বেড নাম্বার ১৪২৪ (পর্ব ৬)

Reading Time: 2 minutes

বিতস্তা ঘোষাল আবার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। ইরাবতী পরিবার তার দ্রুত আরোগ্য কামনা করছে। কিছুদিন আগেই হাসপাতালের দিনগুলো নিয়ে ধারাবাহিক  লিখেছিলেন কেবিন নং ৩০৪। আজ থেকে শুরু করলেন বেড নাম্বার ১৪২৪ নামে এক নতুন লেখা। ডায়েরির মত করে লেখা এই আখ্যান কেবল একজন রুগীর নয়, একজন কবির চোখে দেখাও বটে। আজ তার ষষ্ঠ  কিস্তি।


পঞ্চম দিন

 

“তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে,
তখন ছিলেম বহু দূরে কিসের অন্বেষণে॥
কূলে যখন এলেম ফিরে তখন অস্তশিখরশিরে
চাইল রবি শেষ চাওয়া তার কনকচাঁপার বনে।
আমার ছুটি ফুরিয়ে গেছে কখন অন্যমনে॥
লিখন তোমার বিনিসুতোর শিউলিফুলের মালা,
বাণী সে তার সোনায়-ছোঁওয়া অরুণ-আলোয়-ঢালা–
এল আমার ক্লান্ত হাতে ফুল-ঝরানো শীতের রাতে
কুহেলিকায় মন্থর কোন্‌ মৌন সমীরণে।
তখন ছুটি ফুরিয়ে গেছে কখন অন্যমনে।”

সকাল থেকেই মনের মধ্যে এই কটা লাইন গুনগুন করছে। কেন যেন মনে হচ্ছে এই ছুটি আমার এখনো দেরি। এসবই আমার কিছু ভোগান্তি ।ছুটি নয় ছুটি নয়. .
রমা মাসিমা চলে গেলেন আজ দুপুরে।লাল ম্যাক্সি পরে।হাসি হাসি মুখে ডাকলেন আমাকে।এই মেয়ে তোর কবে ছুটি?
আমি বললাম, আমার ছুটি কবে আমি নিজেও জানিনা ।
বলল, আমাদের মতো সব বয়স্ক রুগীগুলোর জন্য তুই নিজে অসুস্থ হয়ে যেভাবে করলি তার ঋণ শোধ হবে না।আশির্বাদ করি, তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে বাড়ি যা।
মনে মনে ভাবি, আমি করছি না মাসিমা, বাবা আমাকে দিয়ে করিয়ে নিচ্ছেন।
এর আগের মাসিমার বেডে আসা কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মী রাখিদির সঙ্গে খুব গল্প হয় ।তারও একটি মেয়ে।একাদশ শ্রেণিতে পড়ে ।প্রচন্ড দুঃশ্চিন্তায় ভোগে।বুকে জল জমেছে তার।সে অনর্গল বলে যায় তার শরীরের কথা, মেয়ের কথা , পরিবার, বন্ধু, সমাজ সব নিয়ে।
আমিও বলি কিছু। বয়স্কদের মাঝে টাটকা একটা বাতাসের মত আমাদের ফিসফিসানি চলে। যদিও সে মাত্র রাতটুকুর অতিথি ।
সকাল হতেই ছটফট করে বাড়ির জন্য।চলেও যায়।
আমি ভাবি এই যে চার বেডে চার রোগী আমরা, ভিন্ন দর্শন, ভিন্ন মত, ভিন্ন বয়স, এমনকি ভিন্ন রোগ, তবু কোথাও একসূত্রে বাঁধা । যোগটা বোধহয় ঈশ্বর বেঁধেছেন।হয়তো কোনো এক জন্মে এদের কাছে ঋণী ছিলাম, এ জন্মে তাই পরপর তারা আসছে আমার সামনে । আমি চন্ডাল কন্যার মত জল দিয়ে নিজের সেই বহুজন্মের ভুলে যাওয়া ঋণ শোধ করার চেষ্টা করছি।
নইলে কেনই বা এতদূর আসব ভর্তি হতে, কেনই বা কেবিন পাব না, আর কেনই বা সব বয়স্ক মানুষের দল এ ঘরে! কেউ তো আসতে পারত আমার মতোও।
আসলে আমার হাতে কিছুই নেই।কেবল অদৃশ্য থেকে নেমে আসা সুতোর টানে কেবল নেচে চলেছি ইচ্ছে বা অনিচ্ছায়।
বরাবরই ঈশ্বর বিশ্বাসী আমি। রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ আর আমার বাবা ঋষি বৈশম্পায়ন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এ জীবন। কোনো কাজ কখনো নিজের ইচ্ছায় করতে পারি নি।যতবার অকাজের, কোনো অন্যায় ভেবেছি ততবার দেখেছি তিন মূর্তি সামনে দাঁড়িয়ে ।
আর বাবা ছাড়া তো কোনো অস্তিত্ব নেই আমার। আমি নিশ্চিত তিনিই অলক্ষে থেকে ঘুটি সাজাচ্ছেন অন্য কোনো কাজের জন্য।
এদিকে আমি মরে যাচ্ছি টেনশনে। শারদীয়া প্রকাশ করতেই হবে ২১ অগস্ট । অন্যান্য দিক সামলে নিলেও এই বিশাল পত্রিকার বিজ্ঞাপন কীভাবে আনব! জুলাইয়ে মধ্য সময় অবধি তো বাড়িতেই থাকতে হবে। কাল দুপুরে খবর পাওয়ার পর থেকে নিজেকে পাগল পাগল লাগছিল। আমি তো কোনো অনুবাদককে বলতে পারব না, বিজ্ঞাপন দাও। কী করব!
আজ অনেক শান্ত ।
জীবন তো ঢেউয়ের মত, কখনো উত্তাল কখনো শান্ত।দেখা যাবে কী হবে!
তবু বুকের মধ্যে একটা দ্রিমি দ্রিমি লয় বেজে চলে।মনে মনে ডাকি ভিতরের আমিকে।বলো তুমি পারবে।প্রথমে আওয়াজ আসে না।আরো দৃঢ় ভাবে ডাকি।তবু সে উত্তর দেয় না।তারপর বাবাকে বলি, জাগাও আমাকে।বহুদূর থেকে শুনি যেন তাঁর কন্ঠ-সব হবে।সব হয়ে যাবে ।
আমি আবার সব ভুলে মাসিমাদের তদারকিতে মেতে যাই ।
এইটুকু তো জীবন । যতটুকু সকলকে নিয়ে বাঁচা যায় ।

 

.

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>