| 29 মার্চ 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

প্রবন্ধ: বঙ্কিমদৃষ্টিতে তিন চরিত্রের তুলনামূলক বিশ্লেষণ

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

ফারজানা আলম

 

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৩৮ সালের ২৬ জুন পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার কাঁঠালপাড়া গ্রামের নৌহাটিতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৮৯৪ সালের ৮ এপ্রিল কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। তার জন্ম গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারে। পিতা যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং মাতা দুর্গাসুন্দরী দেবী। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন তৃতীয়। পাঁচ বছর বয়সে বঙ্কিমচন্দ্রের হাতেখড়ি হয় পুরোহিত বিশ্বম্ভর ভট্টাচার্যের কাছে। তিনি ১৮৪৯ সালে হুগলী কলেজে ভর্তি হয়ে ছয় বছর পড়াশোনা করে কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করেন। পরবর্তীকালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৮৫৭ সালে এন্ট্রাস বা øাতক পরীক্ষা দিয়ে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন এবং ১৮৬৯ সালে একই কলেজ থেকে আইন বিষয়ে ডিগ্রি লাভ করেন। বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা একমাত্র ইংরেজি উপন্যাস ‘Rajmohans Wife ’ (১৯৩৫) আর তার লেখা দুটি ইংরেজি প্রবন্ধ হচ্ছে ‘Bengali Literature’ এবং ‘Vedic Literature’। এছাড়াও অন্যান্য রচনাবলির মধ্যে রয়েছে ললিতা, পুরাকালিক গল্প (১৮৫৬), লোকরহস্য (১৮৭৪), বিজ্ঞান রহস্য (১৮৭৫), কমলাকান্তের দপ্তর (১৮৭৫), বিবিধ সমালোচনা (১৮৭৬), রায় দীনবন্ধু মিত্র বাহাদুরের জীবনী (১৮৭৭), কবিতা পুস্তক (১৮৭৮), প্রবন্ধ-পুস্তক (১৮৭৯), সাম্য (১৮৭৯), মুচিরাম গুড়ের জীবনচরিত (১৮৮৪), কৃষ্ণচরিত্র-প্রথম ভাগ (১৮৮৬), বিবিধ প্রবন্ধ-প্রথম ভাগ (১৮৮৭), ধর্মতত্ত্ব-প্রথম ভাগ (১৮৮৮), বিবিধ প্রবন্ধ-দ্বিতীয় ভাগ (১৮৯২), সহজ রচনা শিক্ষা, সহজ ইংরেজি শিক্ষা, শীমদ্ভাগবদগীতা (১৯০২)। বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা ‘বন্দে মাতরম’ গানটি হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ‘বন্দে মাতরম’ গানটি তিনি ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে প্রথম প্রয়োগ করেছিলেন। তার সম্পাদিত মাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘বঙ্গদর্শন’ প্রকাশিত হয় ১৮৭২ সালে।

বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন একাধারে লেখক, কবি ও সাংবাদিক। তার উপন্যাসসহ অন্য রচনাবলি ভারতের বিভিন্ন ভাষা ও ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র যে একজন বড় মাপের সাহিত্যিক তা তার সৃষ্টি ও জীবনদর্শনে জাজ্বল্যমান। ‘শকুন্তলা, মিরন্দা এবং দেসদিমোনা’ প্রবন্ধটি বঙ্কিমের মননশীলতার প্রতীক। বাংলা সাহিত্যের চতুর্থ শতাব্দীর কবি কালিদাস মহাভারতের চরিত্র শকুন্তলাকে এক অনন্য সাহিত্য রূপ দিয়েছেন তার শকুন্তলা কাহিনী কাব্যে। মেনাকা ও বিশ্বামিত্রের কন্যা শকুন্তলা। ঋষি কানভা শকুন্তলাকে শিশু অবস্থায় জঙ্গলে কুড়িয়ে পেয়েছেন। আর তখন থেকেই শকুন্তলা ঋষিকন্যা হিসেবে আশ্রমে বড় হতে লাগল। বঙ্কিমচন্দ্র তার ‘শকুন্তলা, মিরন্দা এবং দেসদিমোনা’ প্রবন্ধে শকুন্তলা ও মিরন্দাকে পরিচয় করিয়েছেন যেভাবে- ‘উভয়েই ঋষিকন্যা : প্রস্পেরো ও বিশ্বামিত্র উভয়েই রাজর্ষি। উভয়েই ঋষিকন্যা বলিয়া, অমানুষিক সাহায্যপ্রাপ্ত। মিরন্দা এরিয়াল-রক্ষিতা, শকুন্তলা অপ্সরো রক্ষিতা। উভয়েই ঋষি-পালিতা। দুটিই বনলতা- দুটিরই সৌন্দর্যে উদ্যানলতা পরাভূতা।’ শেক্সপিয়রের ‘দ্য টেমপেস্ট’ নাটকে প্রস্পেরোকে যখন রাজ্য থেকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে তখন পিতার নির্বাসিত জীবনের সঙ্গী মিরন্দার বয়স মাত্র তিন বছর। আর যখন সে জীবনের বয়ঃসন্ধিকাল অতিক্রম করে যৌবনে পদার্পণ করেছে তখন মনুষ্য সমাজ তার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত এবং আশ্চর্যেরক্স “ wonder!/How many goodly creatures are there here!/How beauteous mankind is! brave new world,/That has such people int.

মিরন্দা শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘প্রশংসার যোগ্য’। প্রথম দর্শনেই মিরন্দা যুবরাজ ফার্দিনন্দের প্রেমে পড়ে। আর জীবনের এই প্রথম ভালোবাসা প্রকাশে সে শিশুর মতো সরল ও অকপট। শকুন্তলা দুষ্মন্তের আর মিরন্দাফার্দিনন্দের প্রেমে মুগ্ধ। প্রথমজন লাজুক বলে মনের ভালো লাগা ইঙ্গিতে ব্যক্ত করেছে, ‘দুষ্মন্তকে দেখিয়াই শকুন্তলা প্রণয়াসক্তা; কিন্তু দুষ্মন্তের কথা দূরে থাক সখীদ্বয় যতদিন তাঁহাকে ক্লিষ্ট দেখিয়া, সকল কথা অনুভবে বুঝিয়া পীড়াপীড়ি করিয়া কথা বাহির করিয়া না লইল, ততদিন তাহাদের সম্মুখেও শকুন্তলা এই নতুন বিকারের একটি কথাও বলেন নাই।’ দ্বিতীয়জন (মিরন্দা) অলাজুক বলে প্রকাশ্যে মনের ভাব ব্যক্ত করে ফার্দিনন্দকে নিজের করে নিতে পেরেছে। এ প্রসঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র মত প্রকাশ করেছেন, ‘দেশী কুলবধূ বলিয়া শকুন্তলা লজ্জায় ভাঙ্গিয়া পড়িল আর মিরন্দা বা জুলিয়েট বেহায়া বিলাতি মেয়ে বলিয়া মনের গ্রন্থি খুলিয়া দিল এমত নহে… বরং বলিতে গেলে তিনজনের মধ্যে শকুন্তলাকেই বেহায়া বলিতে হয় অসন্তোসে উণ কিং করেদি? তাহার প্রমাণ।’ প্রকৃত অর্থে সমাজের প্রচলিত প্রথা, পদ্ধতি ও সংস্কার সম্পর্কে শকুন্তলা যতটা অভিজ্ঞ মিরন্দা ঠিক ততটাই অজ্ঞ এ সত্যটিই বঙ্কিমচন্দ্র প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন।

রাজা রবি ভার্মার তুলিতে কালিদাসের ‘শকুন্তলা’ নির্জন দ্বীপে একাকী মিরন্দার বেড়ে ওঠা মৃত্যুর কোলে দেসদিমোনা

শেক্সপিয়রের দেসদিমোনা একজন জেনারেল পত্নী। দেসদিমোনা বিশ্বাসী ও আদর্শ স্ত্রী। সে পূত চরিত্রের অধিকারী। দেসদিমোনা ওথেলোর শৌর্য ও বীর্য দেখে প্রণয়াসক্ত। একজন ভেনিসীয় ধনাঢ্য পিতার সুন্দরী ও নিরহংকার কন্যা হিসেবে দেসদিমোনা অন্য যে কোন ধনী-সুপুরুষ পাত্রকে বিয়ে করতে পারত। পরিবর্তে, সে সমাজকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ভেনিসীয় সমাজে গ্রহণযোগ্য নয় এমন একজন বহিরাগত কালো মানুষকে জীবনসঙ্গী করে নেয়। মানুষ হিসেবে একজন কালো জেনারেলের প্রতিষ্ঠা, ক্ষমতা ও সামাজিক প্রভাবকে দেসদিমোনা খাটো করে দেখতে পারেনি। বরং শারীরিকভাবে শক্তিশালী বীর ওথেলো খুব সহজেই তার নজর কাড়ে। এ প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র নারীর মনস্তত্ত্ব যথার্থই বিশ্লেষণ করেছেন- ‘রূপের মোহ হতে বীর্যের মোহ নারী হৃদয়ের উপর বলবত্তর।’ অশেষ মনোকষ্ট ভোগ করেও দেসদিমোনা জীবনে একটিবারের জন্য উষ্মা প্রকাশ করেনি। ক্রোধের বশীভূত হয়ে ওথেলো নিরপরাধ দেসদিমোনাকে হত্যা করে। স্বামীর হাতে প্রাণ দিয়েও তার ক্ষোভ নেই, অভিযোগ নেই ‘চলিলাম! আমার প্রভুকে আমার প্রণাম জানাইও। আমি চলিলাম।’ দেসদিমোনা অবর্ণনীয় মরণ যন্ত্রণাকে যীশুখ্রিস্টের মতো বরণ করে অনন্তের পথে যাত্রা করে। শেক্সপিয়র দেসদিমোনার চরিত্রকে দিয়েছেন সুগভীর বিশালতা। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দেসদিমোনা চিরকালের জন্য প্রমাণ করতে পেরেছে যে সে যতক্ষণ বেঁচেছিল তার হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দন ছিল ওথেলোর জন্য। দেসদিমোনা শেক্সপিয়রের সৃষ্ট একটি ‘কর্ষিত কাঞ্চন’।

ভারতীয় উপমহাদেশের শ্বাশ্বত নারী চরিত্রের একটি চিরায়ত রূপ শকুন্তলা। ভারতের পুরনো সে স্বর্ণালী দিনের স্বাধীনচেতা এক রমণীর উপাখ্যান। বিবাহের পর রাজা দুষ্মন্ত কর্তব্যের টানে নিজ রাজ্য হস্তিনাপুর চলে যায়। দুষ্মন্ত শকুন্তলাকে ছেড়ে যাওয়ার সময় ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে একটি আংটি উপহার দেয়। ঘটনাক্রমে পানিতে আঙুল চালিয়ে আনমনে খেলা করার সময় সে তাদের ভালোবাসার সাক্ষী আংটিটি হারিয়ে ফেলে এবং তাদের সম্পর্কের কোন প্রমাণ দিতে না পেরে দুষ্মন্তের দরবার থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে আসে। স্বামী পরিত্যক্ত শকুন্তলা তার ঋষিবাবা ও গুটিকয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে দুষ্মন্তের রাজ কার্যালয়ে হাজির হয়ে নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জোর চেষ্টা চালায়। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে সন্ন্যাসীর অভিশাপে দুষ্মন্তের স্মৃতিশক্তি মুছে যায় এবং সে শকুন্তলাকে অস্বীকার করে। শকুন্তলা এ অপমানের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে দুষ্মন্তকে তিরস্কার করে- ‘অনার্য! আপন হৃদয়ের অনুমানে সকলকে দেখ?’ এটা সুস্পষ্ট যে কালিদাসের শকুন্তলা প্রতিবাদী এবং সাহসী। সে তার সময়ের রমণীকুলের চেয়ে অনেকটা এগিয়ে। শকুন্তলা তার নিয়তিকে প্রচণ্ড সাহস আর সৌর্যের সঙ্গে মোকাবেলা করে দৌর্দণ্ড প্রতাপশালী নৃপতি দুষ্মন্তকে এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি করে তোলে। শকুন্তলার আমিত্ব এবং অহংবোধ যেন তাকে ঠিক অলংকারের মতো মানিয়ে যায়। অপরদিকে ভার্জিেেলর ‘দ্য এনিড’ মহাকাব্যে এ রকম একটি পরিস্থিতিতে দেখা যায় ট্রয়ের রাজকুমার এনিয়াস যখন ভবিষ্যৎ রোমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য কারথ্যাজের রানী ডিডোকে ছেড়ে যায় ডিডো তখন তাকে অভিসম্পাত করে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। লক্ষণীয় যে, জীবনের ঘটনাগুলো এভাবেই ঘটে এবং আমাদের বিস্ময়াভিভূত করে।

কবি কালিদাসকে বলা হয় প্রাচ্যের শেক্সপিয়র। কালিদাস তার মহাকাব্যিক প্রতিভার জাদুময় ছোঁয়ায় শকুন্তলার সৌন্দর্যকে মোহনীয় রূপে উপস্থাপন করেছেন। শকুন্তলা উপাখ্যানে প্রকৃতি হচ্ছে এজেন্ট যা আত্মসংযমী শকুন্তলাকে মনের ভাব প্রকাশে আপন সমান্তরাল অবস্থানে নিয়ে আসে। কালিদাসের শকুন্তলা হিমালয়ের পাদদেশ দিয়ে বয়ে চলা মালিনী নদীর মতোই উচ্ছল আর প্রকৃতি লীলায় ব্যক্ত। অপরদিকে শেক্সপিয়রের মিরন্দা ‘চিরসুন্দরের অভিবন্দনা’ এবং দেসদিমোনা ‘অসাম্প্রদায়িক’, ‘অপ্রতিরোধী’, ‘বিনয়ী’, ‘নিরভিমানী’ ও ‘নিরঞ্জন’। বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষ্য ‘শকুন্তলা ত্রিকরের চিত্র; দেসদিমোনা ভাস্করের গঠিত সজীবপ্রায় গঠন। দেসদিমোনার হৃদয় আমাদিগের সম্মুখে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত এবং সম্পূর্ণ বিস্তারিত; শকুন্তলার হৃদয় কেবল ইঙ্গিতে ব্যক্ত… শকুন্তলা অর্ধেক মিরন্দা, অর্ধেক দেসদিমোনা।’ সাহিত্যমান বিচারে কালিদাসের শকুন্তলা পাশ্চাত্যের নাট্যকার ও কবি শেক্সপিয়রের দুই নন্দিত নারী চরিত্র মিরন্দা ও দেসদিমোনার সম্পূরক। শকুন্তলা, মিরন্দা ও দেসদিমোনা প্রত্যেকেই তাদের আপন গুণাবলীতে পরিপূর্ণ- ‘দেশভেদ বা কালভেদে কেবল বাহ্যভেদ হয় মাত্র; মনুষ্য হৃদয় সকল দেশেই সকল কালেই ভিতরে মনুষ্য হৃদয়ই থাকে।’ শকুন্তলা, মিরন্দা ও দেসদিমোনা নির্দিষ্ট গণ্ডি ও কালের ঊর্ধ্বে। তারা সর্বযুগের-সর্বকালের-সর্বহƒদয়ের। তিন নারীর অনুভব-অভিজ্ঞতা বিবরণের মধ্য দিয়ে বঙ্কিম সমাজের এক বিশেষ অধ্যায়কে সমকাল এবং উত্তরকালের পাঠকের সামনে হাজির করেছেন।

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত