বিষাদপাখি
১.
খুব ছেলেবেলা থেকে নিলয় একটা তত্ত্ব পুষে রেখেছে বুকে। “হোপ ফর দ্য বেস্ট, বাট বি প্রিপেয়ার্ড ফর দ্য ওয়াস্ট”। জীবনের সর্বক্ষেত্রে মনটাকে ওই খাতে বইয়ে দিতে পারলে নাকি সুখ আসে একেবারে গাণিতিক নিয়মে। মুকুটমণিপুর সফরের প্রাকমুহূর্তে কথাটা সবার মধ্যে সংক্রমিত করবার চেষ্টা করেছে ও। সবাই একমত হয়েছে। পাতি গেরস্থের মতো অতো গুছিয়ে-গাছিয়ে কোথাও বেরোনো উচিত নয়। সর্বার্থে সংসারটাকে সঙ্গে নিয়ে চললে সফরটা আরো একটা সংসার হয়ে ওঠে। সংসারকে খানিক হারাবার জন্যই তো বেরোনো। সেখানে অনির্দিষ্টই আনন্দ। লক্ষ্যহীনতাই লক্ষ্য। সংসার থেকে আচমকাই পালাতে হয়।
মুকুটমণিপুরে একাধিক ছিমছাম বাংলো, লজ রয়েছে। ইচ্ছে করলে ওগুলোর যে-কোনও একটা বুক করা যেত। খাবার-দাবারও অনেক বয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল। রায়ের ওয়াইনশপ থেকে দু’চারটে সোনালিঈগল, বৃদ্ধ-সন্ন্যাসী…? কিন্তু ওই যে, অত মাপজোক, হিসেব-নিকেশ করে গুছিয়ে-গাছিয়ে যাওয়ার কোনও মানে হয় না। এক সংসার থেকে পালিয়ে দ্বিতীয় সংসার রচনার স্পৃহা নেই কারো। তাই ধ্বনিভোটে পাশ হয়ে গেল প্রস্তাবটা। একেবারে শূন্য হয়েই যাব। ওখানে যা মিলবে, খাব। যেখানে পাব, থাকব। যা খুশি করব। কিছুই ঠিক থাকবে না আগে থেকে।
রওনা দেবার মুখে ধলডাঙার মোড়ে চা-বিস্কুট খেয়ে ওরা চড়েছিল একটা ঝরঝরে বাসে। ওর পিছু পিছুই নাকি একটা ভালো গাড়ি ছিল। এক্সপ্রেস। কিন্তু ওই যে, ওরা পণ করে বেরিয়েছে, কোনও বাছবিচার থাকবে না, ভাল-মন্দর ফারাকটাও লোপ পেয়ে যাবে। কাজেই ওই ঝরঝরে বাসেই আরোহণ।
সর্বাঙ্গে ঝনঝনা আওয়াজ তুলে খানাখন্দের ওপর নাচতে নাচতে এগোচ্ছিল বাস। দু’ধারে ডাঙা-ডহর-ডিহি হারিয়ে যাচ্ছিল শ্লথগতিতে।
শুলুকপাহাড়ীর হাট জমে উঠেছে এখনই। বাসটা থেমেছিল ওখানে। বিজিত দৌড়ে গিয়ে একটা পকেট-চিরুনি কিনে আনতে চেয়েছিল। চিরুনিটা ও ফেলে এসেছে বাড়িতে। নন্দিতা চোখ দিয়ে শাসন করেছে স্বামীকে। ইঁদপুর পেরোবার কালে হৈ হৈ করে উঠেছিল সুচন্দ, এখানে নীলাঞ্জন বি-ডি-ও। ওকেও নিয়ে নিলে ভালো হতো মাইরি। দারুণ জমাটি ছেলে। কিন্তু ধ্বনিভোটে খারিজ হয়ে গিয়েছে প্রস্তাবটা, কিনা, চলতি সংসার থেকে কিছুই সঙ্গে নেব না আমরা। চিরুনিও না, নীলাঞ্জনও না।
বয়রামুড়ি পেরোতেই পেছনে একটা বাস দেখা গেল। বেশ ঝকঝকে, নতুন। অহঙ্কারী আওয়াজ তুলে ছুটে আসছে। তাই দেখে বাঁশরি হায়-হায় করে উঠেছিল! কিনা… ওই বাসটাতে গেলে আগে পৌঁছনো যেত। নিলয়দা, নেমে পড়বেন ?
