শাড়ি

Reading Time: 3 minutes

 রাত তখন প্রায় সাড়ে ন’টা । মোড়ের মাথার সুবীরের দোকানে চায়ের গ্লাস হাতে নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে কাঠের বেঞ্চে বসা আমার দুই বন্ধুবাবু আর দীপের সঙ্গে গল্প করছিলাম। চা, আর ডিমের অমলেট খেয়ে ওরা সিগারেটে আগুন ধরিয়ে টানতে লাগলো। সিগারেটের ধোঁয়ায় কুন্ডলী পাকিয়ে আশপাশটা ভরে গেল।কেন যে মানুষ সিগারেট খায়?কেনই বা আশপাশের পরিবেশটাকে দূষিত করে ভেবে বিরক্ত হলেও চুপ থাকলাম।

 আরো কিছুক্ষণ আড্ডা দেওয়ার পর তিন বন্ধু একসঙ্গে বাড়ির উদ্দেশ্য রওয়ানা দিলাম। ঘন্টার কাঁটা প্রায় এগারোটা ছুঁই ছুঁই। আকাশে ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদ।ছেঁড়া মেঘের ফাঁক-ফোকর দিয়ে মরা জ্যোৎস্না এই মধ্যরাতের প্রকৃতিকে বড় অচেনা করে তুলেছে।আজ কপালে বাবার বকুনি আছে ,অনেক রাত হয়ে গেল, এসব এলোমেলো ভাবতে ভাবতেই হাঁটছিলাম। খানিকটা একসাথে এসে বন্ধুরা চলে গেল তাদের বাড়ির রাস্তায়।চারদিক এখন একেবারে নীরব নিস্তব্দ; পুরো পাড়ামনে হচ্ছে গভীর ঘুমে মগ্ন।যতই এই জায়গাটায় এখন হাইরাইজ বিল্ডিং হোক ,আদতে এখনো শহর হয়ে ওঠেনি।ফাঁকা ফাঁকা ,বেশ নির্জনই।  দূরে কতগুলো কুকুর ডেকে চলছে অবিরাম। শুনলে গা ছম ছম করে উঠে!সেই ডাক এই শীতের রাতের নিঃস্তব্দতাকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। আমি চলার গতি বাড়ালাম ।

আমার হাতে মোবাইলের টর্চ লাইট। বড় রাস্তা ছেড়ে গলিতে একটু ঢুকেইহাঁটা থামিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম! মনে হল, রাস্তার একটু দূরেই কদম গাছের নিচের ঝোপ-ঝাড়গুলো বড় বেশী নড়া-চড়া করছে! একটু ভয় নিয়েই আস্তে করে সেদিকে এগিয়ে গেলাম। তারপর আলো ফেলতেই একজন মাঝবয়সী লোকহাজার মাইল বেগে ছুটে পালালো।আরো একটু এগিয়ে লাইটের আলো ফেলতেই দেখলাম নাভীর উপরের অংশে কাপড় ছাড়া একটা নারীদেহ; মুখে হাত দিয়ে দুই চোখ ঢেকে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। তার ভরাট দেহ যেন বর্ষার নদীর ঢেউয়ের মত ফুলে ফুলে উঠছে! চোখ’টা সরিয়ে নিলাম। কি বলবো তাকে ঠিক বুঝতে না পেরে জোরে ধমক দিয়ে বললাম , এই মেয়ে তুমি কে? এত রাতে এখানে কি করছ ?বলা মাত্রই মেয়েটা আমার দু’পা জড়িয়ে ধরে ঠুকরে কেঁদে উঠল।

দাদা ভগবানের নামে বলছি আমি বাজে মেয়ে নই। আমার কোন দোষ নেই। আবার ধমক দিলাম, চুপ করো; কাপড় পরে নাও, তারপর কি হয়েছে বলো। মেয়েটি পা ছেড়ে পাশের ঝোপের আড়াল থেকে রঙচটা শাড়ি নামক এক বস্তু গায়ে জড়িয়ে এলো। শাড়িতে কয়েকটি তালি লাগানোর পরেও তা মেয়েটির দেহ ঢাকতে ব্যর্থ।

এরপর ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে মাথা নিচু করে সে এসে সামনে দাঁড়াল।সেই অস্পষ্ট আলোয় তাকিয়ে দেখলাম, একটা অল্প বয়সী মেয়ে।বড়জোড় কুড়ি বাইশ হবে। সে মাথা নিচু করেই বলতে লাগলো,

-আমি পাশের পাড়ার মৃত হুসেন আলির ছেলে শিশিরের স্ত্রী।স্বামী বিদেশে সোনার কারখানায় চাকরি করে।সেখান থেকেই টাকা পাঠাত। বছর খানেক পর পর বাড়িও আসত, কাপড় নিয়ে, টাকা নিয়ে। দুই’ বছর হয়ে গেল আর আসে না। ওখানে সে আরেকটা বিয়ে করেছে । এখন আর টাকা পাঠায় না।

-ও। বলে আমি চুপ করে গেলাম ।

সে আবার বলল – আমি আগে গৃহস্থ বাড়িতে ঘর মোছা ,বাসন মাজার কাজ করতাম।এখন সোয়ামী আর আসবে না জেনে গিয়ে অনেক যুবক এমনকি বয়স্ক বৃদ্ধরাও কুকামের প্রস্তাব দেয়। কোনোদিন রাজি হইনি। অনেকবার ভেবেছি এই শহর ছেড়ে; স্বামীর ঘর ছেড়ে চলে যাব । কিন্তু ঘরে অসুস্থ শ্বাশুড়িকে রেখে কিভাবে যাই ?- মায়া মাখানো স্বরে বলল সে।

 যে স্বামী তার খোঁজ খবর না নিয়ে আরেকটা বিয়ে করে সুখে থাকতে পারে অথচ তারই বৃদ্ধা অসুস্থ মায়ের দায়িত্বভার বহন করছে সে! আমি অবাক দৃষ্টিতে শুনতে লাগলাম তার কথাগুলো।

-প্রতিদিন একবেলা খেয়ে দিন কাটাই , তাও আবার জোটে না ঠিকভাবে। না খেয়ে ঘরে বসে থাকি। বাইরে বেরলেই কুপ্রস্তাব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে অনেকেই। এখন আর যাইনা কাজে। নিজে না হয় না খেয়ে মরে যাব তাতে দুঃখ নেই , কিন্তু বৃদ্ধ শ্বাশুড়ি ক্ষিদের জ্বালায় যখন ছটপট করে তখন আর সহ্য হয়না। সবাই শাড়ি, টাকার লোভ দেখায়। কাপড়ের অভাবে অন্য কোথাও কাজের জন্য যেতে পারিনা। আজ শ্বাশুড়ির চিৎকারে ঘর থেকে বেরিয়ে এই লোকটির কথায়… বলতে গিয়ে………..আবার কেঁদে উঠলো।

এবার আর ধমক দিলাম না! কাছে গিয়ে আস্তে করে তার মাথায় হাত রাখলাম। মেয়েটি ভয়ে ভয়ে মাথাটা সোজা করলো। তার ঠোঁট দু’টো মাছির পাখার মত কাপছে; ভয় আর লজ্জায় সে আর কথা বলতে পারছে না।

আমি বললাম – কোন চিন্তা কোর না। এ কথা আমি কাউকে জানাবো না। বলে আমার বাড়ির ঠিকানা দিয়ে কাল থেকে কাজে আসতে বললাম।

কথাটা শুনে সে বড় করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। মনে হল, তার বুকের উপর চাপানো একটন ওজনের কোনো পাথর এইমাত্র সরে গেল।

বললাম-চল এগিয়ে দিই বাড়ি অব্দি।

-আমি যেতে পারব।আপনার সাথে দেখে ফেললে সবাই…, তাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বললাম , বেশ ।তবে সাবধান যাও।

ছেঁড়া,তালিযুক্ত কাপড়টাকে কোনমতে গায়ে জড়িয়ে ক্লান্ত দেহটা বয়ে নিয়ে আস্তে আস্তে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল মেয়েটি।

আমি এখনো মেয়েটির চলে যাওয়া রাস্তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছি ।  নিজেকে ভীষন অপরাধী মনে হল, আমি অসাধারন কেউ নই। সমাজ সংস্কারক ও নই, অতি তুচ্ছ একজন মানুষ ।তবুও মনের পর্দায় জেগে উঠলো, জীবনে দেখা অনেক মহিলার কথা। যাদের কাছে শাড়ি লজ্জা নিবারনের জন্য কোন মূল্যবান বস্তু নয়। শাড়ি তাদের জন্য ফ্যাশন। বিশেষ বিশেষ দিনে টিভির পর্দায়,খবরের কাগজে, মানুষের মাঝে নিজেকে আকর্ষণীয় করে তোলার এক আবরন। আলমারীতে শোভা করে রাখা অহংকার। সেইসব শাড়ি পরিহিতাদের নামি-দামী বর্ণাঢ্য শাড়ির ঝলকানিতে চোখ ঝলসে গিয়েছে অনেকবার, কিন্তু জল আসেনি। অথচ আজ এই শতছিন্ন –তালিযুক্ত অতিসাধারন একটি শাড়ি দেখে চোখে কেন জল চলে এলো তা বুঝলাম না।

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>