সামাজিক জীবনে খেলাধুলা একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। প্রতিটি মানুষের মধ্যে খেলাধুলার আকর্ষণ শৈশব থেকেই লক্ষ করা যায়। খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ শুধু মানুষের মধ্যে নয়, পশুপাখিদের মধ্যেও দেখা যায়। আদিমকালে মানুষ অরণ্যে, গুহায় বাস করত। তখন জীবন ধারণের জন্য তাদের প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হত। এই লড়াইয়ে কখনও জয় ছিল, কখনও পরাজয় ছিল। সে যুগে খাদ্য সংগ্রহের অন্যতম উপায় ছিল শিকার। সে সময়কার জীবন সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি বর্তমানে বহু খেলাধুলার মধ্যে প্রতিফলিত হতে দেখা যায়।
যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে খেলাধুলার রীতি, নিয়ম ও পদ্ধতি্র অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। ইদানীং শহরাঞ্চলের ছেলেমেয়েদের দলবদ্ধ খেলার পরিবর্তে কম্পিউটারের সামনে বসে একক খেলাতেই বেশি মেতে থাকতে দেখা যায়। তুলনায় গ্রাম বাংলার ছবি এখনও অন্যরকম। সেখানে দলবদ্ধ খেলার প্রতি মানুষের ঝোঁক এখনও অনেক বেশি। ক্রিকেট বা ফুটবলের মতো জনপ্রিয় খেলার পাশাপাশি বহু লৌকিক খেলাধুলায় মানুষ এখনও সেখানে অংশ গ্রহণ করে থাকে।
লৌকিক খেলাগুলির সঙ্গে গণিতের যোগসূত্র
কুস্তি, লাঠিখেলা, খোখো, গাদি প্রভৃতি খেলায় যেমন বড়দের অংশগ্রহণ করতে দেখা যায় তেমন ছোটদের খেলতে দেখা যায় এক্কাদোক্কা, ঘুঁটি খেলা, ষোলঘুঁটি, লুডো, গোলকধাম, বাঘবন্দী, পিট্টু ইত্যাদি। এই খেলাগুলির সঙ্গে হারজিত বা প্রতিযোগিতার সম্পর্ক থাকলেও শরীরচর্চা, আমোদ-প্রমোদ এবং দৈনন্দিন জীবনের একঘেয়েমি থেকে মুক্তি জড়িত থাকে অনেক বেশি। তাই বিভিন্ন উৎসবে, অনুষ্ঠানে, অবসর জীবনযাপনে, অনন্দ উপভোগে, লোকাচারে এই খেলাগুলি অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়। এইসব লৌকিক খেলাগুলির উদ্দেশ্য যাই থাকুক না কেন এগুলির সঙ্গে গণিতের যোগসূত্র আছে। সংখ্যা গণনা থেকে আরম্ভ করে যোগবিয়োগের নানা হিসেবনিকেশ জড়িয়ে থাকে এই ধরনের খেলাগুলির সঙ্গে।
দলবদ্ধ খেলায় অধিকাংশ সময় দল গঠন করতে হয়। সেক্ষেত্রে ন্যূনতম দুটি দলের প্রয়োজন হয়। লৌকিক খেলাগুলি যখন নিছক আনন্দ উপভোগের জন্য খেলা হয় তখন দল গঠন করা হয় মূলত একই অঞ্চলের বা একই পাড়ায় বসবাসকারী বন্ধুবান্ধবের মধ্য থেকে। ছেলেমেয়েরা প্রথমে সার বেঁধে দাঁড়ায়। সেখান থেকে দু’পক্ষের দু’জন দলপতি বা দলনেত্রী ঠিক করা হয়। কোন দলে কোন খেলোয়াড় যাবে তা এরাই সংখ্যা গণনার মাধ্যমে ঠিক করে।এতে কোনো দলের বা কোনো খেলোয়াড়ের অসন্তুষ্ট হওয়ার সুযোগ থাকে না। এক থেকে কুড়ি পর্যন্ত গণনার মাধ্যমে প্রতি দলের খেলোয়াড় নির্বাচিত হতে থাকে।
অক্ষর জ্ঞান হওয়ার আগেই শিশুরা ছড়া বলতে শিখে যায়। বড় বড় ছড়া তারা না থেমে অবলীলায় বলতে পারে। গ্রাম বাংলার লৌকিক খেলাগুলিতে ছোটছোট ছেলেমেয়েরা যখন অংশগ্রহণ করে তখন তাদের গোনার কাজটি ছড়ার মাধ্যমে করতে দেখা যায়। ছড়ার মায়াবী ছন্দে এই কাজটি করতে তাদের বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না।
গ্রাম বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে একই গণনার কাজ বিভিন্ন ছড়ার মাধ্যমে করতে দেখা যায়। যেমন
বাংলাদেশের রংপুর জেলায় কুড়ি পর্যন্ত গোনার জন্য যে ছড়াটি বেশি ব্যবহৃত হতে দেখা যায় সেটা হলঃ

এখানে এক-এর পরিবর্তে ‘এ্যাকোড়’, দুই-এর পরিবর্তে ‘ব্যাকোড়’ ইত্যাদি। এইভাবে গুণতে গুণতে দলপতি যে খেলোয়াড়কে স্পর্শ করে ‘বিশ’ সংখ্যাটি গোণে সে খেলোয়াড় সেই দলপতির দলভুক্ত হয়।
মোমেনশাহীতে এই গোনার কাজ যে ছড়াটির মাধ্যমে করা হয় তা রংপুর জেলার ছড়াটির সঙ্গে মেলে না। এই ছড়াটি হলঃ

সিলেট অঞ্চলের হড়াটি আবার অন্য ধরনেরঃ

লক্ষণীয় এই যে প্রতিটি ছড়াই শেষ হয়েছে কুড়ি গোনার পর।
মোমেনশাহী অঞ্চলে আরও একটি ছড়া চালু আছে। এই ছড়াটি হলঃ

এখানে গণনার কাজটা হয়েছে কুড়িটি শব্দের সাহায্যে।
ভিন্নতর রূপে অনুরূপ আরেকটি ছড়া যশোর অঞ্চলে প্রচলিত আছেঃ

উপরের প্রত্যেকটি ছড়াতেই গোণার কাজ শেষ হয়েছে কুড়ি সংখ্যায় এসে। এখন প্রশ্ন হল, এই গোণার কাজে কেন এক থেকে কুড়ি পর্যন্ত সংখ্যা বেছে নেওয়া হল? এর উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের যেতে হবে সেই আদিম যুগে। আদিমকালে মানুষ সংখ্যার ধারণা ও গণনা শুরু করেছিল হাতের ও পায়ের আঙুলের সাহায্যে। হাতের ও পায়ের মোট আঙুলের সংখ্যা কুড়ি। তাই প্রথম অবস্থায় সংখ্যা সম্পর্কে মানুষের ধারণা ছিল ঐ কুড়ি পর্যন্তই। বর্তমানে সামাজিক জীবনে লৌকিক গণনায় কুড়ির প্রভাব এখনও বিদ্যমান। বহু ক্ষেত্রেই আমরা এখনও এক কুড়ি, দুই কুড়ি ইত্যাদি হিসেব গূণে থাকি।
গ্রাম বাংলার লৌকিক খেলাগুলির সঙ্গে শুধু যে অবসর সময়ের আনন্দ উপভোগ বা শরীর চর্চা যুক্ত তা নয়। বিশ্লেষণী মনোভাব নিয়ে এগুলিকে লক্ষ করলে দেখা যাবে এগুলির মধ্যে নানারকম গণিত ও গণিতের প্রথম পাঠ দেওয়ার প্রচেষ্টা। আধুনিক সমাজজীবনে এইসব লৌকিক খেলার প্রচলন কমে গেলেও একেবারে বিলুপ্ত হয় নি। শুধু বাংলাদেশেই নয়, পশ্চিমবাংলার গ্রামে-গঞ্জে এখনও এই খেলাগুলি দেখতে পাওয়া যায়। লৌকিক জীবনীর অপরিসীম গুরুত্ব উপলব্ধি করে গ্রাম বাংলার লৌকিক খেলাগুলিকে বাঁচিয়ে রাখার দরকার আছে।
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জী ও পত্র-পত্রিকাঃ
- W .C. Vergava, Mathematics, Vol. I. II
- B. Datta & A. N. Singha, History of Hindu Mathematics, in 2 Vols., Lahore, 1935
- ড. অমল কে ভৌমিক, লোকগণিতঃ স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য, বেস্ট বুকস, কলকাতা, ২০০৩
- বসন্ত কুমার সামন্ত, সংখ্যার মজা আর মজার সংখ্যা, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তকপর্ষৎ, কলকাতা, ১৯৯৮
- সম্পাদক— সনৎ কুমার মিত্র, লোক সংস্কৃতি গবেষণা (সংখ্যার যাদু বিশেষ সংখ্যা), ১৪ বর্ষ ও সংখ্যা, কার্তিক-পৌষ, ১৪০৮ (ত্রৈমাসিক পত্রিকা), লোক সংস্কৃতি গবেষণা পরিষদ, কলকাতা

বিশ্বের সর্বশেষ খবর, প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, সাক্ষাৎকার, ভিডিও, অডিও এবং ফিচারের জন্যে ইরাবতী নিউজ ডেস্ক। খেলাধুলা, বিনোদন, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং স্বাস্থ্য সহ নানা বিষয়ে ফিচার ও বিশ্লেষণ।