বেলপাতার ঘ্রাণ

Reading Time: 3 minutes
জিবরান আর আমি একই ইশকুলে পড়তাম। জিবরান মানে কাহলিল জিবরান। সে অনেক কাল আগের কথা। আমার প্রথম জন্মে সমুদ্রের ধারে একটা পাহাড়ের ছায়ায় আমাদের বাড়ি ছিলো। অংক ক্লাসে জিবরানের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। সে সামনের সারিতে বসেছিলো। আর আমি পেছনে।
অংক স্যার যখন আমাদের দুজনকে কানে ধরে দাঁড় করালো তখন জানতে পারলাম আমরা দুজনেই কাকতালীয়ভাবে অংক খাতায় ছবি আঁকছিলাম। আমাদের খাতা ভর্তি ছিলো কয়লা ঘষে আঁকা নয়টা করে মোট আঠারোটা দাঁড়কাক। অংক স্যার যখন আমাদের দুজনকে মেহেদি গাছের চিকন ডাল দিয়ে পিটিয়ে ক্লাস থেকে বের করে দিলো তখন আমরা ইশকুলঘরের সামনে দাঁড়িয়ে মুখোমুখি হলাম।
আমাদের পরনের শাদা শার্ট পিঠের দিকে রক্তজবা হয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের হুঁশ নাই। জিবরান বললো, ‘দেখ কীভাবে দাঁড়কাক আকাশে ওড়ে।’ বলে সে তার অংক খাতা থেকে কাঠকয়লায় আঁকা দাঁড়কাকের ছবি ছিঁড়ে ছিঁড়ে বাতাসে উড়াচ্ছে, আর ছবিগুলি দাঁড়কাক হয়ে ‘কাহ্ কাহ্ কাহ্’ করতে করতে উড়ে যাচ্ছে আকাশে। আকাশে তখন নয়টা দাঁড়কাক।
জিবরান বললো, ‘ওরা কেনো কাহ্ কাহ্ করতেছে জানিস?’
‘কেনো?’
‘কাহ্ মানে হলো কাহলিল, ওরা আসলে আমার নাম জপ করছে।’
‘তোমার নাম জপ করছে কেনো?’
‘কারণ আমি কবি। কবি থেকে একদিন নবী হয়ে যাবো, তা ওরা জেনে গেছে। তাই আমার নাম জপ করছে।’
জিবরান আমার চেয়ে তিন দিনের বড়ো। সে আমাকে তুই করে বলে, আর আমি তাকে তুমি করে বলি। তখন আমি আর সে থ্রি তে পড়ি। ওর বাবার নাম ছিলো খলিল জিবরান। লোকটা ছিলো ভবঘুরে, ছন্নছাড়ার একশেষ। মায়ের কাছে অনেক কষ্টে-শিষ্টে জিবরান থাকে। জিবরানের নাম ছিলো খলিল জিববান খলিল। তো ইশকুল তার নামটা ছোটো করতে গিয়ে দেখে তার নাম আর তার বাবার নাম একই হয়ে যাচ্ছে, তাই ওর নাম ইশকুলের খাতায় লেখা হলো খলিলের জায়গায় কাহলিল। আর সে হয়ে গেলো কাহলিল জিবরান।
দাঁড়কাকের মুখেও এখন তার নাম। তো জিবরান ম্যাজিক জানতো। আর আমি কোনো ম্যাজিক জানতাম না বলে আমার আঁকা নয়টা দাঁড়কাকের জীবন দিতে পারলাম না। একদিন আরো কয়েকবছর পর বিকেলবেলা জিবরানকে দেখলাম একটা সূর্যমন্দিরের মাটির দেয়ালে কয়লা ঘষে ঘষে একটা নারীর মুখ আঁকছে। মুখের পেছনে ছায়ার মতো একটা নেকড়ের মুখ। আমি গিয়ে তার পেছনে দাঁড়ালাম। তার নগ্ন পিঠে আমি দুই ইঞ্চি একটা জন্মদাগ দেখতে পেলাম। দাগটা এতোই সুন্দর যে আমার ছুঁতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু ছুঁলাম না। আর যেহেতু আমার পেছনে সূর্য ছিলো সেহেতু আমার একটা দীর্ঘ ছায়া তার আঁকা ছবির ওপর পড়লো। সে ঘুরে দাঁড়ালো।
ততক্ষণে তার ছবি আঁকাও শেষ। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি সেই ছবির দিকে। এত মায়া আমার মা ছাড়া আর কারো মুখে দেখিনি। জিবরান আমাকে দেখে হাসলো। সে হাসি তার চোখেও ছড়ালো।
আমি বললাম, ‘কার ছবি?’
জিবরান বললো, ‘আমার মা?’
‘পেছনে নেকড়ের মুখ কেনো?’
জিবরান আমার এই কথার উত্তর না দিয়ে অদ্ভুতভাবে হাসলো।
আমি বললাম, ‘তোমার মায়ের নাম কী?’
‘কামিলা।’
‘কামিলা মানে কী?’
‘কামিলা মানে নিখুঁত।’ বলে জিবারান আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোর মায়ের নাম কী?’
‘লায়লা।’
‘লায়লা মানে কী?’
আমি বললাম, ‘লায়লা মানে রাত্রি। আমার রাত্রি মা।’
‘তোর মা আর আমার মা দুজনের নামের শেষেই ‘লা’। ‘লা’ মানে নাই, লা ইলাহা হাহাহাহাহা…। লা লা লা লা লা…, হি হি হি হি হি…।’
‘হাসছো কেনো?’
‘তোর মা-ও নাই, আমার মা-ও নাই। মজা, না? চল যাই, সমুদ্রে যাই।’
আমি আর জিবরান হাত ধরে সমুদ্রের দিকে গেলাম। সৈকতের বালিতে আমি আমার রাত্রি মায়ের মুখ আঁকলাম। পরক্ষণেই একটা ঢেউ এসে মুছে নিয়ে গেলো। জিবরান বললো, ‘তোর মা কি সমুদ্রের সঙ্গে চলে গেছে?’ আমি মাথা নাড়লাম। জিবরান সহসা আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার ঠোঁটে চুমো খেলো। তারপর ছেড়ে দিলো। সেই মুহূর্তটি অবস্মরণীয় হয়ে গেলো। আর আমি সমুদ্রের ফেনায় বেলপাতার ঘ্রাণ পেলাম। আমি বললাম, ‘বেলপাতার ঘ্রাণ সুবজ।’ আর জিবরানের চোখের হাসিতে লেগে গেলো সেই ঘ্রাণ।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>