| 20 এপ্রিল 2024
Categories
দুই বাংলার গল্প সংখ্যা

ভার্চুয়াল প্রেম

আনুমানিক পঠনকাল: 11 মিনিট

 

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.comবন্ধুঅনুরোধে  নাম পাঠিয়ে শান্তি নেই। মেসেজ  দিচ্ছে গ্রহণ করার অনুরোধ জানিয়ে। তিনি একজন বিদেশি। একটু অবাক হয় দোলা। তবু  ক্লিক করে  একদিন জানতে চাইলো,  বাঙলা জানেন?

-জানি না কিন্তু বুঝি।

কেমন করে?

আমার এক কলিগ বাঙালি। 

-আমি তো শুধু বাঙলাই বলবো।

-রোমান হরফের লেখা আমি বুঝতে পারি।

-থাকেন কোথায়?

-সিঙাপুর এবং পেনাং।

-দুই জায়গায় কেনো?

-দুটো সংসার। দুই জায়গায় ব্যাবসা করি বলে দুই জায়গাতেই থাকতে হয়।

-তারপরেও সময় থাকে বন্ধুবাজি করার জন্য?

-বহুদিন ধরে আপনাকে ফলো করছি ম্যাম। প্লিজ আমার রিকু এক্সেপ্ট করেন। আমি আপনার ফ্যান  হয়ে পড়েছি।

সেই দিনই ওকে ব্লক দিলো  দোলা। ফাজিল মানুষ। দুটো বউ নিয়েও শান্তি নেই। নিশ্চয় আরও বন্ধু আছে। মেয়েদেরকে  বিরক্ত করাই কি ওর কাজএতোদিন থেকে ফেইসবুকে আছে, বন্ধু সংখ্যা এখনও চার পাঁচ শো। প্রতিদিন কয়েকটা বন্ধুঅনুরোধ আসে। নিলে তো নয় বছরে  কয়েক  হাজার হয়ে যেতো। বেশি বন্ধু সামলাতে পারবে  না তার মতো অধম, তা জানে খুব ভালো করে। তাই ব্যাকগিয়ারেই পা রাখে সে। দেশের বন্ধু নিতেই  তার  ভয়, বিদেশি বন্ধু দিয়ে কি করবে? যত্তো সব

সাত দিন যেতে না যেতেই পর পর কয়েকটা বিদেশি বন্ধু রিকু পাঠালো। টিক দিলো না। ডিলিটও করলো না। বিষয়টা নিয়ে ভাবলোও না। রোজই বসে দোলা ফেইসবুকে। প্রবাসে তার খোলা জানালা এটা। লেখালেখি করতে করতে একঘেয়ে  লাগলে ফেসবুকের জানালা খুলে দেয়। হেসে ওঠে পৃথিবী। কতো মুখ, কতো কথা, কতো খাজুরে আলাপ, কতো বাতুল কথা, কতো ছবি গান! আনন্দিত হয়ে যায় সে কিছুক্ষনের জন্য। কিন্তু এ কোন জ্বালা শুরু হলো? আগে ছিলো না তো! ওদের দেশে কি বন্ধু পাওয়া যায় না?

এবার এক রিকু এলো লন্ডন থেকে। কৌতুহল  বশে  তাকেও  ধরলো একদিন দোলা। জানতে চাইলো, কেনো সে বন্ধু হতে চায়? ইংরেজিতে লেখালেখি হয়।

তোমাকে দেখে আমার ভালো লেগেছে।

সেটা তো  ছবি! আমার নাও হয়তে পারে।

অসম্ভব। আমি জানি, এটা তোমারই ছবি।

বাপ্‌স! এটা তো দেখা যায় অন্য কিসিমের চিড়িয়া। সাক্ষাত গনক ঠাকুর! লেখে,  করো কি? বয়স কতো?

স্টিল মিলে কাজ করি। নাম, উইলমন্ড। 

সেতো দেখতেই পাচ্ছি।

লন্ডনে বাসা আছে আমার।

-তো?

-তুমি বেড়াতে আসো। বন্ধুত্ব পাকা করি। নতুন কিচেন কিনেছি। দুই জনে শেয়ার করতে পারবো। বড়ই আছে মোটামুটি।

কথা শুরু হতে না হতেই গদগদ ঢলো ঢলো ভাব। একেবারে কিচেন শেয়ারিং! মনে মনে হাসে দোলা। নিশ্চয় বোতল খেয়ে কথা বলছে। বলে, আজ রাখি, পরে কথা হবে।

পরদিন ফোন করলো উইলমন্ড। হাই, কেমন আছো দোলা?

