bengali kids story by Ananya Das

শিশুতোষ গল্প: সৃজিত আর স্টেগির ভূত । অনন্যা দাশ

Reading Time: 4 minutes
সৃজিতের স্থির বিশ্বাস যে ওর ঘরে ও ছাড়াও কিছু একটা থাকে। এখন সেটা দৈত্য না ভূত না অন্য কিছু, সেটা সে জানে না! আসলে রাতে যখন ওর ঘুম আসতে দেরি হয়, তখন খাটের তলা বা দেওয়াল আলমারি থেকে ঘুট-ঘুট শব্দ শুনতে পায় সে! প্রথম প্রথম ভয় করত, কিন্তু এখন করে না। যেই থাকুক, সেও মনে হয় সৃজিতকে ভয় পায়, তাই কখনও বেরোয়নি! না বেরোলেই ভাল বাবা!
 
আজকের দিনটা মোটেই ভাল যাচ্ছিল না সৃজিতের। ওদের স্কুলের সায়েন্স ফেয়ারে ওকে প্রোজেক্ট দিতে হবে। কী প্রোজেক্ট করবে, সেটা মিসকে এখনও বলেনি বলে মিসের কাছে বকুনি খেয়েছে। বাবা অফিস থেকে ফেরার পর তাই নিয়ে বাবাকে ধরেছিল সে, কিন্তু বাবা যা-ই বলেন, কেউ না কেউ একটা সেই প্রোজেক্ট করছে! আসলে সৃজিত শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে বলেই এই বিপদ!
 
বাবা বললেন, ‘কেমিক্যাল আগ্নেয়গিরি?’
 
 
 
 
‘না, ওটা অরিন্দম করছে। আমার নতুন কিছু চাই!’
 
 
 
 
‘বোতলে ডিম ঢোকানো? বা জলে ছুঁচ ভাসানো?
 
 
 
 
‘না, না, ও সব চলবে না। অন্য নতুন ভাল কিছু! না হলে প্রাইজ পাব না!’
 
‘তবে শেষ দিনের আগে বললি কেন? তা হলে লাইব্রেরি থেকে কিছু বইটই নিয়ে আসতাম। দেখি আলমারিতে খুঁজে হয়তো আমার বা পাপুর কোনও বই পাওয়াও যেতে পারে,’ বলে বাবা নীচের ঘরের বইয়ের আলমারিতে খুঁজতে গেলেন।
 
সেখানে সায়েন্স প্রোজেক্টের কোনও বই পাওয়া গেল না, কিন্তু বাবা আর কাকুর ছোটবেলাকার বেশ কিছু গল্পের বই পেয়ে বাবা সেগুলো সৃজিতকে দিলেন। তার মধ্যে সৃজিতের সব থেকে ভাল লাগল বাঁধানো কয়েকটা কমিকস বই। পরের দিন লাইব্রেরি থেকে প্রোজেক্টের বই নিয়ে আসবেন কথা দিলেন বাবা।
 
খাওয়াদাওয়ার পর বিছানায় শুয়ে শুয়ে কমিকস বইটা পড়ছিল সৃজিত, এমন সময় মা এসে, ‘পড়াশোনার নাম নেই আর এখন গল্পের বই পড়া হচ্ছে! ঘুমিয়ে পড়ো না হলে কালকে স্কুলবাস ধরতে পারবে না!’ বলে ঘরের আলো নিভিয়ে দিলেন।
 
মা দরজা বন্ধ করে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া মাত্র সৃজিত বালিশের তলা থেকে টর্চটা বার করে লেপের তলায় টর্চ জ্বালিয়ে বইটা পড়তে লাগল। দুষ্টু লোকগুলো এই ধরা পড়ল বলে, সেই অবস্থায় কী আর গল্পটা ছাড়া যায়!
 
হঠাৎ খট-খট খটাস শব্দে চমকে উঠল সৃজিত। চট করে টর্চটা বন্ধ করে লেপটা সরিয়ে ঘরের চারিদিকে তাকাল সে। ওর বিছানার পাশে ওটা কী দাঁড়িয়ে রয়েছে! অবাক হয়ে দেখল সৃজিত। ঘরের চাঁদের আলো এসে পড়ছে জানলা দিয়ে, সেই আলোতেই অদ্ভুত প্রাণীটাকে দেখতে পেল সে। গণ্ডারের মতো জন্তুটার গায়ে শিরদাঁড়া বরাবর তাসের ইস্কাবনের মতন বড় বড় কী সব!
 
‘কে তুমি?’ ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল সৃজিত।
 
‘আমি স্টেগোসরাস, ডাইনোসরদের এক জন।’
 
‘অ্যাঁ, তুমি এখানে মানে আমার ঘরে এলে কী করে?’
 
‘কেন, অসুবিধা কোথায়? আমি তো এই ঘরেই থাকি!’
 
‘অ্যাঁ!’
 
‘তুমি অ্যাঁ, অ্যাঁ করছ কেন বলো তো? তোমার শব্দ ভাণ্ডারে কী আর কোনও শব্দ নেই?’
 
‘তুমি যে বললে তুমি এই ঘরেই থাক, তার পর কী করে আশা করছ যে আমি কথা বলব!’
 
‘থাকি তো! কখনও তোমার খাটের তলায় কখনও বা তোমার আলমিরের মধ্যে!’
 
‘ধ্যাৎ! তা কী করে হয়! তুমি তো ইয়া বড়! তুমি খাটের তলায় বা আলমারিতে ঢুকতেই পারবে না!’
 
হাসল স্টেগোসরাসটা, ‘তুমি ভুল বুঝছ সৃজিতবাবু!’
 
ওরে বাবা রে! জন্তুটা আবার ওর নামও জানে!
 
‘কী ভুল বুঝছি?’ বেশ ভয় পাচ্ছিল সৃজিত কিন্তু অবাক কাণ্ড, ওর কথাগুলো ঠিক মুখ থেকে বেরিয়ে আসছিল!
 
‘আমি তো সত্যিকারের স্টেগোসরাস নই, আমি হলাম স্টেগোসরাসের ভূত, তাই আমার কোথাও থাকতে কোনও অসুবিধে নেই!’
 
‘তুমি ভূত? আমি শুনেছি তোমরা ফসিল হয়ে গেছ! আমি সে দিন মিউজিয়মে দেখলাম তো তোমাদের ফসিল!’
 
স্টেগোসরাসটা বলল, ‘তুমি তো ভারী বোকা ছেলে দেখছি। আমরা এক জন তো নয়, অনেকেই ছিলাম, আমাদের মধ্যে কেউ কেউ মরে ফসিল হয়েছে আর আমি ভূত হয়েছি!’
 
সৃজিত মনে মনে ভাবল কেন যে বাবা স্টেগোসরাসের ভূতকে আমার ঘরেই থাকতে হল!
 
অমনি ভূতটা ওর মনের কথা বুঝতে পেরে গিয়ে বলল, ‘যেখানে ভূতের ভয়, সেখানেই তো ভূতে রয়!’
 
‘তুমি কি আমাকে খেয়ে ফেলতে বা আমার ক্ষতি করতে এসেছ?’
 
ওর কথা শুনে ভীষণ আশ্চর্য হল স্টেগোসরাস, বলল ‘না, না, আমরা তো ঘাসপাতা ফলমূল খাওয়া শাকাহারী জীব আর বন্ধুরা কী কখনও বন্ধুদের ক্ষতি করে?’
 
‘ভূতেরা আবার মানুষের বন্ধু হতে পারে নাকি!’
 
‘হতে পারে না হয়তো, কিন্তু দু’দিন বাদে তো তুমিও ভূত হয়ে যাবে, তখন আমরা একসঙ্গে খেলা করব। তোমার ঘরে থাকি তো তাই তোমাকে আমার খুব পছন্দ!’
 
‘অ্যাঁ, কী আজেবাজে কথা বলছ!’
 
‘না, আজেবাজে নয় একেবারে খাঁটি সত্যি কথা! মানে শুধু তুমি নয়, পৃথিবীর সবাই ভূত হয়ে যাবে! সেটাকে আটকানো যায়, কিন্তু সেই নিয়ে কারও তেমন কোনও মাথাব্যথাই নেই!’
 
সৃজিত চোখ গোলগোল করে বলল, ‘ঠিক করে বলো, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!’
 
‘দ্যাখো, আমরা তো মেসোজোইক যুগে বাস করতাম, মানে আজ থেকে ২৫২ থেকে ৬৬ মিলিয়ন বছর আগে। তখন উত্তর মেরু বা দক্ষিণ মেরুতে এখনকার মতন বরফ ছিল না। সমুদ্রের জল এখন যা আছে তার থেকে একশো-দুশো মিটার বেশি উঁচুতে ছিল। পৃথিবীর তাপমাত্রাও ছিল অনেক বেশি। তার পর দুম করে সব বদলে যেতে লাগল— সব কিছু এখনকার মতন হয়ে গেল আর আমরা সেই সব সহ্য করতে না পেরে ভ্যানিশ হয়ে গেলাম! তার পর তোমরা এলে, অনেক উন্নতি করলে কিন্তু এখন তোমরা যা করছ তাতে পৃথিবীর অবস্থা সেই মেসোজোইক সময়ের মতনই হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ! তোমরা কারখানা তৈরি করে, তেল পুড়িয়ে আরও অনেক কিছু করে যে সব গ্যাস বায়ুমণ্ডলে ছেড়ে দিচ্ছ, তাতে পৃথিবীর তাপমাত্রা হুহু করে বেড়ে চলেছে। মেরুর বরফ গলে যাচ্ছে, আর সব বরফ গলে গেলে সাগর আর মহাসাগরগুলোতে যে পরিমাণ জলোচ্ছ্বাস হবে তাতে বহু জায়গা জলের তলায় ডুবে যাবে। তার পর তোমাদের পৃথিবীতে অক্সিজেন কমে যাচ্ছে, অক্সিজেন কমলে কী হয় জান না? আমি জানি, আমাদের হয়েছিল— হাঁকপাঁক, হাঁকপাক!’
 
সৃজিতের তো মুখ হাঁ! বলে কী স্টেগোসরাস!
 
‘ওই সবকে আটকানো যায় না?’
 
‘যায়, তোমাদের পেট্রল খরচ সাবধানে করতে হবে, বিষাক্ত সব বাষ্প আর জিনিস হেলায় বায়ুমণ্ডলে আর জলে ছেড়ে দেওয়া চলবে না! প্লাস্টিক ব্যবহারে সচেতন হতে হবে, আরও সবুজ করে তুলতে হবে পৃথিবীকে। কিন্তু এই সব কথা শোনার কারও ইচ্ছে নেই, তাই পৃথিবী রসাতলে না গিয়ে যায় না! তুমি তো নেহাতই ছোট তুমি আর কী করতে পারবে? সারা পৃথিবীর সব লোক মিলে চেষ্টা করলে তবে কিছু হতে পারে, কিন্তু তোমাদের পৃথিবীর লোকজন তো আর একসঙ্গে মিলে কিছু করতে চায় না, তাই কিছুই হবে না!’ এতটা বলে স্টেগোসরাসটা, ‘এসো বন্ধু!’ বলে সৃজিতের খুব কাছে এসে একটা পা ওর ঘাড়ে তুলে দিল।
 
ওয়াক, ভূত জন্তুটার গায় কী বিশ্রী আঁশটে একটা গন্ধ আর গাটাও কেমন যেন খসখসে মতন! ‘ওরে বাবা রে!’ বলে দূরে সরে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল সৃজিত কিন্তু স্টেগোসরাসের গোদা পা যেন ওর ঘাড়ে চেপে বসছে! ভূত এত ভারী হয় কী করে!
 
ঠিক তখনই মার গলা শুনতে পেল সৃজিত!
 
‘কী হচ্ছে কী সৃজিত! অমন গোঁ, গোঁ করে শব্দ করে সারা খাটময় ঘুরে বেড়াচ্ছ কেন? নাও, এ বার উঠে পড়ো, না হলে স্কুলের বাস ছেড়ে যাবে!’
 
ধড়মড় করে উঠে বসল সৃজিত। উফ্ফ, কী ভয়ানক স্বপ্ন রে বাবা! টর্চের আলোয় বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে! বাবার ছোটবেলার কমিকসগুলোর মধ্যে থেকে যে কমিকসটা শোওয়ার ঠিক আগে পড়ছিল সৃজিত সেটাতে অরণ্যদেবের পোষা ডাইনোসর স্টেগিকে ওর বেশ ভাল লেগেছিল, সেই জন্যেই ওর ওই দুঃস্বপ্নটা মনে হয়!
 
স্কুলের জন্যে তৈরি হয়ে জলখাবার খেতে খেতে সৃজিত বাবাকে বলল, ‘বাবা, লাইব্রেরি থেকে বই আনতে হবে না। সায়েন্স ফেয়ারের প্রোজেক্ট পেয়ে গেছি।
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>