বেড নাম্বার ১৪২৪ (পর্ব-৪)
বিতস্তা ঘোষাল আবার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। ইরাবতী পরিবার তার দ্রুত আরোগ্য কামনা করছে। কিছুদিন আগেই হাসপাতালের দিনগুলো নিয়ে ধারাবাহিক লিখেছিলেন কেবিন নং ৩০৪। আজ থেকে শুরু করলেন বেড নাম্বার ১৪২৪ নামে এক নতুন লেখা। ডায়েরির মত করে লেখা এই আখ্যান কেবল একজন রুগীর নয়, একজন কবির চোখে দেখাও বটে। আজ তার চতুর্থ কিস্তি।
তৃতীয় দিন
সকাল থেকেই জ্বর।তুড়া চলে যাবার পর প্রিয়াঙ্কা আর শুক্লা চলে এসেছে।মাসিমার অস্থিরতা আবার শুরু।বাবু এল না?
ভিজিটিং আওয়ারে ওনার বৌমা এল।বলে গেল বিকালের আগে মেডিক্লেম ক্লিয়ার হবে না।মাসিমা বলল, সব টাকা দেওয়া , তুমি ইচ্ছে করে বলছ।
বৌমা আর কোনো কথা না বলে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ভদ্রমহিলা নিশ্চয়ই আপনাকে খুব জ্বালিয়েছে ।আজ অবধি কোনও জায়গায় উনি শান্তি দিতে পারেন নি।বলুনতো ওনাকে এখানে রাখা মানে আমাদের দৌড়াদৌড়ি বেড়ে যাওয়া যায় নয়!
আমি মিষ্টি করে হেসে বলি বয়স্ক মারা এই বয়সে এসে বাচ্চা হয়ে যায় ।আমার ও তো মা, শাশুড়ি আছেন।আমার কোনো অসুবিধা হয় নি ওনার জন্য।তবে উনি আপনাকে খুব ভালবাসেন।বলেন, মেধা এলেই এরা সব ভয়ে আমার সেবা করবে।মেধা খুব কাজের।
মাসিমা এই কদিনে বারবার বলেছে, মেধা আমার মেয়ে কেন হতে যাবে, ছেলের বৌ।এতদিন বাইরে থাকত।বদলি হয়ে কলকাতায় ।সল্টলেকে থাকে ।শুধু আমার বাবু আর নাতির জন্য মেনে নিই. .
মেধাকে সেসব কথা বলি না।মেধা হঠাৎ বলেন, আপনি খুব ভালো মানুষ।আমি আজ ৩০ বছর কর্পোরেট জগতে আছি।বিয়ে ও প্রায় ৩৫ বছর।মানুষ মোটামুটি চিনি।আমার শাশুড়ি মাকে এত বছর ধরে দেখছি ।কখনো উনি প্রশংসা করেন না আমার । আপনি যা বললেন, জানি তা সত্য নয়, তবু ভালো লাগলো ।কখনো কখনো মিথ্যাও শুনতে ভালো লাগে।
আমি বললাম, আপনারা ছাড়া ওনার তো কেউ নেই, তবে মন থেকেই বলছি উনি আপনাকে ভরসা করেন।
মেধা সামনে এগিয়ে এলেন।আমার হাতে হাত রেখে বললেন, আপনার মতো কিছু মানুষের জন্য পৃথিবীতে এখনো শান্তি।
মেধা চলে যাবার পর, মাসিমা বলল, কখনো আসবে না ঠিক টাইমে। বদ মেয়ে।অফিস ছুটি হলে তবে আসবে।
কী জানি হঠাৎ মাথাটা গরম হয়ে গেল ।বললাম, মাসিমা, কদিন ধরে খুব চেঁচিয়ে যাচ্ছ ।এখানে সবাই রুগী।কেউ তোমার মতো করছে? আমি এবার ভীষণ বকব।আর তোমার বাবুকে বলে আরও কদিন এখানে রেখে দেব।আর কেবিনে।যাতে কেউ তোমার কথা শুনতে না পায়।
মাসিমা চুপ করে গেল।বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা। তার পাশের বেডের মাসিমার ঘন ঘন বেড প্যান চাওয়া।এসবের মধ্যে চোখ বোজার চেষ্টা ।
আমার বেডটি দরজা দিয়ে ঢুকেই ডানদিকের প্রখমটি।
আর দরজার মুখোমুখি আরেকজন রোগী।কাল রাতে ভরতি হয়েছে।আজই চলে যাবে।গলব্লাডারে স্টোন।তার পূর্ব প্রস্তুতি ।বাড়ি পাটবাড়ি।শুনে খুব আনন্দ হল।আমাদের বাড়ির কাছের মেয়ে।বয়স বছর ২৬।দেড় বছরের ছেলেকে রেখে এসেছে মা শাশুড়ি দুজনের ভরসায়।
আমার মনে পড়ল ২০০৩ সালে এ্যাপেনডিক্স অপারেশনের সময় ভোরাই ৩ বছর।১ লা মে আমার অপারেশন হল।আমার শ্বশুর শাশুড়ি খবর পেয়ে বহরমপুর থেকে চলে এলেন ।সঙ্গে মেয়ের নতুন জামা।সেই জামা পরে বিকেলে দেখতে গিয়ে মেয়ে প্রথমেই বলল, নতুন জামা তোমাকে দেখতে পরে এলাম।এবার বাড়ি চলো।আমার সেদিন ভাল করে তখনো সেন্স আসেনি।মেয়ে কাঁদছে , সবাই বলল, নতুন জামা পরলে মা বাড়ি চলে আসবে।আমার জামা এখনি খুলে দাও, তুমি তো কথাই বলছ না।
বাচ্চাদের মা ছাড়া থাকাটা খুব কষ্টের তখনি অনুভব করেছি ।হয়তো নিজের মতোই ব্যস্ত, কিন্তু কোনো কারণ ছাড়াই মা মা করাটাও তাদের জীবনের অঙ্গ ।
পাটবাড়ির মেয়েটির নাম সৃষ্টা।সে দুপুরে চলে গেল খাবার খেয়ে ।
সবে ঘুম এসেছে ।মাসিমা শুরু করলেন ও দিদি বাবু এল? ভাবলাম উত্তর দেব না।কিন্তু মন আর মুখ অনেক সময় এক হয়ে ওঠে না।বললাম, মাসিমা সবে ৩ ।চারে চারটে বাজুক।
মাসিমার সময় গোনা শুরু হল।আমার অবশিষ্ট ঘুমও গেল।
ইতিপূর্বে আজ সকালে ড:বৃথি কে দুবার কল করছিলাম ।আসেন নি।সাড়ে ৩ টেয় এলেন।মাথাটা হঠাৎ গরম হয়ে গেল।বললাম, ড : তোমার ওপর আমি খুব রাগ করেছি।তুমি তো ডাক্তার ।রোগী ডাকলে নিশ্চয়ই আড্ডা মারার জন্য তোমাকে ডাকবে না।দরকারে ডাকবে।
উনি বললেন, একটু ব্যস্ত ছিলাম ।
আমি বললাম, আমিও এখন মুডে নেই, তবে মনে রেখো , রোগী আছে বলেই তোমার গুরুত্ব ।আর রোগী তার প্রয়োজনে তোমাকে ডাকবেই।ইউ মাস্ট অ্যাটেন্ড হার।
এক নিঃশ্বাসে বলার পর নিজেই অবাক হলাম।এইসব আমি কী করে বলছি! এখানে এসে থেকে সমানে অন্য রোগীদের জন্য বলতে বলতে নিজের কথা কী বলার ছিল সেটাও ভুলে যাচ্ছি ।
ডাক্তার বার দুয়েক সরি বললেন।আমি ইটস ওকে, বলে বললাম, মাথা ব্যথা কমছে না।উনি ওষুধ লিখে দিলেন ।
এই হাসপাতালে এমনি সব ভালো , কিন্তু কোনো আর এম ও, কোনো ডক্টর আসেনা ঠিক সময়ে ।কেউ হয়তো ১ বার, যেমন আমার ডক্টর, বাকিদের সেভাবে দেখতে পাই না।
খানিকবাদে সবে চোখ বুজেছি , মাসিমা, বাবু ও বাবু ওদিকে কেন, বলে চেঁচাচ্ছে দেখে দেখলাম, নতুন পেশেন্ট এসেছে ।তার সঙ্গে বাড়ির লোক।তাদের ই একজনকে বাবু বলে মাসিমা ভুল করেছে।
ও মাসিমা, উনি বাবু নন, ওই যে নতুন মাসিমা ভরতি হলেন তার সঙ্গে এসেছেন ।
মাসিমা আমাকে ধমক দিয়ে বলল, তুমি আমাকে বাবুকে চেনাবে?
শেষে ওই ভদ্রলোক সম্পর্কে নতুন রোগী মাসিমার দেওর এসে সামনে দাঁড়িয়ে বলাতে বিশ্বাস করল।
অবশেষে সাড়ে চারটেয় মেধাদি আর বাবু এলেন।মায়ের সঙ্গে মজা করল।আজ নিয়ে যেতে দেরী হবে।
আরো? ? ?
হ্যাঁ ।রাত দশটা হয়ে যাবে।
বাবু তুই কী চাস, মা মরেই যাক!
বাবু বলল, মা, তোমার এই ব্ল্যাক মেল করার স্বভাব আর গেল না। আর আধ ঘণ্টার মধ্যেই ছেড়ে দেবে।
বাবুর পরনে কমলা টি শার্ট ।মাসিমা বারবার বলতে লাগল, কী সুন্দর লাগছে বাবু।কবে কিনলি? থুঃ , নজর না লাগে!
আরো কিছু বাদে মাসিমা বলল, দিদি, তুমি কী এই হাসপাতালের মালিকের কেউ নাকি ডাক্তার?
কেন বলতো মাসিমা?
সবাই তোমাকে নিয়ে ব্যস্ত।তুমি বললেই সঙ্গে সঙ্গে সব কাজ করে দিচ্ছে , আমাদের কাজ ও করছে তুমি বললেই ।
আমি বললাম, মাসিমা আমি খুব সাধারণ একটা মানুষ ।এই যে বাচ্চা মেয়েগুলো কাজ করছে সব ধরো আমার মেয়ে।আর মায়েদের কথা মেয়েরা তো শোনেই তাই না?
মাসিমা বলল, তা মেয়ে, তুমি করো কী?
বললাম, আমি গল্প লিখি।নিজের কথা লিখি।
মাসিমা বলল, শুধু গল্প লিখলেই মানুষের মন পরিস্কার হয় না।তুমি মেয়েটা ভালো।তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরো এই আশির্বাদ করি।
মাসিমা চলে যাবার পর হঠাৎ মনে হল, এভাবেই হয়তো সম্পর্ক তৈরি হয় , বাবা বলত, ঈশ্বর তোদের অনেক বড় কাজ করার জন্য পৃথিবীতে এনেছে।হয়তো এই ভালোবাসা পাওয়া টাই আমার কাজ।
তাই আপাত: নিরীহ আমি হঠাৎ করেই জেগে উঠি , আর মাসিমার আশির্বাদ পাই সুস্থ হবার ।
কী বিচিত্র এ সংসার…
কবি,কথাসাহিত্যিক,সম্পাদক ও প্রকাশক