আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট


বাংলা কবিতা বললেই আমরা প্রথমেই ভাবি পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ বা ত্রিপুরার কবিদের লেখা কবিতার কথা। বাংলা কবিতায় ঘুরে ফিরে তাঁরাই আসেন বারংবার। ত্রিপুরার বাংলা কবি ও কবিতা অবহেলিত হলেও তাঁদের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়, কিন্তু অসমে বসে যাঁরা বাংলা সাহিত্য চর্চা করছেন কিংবা কবিতা লিখছেন তাঁদের কথা, তাঁদের লেখার খোঁজ সেইভাবে পাওয়া যায় না। ইরাবতী অসমের সমসাময়িক কবিতাকে পাঠকের কাছে তুলে ধরতে আজ প্রকাশ করছে ১৪ জন অসমের বাংলা কবির কবিতা। এই বিশাল আয়োজনটি সম্পূর্ণ হতো না কবি অর্জূন দাসের সহযোগিতা না পেলে। ইরাবতীর পক্ষ থেকে কবি অর্জুন দাসকে জানাই আন্তরিক অভিবাদন ও শুভেচ্ছা।
সুখ-অসুখ
প্রমোদরঞ্জন সাহা
সুখের সময় পদ্ম ফোটে গোলাপ ফোটে,
দুঃখের সময় কারো
দেখা মেলে না।
নির্জন কাননে শুধু বাতাস
হু হু করে,
সেই বাতাসে কেবল
হলুদ পাতা ওড়ে।
সুখ তুই সবার বড়
আপন,
দুঃখ তুই অনাদরে
বেড়াস ছুটে,
যেখানে লক্ষ্মীর আবাস
নেই মোটে,
সেখানে দুঃখ কেন যে
বাসা বাঁধে?

শেষ ট্রেনের বিলাসখানি
সঞ্জয় চক্রবর্তী
কোথায় থাকো,কী নাম?
তোমার নামেই তরী ভাসালাম ৷
গৃহদ্বারে ফিরব,হাতপাখা দোলে
আঁচল মোছায় জন্মান্তরের ঘাম ৷
কতদূরে চলে গেলে ফিরে আসার
পথ খোলা থাকে?এই জীবন
ধুলোসম্বল,আর এককের গান ৷
শরীরে বৃষ্টি জড়িয়ে আসবে সে,
চব্বিশের শ্রাবণ,আঠাশে ভিজব আমি ৷

পরবাস
অমিতাভ দেব চৌধুরী
দু’জন আসলে দান্তের দেশ থেকে
এসেছিল এই শকুন্তলার শ্লোকে।
তারপর আর হয়নি তাদের ফেরা।
দেবতারও রোগ। মানুষ কি পায় ছাড়া?
তাদের কফিনে পেরেক ঠোকার আগে
একফোঁটা শুধু অশ্রুলিখন জাগে।
মৃত্যুও তবে বুঝি হয় পরবাসী?
দেশে না-ফেরা কি মৃত্যুর সন্ন্যাসই?
মৃত্যুও তবে গেরস্থ হতে চায়?
গৃহ হে , তোমায় এড়ানো ভীষণ দায়!

আদার ব্যাপারী
তপন মহন্ত
অবেলার বাগানে শব্দের চাষ
আমের কলম ছাটতে গিয়ে
লিখি অজগর
কেউটে ধরতে চাই
অথচ হেলেতে ভয়
ভাবি গাছ
লিখি কাঠঠোকরার ঠোঁট
আদার দোকানে বসে
জাহাজের ছবি আঁকি
সুনীল জল আর বিপুলা জাহাজ

বৃষ্টি
দীপিকা বিশ্বাস
আমি এখন পুড়তেও অক্ষম
মুশলধারে বৃষ্টি যেমন
শুকনো পাতাকে উড়তে দেয় না
পুড়তেও না!
যখন আবহাওয়া ভেজায় না মাটি
বর্ষীয়ান ক্ষেতের সফলতা পাম্পসেটে
তখনও বৃষ্টিকেই ভয় পাই
যে পতন থেকে সৃষ্টি উদোম
ভেসে যাবার বিষম ভয় তাকেই৷
সব অস্তিত্ব কি তেমনই উভয় সংকটে!