লেখালেখি বাদ দিয়ে একেবারে ফোন! বেশ অবাক হয় দোলা। তবু বলে,

ভালো। লেখালেখিই তো ভালো ছিলো।

-মাই গুডনেস! কি সুইট তোমার কন্ঠ!

হেসে ফেলে দোলা। বলে, কেমন আছো ?

-তোমাকে না পেলে ভালো থাকবো না বন্ধু।

-পাগল না কি? বলছো কি এই সব?

-সত্যিই বলছি। কাল সারারাত তোমার ছবির দিকে তাকিয়ে  ছিলাম।

আজ তোমার কাজ নেই?

যাবো না। ছুটি নিয়েছি।  ব্যথা পেয়েছি হাতে। রেস্ট নেবো।

রেস্ট মানে তো লম্বা ঘুম। যাও, পেইন কিলার খেয়ে ঘুমাও গিয়ে।

ঘুম আসছে না। শুধু তোমার কথা মনে হচ্ছে। কাছে পেতে ইচ্ছে করছে।

শালা পাগল। নির্ঘাত পাগল। হ্যাংলার মতো কথা বলছে উইলমন্ড। কি মনে করে ওরা মেয়েদেরকে? কি উদ্দেশ্য নিয়ে বন্ধুত্ব চাইছে? সভ্য দেশের প্রেমের ধারা কি এই রকম? উপনিষদ মার্কা? ‘চারিচক্ষের মিলন হইলো। সামান্য বাদে অন্য রকম মিলনও ‘হইলো’। চক্ষের মিলনও তো হয় না ফেইসবুকে!

কিন্তু কথা বলতেও ইচ্ছে করছে দোলার। পুরুষ বন্ধু তাদের জীবনে কল্পনাও করা যায় না। তবে পুরুষের সাথে কথা হয়। তারা আত্মীয়,  প্রতিবেশি,  নয়তো স্নেহভাজন কেউ বা কাজের লোক, এমনি। এমন করে কারও সাথে কথা হয়নি।  প্রযুক্তি শুধু আকাশ খোলেনি, মানুষের মনও খুলে দিয়েছে। কতো সাধ্য সাধনা করে সুকুমার বৃত্তিগুলোকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা  হয়। প্রযুক্তি  কি অনায়াসে সেই ঘুম ভাঙায়! সাত সমুদ্র তেরো নদীর ব্যাবধানে বসে  তাই  অচিন লোকের সাথে বন্ধুর  মতো কথা বলা সম্ভব হচ্ছে। চুয়াত্তর বছর বয়সে নতুন অভিজ্ঞতা। চিন্তা একটাই, কাজটা ঠিক হচ্ছে কি না?

তিনদিন পরে  আবার ফোন করে উইল। বলে, এখন তো সামার, চলে এসো না, আমরা  আইসল্যান্ডে বেড়াতে যাবো।

ছোট্ট ঘুর্নিঝড় বয়ে গেলো মনের জমিনে। তার মানুষটা তো এমন করে বলেনি কোনোদিন। টাকা ছিলো, কিন্তু সখ ছিলো না। কৃপনও ছিলো। সংসার সন্তান তার ঘাড়ে ফেলে  একা একা বেড়াতো।  সামলে নিয়ে দোলা বলে, তোমার দেশ কোথায়?

গ্রেট বৃটেন, স্কটল্যান্ড।

-তোমার উচ্চারণ তা বলে না কিন্তু।

-আমার মায়ের দেশ ইতালি। তুমি চাইলে ইতালিতে, ভেনিসে, রোমেও যেতে পারি। ক্রোয়েশিয়াও হতে পারে। বলো কোথায়  যাবে?

-তাই  তো বলি! দোলা হাসে। মাতৃভাষার উচ্চারণ লুকোবে কোথায়?

– আই  লাভ  ইউ দোলা।

ওরে আমার সারিন্দা রে! সে বলে কি, আর সারিন্দা বাজায় কিতবু চমকে ওঠে দোলা। কি বলে এই সব লোকটা? ভালোবাসা এতোই  সহজ?

তবু ধুকপুক করে বুকের মধ্যে। শব্দটার ব্যঞ্জনা ঐশী সুরের মতো। বকাবকি করতে পারতো দোলা। পাগলাটে বলেই করেনি। তাছাড়া এতো সহজে এখন আর

রাগ হয় না। পৃথিবীতে কতো রকম পাগল আছেরাগও করতে পারেনি ওর ওপর। বেচারা ভালোবাসার কথাই তো বলেছে। কে জানে, হয়তো একা থাকে। বঞ্চিত নিঃসঙ্গ জীবন। প্রবাদটা মনে পড়ে দোলার, ‘চারদিকে পানি, কিন্তু একফোঁটা পানি নেই খাওয়ার।’ ফ্রি সোসাইটিতে থাকে। রমনী কূলকামিনীতে ভরা দেশ, তবু একা থাকে। জীবনের কি পরিহাস!

দোলা শুনেছে, ফেইসবুকের  আলাপ থেকে প্রেম হয়, বিয়েও হয়। কিন্তু সেতো  বয়সি মহিলা। চুয়াত্তর বছর বয়স। প্রেম বিয়ে কোনোটাই হবে না। উইল বলেছিলো, তার বয়সও চুয়াত্তর। এখনও তবে বন্ধুবাজির হাউস আছে তার? অবাক হয় সে। প্রাণটা তাহলে তাজা আছে। দেশের মেয়ে পায় না? সব ছেড়ে বাঙালি বয়সি মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব! প্রেম! বয়সকে উইল বলে, ‘নাম্বারস’। ও কিছু না। মনই হলো আসল।

হতভাগা, জানো না তো, আমাদের দেশে সবচেয়ে আগে মারতে হয় মনকে। কেউ বুঝতে চায় না, বয়স হলেও মানুষের মধ্যে সব সুকুমার অনুভুতিই থাকে। সমাজের অয়োময় অদৃশ্য প্রাচীরে শক্ত করে ঘেরা। ছেলেরা  বয়স হলেও অনেক কিছু বলতে পারে, মেয়েরা পারে না। ছেলেরা অনেক কিছু করতেও পারে, মেয়েরা চোর হয়ে থাকে। চুয়াত্তর বছর বয়সে প্রেম ভালোবাসার কথা কোনো বয়সি মেয়ে বললে পাবনার পাগলা গারদে বেঁধে নিয়ে যাবে পরিবার, সমাজ। আপন মনে হাসে দোলা।

কিছুদিন পর বন্ধ হয়ে গেলো উইলের সাথে গল্প করা। আহারে মানুষ! কিচেন শেয়ার, বিশ্ব ভ্রমন, লন্ডনে বেড়াতে যাওয়া, সব হাওয়া হয়ে গেলো। ওর পক্ষ থেকেই বন্ধ হয়ে গেলো ফোন। হয়তো ফেইসবুকেই  অন্য কারো  দিকে লাইন দিয়েছে। ব্যাক্টেরিয়ার মতো সবাইকে কামড়ে বেড়ায় তো। থিতু হতে চায় না। এইজন্য এরা একা। কয়েক সেকেন্ডেই  জানে জিগরি দোস্ত হয়ে যায়। পারলে মাথায় তুলে নেয়। বিছানায় নিয়ে শোয়।  তারপরই  শেষ  হয়ে যায় আকুল ব্যাকুল দোস্তালি। উতল মাতাল প্রেম। ক্যামন জীবন যাপন করে এরা?

দিন যায়। তিনচার মাস পর  আবার এক বিদেশি বন্ধু-অনুরোধ আসলো। পাত্তা দিলো না দোলা। দুর, উটকো ঝামেলা সব। কয়েকবার নক করলো। উইলের কথা ভুলেই গিয়েছিলো একেবারে। আবার কোন উৎপাত?  কথা আছে না, পাপের আকর্ষণ বেশি। দোলা ভাবে, দেখাই যাক না,  এই  বিদেশি কেমন করে প্রেম করে? ক্লিক করে একদিন। খুলে যায় ফেইসবুকের  আকাশ জোড়া দেয়াল। 

নিঃশব্দ অক্ষর ভেসে উঠলো,  আমার নাম ফিলিপ, দেশ আমেরিকা। থাকি ওয়াশিংটন ডিসি-তে। 

দোলা প্রশ্ন করে, বন্ধু হতে চাও কেনো ?

– তোমার ছবি দেখে আমি মুগ্ধ।

-ওটা পুরনো ছবি। আমার প্রোফাইল দেখেছো?

– না। ছবিই যথেষ্ট বন্ধু।

-তোমার ছবি কবেকার?

– এই বছরের  জানুয়ারি মাসের।

– তুমি তো বাঙলা জানো না। কথা বলবে কি ভাবে?

-এখন যেমন ভাবে বলছি।

– মানে, ইংরেজিতে?

– হোয়াই  নট?

– কি নিয়ে কথা বলবো আমরা?

-জগতে টপিকের আকাল আছে কি?

– তা নেই। ‘করোনা’ কালে কিছুই ভালো লাগে না।

-বাংলাদেশের অবস্থা কেমন?

-বেশ খারাপ।

-সে তো আমেরিকাতেও খুব খারাপ।

-তোমার প্রফেশন কি ?

-সিভিল ইঞ্জিনিয়র।

– তোমার?

– প্রোফাইল দেখে নাও, তারপর আবার কথা হবে,  নো মোর টুডে, ওকে।

 

নিঃসঙ্গ দোলার খারাপ লাগছে না কথা বলতে। আঠারো বছর হলো মানুষটা চলে গেছে। তারপর থেকে  শূণ্য জীবন। এই চুয়াত্তর বছর বয়সেও পূর্নিমা রাতে মন কেমন করে। খুব মনে পড়ে  আটত্রিশ বছরের জীবন সঙ্গী মুস্তাকিমকে। হরিহর আত্মা ছিলো না তারা, কিন্তু ভালো সময়ও তো কেটেছে  তাদের। নির্ঘুম রাতে মনে হয়, ও যদি গায়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতো, তাহলে হয়তো ঘুম এসে যেতো। সে তো আর হবে না ইহ জীবনে। কি হবে এই  সব  বন্ধুত্ব টন্ধুত্ব দিয়ে? তবে এটা ঠিক, দেশে কারও সাথে এমন করে কথা বলা যাবে না। দেশের কেউ আর  কোনও দিন বন্ধু হবে না। বিধবা বুড়ো মানুষের আবার জীবন কি? বন্ধু কি? এখন জীবনে প্রান থাকাটাই  নিন্দনীয়। ধর্ম কর্ম করেই সময় কাটাতে হবে। এটাই তো হয়ে আসছে। ব্যতিক্রম দেখে অভ্যস্ত নয় কেউ। ভেবেও না।

 

হোয়াটস এপ-এ মেসেজ এলো। মোবাইল খুলে দেখে ফিলিপ। ছোট্ট ম্যাসেজ, হাই  সুইটি।

মুখ টিপে হাসে দোলা। সে  আবার সুইটি হলো কখন? একদিন হাই  হ্যালো হতেই কেউ সুইটি হয়? এও তো দেখি পাগল! আরও বড়ো পাগল। আসলে এদের সংস্কৃতিটাই  আলাদা। বচন-বাচন, মনন, ধরণ-ধারন অন্য রকম। দোলা টাইপ করে,  ফেইসবুক কি হলো?

-ডাজেন্ট ওয়ার্ক। দুই এক দিনের মধ্যে আর একটা একাউন্ট খুলে নেবো। আপাতত হোয়াটস এপ-এ কথা বলা যাক, কি বলো?

-ওকে। নো  প্রব্লেম।  আমার প্রফাইল দেখেছো?

– দেখেছি।

-জন্ম সাল দেখেছো?

– অফ কোর্স।

-তোমার প্রোফাইল তো অসম্পূর্ন।

-মানে, জন্ম সাল লেখা নেই, এই তো? আমার বয়স তেতাল্লিশ।

 খুব জোরে হেসে ওঠা দোলা। লেখে, লোল (Lol)।

– কেনো? হাসির কি হলো?

-আমার চেয়ে একতিরিশ বছরের ছোটো এক বিদেশির সাথে আমি বন্ধুত্ব করবো?

-সমস্যা কোথায়? বয়স তো শুধু নাম্বার।

চমকে ওঠে দোলা। এও একই কথা বলছে! বিদেশিরা বয়সকে সত্যি নাম্বার মনে  করে? দেশের প্রবাদ ‘ কুড়িতেই বুড়ি’ মনে পড়ে। লেখে,  এইরকম বন্ধুত্ব আমি কখনও দেখিনি ফিলিপ।

-বন্ধুত্ব ইজ বন্ধুত্ব। বয়সে কি যায় আসে  সুইটি। 

কথা নেই বার্তা নেই, ‘সুইটি’  ডাকটা রপ্ত করে ফেললো? বৌ শুনলে ঝাঁটা পেটা করবে। দোলার কেমন যেনো লাগে। কথা খুঁজে পায় না। লেখে, লাঞ্চ করেছো?

– জাস্ট ডান।

– কি খেলে?

– শুধু  ফল মূলের  ককটেইল। তুমি?

– আমরা ভেতো বাঙালি। মাছ ভাত সবজি খেলাম।

– তুমি রান্না করো?

– মাঝে মাঝে করি। তুমি রান্না করতে পারো?

– বেশ পারি। একা মানুষ। বেশির ভাগই কেনা খাবার। গরম করে নিলেই হলো।

– একা কেনো?

