| 29 নভেম্বর 2024
Categories
নারী প্রবন্ধ সাহিত্য

বেগম রোকেয়া ও বাঙালি মুসলমান নারী আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট
শরীফ আহমদ
 
আজ ৯ ডিসেম্বর বাঙালি নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার জন্মদিন ও মৃত্যুদিন। বাঙালি মুসলমান সমাজে মেয়েদের শিক্ষা ও অগ্রগতির জন্য আমৃত্যু লড়াই করে গেছেন বেগম রোকেয়া।‌ বাংলা সাহিত্যেও রোকেয়ার অবদান অপরিসীম।
 
বেগম রোকেয়ার কথায় “মেয়েদের এমন শিক্ষায় শিক্ষিত করিয়া তুলিতে হইবে যাহাতে তাহারা ভবিষ্যৎ জীবনে আদর্শ গৃহিনী, আদর্শ জননী এবং আদর্শ নারীরূপে পরিচিত হইতে পারে।”
 
আজ নারীদের যে স্বাধীনতা বিশেষ করে শিক্ষা ও কর্মজীবনে নারীদের গ্রহণ ও স্বীকৃতির মানসিকতা পরিলক্ষিত হয় তা বাস্তবায়ন করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন মুসলিম নারী আন্দোলনের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া। তিনি একজন দূরদর্শী সমাজ চিন্তক, সুসাহিত্যিক এবং নিভৃতচারি সুদূরপ্রসারী রাজনীতিক‌ও ছিলেন। একা হয়ে আজীবন নারী স্বাধীনতার জন্য আপোষহীন সংগ্রাম করেছেন রোকেয়া।
 
বেগম রোকেয়া জন্মগ্রহণ করেন ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর বর্তমান বাংলাদেশের রংপুরের অন্তর্ভুক্ত পায়রাবন্দ গ্রামে। চিরাচরিত মুসলিম সমাজ ব্যবস্থা অনুসারে রোকেয়া ও তার বোনদের বাইরে পড়াশুনা করতে পাঠানো হয়নি বরং ঘরেই আরবী ও উর্দু শেখানো হয়।
 
ঐ সময়ে বাংলা শেখা মেয়েদের জন্য একপ্রকার নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু রোকেয়ার বড়ভাই ইব্রাহিম সাবের এত গোড়া মানসিকতা রাখতেন না। ইব্রাহিম গোপনে রোকেয়া ও তার ছোটবোনকে ঘরে বাংলা ও ইংরেজী শেখান। ১৮৯৬ সালে ১৬ বছর বয়সে ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট উর্দুভাষী ও বিপত্নীক সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন রোকেয়া। এরপর ওনার পরিচিতি হয় বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নামে। ভাগ্যবশত রোকেয়ার স্বামী উদারমনা ছিলেন। তিনি রোকেয়াকে সাহিত্যচর্চায় উৎসাহ দিতেন। এর ফলেই রোকেয়া বাংলা ও ইংরেজি আয়ত্ত করেন।
 
১৩ বৎসর বিবাহিত জীবনের পর ১৯০৯ সালে সাখাওয়াত হোসেনের মৃত্যু হয়। কয়েকদিন রোকেয়া একা হয়ে যান কিন্তু এর পরেই সমাজসেবা মূলক কাজে বিশেষ করে নারী শিক্ষার বিস্তার করার জন্য কাজ করা শুরু করে দেন। নিজের টাকায় সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল নামে মেয়েদের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। সম্পত্তি জনিত সমস্যা থাকায় স্কুলটি অচিরেই বন্ধ হয়ে যায়। এর পর তিনি কলকাতায় চলে আসেন আর মাত্র ৮ জন ছাত্রী নিয়ে পরের বছর কলকাতায় আবার স্কুল শুরু করেন। ধীরে ধীরে ছাত্রীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। পরবর্তীতে এই স্কুল হাইস্কুলে উন্নিত হয়। বেগম রোকেয়া সর্বশক্তি প্রয়োগ করেন স্কুল পরিচালনায়।
 
রোকেয়া অনেক কষ্ট, লাঞ্ছনা সহ্য করে ছাত্রী সংগ্রহ করতেন। স্কুল পরিচালনা করতে গিয়ে বারবার তাকে বিরূপ সমালোচনা ও প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়। সবকিছুকে মোকাবিলা ও উপেক্ষা করেই স্কুলটিকে সেযুগে মুসলমান মেয়েদের শিক্ষালাভের অন্যতম প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন। স্কুল পরিচালনা ও পাঠদানে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য বেগম রোকেয়া বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করতেন। এসঙ্গে তিনি কোলকাতার শিক্ষিত ও অভিজ্ঞ ইংরেজ, বাঙালি, ব্রাহ্ম, খ্রীস্টান সব শ্রেণীর মহিলাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। তার উদ্যোমী চেতনা, শিক্ষার প্রতি অনুরাগ আর নিষ্ঠা সবাইকেই মুগ্ধ করে। তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই ১৯১৯ সালে সরকার কলকাতায় মুসলিম মহিলা ট্রেনিং স্কুল স্থাপন করে।
 
রোকেয়া সাহিত্য ক্ষেত্রে প্রবেশ করেন ‘পিপাসা’ গল্পের মধ্য দিয়ে। Sultans Dream তাঁর এক অনবদ্য রচনা যা নারীবাদী সাহিত্যের মাইলস্টোন ধরা হয়। বেগম রোকেয়া লিখতেন ধর্মিয় ও সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আর নারী শিক্ষার পক্ষে। বাল্যবিবাহ ও বহু বিবাহ প্রথার বিরুদ্ধেও তিনি ছিলেন সবসময় সোচ্চার। তার লেখনীতে ব্যাঙ্গাত্মক ভাষায় এই সব সামাজিক ব্যাধির তীব্র সমালোচনা করতেন। তার রচনা দিয়ে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন।
 
বেগম রোকেয়া লিখেছেন “ভগিনীগণ! চক্ষু রগড়াইয়া জাগিয়া উঠুন- অগ্রসর হউন! বুক ঠুকিয়া বল মা, আমরা পশু নই। বল ভগিনী, আমরা আসবাব নই। বল কন্যে, আমরা জড়াউ অলংকার-রূপে লোহার সিন্দুকে আবদ্ধ থাকিবার বস্তু নই; সকলে সমস্বরে বল, আমরা মানুষ।”
 
বেগম রোকেয়া ছিলেন প্রথম মুসলমান বাঙালি মহিলা যিনি নারীর প্রাপ্য সম্মান ও অধিকার আদায়ের প্রথম সামাজিক আন্দোলন শুরু করেন। রোকেয়ার কথায় “আমরা উত্তমার্ধ, তাহারা নিকৃষ্টার্ধ, আমরা অর্ধাঙ্গী, তাহারা অর্ধাঙ্গ। অবলার হাতেও সমাজের জীবন-মরণের কাঠি রহিয়াছে। যেহেতু না জাগিলে সব ভারত ললনা, এ ভারত আর জাগিতে পারিবে না। প্রভুদের ভীরুতা কিংবা তেজস্বীতা জননীর ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। তবে শারীরিক বলের দোহাই দিয়া অদূরদর্শী মহোদয়গণ যেন শ্রেষ্ঠত্বের দাবী না করেন।”
 
১৯১৬ সালে বেগম রোকেয়া ‘আঞ্জুমানে খাওয়াত নে ইসলাম’ বা মুসলিম মহিলা সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর জীবনব্যাপী সাধনার অন্যতম ক্ষেত্র এই মহিলা সমিতি। ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর মাত্র ৫২ বছর বয়সে রোকেয়ার মৃত্যু হয়। রোকেয়া পেছনে রেখে গেছেন অজস্র লেখালেখি ও অফুরান নারীবাদী চেতনা। বাংলাদেশের নারী আন্দোলনে যে মহিলারা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছেন তাদের বেশিরভাগই রোকেয়া স্কুলে পড়া আর ওনার লেখায় অনুপ্রাণিত। এই দিনটিতে বাংলাদেশ সরকার এই মহিয়সীর অবিস্মরণীয় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে উপযুক্ত মহিলাদেরকে তাদের অবদানের জন্য বেগম রোকেয়া পদক প্রদান করে।
 
(তথ্যসূত্র ইন্টারনেটের একাধিক সোর্স থেকে নেওয়া)

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত