| 29 মার্চ 2024
Categories
সাক্ষাৎকার

জল বায়ু আলোর মতই আমি কোথাও থাকতে চাইনাঃ বারীন ঘোষাল

আনুমানিক পঠনকাল: 23 মিনিট

বারীন ঘোষাল। বাংলা অপর কবিতায় তিনি সবচেয়ে চর্চিত নাম।তাঁকে নিয়ে ফিসফাসের অন্ত নেই।বারীন কি ভাবেন, কি ভাবেন না। কি করেন,করেন না-কি বলেন,কি বলেন না। তিনি কি করতে পারতেন, কি তিনি করেননি।কোথায় তিনি পৌঁছে গেছেন- কোথায় তিনি যেতে চাননি। তাঁকে নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই।

বারীনের পক্ষে এবং বিপক্ষে অনেক কথা শুনতে শুনতে কৌতূহলের জন্ম হয়। প্রশ্নগুলো রাখা গেল,সাহস করেই রাখা গেল।এই প্রশ্নগুলো হয়তো এই প্রথম বাতাস থেকে নেমে এল ছাপার অক্ষরে। আর উত্তরগুলো ? মাটি ফুঁড়ে !! সাক্ষাতকারটা নিয়েছিল কবি অনুপম মুখোপাধ্যায়। এই আলাপচারিতা ‘এখন বাংলা কবিতার কাগজ’এর ২০১০সালের বইমেলা সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল। বারীন ঘোষালের জন্মতিথিতে সেই আলাপচারিতা ইরাবতীর পাঠকদের জন্য পুনঃপ্রকাশ করা হলো।


  বারীনদা ,আপনার প্রথম কবিতাটা কিভাবে লেখা হয়েছিল ?

আজো সেই প্রথম কবিতা লেখা হয়ে ওঠেনি ভাই।যেদিন হবে কলম গুটিয়ে রাখবো। হ্যাঁ, সিরিয়াসলি কবিতা লেখার চেষ্টায় কমল চক্রবর্তী প্রথম আমার হাত ধরে শিখিয়েছিলেন। সেই থেকে চেষ্টায় লেগে আছি। যা লিখি কবিতা আর হয়না।দেখি সব কবিতা লিপি হয়ে যাচ্ছে।

কৈশোরে কোনো প্রিয়কবি কি ছিলেন ? কখনো সেইভাবে কোনো একজন  প্রিয়কবি হয়েছেন ?

আমাদের পাড়ায় একজন কবি ছিলেন-ছ’ফুট লম্বা, ফর্সা,টিকোলো নাক, কালো ঝাঁকড়া চুল, খুব সুন্দর রাজপুত্রের মত দেখতে। তাঁকে নানা অনুষ্ঠানে, পুজো প্যান্ডেলে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে উদাত্ত গলায় কবিতা পড়তে দেখতাম। মনে মনে প্রার্থনা করতাম যেন বড় হয়ে সেই সত্যেনদার মত কবি হতে পারি।আমার খুব প্রিয় ছিলেন কবি সত্যেন্দ্র দে ।পরবর্তী সময়ে আমার কবিতা শুনে তিনি আমায় স্নেহ করতেন। তিনি প্রয়াত হলে তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত ‘সত্যেন্দ্র দে সম্মান’ না পেয়ে আমি ধন্য হয়ে যাই।আমার প্রিয় কবি এভাবে আমার কাছে রয়ে গেলেন।

  সত্তরের কবি, না আশি ? কোনো দশকে কি রাখতে চাইবেন নিজেকে ?

আমি সত্তর দশকে শুরু করে থাকলেও,আমি প্রতি দশকের কবি। প্রতিবার আমি নতুন  শিখেছি ,নতুন লিখেছি। পরিবর্তন কখনো আবর্তন হয়নি।এখনো রোজ পথ খুঁজি।  তাই আমার শিং গজালনা। তা জেনে লজ্জা পাব না ফুর্তি করব বুঝতে পারিনা। তুমি দ্যাখোনা-বুড়ো মানুষরা আমার কাছে ঘেঁষে না,ছোটরা ভালবাসে আমাকে !

অতিচেতনা শব্দটা কোথা থেকে এল ? এই শব্দ বিনয় মজুমদার ব্যবহার করেছেন আলোক সরকার সম্প্রতি করেছেনমণীন্দ্র গুপ্ত করেছেন শুনেছি, নিজে দেখিনি

‘অতিচেতনা’ শব্দটা বা ধারণাটি আমার পেটেন্ট করা নয়।এটি আমি ১৯৮১ থেকে ১৯৮৭ পর্যন্ত কৌরবের বিখ্যাত ‘কবিতার ক্যাম্প’ চলাকালীন তর্ক বিতর্কের সময় কমল চক্রবর্তীর বলা ‘চেতনকল্প’ শব্দ-উৎস থেকে পাই কল্পনার খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে। বিনয় মজুমদার অবচেতনায় কবিতা লিখতে বসে অতিচেতনা ভাবনা পাবেন কোথায় ? ওটা একটা শব্দমাত্র ছিল তাঁর কাছে। তিনি ১৯৮৭ সালে শব্দটা ব্যবহার করেছেন।‘অতিচেতনা’ শব্দটা  তার  আগেই কৌরবের ক্যাম্প রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছিল।মনীন্দ্র গুপ্তর প্রায় সব গদ্যই আমার পড়া । তিনি এবং আলোক সরকার আমার শ্রদ্ধেয় কবি। আমি তাঁর বা আলোক সরকারের কোনো লেখায় শব্দটা দেখিনি।আর থাকলেই বা কি ? শুধু ধারণায় নয়, সেটি চেতনায় গ্রথিত হলে কবিতায় প্রয়োগে তার সম্প্রসারণ থেকেই ক্রমশঃ অতিচেতনার অস্তিত্ব জানা যায়, সে  সম্পর্কে কথা বলা যায়।

অতিচেতনার কথায় কোন তন্ত্রের ব্যাপার কি জড়িয়ে নেই?

পন্ডিত প্রবর কলিম খান এবং রবি চক্রবর্তির সম্প্রতি প্রকাশিত ‘বঙ্গীয় শব্দার্থ কোষ’ অভিধান গ্রন্থটি খুলে দেখলাম পৃথিবীতে সবসুদ্ধ ১৯২ টি তন্ত্র আছে।, তারমধ্যে ৬৪ টি বঙ্গদেশের।মহাতন্ত্র ছাড়াও কতকগুলো উপতন্ত্রও আছে। এইবার বল,  কোন তন্ত্রের কথা বলতে চাইছিলে? হতে পারে তা কবিতাতন্ত্রের কথা। এই শব্দটা ওই অভিধানে নেই। এটা এক্ষুণি বানালাম। অর্থাৎ যার অভ্যাস ও প্রয়োগে সার্থক কবিতা রচনা সম্ভব। না ভাই, এরকম কোন তন্ত্রের অবকাশ নেই অতিচেতনায়।

অতিচেতনায় যেতে হলে প্রথমে তোমাকে আত্ম উপলব্ধি করে তোমার কোর চেতনায় , কোরকে পৌঁছতে হবে।নিজের চেতনা সম্পর্কে সচেতন হলে বুঝতে পারবে সেটা জীবন্ত এবং তা থেকে বলয়াকারে কেন্দ্র-বিমুখী তরঙ্গমন্ডল প্রসারিত এবং ক্ষীণশক্তি হচ্ছে।এই ক্রমপ্রসারিত তরঙ্গবলয়রা হয়তো তোমার অভিজ্ঞতা স্পর্শ করবে কখনো একেই বলে সম্প্রসারিত চেতনা বা অতিচেতনা। এটি স্বয়ংক্রিয় এবং তোমার সংবেদনশীলতার জন্য অপেক্ষারত। এতে তো কোনো তন্ত্র নেই গো।

বিশ শতকের প্রথমার্ধে জীবিত সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট কবি কাকে মনে করেন ? ইনক্লুডিং টেগোর ?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।আবার কে ?

আপনার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দশক কোনটা ? যদি দশকভাগ মেনে নিই

ষাটের দশক অবশ্যই। সে সময় সমকালীন বাংলা কবিতা, আন্দোলন, পত্রিকার কথা কিচ্ছু জানতাম না।ছিলাম জলপাইগুড়ি শহরে। ঘুরে বেড়াতাম পাহাড়ে, বনে জঙ্গলে, নদীতে, গ্রামের পথে পথে।স্বভাব-কবির সমস্ত মালমশলা আমার অজান্তেই আমার মধ্যে পুরে দিল জলপাইএর সবুজ প্রকৃতি।ওখানে না থাকলে আমার কবি হওয়ার কোনো সাধ জাগতোনা। তাই ষাটের দশক আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলে মনে হয়।

আপনি একবার আমাকে বলে ছিলেন বিমল মজুমদার একটা মিথআমার কানে লেগে আছে একটু বলুন

বেশী বললে লোকে আমারই কান দুটো কেটে নেবে। ১৬ বছর বয়েস থেকে কবিতা লিখেছেন.২৪ বছর বয়েসে কোনো পত্রিকায় কবিতা প্রকাশের আগেই দেবকুমার বসু ‘বিশ্বজ্ঞান’ থেকে তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘নক্ষত্রের আলোয়’ (১৯৫৮ সালে )প্রকাশ করে বিখ্যাত হবার রাস্তা পাকা করে দিয়েছিলেন।এরপর সবার লক্ষ্য-জন হয়ে ওঠেন এবং পত্রিকাগুলিতে আমন্ত্রণ পেতে থাকেন। ১৯৬১ সালে ‘গায়ত্রীকে’ আবার দেবকুমার বসুই প্রকাশ করেন। ১৯৬২ সালে বেরোয় ‘ফিরে এসো চাকা’ । এবার ভাবো  ১) পত্রিকায়  কবিতা প্রকাশের আগেই প্রকাশক কেড়ে নিয়ে যায় বই করতে, ২) ২৮ বছর বয়সের মধ্যেই তিনখানা বই প্রকাশিত, ৩) জীবনে গায়ত্রী চক্রবর্তীর সঙ্গে একটাও কথা না বলে মনে মনে জপে গেলেন, তবুও সেই অলীক প্রেম নিয়ে গল্পগাছার ঘায়ে বেচারি বিনয় মেন্টাল হাসপাতালে ১৯৬৩ থেকে ঢুকলেন  আর  বেরোলেন না আজীবন। ৪) শেষে কত মানুষের আগ্রহ, অনুকম্পা, দাক্ষিণ্য, সহযোগিতা, সহানুভূতি ,সাহায্য শুশ্রুষা  আকর্ষণ করলেন। ৫) আবহমান বাংলা কবিতায় কোনো বাঁকবদলের প্রতিশ্রুতি না রেখে ১৯৬৪ পর্যন্ত চোদ্দ বছর শুধু মাত্রাবৃত্তে তাঁর প্রায় লেখা শেষ করে ২০০৭ পর্যন্ত পাঠকের মনে জেগে থাকলেন- মিথ নয়! এর পরেও তাঁর অনেক বই বেরিয়েছে কবিতা, অনুবাদ গণিত বিষয়ে। আমি কেবল মিথিক্যাল বিনয় মজুমদার নিয়ে বললাম।

নতুন কবিতার জন্য আশির কবিরা পথচলার যে বিধিগুলো তৈরী করেছিলেন, আজ কি সেগুলো কোনোভাবে ব্রেক করা জরুরী মনে করেন?