-বৌ চলে গেছে। ছয় বছরের বাচ্চাটা  থাকে আমার মায়ের কাছে।

– সরি।

– নো ম্যাটার। দিস ইজ লাইফ হানি। তোমার কথা বলো।

আরে! আবার হানি বলে! বকা দেবে নাকি? কিন্তু এতোই স্বাভাবিক ভাবে বলছে, মনে হচ্ছে কতোদিনের পরিচয়। মন্দ লাগছে না শুনতে। ভাবে,  আমাদের মানুষেরা বৌকে  এইসব মনহরা বিশেষনে ডাকতেও জানে না কেনো? কথা বলতে তো টাকা লাগেনা! অন্তত তাকে তো ডাকেনি মুস্তাকিম। লেখে, আমিও একা। আমাকে ফেলে ও চলে গেছে আঠারো বছর আগে।

– তারপর?

– তার  আর পর নেই।

-তোমার জীবনে আর কোনও পুরুষ আসেনি?

– না। আমাদের দেশে এটাই স্বাভাবিক। আমার অনেক বড়ো সংসার। ছেলে মেয়ে নাতি পোতা আছে। কেটে যায় দিন।

-সো হোয়াট। লাইফ ইজ ইওরস।  ইউ আর স্টিল ইয়ং।

– ওরকম ভাবতে অভ্যস্ত নই আমরা।

– আবার যদি কেউ প্রপোজ করে?

লাফিয়ে লাফিয়ে এগোচ্ছে দেখা যায়। লেখে,  এই  বয়সে?

– ইউ আর সো  প্রিটি  হানি। ইনজয় ইয়োর লাইফ।

– প্লিজ, ছাড়ো  এসব কথা।

-হোয়াই  ডার্লিং? আমি  যদি  প্রপোজ করি?

আর সহ্য হয় না দোলার। শির শির করে ওঠে সারা শরীর। লেখে, আজ থাক, পরে কথা হবে। মোবাইলটা হাতে ধরা। কিছু একটা  লিখছে  দেখা যায়।

ফিলিপ লিখেছে,  আই লাভ ইউ ডার্লিং। মাই বেবি। ইউ আর মাইন।

পাগল, পাগল, তস্য পাগল। উন্মাদ! ‘ লাভে’র বাচ্চা  সব। ভালোবাসা এদের কাছে এতো সড়সড়ে?  সুইটি,  হানি, ডার্লিং, বেবি, ঠোঁটের আগায় থাকে।  শব্দ গুলো যেনো কিছু নয়। কথার কথা। তবে বেবি সম্বোধনটা নতুন। মানেটা কি?

দোলা ভাবে, দেখা যাক না কোথাকার পানি কোথায় যায়! তামাশা বই তো নয়! তবে একটা কথাও মনে জাগছে, নিশ্চয় এদের কোনও উদ্দেশ্য থাকে। দেশ কিছু নয়, ভাষা কিছু নয়, বয়স কিছু নয়। জাত ধর্ম তো বাদই গেলো। কোনটা তাহলে কিছু? সেই  কিছুটা,  তাহলে কি?

পরদিন আবার ম্যাসেজ আসে। লেখা, কেমন আছো ডার্লিং?

-ভালো।

– কি করছো?

– নিঃসঙ্গ মানুষ যা করে। বই পড়ছি।

– তুমি একা নও। আমি আছি পাশে হানি। জাস্ট ফিল মি এট ইয়োর সাইড।

‘ম্যায় হুঁ না’-র মতো ডায়ালগ! দোলা লেখে, লোল (Lol)। কোথায় তুমি, আর কোথায় আমি! 

– হেসো না, হেসো না, তোমাকে নিয়ে আসবো এখানে।

– তুমি কি সত্যি পাগল?

– আই লাভ ইউ ডার্লিং। আমি তোমাকে বিয়ে করে ঘরে আনবো। বাকি জীবন আমরা একসাথে থাকবো। কেউ আটকাতে করতে পারবে না।

– আমি তো  জীবনের পর্যটন শেষ করেই এনেছি।

– সব  ফিরিয়ে  দেবো  তোমাকে আমি। ফিরিয়ে দেবো  বয়স, ফিরিয়ে দেবো জীবনের তারুণ্য। ফিরিয়ে দেবো বসন্ত। তুমি শুধু আমার হবে। শুধু আমার। 

প্রচন্ড একটা ধাক্কা লাগে  মনে। ভূমিকম্পের মতো কেঁপে ওঠে  শরীরের জমিন। কি অসম্ভব কথাবার্তা! দোলার বুকের মধ্যে রোমাঞ্চ ঝিঁ ঝিঁ পোকার মতো  শব্দ করতে থাকে। চুপ করে থাকে সে। কেন এই সব কথা বলছে ফিলিপ? তেতাল্লিশ বছরের  ভর যৌবনের  টগবগে  মানুষ, বিয়ে  করবে চুয়াত্তর বছরের বুড়ো এক মহিলাকে। অবাস্তব কথা বলে যায় কি অনায়াসে! কিন্তু বলছে কেনো? জাস্ট ফান? কৌতুক? অথবা?