নিলয় আড়চোখে তাকিয়েছিল বাঁশরির কব্জির দিকে। বলেছিল, ঘড়িগুলো সঙ্গে এনে ব্লান্ডার হল দেখছি।
লজ্জা পেয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল বাঁশরি। মিষ্টি হেসে বলেছিল, স-রি।
পেছনের বাসটা ঝড়ের বেগে এগিয়ে আসছিল। দেখতে দেখতে বাসের মধ্যে অনেকেই চঞ্চল হয়ে ওঠে। চেঁচিয়ে বলে, আরে, চালাও হে ড্রাইভার। জোরসে চালাও।
বাসটা কাছাকাছি আসতেই হৈ হৈ করে ওঠে সুচন্দর, একদম রাস্তার মাঝ-বরাবর চালাও ভাই। ও যেন সাইড না পায় কোনমতেই। সুচন্দনের প্রস্তাবে হৈ-হৈ করে সায় দেয় অনেকেই।
ঘনঘন হর্ন দিচ্ছে পেছনের বাসটা। সুচন্দন সোজা হয়ে বসেছে। ওর কপালের তাবৎ রেখায় চাপা উত্তেজনা। বলে, ডাইনে চেপে ভাই। একটু সাইড পেলেই বেরিয়ে যাবে ও।
সেই ভাবেই চলছিল বাসদুটো আর বাসের অন্য যাত্রীদের সঙ্গে মণিময়ও উত্তেজনায় থরথরিয়ে কাঁপছিল। একটা সিগারেট বের করেছিল, উত্তেজনায় জ্বালাবার ফুরসৎই পায়নি।
ওকে দেখতে দেখতে একসময় দুচোখে দুর্বোধ্য দৃষ্টি ফুটিয়ে নিলয় বলেছিল, সুচন্দন, তুই বরং নেমে ফিরতি বাসে বাড়ি যা। একটু বাদে তোর অফিস শুরু হয়ে যাবে। বলা যায় না, তোর একদিনের অ্যাবসেন্সে তরুণ বোস যদি বড়সাহেবকে পটিয়ে দু’কদম এগিয়ে যায়।
মণিময় অপ্রস্তুত বোধ করে নিলয়ের কথায়। কথার মর্মার্থটা বুঝতে পারে। বলে, বাসে উঠলে একটা কমপেটিটিভ মাইন্ড প্লে করে মাইরি।
…সেটাই তো বলছি। ওটা বাসের সঙ্গে না করে তরুণ বোসের সঙ্গে করাই ভালো। খুব শীতল গলায় বলেছিল নিলয়।
সুচন্দন লজ্জা পেয়ে গুটিয়ে নেয় নিজেকে।
২.
মুকুটমণিপুরের স্টপেজে ওদের নাবিয়ে দিয়ে বাসটা গোরাবাড়ির দিকে চলে গেল। দু’ধারে খাড়াই সারবন্দী ডুংরী। সামনে আঁকাবাঁকা প্রশস্ত ড্যাম । ড্যামের ওধারে কাঁসাইয়ের নীল জল। মাথার উপর ঝকঝকে আকাশ।
বাঁশরি একটা আলতো আলমোড়া ভেঙে শরীরে বার দুই লীলায়িত ঝাঁকুনি তুলল। নন্দিতা সবার অলক্ষ্যে ও গোলাপি জামদানী শাড়ির কুচিঁটাকে গুছিয়ে নিল, দু’ হাতের নিপুণ কৌশলে। নিলয় একখানা লম্বা সিগারেট ধরাল।
-আমরা থাকব কোথায়? ঠিক তেমনই মুহূর্তে বলে ওঠে নন্দিতা।
-কেন? এইখানে, এই উদার আকাশের তলায়, ওই ডুংরির কোলে, সবুজ জাজিমের ওপর।
-থামুন দিকি। নিলয়ের কথায় চোখ পাকায় নন্দিতা, – সব তাতেই ইয়ার্কি। ইস্, মা গো, আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি নে।
বাঁশরি অল্প তফাতে দাঁড়িয়েছিল। ও সবসময় খুব ঝকঝকে থাকতে ভালবাসে। এতক্ষণের বাস জার্নিতে ওর মুখে অল্প ঘাম-ময়লা জমেছে। শাড়ির কুঁচি ঈষৎ লাটঘাট।সৌখিন গোলাপী রুমাল দিয়ে নাকের ডগায় বুলোচ্ছিল পরিপাটি করে।
নন্দিতার কাছে বকুনি খেয়ে নিলয় তাকায় বাঁশরির দিকে। বলে, কী? সত্যিই কি এখানেও একটা চার-দেয়ালের বন্দীত্ব কামনা করছো তুমিও?
-করছি বৈকি কি নিলয়দা। বাঁশরি চোখের কোলে হাসে, ছেলেদের কথা আলাদা, কিন্তু মেয়েদের একটা চার দেয়ালের আস্তানা চাই বৈকি।
-এই পরবাসে, এমন নগ্ন প্রকৃতির কোলে, মেয়ে-পুরুষের ভেদাভেদটা না হয় নাই রইল…।
-অতটা সন্নিসী হইনি এখনো। বাঁশরি চোখ টিপে হাসে।
হোটেল-লজগুলো সবই প্রায় ভর্তি। ইয়োথ-হোস্টেলে সীটপাওয়া গেল। কিন্তু ওটা ডরমেটরি গোছের। সারবন্দি চৌকি পাতা। দেখেই নন্দিতার চক্ষু চড়ক গাছ।
বিজিত পরিস্থিতিটা এক নজর দেখে নিয়ে বলে, তোমরা একটুখানি থাকো এখানে, দেখি, অন্য কিছু ব্যবস্থা করা যায় কি না।
বিজিত যে কতটা করিতকর্মা তার প্রমাণ পাওয়া গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই। ইরিগেশণনের বাংলোর দুটো ঘর বুক করে ফিরে এল খানিকক্ষণের মধ্যেই। এক কথায় অসম্ভবকে সম্ভব করল ও।
এতক্ষণে সবাইয়ের মুখে হাসি ফুটল। মেঘে ঢাকা আকাশের আড়ালে অপরুপ আলোর ছ্টা… এতক্ষণে।
এক নম্বরে ঢুকল সুচন্দন আর বাঁশরি, দু’নম্বরে নন্দিতা আর বিজিত। নিলয় বলল, আমার জন্য ভেবো না। আমি রাতের বেলায় ড্রইং রুমের সোফাতেই বডি ফেলে দোবো।
হলঘরে এসে বসল সবাই। কফি আর ওমলেট এল। ওমলেটে কামড় দিতে দিতে পুরো জমায়েতটা চুপ মেরে গেল।
নিলয় সবাইকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল। বিজিতের দু’চোখের কোণায় টলটলে অহংকার। ঠোঁটের কোণে বিজয়ের হাসি। একটা ভয়ানক অনিশ্চয়তার হাত থেকে সবাইকে মুক্তি দেবার বারোআনা কৃতিত্ব বুঝি ওরই। একে নিশ্চয়ই কোনও অর্থে জয় বলা যায়। নন্দিতাও স্বামী-গরবে গরবিনী হয়ে দেমাকি মুখ করে কফির কাপে চুমুক মারছে। বাঁশরির মুখ ঈষৎ থমথমে। বোধ করি সেই কারণেই সুচন্দনের চোখেমুখে এক ধরণের অপ্রস্তুত ভাব।
দেখেশুনে হালকা ফোড়ন কাটে নিলয়, মনে হচ্ছে আমরা কোনও গুরুতর সমস্যায় পড়েছি?
-কেন? চমকে তাকায় সুচন্দন, কিসের সমস্যা?
-সেটাইতো জানতে চাইছি। অকস্মাৎ সবাই কেন একসঙ্গে মুখের ভাষা হারিয়ে ফেললাম? নিলয় সবার মুখের ওপর একপ্রস্থ দৃষ্টি বুলিয়ে নেয়, এই মুহূর্তে কী ভাবছি আমরা?
অল্প আড়মোড়া ভেঙে নন্দিতা বলে, বাংলোটা না পেলে কী কষ্টটাই না হত! ও অবশ্যি চিরকালই এমন রিসোর্সফুল। সেবার গোয়াতে …।
সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ায় বাঁশরি, যাই। মুখেচোখে জল দিই গে।
খানিক বাদে বোঝা গেল, তড়ি-ঘড়ি বেরোতে গিয়ে প্রত্যেকই কতকিছু ফেলে এসেছে বাড়িতে। সুচন্দন পায়জামার সঙ্গে বাড়িতে পরার পাঞ্জাবি আনেনি। অথচ পায়জামার সঙ্গে শার্ট পরাটা বাঁশরির ভীষণ অপছন্দ। বিজিত দাড়ি কামাবার সেটটাই ভুলে ফেলে এসেছে। পেঁচার মতো মুখ করে বসে রয়েছে সে। নন্দিতা, এমনিতে বাড়িতে থাকলে ফি-বিকেলেই মেক-আপ করে সে, কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, বিকেলে আমি কিছুতেই বেড়াতে বের হতে পারব না। বাঁশরির মনেও সুখ নেই একতিল। কিছু ব্যক্তিগত প্রিয় বস্তু সেও নির্ঘাত ছেড়ে এসেছে।
সময়ের সাথে সাথে ফেলে আসা সামগ্রীর তালিকা ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। সুচন্দনের স্পেশাল ব্রান্ডের সিগারেট, বিজিতের পাঞ্জাবির বোতাম, বাঁশরির খাওয়ার আগের টনিক, নন্দিতার মাথা-ধরার বড়ি … তেল, বোরোলিন, চটি, চিরুনি, শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করে টিপ…। কতকিছুই যে ভুল হয়ে গিয়েছে ওদের!
নন্দিতা ডুকরে উঠে সবার সুমুখে, কত সখ করে নতুন ডিজাইনের বাউটি-জোড়াটা গড়ালাম, বেরোবার সময় এমনই তাড়া লাগালো, পরে আসতেই ভুলে গেলাম। ধুশ, জার্নিটাই মাটি।
৩.
-তোমার এক নম্বরেই ঢোকা উচিত ছিল। বিকেলে বেড়াতে বেরিয়ে বিজিতকে এক ফাঁকে খুব খাটো গলায় বলে নন্দিতা।
-কেন?
-কেন কি, ওটা ভি-আই-পিরুম, অনেক বেশি কম্ফরটেবল।
বিজিত কোনও জবাব দেয় না।
-তোমার জন্যই বাংলোটা পাওয়া গেল। নন্দিতা যেন দাবির পেছনে একটা শক্ত যুক্তিও খুজেঁ পায়, -ওদেরও উচিত ছিল এক নম্বর রুমটা তোমাকে অফার করা।
বিজিতের মগজে তখন অন্য চিন্তা ঘুরছে। নন্দিতার কথাগুলো ওকে তেমন করে ছুঁলো না। সেটা আন্দাজ করে মনে মনে আহত হয় নন্দিতা। ঠোঁট বেকিয়ে বলে, খামোখা বিল সেঁচে বেড়ানোটা তো তোমার চিরকালের অভ্যেস। কই খায় অন্যরা।
বিজিত কী একটা জবাব দিতে যাচ্ছিল, তার আগেই পাশ দিয়ে একটা দেহাতি লোককে চলে যেতে দেখে হাত তুলে থামায়। নন্দিতা বুঝতে পারে, দেশি মদের সন্ধানে মানুষটা অস্থির হয়ে উঠেছে।
-আজকের দিনে ওটা না হলে চলত না? মৃদু গলায় বলে নন্দিতা।
-তার মানে? বিজিত অবাক চোখে তাকায়, আজকের দিনেই তো বেশি করে চাই নইলে অদ্দুরে আসা কেন?
নন্দিতা মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে থাকে।
পেছনে হাঁটতে থাকা ওদের পুরো দলটি এসে পড়ে ততক্ষণে।
বাঁশরি আদুরে গলায় বলে, ও নিলয়দা, শুনেছি, এখানকার নদীতে নানান রঙের নুড়ি পাওয়া যায়? আমাকে কিন্তু নুড়ি জোগাড় করে দিতে হবে।
নিলয় চারপাশের পাহাড়-ডুংরিগুলোর দিকে হাতটা ঘুরিয়ে এনে বলে, কেন, এই তো চারপাশে রাশিরাশি নুড়ি! ছোট… বড়…, সাদা… কালো।
-ওসব শুনছি নে। বাঁশরি জেদী গলায় বলে ওঠে, তুমি কিন্তু আমাকে নুড়ির লোভ দেখিয়ে এনেছ। রঙ-বেরঙের নুড়ি কুড়োবার লোভেই কিন্তু আমি এসেছি এখানে। মনে থাকে যেন সেটা।
দু’ধারে অসংখ্য নুড়ি, পাথর, হরেক রঙের। নিলয় তার থেকে দু’চারটে বেছে এনে ধরে দেয় বাঁশরীর সামনে।
-ধেৎ! বাঁশরি ঠোঁট ওলটায়, এগুলো চাইনে। আরও সুন্দর নুড়ি চাই আমার।
নন্দিতা অনেকক্ষণ গম্ভীর মুখে হাঁটছিল। এক সময় সুচন্দন ঘন হয়ে আসে ওর দিকে। শুধোয়, কী হল ম্যাডাম, অমন চুপচাপ?
-কিছু না। ঠান্ডা গলায় জবাব দেয় নন্দিতা, মাথাটা ধরেছে।
নন্দিতার মাঝেমাঝেই কোন এক রহস্যময় কারণে মাথা ধরে। বিজিত সেটা জানে। এমনকি, বিয়ের অ্যাদ্দিন বাদেও কারণটা ঠিকঠাক বুঝতে পারেনা।
নিলয় হালকা চালে বলে, ওটাকে অদ্দুর অবধি বয়ে এনেছেন ম্যাডাম?
বিজিত ব্যস্ত হয়ে বলে ওঠে, ট্যাবলেটগুলো আনোনি?
নন্দিতা জবাব দেয় না।
দানুয়া ডুংরির একেবারে পশ্চিমপ্রান্তে বসেছে ওরা। ওরা মানে নিলয় আর বাঁশরি। বিজিত আর সুচন্দন গিয়েছে মহুয়ার সন্ধানে। নন্দিতা অল্প তফাতে কুসুমগাছের তলায় বসে পড়তি বিকেলের শোভা দেখছে অপলক। বিকেলের স্নান আলো ওদের গায়ে লুটোপুটি খাচ্ছিল। পায়ের তলায় কংসাবতীর প্রাচীন খাত। এখন একটা মজে যাওয়া দহের মতো লাগে। তার ওপারে সারবন্দী ডুংরিগুলো দিনান্তের অন্ধকার গায়ে মাখতে শুরু করেছে। দেখতে দেখতে শিহরিত হয় বাঁশরি ।
-ঠিক যেন একপাল বুনো হাতি। বাঁশরির দু’ ঠোঁটে ফেনিয়ে ওঠে গূঢ় হাসি, ঠিক কিনা বলুন?
সত্য একটা লম্বা সিগারেট মুখে পুরে জবাব দেবার দায় সারে।
বেলা পড়ে গেছে। পশ্চিম আকাশে সূর্যের চাকিটা ডুবে যেতে উদ্যত। চারপাশের পাহাড়ে-ডুংরিতে, গাছেদের শরীরে তখনও অবধি লেপটে রয়েছে ফিকে রোদ্দুরের রেশ। একটা নাম-নাকি-জানা পাখি সামনের গাছটার লিকলিকে ডালে বসে রয়েছে অনেকক্ষণ। ডালের ওপর একবারে স্টিল ছবির মতো স্থির হয়ে গিয়েছে পাখিটা। এমনকি, দিনান্তে বাসায় ফিরে যাবার কথাটাও অবধি বুঝি ভুলে গেছে ও।
বাঁশরি সহসা আবিষ্কার করে, পাখিটার চোখদুটিকে ভারি বিষন্ন লাগছে।
নিলয়ের দিকে তাকায় সে। বলে, পাখিটার মনে অত বিষাদ কেন নিলয়দা?
-দিনের শেষ যে। নিলয় আলগোছে হাসে, এ সময় পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীর মনে বিষাদ জমে। পাখিটার মনেও সেই দিনান্তের বিষাদ।
-ও বাড়ি ফিরবে না?
-কে জানে! নিলয় মৃদুস্বরে বলে ওঠে, ও ও হয়তো আমাদের মতোই সমাজ-সংসার ছেড়ে…।
৪.
সন্ধের মুখে আকন্ঠ চড়িয়ে ফিরল বিজিত আর সুচন্দন।
নিলয়রা ততক্ষণে বাংলোয় ফিরে এসেছে।
বিজিত ঘোষণা করল, এটা বড়সড় মুরগি পাওয়া গেছে। সুচন্দন আরও গোপন খবর দিল। খাতরায় লোক পাঠানো হয়েছে এক বোতল ওল্ড-মঙ্ক নিয়ে আসার জন্য । সাড়ে-সাতটার বাসে আসছে সেটা।
বাঁশরি ভাবলেশহীন চোখে দেখছিল ওদের উচ্ছ্বাস। নন্দিতা পুতুলের মতো বসে ছিল সোফায়। সুচন্দন আর বিজিত পোশাক বদলাতে চলে গেল যে-যার ঘরে।
চৌকিদার লন্ঠন জ্বালিয়ে দিয়ে গেল। লন্ঠনের মৃদু আলোয় তিনটে ছায়া নৃত্য জুড়ে দিল নিরবে। নাচতে নাচতে লুটোপুটি খেতে লাগল এ-ওর গায়ে।
-ইস্, কী বিচ্ছিরি যে লাগছে! বাঁশরি চোখের তারায় নিদারুণ ক্রান্তি ফুটিয়ে বলে।
-সত্যি, এখানেও লোড-শিডিং। নন্দিতার গলায় জমাট বিরক্তি।
সুচন্দন-বিজিত পোশাক বদলে ফিরে এল।
চৌকিদার চা দিয়ে গেল। চুপচাপ বসে চা খেতে লাগল সবাই। ধীরেধীরে বাংলোটা একটা হানাবাড়ির রুপ নিল।
খানিক বাদে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল নিলয়। বলল, চল, বাগানে যাই। খোলা আকাশের তলায় বসে চুটিয়ে গল্প করি।
নন্দিতা এবং বাঁশরি একসঙ্গে শিউরে উঠল। বলে, বাপ রে, জমে যাব ঠান্ডায়।
-কাল তাহলে নির্ঘাত নিওমোনিয়া। সুচন্দন জড়ানো গলায় বলে ওঠে।
-তাহলে এস, এখানে সবাই মিলে নাচি।
-ফ্যাট। বাজে বকবেন না তো।
-তাহলে একসাথে গান ধরি এস।
-কী গান?
-যে-কোনও গান। নিলয় কাঁধ ঝাঁকায়, রবীন্দ্র, নজরুল, শ্যামাসঙ্গীত, খেয়াল, ঠুংরি… যা খুশি।
সুচন্দন আর বিজিত পুতুলের মতো হাসে ।
আচমকা গান ধরে নিলয়। একটা চেনা নজরুল। মিহি সূরে গলা মেলায় নন্দিতা। দেখাদেখি বাঁশরিও। সুচন্দন আর বিজিত নাকিসুরে গলা ভাঁজতে লাগল সবাইয়ের সঙ্গে।।পাঁচমেশালি বেসুরো গলায় আওয়াজে ভরে যায় হলঘর।
একটুবাদে সোফার গায়ে এলিয়ে পড়ে নন্দিতা। ধুশ, গান না ছাই হচ্ছে। তাই শুনে অন্যরাও একেএকে থেমে যায়। একসময় হলঘরটা আবার নিথর হয়ে আসে। থমথম করতে থাকে শীতের রাত। কাঁসাই নদীর কনকনে হাওয়া কাচের দরজায় ঘা মেরে মেরে অস্থির হয়ে ওঠে।
রাতটা গাঢ় হচ্ছিল।
সুচন্দন আর বিজিত ওল্ড-মঙ্ক নিয়ে বসেছে ডাইনিং টেবিলে। নন্দিতা শুয়ে পড়েছে নিজের বিছানায়। তার মাথায় যন্ত্রণাটা নাকি বেড়েছে।
এক সময় নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ায় বাঁশরি। পায়েপায়ে চলে আসে বাংলোর বাইরে। কাঁচের পাল্লা খোলার সঙ্গেসঙ্গে একঝাঁক ঠান্ডা বাতাস ঝাঁপিয়ে পড়ে হলঘরের মধ্যে।
বারন্দায় নিকষ অন্ধকারে দাঁড়িয়েছিল বাঁশরি। নিলয় পায়ে পায়ে এসে দাঁড়ায় ওর পাশটিতে। সামনে একচিলতে বাগান। বাগানের ও প্রান্তে আচমকা কালো খাদ। কাঁসাইয়ের খোলামেলা বুক। ওপারে কালো কুচকুচে ডুংরীগুলোর আড়ালে নিঝুম আদিবাসী গাঁ।
অস্পষ্ট মাদল বাজছে কোথাও। কারা যেন উচ্ছল হয়ে গান ধরেছে। আদিম প্রকৃতির বুক জুড়ে একটা একঘেয়ে করুণ সূর গুমরে গুমরে উঠছে আঁধারে।
এক সময় অন্ধকারকে ভাঙে বাঁশরি। ভেজা গলায় বলে, দিনটা যেন কী করে খরচ হয়ে গেল। অথচ কতো আশা নিয়ে বেরিয়েছিলুম সকালে।
নিলয় সহসা জবাব খুঁজে পায় না। অন্ধকারে খুঁজতে থাকে কিছু। হাতড়াতে থাকে।
-সবচেয়ে কষ্ট হচ্ছে…। বাঁশরি আবার গুমরে ওঠে, একখানা নুড়িও কুড়োতে পারলুম না সারাদিনে। একখানাও না।
অন্ধকারের বুকে ম্লান হাসি ছড়িয়ে দেয় নিলয়, বুকের খাঁচায় সারাক্ষণ একটা বিষাদের পাখিকে আদর-সোহাগ দিয়ে পুষে রাখলে এমনটা হবেই ম্যাডাম।
বলতে বলতে নিলয় রাতের আকাশের দিকে নিষ্পলক তাকায়। মৃদু গলায় বলে, বুকের খাঁচাবন্দি এমন একটি বিষাদপাখি আমাদের, বুকে জুড়ে অমন ভরভরাট সংসার তার, নুড়ি কুড়িয়ে রাখবার মতো বাড়তি জায়গা আমরা পাব কোথায়, বলো?

জন্ম অখণ্ড মেদিনীপুর জেলার কেশিয়াড়ি থানার সাঁতরাপুর গ্রামে। অদ্যাবধি তাঁর প্রকাশিত উপন্যাসের সংখ্যা ১৫টি, গল্প প্রায় ২৫০টি, হাসির গল্প-সংকলন ৪টি, ভ্রমণকাহিনি ৮টি, কিশোর উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থ ১৩টি এবং অনেক নাটক প্রবন্ধ ও রম্যরচনা। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : ‘মৃগয়া’ (৫ খণ্ডে), ‘আড়কাঠি’, ‘চারণভূমি’, ‘জানগুরু’, ‘শিকলনামা’, ‘অমানুষনামা’, ‘ঐন্দ্রজালিক’, ‘জাদুগর’, ‘বাজিকর’, ‘ফাঁসবদল’, ‘আরশিচরিত’, ‘শিকড়ের ঘ্রাণ, অন্তর্গত নীলস্রোত’, ‘তস্কর, সেরা ৫০টি গল্প’, ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’, ‘সরস গল্প’, ‘হাসির বারো গল্প’, ‘হাসির আরো গল্প’, ‘মালয়ের ডায়েরি’, ‘স্বর্ণলঙ্কার খোঁজে’, ‘সরস জম্মু-কাশ্মীর-বৈষ্ণোদেবী, দেবভূমি কেরালা’, ‘কিন্নরের পথে পথে, বনসাই-চর্চা’, ‘কুটুম-কাটাম’ ইত্যাদি। তাঁর একাধিক গল্প হিন্দি, ইংরেজি ও অসমিয়া ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এছাড়াও অনেক গল্প-উপন্যাস মঞ্চায়িত ও চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রদত্ত বঙ্কিম পুরস্কার, সমরেশ বসু পুরস্কার, তারাশঙ্কর পুরস্কার, সর্বভারতীয় ‘কথা’ পুরস্কার প্রভৃতি।