মাংসের ঘ্রাণ
সমর দেব
ক্যানাইন টিথে মানচিত্র ছিঁড়ে ফেলে বসেছো বিরামে
তখনও হয়নি ভোর সূর্যের প্রথম ছটা আছে বহুদূর
অন্ধকার এখনও অনেক গাঢ়, এখনও প্রচুর শীত
ফুটপাথ জুড়ে ছেঁড়া কম্বলে আপাদমস্তক ঢাকা
কয়েকটা মানুষ, তাদের নিঃশ্বাসে ঝড় ওঠে খুব
তখন দাঁতন হাতে তুমি ঘসে ফেলো ঝকঝকে দাঁত
মাংসের বিরল স্বাদ জেনে গেছে পৃথিবীর সমস্ত বাঁদর
সমস্ত জল আর স্থলভাগ জুড়ে তারা ঢুঁড়ে ফেরে
আমিশাষী ঘ্রাণ, আকস্মিক নিভে যায় হ্যালোজেন ছিল যত
মধুর কিমায় তারা সুনিপুন ঢেকে দেয় কলসের মুখ
মহেঞ্জোদড়োর মতো চাপা পড়ে গ্রাম ও শহর আর নিঃস্ব পাঁজর
অথচ অবোধ্য লিপিতে ঠিক ধরা থাকে সত্য অকপট
একদিন ডিকোড হবে ঠিক, একদিন আচ্ছাদন সরে যাবে দেখো
সমস্ত অবোধ্য লিপি প্রতিভাত হবে কোনোদিন চরম প্রজ্ঞায়
সব ব্যথা, সব দুঃখ, সমস্ত অভিমান আর অকথ্য নিপীড়ন
উদ্ঘাটিত হবে, দাঁতের ফসিলে যত থরে থরে লুকনো অতীত
বেলজিয়াম কাচের আয়নায় প্রতিচ্ছবি এত স্বচ্ছ হতে পারে
আগে তো ভাবনি সময়ের দাঁতে মাংসের ঘ্রাণ লেগে থাকে।

লাথ কতদূর যায়
শিবাশিস চট্টোপাধ্যায়
ধরে নিন ‘ডি’, যার টাকা নেই, উকিল নেই
গলাধাক্কা দিলেও যায় না, আর তা দেখে অতঃপর (আপনি) আপনার জুতোর মাপ নিলেন, গুণাগুণ পরীক্ষা করলেন, ‘খাদিম’ লেখা দেখে লাফিয়ে উঠলেন, বুঝে ফেললেন এটাই মোক্ষম…,তারপরই খানিক থমকে দাঁড়িয়ে হিসেব কষে দেখলেন, লাথ কতদূর যায়, বা যাবে? সীমান্ত অব্দি? আর যার পাছা সে (যদিও পাছা কী ভাবছে বড় কথা নয়) তখন ভাবছে কতটা নিতে পারবে, মানে ধাক্কা, মানে ঘুষির মতন ঠিক কতো সিক্কা–বিরাশী না তিরাশী না চুরাশী? আর সীমান্তের ওপারের ভারি বুট? বুটের কথা ছেড়েই দিন— বুকের ভিতর মচমচ করে ওঠার আগেই লাত্থিটা মারুন, মশায়!

আমি সেই কিশোর রিফিউজির সন্তান
অভিজিৎ চক্রবর্তী
আমি শ্রীমতী ভবতারিণী চক্রবর্তী, স্বামী ঈশ্বর
অমৃতলাল চক্রবর্তী, বয়স পঞ্চান্ন, বর্তমানে
ভারত রাষ্ট্রের আপনবাটি গ্ৰামের বাসিন্দা,
ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট এই মর্মে ঘোষণা
করিতেছি যে, আমি আমার তিন পুত্র যথাক্রমে
২৮,১৮ ও ১২ বছর বয়সী গণেশ, দয়াময়, মায়াময়
এবং ২০ বছরের বাল্য বিধবা কন্যা কমলাকে লইয়া
পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকা জেলার পুরাপাড়া গ্ৰাম হইতে
১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে এই
দেশে আসিয়াছি। আমার কেহই আর পূর্ব পাকিস্তানে
ফিরিয়া যাইতে চাহি না। —১৯৫৫ সালের জুলাই মাসে
এই ঘোষণা মর্মে ম্যাজিস্টেটের নিকট স্বাক্ষর করিলাম।
এই আখ্যান থেকে সেদিন জন্ম নিয়েছিল কবিতা।
মুক্ত ছন্দে লেখা, পৌনে শতাব্দীর প্রাচীন ব্যালাড।
শুধু ছন্দমুক্তি নয়, ছিল মানচিত্রমুক্তিরও ঘোষণা।
কবিতা কোনো কালেই মানেনি কাঁটাতারের বাধা।
যেন সুর, এক ভূগোলে জন্মে ছড়িয়ে যেতে থাকে।
যে তাকে কোল পেতে দেয়, জিরিয়ে নেয় সাময়িক।
ভবতারিণী দেবীর কনিষ্ঠ পুত্রটি আমার পিতা।
আমি সেদিনের সেই কিশোর রিফিউজির সন্তান।
যাবতীয় পরিচয় চিহ্ন মুছে সেই কবিতাটিকে
অনন্তের দিকে নিয়ে চলেছি, পুত্রাদির ভরসায়।

মাটি
তমোজিৎ সাহা
কবরের মাটিতে বা শ্মশানের
কালো ছাইয়ের স্তুপে
মিশে যাব একদিন
সেখানেই শুয়ে থাকব
যতদিন না তুমি লাঙল হাতে
এসে মাটি খুঁড়ে শষ্যের
বীজ বপন করছ
এই পৃথিবী থেকে কবর আর
শ্মশানের সব চিহ্ন মুছে দিয়ে
শুধু ফুল আর ফসলের
চাদর বিছিয়ে দিচ্ছ ৷
জানি এ সবই অলীক
উন্মাদের প্রলাপ বলে
সম্পাদক মশাইও ছিঁড়ে-ছুড়ে
ফেলে দেবেন আমার এই পাণ্ডুলিপি
তবুও মনের কথা বলবই
স্বপ্নের কাঁথা বুনবই৷
হাজার হাজার বছর পরে
যখন গোরস্থান ও শ্মশান
মাটিতে মিশে যাবে
মনুষ্যহীন শান্ত সেই পৃথিবীতে
শুধু গাছ হয়ে মাটির সভ্যতাকে
ভালোবাসার শিকড়ে জড়িয়ে থাকব৷

লিগ্যাসি
দেবলীনা সেনগুপ্ত
পুরনো চিঠির অক্ষর মুছে গেছে সব
জড়ানো হাতের টানে প্রিয়নাম
অভিমানিনীর মত মুখ ঢেকেছে
গলে যাওয়া কালিদাগে ৷
এখানে কেউ কি রেখেছিল বুকের সুবাস?
ঝাউপাতার মাঝে গোলাপি উপহার?
অথবা সাদাসিধে কথন ও কুশল সংবাদ
বিনিময়, গ্রহণ ও প্রত্যাখ্যানে মিশে যাওয়া
অদরকারী দিনরাত,প্রলাপ ও প্রলেপ
অনিবার্য ক্ষতে?
আগন্তুক দিন জানে
পুরনো চিঠি কোন আগুন জ্বালে না আর,
পুরনো চিঠির কোন জবাব যাবে না
বাহারী খামে
তবুও আঙুল ফেরায় সুদর্শন লিপি
স্মৃতিজড়িত আঙিনায়
এখন তো সব দিন কাটে, কাটে রাত
লিগ্যাসি খোঁজার বাহানায়।

ছাপোষা
নীলদীপ চক্রবর্তী
আভূমি যে মাথা নুইয়ে রাখা
তাঁর চুলে ধুসর অতীত –
বোবা কান্না মূল থেকে গভীর ধ্বনিতে
কন্ঠে যে ঈশ্বর আছেন, নির্বাক বধির
সুপ্তিতে ছড়িয়ে তাঁর অতিকায় দানব,
প্রতি কোষে বিলিয়ে চলে – নির্বিঘ্ন প্রতারণা
তবুও পরাভূত হবার আগে, সে জাগে
বীজ তবু বৃক্ষ হয়,
অতি কষ্টে শুষে নেয়
জরুরি পুষ্টি!
এই বৈপিরীত্য তাঁর শিখর ছুঁয়েছে
আভূমি যার মাথা নোয়ানো –
তাঁর চুলে ধুসর অতীত!

গল্পবিজ্ঞান – ৫
কমলিকা মজুমদার
স্থান ও সময়ের অক্ষরেখা ভেদ করে
যে অচেনা ডাইমেনশনে দিয়েছি পা,
বিজ্ঞান তাকে টাইম ট্রাভেল বলে,
বলে বিদেশি সিনেমার রুপালি পর্দা।
আমি শুধু ফিরে যাই হারানো পাতায়
একবার তোমায় ছুঁয়ে দেখবো বলে,
নিজের করে জের টানবো দিনগুলোর
আমার বর্তমানে, গণিত খাতার মতো।
আইনস্টাইন তো সেই কবেই বলেছেন
সময় এক ও অভিন্ন হয় না কখনোই ,
তবু, মাঝে মাঝে আমার নিস্তব্ধ মুহূর্তেরা
তোমার ঘড়ির প্রতি অদম্য লোভে জাগে।

জন্মভূমিকে আমি কি ভুলিতে পারি?
অর্জুন দাস
যে ভূখণ্ডে এখন আমার বসবাস
সেখান থেকে কয়েক পা দূরে
এক ভিন্ন প্রদেশ। সীমাহীন এক সীমা।
সেখান থেকেও মধ্যরাতে মাঝে মাঝে
ভেসে আসে জুবিনের সুরেলা বিহু গীত।
একাকী সেই সুর বাকহীন ও বধির হয়ে
বুকে আঁকড়ে নেই। যেন পড়শীর বাড়ানো হাতটা!
তখন মনে হয় জন্মভূমিকে এই তো ছুঁতে পারলাম।
তবে কি ঘরের বাইরে এলেই দেশকে
বেশিকরে বুকে নেওয়া যায়—
একথাটা সত্যি?

মেঘ
নীলাদ্রি ভট্টাচার্য্য
ছায়া রঙের পরাগ অন্ধকার
পিছু ফিরে তাকিয়ে থাকলে মনে পড়ে
আমার সামান্য অন্তরমুখী ঘরের ছাদে
অসমান্তরাল অসংখ্য মেঘলা আঘাত
প্রতিটি স্তরে আবার বৃষ্টি চাইছে
তারপর বর্ষা…
অন্তর পশলা ডাঙা
তুমুল এক বাদল ঘন
তোমার
প্রেমের গৃহহীন মালা
এক ঘূর্ণিতে ওঠে আসছে
আবার হৃৎপিণ্ডের মতো নিষ্ঠাভরা আমের গন্ধ।

দারুণ কাজ হচ্ছে। পড়লাম , পড়ালাম
খুব ভালো লাগলো । পড়ে আবিষ্ট হওয়ার আনন্দ পেলাম । ১৪ জন কবির মধ্যে ৩ জন মহিলার নাম আমায় আলাদা করে ভাবিয়েছে । মেয়েরা সাহিত্য জগতে এখনও প্রান্তিক ।সেখানে এঁদের কবিতাগুলোয় মোটৈই প্রান্তিক নয় কেন্দ্র কে স্পর্ধায় ছুঁয়ে যায় । ইরাবতী র উদ্যোগ অবশ্যই অভিনন্দন যোগ্য ।