ইরাবতী ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব-৬) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
শুধু খাবারদাবার নয়,ছুটির দিনে ডুগডুগি বাজিয়ে আসত ভালুকওলা।তার ডুগডুগির বাজনার সঙ্গে তালে তালে নাচত ভালুকছানা। কখনও কখনও বাঁদর আসত এক জোড়া।তারা বালতি করে মিছিমিছি জল তুলত। মেয়ে বাঁদরটা ছোট শাড়ি কুঁচিয়ে পরত,মাথায় সিঁদুর দিত,আর আয়নায় মুখ দেখার সময় ফিকফিক করে হাসত।ডুগডুগি বাজিয়ে বাঁদর ওলা গাইত, “প্যার কিয়া তো ডরনা কেয়া …।”
আর একটা মজা হত ওই বাঁদর ,ভালুকওলা এলে।ওরা পাড়ায় পা ফেললেই পাড়ার সব কুকুর একযোগে ঘেউ ঘেউ করে উঠত।তাদের সমবেত আপত্তি অগ্রাহ্য করেই ওইসব নাচাগানা শুরু হত।কিছুক্ষণ পরে মানুষের এসব খামখেয়ালীপনায় বিরক্ত হয়ে রণে ভঙ্গ দিত তারা।তল্লাট ছাড়ার আগে এক একবার চিৎকার করে তাদের অপছন্দ জানালেও মুগ্ধ দর্শকের দল সেসব মোটে পাত্তা দিতনা।
আমোদ হত যখন মুখে চোঙা লাগিয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁকতে হাঁকতে যেত সিনেমাওলা। ও হাঁকত, “তাজমহল ,তাজমহল,” আর আমরা ছুটতাম। স্ট্যান্ডের ওপর দাঁড় করানো কাঁচের একটি চৌকো বাক্স।বাক্সর সারাশরীরে ঝলমলে শাটিনের ঢাকা। ঢাকার এককোনে একটা খোলা গর্ত।সেখানে বাক্সের মাথায় লাগানো একটি গোল কাচ।তাতে চোখ লাগিয়ে ভেতরের সিনেমা দেখতাম আমরা।ওই বাক্সে আবার গান শোনার জন্য লাগানো রয়েছে লম্বা চোঙ।
বাক্সে চোখ লাগিয়ে সিনেমা দেখা। ভেতরে আজব কারখানা!বাক্সের গায়ে লাগানো হ্যান্ডেল ঘোরালেই ছবি ঘুরতে থাকে।কাঁচের গর্তে চোখ লাগিয়ে দেখি একটার পর একটা ছবি ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে। তাজমহল,চীনের প্রাচীর, জাপানের প্যাগোডা, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ,নেতাজী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ইত্যাদি ইত্যাদি। স্থিরচিত্র সব।কত পয়সা লাগত এখন আর মনে নেই।তবে বাক্সের চারধারের জমাট ভিড়ের কথা মনে আছে।
সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা তখন নেই বললেই হয়। অভিভাবকদের অনুমতি নিয়ে মাঝেমাঝে ‘বীর হুনুমান’ জাতীয় কিছু ছোটদের বই আমাদের দেখানো হয়। সে কথায় পরে আসছি।তাই ওই কাচের জানলায় চোখ দিয়ে স্থিরচিত্র দেখতে আমাদের খারাপ লাগতনা।বড়রা জানতেন না ওই বক্সের সিনেমায় আমাদের জন্য নিষিদ্ধ কিছু উপকরণও রাখা আছে ।ওসব স্থির চিত্র ছাড়াও দেখানো হত হিন্দী বা বাংলা সিনেমার নায়ক নায়িকাদের স্থির ছবি।তার সঙ্গে বাজত সিনেমার গান।
আরো পড়ুন: ইরাবতী ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব-৫) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
সিনেমা সংক্রান্ত ছবি দেখালেই ঠেলাঠেলি শুরু হয়ে যেত।সবাই আগে দেখবে।আগে শুনবে।
এছাড়াও সওদা করার অন্যরকম একটা সুযোগ ছিল।মাঝেমাঝে মেলা বসত কোন একটা বিশেষ উপলক্ষ্যে।রাসের মেলা,কুন্তীর মেলা,মূলোজোড়ের মেলায় হাজির হলে দেখতাম সেই ঘুঘনি দাদু,কুলপীওলা কাকু,আইসক্রিম দাদারা কেমন ভিড় জমিয়েছেন।কাঁচের চওড়া বাক্সে নকল পাথরের আংটি সাজিয়ে বসে আছেন আমাদের ফেরিওয়ালা দাদা। চেনা মানুষ দেখে তার এবং আমাদেরও ভারী আনন্দ! আমরা আংটিওয়ালার কাঁচের বাক্সের সামনে উবু হয়ে বসে আংটি বাছাই করি।আর মনোমত আংটি হাতে পরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পাথরটা দেখি। কে জানে বাবা ঠকে গেলাম নাতো।ঠিক তখুনি কালো মেঘ সরে যায়, রোদ পড়ে, আর আংটিতে রামধনুর নানা রঙের রঙ ঝলকায়!আমরা মুগ্ধ হয়ে যাই ।
মাঝেমাঝে পাখির ঝাঁকা কাঁধে আসত পাখিওলা। সে মুখে মুখে বলত নানা রঙের পালকে রঙিন, গুণবান গুণবতী পাখিদের বংশ পরিচয় এর বিস্তারিত বিবরণ। বলাবাহুল্য খুব লোভ হলেও পাখি কেনার কথা বাড়িতে বলতে পারিনি।পাড়ায় ছিলেন শৌখিন ফিটফাট সমরেশ কাকু। নিশ্চয়ই বড়সড় চাকরি করতেন, কেননা অফিসের গাড়ি আমাদের অপরিসর গলিতে ঢু্কে, অনেক কসরৎ করে তাকে রোজ নিয়ে যেত।তার ছিল পাখি আর বাগানের শখ।পাখিওলা তার বাড়ির দিকে গেলে আমরাও পিছু ছাড়তাম না।পাখি কেনা পর্বের পুরোটার নীরব দর্শক হতে আমাদের একেবারেই আপত্তি ছিলনা। কিন্তু লোহার বড় গেটের মধ্যে পাখিওলা ঢুকে গেলে গেট বন্ধ হয়ে যেত। গেটের বাইরে আমরা উঁকিঝুঁকি মেরে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরতাম।মানুষের ব্যক্তিগত পরিসরে যে ঢুকতে নেই সে বোধ আমাদের ছিলনা।তাই লজ্জা তো হতই না, উল্টে পুরোটা না দেখতে পাওয়ার অব্যক্ত ক্ষোভ মনের মধ্যে বাসা বাঁধত। কেননা নিজেদের মধ্যে গুজগুজ করা ছাড়া কোনকথাই কাউকে বলার সাহস ছিলনা।

ঐতিহ্যময় শহর চন্দননগরের স্থায়ী বাসিন্দা সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায় বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির স্নাতক।১৯৯৬ সালে প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়’দিবারাত্রির কাব্য’ পত্রিকায়।২০০১ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়।‘আনন্দবাজার’, ‘বর্তমান’, ‘আজকাল’, ‘প্রতিদিন’, ‘তথ্যকেন্দ্র’, ‘উত্তরবঙ্গ সংবাদ’ ছাড়াও, ‘অনুষ্টুপ’, ‘কুঠার’, ‘এবং মুশায়ারা’-র মতো বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনেও তার কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ প্রকাশের ধারা অব্যাহত। প্রকাশিত উপন্যাস পাঁচটি, গল্পগ্রন্থ চারটি, এবং কবিতার বই একটি।