ম্যাসেজ আসে, তোমার হবি কি?

– বইপড়া, লেখালেখি করা।

– আমার হবি, গান শোনা, লং ড্রাইভে যাওয়া।

নাহ, ওকে জিততে দেয়া যাবে না। দোলা ভাবে, একটু খেলতেই হয়। সবই তো চোখের আড়াল। ভিডিও কল হয়নি এ পর্যন্ত। ফোনেও কথাও হয়নি। দোলা লেখে, আমিও লং ড্রাইভ পছন্দ করি।

– এমেইজিং। কী মিল! আমাদের দেখো কুইনি। আ পারফেক্ট ম্যাচ।

একা ঘরে শব্দ করে  হাসে দোলা। লেখে, চলো যাই কোথাও।

– তুমি এলে ডিসি (ওয়াশিংটন ডিসি) পুরো ঘুরবো।

– এখনই চলো।

– কেমন করে হানি?

– চোখ বন্ধ করো। তিরিশ সেকেন্ড চোখ বন্ধ করে রাখো। তারপর খোলো। দেখবে আমরা ঘুরে এসেছি।

– এমেইজিং ডার্লিং। তোমার মতো স্বপ্নবাজ একটা বউ দরকার ছিলো আমার।

– আজ রাখি, পরে কথা হবে।

– ওকে মাই ওয়াইফ। মাই  সুইট ডার্লিং।

উহ!, কান মন  শরীর  তপ্ত হয়ে যায়। শব্দগুলোর শক্তি আছে! কেমন একটা শিহরন অনুভব করে দোলা। এই  বয়সে এমন লাগে  নাকি কারও? ভাবে, ঠিক হচ্ছে  কি এমন প্রেমের খেলা? চিরাচরিত সংস্কারে কট কট করে টান পড়ে। কোথায় যেনো  মূল্যবোধও মৃদু খোঁচা দেয়। ঠিক হচ্ছে কি?

 

দোলা প্রায় নিশ্চিত, লোকটার কোনো উদ্দেশ্য আছে। কেনো এ  রকম  মনে  হচ্ছে, তা জানে না। উইলকে তো দেখলো। একটা  ফটকা! কিন্তু ফিলিপের  কি উদ্দেশ্য  হতে পারে, সেটাও বুঝতে পারছে না। এমন গায়ে পড়া প্রেম তো স্বাভাবিক না। যথেষ্ট বাকপটুও মানুষটা। শেষে কোনো ফাঁদে পড়বে না তো? তাই বা কেমন করে হবে? হাজার হাজার মাইলের ব্যবধান। তবে ইন্টারনেটের যুগ। ও কি গুপ্তচর? সাবধানেই তো কথা বলে  দোলা। দেশের বিরুদ্ধে একটা শব্দও তো উচ্চারণ করেনি সে। সাইবার ক্রাইমের গল্প শোনা যায়। সেটা নাকি ভয়ঙ্কর! কিন্তু এই সামান্য কথা, খেলা খেলা বায়বীয় প্রেম, দুই-চারটে  বিদেশি অভ্যেসের মিঠি মিঠি শব্দের উচ্চারণ,  এসব থেকে কি আর হতে পারে? সাহসী  হয়ে উঠতে চায় সে। নাহ! এমন খেলায় দোষ নেই। বিপদ নেই। খেলাই যাক একটু।

 

সারারাত কানের কাছে  সুইটি, হানি, ডার্লিং, মাই ওয়াইফ, শব্দগুলো বাজতে থাকে। বড্ড ঘুমের ব্যাঘাত হলো দোলার। যতোই মনে করতে চেষ্টা করে, ওগুলো ফালতু লোকের ফাজলামির শব্দ! ততোই  ব্যঞ্জনা নিয়ে শব্দগুলো গান হয়ে ওঠে। কেমন এক ভালো লাগার রোমাঞ্চে  আবেশ জাগে  শরীরের লক্ষ কোটি  কোষে, হৃদয়ের তন্ত্রিতে তন্ত্রিতে। বিরক্ত হয়ে ওঠে দোলা নিজের  ওপরেই। 

প্রতিদিন ছোটো ছোটো ম্যাসেজ আসে। আজকাল কিছুই আর গোপন থাকে না। সময়  হিসেব করে দেখে দোলা, গভীর রাতে লেখা ম্যাসেজগুলো।

একদিন লেখে, রাতে ঘুমোও না?

– খুব ডিস্টার্বড থাকি। ভালো ঘুম হয় না। তুমি পাশে থাকলে এমন হতো না হানি।

– উইকেন্ডে খুব পান করেছো বোধ হয়।

– তোমার সাথে বিছানায় খুনশুটি করেছি।

– ভাষা তো জানো না। মাতৃভাষা না হলে খুনশুটি হয়?

– তাতে কি? তোমাকে আস্তে করে বিছানায় শোয়ালাম। আনড্রেস করলাম। তোমার সারা শরীর স্পর্শ করলাম। লীলা শেষে একসাথে বাথ নিলাম। ঘুমোবো কখন?

ফোন বন্ধ করে দেয় দোলা। অসহ্য! অসহ্য! কেমন করে পারে মানুষ এইসব কথা বলতে? আসলে  কথাই যাদু। কথা দিয়েই মানুষকে ভোলায় মানুষ। তারই যদি শিহরন জাগে, নেশার মতো লাগে, তাহলে কিশোরী কন্যারা তো রোমাঞ্চিত হবেই। গলেও যাবে এক সময়।

ম্যাসেজ আসে, কথা বলো ডার্লিং। কবে আমরা একসাথে থাকতে পারবো?

– তোমার কথা শুনে লজ্জা পাই ম্যান। কি যে সব বলো!

– আমার কাছে তোমার লজ্জা কি মাই কুইন, মাই লাভ?

– আজ থাক, পরে কথা হবে, ওকে?

-গিভিং আ টাইট হাগ ডার্লিং। ডু ইউ ফিল?

-প্লিজ, এসব  ভাষায় কথা বলো না।

-হোয়াই নট? ইউ  আর মাই  ওয়াইফ। মাই কুইন। টেইক আ  লং  কিস।

দোলা বন্ধ করে দেয় ফোন। বড্ড বেশি বেয়াড়াপনা  করছে ফিলিপ।

আকুল ব্যাকুল চিন্তায় দোলা অস্থির। প্রেমে পাগলের মতো করছে  কেনো  লোকটা?  জীবনের দিনগুলো তাকে নিয়েই নাকি কাটাবে। জীবনটা কি রূপকথার গল্প? ইচ্ছে  হলো আর বিশাল ঈগল পাখির পিঠে চড়ে ধবল মেঘের বাড়ি গিয়ে বসলো? চাঁদ মামা এসে কপালে চন্দনের টিপ পরিয়ে দিলো?  তারারা নিয়ে এলো সুবাসিত ফুলের মালা। দেবদূতেরা এসে শুরু করল নাচ গান।ফিনিক্স পাখিরা নিয়ে এলো বেশুমার সুখাদ্য। আহা, সখ  কতো! কিন্তু এখনও ফিলিপের উদ্দেশ্য ধরতে পারলো না দোলা। একটা  কিছু অবশ্যই  আছে এর মধ্যে। এমন হঠকারি প্রেম বিশ্বাসযোগ্য নয়। কেউ কারও কণ্ঠ শোনেনি। ভিডিও কল করে চেহারা দেখেনি। ও কি ছেলে , না মেয়ে? কালো না ধলো? লম্বা না খাটো? মোটা না পাতলা? সেটাও তো প্রশ্নবিদ্ধ।

প্রতিদিন কথা হয়। প্রায় দু’ সপ্তা হতে চললো। কুয়াশা কাটলো না। একদিন আবার বলে, একটা কথা তোমাকে শেয়ার করতে পারি ডার্লিং?

– ভরসা থাকলে বলো।

-আমি একটা প্রাইভেট বিজনেস, মানে রিয়াল স্টেটের ব্যবসা করি। হঠাৎ টাকার সমস্যায় পড়েছি। প্রকট সমস্যা।’

– তারপর?

– তুমি কিছু টাকা দাও না। তিনমাসের মধ্যে ফিরিয়ে দেবো। কথা দিচ্ছি।

মেঘলা আকাশে বিদ্যুৎ চমকে গেলো। শাখা প্রশাখা মেলে  বিদ্যুৎ শিখা যেনো চিরে চিরে দিলো শান্ত নিরীহ নিটোল  আকাশের গা। এতোগুলো বিগ ব্যাঙের দেহ আকাশের গায়ে? এই তবে উদ্দেশ্য! দোলার চোখ খুলে গেলো। তার ধারণাই ঠিক। প্রেমের ফাঁদে ফেলে  টাকা বাগিয়ে নেয়াই  তাহলে উদ্দেশ্য! প্রফেশনাল লাভার দেখা যায়। এরাতো চারুবাক হবেই। 

দোলা লেখে, আমি প্রবাসী। পরজীবী জীবন। আমার তো টাকা নেই ধার দেয়ার মতো।

– কোথাও থেকে জোগাড় করো, প্লিজ হানি। কঠিন অবস্থা আমার।

দোলা তো বুঝেই গেছে ফিলিপের প্রেম  কি জন্য? তার মুখের ‘হানি’তে কতো বিষ! গল্প শুনেছে ধনাঢ্য বিধবাদেরকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে ,কেউ কেউ বয়সী মহিলাকে বিয়ে করে তার সমস্ত টাকা আত্মসাৎ করেছে। ফিলিপ  কি তাকে ধনাঢ্য বিধবা ভেবেছে? আহারে আবাল! তবু খেলাটার শেষ দেখতে চায় দোলা।

আবারও ম্যাসেজ এলো, আমার জন্য কিছু করতে পারলে হানি? যা পারো তাই দাও। কাজে লাগবে। আমার কথাটা ভাবো ডার্লিং। 

– সরি ম্যান, পারছি না।

-প্রেম কিন্তু শুধু ঠোঁটে নয় হানি।

কুৎসিত শোনালো কথাটা। লিখলো, প্রেম টাকার শর্তও নয়।

দোলা ভাবে, রিয়েল স্টেটের ব্যবসায় “যা পারো তাই দাও”, কথাটা বেমানান। ওর লাগার কথা হাজার হাজার ডলার। দুচার শোতে কি হবে? বলেছে ব্যাঙ্ক থেকে ধার  নিলে  হাই  ইনটারেস্ট। তাই বন্ধু বান্ধবের কাছে হাত পাতা।

আবার ম্যাসেজ, সুইটি, তোমার বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে জোগাড় করে দাও না।

– প্লিজ আমাকে লজ্জা দিও না, দোলা লিখে। ভাবে, হ্যাংলামি হয়ে যাচ্ছে না! আত্মসম্মানও কম। পরিচয়  হতে না হতেই  টাকা ধার চাওয়া।

দুদিন চ্যাট হলো না। মন তেতো হয়ে গেছে দোলার। ফিলিপও ম্যাসেজ দিলো না। আবার ম্যাসেজ, আমাকে সাহায্য করার জন্য তুমি চেষ্টা করলে না।

– কি বলছো ডিয়ার? ইচ্ছে  করেই দোলা সম্বোধনটা করে। খেলা তো শেষ হয়ে গেছে, সন্দেহ নেই। রেফারির বাঁশি বাজুক আর নাই বাজুক।

– আমি জানতাম, তুমি আমাকে টাকা দেবে না।

– অবিশ্বাস করছো? বলেছি, আমার টাকা নেই। তোমাকে বিশ্বাস  করতে হবে আমার কথা। আর বিশ্বাসই যদি না থাকে, তাহলে বন্ধুত্বও হয় না। ভালোবাসা তো  বহু  দূরের কথা ফিলিপ।

তারপরেও কিছু কথা হলো। দমে দমে সুইটি, কুইনি, মাই লাভ, মাই ওয়াইফ, হানি, হাগিং, কিসিং সব  মিসিং হয়ে গেলো। বোঝাই গেলো, ভার্চুয়াল প্রেম খতম ‘মানি’র  অভাবে। কি  বিশ্রি একটা খেলা! এরাও  তো  এক  রকম সাইবার ক্রিমিন্যাল!

দোলা ‘ গুড বাই’ বলতে পারতো। বলেনি। নিষ্ঠুরতা হয়ে যেতো হয়তো! প্রেমের খেলা তো সেও খেলেছে। প্রেমের  সম্বোধনগুলো তো ভালো  লাগতো। দেহে মনে কেমন এক আলোড়োন তুলে দিয়েছিলো  ফিলিপের  কথা, সম্বোধন। এই বয়সে জীবনের রুক্ষ্ম বঞ্চনাকে  ক্ষনিকের জন্য হলেও রোমাঞ্চের মদির অনুভবে  নাড়িয়ে দিয়েছিলো। কদিনের রোমান্স। না চাইতে পাওয়া। তবে হেরেই তো গেছে ফিলিপ। তাহলে  আর শাস্তি দেয়া কেনো? ভব্যতাটুকু তার ক্ষনিক  আনন্দের দাম  হয়েই থাক। 

মনে মনে বলে দোলা, গুড বাই  ফিলিপ। গুড বাই অচিন বন্ধু। 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত