অমর্ত্যলোক
বেহুলা বাসরে ঢোকার আগেই সর্পনিবারণ কল্পে পালঙ্কের চারটি পায়ায় চারটি নকুল বেঁধে রেখেছিল। তখন সে ছিল অন্যমনা। কিন্তু এখন সে তার দীর্ঘ কেশ ঝুলিয়ে দিয়ে পালঙ্কের কোন ঘেঁষে শুয়ে পড়লো।
মূহুর্তে তার ইচ্ছা (মনসা!) অনুসরণ করে কেশরজ্জু বেয়ে উঠে এলো মনিয়ার নামক এক সর্প।
-মা, আমাকে স্মরণ করেছেন কেন?
-শোনো মনিয়ার, এই শবাসন আশ্রিত পুরুষটিকে তুমি দংশাবে, কিন্তু খাবেনা। লিঙ্গ ব্যতিরেকে অন্য সব অক্ষত রাখবে, যাতে আর কোনো জন্মে কক্ষনো কোনো অরমনীয়াকে রমন করতে না পারে।
মনিয়ার পড়লো মহাসঙ্কটে।
-কিন্তু মা, এভাবে তো ক্ষেত্র নির্দিষ্ট করে কোনো পুরুষের যৌন ক্ষমতাকে কেড়ে নেওয়া সম্ভব নয়। পত্নী ছাড়া আর কারো সাথে সে রতিলিপ্ত হতে পারবে না, এমন ব্যবস্থা করা অসম্ভব।
-তবে যেভাবে সম্ভব, সেভাবেই করো।
-তাতে যে আপনারই জীবন ছারেখারে যাবে মা। ‘কাম’ই যে তাবৎ কর্মক্ষমতার উৎস। কাম ছাড়া যে মা সৃজন অসম্ভব। তাছাড়া “মা” হতে না পারলে যে নারী জীবনের সার্থকতা…
-থামো মনিয়ার, থামো। এই পৃথিবীতে কাউকে নির্ভর করে কখনোই কারো কোনো সার্থকতা কোনোদিনও আসেনি। আসবেও না কখনো কোন দিন। এ জগতের প্রতিটি ক্ষুদ্রস্য ক্ষুদ্র জীবেরও বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় নিজস্ব পর্যাপ্ত পরিসর সুনির্দিষ্ট আছে। ও নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। যা বলছি, করো।
তবুও মনিয়ার কাঁচুমাচু করতে থাকলো,
-কিন্তু মা, এই বাসরঘটনা যখন চার দেওয়ালের সীমানা টপকে প্রতীকী ব্যঞ্জনা নিয়ে বৃহত্তর লোকসমাজে পৌঁছবে…।
-চিন্তা কোরোনা মনিয়ার। ভবিষ্যের নারীকূলে আর কেউই কখনো বাধ্যতার ভাত রেঁধে কাউকে তুষ্ট করতে যাবে না। লোহার মাছ- কলাই সেদ্ধ করে দেবার অপমানজনক ইন্টারভিউ দেবে না। লোহার বালা পরে পলকা পুরুষকে দৃঢ়ভাবে বেঁধে রাখার হাস্যকর চেষ্টা করবে না। সর্পসোপানরূপী দীর্ঘ কেশদাম, সুদীর্ঘ বসনাঞ্চল সর্বাংশে পরিত্যাগ করবে, মা হবার জন্যেও আর সঙ্গমের প্রয়োজন পড়বেনা। যাও মনিয়ার, আর কালক্ষেপ কোরোনা। দংশাও, এবং বাসর ছেড়ে চলে যাও।
চুল,
এক কুল খায়
পরদিন সকালে, সহযাত্রার প্রাক্কালে, ভাই সুমতি রামকলার মঞ্জুষ থামিয়ে তাকে পিতৃগৃহে ফিরে যেতে অনুরোধ করলে শান্তস্বরে বেহুলা জানালো,
” ভবনের বার্তা মোর কিছু নয় হারা।
বিষম বনিতা সব তোমাদের দ্বারা।।
বাজিলে কোন্দল বড় সবে দিবে গালি।
বাসরে ভাতার খেয়ে হেথা কেন আলি।।”
-কিন্তু বোন, তোর ঘর, তোর সংসার…
-কার ঘর! আর কিসেরই সংসার! আমি তো সর্বযুগেই চির অনিকেত। কখনো সীতা হয়ে পালিয়ে বেঁচেছি আঁধার পাতালে, কখনো সাবিত্রী হয়ে ‘স্বর্গ’ মিথ্ এর অবিশ্বাস্যতায়, কখনো সতী হয়ে খন্ডে খন্ডে খাদ্য হয়েছি পশু- পক্ষী- ইতর প্রাণীর। এমন সর্বকেলে সর্বগ্রাসী ভাঙনের কুলে বসে, কেবলই
‘ ঘর’ ‘ঘর’ করে সাতজন্ম, তিনকাল, চব্বিশটি প্রহর এই যন্ত্রনাময় যন্ত্রসংসারে এতো যে ঘর্ঘর করে মরলাম, সত্যি তার অর্থ ছিল কোনো?
টুকরো করে কাছি, আমি ডুবতে রাজি আছি কিন্তু কার সঙ্গে? এই শবকে কি স- ব ভাবতে পারা সম্ভব?
চিন্তা মাত্রে উত্তাল হয়ে উঠলো জলতল, গর্জন ধেয়ে এলো তরঙ্গে তরঙ্গে, জলদ গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন রাখলো লখীন্দর
-তুমি তাহলে এ্যাতো কান্ডে জলে ভাসলে কেন?
-কি জানি। তখন যেন মনে হয়েছিল তোমাকে নিজের হাতে নাড়বো, চাড়বো, সেবা করবো, যত্ন করবো, আর -আর ভালবাসবো খুব।
-এখন আর তা মনে হচ্ছে না?
-তাও ঠিক জানি না। (হঠাৎই সম্বিত ফিরে পেয়ে) কিন্তু ইতিমধ্যে যে ঘটে গেছে মাত্রাহীন ভাঙন। আমি তো প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তোমাকে ফিরিয়ে দিতে পিতৃ-মাতৃক্রোড়ে, আর স্বয়ং বয়ে যেতে নদী হয়ে এই জনপদে।
-বড়ো কঠিন, বড়ো অহংকারী মেয়ে তুমি। সংসারের উপযুক্ত নও। বয়ে যাওয়া নারী আর ক্ষয়ে যাওয়া নদী, দুই -ই বড়ো বিষম আঁধার।
ছিলা কেটে বেরিয়ে যাওয়া তির যেমন আর তুনীরে ফেরে না, সংসার বাহুল্য বোধে সে মেয়েও আর ঘরে ফিরলো না। নিঃশব্দে সে বয়ে চললো বল্বুকা নাম ধরে চম্পাইনগর গাঁয়ের কাঁকাল জড়িয়ে দেশ বাংলাময়। জনপদ বাঁধা গৎ এ সতীপীঠ – সীতামন্দির- সাবিত্রীকুন্ডের ঢঙে বেহুলার থান গড়েছে। সংসার পায়ে -ঠেলা- নারী পূজার যোগ্য হ’ন।
দশহরার দিন বঙ্গদেশ জুড়ে বিষহরির সঙ্গে পূজিতা হ’ন বেহুলা ও। বেহুলার বাসর স্মরণে সধবা নারীরা স্বামীকে ছেড়ে পিতৃগৃহে একরাত কাটান। গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে পালিত হয় ‘অরন্ধন ‘ ব্রত। গৃহস্থ জনেরা কেউ আগুন ছোঁন না, গরম খাবার খান না, কোনো ডিমের খোলা ভাঙেন না, বিউলির ডাল- কচু- ঢেঁড়শ- পুঁইশাক এসব ল্যালপেলে খাবার খান না, আর আশ্চর্য বিধিবদ্ধ নিয়ম মেনে অবধারিত স্বর্গ থেকে নেমে আসবে পুষ্পবৃষ্টির মতো বিশ্বপ্রাণের বীজবাহী অবারিত বরিষণ ধারা। সূচিত হয় বৃহৎবঙ্গে সৃজনময়তার ঋতু বড়ো ভরসার বরোষা।
তারও বেশ পক্ষকাল পরে, জলে টম্বুর সে নদীর স্পর্শসুখ চেয়ে যখন নিঃশব্দ আনমনায় বইতে চাইবে বাউল স্বভাবী কোনো ব্যাকুল বাতাস, আঁধিয়ার মন্ডিত গভীর গহীন নির্জনতম অরণ্য তার ঝরা পাতার হা- হা- স্বরে সূদুর অন্তর্লোক থেকে বয়ে আনতে থাকবে মায়াবী উতলা এক ভিন্নতর সুরেলা উচ্চারণ।
আমাদের এই গ্রামের নামটি বিহ্বলা,
আমাদের এই নদীর নামটি বল্বুকা,
তাহার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচজনে
আমাদের সেই মেয়ের নামটি বে হু লা।।
লেখক