত’ নাহয় ‘দুধ-ভাত’ কিংবা ‘মাছ-ভাত’। মাছ-ভাত সম্পর্কে মঙ্গলকাব্যগুলোতে রয়েছে মাছ ও মাছ রান্নার প্রসঙ্গের ছড়াছড়ি। আর মাছের ব্যাপারে বরাবরই পূর্ববাংলা বিখ্যাত। কারণ এখানে ছিল মাছের রাজত্ব। কে না জানেন নদী-নালা, বিল-ঝিল, হাওড়-বাওড়ের সোনালি সুতায় বোনা পূর্ববঙ্গ যেন এক মছলী কাঁথার মাঠ। বিজয় গুপ্ত কিংবা দ্বিজ বংশীদাসের (দুজনই পূর্ব বাংলার মানুষ) বর্ণনা থেকে সামান্য উদ্ধৃতি দিলে স্পষ্ট হবে পূর্ব বাংলার মাছ ও মাছের রন্ধনবৈচিত্র্যের ব্যাপ্তি—
‘মনসামঙ্গল’-এ বরিশালের বিজয়গুপ্ত লিখেছে,
‘রান্ধি নিরামিষ ব্যঞ্জন হলো হরষিত।
মেস্যর ব্যঞ্জন রান্ধে হয়ে সচকিত
মত্স্য মাংস কুটিয়া থুইল ভাগ ভাগ।
রোহিত মত্স্য দিয়া রান্ধে কলকাতার আগ
মাগুর মত্স্য দিয়া রান্ধে গিমা গাচ গাচ
ঝাঁঝ কটু তৈলে রান্ধে খরসুল মাছ
ভিতরে মরিচ-গুঁড়া বাহিরে জড়ায় সূত।
তৈলে পাক করি রান্ধে চিঙড়ির মাথা
ভাজিল রোহিত আর চিতলের কোল।
কৈ মত্স্য দিয়া রান্ধে মরিচের ঝোল
ডুম ডুম করিয়া ছেঁচিয়া দিল টই।
ছাইল খসাইয়া রান্ধে বাইন মেস্যর কৈ…
বারমাসি বেগুনেতে শৌল-মেস্যর মাথা।…’ ইত্যাদি।
ময়মনসিংহের দ্বিজ বংশীদাস তার ‘মনসামঙ্গল’-এ লিখেছেন,
‘নিরামিষ রান্ধে সব ঘৃতে সম্ভারিয়া।
মেস্যর ব্যঞ্জন রান্ধে তৈল পাক দিয়া
বড় বড় কই মত্স্য, ঘন ঘন আঞ্জি
জিরা লঙ্গ মাখিয়া তুলিল তৈলে ভাজি।
কাতলের কোল ভাজে, মাগুরের চাকি।
চিতলের কোল ভাজে রসবাস মাখি
ইলিশ তলিত করে, বাচা ও ভাঙ্গনা।
শউলের খণ্ড ভাজে আর শউল পোনা
বড় বড় ইচা মত্স্য করিল তলিত।
রিঠা পুঠা ভাজিলেক তৈলের সহিত
বেত আগ পলিয়া চুঁচরা মত্স্য দিয়া।
শক্ত ব্যঞ্জন রান্ধে আদা বাটিয়া
পাবদা মত্স্য দিয়া রান্ধে নালিতার ঝোল।
পুরান কুমড়া দিয়া রোহিতের কোল…’ ইত্যাদি
এবার পশ্চিমবঙ্গের প্রসঙ্গে আসি। সেখানকার মানুষও সমান মত্স্যপ্রেমী, যদিও প্রাপ্তিযোগে হেরফের অবশ্যই রয়েছে। ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’-এ (রচনাকাল :১৭৫২-৫৩) চোখে পড়ে ভবানন্দ মজুমদারের স্ত্রী পদ্মমুখী ব্রাহ্মণ ভোজনের জন্য রাঁধতে বসেছেন—
‘নিরামিষ তেইশ রাঁধিলা অনায়াসে
আরম্ভিলা বিবিধ রন্ধন মত্স্য মাসে।
কাতলা ভেটুক কই কাল ভাজা কে
শিক-পোড়া ঝুরি কাঁঠালের বীজে ঝোল।
ঝাল ঝোল ভাজা রান্ধে চিতল ফলুই
কই মাগুরের ঝোল ভিন্ন ভাজে কই।
ময়া সোনা খড়কীর ঝোল ভাজা সার
চিঙ্গড়ির ঝোল ভাজা অমৃতের তার।
কণ্ঠা দিয়া রান্ধে কই কাতলার মুড়া
তিত দিয়া পচা মাছ রান্ধিলেক গুড়া।
আম দিয়া ষোল মাসে ঝোল চড়চড়ি
আড়ি রান্ধে আদারসে দিয়া ফুলবড়ি।
রুই কাতলার তৈলে রান্ধে তৈল শাক
মাছের ডিমের বড়া মৃতে দেয় ডাক।
বাচার করিল ঝোল খয়রার ভাজা
অমৃত অধিক বলে অমৃতের রাজা
সুমাছ বাছের বাছ আর মাস যত
ঝাল ঝোল চড়চড়ি ভাজা কৈল কত।
বড়া কিছু সিদ্ধ কিছু কাছিমের ডিম
গঙ্গাফল তার নাম অমৃত অসীম।’ ইত্যাদি
‘চৈতন্য চর্বিতামৃত’-এর লেখক কৃষ্ণদাস কবিরাজের বিবরণ অনুসারে শ্রীক্ষেত্রে সার্বভৌম ভট্টাচার্য্যের বাড়িতে চৈতন্যদেব কেমন নিরামিষ রান্না অন্নের আহার করিয়েছিলেন সংক্ষেপে তা শোনা যাক—
‘বর্তিসা কলার এক আঙ্গেটিয়া পাত,
ঊণ্ডারিত তিন মান তণ্ডুলের ভাত।
পীত সুগন্ধি ঘৃতে অন্ন সিক্ত কৈল,
চারিদিকে পাতে ঘৃত বাহিয়া চলিল।
কেয়া পাতের খোলা ডোঙ্গা সারি সারি,
চারিদিকে ধরিয়াছে নানা ব্যঞ্জন ভরি।
দশবিধ শাক নিম্ব তিক্ত শুক্তার ঝোল,
মরিচের ঝালে ছেড়াবড়ি বড়া ঘোল।
দুগ্ধতুম্বী, দুগ্ধ কুষ্মাণ্ড, বেশারী নাফরা,
মোচা ঘণ্ট, মোচা ভাজা, বিবিধ শাকেরা।
ফুল বড়ি ফল মূলে বিবিধ প্রকার,
বৃদ্ধ কুষ্মাণ্ড বড়ির ব্যঞ্জন অপার।
নব নিম্ব পত্র সহ ভ্রষ্ট বার্তকি,
ফুল বড়ি, পটোল ভাজা কুষ্মাণ্ড মানচাকী।’ ইত্যাদি
তিন.
একসময় বাঙালির কাছে খিচুড়ি ও ইলিশ ছিল অভিন্ন। এখন সাধারণ বাঙালির সে যুগ আর নেই। বাঙালির ট্যাকের করুণ দশা এতদিনে জানা হয়ে গেছে পদ্মার ইলিশকুলের, তাই তারা উড়ে চলেছে নতুন অজানা সব ঠিকানায়। কিন্তু অভাগা বাঙালিকে একেবারে ছেড়ে যায়নি। পুষ্টিকর বলকর খিচুড়ির সহচর জোগাতে রন্ধন পটিয়সী বাঙালি বধূরা যেসব পদ আবিষ্কার করেছেন, তার সংখ্যা অনেক। ইলিশ সবসময় না জুটলেও কুছ পরোয়া নেহি। সাধ্যের মধ্যে রয়েছে বেগুনভাজা, বেসন দিয়ে কুমড়া বা বেগুন অথবা বাঙালি মধ্যবিত্তের চির সখা ডিমের ওমলেট—যাকে আমরা ছেলেবেলায় বলতে শুনেছি মামলেট। অবাঙালিরা নাকি খিচুড়ির সঙ্গে পাপড়, আচার বা দই খায়। বঙালিরা নিরুপায় হয়ে পাপড়ে হাত দিলেও খিচুড়ি সঙ্গে দই-আচার কদাপি নয়—নৈবনৈবচ।
ভোজন রসিক বাঙালি জেনে খুশি হবে সম্রাট জাহাঙ্গীরের বিত্তবৈভবের কোনো কমতি না থাকলেও তার প্রিয় খাবার ছিল মাংস বা মাছ নয়, গুজরাটি খিচুড়ি। আকবর বাদশাহরও পোলাও ছেড়ে খিচুড়ির স্বাদ গ্রহণে অরুচি ছিল না। তবে সারা উপমহাদেশ জানে, বাঙালির অন্যতম প্রিয় খাদ্য হলো খিচুড়ি। পৃথিবীর যেখানেই বাঙালি বসতি রয়েছে, সেখানে খিচুড়ি অবশ্যই মিলবে। এক মুঠো চাল, এক মুঠো ডাল মিশিয়ে নিয়ে হাঁড়ি চড়ালেই হয়ে গেল খিচুড়ি। তীর্থ যাত্রীদের জন্য সবচেয়ে কম ঝামেলার খাবার। প্রজ্ঞা সুন্দরী দেবীর বিখ্যাত রান্নার বইয়ের সেই বিখ্যাত পঙক্তির দিকে আর একবার তাকানো যাক, ‘সৈন্যের গুণে যেমন সেনাপতির খ্যাতি বর্ধিত হয়, সেই রূপ আনুষাঙ্গিক খাদ্যের গুণে প্রধান খাদ্য সমাধিক রুচিকর হইয়া ওঠে। খিচুড়ির এই আনুষাঙ্গিক খাদ্যের মধ্যে তখনও প্রধান হলো ইলিশ। আরও নির্দিষ্ট করে বললে ইলিশ ভাজা। গলা খিচুড়ি আর ভুনা খিচুড়ি উভয়ই বাঙালির অন্যতম প্রিয়।’ আর বর্ষাকাল এলেই বাঙালি মাত্রই একটি নির্ভেজাল খিচুড়ি-প্রেমিক হয়ে ওঠেন—সেই খিচুড়ি আমিষ বা নিরামিষ যাই হোক না কেন। ‘মনসামঙ্গল’-এ আছে ডাবের জলে দিয়ে রান্না করা মুগের ডালের খিচুড়ি খেতে চেয়েছিলেন পার্বতীর কাছে স্বয়ং শিব। কৈলাসে তো নারকেল গাছ নেই যে ডাব পাওয়া যাবে। ‘মনসামঙ্গল’-এর লেখক বিজয় গুপ্ত জন্মেছেন বরিশালে, যেখানে সারা বছরই অঢেল নারকেল ও ডাব সুলভ ও সহজলভ্য। ফলে বিজয় গুপ্তের পক্ষে ডাবের জল দিয়ে খিচুড়ি রান্নার রেসিপি উল্লেখ খুব অন্যায্য নয়।
সংস্কৃতে খিচুড়ির আর এক নাম কৃশর; অর্থাত্ তিল, মুগ ডাল ও চালে ঘৃতপক্ক অন্ন।
ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’-এ দেখি মোগলাই খানা বাঙালির বিশেষ করে হিন্দু বাঙালির ঘরেও ঢুকে পড়েছে—‘কচি ছাগ মৃগ মাংসে ঝোল ঝাল রসা/কালিয়া দোল্মা বাঘা সেকিচ সমসা/ অন্য মাংস শিক ভাজা কাবাব কবিয়া/ রান্ধিলেন মুড়া আগে মসলা পুরিলা’। (কালী প্রসন্ন ৫৯)
বাংলার আকাশে বাতাসে দিল্লি, আগ্রা, লখনৌর পাকশালার সৌরভ। এ হাওয়ার স্থানীয় উত্স মুর্শিদাবাদ, ঢাকা, কৃষ্ণনগর ও বর্ধমানের রাজবাড়ি এবং কলির শহর কলকাতায় গড়ে ওঠা দেদার হোটেল, কফি হাউস আর রেস্তোরাঁ। সেখানে যেমন ইউরোপীয় খাদ্য মেলে, তেমনি মেলে দেশীয় অর্থাত্ মোগলাই নানা ডিস।
একটু পরে বঙ্কিমচন্দ্র থেকে জানা গেল ফাউল কারিও ঢুকে পড়েছে হিন্দুর হোটেলে। নদের ফটিক চাঁদ, এখন আর মালপো ভোগে তেমন আস্থা নেই তার, ফাউল কারি ঠিকমতো তরিবত্ হলো কি না এ নিয়ে তার বেজায় দুশ্চিন্তা। কিন্তু বঙ্কিমের খাদ্য রুচির একটু পরিবর্তন পাওয়া যাবে ‘আনন্দমঠ’-এ। ‘আহার্য্য বস্তু তার উপকরণের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে পরিবেশনকারীর স্নেহরস। জীবানন্দ ক্ষুধার্ত—নিমি তাকে খেতে দিচ্ছে—নিমি পিঁড়ি পাতিয়া মল্লিকা ফুলের মতো পরিষ্কার অন্ন, কাঁচা কলাইয়ের ডাল, জঙ্গুলে ডুমুরের ডালনা, পুকুরের রুই মাছের ঝোল এবং দুগ্ধ আনিয়া জীবানন্দকে খাইতে দিল।’ যবে দেখা দেয় সেবা মার্ধুযে ছোঁয়া, তখন সে হয় কি অনির্বচনীয়! পরিবেশনকারিণী ও পরিবেশিত ভোজ্যের অপরূপ সংযোগের বিবরণ রয়েছে বাংলা সাহিত্যে। শরত্চন্দ্র এ ব্যাপারে নমস্য লেখক। আনন্দ আর শ্রীকান্তকে রাজলক্ষ্মীর খাওয়ানোর বিবরণ একবার নয়, বারবার পাঠ্য। এর পরেই নাম করতে হয় তারাশঙ্কর, বনফুল ও বিভূতিভূষণের।
রবীন্দ্রনাথকে বাদ দেয়ার কোনো উপায় তিনি আমাদের জন্য ছেড়ে যাননি, ‘নৌকাডুবি’ উপন্যাসের কমলা-রমেশের স্টিমার যাত্রার বিচিত্র সরসতা পাঠকের জন্য ভুলবার নয়। কমলার রন্ধন নৈপুণ্য এবং রমেশের সংগ্রহ ক্ষমতা মিলে সে এক রসঘন পরিস্থিতি। সজনে ডাটা, লাউডগা, বেগুন কুমড়োফুল, রুইমাছ—সব মিলিয়ে সে এক কাণ্ড! ‘নৌকাডুবি’ উপন্যাসের সম্পর্ক-জটিলতার স্টিমার যাত্রার এই বর্ণনা ক্ষুধা-উদ্রেককারী এক ঝলক নদীর হাওয়া যেন।
তবে দ্রুত রুচি পালটে যাচ্ছে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। উচ্চবর্গের পরিবারগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে পোশাক-আশাক, সাহিত্য, চিন্তাচর্চায় এমনকি খাদ্যরুচিতে পর্যন্ত রয়েছে মোগল প্রভাব। ১৮৩৪ সাল পর্যন্ত ফারসি ছিল আদালতের ভাষা। সেটা ইউলিয়াম বেন্টিংকের আমল। সুতরাং ফারসি ছিল বিদ্যালয়ের ভাষা। এমনকি বাঙালি মেয়ের ব্রত কথায় দেখা গেছে। প্রচণ্ড আগ্রহে তার প্রার্থনা, ‘আরশি/আরশি। আমার স্বামী যেন পড়ে ফারসি।’ ভারতচন্দ্র তো কালিয়া কোফতা, শিক কাবাবের কথা আগেই বলেছেন তার ‘অন্নদামঙ্গল’-এ। কালীপ্রসন্ন বন্দোপাধ্যায় ‘মধ্যযুগের বাঙলা’য় তার এক বন্ধুকে উদ্ধৃত করছেন। পরিস্থিতি দেখে তিন মন্তব্য করতে বাধ্য হয়েছেন—‘কোর্মা, কোপ্তা, কারি, কাটলেট প্রভৃতি কাবাবাদি ব্যঞ্জনের প্রকোপে বুঝিবা ঝাল ঝোল দালনা চড়চড়ি আর বাঙালি বাবুর মুখে রুচিবে না।’ কথাটা অতিশয়োক্তির মতো শোনালেও উনিশ শতকের শহরগুলোর উচ্চবিত্তের পরিবারে অন্তত পরিস্থিতি অনেকটা এরকমই ছিল। এছাড়া নারায়ণগঞ্জ, গোয়ালন্দ, বরিশাল, খুলনায় স্টিমার সার্ভিস চালু হলে সেই স্টিমারে প্রথম শ্রেণির ডাইনিং রুমে ইংরেজি খাবার; বিশেষ করে পুডিং বা ক্যারামেল কাস্টার্ড আস্বাদন করার সুযোগ অনেক বাঙালি পরিবারের একাধিক বার হয়েছিল। এই যোগাযোগব্যবস্থার ফলে অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চলেও কিছু মোগলাই ও ইংরেজি ডিসের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল বললে ভুল বলা হবে না। রাজধানীর সম্ভ্রান্ত বাঙালিরা হিন্দু-মুসলিম উভয়েই বাড়িতে সাহেব-মেমদের আপ্যায়ন করতে শুরু করেন। সাহেবি খানা আনা হয় বড় বড় হোটেল থেকে। ইয়াং বেঙ্গলরাও পিছিয়ে রইলেন না, তারাও সোত্সাহে হানা দিতে লাগলেন সাহেবি হোটেলে। বাংলায় দেখা দিল ভিনদেশি খানার জন্য কাড়াকাড়ি। ভিনদেশি বলতে একদিকে ইংরেজি খানা, অন্যদিকে মোগলাই তথা উত্তর ভারতীয়। শেষ পর্যন্ত মনে হয় ইংরেজি বনাম মোগলাইয়ের লড়াইয়ে বিজয়ী হয়েছিল মোগলাই খানা। লখনৌর বাদশাহ কলকাতার মেটিয়া বুরুজে নির্বাসিত হলে তিনি প্রায় পুরো লখনৌ শহরটি সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। ফলে সংগীত, নৃত্যের প্রসার হলো দ্রুত, সঙ্গে লখনৌর বিখ্যাত বিরিয়ানি, পান, পোশাক ও নানা বিলাসিতা কলকাতাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। বাঙালি খাদ্য রুচিতেও এর প্রভাব পড়ল বিশেষ করে কলকাতা, ঢাকার মুসলিম পরিবারে। এখনও সেই গৌরব অস্তমিত হয়নি। ঢাকার কাচ্চি বিরিয়ানি হলো সেই প্রভাবের ফল, যা আজ মরক্কো-জর্দানের রাজপরিবারের ভোজে সমাদৃত। বাঙাল কার্টুন পত্রিকা ‘বসন্তক’-এর আমুদে মন্তব্য, ‘হোটেল হইতে খানা আনিয়া ভবনে/ খাওয়াই প্রাণের বন্ধুগণে সযতনে/কী জানে রাঁধিতে যত দেশি রাঁধুনিতে/জানে থোড় কচু ঘেচু কেবল রাঁধিতে।’
চার.
মুসলিমদের প্রভাবের ফলে মধ্যযুগের বাঙালি সমাজের কিছু অংশে নতুন ধরনের খাবারের প্রচলন হয়েছিল। বহিরাগত সুলতান, নবাব, আমির-ওমরাহরা উত্তর ভারত, ইরান এবং পশ্চিম মধ্য এশিয়া থেকে ভিন্ন ধরনের খাদ্যের ঐতিহ্য ও উপকরণ নিয়ে এসেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ বলা—লুচি-পরোটা শব্দদুটির প্রথমটি প্রাচীন ভারতীয় খাবার—কড়াইয়ে ভাজতে হয়—পরোটা মুসলিম প্রভাবের ফসল, ভাজা হয় তাওয়ায়। তাওয়া ও তন্দুর—দুটি উপকরণই মুসলিমদের বাংলাদেশে আগমনের ফসল। এসব মুসলিম প্রভাবিত খাবারের কোনো কোনোটাই দেশীয় গরিব মুসলিমদের মধ্যে প্রথমে ছড়িয়ে পড়ে বলে গবেষক গোলাম মুরশিদ অনুমান করেন। এছাড়া যে ধনী হিন্দুরা ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন অথবা কাজকর্মসূত্রে মুসলিম শাসকদের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসেছিলেন, তারাও ধীরে ধীরে বহিরাগত শাসকদের খাবারের কিছু কিছু অংশ গ্রহণ করেছিলেন। তবে এর জন্য যে কয়েক শতাব্দী লেগেছিল—এমনটি মনে করা স্বাভাবিক, কারণ ভারতচন্দ্রের আগে মোগলাই খাবারের উল্লেখ কোনো অমুসলিম কবির লেখায় পাওয়া যায় না। অর্থাত্ ভারতচন্দ্রের সময়ের আগে পর্যন্ত মুসলিম খাবার হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বাঙালি সমাজে প্রবেশ করেনি বলেই অনুমেয়।
মুসলিমরা আরও একটি বস্তু সঙ্গে এনেছিলেন—যা থেকে তারা পনির তৈরি করতেন। দই, ঘি, ছানা, মিষ্টি হিন্দু ময়রারা তৈরি করলেও বাংলাদেশে তখন পনির শুধুমাত্র মুসলিম কারিগররাই তৈরি করতেন। তখনও এটি মুসলিমদের একচেটিয়া।
মুসলিম শাসকরা তরমুজ-খরমুজ প্রভৃতি ফলও নিয়ে এসেছিলেন। কিছু নতুন খাবারের প্রচলন পর্তুগিজদের সঙ্গেও হয়েছিল। তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো গোল আলু। মধ্যযুগের বাঙালির ভাতের থালা নিরালু—অর্থাত্ আলুহীন। পর্তুগিজরা ইউরোপ থেকে আলু এদেশে নিয়ে আসে। কলকাতা-ঢাকা-মুর্শিদাবাদের কথা যেমনই হোক, বাংলার গ্রামাঞ্চলে আলু পৌঁছেছিল অনেক পরে। বিভূতিভূষণ ‘ইছামতী’ উপন্যাসে আলু পান কলকাতায়, ওখান থেকে তার গ্রামে আলু নিয়ে এলে হুলুস্থূল পড়ে গিয়েছিল।
আলুর চেয়েও আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ বা অভূতপূর্ব উপকরণ পর্তুগিজরা আমদানি করেন, তা হলো মরিচ আর তামাক। যা বাংলাদেশের লোক লুফে নিয়েছিল। এবং দ্রুত তা সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি—তিনটি সম্ভবত পর্তুগিজরা এদেশে এনেছিল। কারণ পর্তুগিজ ভাষায় এদের বলা হয় কোবি—যা থেকে বাংলা কপি, ফুলকপি ইত্যাদি। কথায় বলে একজন কী খায়, তা থেকে বলে দেয়া যায় সে কী রকম মানুষ। বুদ্ধদেব বসু তাঁর বাংলা খাবার নিয়ে লিখতে গিয়ে বলেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসে মধুসূদন ধনাঢ্য ব্যক্তি রুপার থালায় খেলেও তার দৈনন্দিন খাদ্য হলো কলাইয়ের ডাল, কাটা চচ্চড়ি, তেঁতুলের অম্বল এবং মস্তবড় বাটি ভরতি চিনি মেশানো দুধ। এইভাবে রবীন্দ্রনাথ বুঝিয়ে দিলেন বেচারা কুমুদিনী তার বায়বীয় ধরন-ধারণ নিয়ে কী রকম শক্ত লোকের পাল্লায় পড়েছে।’
গোপাল হালদার মনে করেন, জমিদার-তালুকদারদের পঙিক্ত ভোজন ছাড়িয়ে ইংরেজ আমলে শিক্ষিত বাঙালি শ্রেণি একটি রস ও রুচির মাপকাঠি তৈরি করেছিল, কিন্তু তা রয়ে গেছে পারিবারিক গণ্ডির মধ্যে। কারণ মধ্যবিত্ত সমাজের সীমাবদ্ধ আদান-প্রদানের মধ্যেই গড়ে উঠেছিল সেই বাঙালি ভোজনরীতি। তিনি মনে করতেন, বাঙালি খাওয়ার ব্যাপারে ‘না-গ্রহণ না-বর্জন’ নীতিতে সহনশীল। বাঙালি বাড়ির নিমন্ত্রণে প্রথমে আদি-অকৃত্রিম শাক, তারপর আসবে মোগলাই পোলাও, কোর্মা, কাবাব এবং শেষে আসবে ইংরেজি-বাঙালি পর্বে চপ-কাটলেট থেকে আইসক্রিম পর্যন্ত। লিখেছেন—
নিমন্ত্রণ তো নয়, এ বাঙালির ইতিহাস… বাঙালির নিমন্ত্রণে আজ নিমন্ত্রিত হয় বাঙালি অতিথির তিন জন্মের তিন সত্তা। সেই আদি জন্মের গেঁয়ো বাঙালি সত্তা, তার মধ্যজন্মের আধা-মুসলমানি সত্তা, আর তার ইংরেজি আমলের আধা-ঔপনিবেশিক সত্তা। কিন্তু সত্তা যত বিচিত্র হোক, হায়, উদর মাত্র একটি।
মিষ্টান্ন প্রিয় বাঙালির জীবনের মিষ্টির প্রভাব সুবিদিত। সুসংবাদে মিষ্টি, আতিথ্যে মিষ্টি, ভদ্রতায় মিষ্টি, বিয়েশাদি-কুলখানিতে মিষ্টি। সংবাদ আনতে মিষ্টি নিয়ে যাবার বহুল প্রথা সংবাদকেই সন্দেশে রূপান্তরিত করেছে। একসময় বাড়ির মেয়েরাই বেশির ভাগ মিষ্টি তৈরি করতেন। পিঠে তৈরিতে বাংলার মেয়েরা দৈহিক পরিশ্রম আর মনের আনন্দ মিশিয়ে ফেলেন। একসময় ঢাকায় পিঠেওয়ালি মহিলারা… বাড়ি বাড়ি গিয়ে পিঠে বিক্রি করতেন। পিঠে বিক্রির সঙ্গে নানা ধরনের মজার মজার গল্পও শুনিয়ে আসতেন বিনি পয়সায়। দেবী ঘোষ তার বইয়ে লিখেছেন যে, ‘পূর্ব বাংলার পিঠে তৈরির বৈচিত্র্য পশ্চিম বাংলার তুলনায় বেশি। পূর্ব বাংলার বিশেষ বৈশিষ্ট্য আসকে পিঠে (চিতই পিঠা)।’
বাঙালি ঘরে নানা অসুবিধার মধ্যে মেয়েদের রান্না করতে হয়। দরিদ্র সংসারে মেয়েরা প্রিয়জনের মুখে অন্ন তুলে দিতে গভীর সঙ্কটে পড়েন। জ্বালানির সঙ্কট, চাল সহজে সিদ্ধ হয় না, অথচ খাওয়ার সময় পেরিয়ে যায়, বাড়ির পুরুষরা অসন্তুষ্ট হয়। চট্টগ্রামের একটি চটকা গানে শাশুড়ি ও বধূর এমন সঙ্কটের ছবি ফুটে উঠেছে।
‘মাইজান বউয়ে তাহার উপর চড়াইয়া দিছে ডাইল।
বাড়ির মানুষ শুইনা কত দিবার লাইগছে গাইল
বেলা হৈল দুপুর গেল ডাইল গলে না হায়।
নতুন ইষ্টির ছামনে এহন ক্যামন দেয়ন যায়
ত্যক্ত হৈয়া মাইজান বউয়ে ডাইলে মারে ঘাও।
চরকা যেমন ঘ্যাগর ঘ্যাগর কইরবার লৈল রাও
ভাসুরে করে কিচির মিচির দেওরে করে রাগ।
ফোঁটা তিলক কাইটা হউড় সাইজা বইছে বাঘ’
সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর ভোজন বিষয়ে নিজস্ব ধারণা ও বাঙালির ভোজন বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করেছেন তার ‘জলে ডাঙ্গায়’ বইয়ে, তিনি বলেছেন, ‘আমরা তেতো, নোনা, ঝাল, টক, মিষ্টি—এই পাঁচ রস দিয়ে ভোজন সমাপন করি। ইংরেজ খায় মিষ্টি আর নোনা, ঝাল সামান্য, টক তার চেয়েও কম এবং তেতো জিনিস যে খাওয়া যায়, ইংরেজের সেটা জানা নেই। তাই ইংরেজি রান্না আমাদের কাছে ভোঁতা ও বিস্বাদ বলে মনে হয়। অবশ্য ইংরেজ ভালো কেক-পেস্ট্রি-পুডিং বানাতে জানে—তাও সে শিখেছে ইতালিয়ানদের কাছ থেকে এবং একথাও বলব, আমাদের সন্দেশ-রসগোল্লার তুলনায় এসব জিনিস এমন কী, যে নাম শুনে মূর্ছা যাব।’
পশ্চিমবঙ্গের রান্না ও বাংলাদেশের রান্নার পার্থক্য নিয়ে মুজতবা আলীর সরস মন্তব্যটি শোনা যাক। বাংলাদেশের রান্নায় ঝালের প্রাচুর্য, পশ্চিমবঙ্গের রান্নায় চিনির। এই বিষয়টাকে আরও সরস করতে তিনি একজনের মন্তব্য তুলে ধরেছেন—সে ব্যক্তি বলেছেন—মাই মোটর কার ইজ সাউন্ড ইন এভরি পার্ট, একসেপ্ট অন দি হর্ন—ঠিক সে রকম পশ্চিমবঙ্গের রান্নাতে ‘সুগার ইন এভরিথিং একসেপ্ট ইন রসগোল্লা’।
মাছ-ভাত-শাকসবজির মতো দৈনন্দিন খাবারের বেলায় হিন্দু এবং দেশীয় মুসলমানদের রান্নায় বিশেষ পার্থক্য ছিল বলে মনে হয় না। তবে হিন্দু বাড়ির রান্নায় হিঙ্গের ব্যবহার দেশীয় মুসলিম পরিবারে তেমন দেখা যায় না। হিন্দু বাড়ির রন্ধনপ্রণালিতে ফোঁড়ন ব্যবহারের প্রবণতা বাঙালি মুসলিম পরিবারের চেয়ে বেশি। তবে মাংসের ব্যাপারে পার্থক্য প্রচুর। মুসলমানদের মধ্যে মাংস খাবার চলন বেশি—গরুর মাংস তো খেতেনই; মুরগি ও ছাগল বা খাসির মাংসের ব্যবহার ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়। মুকুন্দবাবুর লেখায় আমরা দেখেছি মুরগি ও ছাগল জবাহ করে মোল্লা পারিশ্রমিক নিচ্ছেন—এ থেকে মুসলিমদের খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে সাধারণ বাঙালি হিন্দুর কিছু পার্থক্য অনুমান করা সম্ভব। তবে ছাগল, হরিণ, কচ্ছপসহ নানা প্রাণীর মাংস খেতে পছন্দ করতেন তারা।
উপরের খাদ্য তালিকাটি প্রধানত অবস্থাপন্ন মানুষদের প্রসঙ্গে বলা হলো। পাশাপাশি বৃহত্তর সমাজে সেকালেও গরিবদের খাবার ছিল পান্তাভাত। তবে ইলিশ পান্তা তাদের সাধ্যের বাইরে ছিল। পাদ্রি সিবান্তিয়ান মানরিক ষোলো শতাব্দীতে বঙ্গদেশে ভ্রমণ করেছিলেন বেশ কয়েক বার। তিনি লিখে গেছেন যে গরিবরা নুন আর শাক দিয়ে ভাত খেতেন। প্রায় একই সময়ে মুকুন্দরাম দরিদ্র ব্যাধ কালকেতুর খাবারের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা থেকে সাধারণ মানুষের খাওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। কালকেতুর কপালে জুটত খুদের জাউ, সঙ্গে লাউ দিয়ে রান্না মুসুর ডাল, ওল কচু, করঞ্জা আর আমড়া। দই পেলে কালকেতুর তৃপ্তি পুরো হতো। তবে গরিবের পাতে দুই মিলত কদাচিত্। ঘোল-মাঠাও জনপ্রিয় ছিল। কোনো কোনো গবেষক মনে করেন, মাঠা মুসলিম অভিযাত্রীরা বঙ্গদেশে এনেছিলেন। খাওয়ার শেষে পান-সুপারি এবং মৌরি খাওয়ার ব্যাপক প্রচলন ছিল।
বাঙালির স্বাদ গ্রহণের বিশিষ্টতায় সরষে প্রীতি উন্নত স্থান গ্রহণ করেছিল সরষে বাটা দিয়ে মাছ, পাতুরি, চচ্চড়ির স্বাদের বৈচিত্র্য বাঙালি মাত্রই জানা। কাসুন্দির কথা সরষে প্রসঙ্গে না বললে চলে না। সৈয়দ মুজতবা আলী তার সরষে প্রীতির পরিচয় দিয়েছেন ‘বাঙালী মেনু’ নিবন্ধে (৫৪) তিনি লিখেছেন, ‘মাছের সঙ্গে সর্ষে, যেন রবীন্দ্রসংগীতে কথার সঙ্গে সুরের মিলন।’ নিতান্ত সন্দেশ-রসগোল্লা ছাড়া তিনি নাকি সব খাবারের সঙ্গে সরষে খাবার কথা বলেছেন। বিলিতি মাস্টার্ডের চেয়ে দেশি কাসুন্দি ছিল তার প্রিয়। কাসুন্দিতে থাকে মিঠে কড়া মোলায়েম ঝাঁঝ আর বিলিতি মাস্টার্ডে বদখত মিষ্টি মিষ্টি ভাব।
মুজতবা আলী বহু দেশ ঘুরেছিলেন, বহু ধরনের রান্না খেয়েছেন। আরব দেশ ভ্রমণের সময় মুরগি মোসাল্লম, শিক কাবাব, শামি কাবাবের স্বাদ পেয়েছেন। জাহাজে ঘুরে বেড়াবার সময় আইরিশ ফুড আর ইতালিয়ান ম্যাকারনি খেয়ে পেটে কড়া পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু প্রাণ কাঁদছিল—চারটি আতপ চাল, উচ্ছে ভাজা, সোনামুগের ডাল, পটল ভাজা আর মাছের ঝোলের জন্য।
কায়রোতে গেলেন, সেখানে দোকানের সাইনবোর্ডে লেখা Fool’s Restaurant মানে আহাম্মকের রেস্তোরাঁ। পরে বুঝলেন এ দোকানে উত্তম শিম বিচি বিক্রি করা হয়। ফুল অর্থ ‘বিন’ অর্থাত্ শিমের বিচি।
বাঙালি জীবনে খাওয়ার সাধ আর বঞ্চনা ছড়িয়ে আছে দৈনন্দিন জীবনের পরতে পরতে। সম্পন্নের ভাগ্যে সহজেই জোটে ভালো খাবার। দরিদ্র তো ক্ষুধা নিবৃত্তি করতেই জানে না, নিমন্ত্রণের অধিকার রাখে না। ‘পথের পাঁচালী’তে অপুর পূর্বপুরুষের সমৃদ্ধির দিন গত হয়েছে বহুদিন। অপু বাবার সঙ্গে সম্পন্ন গৃহে খাবারের যে আপ্যায়ন পেয়েছিল তাতে তাদের ঘরের দৈন্য সম্পর্কে একটা ধারণা জন্মে। অপুকে মোহনভোগ খেতে দিয়েছিল তারা। সেই মোহনভোগে ঘিয়ের পরিমাণ এত বেশি ছিল যে অপুর আঙুলে মাখামাখি হয়ে যায়। তার মনে পড়ে, মায়ের কাছে মোহন ভোগ খেতে চাইলে ‘শুধু সুজির জলে সিদ্ধ করিয়া একটু গুড় মিশাইয়া পুলটিসের মতো এক দ্রব্য তৈয়ার করিয়ে ছেলেকে আদর করিয়া খাইতে দেয়।’ আজকের মোহন ভোগ আর মায়ের তৈরি মোহনভোগের সঙ্গে অপু তফাত্ করতে পেরেও সে দরিদ্র মায়ের প্রতি করুণা ও সহানুভূতিতে পূর্ণ হয়ে গেল। ‘খাইতে বসিয়া বারবার তাহার মনে হইতেছিল অর্থাত্ তাহার দিদি এরকম খাইতে পায় নাই কখনো’। সুস্বাদু খাবার তাকে সুখের বদলে দুঃখ এনে দেয়।
এবার একটি হালকা করুণ গল্প দিয়ে বাঙালির খাদ্যবিলাস শেষ করি। গল্পটি পাওয়া গেছে অভিনব গুপ্তর ‘জেনো বাসনার সেরা বাসা রসনায়’ থেকে। পড়তি অবস্থার মুসলমান জমিদার। সেদিন তার খাবারের সংস্থান মাত্র দুটি ক্ষুদ্র মাছ, তাও বিড়ালে নিয়ে গেছে। নকুল এসে বন্ধু পরিবৃত জমিদার সাহেবকে খাবার দিল —‘বিল্লি খা আকে মছলী মহল লুট লিয়া।’ জমিদার সাহেব বললেন—‘তুম জলদি মসুর খাকে বোলাও।’ আলু যেখানে এমন পড়তি সংসারে দুর্লভ, সেখানে কচুর দম আর আমড়ার টকই বিকল্প খাদ্য। তার ছদ্মবেশী ভাষা—ভুঁই আন্ডা কি কাবাব, আউর আসমান গোলা (আমড়া) কি চাটনি।
বঞ্চনা ঢাকার জন্যও কত না প্রচেষ্টা অভাগা এদেশে!

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত