Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,Bankim Chandra Chatterjee

সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র ও সংগীত

Reading Time: 6 minutes

তপন মল্লিক চৌধুরী

 

গভীর রাত্রে জগৎসিংহের সঙ্গে গোপন সাক্ষাতে গড় মান্দারণ থেকে শৈলেশ্বর মন্দিরে চলেছেন বিমলা, সঙ্গে গজপতি বিদ্যাদিগ্‌গজ। রূপসী বিমলাকে ওই রাত্রে মুগ্ধ করতে বিগলিত দিগ্‌গজ গান গাইতে শুরু করে, ‘সই, কি ক্ষণে দেখিলাম শ্যামে কদম্বেরি ডালে।/সেই দিন পুড়িল কপাল মোর-/কালি দিলাম কুলে’। এই গানের সূত্র ধরে সংগীতনিপুণা বিমলা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে গান গেয়ে উঠলে বিদ্যাদিগ্‌গজের আর গান গাওয়া হয় না, কারণ সে ‘বীণাশব্দবৎ মধুর সঙ্গীতধ্বনি’ শুনে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়ে। গান শেষ হলে সে বিমলাকে একটি বাংলা গান গাওয়ার আনুরোধ করে।
 
নিজের প্রথম উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’র প্রথম খণ্ড পঞ্চদশ পরিচ্ছেদে বঙ্কিমচন্দ্র সংগীতের এমনই এক সুন্দর আবহ রচনা করেছিলেন। সে কালে প্রচলিত কায়স্থ কমলাকান্তের রূপ-অভিসারের পদ ‘কি ক্ষণে শ্যামাচাঁদের রূপ নয়নে লাগিল’ অথবা বেলডাঙার রূপচাঁদ অধিকারীর ঢপকীর্তন ‘কি রূপ দেখিনু কদম্বমূলে/কলিন্দ নন্দিনীর কূলে’ ইত্যাদি বাংলা গানের আদলে বঙ্কিম যে গীতিকাব্য রচনা করেছিলেন তা গজপতি বিদ্যাদিগ্‌গজের পক্ষে যেমন খুবই মানানসই ছিল তেমনই বঙ্কিমের সংগীতপ্রীতি-সহ তাঁর গান রচনার দক্ষতাও স্পষ্ট হয়। অন্য দিকে বিমলার গান শেষ হওয়ার পর গজপতি বিদ্যাদিগ্‌গজ যখন ‘একটি বাংলা গাও’ বলে অনুরোধ করে তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে বিমলা শুদ্ধ কোনো হিন্দুস্তানি রাগসংগীত গেয়েছিলেন। বিমলা যে শাস্ত্রীয়সংগীত জানতেন সে কথা আমরা জানতে পারি ‘দুর্গেশনন্দিনী’ উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ড সপ্তম পরিচ্ছেদে। সেখানে বিমলা জগৎসিংহকে তাঁর লেখা একটি চিঠিতে জানিয়েছেন, তিনি ছিলেন মানসিংহের মহিষী, জগৎসিংহের বিমাতা ঊর্মিলা দেবীর সহচারিণী দাসী, যিনি বিমলাকে দাসী নয় সহোদরা বোনের মর্যাদা দিতেন। বিমলাকে নানা বিদ্যায় শিক্ষিত করেছিলেন এবং তাঁরই ইচ্ছায় বিমলা নাচ ও গানের তালিম নিয়েছিলেন। বিমলার গানে মুগ্ধ হয়েছিলেন নবাব কতলু খাঁ। মৃত্যুর আগে বিমলার গান শুনে তাঁর মনে হয়েছিল, ‘এ কি মানুষের গান, না সুররমণী গায়?’
 
গীতিকার হিসাবে বঙ্কিমের সম্যক পরিচয় মেলে ‘মৃণালিনী’ উপন্যাসে। এই উপন্যাসে মোট বারোটি গান আছে, এর মধ্যে মাত্র দু’টি গান উপন্যাসের নায়িকা ‘মৃণালিনী’-র গলায় আর বাকি দশখানি গান গেয়েছেন গিরিজায়া। এই গিরিজায়া ‘মৃণালিনী’ উপন্যাসে প্রথম আবির্ভূত হন প্রথম খণ্ড তৃতীয় পরিচ্ছেদে। গিরিজায়া আসলে ভিখারিনি বেশে দূতী। গিরিজায়া প্রথম গান গায়; এক দিকে কানু ও রাই, অন্য দিকে হেমচন্দ্র ও মৃণালিনী। গিরিজায়া গেয়ে চলে, ‘মথুরাবাসিনি, মধুরহাসিনি, শ্যামবিলাসিনি-রে।/কহ লো নাগরি, গেহ পরিহারি, কাঁহে বিবাসিনি-রে’। গিরিজায়ার কণ্ঠে এই গান শুনে মৃণালিনীর এতই ভালো লাগে যে সে দ্বিতীয় বার গিরিজায়াকে গানটি গাওয়ার অনুরোধ করে। দ্বিতীয় বার গান শেষ হলে মৃণালিনী গিরিজায়াকে জিজ্ঞাসা করে, “তুমি গীত সকল কোথায় পাও?” গিরিজায়া জানায়, “যেখানে যা পাই তাই শিখি”।
 
গিরিজায়া মারফত বঙ্কিম আমাদের ফের জানিয়ে দেন যে হাটে-মাঠে-বাটে গান গেয়ে ফেরা বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীরা চিরকালই বাংলার সেরা গান সংগ্রাহক। লক্ষণীয় এই গানের ভাষা ব্রজবুলি ভাষায় এই গানের রচয়িতা বঙ্কিম, ‘মৃণালিনী’ উপন্যাসে তিনি ওই ভাষায় কেবল একটি নয় আরও বেশ কয়েকটি গান লিখেছেন। প্রসঙ্গত বঙ্কিমের ‘মৃণালিনী’ যখন প্রকাশিত হয় তখন রবীন্দ্রনাথ আট বছরের বালক। তার মানে ভানুসিংহ নন, বঙ্কিমই ব্রজবুলি ভাষাকে বাংলা সাহিত্যে নতুন ভাবে ব্যবহার করার অগ্রপথিক। গানটির ফুটনোটে আছে ‘এই গীত ঢিমে তেতালা তাল যোগে জয়জয়ন্তী রাগিণীতে গেয়’।
 
‘মৃণালিনী’ উপন্যাসে একের পর এক গান এসেছে নানা অনুষঙ্গে। ‘যমুনার জলে মোর, কি নিধি মিলিল।/ঝাঁপ দিয়া পশি জলে, যতনে তুলিয়া গলে,/পরেছিনু কুতুহলে, যে রতনে’। গিরিজায়ার কণ্ঠে এ গানে হেমচন্দ্র ও মৃণালিনীর পরিচয়, অনুরাগ ও শেষে আকস্মিক বিচ্ছেদের কথাই যেন ফুটে উঠছে। ব্রজবুলি ভাষায় রচিত আরেকখানি গান, ‘ঘাট বাট তট মাঠ ফিরি ফিরনু বহু দেশ।/কাঁহা মেরে কান্ত বরণ, কাঁহা রাজবেশ’। ব্রজবুলি ভাষায় রচিত গিরিজায়ার গাওয়া এই গানও যে মৃণাল-হারা হেমচন্দ্রের উদভ্রান্ত দশার কথা বলেছে সেটা বুঝতে অসুবিধে হয় না।
 
 
কেবল ব্রজবুলি ভাষায় পদাবলি ঢঙে রাগাশ্রয়ী গান তো নয়, বাংলার নিজস্ব ধ্রুপদী গানের অন্য ধারারও দেখা মেলে উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ডের তৃতীয় পরিচ্ছেদে। যখন গিরিজায়া ও মৃণালিনী একটি ছোটো নৌকায় চড়ে নদীতে ভেসে চলেছে, তখন তাদের কথোপকথনের মধ্যে যে গানের কলিগুলি বিনিময় হয় তা তো আসলে একটি কীর্তনের আসর। এই পরিচ্ছেদের প্রথম গান, ‘চরণতলে দিনু হে শ্যাম পরাণ রতন/দিব না তোমারে নাথ মিছার যৌবন’। দ্বিতীয় গান, ‘সাধের তরণী আমার কে দিল তরঙ্গে।/কে আছে কান্ডারি হেন কা যাইবে সঙ্গে’।
 
সংগীতপ্রেমী বঙ্কিম বাংলার নিজস্ব ধ্রুপদী সংগীত কীর্তনের প্রতি বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। সেই আগ্রহ থেকে তিনি সংগ্রহ করতেন বৈষ্ণব গীতিপদ, তাঁর নিজস্ব সংগ্রহে ছিল বহু কীর্তন গান। ‘ক্যালকাটা রিভিউ’ পত্রিকায় ১৮৭১ সালের ১০৪ সংখ্যায় ‘বেঙ্গলি লিটারেচার’ শীর্ষক প্রবন্ধেও তিনি বাংলার নিজস্ব ধ্রুপদী সংগীত কীর্তন প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। বঙ্কিমের সংগীতপ্রীতি কেবল কীর্তন গানে সীমাবদ্ধ ছিল না, তিনি বাউল গানেরও একজন মুগ্ধ শ্রোতা ছিলেন। ‘মৃণালিনী’ উপন্যাসে তাঁর নিজস্ব ভাষাশৈলীতে যেমন কীর্তনাঙ্গের গান বেঁধেছেন, পাশাপাশি ‘সাধের তরণী আমার কে দিল তরঙ্গে’র মতো যে গান রচনা করেছেন তাতে লালন বিরচিত ‘চাতক স্বভাব না হলে…’ কিংবা লালন-শিষ্য গোঁসাই গোপালের ‘না জেনে অকুল পাথারে ভাসালাম তরী’ ইত্যাদির প্রভাব লক্ষ করা যায়।
 
১৮ শতকের শেষ দিক থেকেই বাংলার উত্তর-পূর্ব প্রান্তে লালনের সহজিয়া গান ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। কর্মজীবনের শুরুতে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিমকে ঘুরতে হয়েছিল যশোর, খুলনার গ্রামেগঞ্জে। গানের টানে বঙ্কিমও কি সেই মাটিতে পা রেখেছিলেন, মাতোয়ারা হয়েছিলেন একতারার সহজ সুরধ্বনিতে? তাঁর সঙ্গে কি লালন ফকিরের দেখা হয়েছিল? এখনও পর্যন্ত তেমন কোনো তথ্যপ্রমাণ মেলেনি তবে বঙ্কিম যে কীর্তনের মতো বাউল গানেরও ভক্ত ছিলেন তাতে সংশয় নেই। হয়তো বঙ্কিম কীর্তনের মতো বাউল গানেরও সংগ্রাহক ছিলেন।
 
‘মৃণালিনী’ ছাড়াও কীর্তনের আসর বসতে দেখা যায় ‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসে; সপ্তম পরিচ্ছেদে, এখানে আসর অনেক বেশি জমজমাট। ‘কথা কইতে যে পেলাম না—দাদা বলাই সঙ্গে ছিল—কথা কইতে যে’ তুলসির মালা পরা, কপালে তিলককাটা বৈরাগীর দলকে মৃদঙ্গ বাজিয়ে নগেন্দ্র দত্তের ঠাকুরবাড়িতে যেমন গাইতে দেখি, তেমনই বৈষ্ণবীদেরও রসকলি কেটে খঞ্জনীর তালে গাইতে দেখা যায় ‘মধো কানের’ বা ‘গোবিন্দ অধিকারীর’ গীত। এর পর নবম পরিচ্ছেদে শোরগোল তুলে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়ে আবির্ভুত হয় হরিদাসী বোষ্টমী। হরিদাসী ভেকধারী, জাল বোষ্টমী, আসলে দেবেন্দ্র দত্ত, নগেন্দ্রর অন্তঃপুরে প্রবেশের জন্য ছদ্মবেশ ধারণ করেছিল। গিরিজায়ার মতো সে নয়, কিন্তু তার ঝুলিতে বঙ্কিম ভরে রাখেন আঠারো শতকের শেষপাদ ও উনিশ শতকের বাংলা গানের নমুনা। এক এক করে হরিদাসী পেশ করে সেই সব গান। কুন্দনন্দিনীর উদ্দেশে হরিদাসী প্রথমে কীর্তন, ‘শ্রীমুখপঙ্কজ—দেখবো বলে হে,/ তাই এসেছিলাম এ গোকুলে।/আমায় স্থান দিও রাই চরণতলে’। এর পর ঢপ, ‘আয়রে চাঁদের কণা/তোরে খেতে দিব ফুলের মধু, পরতে দিব সোনা’। এর পর দেবেন্দ্র বা হরিদাসী আরো প্রগলভ হয়ে ওঠে, ‘কাঁটাবনে তুলতে গেলাম কলঙ্কের ফুল,/গো সখি কাল কলঙ্কেরি ফুল’। জাল বোষ্টমী চরিত্র বোঝাতে বঙ্কিম উচ্চাঙ্গের কীর্তন যেমন রেখেছেন তেমনই হাজির করেছেন বাগানবাড়ির গান, গোপাল উড়ের টপ্পার ধাঁচে লঘু গান ইত্যাদি।
ভারতীয় মার্গসংগীত থেকে কীর্তনাঙ্গের গান, এমনকি বাংলা লঘু বা চটুল গান বঙ্কিমের উপন্যাসে পরিপূর্ণ ভাবেই আছে। তবে সব গান যে তাঁরই রচনা এমনটা কিন্তু নয়। অনেক গানে আবার অন্য গানের সরাসরি প্রভাব লক্ষ করা যায়, কোনো কোনো গানের সংগ্রাহক আবার বঙ্কিম নিজে। নিজের লেখা গানে বঙ্কিম তো কেবল রচয়িতা নন, রাগ-তাল-এর যথাযথ উল্লেখ বলে দেয় সংগীত সম্পর্কে তাঁর সম্যক ধারণা কতখানি গভীর। ‘মৃণালিনী’, ‘বিষবৃক্ষ’র মতো সংখ্যায় বেশি না হলেও গান রয়েছে ‘ইন্দিরা’তেও। ‘একা কাঁখে কুম্ভ করি, কলসীতে জল ভরি,/জলের ভিতরে শ্যামরায়’ – এই প্রাচীন গীত ইন্দিরার মনে পড়ে নৌকা চড়ে গঙ্গা দিয়ে কলকাতা যাওয়ার সময়।
পাঠকমাত্রেরই সাহিত্যসম্রাটের সংগীত প্রসঙ্গে ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের প্রথম খণ্ডের দশম পরিচ্ছেদে ‘বন্দেমাতরম’ গানটির কথা মনে আসে, যে গান ভারতের জাতীয়তার মহামন্ত্র। গানটি বঙ্কিম ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাস লেখার অন্তত ছ-সাত বছর আগে লিখেছিলেন সঞ্জীবচন্দ্র সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায়। ফুটনোটে আছে মল্লার রাগ ও কাওয়ালি তালে গানটি গীত। শোনা যায় বঙ্কিমের সংগীতগুরু যদুভট্ট গানটিতে প্রথম সুরারোপ করেছিলেন, কিন্তু কোন রাগ বা তালে তা জানা যায় না। বন্দেমাতরম ছাড়াও ‘আনন্দমঠ’-এ আরও গান আছে, দ্বিতীয় খণ্ড দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে বাগীশ্বরী রাগিণীতে আড়া তালে শান্তিকে গাইতে দেখি, ‘দড় বড়ি ঘোড়া চড়ি কোথা তুমি যাও রে… পায়ে ধরি প্রাণনাথ আমা ছেড়ে যেও না’। তৃতীয় খণ্ডের তৃতীয় পরিচ্ছেদে শান্তি ও তাঁর স্বামীর যুগলকন্ঠে পাই, ‘এ যৌবন-জলতরঙ্গ রোধিবে কে?/হরে মুরারে! হরে মুরারে!’ এ ছাড়াও ব্রহ্মচারী সত্যানন্দ ও শান্তির গলায় বঙ্কিম রেখেছেন জয়দেব গোস্বামী বিরচিত পদ – ‘ধীরসমীরে তটিনীতীরে বসতি বনে বরনারী…’। তৃতীয় খণ্ডের সপ্তম পরিচ্ছেদে শান্তি গায় গোস্বামী কবির দশাবতার স্ত্রোত্র, ‘প্রলয়পয়োধিজলে ধৃতবানসি বেদম…’।
 
উপন্যাস ছাড়াও বঙ্কিমের গান পাওয়া যায় ‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এ। কমলাকান্ত প্রসন্নকে শুনিয়েছিলেন, ‘এসো এসো বঁধু এসো, আধ আচারে বসো…’। ‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাসে ধনকুবের জগতশেঠ ভাইদের জলসাঘরের ঐশ্বর্যমণ্ডিত সংগীতসভায় মনিয়াবাঈকে ‘সনদি খিয়াল’ গাইতে দেখা যায়, ‘শিখো হো ছল ভালা’। অনুমান মেটিয়াব্রুজে ওয়াজেদ আলি শাহর সভাগায়ক সনদপিয়া রচিত ঠুমরি হল সনদি খিয়াল। ‘রাজসিংহ’ উপন্যাসের চতুর্থ খণ্ড প্রথম পরিচ্ছদে মোগল সেনার বেশে মানিকলালের গলায় বঙ্কিম রাখেন উত্তর-মধ্য ভারতের লোকভাষার একটি গান, ‘শরম ভরমসে পিয়ারী,/সোমরত বংশীধারী,/ঝুরত লোচনসে বারি…’। এ রকম উদাহরণ আরও রয়েছে বঙ্কিমের উপন্যাসে এবং লেখায়। বঙ্কিমের এই সংগীতপ্রীতি এবং সংগীত বিষয়ে গভীর ধারণা কোথা থেকে কী ভাবে হয়েছিল?
আমরা জানি বঙ্কিমের সময় হল বাংলায় রাগসংগীত চর্চার সুবর্ণ যুগ। এক দিকে মেটিয়াব্রুজে লখনউয়ের সিংহাসনচ্যুত নবাব ওয়াজেদ আলি শাহর সংগীত দরবার, যার স্পষ্ট প্রভাব বঙ্কিমের ‘দুর্গেশনন্দিনী’ ঊপন্যাসে বর্ণিত নবাব কতলু খাঁর নাচগানবিলাসিতার মধ্যে অনেকখানি ধরা পড়ে, অন্য দিকে পাথুরিয়াঘাটার রাজা যতীন্দ্রমোহন ও সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের গানবাজনার আসর, কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ি-সহ কয়েকটি বনেদি বাড়ির সংগীতচর্চা ও বৈঠকি আড্ডা কলকাতার সেই সময়কার সংগীতচর্চাকে অন্য মাত্রা দিয়েছিল। প্রসঙ্গত বঙ্কিম ছিলেন সৌরীন্দ্রমোহনের খুবই ঘনিষ্ঠ। তাঁদের বাগানবাড়ি মরকতকুঞ্জে ১৮৭৬ সালের ৩১ জানুয়ারি সরস্বতী পুজোর দিন অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় বার্ষিক কলেজ রি-ইউনিয়নে সৌরীন্দ্রমোহনের গান শুনতে উপস্থিত ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। বঙ্কিমের কাঁঠালপাড়ার বাড়িতেও গৃহদেবতা রাধাবল্লভের নানা পার্বণ উপলক্ষ্যেও যাত্রা, পালাগান, কথকতা ইত্যাদি লেগেই থাকত। শৈশবাবস্থা থেকেই বঙ্কিম ওই সাংগীতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠায় তাঁর কান গানের জন্য যে তৈরি হয়ে উঠেছিল তা বলাই যায়। পরবর্তীকালে একটু বেশি বয়সে তিনি রীতিমতো নাড়া বেঁধে তাঁর থেকে দু’বছরের ছোটো সেই সময়ের প্রখ্যাত ধ্রুপদশিল্পী যদুভট্টের কাছে শাস্ত্রীয় সংগীতের তালিম নিয়েছিলেন।
 
শোনা যায়, শৈশবকাল থেকেই বঙ্কিম মুখে মুখে গান রচনা এবং তাতে সুর সংযোগ করতেন। বঙ্কিম অনুজ পূর্ণচন্দ্রের একটি লেখা থেকে জানা যায়, যখন বঙ্কিমের ১৩-১৪ বছর বয়স সেই সময় দাদা ও ভাইদের সঙ্গে নৌকায় ভাসান দেখতে বঙ্কিম ফরাসডাঙা যাচ্ছিলেন। ভাগীরথীর পূব পাড়ের শ্মশানে তখন শবদাহ হচ্ছিল। শ্মশানে এক মহিলা কাঁদতে কাঁদতে জলন্ত চিতায় ঝাঁপ দেওয়ার চেষ্টা করছিল, তাকে ধরে রেখেছিল তার বাড়ির লোক। এই ঘটনায় বঙ্কিমের চোখ জলে ভরে যায়। কিশোর বঙ্কিম নৌকায় বসেই একটি গান লিখে সুর সংযোগ করেছিলেন। মল্লার রাগিণীতে তৈরি সেই গান বহু কাল প্রচলিত থাকার পর লুপ্ত হয়ে যায়। গানটির কথা… ‘হারালে পর পায় কি ফিরে মণি – কি ফণিনী, কি রমণী?’
 
বঙ্কিমের ভাইয়ের ছেলে তথা বঙ্কিমজীবনীকার শচীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘বঙ্কিম-জীবনী’তে লিখেছেন, ‘মৃণালিনী’ লেখার সময় বঙ্কিম ইতিহাস ও বিজ্ঞান পড়তে যেমন শুরু করেছিলেন, তেমনই তাঁর মধ্যে গান শেখার ঝোঁকও দেখা যায়। কাঁঠালপাড়ারই একজন বঙ্গবিশ্রুত গায়ক যদুভট্টকে পঞ্চাশ টাকা বেতন দিয়ে তিরিশ-উত্তীর্ণ বঙ্কিম গান শেখা শুরু করেন। বঙ্কিমের ‘মৃণালিনী’ প্রকাশিত হয় ১৮৬৯-এর ১৯ নভেম্বর, তার আগে ব্যক্তিগত কাজে তিনি ছ’মাসের ছুটি নিয়েছিলেন ১৮৬৮-র ৪ জুন থেকে। এর পর ১৮৬৮-র শেষাশেষি তিনি ‘মৃণালিনী’ লিখতে শুরু করেন, শচীশচন্দ্রের জীবনী অনুযায়ী এই সময়েই তিনি যদুভট্টের কাছে সংগীত শিক্ষা শুরু করেছিলেন। প্রসঙ্গক্রমে বলাই যায় বঙ্কিমের সংগীতচর্চা খুব নিয়মিত হয়নি। কারণ ১৮৬৯-এর ১৫ ডিসেম্বর তিনি বহরমপুরে কাজে যোগদান করেন। ১৮৭২-এ ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকা প্রকাশের পর থেকেই বঙ্কিম সপ্তাহান্তে কাঁঠালপাড়ার বাড়িতে ফিরতেন। তাঁর বাড়িতেই বসত ‘বঙ্গদর্শন’-এর বিখ্যাত মজলিশ, সেখানে উপস্থিত থাকতেন যদুভট্টও।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>