শ্রাবণের সাপ আর শাপের দাপট রুখে দেওয়ার কীর্তিময়ী ব্যক্তিত্বের নাম বেহুলা। লখীন্দরের বউ, আর চাঁদ বনিকের বউমা।
কিন্তু সব শুরুরই নিশ্চিত আরো খানিক শুরু থেকেই যায়।সেই শুরুর কথা কই।
পূর্বকথা
দেবী মনসা দেবরাজ ইন্দ্রকে সুকৌশলে বশ করে ইন্দ্রসভার নর্তক দম্পতি অনিরূদ্ধ- ঊষাকে বাধ্য করলো মনুষ্য যোনিতে জন্মগ্রহণ করতে। ইন্দ্রের অভিশাপে চম্পক নগরে চাঁদ সদাগর ও সনকার পুত্র লখীন্দর হয়ে জন্মালো অনিরূদ্ধ, আর উজানী নগরে সাধু বনিক ও সুমিত্রার কন্যা বেহুলা হয়ে জন্মালো ঊষা।
শুরু হলো অভিশাপের অন্তহীন কাহিনির অন্তর্লীন বহমানতা। প্রেম ও অভিশাপ কীভাবে যে তাড়া করে ফেরে যুগ থেকে যুগান্তরে, লোক থেকে লোকান্তরে, জন্ম থেকে জন্মান্তরে তা তিন ভুবনের কথায় আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়ে গেছে।
তিন ভুবনের বৃত্তান্ত
(১)স্বর্গলোক
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ জানাচ্ছে, কৃষ্ণ ও রুক্মিণীর পুত্র প্রদ্যুম্নের পুত্রের নাম অনিরূদ্ধ এবং বলি রাজার পুত্র বান রাজার কন্যা ঊষা।
তো, মহাদেব ও উমার কামক্রীড়া দেখে ফেলে কুমারী ঊষা চঞ্চলা হয় তখন উমা তাকে জানান, “তুমিও অচিরেই তোমার পতির সঙ্গে কামক্রীড়ায় মিলিত হতে পারবে।বৈশাখ মাসে শুক্লা দ্বাদশীতে তুমি যাকে স্বপ্নে দেখবে, সেই তোমার পতি হবে।”
উমার কথামতো ঊষা স্বপ্নে এক অনিন্দ্যসুন্দর পুরুষকে দেখতে পেলো ও আসক্ত হয়ে তাকে কামনা করলো। তখন সখী চিত্রলেখা ঊষার মুখে বর্ননা শুনে দেবতা, গন্ধর্ব, দৈত্য ও মানুষের মধ্যে যারা কীর্তিমান পুরুষ তাদের ছবি পটে এঁকে দেখালে, ঊষা চিহ্নিত করলো অনিরূদ্ধকে।সখী চিত্রলেখা তার যোগ বিদ্যাবলে অনিরূদ্ধকে অন্তঃপুরে ঊষার কাছে এনে তাদের মিলন ঘটালো। কিন্তু ঘটনা গোপন রইলো না। জানাজানি হতেই যুদ্ধ বেধে গেল বাণ রাজা এবং কৃষ্ণ-বলরামের মধ্যে।
বাণ রাজার দশ হাত কেটে ফেলে ঊষা-অনিরূদ্ধকে নিয়ে কৃষ্ণ-বলরাম দ্বারকায় ফিরে গেলেন।
অনিরূদ্ধ এমনই এক ঝকমারি চরিত্রের পুরুষ। যতবার বিয়ে করেছে, ততোবারই শ্বশুরকুলের সঙ্গে ধুন্ধুমার যুদ্ধ। ইতিপূর্বেই ইনি নিজ পিতার অনুসরণে নিজের মামাতো বোনকে বিয়ে করেছিলেন। সেবার অনিরূদ্ধের পক্ষে কৃষ্ণ-বলরামের হাতে নিহত হন স্বয়ং রুক্মি। সম্পর্কে যিনি কৃষ্ণপত্নী রুক্মিণীর সহোদর ভাই। কৃষ্ণপুত্র প্রদ্যুম্নর আপন মামা এবং শ্বশুর, কৃষ্ণপৌত্র অনিরূদ্ধের মাতামহ এবং দাদাশ্বশুর।
তো উমা-মহাদেবের কামক্রীড়া দর্শনে বিহ্বলা (পরজন্মের বেহুলা) ঊষা সম্ভবত সুস্থ মস্তিষ্কে ছিল না। সে কারণেই এমন এক বহু বিবাহিত পুরুষকে কামনা করে বসার মতো আত্মঘাত করে বসেছিল। বিহ্বলা বালিকা আদপেই বোঝেনি যে, এই বহুবল্লভ পুরুষটি কোনো জন্মে কস্মিনকালেও তার আপনারটি হবে না।
তবে! তবে ইন্দ্রের শাপে কিন্তু বরই হলো।অভিশাপ পাওয়া মাত্রই ঊষা অনিরূদ্ধকে বগলদাবা করে সটান একেবারে মর্ত্যলোকে।অগুনতি রূপবতী, গুনবতী, সন্তানবতী সপত্নীরা ড্যাবড্যাব করে চেয়ে চেয়ে দেখলো, আর নিজেদের আঙুল কামড়ালো। কি করেই বা তারা পিছু ধাওয়া করবে অনিরূদ্ধের! একচোখো সহস্রাক্ষ যে বেছে বেছে ঊষাকেই অভিশাপটি উপহার দিলো!
(২) মর্ত্যলোক
“মর্ত্যে বাপু লোকে মরতেই আসে। চিরটিকাল টিঁকে থাকার হ্যাপা নেই এখানে। যে কটাদিন বাঁচো,রসে বশে বাঁচো।” স্বর্গ থেকে সাঁ সাঁ করে নেমে আসতে আসতে ঊষা পাখি-পড়া করে বোঝাচ্ছে অনিরূদ্ধকে, “দ্যাখো, মর্ত্যে গিয়ে যতদিন না আমাদের আবার সাক্ষাৎ হচ্ছে, আলপটকা আবার কাউকে জুটিয়ে নিও না প্লিজ। বহু কষ্টে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে তোমাকে উদ্ধার করে এনেছি।”
আঁতে ঘা লাগলো অনিরূদ্ধের, “তুমি উদ্ধার করে এনেছো, মানে?”
“মনসার ইচ্ছেতেই তো ইন্দ্রদেব অভিশাপটি দিলেন। ‘মনসা’ মানে কি? মন জাত ইচ্ছাই তো! আমার ইচ্ছে না হলে নাচে তালভঙ্গ হতো? “
-কিন্তু আমার যে দেহগলে যাবার অভিশাপ জুটলো?
ঊষার মুখ ফস্কে বেরিয়ে যাচ্ছিলো কটু সত্যি কথা, কিন্তু কঠোর সংযমে সে গিলে ফেললো তা। আহ্লাদী স্বরে উচ্চারণ করলো, -আহা শব্দার্থে ধরছো কেন, ভাবার্থে ধরো। আমার প্রেমে তো তুমি সত্যি সত্যিই গলবে। ঠিক যেমন আগুনে গ’লে ঘি। এই তো! এইতো এসে পড়েছি পৃথিবীতে। বাই… ভুলোনা যেন!ভুলোনা আমাকে। ভুলোনা…।
কে কার কথা রাখে!
যুবক লখীন্দর একদিন গঙ্গায় ছিপ ফেলে তুললো এক বিশাল লোহার মাছ। গঙ্গা জানালেন, তোমার বাবা যখন তোমার বিয়ের পাত্রী খুঁজতে যাবেন, তখন তাঁর সঙ্গে এই মাছটা দিয়ে বোলো যে, যে কন্যা এই লৌহমৎস্য স্বহস্তে কেটে লৌহকলাই যুক্ত করে রন্ধন করতে পারবে, তার সঙ্গেই যেন তোমার বিবাহ স্থির করা হয়।
মেঘে মেঘে বেলা বাড়ে। লখীন্দরের মা কিছুতেই ছেলের বিয়ে দিতে চায় না। ছেলের যে বিয়ের রাতেই মৃত্যুযোগ। বাধ্য হয়ে মনসা তখন লখীন্দরের মনে কাম উদ্দীপনা দিল।আর সেও অমনি (পূর্বজন্মের পিতৃপুরুষ কৃষ্ণের অনুকরণে) সটান গিয়ে আপন মামী কৌশল্যাকে ধর্ষণ করলো।
আর কালক্ষেপ না করে, চাঁদ সদাগর মাথা নীচু করে পাত্রীর সন্ধানে বেরোলো।
অতি সাধারণ এক গ্রাম্য মুরুব্বির বেশ ধরে, হাতে একটি লম্বা লাঠি, আর লোহার মাছ কলাই বাঁধা গামছাটা পিঠে ফেলে একা একাই পাত্রী খুঁজতে খুঁজতে উজানী নগরের প্রান্তে এক নদীর তীরে এসে দাঁড়ালো চাঁদ সদাগর। চাঁদকে দেখে মনসাও তখন বুড়ীর ছদ্মবেশ ধরে উল্টো দিকের ঘাটে এসে বসলো।
সে ঘাটে তখন বেহুলা পঞ্চসখীকে নিয়ে নাইতে নেমেছে। চাঁদ নদীর ওপার থেকে হাঁক দিয়ে শুধালো, -ও মেয়েরা, একটু যে ওপারে যেতে হবে, তা এ নদীর জল কতোটি?
বেহুলা তার এক সখীকে ওপারে পাঠালো চাঁদকে সাহায্য করার জন্য। মেয়েটি সাঁতরে ওপারে পৌঁছুতেই চাঁদ আবারও জলের গভীরতা জানতে চাইলো।
মেয়েটি বললো, আপনার সঙ্গে যে আছে, তাকেই জিজ্ঞেস করুন না।
চাঁদ তো অবাক। তার সঙ্গে তো কেউ নেই।
মেয়েটি তখন তাকে খেই ধরিয়ে দিল, আপনি যার ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, তার কথা বলছি।
শুনে চাঁদ চমৎকৃত। তাইতো! লাঠিটা সামনে ফেলে এগুলেই তো জলের মাপ ঠাওর করা যায়। চাঁদ তখন তাই করলো। মেয়েটিও পাশে পাশে সাঁতরে চললো। চলতে লাগলো আলাপচারীতা।
-তোমার বাবা কি করেন মা?
-বাবা তো নানা রকম কাজ করেন। তবে আজ গেছেন সুয্যিকে চাপা দিতে।
চাঁদ আবারও ভ্যাবাচ্যাকা খেলো। সামলে নিয়ে আবার শুধালো, -তা, তোমার মা আছেন তো বাড়িতে?
-না না, মা তো গেছেন একটাকে দুটো করতে।
এইবারে চাঁদ বেশ মুষড়ে পড়লো। মেয়েটিকে বেশ চোখে ধরেছিল তার কিন্তু এ মেয়ে তার ঘরের উপযুক্ত নয়। এর বাবা ঘরামি, আর মা দাইয়ের কাজ করে। আচ্ছা! দেখা যাক। যদি এর ভাইদের কোনো মুখ – উজোলা অবস্থান থাকে। –
হ্যাঁ গো মা, তোমার দাদারা কী কাজকর্ম করেন?
-আমার তো একটিই দাদা। তিনি গেছেন আজ কাঁটা দিয়ে কাঁটা ঢাকতে।
চাঁদ এ ধাঁধারও অর্থভেদ করে বুঝে নিলো, মেয়েটির দাদা গেছে কাঁটাবেগুনের খেতে কাঁটাবেড়া দিতে। চাঁদ আবারও কষ্ট পেলো, নাহ্। এ মেয়ে তার পাল্টি ঘরের নয়।
নদী পেরিয়ে চাঁদ সাধুবেনের প্রাসাদে গেল।বেহুলাও স্নান সেরে ভিজে কাপড়ে উঠে আসছিল। ভেজা চুলের এক ফোঁটা জল লেগেছে কি লাগেনি, শাপ দিল মনসা,- “বিভা রাত্রে খাইবি ভাতার।”
জাতিস্মর বেহুলা মনসাকে চিনলো।
অকারণে অভিশপ্তা হয়েও সে খুব কিছু বিহ্বলা হলো না কারণ সে তো জানেই যে, বারো বছর পন্ডিতি করলে গাধা হয়, আর জন্মে ইস্তক দেবীত্ব খুঁজলে সাপ হয়। আর সাপ শাপ দেবে না তো আর কি বা দেবে!নিজের বাপ-মা-সৎমা- সমাজের লোকজন মায় স্বামীটি পর্যন্ত শাপ ছাড়া আর কিছুই তো তাকে দেয়নি! আর ঝুলিটি যার কেবলই খোটা সিক্কায় ভরা, সোনার মোহর সে দেবে বা কোত্থেকে!
মায়া হোলো তার মনসার জন্য। দেবীকে প্রণাম করে হাসিমুখে সে বাড়ি ফিরে গেলো।তারপর নিজে হাতে লৌহমৎস কেটে লোহার কলাই সহযোগে কাঁচা মাটির হাঁড়িতে রান্না করে দিলো।
যে পরীক্ষায় পাশ করলেও কিছু হয় না, ফেল করলেও কিছু হয় না, সেই পরীক্ষাটাই খুব সিরিয়াসলি দিলো। চাঁদ অমনি খেয়ে দেয়ে, বিয়ের দিন ঠিক করে, লগ্নপত্র তৈরি করে হৃষ্টমনে বাড়ি ফিরে গেল।
ফিরে গিয়েই তৈরি করলো, গায়ে হলুদের তত্ত্বের সাথে পাঠালো বাঁ হাতের লৌহবলয় (নোয়া)। প্রকারান্তরে চাঁদ বেহুলাকে আগাম জানান দিয়েই রাখলো, “লোহার চেয়েও কঠিন অদৃষ্ট তোমার।”
(চলবে)
লেখক