| 28 মার্চ 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ছোটগল্প: একটি বেনসন বা জংলীফুলের গন্ধ । ইসরাত জাহান

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

বড় রাস্তাটার ডান পাশ দিয়ে যে ছোট গলিটা শুরু হয়েছে, সেই গলির মুখে “খাই খাই” রেস্টুরেন্টের শিক কাবাবের মাংসগুলো যখন ঝলসানোর অপেক্ষায় বসেছিলো, তখনই একটি গাঢ় দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বিথী এসে কলিংবেলে আঙুলটা রাখে। আজও দশ মিনিট দেরী। আসার পথে হাউস সাইজের কেটলিতে জ্বাল করা চা পাতার ঘ্রাণটা চায়ের তেষ্টা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। দীর্ঘশ্বাসের সাথে তেষ্টা দুটোই মনকে বিষিয়ে তোলার জন্য পরিপুরক।

তাজমহল রোডের এই গলিটায় একটু পরেই ভাত ঘুমের রোদটা ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে আসবে। মুখরিত হবে গোটা পাড়াটা শিশু, ঘরে ফেরা মাইনে পাওয়া ভদ্রলোকদের গাড়ীর হর্ন বা রিকশার টুংটাং শব্দে, সাথে আছে ডেভলপারদের সারাদিন নতুন দিগন্তে কেতন তৈরীর শব্দমালা। এই পাড়ায় প্রতি সপ্তাহে দুইদিন আসে বীথি। দরজাটা খোলে অনির্বান। ঘরে ঢুকে কাঁধের ব্যাগটা ছোট টুলের উপর রেখে সোজা বাথরুমে চলে যায়, অনির্বানের চোখের উষ্ণতাকে এড়িয়ে যাবার জন্য। আজও কথা শুনতে হবে, তার চেয়ে কিছু সময় পানি নিয়ে জলকেলি করাটা মন্দ না। দশ মিনিট পরে বের হয়ে ব্যাগ থেকে খাবারের বাটিদুটো আলাদা করে রাখে, যার দুই বাটির একটিতে খিচুড়ি অন্যটিতে ঝালঝাল ডিমভুনা।

– আজও দেরী তোমার ?

– কি করবো, রাস্তায় জ্যাম। ভালোমন্দ আনার কারনে একটু দেরী হয়ে গেলো।

– এরপরে দেরী করলে আমাকে অন্যচিন্তা করতে হবে।

এই কথা শুনতে শুনতে বীথি বড় বসার ঘর থেকে পা মাড়িয়ে ছোট ঘরটায় ঢুকে পড়ে। প্রতিদিন একই কথা, পুরোটা মুখস্থ। ছোট ঘরটা স্টুডিও। দুইপাশে দুটো ফোকাসিং লাইট, মাঝে হ্যালোজেন বাতি জ্বলছে। হ্যালোজেন বাতি বরাবর ছোট টুলটায় বসে পড়ে, আজ একটু দুর্বলও লাগছে। এতো ছোটাছুটি শরীর আর নিতে পারে না আজকাল। সাথে অনির্বানের কর্কশ ভাষায় আলাপন। যা কানে জ্বালা ধরায় বীথির। কিন্তু শুনতে মন চায়।

– বসে পড়লে কেন? তোমাকে সময় ধরে পে করা হয়। আমার লস করে কি লাভ তোমার।

– একটু জিরিয়ে নেই। আজ অফিসে খুবই চাপ গেলো। সময়টা একেবারে পুশিয়ে দেবো সময় ধরে ধরে।

– তোমার সময় দিলে হবে না, আমারও তো সময় থাকতে হবে। তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নিও।

– আজও কি পুরোটা?

