বাঙালীর ডাকাত সংস্কৃতি ও ঠগী ঠ্যাঙাড়ে | সৈকত বালা
সন তারিখের পদ্ধতি আত্তীকরণ করতে গিয়ে বাঙালী অসহিষ্ণুতাবশত একটি স্তরে এসে নিজেকেই হীন বলে মনে করেছে। কিন্তু একথা অনস্বীকার্য যে শুধু জাতিগত কৃত্যই নয় নৃতাত্ত্বিক দিক থেকেও বাঙালীরা মিশ্র। আর যখন এই মিশ্রণ সুস্পষ্ট রূপে ঘটে যায়নি তখনকার গননা পদ্ধতি ছিলো চান্দ্রবর্ষ নির্ভর। এ ধারা আজও সাঁওতাল, কোল, ভিলদের মধ্যে বেঁচে আছে এবং প্রায় কাছাকাছিই অপর একটি ধারা ভারত থেকে আরো অনেক কিছুর সঙ্গে তিব্বতে গিয়ে তিব্বতী বর্ষগননা পদ্ধতির জল অধিবর্ষ, শশক অধিবর্ষ ইত্যাদি বর্ষ গননা পদ্ধতির জন্ম দিয়েছে। ফলে বাঙালীর এই নিজস্ব ইতিহাস বলবার বিভিন্ন ধরনের মধ্যে বেঁচে থাকা শেষ যে ইতিহাস সকল দুরন্ত বঙ্গ শিশুর চোখে ভীতির তন্দ্রা নিয়ে এসেছে , বর্তমান কাল থেকে সেই ইতিহাস খুব বেশি দূরের না। সন অনুযায়ী ১৮০০ থেকে ১৯০০ এই শতবর্ষের মধ্যকার সময়গুলোতে রাতে প্রায় সকল শিশুই পরিবারস্থ ঘুমপাড়ানোর দায়িত্বে থাকা কত্রীটির মুখে শুনতেন- ” ঘুম ঘুম যারে , ওরে খোকা ওরে / ঐ আসছে বিশে বোদে/ হারে রে রে রে।”
মূলত এ ছড়াটি যাঁর বা যাঁদের জন্য জনমানসে থিতু হয়ে বসেছিলো সেই বিশুডাকাত ওরফে বিশ্বনাথ বাগদী ডাকাতি করতেন পালকি চড়ে, এবং ডাকাতির প্রতাপে বিশ্বনাথ বাগদী থেকে বাবুত্বে পর্যন্ত উন্নীত হয়েছিলেন। তবে সমগ্র বাঙালী জনমানসে এদের প্রতিক্রিয়া ছিলো মিশ্র। অর্থাৎ রবিনহুড জাতীয় তকমা নিয়ে এঁরা হেঁটে, চলে, দাপিয়ে বেড়ালেও আদতে এঁদের উৎপত্তি মূলত ইংরেজ অপশাসনেরই ফল। একাংশে দারিদ্রতা, জাতিগত বৈষম্য এবং নীলকরদের অত্যাচারকেও দায়ী করা খুবই সঙ্গত। অর্থাৎ ভালো করে পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে এঁদের ধারাবাহিক ডাকাতির কোন ঐতিহ্য নেই। একটা সময় একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীর মানুষ হঠাৎ করে বিভিন্ন কারনে খুনে প্রবৃত্তির হয়ে উঠেছে এবং তাঁরা অধিকাংশই সমাজের বঞ্চিত মানুষের দল, নয়তো উচ্চবিত্তের চোখে দলিত পরিচয় বহনকারী। তবে বাংলার বর্গীদেরও বহুপূর্বে বাংলায় একাধিক দল জনমানসে বর্গীদের মতো ত্রাস সৃষ্টি না করলেও জীবন ধারনের ক্ষেত্রে প্রশ্নচিহ্নের মতো ঝুলেছিল তো বটেই। ১৮১২ সালের আগে প্রতিবছর যে ব্যাপক হারে মানুষ হারিয়ে যেতেন তার (গঙ্গার গণকবর আবিষ্কার হবার আগে পর্যন্ত) অস্তিত্ব নির্দিষ্ট অঞ্চলের অধিবাসীদের কাছে সাধারণ দুর্বৃত্তের মতো হয়ে হয়ে থাকলেও প্রশাসনের চোখে এরা ছিলো সম্পূর্ণ অদৃশ্য। আর এইসব তথাকথিত আঞ্চলিক দুর্বৃত্তদের বাংলার বাইরে অঞ্চল ভেদে নাম ছিলো “অন্তকালের”, “আরিতুলুকার”, “মেকফানসা” এবং বাংলায় এরা ফাঁসিগীর, ফাঁসুড়ে, ধুতুরিয়া, ভাগিনা, ঠগী ও ঠ্যাঙ্গাড়ে।