তোমার কথা বিধির বিধানের মত শোনাচ্ছে।তা তো নয়।আর আশির কবিরা বলতে ২০০ জন কবিকে বোঝায়।তাঁরা সবাই তো আবহমান কবিতার চর্বিত চর্বণ করছিল। মাত্র কয়েকজন অন্য পথ খুঁজেছিল। সবাই তো আর নতুন কবিতার বিবর্ধনে সংযুক্ত ছিলনা। তাই নতুন কবিতার উন্মেষের ভাগী আশীর দশককে বলা চলেনা। নতুন কবিতার জন্য কোনো বিধানের কথা আমার জানা নেই।সে সময় পর্যন্ত সমকালীন এবং আবহমান বাংলা কবিতার পুনরাবৃত্তি না করে ৭/৮ জন কবি তাঁদের প্রতিষ্ঠিত কবিতা পত্রিকা ছেড়ে ‘কবিতা ক্যাম্পাস’ নামের তলায় নতুন কিছু করার তাগিদ অনুভব ও প্রয়াস করেছিল,৯০ দশকের শুরুতে । কিন্তু পুরোনো কবিতার বিজড়ন এড়ানো সম্ভব হচ্ছিলনা।তাঁদের মধ্যে আমি হয়ে উঠেছিলাম ক্যাটালিস্ট-এর মত।অনেকবছর ধরে ওয়ার্কশপের মাধ্যমে তর্ক-বতর্কের পর স্থির হয় যে আগে পুরোনো কবিতার সমস্ত চিহ্ন ত্যাগ করতে হবে, তারপর নুতন কবিতার নির্মাণ সম্ভব হতে পারবে।এই যে পুরোনো কবিতার গুণ ও প্রকৃতি ত্যাগ করার কথা হল-এটাকেই তুমি বিধি বলছো ।তাইতো ? সেগুলো ব্রেক করা জরুরী মনে করিনা আমি।করলেই তো আবার সেই পুরোনো কবিতার অনুকরণের রিমেক শুরু হয়ে যাবে।বাংলায় সবাই যখন নতুন কবিতা লিখবে তখন নিজের ভারেই বাঁকবদল উপস্থিত হবে আবার।ততদিন অপেক্ষা কর।

নতুন কবিতার পর কি ? নতুনোত্তর কি হতে পারে ? আগামী দশ বছরে বাংলা কবিতায় কি হতে পারে ?

যেভাবে বাংলাভাষার চর্চা কমে আসছে তাতে নতুনোত্তর কবিতার উন্মেষের সুযোগ সুদূর পরাহত মনে হয়।প্রয়োজনের চাপ থেকে নতুনের উদ্ভব হয়।সেটা হবে যখন নতুন কবিতা আবার পুরোনো গাড্ডায় পড়বে।আগামী দশ বিশ বছরে হবেনা মনে হয়।নতুন কবিতা আগে সম্পৃক্ত হোক। ব্যবসায়ীদের টনক নড়েনি এখনো।তাঁরা এখনো পুরোনো কবিতাকেই বাজারে দিচ্ছে।যখন তাঁরা অ্যাকোমোডেশন শুরু করবে তখনি নতুন কবিতার গাড্ডা খোঁড়া হয়ে যাবে।

সম্পূর্ণ অলংকারবর্জন কি কোনরকম ভাষার আওতায় থেকেই সম্ভব?থেকেই কি যায় না ?

অলংকারকে অতিরিক্ত মনে হলেই রিক্ত করা যায়।তুমি কি স্বেচ্ছায় অলংকার বিবর্জিত মহিলাদের সৌন্দর্য ও অহংকার লক্ষ্য করনি ? নিষেধ আরোপ ক’রে সীমাবদ্ধতার মধ্যে এক্সপ্লোর করলে কবিতার অনেক সম্ভাবনার স্ফুরণ হয়। এরকমভাবে পরীক্ষা না করলে তোমার নিজেরও সন্দেহ যাবেনা।

সত্য বলে কিছু আছে আদৌ ? কবিতায় সে কি আছে ? থাকতে পারে ?

বিশ্বে আর জীবনে পরিবর্তন আর পরিবর্ধন ছাড়া আর কোনো ধ্রূব সত্য নেই।বাকি সমস্ত সত্যই আপাত সত্য।ভাবনা দিয়ে কবিতা নির্মিত হয়,তার মধ্যে আবার ভাবনাগুলো ফুটে থাকে। সেখানে সত্য মিথ্যার জায়গা নেই।

কবিতা যদি টাইপোগ্রাফি ভেঙে ফেলে, অক্ষরের বাইরে চলে আসে- ভাল লাগে আপনার ? ধরুন দৃশ্য-কবিতা-ভিস্যুয়াল পোয়েট্রি-

কবিতা আগে দৃশ্য এবং শ্রাব্য। এই দুটি অঙ্গ বা যে কোন একটি ছাড়া কবিতা হয়না। সেই কবিতা অনুভব করে কবিতাকে অক্ষরের মাধ্যমে ব্যক্তিগত ভাষায় অথবা সাধারণের ভাষায় প্রকাশ করে।সেটা হল প্রাথমিক অনুবাদ। সেটাকে আবার অক্ষরের বাইরে নিয়ে যেতে চাইছ কেন? তা সম্ভব নয়।তাহলে তাকে নকল করতে হবে ।তার চেয়ে কবিতার প্রাথমিক আবির্ভাবটির অনুভবকেই অক্ষরের বদলে শুধু দৃশ্যকবিতা রূপে তুলে ধরলে অসাধারণ কাজ হতে পারে।ভিস্যুয়াল কবিতা খুব ভাল লাগে আমার। সেটা সর্বদা অক্ষরের বাইরেই থাকে।ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুললেই ভিস্যুয়াল কবিতা হয়না।দৃশ্যকে অক্ষর কবিতা করা নয়,কবিতাকে নিরক্ষর-দৃশ্য হতে হবে।আগে কবিতা তারপর দৃশ্য। ছবি বা চিত্র কবির আঙুল আর মেধা-যোগে দৃশ্যকবিতা হয়ে উঠতেই পারে।মেধাবী চিত্রকর চিত্রে ভিস্যুয়াল কবিতা উপস্থিত করতে পারেন।মেধাবী ফোটোগ্রাফাররা বিষয় ও বস্তু পেরিয়ে কবিতা দেখতে পান।

সময়ে না স্থানে কোথায় থাকতে চান ?

জল বায়ু আলোর মতই আমি কোথাও থাকতে চাইনা। অনবরত চলে যেতে চাই।

স্বপন অলোক প্রণব রঞ্জন ধীমান রতন শুভংকর কার কবিতা সবচেয়ে প্রিয় আপনার ? প্রশ্নটা ছেলেমানুষী, এবং সুদূর প্রসারী কিন্তু !

সে তো তোমরা,পাঠকরা অনুমান করবে।এরা সবাই আমার প্রিয়। আমি এদেরকে ভালবাসার তুলনা করিনা।যতক্ষণ এরা, বা যারাই নতুন কবিতা লিখছে আমি প্রত্যেককে ভালবাসি।তবে নির্মাণের ক্ষেত্রে কাঠামো আর  টেক্সচার, সাবব্জেক্ট আর অবজেক্ট-বস্তু আর বস্তু ভাবের-ক্রিয়া ও কর্মের জায়গা বদলের টেকনিকে ধীমান আমার খুব কাছাকাছি ;গঠন প্রক্রিয়া এক হলেও পরিবর্ত বিমূর্তিতে প্রচুর অমিল থাকে। ছেলেমানুষী প্রশ্ন কখনো সুদূর প্রসারী হতে পারে ? এটা কি বললে !

ধীমান চক্রবর্তী লেখা অনেক পালটে ফেলেছেন।অনেক বাক্য-অনেক নরম- জোড়শব্দহীন-প্রিয়তামুখী-এই বদল কি সদর্থক ?

প্রথম কথা হল- লেখা পাল্টানোর ব্যাপারটাই সদর্থক।আমি চাইনা কোন কবি নতুন কবিতার আবর্ত রচনা করুক। আমি চাই এগিয়ে যাক সব সময়। ধীমানের পাল্টানোটা আসলে এগোনো।এই তো চাই। সদা নতুন। আমরা কবিতা লিখি নিজের জন্য। লেখা হয়ে গেলে তা আমার থাকেনা।হয়ে যায় পাঠকের।তাকে তাড়াবার কথা ভাবিনা। পরীক্ষা করি ভাবনায়, শব্দবোধে আপোষ না করে কিভাবে তা পাঠকেরও কবিতা করে তোলা যায়।ধীমানের পজিটিভ বদলকে তুমিকি ঠাট্টা করতে চাইলে ? তাকে প্রণাম কর বরং।

কবিতার কোনো বাণিজ্য কি কাম্য আপনার কাছে ? ধরুন খবর পেলেন ধীমানদার বই হাজার হাজার কপি বিক্রী হচ্ছে-স্বপনদার ছবি লাগানো হচ্ছে দোকানে

উফ! তোমার মুখে ফুল চন্দন পড়ুক। আমি রামকৃষ্ণর স্টাইলে ধুতি খুলে নাচব। ওয়ার্কশপ চলাকালীন আমি এরকম বিক্রয়যোগ্যতা যাচাই করার পরামর্শ দিয়ে সবাইকে উৎসাহ দিতাম। বলতাম চিত্রের মত ক্যানভাসের ওপর কবিতা লিখে একজিবিশন হলে নাহলেও কলেজ স্ট্রিটে বা চৌরঙ্গীর রেলিং   এ লটকিয়ে প্রদর্শন করা হোক। বিক্রি হবেই । ওরা ব্যাপারটাকে কবিদের পক্ষে অশোভন মনে করত।  এ নিয়ে আমি একটা গদ্যও লিখেছিলাম। অনেক পরে ২০০৬ সালে সৌমিত্র সেনগুপ্ত তাঁর ড্রয়িং রুমে সেরকম ভাবে ওয়ার্কশপের কবিদের লেখা ৫টি কবিতা ক্যানভাসে ছাপিয়ে দেয়ালে টাঙিয়েছে। সেইসব কবিরা এমনকি আজ যে-ই দেখে প্রশংসা করেছে। কলকাতায় এভাবে ঘর সাজানো ভাবা যায়না।

কোনো মানুষকে কখন কবি মনে হয় আপনার ?

