Categories
রোকেয়ার নারীবাদ, রোকেয়ার বিপ্লব । কুদরত-ই-হুদা
আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
রামমোহন রায় আর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রযত্নে বাঙালি হিন্দু নারীর জীবন ও প্রাণ দুইই যখন রক্ষা পেল, তখন প্রয়োজন পড়ল নারীর মানসিক মুক্তির। কারণ, বাইরের সহানুভূতি ও সাহায্যে আর কতদিন! নারীর নিজের পায়ে দাঁড়ানো দরকার, নিজের আলোয় পৃথিবীটা দেখা প্রয়োজন। নারীরও যে একটা স্বতন্ত্র স্বর আছে তা জাগানো দরকার। এ জন্য এগিয়ে এলেন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (৯ ডিসেম্বর ১৮৮০—৯ ডিসেম্বর ১৯৩২)। তিনি প্রয়োজন অনুভব করলেন নারী শিক্ষার। গুরুত্ব দিলেন নারীর অর্থনৈতিক মুক্তির ওপর। এ যেন ইতিহাসের দারুণ এক পরম্পরা। একেই বুঝি বলে ইতিহাসের দায়ের মশাল দৌড়। রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগরের হাত ঘুরে নারীকল্যাণের মশালটি বহনের দায়িত্ব এসে পড়ল রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের মতো দীর্ঘ দম আর শক্ত হাতের মানুষের কাছে।
প্রথম দুজন কাজ করেছিলেন রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের নারীর জন্য। আর রোকেয়া তৎপর হলেন রক্ষণশীল ও পশ্চাৎপদ মুসলমান সমাজের নারীর অন্তর–বাহিরের উন্নয়নে। রোকেয়ার ভাবনার দিগন্ত অনেক ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান-পূর্ব-পশ্চিম—সব সমাজকেই কোলাকুলি করেছে। শুধু তাই নয়, নারীকে রামমোহন বা বিদ্যাসাগরের মতো সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখেননি রোকেয়া, নারী জাতিকে তিনি আপন শক্তিতে দাঁড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন। অর্থাৎ পরবর্তী প্রজন্মের মানুষ হিসেবে রোকেয়া পূর্বজদের থেকে এখানেই প্রগতিবর্তী।
নারীর অধিকার নিয়ে যিনি কথা বলেন তিনি নারীবাদী, সন্দেহ নেই। এই অর্থে রোকেয়া অবশ্যই নারীবাদী। কিন্তু তিনি কি নারীবাদী তত্ত্বদর্শন দ্বারা প্রভাবিত নারীবাদী ছিলেন, নাকি নারীবাদী তত্ত্বদর্শনের গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি নির্মাণ করেছেন—রোকেয়াকে বোঝার জন্য এটি এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বটে। রোকেয়ার রচনা ও চিন্তার পদ্ধতি থেকে বোঝা যায়, বাইরের তত্ত্ব-দর্শনের ধার কোনোকালেই সেভাবে ধারেননি তিনি। তাঁর নারীবাদী ভাবনা ওপর থেকে নিচে নামেনি বরং নিচ থেকে উঠে গিয়েছে ওপরের দিকে। রোকেয়া প্রণীত অবরোধ-বাসিনী (১৯৩১) বইয়ের ভূমিকা লক্ষ করলে বিষয়টি বোঝা যাবে। এখানে তিনি বলেছেন, ‘কতগুলি ঐতিহাসিক ও চাক্ষুষ সত্য ঘটনার হাসি-কান্না লইয়া “অবরোধ-বাসিনী” রচিত হইল।’ এই মহিয়সী নারী বাইরের দেশে চালু নারীবাদী ভাবনার ছকচিত্রের মধ্য দিয়ে বাংলার নারীদের সমস্যাকে দেখেননি, বরং বঙ্গদেশের নারীসমাজকে প্রত্যক্ষ করার মধ্য দিয়ে বিশ্ব নারীবাদী তত্ত্বদর্শনকে ঋদ্ধ করেছেন। চারপাশের নারীসমাজকে তিনি দেখেছেন দরদি হৃদয় ও যুক্তিবাদী মন দিয়ে। আর এভাবেই সামাজিক বাস্তবতার নিরিখে তৈরি করেছেন নারী মুক্তির প্রশস্ত পথ। এখানেই রোকেয়ার নারীবাদী ভাবনার অনন্যতা।
নারীকে জাগানোর ভাবনা ভাবতে গিয়ে রোকেয়া প্রথমেই খেয়াল করলেন যে, বাঙালির ভাবনাচিন্তায় বাঙালি নারী প্রায় অনুপস্থিত। তাকে সক্রিয় সত্তা হিসেবেই ভাবা হয় না। অন্তঃপুর, রন্ধনশালা আর কবিতাকল্পনালতায় ছাড়া আর কোথাও সেভাবে তার অবস্থান নেই। নারী যে সমাজের অর্ধেক শক্তি, এই শক্তি অব্যবহৃত থাকার ফলে একটি জাতি যে পিছিয়ে পড়ে, এই কথা বাঙালি পুরুষ সমাজে তখনো কেউ খুব একটা গ্রাহ্য করতেন না। তবে রোকেয়া বারবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চেয়েছেন যে সমাজটা দুই চাকার গাড়ির মতো। প্রবন্ধগ্রন্থ মতিচূর-এ তিনি লিখছেন, ‘যে শকটের এক চক্র বড় (পতি) এবং এক চক্র ছোট (পত্নী) হয়, সে শকট অধিক দূরে অগ্রসর হইতে পারে না; সে কেবল একই স্থানে (গৃহকোণেই) ঘুরিতে থাকিবে। তাই ভারতবাসী উন্নতির পথে অগ্রসর হইতে পারিতেছে না।’ প্রায় একই ধরনের বক্তব্য তিনি দিয়েছেন ‘সুগৃহিণী’ নামের প্রবন্ধে। কিন্তু এখানে তাঁর কথার সুর বেশ চড়া, ‘একচক্ষুবিশিষ্ট ব্যক্তিকে লোকে কানা বলে।’
একটা রক্ষণশীল সমাজের ভাবনা-কাঠামোকে এভাবে আঘাতের পর আঘাত করাকে বিপ্লবী কর্মকাণ্ড হিসেবেই চিহ্নিত করতে হবে বইকি! সমাজের ভাবনার ছককে নাড়িয়ে দিয়েই রোকেয়া একের পর এক আঘাত করেছেন নারী-পুরুষের অসমতার ঘাঁটিগুলোতে।
তাঁর প্রথম আঘাত ছিল শিক্ষার দুর্গে। সেকালে, মানে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকেও, শিক্ষায় ছিল পুরুষের প্রায় একক অধিকার। নারীশিক্ষা বিষয়ে তখনো অধিকাংশের ধারণা ছিল এই যে, ‘স্ত্রীলোকদের উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন নাই। মেয়েরা চর্ব্ব্য, চোষ্য রাঁধিতে পারে, বিবিধ প্রকার সেলাই করিতে পারে, দুই-চারি খানা উপন্যাস পাঠ করিতে পারে, ইহাই যথেষ্ট।’ এ কারণে নারীদের শিক্ষার জন্য তেমন প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাও ছিল না। তৎকালেই রোকেয়া বুঝেছিলেন, নারীর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার এই শোচনীয় অবস্থার পরিবর্তন রাতারাতি সম্ভব নয়। আবার নারীশিক্ষা বিষয়ে সমাজের মনোভঙ্গির পরিবর্তনও এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। ফলে খোদ শিক্ষার সংজ্ঞাটি তিনি দিলেন পাল্টে। আর এতে তিনি অগ্রাহ্য করলেন প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষাকে। রোকেয়া নারীকে শিক্ষা নিতে বলেছেন বটে, তবে সেটি কোন শিক্ষা! রোকেয়ার ভাষায়, ‘ঈশ্বর যে স্বাভাবিক জ্ঞান বা ক্ষমতা (faculty) দিয়াছেন, সেই ক্ষমতাকে অনুশীলন দ্বারা বৃদ্ধি (develop) করাই শিক্ষা।…আমরা কেবল “পাশ করা বিদ্যা”কে প্রকৃত শিক্ষা বলি না।’ শিক্ষার এই সংজ্ঞায়নের মাধ্যমে পুরুষতন্ত্রের কবলে থাকা শিক্ষাকে নারীর মানসিক উন্নতির জন্য অনাবশ্যক জ্ঞান করলেন রোকেয়া। তাঁর নারীশিক্ষার এই প্রস্তাবনাকে বিপ্লবী প্রস্তাবনা ছাড়া আর কী বলা যায়!
শুধু শিক্ষার দুর্গে নয়, বিংশ শতাব্দীর একেবারে প্রথম পাঁচ বছরের মধ্যেই রোকেয়া বিপজ্জনক ঢিল ছুড়েছিলেন বিভিন্ন বিধিবিধানের মৌচাকে। এসব বিষয়ে তিনি অবশ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে চকিতে ঢিল ছুড়ে ছুট দিয়েছেন। কিন্তু তাতে ধরাশায়ী হয়েছে বিরাট বিরাট বিধান। প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে গোটা একটা ব্যবস্থা। যেমন রোকেয়া প্রশ্ন তুলেছেন পৈতৃক সম্পত্তি বণ্টনব্যবস্থা নিয়ে। তিনি মনে করেন, সম্পত্তি বণ্টনের ব্যবস্থার মধ্যে নারী-পুরুষের অসমতার বীজ, অর্থাৎ পুরুষতান্ত্রিকতার আসর আছে। সেখানে নারীকে খাটো করার যথেষ্ট মনোভঙ্গি লক্ষ করা যায়। রোকেয়ার সংক্ষিপ্ত কিন্তু নির্মম খোঁচাটি লক্ষ করা যাক, ‘আমরা পুরুষের “অর্দ্ধেক”, অর্থাৎ দুইজন নারী একজন নরের সমতুল্যা। অথবা দুইটি ভ্রাতা ও একটি ভগিনী একত্র হইলে আমরা “আড়াই জন” হই!’
সম্পত্তির অধিকার দিয়ে মানুষকে মাপার মতো চিন্তা বিপ্লবী চিন্তাই বটে। সম্পত্তি যার, উপার্জন যার, স্বাধীনতা ও মুক্তিও তার এই তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন রোকেয়া। স্বকাণ্ডজ্ঞান থেকে তিনি এই উপলব্ধিতে এসেছিলেন যে, সম্পত্তির ওপর একচ্ছত্র অধিকারের বলেই পুরুষকুল নারীর ওপর ‘স্বামীত্বের’ (পড়ুন: প্রভুত্বের) ছড়ি ঘোরায়। তাই তাঁর ভাষ্য, ‘পুরুষের সমকক্ষতা লাভের জন্য আমাদিগকে যাহা করিতে হয়, তাহাই করিব। যদি এখন স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জ্জন করিলে স্বাধীনতা লাভ হয়, তবে তাহাই করিব।…যে পরিশ্রম আমরা “স্বামী”র গৃহকার্য্যে ব্যয় করি, সেই পরিশ্রম দ্বারা কি স্বাধীন ব্যবসায় করিতে পারিব না?’
নারীর মুক্তির জন্যে এমন কোনো অস্ত্র নেই যা রোকেয়া ব্যবহার করেননি। তিনি জানতেন ধর্মীয় কুসংস্কারের আঁধারে ঘুরে মরা বাঙালি মুসলমান সমাজ নারীকে পর্দার দোহাই দিয়ে কীভাবে অবরোধবাসিনী করে রাখতে চায়। ফলে অবরোধপ্রথাকে ভাঙতে তিনি আশ্রয় নিলেন বাস্তবের করুণ কাহিনির, রচনা করলেন অবরোধ-বাসিনী। এ ছাড়া সুলতানার স্বপ্ন ও পদ্মরাগ (১৩৩১) গ্রন্থেও তিনি দেখিয়েছেন যে পর্দা নারীর কর্মমুখী হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নয়।
নারীর সার্বিক মুক্তির জন্য রোকেয়া সারা জীবন লেখনীর মাধ্যমে যে সংগ্রাম করেছেন, তার অধিকাংশই লিখেছেন বাংলা ভাষায়। এটাও তাঁর জন্য এক বিপ্লবী অবস্থানই বটে। কারণ, তাঁদের পারিবারিক ভাষা বাংলা ছিল না। শিক্ষার ভাষা ছিল আরবি, ফারসি ও উর্দু। বাবা ও আত্মীয়স্বজনের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাংলা শিখেছিলেন তিনি। কারণ, এটি জানতেন যে, তিনি যাদের মুক্তির জন্য লিখেছেন, তারা সব বাংলাভাষী। এই ভাষাতেই তাঁকে কাজ করতে হবে। রোকেয়া তা-ই করেছিলেন। চোস্ত ইংরেজিও জানতেন তিনি। তাঁর ইংরেজির প্রশংসা খোদ ইংরেজরাই করতেন। কেউ কেউ বলেছেন, রোকেয়া এত ভালো ইংরেজি জানতেন যে সে রকম ইংরেজি কোনো বিলাতফেরত পুরুষ জানলে রীতিমতো শ্লাঘা অনুভব করতেন। তবু তিনি ইংরেজিতে লেখেননি। ১৯০৮ সালে সুলতানাস ড্রিম নামের উপাখ্যানটি প্রথমে ইংরেজিতে লিখে আবার নিজেই সেটি সুলতানার স্বপ্ন নামে বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন রোকেয়া। কারণ, তাঁর লক্ষ ছিল বাঙালি সমাজ। রোকেয়ার নারীমুক্তি-সম্পর্কিত চিন্তা ছিল আমাদের ঠিক উল্টো। কোনো তত্ত্ব দ্বারা শাসিত হয়ে নারীর উন্নয়নের কথা রোকেয়া ভাবেননি, বাংলা ভিন্ন অন্য ভাষায় তো নয়ই।
নিজের লেখনী ও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে নারী সমাজের মননে আর চোখে রোকেয়া ফোটাতে চেয়েছেন জ্যোতির্ময় আলো। বলা বাহুল্য, সেই আলো কোথাও থেকে ধার করা নয়, তাঁর একান্ত নিজস্ব। আর এই তাঁর নিজস্বতার মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যাবে রোকেয়ার বিপ্লব ও নারীবাদের স্বরূপ।