‘চন্ডীমঙ্গল’-এ কালকেতুর গুজরাট নগর পত্তন কালে অতি পরিচিত ঠগ চরিত্র ভাঁড়ুদত্ত কিম্বা সুবোধ ঘোষের ‘ঠগিনী’ গল্পের ঠগ চরিত্রের মতো বাস্তবের ঠগীরা আদতে এতোখানি নিরীহ ছিলো না। তবে বাকচাতুর্যে ভরা প্রাণোচ্ছল মানুষগুলো ঠিক যেভাবে ভাঁড়ুদত্ত সকল কে ভুলিয়েছে এবং কাঁচকলা ভেঁট নিয়ে দেখবার মতো ধুতি এবং নিজেকে বিশেষ ভাবে দৃশ্যমান করে তুলে লোকঠকাতে বেরিয়েছে। অপর দিকে সুবোধ ঘোষের ‘ঠগিনী’ যেভাবে বিবাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে পাত্রপক্ষের সর্বস্ব হরণ করে নিজের অজান্তে নিজের নারীত্বের কাছে নিজেই একসময় ঠকে গেছে, ঠিক সেভাবেই বাস্তবের ঠগীরা বাকচাতুর্যের দ্বারা কার্যসিদ্ধির পথে হাঁটতেন। তবে দু একটি ব্যতিক্রম ভিন্ন তাদের দল ছিলো সম্পূর্ণ নারী বিবর্জিত। আর ইতিহাসের আঁচড় না কাটলেও এই দুই ভিন্নসময়ের কাব্য ও গদ্য প্রমাণ করে জনমানসে ঠগীদের প্রভাব কতখানি ছিল। ১৮৩০ সনের সরকারী রিপোর্ট অনুযায়ী, বছরের হিসেবে ঠগীরা গড়ে প্রায় তিরিশহাজার মানুষ হত্যা করতেন এবং সবথেকে হতভাগ্য অকর্মণ্য যে ঠগী তাঁর হাতেও ছিলো প্রায় কুড়িটি মানুষের প্রাণ। এঁরা কেউই অবশ্য আদিতে বাঙালী নন, উত্তর পশ্চিম ভারত থেকে ১২৯০ সনের পর প্রায় সহস্র ঠগী বাংলায় আসেন। এ প্রসঙ্গে ১৩৫৬ সনে লিখিত জিয়াউদ্দিন বারনীর “তারিখ ই ফিরোজশাহী” বইটির কিছু অংশ নির্দেশ করা যায়। যেখানে বর্নিত ফিরোজ শাহের আমলে ধৃত ঠগীদের কোন এক অজ্ঞাত কারণে ফিরোজ শাহের রাজ্যসীমায় পুনর্বার প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা জারি করে লক্ষণাবতীতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এইবার এই অজ্ঞাত কারন যতটা নিরীহ শোনাক না কেন, এর আড়ালে চক্রান্তের বীজ নিশ্চয়ই চোখ এড়ায় না। কেননা নৌকা যোগে যে মানুষ গুলো বর্তমান বাংলার খুবই কাছাকাছি এই লক্ষণাবতীতে এলেন তাঁরা প্রত্যেকেই একেকজন দুর্ধর্ষ খুনী। আর এদেশে এসে একদল জলে নেমে গেলেন আর অপরজন থেকে গেলেন ডাঙাতেই। যাঁরা জলে নেমে যান এঁরা ক্রমে পরিচিত হন জলঠগী ভাগিনা নামে এবং বাংলার বাইরে এঁরা পাঙ্গু নামে পরিচিতি পান। এঁদের মূল নিবাস বাংলার বর্ধমানে। এছাড়াও বীরভূম, বাঁকুড়া, সিউড়ি, কালনা এবং কাটোয়াতেও এঁদের শক্ত ঘাঁটি ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য জনশ্রুতি এইরূপ , দাঁইহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশের কালিবাড়িটি এই জলঠগী ভাগিনাদেরই নির্মিত এবং পূজিত, যেখানে পরবর্তীকালের বর্গীরা এসে তৎসংলগ্ন অঞ্চলে অবস্থানের সময় ওই মন্দিরে পুজো সেরে নিতেন।
জলের ঠগীরা ডাঙার ঠগীদের ভাষা বুঝতেন না আর ডাঙ্গার দল বুঝতেন না জলের ভাষা। ঠগীদের ভাষা মাত্রই তাঁদের নিজের তৈরি করা ভাষা “রামসি”, তবে এক্ষেত্রে ভাষার তারতম্য ঘটে যেত। আর উভয় দলই স্বাদবদলের জন্য উভয় দলে যোগ দিতেন। জলপথে মুর্শিদকুলি খাঁর সময় জলঠগীদের উৎপাত বড্ড বেড়ে যায় এবং এদের সর্দার ছিলেন কালীসাধক রমনীমোহন সরকার। তাঁর নেতৃত্বে সাতটি পানসি শিকারের অপেক্ষা করতো ঘাটে ঘাটে, এদের শাস্তিবিধান করার জন্য কাটোয়ায় ফৌজদার হিসেবে মহম্মদ জান কে নিযুক্ত করা হলে তিনি এঁদের শাস্তি বিধান করতেন নৃশংস ভাবে। কোন জলঠগী ধরা পড়লে এবং তাঁর অপরাধ প্রমাণিত হলে মহম্মদ জানের অধীনস্থ কুড়ুলধারী ঘাতকেরা উক্ত ঠগীকে কুড়ুল দিয়ে ক্ষতবিক্ষত ও টুকরো করে ঘাটের কাছের গাছে ঝুলিয়ে দিতেন এই উদ্দেশ্যে যাতে বাকি ঠগীরা সতর্ক হয় এবং শুধরে যায়। কিন্তু আদতে ১৮৩৬ সন পর্যন্ত গঙ্গার বুকে অসংখ্য মৃতদেহ ভেসে গেলেও কেউ ঘুণাক্ষরে সন্দেহটুকুও করতে পারেননি যে এর পেছনে রয়েছে ইতিহাসের সবথেকে দুর্ধর্ষ এবং স্বশিক্ষিত এক খুনে বাহিনীর এক অংশের হাত।
১৮৩৬-৩৭ সালের মধ্যে প্রশাসনের হাতে সকল জলঠগী বা ভাগিনারা নির্মূল হয় এবং সর্বসাকুল্যে ধরা পড়ে একশো একষট্টি জন ভাগিনা। সেই সঙ্গে প্রথম জানা যায় এদের শুধু গঙ্গার বুকেই রয়েছে প্রায় আঠেরোটি ঠগী নৌকা এবং তাদের প্রত্যেকটিতে কর্মরত অবস্থায় সদা তৎপর প্রায় গড়ে চোদ্দজন ভাগিনা। ডাঙায় যে দলটি থেকে গিয়েছিলো তাদের মধ্যে একদল খাবারে ধুতরোর বিষ মিশিয়ে পথিকদের ওই খাবারের মাধ্যমে হত্যা করে পথচারীদের সর্বস্ব লুঠ করে দেহটিকে ওখানেই ফেলে রেখে যেত। এদের সঙ্গে প্রায় কাছাকাছিই ফিরত অপর একটি দল তারা ফাঁসুড়ে, পথচারীদের বিশ্বাস ভাজন হয়ে আন্তরিকতার সঙ্গে ঘরে এনে আতিথেয়তায় মুগ্ধ করে অথবা রাস্তাতেই সকলের অগোচরে গলায় গামছার ফাঁস আটকে হত্যা করে দেহটিকে ঝুলিয়ে দিত কোন সুউচ্চ গাছের ডালে। এদের সঙ্গে প্রথম সাক্ষ্যৎ ঘটিয়েছেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ে তাঁর “ফাঁসুড়ে ডাকাত” গল্পে এবং তিনি যে সমস্ত এলাকার নাম উল্লেখ করেছেন ১৮৪০ পর্যন্ত বর্ধমান সন্নিহিত ওই সকল এলাকাই ছিলো ফাঁসুড়েদের প্রধান গড়। তবে অপর যে দলটির সঙ্গে প্রায় প্রত্যেক বাঙালী শিশুর পরিচয় করিয়েছেন বিভূতিভূষণ, তারা কখনোই বাকি সমস্ত স্থলচর দলগুলির মতো এতটা অতিথিপরায়ণ ছিল না।
‘পথের পাঁচালী’র বীরু রায় যে দুর্ধর্ষ ঠ্যাঙ্গাড়ের দল পুষতেন, এঁরা তাঁরা। হয়তো পাঠকদের আজও মনে পড়বে বীরু রায়ের কর্মপদ্ধতির জীবন্তবর্ণনা। আর আজও হয়তো পাঠকের মানসচোখে ধরা পড়েবে মজা ঠাকুরঝি পুকুরের পাশের চাষের মাঠে চাষ করলেই লাঙলের ফলায় উঠে আসা হতভাগ্য সেই সব পথিকদের কঙ্কাল! শুধু বিভূতিভূষণ নয় এঁদের কথা অমর করে রেখেছেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর “আখড়াই দিঘি” গল্পে সেখানে ঠ্যাঙ্গাড়ে সর্দার কালী বাগদী প্রবল বর্ষার রাতে নেশার ঘোরে এবং বৃষ্টির তোড়ে চিনতে না পেরে নিজের ছেলেকেই সে শিকার করে বসে ও আখড়াইয়ের দিঘিতে সমাধি দেয়। পরিণামে তাঁর যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হয় এবং একপর্বে শাস্তি শেষে সে মারাও যায়। আর এই ঘটনার বাস্তব রূপ ঘটে গিয়েছিলো পদ্মাপাড়ের চলনবিলে, সেখানেও জমিদারের অধীনস্থ ভাগিনারা শিকার করে জমিদারের জামাইকে। পরিনামে জমিদারমশাই নিজে উন্মাদ হয়ে যান। ঠগী এবং ঠ্যাঙ্গাড়ের দল তো বটেই, এই জলঠগীদেরও দস্যুবৃত্তির এলাকা শুধু মাত্র দুই বাংলাতে সীমাবদ্ধ ছিল না। তাঁরা ছড়িয়ে গিয়েছিল কানপুর, বেনারস পর্যন্ত।
এ পর্যন্ত এসে একটা স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায় এঁরা প্রত্যেকে দলগত ভাবে কাজ করতেন এবং কাজকরার পদ্ধতি ভিন্ন । তবে এদের মধ্যে সবথেকে নিপুণতম খুনের দল আদিখুনী ঠগী ! ঠগী , ভাগিনা , ঠ্যাঙ্গাড়ে , ফাঁসুড়ে এরা প্রত্যেকেই ছিল কালীভক্ত এবং নিজেদের মনে করত এরা প্রত্যেকেই মা ভবানীর সন্তান । হিন্দু মুসলমান উভয় শ্রেণীর মানুষ এক হয়ে একই দেবী কে মা বলে ডেকে একসাথে এক অন্নভাগ করে শুরু করেছিলেন হত্যার সাধনা ! এঁদের উৎপত্তি সমন্ধে এঁদের মধ্যে এক গল্প প্রচলিত ছিলো আর তাইই এঁরা ধ্রুব বলে গ্রহণ করতেন , তাঁদের মতে দানব রক্তবীজের বধের কালে দেবীর ইচ্ছে অনুযায়ী ঠগীদের আদিপুরুষ দুই জনের জন্ম , দেবী তাদের হাতে তুলে দেন মন্ত্রপূত সিল্কের রুমাল । বলে দেন রক্তবীজের রক্তের সন্তানদের একফোঁটা রক্ত যেন মাটিতে না পড়ে, যুদ্ধ জয় লাভ হলে দেবী আর ফিরিয়ে নেন না তাদের অস্ত্র বলেন এ দিয়ে শত্রু নিধন করে বেঁচে থাকতে । আর এঁরা ক্ষিদে কে মনে করেছিলেন শত্রু আর প্রতিটি শিকার ভবানী প্রেরিত, দলগত এই মানুষ গুলি যখন গ্রামে থাকতেন তখন আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতোই কিন্তু পথে এলেই তাঁরা ঠগী । ইতিহাসের ভয়ঙ্করতম মানুষ ! ঠগীর ছেলে ঠগীই হয় অন্যকিছু নয় এই ভাবে বংশপরম্পরায় এক কোনে তামার একটি পয়সা বাঁধা রুমালের উত্তরাধিকার এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত হতো এমনকি ছোটো ছেলেদের ঠগীর দলে একসাথে নিয়ে ঘোরা হতো কিন্তু পরিণত বয়স না হওয়া পর্যন্ত তাঁর সামনে খুন করা হতো না । একই পন্থাছিলো ঠ্যাঙ্গাড়ের দলেও সেখানেও কালী বাগদী তাঁর ছেলের আঠেরো না হলে শিকার কে খুন করার আদেশ দেয় নি ! তবে ঠগীদের রুমালের চেয়েও বড় অস্ত্র হলো একটি ছোটো মন্ত্রপূতঃ কোদাল বা কাসসি । এই কোদাল তাঁদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রা । প্রতিবর্ষায় ঝাঁপবন্ধ কামারশালায় চোখের সামনে বসে সকলের অলক্ষ্যে কামার কে দিয়ে এ কোদাল গড়িয়ে নিয়ে চলে বন্ধঘরে একান্তে কোদালের উপাসনা , একে একে জল , চিনির জল এবং মদ দিয়ে শুদ্ধ করে আগুনে সাতবার সেঁকে রক্ত সিন্দুরের ফোঁটা দিয়ে একঘায়ে একটি নারকেল ভেঙে তবে দেবী কে সন্তুষ্টির কাজ শেষ হতো । এর একটি এদিক ওদিক হলে প্রক্রিয়া প্রথম থেকে শুরু করাই ছিলো রীতি , অবশ্য ঠ্যাঙ্গাড়েদের দলে এতো সব হাঙ্গামা কখনো ছিলো না এবং তাঁরা পথিক দের সঙ্গে মিশতেনও না পথচারীদের দূর থেকে পা লক্ষ করে পাবড়া বা ফাবড়া ছুঁড়ে ঘায়েল করে মানুষটিকে লাঠিপেটা অথবা সর্দার নীচে পতিত মানুষটির ঘাড়ে লাঠি দিয়ে দাঁড়িয়ে অপরজন কে আদেশ করতেন পতিত মানুষটির পা ধরে ঘুরিয়ে দিতে বা উল্টে দিতে । এই ঠ্যাঙ্গাড়ের দল বেশি ছিলো হুগলী বর্ধমান আর হাওড়া জেলায় ।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই হুগলিরই ভূমিপুত্র আর এই ঠ্যাঙ্গাড়ে দের বর্ণনা আরো জীবন্তভাবে দিয়েছেন। তাঁর “বছর পঞ্চাশ পূর্বের একটা কাহিনী”তে গল্পের প্রধান চরিত্র নয়ন বোষ্টম ওরফে নয়ন ছাতি আগে ছিলো ঠ্যাঙ্গাড়ে। তাই ঠ্যাঙ্গাড়ে দল কে তেড়ে গিয়েছিল বোষ্টম হত্যার প্রতিশোধ নিতে। কিন্তু যাকে ধরে আনলো সে তাকে দেখে ডাকাত মনে হয় না , কিন্তু সে স্বীকার করলো সেও ছয় সাত ঘা লাঠির বাড়ি দিয়েছিলো এবং আরো জানা যায় তাঁরা লাশ গুলো জনবিরল নদীর পাঁকে পুঁতে দিত ঠিক যেমন বীরু রায়ের ঠাকুরঝি পুকুর, ঠিক যেমন কালি বাগদীর আখড়াইয়ের দিঘি , ঠিক তেমনই কোন নদীর পাঁক । এইছিল ঠ্যাঙাড়েরা । তবে ঠগীর পদ্ধতি অনুসারে যাঁরা বড় দল বা “চিসা” কে কথার জাদু ও আন্তরিকতায় ভুলিয়ে ঠগীর “বাগ” বা বিচরন ক্ষেত্রে আনতেন , তাঁরা “সোথা” । যেসব গুপ্তচর এইসব দলের খবর আনতেন তাঁরা “তিলহাই” এবং রুমালধারি খুনির নাম “ভুরকুত” । দল “বাগে” এলে দলপতি আদেশ করতেন ” চুকা দেনা” অর্থাৎ ভুলিয়ে বসিয়ে দাও এবং খুনের জায়গা অর্থাৎ “বিল” পরিষ্কারের আদেশে কয়েকজন কে বলতেন ” কুত্তোর মাঞ্জা লেও ” এদের সঙ্গে যেতেন “লুগহা” বা কবর খোঁড়ার লোক , ঠগীরা কবর দিতেন মূলত মাঝে একটুকরো মাটি রেখে গোলাকার কবর খুঁড়ে , তাঁদের মতে ওই ধরনের কবর টেঁকসই। গল্পকথায় ভুলে যাওয়া লোকগুলোর মাঝে দলপতি বড় আপনকরা কন্ঠে আদেশ দেন “পানকা রুমাল লাও ” অর্থাৎ রূমাল ঠিক করো এর পর আদেশ আসতো ” তামাকু লাও ” অর্থাৎ হত্যার আদেশ । কাজ সমাপ্ত হলে দলপতি উচ্ছ্বাসে বলতেন “বাজিত খান বিচালি দেখো ” অর্থাৎ কাজ সমাপ্ত , এবার দেহের ব্যবস্থা করো । একদল “থারু ” বা ঠগী মৃতদেহ ভেঙে হাঁটুসমান করবে আর “কুরোসাওয়া”রা দেহের বুকে পেটে ছুরি চালিয়ে দেহের ফুলে উঠে কবর ভেঙে ওঠার প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেবে । আর এসব কাজ শেষ হলে প্রমাণ লোপাটের দক্ষঠগীর নাম ” ফুরজানা” তাঁদের কাজ শেষ হলে কবরের উপর হবে প্রসাদী গুড়ের ভোজ । গুড় তাদের কাছে অমৃত সমান । প্রায় একই পদ্ধতিতে কাজ করতেন ভাগিনারা , তাঁদের দলপতি নৌকায় তিনবার বৈঠা ঠুকে মৃত্যুর পরোওয়ানা জানান দিতেন আর শিকারের সামনের দিক থেকে যাত্রী ও মাঝিদের গামছা এমন কি বামুনের কাঁধের নামাবলি পর্যন্ত নেমে আসতো ফাঁস রূপে অবশ্যই এই বামুনটি ছদ্মবেশী ঠগী । কখনো আবার সর্দারও বটে ! ফাঁসের সঙ্গে পেছন দিয়ে শিঁড়দাড়ায় চাপ দিয়ে দেহ ভেঙে তালগোল পাকিয়ে শিকার কে জল সমাধি দেওয়া হতো । এবং এর জন্য ঠগী নৌকার পাটাতনের দুটো কাঠ আগে থেকে আলগা করা থাকতো । এই ঠগী ঠ্যাঙ্গাড়ে ভাগিনাদের পবিত্র তীর্থস্থান ছিলো কলকাতার কালীঘাট এবং বিন্ধ্যাচলের বিন্ধ্যবাসিনী দেবীর মন্দির আর এদের ধ্বনিই ছিলো “জয় ভবানী” আর “জয় কালী কলকাত্তাওয়ালী” তবে কালীসাধক এইসকল মানুষেরা হেন কোন কুসংস্কার ছিলো না যা এঁরা মানতেন না , যেমন পূর্বোক্ত রামসি বুলির নাম গুলোর মতোই রামসিতে একটি ছড়া প্রচলিত ছিলো – ” রাত কো বোলে তিতওয়ারা/ দিনকো বোলে শিয়ার । তুজ চৌলি ওরা দেশরা / নৌহিন পুরী আচনক ধা ” অর্থাৎ রাতে ঘুঘু এবং দিনে শিয়াল ডাকলে সেই দেশ যেন ঠগী ততক্ষণ ত্যাগ করে ।
আঠেরো শতকের ডাকাতেরা এইসব ঠগীদের মতো এতো গোপনে আক্রমণ করতেন না বটে তাঁরা রীতিমতো চিঠি দিয়ে বলে ডাকাতি করতেন যে প্রথা সত্তরের দশকের নকশাল আন্দোলনের বিভিন্ন ডাকাতি পর্যন্ত একটি বীরত্বব্যঞ্জক জনপ্রিয় প্রথা ছিলো । স্বদেশী যুগে তো বটেই ! এবং এই পর্যন্তও হিন্দু মুসলিমের ঐক্যছিলো দেখবার মতো , তাঁদের পরিচয় তারা ডাকাত । তাঁরা কালীসাধক , বিপ্লবীদের গোপনে বিপ্লব মন্ত্রে অসি এবং দেবী কালিকার সামনে শপথ নেবার আদিরূপ বঙ্গের প্রাচীন ডাকাতদের কালীসাধনার মধ্যেই নিহিত তাঁরা কালিকাপুরাণের- “নরেন বলিনাদেবী তৃপ্তিং সহস্ত্রবৎসরাণি। বিধিদত্তেন চাপ্নোতি দেবী ত্রিভির্নরে।” শ্লোকে বর্ণিত নরবলির ফলে দেবীর সহস্র বৎসর তৃপ্ত থাকার বাক্যকে ধ্রুব বলে নরবলি দিয়ে থাকলেও, পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে এঁদের অধিকাংশেরই কার্যপদ্ধতি ছিলো গরীবের বন্ধু এবং জমিদার জোতদার ও নীলকরদের যম হিসেবে। যেমন এই বিশু ডাকাতের ফাঁসিই হয়েছিলো স্থানীয় জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য, কিম্বা আচার্য্য বাড়ির ব্রাহ্মণ সন্তান রাণা শিশু কালে চোখের সামনে অভাবের তাড়নায় বোনের প্রায় বুড়ো মহাজন পাত্রের সঙ্গে বিয়ে হতে দেখা ও কয়েক বছর ফিরতে না ফিরতেই মৃত্যু ও অনাথ হওয়া রেখা পাত করেছিলো উচ্চবিত্তদের বিরুদ্ধে। রাণার হস্তক্ষেপে কত দরিদ্রের ঘরে হাঁড়ি চড়েছে ও কন্যার বিবাহ হয়েছে তাঁর হিসেব নেই এমন কি তাঁর নামেই মহকুমার নাম, আজকের রাণাঘাট।
আর রঘুডাকাতের কিংবদন্তি এতো বৃহৎ যে বঙ্গের প্রায় সকল গ্রামেই চাঁদ সওদাগরের ভিটের মতো রঘুডাকাতের প্রতিষ্ঠিত কালীবাড়ি রয়েছে। তবে রঘুর ভাই বুধে ডাকাত রঘুর মতো সৎ চিন্তা ও পরোপকারী মানসিকতার জন্য চিহ্নিত না হলেও রামপ্রসাদের একটি গানের নেপথ্য কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। কথিত আছে বলি দেবার উদ্দেশ্যে রামপ্রসাদকে বুধে, দেবী কালিকার কাছে আনলে রামপ্রসাদ গেয়ে ওঠেন – “তিলেক দাঁড়া ওরে শমন /বদনভরে মাকে ডাকি” শোনা যায় এ গান শুনে বুধে রামপ্রসাদের পায়ে পড়েছিলেন। চিতে ডাকাতের দেবী চিত্রেশ্বরী থেকে জায়গার নাম চিৎপুরের পাশাপাশি বিষ্ণুপুরের মল্লারাজের ডাকাত দলের কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত লুঠ করে নেওয়া ডাকতির পাশাপাশি সাহিত্যের অঙ্গনেও এক বিরল বস্তু। জনশ্রুতি অনুসারে দিন কয়েক পর খবর পেয়ে রাজ সভায় এসে কৃষ্ণদাস এমন চরিতামৃত ব্যখ্যা করেন তাতে নাকি দিনে সন্ধার আভাস ফুটে ওঠে বাঁশি শোনা যায় গোটা বৃন্দাবন নাকি বিষ্ণুপুরে জেগে ওঠে। তবে এ নিছকই গল্প কথা। সত্যি কথা এই যে, তদানীন্তন এক অংশের জমিদাররা হয় ছিলেন ডাকাত, নয় ডাকাতদল পুষতেন। ঠিক যেভাবে রংপুরের প্রবল প্রতাপান্বিত জয় দূর্গা চৌধুরাণী বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দেবী চৌধুরাণী’ হয়ে উঠলেন, তেমনিই বঙ্কিমচন্দ্র মহিষাদলের ভবানী উপাসক রাজার কথা শুনেছিলেন যিনি নরবলি দিতেন এবং অপরাধীদের উদ্দেশে ঘাতকদের বলতেন “ভবানীতলা মে লে যাও” অর্থাৎ বধ করো। বঙ্কিমচন্দ্র ঘাটালের আদিবাসিদের নরবলি দেবার কথাও শুনেছিলেন। ১৮৬০ সালে মেদিনীপুরের ম্যাজিস্ট্রেট থাকাকালীন তিনি নিজে সমুদ্রপাড়ের একাকী বনে কাপালিকের থান ও বলিমঞ্চ দেখে হয়তো বা নিজেই শিউরে উঠেছিলেন আর তার কয়েক বছর থেকে আজ পর্যন্ত পাঠকরা শিউরে ওঠেন বঙ্কিমসৃষ্ট “কপালকুন্ডলা” উপন্যাসখানি পাঠ করে।
আদতে এই ছিলো একদা বাংলার শরীরের দাপিয়ে বেড়ানো তাঁর দুর্দম সন্তানদের কার্যক্রম। এঁদের মধ্যে প্রত্যেকের কর্মপদ্ধতি কাছাকাছি হলেও ছিলো ভিন্ন এবং জনমানসে এঁদের ত্রাসও সমান ছিল না। তবে বিচিত্র এই সকল খুনে মানুষের সংঘবদ্ধ ঐক্য অর্থাৎ ঠগী, ঠ্যাঙ্গাড়ে, ফাঁসুড়ে, ধুতুরিয়া, এঁরা ব্রিটিশ শাসনের সুপ্রভাবে বঙ্গদেশের জল হাওয়া তথা ভারতের আলো থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তবে সমগ্র ১৮০০ থেকে ১৯০০ সনের মধ্যে দাপিয়ে বেড়ানো স্বদেশী ডাকদের সন্ত্রাসমূলক কাজ এবং তাঁদের দমননীতি সম্বন্ধে মধ্যে মধ্যে একটি আবছা প্রশ্ন উঠলেও এঁদের রেখে যাওয়া কিংবদন্তির বীজ ফলিত বৃক্ষ হয়ে আজ বড় নিরীহ রূপে ছায়া দান করে চলেছে। এবং বর্তমান থেকে আরো বহুদূর পর্যন্ত যতদিন বাঙালী জাতিসত্তার অস্তিত্ব থাকবে। তবে হিন্দুমুসলমানের মিলিত সাধনা ধ্বংস শুধু আনেনি, সন্দেহাতীতভাবে এনেছে সাতচল্লিশের পনেরোই আগস্ট এবং এই ইতিহাস চর্চার এক শান্ত সমাহিত সময়কাল। যেভাবে ঠগীদের কালপর্বে অযোধ্যার ভবানী উপাসক ঠগী ছিলো দশভাগের নয় ভাগ মুসলিম, দোয়াবে যেমন ছিলো হিন্দু, নর্মদার দক্ষিণে মুসলিম ও রাজপুতানায় চারভাগের একভাগ মুসলিম ও বাংলা উড়িষ্যায় সমান সমান অনুপাত তেমনি আঠেরো শতকের ডাকতের ধর্মগত পরিচয়ও খানিকটা একই রকম আর স্বদেশী যুগে তো কথাই নেই। তবে ইতিহাস পুনরাবৃত্তি ঘটায়, কাল আমাদের মুখ দিয়ে যে ইতিহাসেরই ফের উচ্চারণ ঘটাক না কেন বাঙালী আদি থেকে অনন্ত তাঁর ইতিহাস বলে এসেছে, বলে এসেছে ধর্মের নয় সমগ্র সময়ের ইতিহাস। সঞ্চিত করেছে স্মৃতি, অনাগত আগামী কে উপহার দিয়েছে শুধু মিলিত সাধনার উত্তরাধিকার। এর বেশি আর কিছু মাত্র নয়।
তথ্যসূত্র ও গ্রন্থপঞ্জী— ১) ঠগী – শ্রীপান্থ, ২) বাংলার ডাকাত- খগেন্দ্রনাথ মিত্র, ৩) পুরনো কলকাতার কথাচিত্র- পূর্ণেন্দু পত্রী, ৪) ঠগী কাহিনী- ঠগী আমির আলির আত্মকথা , ৫) বাংলার ডাকাত- পিনাকী বিশ্বাস