– এটা কেমন কথা, অর্ধেকটা করে রেখেছি, আজ পুরোটা তুলবো। যাও সব খুলে আসো।

অনেকটা হতাশ হয়ে শাড়ী, ব্লাউজ, পেটিকোট, ঘামে ভেজা ব্রা, প্যান্টি একে একে খুলতে খুলতে অনির্বানের দিকে আড়চোখে তাকায় বীথি। লোকটা কাপড় খোলার সময় কখনো ফিরেও তাকায় না। ওইসময়টায় লাইটগুলোতে আলোর মায়জাল তৈরীতে ব্যস্ত থাকে, নারীর শরীরের মায়াজাল থেকে দৃষ্টি সরিয়ে। বীথির লোকটাকে অদ্ভুত লাগে। প্রায় তিনমাস ধরে এখানে আসে, কখনো চাহনীতে কামুকতা দেখেনি। অথচ রাস্তায় বের হলে কতশত কামুক চোখ প্রতিদিন গিলে খায় ওকে। বাসে উঠার সময় হেল্পারের তাড়াহুড়োর নোংরা ছোঁয়া। পাশের সিটের যাত্রীর আনমনে ভদ্র লেবাসযুক্ত ছোঁয়া। আগে প্রতিটি ক্ষণে এই ছোঁয়াছুঁয়ি কারণে অস্বস্তিতে কাটতো ওর পথঘাটের চলার সময়গুলো। একটা সময় সবকিছু পায়ে মাড়িয়ে চলতে শুরু করে। কারণ ততদিনে বিথী বুঝে গেছে এতো অশুচিতা নিয়ে সমাজে চলা যাবে না। বেঁচে থাকতে হলে লজ্জা, অস্বস্তি, ভয়কে কাটিয়ে চলতে হবে। এই উপলব্ধিটা হয় স্বামীর বাস এক্সিডেন্টে পা দুটো কাটা যাবার পরে। চার বছরের পুত্র আর বৃদ্ধ বাবার কাছে পঙ্গু স্বামীকে রেখে যখন কাজের সন্ধানে বিভিন্নজনের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয় ওর। একটা সময় কাজ পায়, সিকিউরিটি গার্ডের। সারা জীবন শাড়ি, সেলোয়ার কামিজ আর বুকটা ওড়না দিয়ে ঢেকে রাখা বিথীর পুরুষের পোশাক প্যান্ট, শার্ট আর বেল্ট পরতে অস্বস্তি লাগতো। বারবার মনে হতো ওর ৩৬” সাইজের বুকের দিকে সবাই তাকিয়ে আছে। একটা সময় সেই লজ্জা কাটিয়ে সুন্দর করে সালাম দিয়ে অর্ভ্যথনা শিখে ফেলে চারটি পেটের আহারের তাগিদে। চাকরি বাঁচাতে হলে ওর এই ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। একদিন বিথীর ডাক পরে সুপারভাইজারের ছোট রুমে। কাজের আলাপের সুত্রে শরীরিক আলাপ সেরে ফেলে সেই লম্পট মজিদ। তারপর থেকে নিজের শরীরের তাগিদে বা কিছুটা সুবিধার কারনে মজিদের সাথে সখ্যতা বাড়ে ওর। কারণ পা হারানো অক্ষম স্বামীর কাছে প্রাপ্তির ঝুড়ি দিনে দিনে শূন্য হচ্ছিলো।


আরো পড়ুন: শমীক ঘোষের গল্প জঞ্জির

একদিন অনির্বান এসেছিলো বিথীদের অফিসে, কোন কাজের প্রয়োজনে। ফেরার পথে কার্ড দিয়ে বলেছিলো দেখা করার জন্য। নতুন কাজের আশায় একদিন ফোন করে বিথী সেই অপরিচিত নম্বরে। বাসার ঠিকানা দিয়ে দেখা করতে বলে। কিছুটা সংকোচ নিয়ে দেখা করতে আসে তাজমহল রোডের এই বাড়িতে। সেখানে এই প্রস্তাব পায় বিথী। সপ্তাহে দুদিন নুড মডেল হয়ে বসতে হবে হ্যালোজেন বাতির নীচে। দুই ঘন্টা করে। বিনিময় হাজার টাকা পাবে। দুইমাস হয়ে গেছে, আরো হয়তো একমাস আসতে হবে এখানে। তারপরে এই বাড়তি ইনকামের পথটা বন্ধ হবে।

– আজ আপনার জন্য একটু খাবার এনেছি?

– কেন?

– একা একা থাকেন, একটু ভালো মন্দ খেতে তো মন চায় আপনার।

– সেটা আমি দোকান থেকে কিনে খেতে পারি, তোমার কষ্টের টাকা আমার জন্য খরচ না করলেও চলবে।

– ভাবলাম…

– বেশী ভেবো না, মন দিয়ে কাজ করো। রেডি?

– একটু… এবারে ঠিক আছে?

পিয়ানোর সুর ভেসে বেড়ায় পুরো ঘরময়, সেই মুর্ছনায় অনির্বান আঁকতে শুরু করে ওর বহুদিনে কাঙ্ক্ষিত পেইন্টিং “নিমগ্নতায় সুখ”
এই ছবিটি আঁকতে শুরু করেছিলো বহুদিন আগে, ওর জন্য নুড মডেল হতে রাজি হয়েছিলো ওর তখকার প্রেমিকা কুমকুম। হঠাৎ একদিন বলা নেই কওয়া নেই কুমকুম হারিয়ে যায় ওর জীবন থেকে। কুমকুমের অনুরোধে অর্ধেক আঁকা ছবির পুরোটাই পুড়িয়ে ফেলে প্রেমিকার সামনে দাঁড়িয়ে। সেই রাতে থেকেই অনির্বানের ঘুমুতে কষ্ট হয়। বহুদিন একা একা রাতের শহরে ঘুরেছে কুমকুমের মুখাবয়বের সাদৃশ্য মুখের সন্ধানে। মাঝেমাঝে একটু মেলানো যাদের পেয়েছে, কেউ রাজি হয়নি। কত গালাগাল খেয়েছে এই ছবির মডেল খুঁজে বের করার জন্য। অবশেষে একদিন মতিঝিলের ব্যস্ত কর্পোরেট ব্যাংকের হেড অফিসে ঢোকার মুখে পেয়ে যায় সেই কাঙ্ক্ষিত মুখখানি। পুরোপুরি কুমকুমের মতো না হলেও মুখখানি তার থেকেও বেশ কমনীয়। লোভ সামলাতে পারে না। যেচে পড়ে কার্ডখানি এগিয়ে দেয় বীথির দিকে। সিকিউরিটি গার্ডের পোশাকে সৌন্দর্য প্রকাশ পাচ্ছিলো না তেমন। কিন্তু চোখ, থুতনীর আদরমাখা ভাঁজ, গালের টোল পুরোটাই অনির্বানকে আকৃষ্ট করে।

– স্যার একটু…

– কি দরকার?

– একটু ছোট কাজে যাবো।

– উফ, বলেছিলাম না দুই ঘন্টার ভেতরে একেবারে নড়বে না।

– স্যার তা কি সম্ভব?

– যাও, তাড়াতাড়ি আসো।

বিথী আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। অনেকক্ষণ বসে থাকার কারনে পা দুটো অসাড় হয়ে থাকে। তাইতো পায়ে কোন সায় পা য়না অনেকটা সময়। বাথরুম কাম টয়লেট থেকে বের হবার সময় আয়নায় নিজেকে দেখে বিথী। সুউচ্চ স্তন, লম্বা গ্রীবা, টানটান চিবুক। বেরিয়ে যাওয়া কন্ঠ হাড়। নিজের দিকে তাকিয়ে নিজেই কিছুটা সময় মুগ্ধ হয়ে যায়। রক্তমাংসের গড়া নারীর প্রতি কেন এই পেইন্টার কোন আর্কষন অনুভব করে না। ব্যাপারটা ওকে ভাবায় বেশ। বেরিয়ে এসে দেখে অনির্বান সবকিছু গুটিয়ে ফেলেছে।

– আজ আর বসবেন না?

– না, ভালো লাগছে না।

– কেন, শরীর খারাপ?

– একটু জ্বর জ্বর লাগছে।

কথাটা শুনেই বীথি কিছু না ভেবে কপালে হাত রাখে উষ্ণতা যাচাই করার জন্য। হঠাৎ কপালে হাত রাখায় অনির্বান কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। বিথীও হাত সরিয়ে নিয়ে। দ্রুততম সময়ে কাপড়টা পরে ফেলে।

– খাবারটা দেবো?

– কেন আনো এইসব। অভ্যাস খারাপ করছো, দাও।

– চা চুলায় দেবো? আমিও একটু খাবো, তাই…

– দাও। চিনি ছাড়া।

এই রান্নাঘরের সবকিছু এখন ওর নখদর্পণে। মাঝেমধ্যে নিজের হাতে গোছায়। ভালোলাগে ওর এই রান্না ঘরটা। সাথে পাগলাটে আঁকিয়েকেও। তার ভেতরটাকে জানতে মন চায়। কিন্তু ও জানে, তা ঠিক না। ও হলো নেংটা মডেল। টাকার বিনিময় কাজ করে। এখানে মনের খোঁজ-খবর নেয়াটা বেমানান।

দূরে দাঁড়িয়ে বিথীকে দেখে অনির্বান। মেয়েটা আস্তে আস্তে ঘরটায় দখল বসাচ্ছে। কাজ শেষে ফেরার পথে ঘরটা একটু আকটু গোছায় নিজের আগ্রহে। নিষেধ করেছে অনেকবার। শোনে না। মায়া লাগে মেয়েটাকে।

– স্যার, চা। কাল কি আসবো?

– কেন কোন সমস্যা?

– না, যদি বলেন, আসবো।

– ঠিক আছে, এসো। টাকাটা টেবিলের ম্যাটের নীচে চাপা দেয়া।

টাকাটা নিয়ে বিথী বেরিয়ে পড়ে ব্যস্ত নগরে। ঘরে ফেরার তাড়ায়। অনির্বান বারান্দায় এসে অন্ধকারে বসে সিগারেটের ধোঁয়ায় আশ্রয় খোঁজে। নিজেকে নিয়ে ভাবে। ইদানিং বিথী উপর কেমন যেন অধিকার দেখাতে মন চায়। অকারণে বকতে মন চায়, মুখখানি মলিন করে অভিমান চোখে তাকালে আদর করতে মন চায়। নিজেকে মনে মনে শাসায়, একজন নুড মডেলের জন্য এতোটা মমত্ববোধ থাকাটা ঠিক না। আগামীকাল এলে তাড়াতাড়ি কিছু স্কেচ করে ছেড়ে দিতে হবে। মেয়েদের প্রতি তীব্র রাগ, বিদ্বেষ অনির্বানকে সমানে এগুতে নিষেধ করে, সাথে বিথীর পিছুটান। কিন্তু মন নামক বায়বীয় বস্তুটি সেই কোমলমুখটির মাঝে হারাতে চায়।

আজ একটু তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বের হয় বিথী। মজিদকে চোখে ইশারায় বোঝায় বিশেষ সময়। তাই তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। বিশেষ মানুষের জন্য বিশেষ সুবিধা সব জায়গায় সর্বদা বিদ্যমান।

কলিংবেলকে অনেকক্ষন অনেকবার বিরক্ত করার পরে, অনির্বান দরজা খোলে ঘুম ঘুম লাল চোখ নিয়ে।

– কি ব্যাপার আজ এতো তাড়াতাড়ি এসেছো?

– অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বের হলাম। তাই একেবারে সোজা এখানে চলে এলাম।

– তাহলে একটু বসো। আমার গোছাতে সময় লাগবে।

– চা বানাই, চা খাবেন?

– তা দিতে পারো।

রান্নাঘরটা পুরোটাই এলোমেলো। আজ বুয়া আসেনি এই বাড়িতে। চায়ের ডেকচিতে চা পাতা, লেবুর খোসা, অর্ধেক খাওয়া কলা যে অনেকটা সময় নিয়ে এই ঘরের পরিবেশ নিয়ে আলোচনা করেছে, তা দেখেই বোঝা যায়।

চায়ের পানি চুলায় দিয়ে একটু উঁকিঝুঁকি দেয় পাশের ঘরে। দেখে পেইন্টার বিরক্ত হয়ে কার সাথে যেন কথা বলছে। বিথী তাকিয়ে থাকে নিঃসঙ্গ, পাগলাটে, অহংকারী কিন্তু শিশুর মতো মনের মানুষটার দিকে। চোখ পড়ার আগেই আবার চলে আসে রান্নাঘরে। একটু পরে দুই কাপ চা নিয়ে টেবিলে এসে অপেক্ষা করে। কিছু সময় পরে অনির্বান এসে বসে বিথীর পাশের চেয়ারে।

– আজ একটু বেশী সময় থাকবে, তোমার কিছু স্কেচ করে রেখে দেবো। তারপরে আর আসতে হবে না।

– কেন? আপনার আঁকা শেষ?

– না

– তাহলে?

– বলেছি আসতে হবে না, মানে আসতে হবে না। আর আমার কাছে টাকা নেই। তোমাকে টাকা দিতে পারবো না। ছবিও বিক্রি হয় না অনেকদিন।

– টাকা দিতে হবে না। আমি আসবো। আমার ভালো লাগে এখানে আসতে।

– আমি চাই না, তুমি আর আসো।

নিঃশব্দ চা টা শেষ করে বিথী, উঠে দাঁড়ায়। দুটো কাপ নিয়ে ধীরে ধীরে রান্নাঘরে চলে যায়। আজ এই ঘরটা সুন্দর করে গোছাতে হবে, আজই শেষদিন। এইসব ভাবতে ভাবতে, অনেকদিন পরে চোখ দুটো আর্দ্র হয় ওর। কতটা দিন শুষ্ক ছিলো এই চোখ দুটো। তাড়াতাড়ি চোখ মোছে। হঠাৎ অনুভব করে পেছনে একজন দাঁড়িয়ে আসে। তার গাঢ় নিঃশ্বাস ও ঘাড়ে একটু একটু লাগছে।

এটা কি কল্পনা? না সত্যি?

মাঝেমাঝে কল্পনাও সত্যি হয়ে যায়। বিথী অনুভব করে অনির্বানের উপস্থিতি, কিন্তু পেছনে ফিরে তাকায় না। কিছু সময় পরে কিছু না বলেই চলে যায়। সবকিছু গুছিয়ে বিথী বের হয়ে আসে রান্নাঘর থেকে। কিন্তু চোখ তুলে তাকিয়ে কথা বলতে পারে না। মাথা নিচু করে জিজ্ঞেস করে,

– এখন কি আঁকা শুরু করবেন?

– আজ আর আঁকবো না। তুমি চলে যাও। ফোন করলে এসো।

– ঠিক আছে।

– কিছু কি বলবে?

মাথা নাড়িয়ে “না” উত্তরকে বেছে নেয় বিথী। দরজার দিকে এগোও।

মনে মনে নিজেকে বোঝাতে থাকে সে।

“কি বলবে, আর কিছু বললেই বা শুনবে কেন লোকটা? কোন তো দায় নেই দুজন দুজনার প্রতি। টাকা বিনিময় কাজ করে। এখানে মনকে টেনে আনা উচিত না। আর বলতেই বা হবে কেন? বুঝেও তো নিতে পারে। শিল্পী মানুষ, নারীর শরীরের ভাঁজ আঁকতে পারে, মন বুঝতে পারে না”

– বিথী…

ডাকটা কেমন যেন লাগে, এতোটা মায়া করে ডাকে। দরজায় হাত রেখে হাতটা তুলে ফেলে আনমনে। পেছনে তাকাতে ইচ্ছে করে না, তারপরও তাকায়, খোঁচা খোঁচা দাড়ির এলোমেলো লম্বা চুলের লোকটাকে দেখতে ইচ্ছে করে আরো একটিবার।

– বিথী, ভুল করলে পরে কিন্তু শুধরাতে পারবেনা।

– ভুল না করলে, শুধরাবো কি করে।

– তাহলে আসো, ভুল করা শুরু করি দুজনে। আমার তুলি আজ তোমায় নিয়ে খেলবে…

গলার কাছে দলাপাকানো কষ্টের দানাগুলো আস্তে আস্তে খুলতে শুরু করে অনির্বানের।এতোদিনের জমানো সব যন্ত্রনার অবসান ঘটাতে আশ্রয় নেয় বিথীর শরীরের প্রতিটি লোমকূপের ভেতরে। আর বিথী অনেকদিন পরে খুঁজে পায় ভালোবাসাময় স্পর্শ। সময় গড়িয়ে যায়। সন্ধ্যা নেমে আসে হাজার পঞ্চাশ স্কয়ার ফিটের এই বাড়িতে। অনির্বান আজ মনে আনন্দে তুলির আঁচড় দিয়ে আঁকে চলে ওর “নিমগ্নতার সুখ”। বিথীর ধ্যান ভাঙে। নরম সুতির শাড়িটা গায়ে-গায়ে মেখে নিয়ে যাবার প্রস্তুতি নেয়। যাবার আগে দুজন দুজনকে অঙ্গীকার করে বিদায় নেয়, পাশে থাকার।

একটু বেমানান হলেও, মাঝেমাঝে রাস্তার পাশে পড়ে থাকা জ্বলন্ত বেনসন সিগারেটের সাথে জংলী ফুলের প্রেম হয়। পোড় খাওয়া সিগারেটের উষ্ণতাকে শুষে নিয়ে পাশে থেকে যায় অনেকটা সময় বা আজীবন। যা কখনো ব্যস্ত নগরবাসী খোঁজও রাখেনা। কেন না এতো সময় কোথায় তাদের।

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত