একটা গান লিখো আমার জন্য: গীতিকার সুধীন দাশগুপ্ত
সুধীন দাশগুপ্ত একজন খ্যাতিমান বাঙালি কণ্ঠশিল্পী, গীতিকার ও সঙ্গীত পরিচালক। তিনি হিন্দি, অসমিয়া এবং ওড়িয়া প্রভৃতি বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় কাজ করেছিলেন। তার রচনা ও পরিচালনায় বাংলা আধুনিক গানে স্পন্দনের সৃষ্টি করে। পাশাপাশি বাংলা চলচ্চিত্রের গানে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিল। গত ১০ জানুয়ারি ছিল সঙ্গীত পরিচালক সুধীন দাশগুপ্তের প্রয়াণ দিবস। ইরাবতী পরিবার মহান এই ব্যক্তিত্বকে সংগ্রামী লাহিড়ীর লেখায় জানায় বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
সেই পঞ্চাশের দশকে এক নবীন যুবক কলকাতায় থাকতে এসেছে। দার্জিলিঙে মানুষ। বাবা ছিলেন দার্জিলিঙের গভর্নমেন্ট স্কুলের মাস্টারমশাই। কড়াধাতের লোক। লেখাপড়া ছাড়া জীবনে অন্য উদ্দেশ্য থাকতে পারে, এ তিনি মানতেন না। ছেলেমেয়েদের শাসনে মানুষ করেছেন। দার্জিলিঙেই স্কুল। ইংরেজিতে শিক্ষা। সুরের প্রতি আজন্মের টান। এনায়েত খাঁর সেতার শুনে নিজে নিজেই শিখেছে বাজাতে। হাঁস যেমন জলে স্বচ্ছন্দ, ঠিক তেমনি অনায়াসে সুরের স্রোতে সে ভেসে বেড়ায়। সঙ্গী হয় কখনো হারমোনিয়াম, কখনো পিয়ানো বা সেতার। পিয়ানো রীতিমত শিখেছে ক্যাপটেন ক্লিভার, জর্জি ব্যাংকস, রবার্ট কোরিয়ার কাছে। আপাতত পুরো পরিবার দার্জিলিং ছেড়ে চলে এসেছে কলকাতায়, কারণ বিরাট ধস নেমেছে সেখানে।
বাবার ঘোর অমত, তাও তরুণ সুধীন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত স্বপ্ন দেখে গান বাঁধার। কম্পোজার হবে সে। কলকাতায় এসে খোঁজখবর করছে, গানে সুর দিতে চায়। বাড়িতে বাবার প্রবল আপত্তি। কথা বন্ধ করে দিলেন। মা আর অন্য ভাইবোনেরা কিন্তু পাশে আছে। সুধীন তার স্বপ্নের পিছনে ঘুরে বেড়ায়। কলকাতায় কত বিখ্যাত গীতিকার, তাঁদের গানে যদি সুর দিতে পারে। “একটা গান লিখো আমার জন্য” – অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায় সেই তখনকার সুধীন দাশগুপ্তের সঙ্গে। তবে সে গান তখনো কালের গর্ভে, জিনিয়াসের প্রতিভা সামনে আসার পথ খুঁজছে।
সেটা পঞ্চাশের দশক। সলিল–সূর্য গানের আকাশে আলো ছড়াচ্ছেন। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, শ্যামল গুপ্ত, অনল চট্টোপাধ্যায়, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত গীতিকাররা রাজত্ব করছেন। একের পর এক সোনা ফলছে বাংলা গানের জগতে।
ততদিনে সুধীন আই পি টি এ–র সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। ভারতীয় গণনাট্য আন্দোলন তাকে টানে। সেখানেই আলাপ গান আর নাটকের জগতের মহীরুহদের সঙ্গে। সলিল চৌধুরী, ঋত্বিক ঘটক, উৎপল দত্ত, দেবব্রত বিশ্বাস – মুগ্ধ বিস্ময়ে সুধীন তাঁদের দেখে। উজ্জীবিত হয়, সেও একদিন গানের সুরে তার স্বাক্ষর রেখে যাবে।
কিন্তু কাজটা সহজ নয়। কে দেবে সুধীনকে নিজের লেখা গান? কোনো প্রতিষ্ঠিত গীতিকারই নতুন সুরকারকে গান দিতে চান না। তাই দরজায় দরজায় ঘোরা আর শেষ হয় না।
হতাশ সুধীন মনে মনে ভাবে, নিজেই গান লিখবে। চিরকালের ইংরেজিতে পড়াশোনা করা সুধীন বাংলায় স্বাচ্ছন্দ নয়। কিন্তু জেদ চেপে গেল। রীতিমত শিক্ষকের কাছে গিয়ে বাংলা শিখল। ততদিনে সে আই পি টি এ-র উত্তর কলকাতার শাখার দায়িত্বে। গান লিখতে হয়, সুর করতে হয়। সেই গান আই পি টি এ–র শিল্পীদের গলায় ছড়িয়ে যায় সর্বত্র। ‘ওই উজ্জ্বল দিন ডাকে স্বপ্ন রঙিন‘ বা ‘স্বর্ণঝরা সূর্যরঙে‘র মত গান বাঁধা হল আই পি টি এ-র জন্যে। বাকিটা ইতিহাস। সুরকার সুধীন দাশগুপ্ত তখন পরিচিত নাম। এবার গীতিকার সুধীন দাশগুপ্তের জন্ম হল। আবাল্য ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করা, নেপালি ভাষায় স্বচ্ছন্দ যুবকটির রচিত বাংলা গানের কথা উজ্জ্বল দিনের রঙিন স্বপ্ন বুনে দিল, যে স্বপ্নে বাঙালি অনেককাল বুঁদ হয়ে থাকবে।
গীতিকার সুধীন দাশগুপ্তের লেখা গানের সংখ্যা কম। কিন্তু সেসব গানের কথার গভীরতা অতল।
চারদেওয়ালের মধ্যে নানান দৃশ্যকে
সাজিয়ে নিয়ে দেখি বাহির বিশ্বকে –
আকাশ করে ছাদটাকে
বাড়াই যদি হাতটাকে,
মুঠোয় ধরি দিনের সূর্য, তারার রাতটাকে…
মান্না দে‘র গলায় এ গানে দিনের সূর্য, রাতের তারা – সবাই ধরা দিয়েছে।
চোখের নজর কম হলে আর কাজল দিয়ে কী হবে?
রূপ যদি না থাকে সখি গরব কেন তবে?
১৯৫৮ সালের গান। সহজিয়া কিন্তু গভীর কথা শ্রোতার বুকে ধাক্কা মারে। সুধীন দাশগুপ্তের লেখা এ গানের কথা কোটেশন হয়ে গিয়েছিল। এমনই সহজিয়া ধারার আরেকটি গান –
চিনেছি চিনেছি তোমার এ মন,
লুকিয়ে রেখো না তারে এখন,
তুমি আমারি, আমি তোমারি মনের মতন।
এমন করে মনের কথাটি বলতে কজন পারে? ১৯৬৬ সালে আরতি মুখোপাধ্যায়ের গলায় এ গান অমর হয়ে আছে। আরেকটি অনন্য গীতিকবিতা লিখলেন, প্রেমিকের অনুভূতি দিয়ে –
নাম রেখেছি বনলতা, যখন দেখেছি,
হয়তো বা সেইক্ষণে তোমায় ভালোবেসেছি
ছোট্ট ছোট্ট সুরের উচ্ছলতায় লাফিয়ে লাফিয়ে এগোয়, হঠাৎ গানের চলন বদলে যায়,
বনলতা, কও কথা,
হয়ো না গো কুণ্ঠিতা…
বনলতার সাধ্য কী যে এমন গানের পরও চুপ করে থাকে? শ্যামল মিত্রের গাওয়া ১৯৬১ সালের এ গান দিয়ে কত যে যুবক প্রেমিকাকে কথা বলিয়েছে, সে হিসেবে কেই বা রাখে?
তাঁর লেখা গান নিয়ে মজার গল্প শুনিয়েছেন সুধীনের ছেলে সৌম্য দাশগুপ্ত। ছেলের আবদারে বাবা একটা ছোট্ট চারলাইনের গান বেঁধে সুর করে দিলেন।
ছোট্ট বাহাদুর, যাচ্ছ কতদূর,
রাস্তা থেকে কিনে দেব গরম চানাচুর
ছেলের জন্যেই বাঁধা গান, কী সুন্দর সুর! ছেলে মহা খুশি।
ও মা, একদিন দেখা গেল ঠিক ওই সুরেই বাবা আরেকটা গান বেঁধে ফেলেছেন –
কী নামে ডেকে, বলব তোমাকে
মন্দ করেছে আমাকে ওই দুটি চোখে…
শ্যামল মিত্র গাইলেন, সুপারহিট হল গান। হলে কী হয়, ছেলে সৌম্য কিন্তু খুব রেগে গিয়েছিল। তার গানটা বাবা অন্যকে দিয়ে দিল? রাগ ভাঙাতে বাবা কী করেছিলেন, সে আমাদের জানা নেই। শুধু জানা আছে, সুধীন দাশগুপ্তের রচিত গানের সুষমা খুব সহজেই হৃদয় ছুঁয়ে ফেলে, সরল করে বড় গভীর অনুভূতির কথা বলে।
একদিন সেইদিন সঙ্গীবিহীন পথে চলে যেতে হবে –
একদিন সেইদিন ক্লান্তিবিহীন স্রোতে ভেসে যেতে হবে –
কী হবে ভেবে কী হবে না হবে,
কী হবে চেয়ে কে রবে না রবে,
জানি না কী হারাবে কবে…
অনন্ত জীবনবোধের কথা, শাশ্বত সত্যের বাণী। বনশ্রী সেনগুপ্ত গেয়েছিলেন এ গানটি। এর সুর নিয়েও মূল্যবান এক্সপেরিমেন্ট আছে। এখানে সেটি আলোচ্য নয়। গানের কথার গভীরতা শ্রোতাকে নাড়িয়ে দেয় – সত্যিই তো, আমরা “জানি না কী হারাবে কবে!”
তবে এটুকু জানি, আর যাই হারাক, সুধীন দাশগুপ্তের সৃষ্টি হারাবে না, অমূল্য রতন হয়ে রয়ে যাবে শ্রোতার মনে, প্রজন্মের পর প্রজন্মে।
সঙ্গে রইল নিজের গলায় গাওয়া গানটি।

ইঞ্জিনিয়ার, পেশায় কনসালট্যান্ট। শাস্ত্রীয় সংগীত নিয়ে বহুদিনের চর্চা। অল ইন্ডিয়া রেডিওর ‘এ’ গ্রেড শিল্পী। লেখালেখির অভ্যাসও ছোট্টবেলা থেকে, বাবা-মা’র উৎসাহে। বর্তমানে কর্মসূত্রে নিউ জার্সির পারসিপেনি শহরে বসবাস। তবে বিদেশে বসেও সাহিত্যচর্চা চলে জোর কদমে। নিউ জার্সি থেকে প্রকাশিত ‘অভিব্যক্তি’ ও ‘অবসর’ পত্রিকার সম্পাদক।
‘ও কলকাতা’ ই-ম্যাগাজিনে ধারাবাহিক ‘সুরের গুরু’ প্রকাশিত হচ্ছে রাগসংগীতের শিল্পীদের নিয়ে। এছাড়া ‘বাংলালাইভ ডট কম’, ‘বাতায়ন’, ‘পরবাস’, ‘উদ্ভাস’, ‘প্রবাসবন্ধু’, টেকটাচটক’, ‘গুরুচণ্ডা৯’, ‘ইত্যাদি ই-ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখিকা।
হীরক সেনগুপ্ত says:
কী যে ভালো লাগল! ইস তবে এই টুকু,ছোট্ট… আরেকটু লিখতেন। প্রাণ জুড়ানো লেখা।
হীরক সেনগুপ্ত