যখন সে কবিতার সামনে মুগ্ধ ও স্থির হয়ে যায়। চোখ মুখ থেকে দুষ্টামি মুছে যায় তাঁর। ভালবাসা জাগে।

এই মুহূর্তে কবিতায় ইন্টারনেট কতটা জরুরী?ধরুন না হলে কৌরবের কোলাবরেটিভ ইস্যুটাই হতনা

কবিতায় ইন্টারনেটের কোনো প্রয়োজন নেই।ইন্টারনেটেরও কবিতার প্রয়োজন নেই।যে কবিরা সস্তায় প্রচার চান ইন্টারনেট তাঁদের জন্য একটা প্রকৃষ্ট মাধ্যম।কিন্তু খানিকটা তরল আর খানিকটা বায়বীয় মাধ্যম।ঘটনা-আয়োজকের জন্য জরুরী অবশ্যই।আজকাল সমস্ত ব্যবসা ,অফিস,প্রেম,চিঠি, সন্ত্রাসের ছক, এমনকি এই সাক্ষাৎকারটিও ইন্টারনেটের সুযোগে হচ্ছে । কবির বেশ উপকার হচ্ছে । তাতে কবিতার কি ?

এত বড় বাড়ি।একা থাকেন।একা রাঁধেন। রাতে পুরো একা। ভয় করেনা ?

আমি সেই ছোটোবেলা থেকে একাকী। সে গল্পে যাবনা। পৃথিবীতে একা এসেছি একা চলে যাব-এই দার্শনিকতা মন্দ কি ?ছেলেবেলায় আরেকটা ব্যাপার ছিল।সবারই থাকে মনে হয়। কাউকে না কাউকে জীবনের হীরো ভেবে নিয়ে ফলো করা।হীরো পাল্টাতে বেশী সময় লাগেনা।দাদা, বাবা, মামা,খেলোয়াড়, মাস্তান, সিনেমার নায়ক , শিক্ষক এরা সাধারণত হীরো হয়ে থাকে।আমি বিবেকানন্দ স্কুলে পড়েছি ৬ বছর।সেসময় আমাদের বিবেকানন্দের জীবনী আর বই পড়ানো হত। তো বিবেকানন্দ হয়ে উঠেছিলেন আমার হীরো।তাঁর একটা কথা এখনো মনে গেঁথে আছে।‘লজ্জা ঘৃণা ভয়, তিন থাকতে নয়’। ওই তিনটেকে শত্রু মনে করেছি।একা থাকাতেই আমি ২৪ ঘন্টা কবিতা ভাবনার ভেতর থাকতে পারি।দুর্বলতাকে শক্তি আর বিপদকে সুযোগ করে তোলার ব্যবস্থা আছে আমার মনে।

কম বয়সে স্ত্রী মারা গেলেন। আর তো বিয়ে করলেন না।কিভাবে গ্রহণ করলেন স্ত্রীর মৃত্যু ? মনের কোথায় লুকিয়ে রাখলেন তাঁকে ? একাকীত্ব ,নিঃসঙ্গতা এই শব্দগুলো কিভাবে আসে আপনার কাছে ? যৌনতা ? কবিতায় যৌনতা দিয়ে একরৈখিকতাকে ব্রেক করেন। হাতের কোন রেখাকে তা ছুঁয়ে আছে ?

কি সব প্রশ্ন করছ !একাকীত্ব বিষয়ে ওপরেই জবাব দিয়েছি।স্ত্রী মৃত্যু মুহূর্তে স্পর্শত আমার সঙ্গে ছিল। গ্রহণ করব কি, সে তো ত্যাগ করা, যেভাবে আমি কবিতা ত্যাগ করি,সেভাবে। আমি নিঃসঙ্গ বোধ করিনা।ব্যস্ত থাকি সারাক্ষণ।হয় মানুষজন,নয় বইপত্র,লেখাজোকা,অনুবাদ,ঘুরে বেড়ানো, ভাল পাহার চিন্তা-ভাবনা এই সব।আর যৌনতা ? সে জন্য বৌ লাগে নাকি ? যৌনতাই তো কবিতাকে ইমপ্রেগনেট করে।সপ্রাণ করে।হাতের সুবর্ণ রেখায় লেগে আছে তা।

  দিনের মধ্যে কোন সময়টা সবচেয়ে প্রিয় ?

ভোর।আমি ভোর হতে দেখি, একটু একটু করে তা কেমন করে তা।প্রায় সাড়ে চারটায় এক কাপ কফি নিয়ে দোতলার ওপেন টেরাসে সূর্যের দিকে পিছন ফিরে বসে আকাশ দেখি,পাখি দেখি,মেঘ দেখি,শিশির দেখি,ফুল দেখি, পথিক দেখি- এর মধ্যে পাখিদের দেখতে আমার খুব ভাল লাগে।কত রকমের পাখি, উড়ে কোথায় যে ফের বসবে নিজেই জানেনা।কত কথা বলছে ! দারুণ লাগে আমার।

প্রিয় বন্ধু কমল  মনের এত মিল কবিতার এত অমিল কেন ? সমপ্রজন্মের অবশ্যম্ভাবী মিলগুলোও নেই

ভাগ্যিস কবিতায় কোনো মিল নেই!মিল থাকলে প্রতিযোগিতা হত,ঈর্ষা হত,ঝগড়া লাগত।আমরা দুই মেরুতে অবস্থান করি, তাই এত সমতুল, এত আকর্ষণ।মিল কি একেবারেই নেই ? ভালবাসায় আছে,জীবনযাপনে আছে,কর্মে আছে, সংগঠনে আছে,পারস্পরিক নির্ভরতায় আছে।এইসব কি যথেষ্ট নয় ? যাঁরা কাউকে অনুকরণ করেন না,সমপ্রজন্ম হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের কবিতায় কোন মিল অবশ্যম্ভাবী নয়।

জীবনের সবচেয়ে প্রিয় শব্দটি কি কৌরব ?

ইয়েস,কৌরব আমার কাছে জীবনযাপন পদ্ধতি।আমরা কৌরব নামে চিহ্নিত হতে চেয়েছিলাম।লোকে আমাদের দেখে বলে-ওই যে কৌরবরা এসে গেছে।গর্বে বুক ফুলে ওঠে।আর কোন কাগজ ঘিরে এই রোমান্টিকতা আছে কিনা জানা নেই।তুমি জানো ?

পুরোনো কৌরবের সঙ্গে নতুন কৌরবের মিল-অমিলগুলো কি দেখছেন ?

কোন মিল দেখিনা টেক্সট কোয়ালিটি ছাড়া।বাকি সবটাই অমিল।আমাদের স্টেক ছিল-কৌরব বাঁচলে নিজেরা বাঁচি লেখক হিসেবে-তাই কৌরবকে জীবন্ত রাখতে হবে, একটা লিভিং ম্যাগাজিন করে তুলতে হবে, এমন আকর্ষনীয় করে তুলতে হবে যাতে ছোট বড় সব লেখকের হাত নিশপিশ করে কৌরবে লেখার জন্য।হাতে পেলে স্ট্যাচু হয়ে পাতা ওলটাতে বাধ্য হবে পাঠক।

কেমন দেখছেন আমাদের শূন্য দশককে ?

শূন্য দশক বেশ চলছে।প্রায় শেষমুখে।অনেক তরুণ কবি নতুন কবিতা লিখছে।নতুন কবিতার বন্যা লেগেছে যেন।এটা খুব উৎসাহের।বন্যা চলে গেলে উর্বর করে যাবে কবিতার ভূমি ।আমরা আবার বড় কবি দেখতে পাব।আমি ভীষণ উৎসাহে লক্ষ্য করে চলেছি। অনেকেই আমার খুব প্রিয় এর মধ্যেই।

অনেকের কাছেই আপনি বিগ্রহ। আইকন। কিন্তু আপনার কবিতার স্পিরিটের সঙ্গে এই শব্দগুলো যায়না।আপনি বন্ধু- সকলের বন্ধু- বিশ্ববন্ধু হলেই যেন মানায়। সে ক্ষেত্রে কেমন করে বাঁচিয়ে রাখেন নিজের আয়রনি গুলোকে ?

এ তো বড় অদ্ভুত কথা।আমি নিজের বিগ্রহ দেখতে পাইনা বলে ওরকম কোনো গ্রহের ফের টের পাইনা।যে মানুষটা জলজ্যান্ত ,চিন্তা ভাবনা করে, কথায় কথায় হেসে ফেলে,জড়িয়ে ধরে সবাইকে,তাকে বিগ্রহ বলছ কেন ? আমি নিজে ভালবাসি স্পিরিট পান করতে।তা থেকেই কিছুটা স্পিরিট ঢেলে দিই কবিতায়, সে তো ওই শব্দগুলোকে ভিজিয়ে দেবে । এইতো ঠিক বলেছ, বিশ্ববন্ধু। আয়রনের দেশের মানুষ তো,তাই গায়ে হয়তো আয়রনি লেগে থাকে।বাঁচাবো কি, মারবো কি , আমি নিজেই তা বুঝিনা।এটাই আমার আয়রনি।

জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন কোনটা ?

জানিনা। আমার তো রোজই আনন্দ। তবে সবচেয়ে বেশী আনন্দ বোধহয় পাব কেউ আমাকে মদের নদীতে ঠেলে ফেলে দিক আর আমি হাবুডুবু খাই। বেড়ে মজায় আছি হে !

বাংলা কবিতার সবচেয়ে বাজে দিক কোনটা ?

এরকম খোলা প্রশ্নের কোন জবাব দেয়া যায়না।তবে বলতে পারি, বাণিজ্যিক পত্রিকায় ঠাঁই পাবার জন্য কবিদের রেষারেষি এবং সেই সব পত্রিকার ব্যবসার স্বার্থে পাঠকের রুচি ও চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করার চাহিদা বাংলা কবিতার সবচেয়ে বাজে দিক।আবৃত্তিকেও শত্রু বলতে পার।কবি শিল্পীরা লিখে কিছু পান না,অথচ বাচিক শিল্পীরা কবিতা আবৃত্তি করে ভাল রোজগার করে থাকে।এরকম দৃষ্টান্ত পৃথিবীর আর কোথাও নেই।বাচিক শিল্পীরা কবিতার শত্রু।তাঁদের উচিত আবৃত্তি করার আগে কবি কে অর্ধ- প্রাপ্তি দিয়ে দেয়া।কবিতার পেটেন্ট হওয়া উচিত শুধু কপি রাইট লিখে দিলে চলছেনা।

কবিতা ক্যাম্পাসে আপনার ভুমিকা টা ঠিক কি ছিল ? ক্যাপ্টেন কি বলা যেতে পারত আপনাকে ওঁদের মধ্যে ? যখন গৃহযুদ্ধে ক্যাম্পাস ভেঙ্গে গেল খুব কষ্ট হয়নি ? কোন ভাবে আটকাতে পারতেননা আপনি ? চেষ্টা করেছিলেন ?

কবিতা ক্যাম্পাসে আমার ভূমিকা ছিল অনু ঘটকের।ওপরেই কোথাও বলেছি।সেখানে কেউ ক্যাপ্টেন ছিলনা। সবাই ছিলাম পারিবারিক বন্ধু।আমার কৌরবের কবিতা ক্যাম্পের অভিজ্ঞতা ওদের কাজে লেগেছিল। কোনো গৃহযুদ্ধ হয়নি কবিতা ক্যাম্পাসে কখনো।মনোমালিন্য নয়,মতের অমিল হয়ে ছিল।কলকাতায় বড়কবি কবেই বলেছিলেন -এক দশকে সংঘ ভেঙ্গে যায়।কলকাতার হাওয়ায় অসূয়া,দূষণ । বলতো কালীবাড়ি একটা শহরে একটা থেকে বিশটা হয় কেন ? কম্যুনিস্ট পার্টি কেন দশ টুকরো হয়? প্রতিজন কবির একটা করে পত্রিকা কেন ? কৌরব কলকাতার হলে এতদিনে শতপুত্রের নামে নামে ছড়িয়ে যেত।আমরা বন্ধ করার পর আর্যনীলরা কন্টিনিউ করতে চেয়েছে মাত্র।আর কবিতা ক্যাম্পাস ভেঙ্গে যাবার দুঃখ কি ?সৃষ্টিশীলরা ঠিকই কাজ করে যাচ্ছে। নিজের ভারে যখন কিছু ভাঙ্গে তখন সেটার নিজস্ব যুক্তি থাকে।যেমন নদী সব। আমি চেষ্টা করেছিলাম থামাবার।অন্তত মতের অমিল ঘোচাবার। কিন্তু ওই নদীর কথা মনে কর।

কিছু লোক অবশ্য রটিয়েছে বারীন ঘোষাল কবিতা ক্যাম্পাস ভেঙ্গের দিয়েছে।পৃথিবীতে নিন্দুকের অভাব নেই।তারা বলেও , আর শুনলে বিশ্বাসও করে।দ্যাখো, আমি যদি ভেঙ্গে দিতাম, তবে ওদের সবার সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক থাকত কি ? কষ্ট কিয়ামি একা পেয়েছিলাম ? সবাই দুঃখ পেয়েছিল ভুলতে সময় লেগেছিল সবার।

নব্বই দশক নিয়ে কিছু বলুন ওরা একজোট হতে চাইছে

কি বলবো ? সত্তর দশকের অন্যতম শ্রেষ্ঠকবি জয় গোস্বামী। কবিতা রচনায় সিদ্ধহস্ত ,অসাধারণ কবিতা লিখেছেন সত্তরে আশিতে, আমরা গর্ব করে বলতাম- জয় হোক।শুনেছি তিনি খুব ভদ্র। এবং বন্ধু বৎসল, একজন প্রেমিক কবি। জয় অল্পবয়েসেই লিজেন্ড হয়ে ছিলেন, খ্যাতির শিখরে উঠেছিলেন। তিনি ৯০ এ হ্যামেলিনের (ন’দের)বাঁশীওয়ালা সেজে (ষাটের মাঝে প্রেমেন্দ্র মিত্রর মত ) কলকাতায় বাঁশী বাজিয়ে বাংলার প্রতিশ্রুতিবান তরুণ কবিদের বড় বাড়ির ছায়ায় টেনে নিয়ে গেলেন। জয়ের অসাধারণ হাত আর চোখ ছিল কবিতা রচনায়। ডাক পেয়ে তরুণরা দল বেঁধে ছন্দ অভ্যাস করতে করতে পিছিয়ে গেল রবীন্দ্রনাথের যুগে। জয় এটা দেখেও দেখলেননা। ৯০ দশক ধূ ধূ করছিল তারপর।কয়েকজন মাত্র অবশিষ্ট কবি স্বচেষ্টায় এগিয়ে গেল।তাঁদের অনমনীয় দৃঢ়তাকে আমি স্যালুট করি। এখন তাঁরাই আমার চোখের সামনে রয়েছে।হ্যামেলিনের মানুষটি অধুনা অবসৃত হতে হয়তো ৯০ এ ঐ বাঁশীর ডাকে যারা কর্ণপাত করেনি তাঁরা এতদিনে পরিণত হয়ে একত্র হচ্ছে দেখতে পাচ্ছি। এটা শুভ লক্ষণ। তাঁরা  Journey 90s নামে একটা ওয়েবজিনও করেছে।ছাপা কাগজও হবে শুনতে পাচ্ছি।

নব্বই এর মধ্যে কবিতে ক্যাম্পাসের ভাবনার খুব সামান্য ছোঁয়া দেখিকিন্তু এরা কৌরব-ক্যাম্পাসে নিয়মিত লিখেছেদীর্ঘসময়ধরুন সুবীর সরকার ,রুদ্র পতি , মানস কুমার চিনি আলাদা করে নাম রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়বেদের লেখায় আপনার উপস্থিতি নেই কিন্তু এরা আবার সেই অর্থে মূলধারার কবিও তো নয়এদের লেখালেখির যে স্বতন্ত্র একটা ধারা ,তাকে আপনি অপর /নতুন কবিতার কোথায় রাখতে চাইবেন ?

কোনো আন্দোলনই সবার ওপর প্রভাব ফেলেনা। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, এমন কি ষাটের হাং গ্রি আন্দোলন ও এই কথা প্রমাণ করেছে। নব্বই এর নতুন কবিতা তরূণ কবিরা তৎক্ষণাৎ গ্রহণ না করলেও কবিতা ক্যাম্পাসে সঙ্গ দিয়েছে। সঙ্গগুণ মানুষকে জারিত করে। ক্রমশঃ নতুন কবিতার চর্চা বেড়েছে ছড়িয়েছে। আর কৌরবে সব দশকেই তরুণ কবিদের বিশেষ জায়গা ছিল। নতুন কবিতা সবার মেধায় কুলোয়না। তুমি যাদের নাম করলে তারা ভালবাসত কোউ রবের সঙ্গে মিশতে। রাজর্ষি এদের মধ্যে বিশেষভাবে নতুন কবিতার মেজাজটা প্রয়োজনে এবং আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করতে পেরেছে। সুবীর রুদ্র মানস মূল ধারার কবি। মূলধারা একটা ধারামাত্র নয়।  তা অনেক ধারার সংমিশ্রণ। তাতে কেউ যে কারো মত ণয় – এটাও হতে পারে।মনীন্দ্র গুপ্ত, উৎপল কুমার বসু, অলোক রঞ্জন দাশগুপ্ত এরা প্রত্যেকে আলাদা রকম লেখেন, কিন্তু তিনজনই মূল ধারার । আমার এরকম মনে হয়।

এখন লিরিক নিয়ে কি ভাবেন ? কোনো বদল নিজের চিন্তা ভাবনায় ?

লিরিক বিদেশী শব্দ। বাংলায় গীতলতা বলতে পার।বাংলাভাষা আর শব্দের অন্তর্লীন তাল লয় ছন্দ স্পন্দন স্পষ্ট হয় উচ্চারণে।এসব টের পায় ক’জন ? রবিন্দ্রনাথ অজস্র লিরিক লিখেছেন। বাংলার পথে ঘাটে গ্রামে মাঠে চিরকাল গায়করা লিরিক গেয়ে গেছেন।সব দেশেই এক। এখন মনে হৃদয়ে যদি গীতলতা না থাকেতাহলে কৃত্রিম ছন্দ দিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে লিরিক লেখা যায়। তাই হচ্ছে। অপ্রকৃত লিরিক বাংলা কবিতাকে ধ্বংস করছে। বাংলা অক্ষরের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি খুব দৃঢ় ও উন্নত মানের।ভাষার ভেতরে থেকে কবিতা লিখলে রঞ্জন মৈত্রের মত ভাষাগুণ মেখে লেখা সম্ভব যাকে প্রকৃত লিরিক বলতে পার। ধ্বনি তরঙ্গ টের পেয়ে সঠিক ব্যবহার করতে পারলে স্বপন রায়ের মত কবিতার সাঙ্গীতিক গুণ আনা যায়।ক’জন পারে ! বদল কেন চাইব , এখনো তো  পুরোটার সদ্ব্যবহার করাই হলনা। আগে সম্পৃক্ত হোক।

  আন্তর্জাতিক কবিতার ক্ষেত্রে বাংলা কবিতার স্থান এখন কোথায় বলে মনে করেন ? কবিতা নিয়ে আর্যনীল মুখোপাধ্যায় এর কাজকর্মে কি আপনি সন্তুষ্ট ?

আমার মনে হয় বাংলা কবিতা  আন্তর্জাতিকতার মানের সামনের সারিতে উঠে এসেছে এতদিনে। এর প্রতি-তুলনা করা যায় কোনো সাধারণ ভাষায় কবিতা অনুবাদ করে পড়লে । সারা পৃথিবীর মধ্যে যদি ইংরেজী ভাষাকে সাধারণ ভাষা জ্ঞানে বিভিন্ন ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনূদিত কবিতা  একসাথে বিচার করা হয়, তাহলেই এটা  বোঝা যাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বাংলা কবিতা অনুবাদ করার চল নেই আজও । এতদিন বিদেশী কবিতা বা সাহিত্য আন্দোলনের প্রভাব সমকালীনতা হারানোর পরে বাংলায় দেখা যেত। আজ এই প্রথমবার নতুন কবিতা নির্মাণের ভাবনা আর প্রয়োগ কোনো বিদেশী প্রভাব ছাড়াই বাংলায় সম্ভব হয়েছে।

আর্যনীলের কাজে আমি যার পর নাই সন্তুষ্ট। সে পরিশ্রমী,বুদ্ধিমান, আয়োজক, অনুবাদক,পত্রিকার সম্পাদক, কবি, বড় চাকুরিরত, নিজস্ব পরিবারের কর্ণধার…একাধারে সে একজন প্রকৃষ্ট কৌরব। বিদেশে একটা দ্বিপের মধ্যে একা একজন ক্রমে বহু হয়ে উঠছে।পৃথিবীর মধ্যে সর্বপ্রথম বাংলা কবিতার ওয়েবজিন সে-ই করেছে। কৌরব প্রিন্ট পত্রিকাকে আন্তর্জাতিকতার চেহারা দিয়েছে।পৃথিবী বিখ্যাত কবিদের নিয়ে দ্বিভাষিক ইস্যু করেছে।বিদেশী কবিদের কলকাতায় এনে বাঙালী কবিদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ করে দিয়েছে। বাংলায় প্রথম কোলাবোরেটিভ ওয়ার্কশপ করেছে। এবং আন্তর্জালের সাহায্যে সারা বিশ্বের ও বাংলার কবিদের নিয়ে কোউরবের কোলাবোরেটিভ ইসযু বার করেছে। বিদেশী কবিদের ওপর প্রচুর প্রবন্ধ লিখে চলেছে। বাংলা কবিতার অনেক ইংরেজী অনুবাদ ও ইন্টারভিউ বিদেশী কবিদের পাশাপাশি কৌরব-অন-লাইনের আর্কাইভে রেখেছে। এমনকি জীবনানন্দ দাশের কবিতা ইংরেজীতে অনুবাদ করে বিশ্ব ইংরেজী সংকলনে স্থান পাবার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।অতীতে অনেক মেজর কবি বিদেশে টানা বা নানা সময়ে বসবাস করেছেন।তাঁরা কেবল নিজের ইনপুট আর আউটপুট নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন।বাংলা কবিতা এবং কবি নিয়ে বিদেশে কিছুই করেননি। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু, অরুণ মিত্র, পুষ্কর দাশগুপ্ত, আলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত,উৎপল কুমার বসু, কেতকী কুশারী ডাইসন প্রভৃতি। আর্যনীল তা করে চলেছে।দূরে থেকেও পত্রিকা পরিচালনা টীমের ক্যাপটেন হয়েছে আর্যনীল। ওর জন্য আমার গর্ব হয় এজন্য যে,তাঁর কম বয়েসের শিক্ষা হয়েছিল কৌরবে,দি মিথিক্যাল পি চোদ্দর টেবিলে।হয়তো অনেক সময় আমরা একমত হতে পারিনা।আমাদের কবিতা বিচারও আলাদা হয়ে যায়। কিন্তু আমি মানি- বরং দ্বিমত হও,তবু রও সাথে।

নিচের নামগুলো নিয়ে আপনার কাছ থেকে একটা করে বাক্য চাই। আপনি চাইলে বেশি বলতেই পারেন।

ক। রবীন্দ্রনাথ– বাঙালির জীবনে মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ আর্বিভাব।

খ।সুকুমার রায়- হাস্যমুখর বাংলা প্রতিকবিতা রচনায় প্রথম বাকবদল করেছিলেন।

গ। সত্যজিৎ রায়- সর্বশিল্পের সমাহার সিনেমার ভাষাটি চিনিয়েছিলেন বাঙালিদের।

ঘ। ঋত্বিক ঘটক- দেশভাগের অকল্যাণে দুর্ভাগা মানুষের কষ্টের জন্য অবসেশনের প্যাশন থেকে বেরোতে পারেন নি তিনি। একজন খাঁটি কবি।

ঙ। অমিতাভ বচ্চন- ভারতীয় সিনেমায় আজ পর্যন্ত আসা সবচেয়ে বড় অভিনেতা।

চ। উত্তমকুমার- একজন নায়কের মতো নায়ক।

ছ। সমিত্র চট্টোপাধ্যায়- আসামান্য অভিনেতা।

জ। দিল্লী- দিল্লী কা লাড্ডু একবার যে খেয়েছে সে-ই পসতেছে।

ঝ। শ্যামলকান্তি দাশ- এমন একজন কবিবন্ধু যে আমাকে খারাপ পাঠক ভেবে কখনো তার একটাও কবিতার বই দেয়নি।

ঞ। কফি হাউস- টেবিলে টেবিলে লেখা গুজে দেবার ঠাই যেখানে কারো কথা না শুনলেও চলে।

ট। গিনসবার্গ- একজন আমেরিকান বিট কবি যিনি জনপ্রিয়তার জন্য গিমিক হিসেবে স্টেজে নিজ শরীরের উলঙ্গ প্রদর্শন করার সাহস দেখিয়েছিলেন।

ঠ। মলয় রায় চৌধুরী- একজন বিহারীবাবু যিনি বাংলা হাংগ্রি কবিতা আন্দোলনের জন্ম দিতে কলকাতায় এসে প্রথম কবি হিসেবে কোমরে পুলিশের দড়ি পরে বিখ্যাত হয়ে ছিলেন।

ড। কাফকা- যার গদ্যশৈলী বিংশ শতাব্দীকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছিল।

ঢ। রামনিধি গুপ্ত- আর একজন অবাঙালি গায়ক যিনি বাংলার নিধুবাবু সেজে মাথায় মাথায় টপ্পার ফুল খিলিয়েছিলেন।

ণ। রামপ্রসাদ সেন- অষ্টাদশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি।

ত। স্বদেশ সেন- বিংশ শতাব্দীতে আমার জানা অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাংলা কবিতার রচয়িতা যিনি নতুন কবিতার পথে হাঁটার সাহস দিয়েছিলেন।

থ। মেটাফিজিক্যাল কবিতা- আশির দশকে জহর সেন মজুমদার বাংলায় মেটাফিজিক্যাল কবিতা লিখে বাংলা কবিতাকে বিশ্বমানের সাথে তুলনীয় করেছে।

দ। বুদ্ধদেব বসু- একজন কবিতা পন্ডিত ছিলেন যিনি তরুণ কবিদের পছন্দ করলেও পরিণত কবিদের দেখতে পারতেন না।

ধ। কার্ল মার্কস- উনবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত একজন দার্শনিক যাঁর অর্থনৈতিক শোষণ ও উদ্বৃত্তের তত্ত্ব জনজীবনে প্রয়োগ করা নিয়ে বিংশ শতাব্দীতে বিপ্লবে অর্ধেক পৃথিবী টালমাটাল হয়েছিল।

ন। মমতা ব্যানার্জি- একজন লড়াকু মহিলা যিনি ভালো মন্দ বিচারের ঊর্ধে আপোশহীন অনমনীয় বিরোধীতার জন্য ইতিহাসে স্থান পাবেন।

প। প্রভাত চৌধুরী- পরিশ্রমী কবিতা ব্যবসায়ি একজন বাঙালি কবি যিনি অসাধারণ অর্গানাইজার এবং নিজে সন্মানিত হবার তোয়াক্কা না করে সন্মান বিলিয়ে দেন মাঠে ঘাটে।

ফ। চৈতন্য চরিতামৃত-এই বইয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী নাকি আমার লেখা ‘অতিচেতনার কথা’ বদ লোকে বলে থাকে।

ব। ঠাকুমার ঝুলি- যে ভাষায় ঠাকুমার ঝুলি নেই সেখানে কিশোরেরা স্বপ্ন দেখতে শেখে না।

ভ। অর্মত্য সেন- ইনি নোবেল পেয়েছেন, তবে সেটা আমাদের কোন কাজে লাগবে সেটাই বুঝি না।

ম। বার্ণস্টাইন- ইংরিজি পোস্টমডার্ণ কবিতার জোয়ারে না ভেসে ভাষা-কবিতা দিয়ে বাকবদল এনেছিলেন।

য। মিশেল ফুকো- ক্ষমতার তত্ত্ব এবং অনুশাসিত সমাজের ব্যবহার বিষয়ে তার সমালোচনা মূলক বিতর্ক বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।

র। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়- একজন আপাদমস্তক ভদ্রলোক কবি যিনি তরুণদের ভালোবাসেন বলেই সত্তর দশকের প্রারম্ভে কলকাতায় তখন অপরিচিত কৌরবকে ব্রেক দিয়েছিলেন।

ল। জয় গোস্বামী- সত্তর দশকের সবচেয়ে বিখ্যাত কবি যার ছন্দের হাত বাঁধিয়ে রাখা উচিত।

ব। জাঁ পল সার্ত্র- মূল্যহীন পার্থিব জীবনে নিজের অস্তিত্বকে মূল্যবান করে তুলতে শিখিয়েছিলেন।

শ। হ্যামলেট- আমি ওমলেট থেকে বেরোতে পারি না। আর কতদিন। আরো কতদিন!!

ষ। জন অ্যাশবেরি- কম বয়সে ওনার কবিতা পড়ে মুগ্ধ হবার সময় জানার প্রয়োজন হয় নি যে উনি আসলে পোস্টমডার্ণ কবিতা লিখেছিলেন।

স। অলোক বিশ্বাস- আমার আনুজ কবি যে ভালোবাসার কাঙাল এবং দাতা একধারে। অলোক কবিতা ক্যাম্পাসের ওয়ার্কশপে খুব প্রাণবন্ত থাকতো। সে কবিতা ক্যাম্পাস পত্রিকাকে আজও টেনে নিয়ে চলেছে।

হ। এ আর রহমান- আজ পর্যন্ত হিন্দী সিনেমার সর্বশ্রেষ্ঠ সুরকার।

। হাওয়া ৪৯-  ‘উনপঞ্চাশ পবন’, সমীরদার এই পত্রিকাটির নাম পত্রিকার জন্মের আগে সমীরদারই অনুরোধে রাখে কমল চক্রবর্তী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্টঅফিসে দাঁড়িয়ে ১৯৯২ সালে। সেখানে উপস্থিত ছিলাম সমীরদার সঙ্গে আমি, কমল আর কৃষ্ণগোপাল মল্লিক। ১ম ইস্যুটা কৃষ্ণদার তত্বাবধানে ছাপা হয়েছিল।

ং। কোলাবোরেটিভ কবিতা- মেধা ও মননের টিউনিং করে দুই বা ততোধিক কবিদের মিলিত ফিলহার্মনিকের মতো অর্কেস্ট্রেটেড কবিতাকে কোলাবরেটিভ কবিতা বলে। এই কবিতা কখনো স্বতোসারিত হতে পারে না।

অ। বিপজ্জনক ব্রহ্মবালিকা বিদ্যালয়- বিজয় দে’র ‘বম্বে টকি’র মতোই জসেম- এর এই বইটাও টোটাল কবি তার বই। খুব প্রশংসা করে আমার ভালো লাগার দীর্ঘ কথা জানিয়েছিলাম জসেম–কে। কিন্তু তার ভালোবাসা নেই।একটাও চিঠি লেখে নি আমাকে। জসেম খুব বাজে লোক।

আ। উৎপল কুমার বসু- আমার মাথায় থাকুন তিনি, পুরস্কার পাবার কায়দা জানেন না বলেই। পিটুনি খাবার ভয়ে ‘আনন্দ’ নিয়েছেন, শুনেছি।

ই। শক্তি চট্টোপাধ্যায়- শক্তিদার মতো আমিও গল্প ছেড়ে কবিতায় নেমে বাংলু ধরে ফেললাম। কিছুদিনেই কে যেন বলে উঠলো চাঁদে আর পোঁদে- শুনেই ঠিক করলাম, জীবনে শক্তিদার মতো কবিতা লিখবো না, হায়।

ঈ। মুখার্জি কুসুম- কৌরবের কবিতার ক্যাম্প আর পরীক্ষা সাহিত্য সিরিজের শেষ এই বইটাই অসাধারণত্ব এই যে অ্যান্টীপোয়েমস শুনে অ্যান্টরাও কুসুম গুলো খেয়ে হায় হায় পড়ে যেতে আবার দ্বিতীয় সংস্করণ বার করতে হয়েছিল পাঠকের চাহিদার খাতিরে।

উ। মৃদুল দাশগুপ্ত- বলেই নিই, সত্তর দশকের প্রসিদ্ধ হয়েছিলেন চারজন কবি- রণজিৎ দাশ, কমল চক্রবর্তী, জয় গোস্বামী এবং মৃদুল দাশগুপ্ত।ওর মতো ভালো কবিতা আমি লিখতে পারিনি কোন দিন।

  পোস্টমডার্ণ পোস্টকলোনিয়াল- কলকাতার মধ্যবিত্ত শ্রেনীর বাইরে এই শব্দগুলো কোথাও আছে কি আদৌ?

আর একটা শব্দ যোগ করো। ছোটবেলায় আমাদের পেন্টুলের সামনের বোতাম বা জিপ লাগাতে ভুলে গেলে অন্যরা বলে উঠত- এই তোর পোস্টাপিস দেখা যাচ্ছেরে- হিহি হিহি! এই শব্দগুলো শুনে এখনো আমার হাসি পায়। না হলে পন্ডিতেরা কি করে খাবে?

  যে কবিতা ভাষাকেই পেরিয়ে যেতে চায়, মানে সর্বস্বতাকে  ধ্বংস করতে চায়- তাকে আমরা ভাষাকবিতা কেন বলব? অন্য কোনো কয়েনজ কি জরুরি নয়?

ভুল বললে। কবিতা কিছু পেরোয় না, কবিতা কিছু করে না। মাথা থেকে কবিতা বেরোয় বলে কবিতার মাথা আছে, তার চাওয়া পাওয়া আছে ভাববে কেন? ভাষা পেরিয়ে যাওয়া যায় না। পরিচিত ভাষার গন্ডীর ওপরে অপরিচিত ভষাবলয় থাকে যার ডিমিনিশি এফেক্ট আমরা টের পাই না। ব্যাপারটা অতিচেতনার মত খানিকটা। তফাৎ হল যে, অতি চেতনার দূর বলয় গুলো আবিষ্কার হলে আলোকিত হয়ে চেনা মনে হয় সেই অজানা ভাবনার জগৎ।শব্দের কোন মানেই নেই তো তুমি সেটা ধ্বংসের কথা তুলছো কি করে? কবিতার ও কোন মানে হয় না। তুমি তো একজন স্কুলের না কলেজের শিক্ষক, তাই না? বলবেই তো!

‘ভাষা কবিতা”- এই শব্দ জোড় পছন্দ না হলে তুমি এর নতূন নাম রেখে চার্লস বার্নস্টাইন বা ক্রিস স্ট্রফোলিনোদের পাঠিয়ে দাও বা নেট- এ প্রস্তাব রেখে পেটেন্ট করে ফ্যালো। অন্যের বাড়া ভাতে ছাই দেয়া পছন্দ করি না। নিজের কাজটূকু করে যাও। তাহলেই পৃথিবী ধন্য হবে।

Wordsworth বলেছেন কবিতা হচ্ছে “Emotions recollected in tranquility” … আপনার কবিতা লেখার প্রসেসটা একটু বলবেন?

দেখেছো? বারে বারে সেই অধ্যাপকটা তোমার ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে। তুমি টেরই পাওনা , না? আমি বিশ্বাস করি না ওয়ার্ডসওয়ার্থ- আবেগ-শান্ত শিষ্ট আবেগ… এর সঙ্গে কবিতার, আজকের কবিতার কোন সম্পর্ক আছে। তিনি বিশ্বযুদ্ধ দেখে থাকলে এই কথা বলতেন না।

আমার কবিতা লেখার প্রসেস নিয়ে বলছি। এক বছর পিছিয়ে যাচ্ছি। আমেরিকার পত্রিকার জন্য আর্যনীল মুখোপাধ্যায় এবং একটা টিম আমার ইন্টারভিউ নিয়েছিল, যা KAURAB-ONLINE- এর আর্কাইভে আছে, সেটা থেকে একটা অংশ তুলে দিচ্ছি ইংরাজিতে।

…as long as the universe with its system and elements exists naturally, and one recognizes human system only as its image, one may be ready to receive poetical spark in his mind. SPARK- I break it up as spontaneous power Activated Resonation Kinetics, to make it easier to understand.

Poems in the world as signals are always occurring and dissolving to be perceived by a sensitive exchange observer/ thinker/ reader/. First, it takes to feeling, then an abstract matching experience from one’s mental log storage gets dislodged and surfaced like a spark or flash of light. All these happen in those magic moments when one’s mental capacitance is just become conductive to receive the spark. This is what we call germination. You see, once a single poem through a spark germinates one’s mind, the poetry building process gets on. A poem has occurred in the mind. All poets are in that. They usually get secondary or a tertiary poem triggered while reading or listing to another poet. But the release of a primary poem waits for trigger by a self-motivating word, the poet being under pressure. It usually happens in good time to an honest poet in the mainstream like Wordsworth.

To avoid this delay or change cooking I needed to expand my consciousness by breaking barriers and stepping out into the unknown darkness. One doesn’t have to write a single poem 1000 times over with various combination and permutation of a word. A whole poem can never be brought out since there is nothing called a complete poem. A poet is not copying or retracing anything. Even if it may seem invisible at times. He is creating/ building/ sculpting a poem that matches the mood and exploration techniques his process has called for. I have to mouth to comment on what other people from the Old Poetry domain have said. I have self-exiled myself.

Poetry must be living. Only then a distant reader can communicate with it. In it I should expect to get a completely new syntax with word assembly from sub-alter to marginal to classical, even newly created, meters and cantos missing or mixed at random without a traditional beginning or end. Both ways open-ended so to say, and all provisions of total meaning burnt.

A poet can never bring forward a total poem out of ever-undergoing process of poetry. A reader can never wait to finish reading/ listing to a complete poem-to-be. That is the fate of e good poem. There is no start and no end. And it is comminutes a new secondary poem in a different mind. A conscious poet rows the sparking seed in the poem since he knows that the whole body of poem is like the body of human where there are both important and unimportant parts by default…

আমার কবিতা গড়ার প্রসেসটা অনেকটা এই রকম। কিছু বোঝা গেল কি?

১০০ শতাংশ বাঙালি কবি কাদের মনে করেন বিংশ শতকের কবিতায়?

যাদের মাতৃভাষা বাংলা এবং বাংলা ভাষায় কবিতা লিখছেন তারা সবাই বাঙালি কবি। কবির ১ শতাংশ আর ৯৯ শতাংশ হয় না। বাঙালি কবির আর কোন ব্যাখ্যা আমি জানি না।

কবিতার কোনো বর্হিবঙ্গ হয়? হতে কি পারে?

কবিতার কোন বহির্বঙ্গ হয় না, হতে পারে না। বর্হিবঙ্গ বলতে আমারা যা বুঝি তাতে কোন আবেগ নেই। দিল্লীর অরুণ চক্রবর্তী বহির্বঙ্গ সোসাইটি নামে একটা প্রতিষ্ঠান এবং ট্রাষ্টিবোর্ড গ’ড়ে বছরে একটা উৎসব আনুষ্ঠান করে থাকেন কলকাতার সাংস্কৃতিক সমাজের কাছে নিজের আলোকিত ইমেজ তুলে ধরার জন্য। আমার সঙ্গে অনেক তর্কের পর যাখন তিনি আমার কথা মতো কবিতার উৎসবে মন দিলেন, আমি কয়েক বছর ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কবিদের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলাম কারণ অরুণ কবিদের চিনতেন না। সেখানে একবার জামশেদপুরের অলকরঞ্জন বসু চৌধুরিকে ডেকেও অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহন করতে দেওয়া হল না, কারণ অলক আনন্দ বাজার পত্রিকাকে কটু কথা বলা একটা ছোট গদ্য পড়তে চেয়েছিল। পরের বছর গেস্টহাউসে রাতের বেলায় ঝামেলা করার মিথ্যা অপবাদে মধ্যপ্রদেশের দুর্বাসা পত্রিকার সম্পাদক কবি বিশ্বজিৎ বাগচীকে অনুষ্ঠান সভা থেকে বার করে দেওয়া হয়। অরুণের এই রকম হাই- হ্যান্ডেড ব্যবহারে আমি সর্বসমক্ষে ঘোষণা করে সেদিনই বর্হিবঙ্গ অনুষ্ঠান বয়কট করি। অরুণ এরপর হলদিয়া বিশ্বকবিতা অনুষ্ঠানে শ্যামলকান্তি দাশের অনুরোধে বহির্বঙ্গের কবিদের নিয়ে একটা প্রোগ্রাম পরিচালনা করেন যেখানে শ্যামলের কথায় আমি শান্ত হয়ে অংশ গ্রহণ করি। প্রোগ্রামটি ব্যর্থ পরিচালনার দোষে মাঝ পথে ভন্ডুল হয়ে যায়। পরের মাসেই অরুণ নেট-এ বহির্বঙ্গ সাইটে bahirbanga betrays bahirbanga শীর্ষক একটা আর্টিকেল লিখে সবার এবং আমার নামে মিথ্যা কথার ফুলঝুড়ি ফোটায়। বহির্বঙ্গ তো কবিতা নয়, ওটা অন্য কিছু হলেও হতে পারে।

তবে প্রবাসী, অধুনা অভিবাসী বাঙালি কবিদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই ডায়াস্পোরিক বাংলার ব্যবহার দেখা যায়। একটু সতর্ক থাকলে তার ধ্বনিগুণ অদ্ভুত শোনাবে। মনযোগ দিয়ে শুনে দেখো।

যদি জামশেদপুরের বদলে কলকাতায় থাকতেন, তবে কিছু কি অন্যরকম হত? পশ্চিমবঙ্গের যে কোন জায়গায় যদি জন্মাতেন?

তাহলে কৌরব করা হতো না। অসূয়া, দূষণ আমাকে কবিতা কৌশলের বদলে কবি হওয়ার কৌশল শিখিয়ে একজন আত্মঘাতী বাঙালি তৈরি করতো। নির্ঘাৎ মওকা মতো সুনীল- দুঃশীল রোড টেনিস খেলতাম।

বাংলায় সবচেয়ে আন্ডাররেটেড কবি কে? সবচেয়ে ওভাররেটেড?একটা মজার প্রশ্ন করলাম আর কি!

এ কি এককথায় বলা যায়। তবু বলি। বাংলায় সব চেয়ে আন্ডার রেটেড কবি শম্ভু রক্ষিত। তার দারুণ একটা পত্রিকা থাকা সত্ত্বেও কলকাতার কেতা শিখলো না। আর সবচেয়ে ওভাররেটেড কবি হলেন বিনয় মজুমদার। আজ বিনয় মজুমদারের প্রথম প্রকাশক দেবুদার ছেলে কবি প্রবাল বসু কথাটা বলেছে। কাল সবাই বলবে, মনে রেখো। এটা একটা মজার প্রশ্ন বলছো কেন? এটা যে বাঙালির দুর্ভাগ্য সেটা বুঝলে না?

কখনো কোনো লেখা দেওয়ার আগে কি দেখেন কোন কাগজকে সেটা দিচ্ছেন? সম্পাদককে কি মাপেন? পাঠক সংখ্যা?

কোনদিন এভাবে দেখিনি। আমার কাছে সব লেখা একটা লেখাই। ভাল মন্দ, কম বেশি পাঠক বিচার করে। অনেক বন্ধু আমাকে বলে- তুমি বোঝ না কেন লেখার গুরুত্ব আর কাগজের গুরুত্ব মেলা উচিত? আমার কাছে তো লেখা তৈরি থাকে না। একজন সম্পাদক বললে আমি লিখতে বসে যা পারি লিখে দিই। পাঠক বাছা বা গোণা আমার কাজ নয়।

জীবনে কোনো একই স্বপ্ন দ্বিতীয়বার দেখার ইচ্ছে আছে?

হ্যাঁ। হাজারবার দেখি স্মৃতি থেকে উঠে আসা অসম্পূর্ণ রমণের স্বপ্নগুলো।

গল্পের বারীন কি কোথাও গিয়ে হেরে গেল কবিতার বারীনের কাছে?

তোমার হেরে যাওয়া ভাবনার ব্যতিক আছে। তুমি তো নামকরণেও হেরে যেতে চাও। আমি এরকমভাবে দেখি না বিষয়টাকে। কৌরবের কবিতার ক্যাম্পে পুরোনো কবিতা থেকে বেরিয়ে যাবার সিদ্ধান্তের পর বুঝতে পেরেছিলাম যে গল্প আর নাটক কবিতা থেকে বাদ দিতে হলে ওগুলোর চর্চা ছেড়ে দিতে হবে। এক দিকে গল্প লিখে যাবো আর কবিতা থেকে গল্প বিদায়ের গল্প শোনাবো… তাহলে একজন ছোট সু নীল হয়ে যাবো নিশ্চিত। এটা স্বেচ্ছা-বিদায়। একে হেরে যাওয়া বলে না।

টোটাল কবিতার ধারণাটা একটু বুঝিয়ে দিন। এটা কি একটা সামাজিক শব্দINTER-MEDIA শব্দটা এই পরিসরে জরুরি হয়ে উঠছে না কি?

দেখ, কবিতা হচ্ছে এক ধরণের অক্রিয়াশীল(নন পারফর্মিং) শিল্প যার প্রদর্শন কলা নেই বলেই বিশ্বাস করি। আবশ্য আগে গান গেয়ে (যেমন চারণ কবিরা, সুফী কবিরা) এমনকি ব্যান্ডপার্টি সহযোগে (যেমন গৌতম চট্টোপাধ্যায় বা ঋষিন মিত্র ইত্যাদি) বা মাইকে গলা কাঁপিয়ে আবৃত্তি করে কলা কবল্য দেখানো হতো। আজকের পৃথিবীতে ভংড় (গিমিক) এতো বেশি যে নাটক ক’রে মঞ্চে নেচে, ছবি এঁকে বা তুলে (ভিস্যুয়াল পোয়েট্রি) তার কোলাজ প্রদর্শন করে শব্দ শিকল (সাউন্ড পোয়েট্রি) বাতাসে ভাসিয়ে, ক্যানভাসে রং ছিটিয়ে (পোলক পোয়েট্রি) প্রায়- কবিতা করা হচ্ছে। এ থেকেই বোঝা যাবে টোটাল কবিতা কাকে বলবো। কেবল নিঃশব্দ শব্দের দৃশ্যমানতা আর শ্রাব্যতাকে ব্যবহার করে চিত্ররেখা ও আলোর, ভাস্কর্যের অবতল ও উপতলের বঙ্কিমতায় আলো- অন্ধকারের খেলা, সঙ্গীতের রেশ- এই সব মিলেমিশে থাকবে মানুষের সমস্ত ভাল- মন্দ লাগা জড়িয়ে যা বেদনা থেকে উল্লাস পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। কথাটা টোটাল সিনেমা থেকে উঠে এসেছে। সমস্ত শিল্পকলার নির্যাস যেখানে সল্মিলিত। তুমি দেখবে কোন কোন সিনেমা থেক উঠে এসেছে। সমস্ত শিল্প কলার নির্যাস যেখানে সন্মিলিত। তুমি দেখবে কোন কোন দেখবে কোন কোন সিনেমা হয় না কাহিনি, অভিনয়, সঙ্গীত, সুর, চিত্রনাট্য, কোরিওগ্রাফি,ক্যামেরা,লাইট,রং পরিচালনা,ইত্যাদি সবগুলো অংশের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার নিয়ে যায়। সেটাই টোটাল সিনেমা। টোটাল কবিতাকে ফিল্মে নয়, অক্ষরে শব্দে গড়ে তোলা সম্ভব। যেমন বিজয় দে’র ‘বম্বে টকি’,বা জহর সেন মজুমদারের ‘বিপজ্জনক বালিকা বিদ্যালয়’।

নেট –এ ‘ইন্টার মিডিয়া’ শব্দটা আসার আগেই টোটাল কবিতা’র ধারণা হয়েছিল আমাদের মধ্যে কবিতার ক্যাম্প চলার সময়, বিশেষ করেই ইউরোপিয়ান কবিতার ইতিহাস চর্চা করতে গিয়ে। সে সময়ের রিপোর্টগুলো খুললে তুমি দেখতে পাবে। এইজন্য ইন্টার মিডিয়ার জ্ঞান জরুরি নয়। একটা করে কবিতা লিখলেই তো চলে।

টোটাল কবিতা সবাই মিলে একযোগে শুরু করে দেবে সেই অবস্থাটাও মঙ্গলের নয়।

কবিতার বিনির্মানের ঝোঁক থেকে কি নির্মানের প্রাণহীন অতিরেক এসে পড়তে পারে?

একদম না। আর ‘প্রাণহীন অতিরেক’ ( বা নিষ্প্রাণ প্রাধান্য) শব্দটা তৈরি হল কিভাবে! কোনো কবিই কি চাইবে তাঁর কবিতার প্রধান গুণ হোক জড়তা? তার আগে সে আত্মহত্যা করবে বা কবিতা লেখা ছেড়ে দেবে। কবিতা নির্মাণটাই তো আনন্দের, উল্লাসের কাজ! এজন্যই তো যুগে যুগে এত কবি এগিয়ে আসে। আর কবিতার বিনির্মাণ ব্যাপারটা কবিদের জন্য থাক। সমালোচনা যেন দখল না করে ফেলে। শব্দসজ্জা থেকে রসায়ন বা সিমেন্ট খুলে রাখলে বিনির্মাণের জন্য তৈরি থাকে কবিতার নিরাবয়ব। একে বিনির্মিত কবিতা বলে। এটা কবিতা গঠনেরই একধরনের একটা শৈলী। বিনির্মিত কবিতা গঠনও একধরনের নির্মাণ। তা সমান আনন্দের। তোমার প্রশ্নের মধ্যে ‘ঝোঁক’ শব্দটা মিসলিডিং।

‘মাস্টারপিস’ শব্দটাকে মান্যতা দেন কি?

শব্দটার গুরুত্ব ছাপাখানা আবিস্কারের পর ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছে। এখন আর মানি না।

কেয়স’-কে কখনও পুনর্গঠন ভেবে বসতে পারি কি? গঠন আর পুনর্গঠনের মধ্যে কবিতায় কখনও শারীরিকভাবে উঁকি দেয়? দিতে পারে?

গঠনের মধ্য থেকে সংবদ্ধতার নিয়ম হারিয়ে গেলে ‘কেয়স’-এর অবস্থা উপনীত হয়। সেটা ফুরিয়ে যাবার পথে একটা অফেরতযোগ্য অবস্থা।শক্তি ফুরিয়ে যাবার আগে সংবদ্ধতার নিয়মটা পুনর্প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে ‘কেয়স’- পূর্ববর্তী যে কোনো অবস্থা ফিরে পাওয়া সম্ভব হতে পারে। এই বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়াটিকে কবিতায় আপ্লাই করতে চাইছ কেন? কবি সেই ভূমিকাটা নিতে পারে না। কেওটিক প্যাটার্নের স্ন্যাপশট দৃশ্যতুমুলতা বা কলরোল দিয়ে উপস্থিত করতে পারে কবি অবশ্যই, যদি তুমি তাই জানতে চেয়ে থাকো।

ঈশ্বরে আপনার বিশ্বাস কতটা?

 অসম্ভব দৃঢ়, কিন্তু আমার ঈশ্বর একমেব। তা হল শক্তি, এনার্জি যা সাড়া বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে, আমাকেও, আমি অনুভব করি। জনসাধারণের বা বেদ- বেদান্তের ঈশ্বর আমি মানি না।

বিশ শতকের একটা বড়ো ব্যাপার ছিল আলো বনাম অন্ধকার। আপনার স্ট্যান্ড কোথায়?

তোমার কথাগুলো ভেবে বলো না কেন অনুপম? আলো বনাম অন্ধকার নয় , তা ‘আলো এবং অন্ধকার’ বা নিশিকরোজ্বল বিমমিষার কথা বলা হয়েছিল। মানে— glorified bourgeoisie – আমি সেখানে একবার দাঁড়িয়ে পড়তে চাই না।

ভারতবর্ষের আবহমান নন্দনত্ত্বঃ আপনার কি মনে হয় ওরকম কোনো কিছু আর জ্যান্ত আছে?

নন্দনতত্ত্ব ভারতের হল কবে থেকে? তা-ও আবার আবহমান কাল ধরে। ভারতের ছিল আবহমান দাসত্বতত্ত্ব, রাজার আর ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্য। ইউরোপিয়ান এস্থেটিক্স বাংলায় নন্দনতত্ত্ব হয়েছে বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে যখন নব্য বাঙালি যুবকরা ইংরাজি শিক্ষার দৌলতে ইউরোপের কবিতা, চিত্রশিল্প ও ভাস্কর্যর সঙ্গে পরিচিত হচ্ছিল। তা কি আবহমানকালের ভারতীয়তা বলা চলে? আমাদের জীবনে এই ব্যাপারটা এখন ফলস। এই তত্ত্বের হিসেব করে সমালোচকরা। আমার কবিতায় ভুলেও এটি ঢুকে পড়লে আমি মুছে দিতে চাই।

একজন কবির গদ্য লেখা কখন সমর্থন করেন? সেই গদ্য স্ট্রেইট যদি আসে… আপনি কিন্তু সরাসরি কথা বলেন…আপনার কবিতা আর কবিতা বিষয়ক গদ্যের ভাষা আলাদা আলাদা… কীভাবে চয়ন করেন?

কবি গদ্য লিখবে, আশ্চর্য কি? কিন্তু কি গদ্য লিখবে? সে যদি খবর কাগজের ফিচার রাইটার হয় বা গল্প উপন্যাস লিখত শুরু করে বা লিটিল ম্যাগাজিনের ব্যক্তি-সংখ্যাগুলোতে সমানে লিখতে থাকে, তাহলে কবিতা লেখা ছেড়ে দিলেই ভাল হয়। কবি নিজেকে প্রশ্ন করে আত্মুআবিষ্কার করবে, নতুন নতুন ভাবনা চিন্তা দিয়ে কবিতা নির্মাণের পথ আবিষ্কার করবে আর সেই জানালাগুলো অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নেবে গদ্যের মাধ্যমে। আমার গদ্যের ভাষা পন্ডিতের ভাষার মতো নয়, কারণ আমি সহজে মানুষের ধরাছোঁয়ার মধ্যে থাকতে চাই। আমার কবিতা কথা বলে না। তা অতিচেতনার পথে সংহত সংকেত দিতে দিত এগোয়। দুটোর ভাষা এক হবে কি করে? চয়ন আমার নয়। চয়ন বিষয়ের।

বিষয়হীন কবিতার নামকরণের কি কোনো প্রয়োজন আছে? নামকরণে কি সে হেরে যায় না? 

আবার হেরে যাবার কথা বলছ তোমার কবিতার বইয়ের মতো। কবিতার নাম সংখ্যাকরণের মতো কোনো কবিতাকে উল্লেখ করার জন্য প্রয়োজন হয়। আমি চিরকাল ধরে একটাই কবিতা লিখে যাচ্ছি না।  তবে লক্ষ্য রাখি যাতে বিষয়হীন কবিতার শিরোনামে বিষয় না ঢুকে যায়। সন্তানের যেমন একটা গাল ভরা নাম দিয়ে কেউ চায় না সন্তান সেই নামের উপযুক্ত হয়ে উঠুক।

Epiphany or Constructive Moments of Epiphany?

 এপিফ্যানি শব্দটায় পাচ্ছিঃ বেথলহেমে যীশুর কাছে প্রাচ্যদেশীয় জ্ঞানীদের আগমন উপলক্ষ্যে ৬ই জানুয়ারি তারিখে অনুষ্ঠেয় খ্রিষ্টিয় উৎসব বিশেষ,  sudden revelation or insight into the nature, essence of meaning or something, the mani-festation of god তাই কোনো অর্থই আমার কাছে ধোপে টেকে না। না ৬ই জানুয়ারি , না হঠাৎ আলো, না মানে বই, না ঈশ্বরের আবির্ভাব। নির্মিত মুহুর্তগুলো পলে পলে ফুরায় যেমন লেখকের কাছে তেমনি পাঠকের কাছে। সময় তো চলে যায় কিন্ত সেই ক্ষণের চিহ্ন রেখে যায় কবিতায়। এত সতর্ক হয়ে কয়জন কবিতা নির্মাণ করে বলো তো?

প্রশান্ত গুহ মজুমদারকে একসেপ্ট করার রহস্যটা কি? কোন নিরিখে ‘কাহাদের কথা’ নতুন কবিতা হয়ে উঠেছে আপনার কাছে? ‘রম্যরচনা’ এবং ‘কাহাদের কথা’র মধ্যে কি কোনো উত্তরণ আছে? থাকলে সেটা কী?

রম্যরচনায় প্রশান্ত নিজে কেমন আছে তাই বলেছিল। কাহাদের কথায় প্রশান্ত’র ভাবনার অনুরণন বিষয় ছাড়িয়ে বলয়াকারে স্পন্দিত হয়ে মানুষকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে জলের যুক্তিতে দূরে হারিয়েছে। সে তো নতুন কবিতাই। পুরোনো সাধু ভাষায় নতুন কবিতা লেখা সম্ভব সেটা প্রশান্তই দেখিয়েছে। আমরা তো ভাষাটিকে নতুন কবিতার অযোগ্য জ্ঞানে বাতিল করেছিলাম। কাহাদের কথা বারবার পড়লেও পুরোনো হয় না।

পুরনো কোনো টেক্সট ( মেঘনাদ বধ, বলাকা, ফিরে এসো চাকা) থেকে ছন্দ অন্তমিল খারিজ করে লেখার ইচ্ছে কখনও হয়েছে? Not deconstruction, but reconstruction, I mean

 ওগুলো কোনো কন্সট্রাকশন ছিল না। ছিল বিষয়-গন্ধি  আবেগ তারল্য। যা দ্বিতীয়বার পড়ার ইচ্ছে হয় না সেটা রিমেক কোন দুঃখে যখন বাংলা কবিতা রিমেক আর রিমিক্স-এ বিরক্ত হয়েই আমি নতুন কবিতার অন্বেষণ করেছিলাম।

গোষ্ঠীবদ্ধতায় পত্রিকা যে অমর হতে পারে ‘কৌরব’ তা দেখাতে পেরেছে, ‘কবিতা ক্যম্পাস’ তা পারেনি। কিন্তু গোষ্ঠীবদ্ধতায় কবির নিজের কবিতা কি জীবন্ত থাকে? তিনি কি কোথাও আটকে যেতে থাকেন?

 ‘কৌরব’ বা ‘কবিতা ক্যাম্পাস’এর অমর হবার বাসনা ছিল না কারু। আমি মনে করি না যে কৌরব অমর হয়েছে। পত্রিকার গুণমান ও নজরকাড়া ঔজ্বল্যের কারণে তুমি হয়তো একথা বলেছ। সেটা আমাদের গোষ্ঠীবদ্ধতার কারণে নয়। বরং তা আমাদের, বিশেষ করে কমলের, অসাধারণ কল্পনা ও ধীশক্তি, সম্মিলিত পরিকল্পনা এবং অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে হয়েছিল যা উদাহরন হয়ে থাকবে। কবিতা  ক্যাম্পাস ছিল যৌথ উদ্যোগ, কিন্তু সম্পাদক বদল হত প্রতিমাসে পরে কয়েকমাস পরপর। ক্রমে তা আর সবার পত্রিকা থাকল না, কারণ কোলকাতার গোষ্ঠীবদ্ধতা নিয়ে যা বলেছি ওপরে তার সব লেগে গেল, পত্রিকা হল সম্পাদকের আর অন্যেরা হল সমালোচক। কৌরব ৫ম সংখ্যা থেকেই সম্পাদকের নাম মুছে দেওয়া হয়েছিল। ১০০ সংখ্যা বেরনো পর্যন্ত কোনো সমস্যা হয় নি। ক্যাম্পাসে সম্পাদক পত্রিকা থেকে বড় হয়ে উঠল। এই ব্যাবস্থায় যা হবার তাই হল। তাতে দুঃখ কিসের? এখনও তো অলোক একা কুম্ভ হয়ে নকল বুঁদির গড় রক্ষা করে চলেছে। সে তো হাল ছাড়েনি।

আর গোষ্ঠীবদ্ধতার উদ্দেশ্য তো পত্রিকার বাইরে যায় না। সবাই নিজের নিজের ভাবনা মতো কবিতা লেখে। সেখানে গোষ্ঠীর কোনো ভূমিকা নেই। অয়ার্কশপে সবাই মিলে তর্কে ভাবনার আদানপ্রদান করে ঋদ্ধ হয়। তা কেন কবিতা রচনার অন্তরায় হবে? কোথাও যে আটকে যায় না তা কৌরবের কবিতা ক্যাম্প বা কবিতা ক্যম্পাসের ওয়ার্কশপের পরবর্তী পর্যায়ে প্রত্যেকের কবিতা লক্ষ্য করলেই পরিষ্কার হবে।

ধরুন অমিতাভ মৈত্রর জগতের কথা। ভাষায় যেন কিরকম একটা ইচ্ছাকৃত আড়ষ্টতা আছে যেটা অনুবাদ সাহিত্যে পাই। যেন ইচ্ছাকৃত hallucination and angstyness আছে। যেন কোনোকিছু কোথাও থেকে পড়ে যাচ্ছে। রক্ত- পিচ্ছিলতা- আড়াল করা যৌন চিত্রকল্প— এই জগতকে গ্রহণ করতে আপনার অসুবিধা হয় না?

 হ্যাঁ, অমিতাভ’র কবিতা পড়ে আমারও মনে হয়েছিল এসব অনূদিত কবিতা। খুব ঘনিষ্ঠভাবে লক্ষ্য করে দেখেছি তা নয়। তার সঙ্গে এই নিয়ে আমার আলাপও হয়েছে। এটা ভাষার একধরণের আর্টিকুলেশন, নতুন স্বাদ আনা। যেকোনো সেন্সিটিভ কবি তার ভাষাটিকে সাধারণ থেকে অসাধারণ করতে চাইবেন। প্রথমে তা চেশটাকৃত মনে হতে পারে, কিন্তু পরে তা এমন কি পাঠকের কাছে সাবলীল হয়ে যায়। আমি নিজে অমিতাভ’র একজন মুগ্ধ পাঠক। নতুন আর পুরানো কবিতার মধ্যে একটা দোলাচল লক্ষ্য করা যায় তাঁর কবিতায় যা খুবই হেলদি সাইন। বারে বারে পুরানো ছেড়ে নতুনে ঢুকে পড়া। সে বিষয়ভিত্তিক কবিতা লেখা শুরু করে কখন যেন বিষয় ত্যাগ করে এগিয়ে যায় তা ভাষার গঠনের ফাঁদে অধরা থেকে যায়। ‘টোটেম ভোজ” বাংলা কবিতার একটা মাইলস্টোন বলে মনে করি আমি। তাঁর ওই দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকে উদ্ভুত টেনশন ও ছত্রখান চিত্রকল্প তো আমার বেশ লাগে। আমি খুব এনজয় করি।

ব্যাস? ফুরিয়ে গেল? কৌরব আমি একশ’ জনের ক্ষমতা ধরি। ৫৮ তে আধপেটা রয়ে গেলাম হে। ভালবেসো, আর না চেয়ে শুধু ভালবেসো। জানো তো, কৌরবের পাসওয়ার্ড ছিল ভালবাসা? শেষ টানা যাক।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত