Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,Bhula jāẏagāẏa yaticihna bhaẏaṅkara

ভুল জায়গায় যতিচিহ্ন ভয়ঙ্কর | ব্রততী বন্দোপাধ্যায়

Reading Time: 4 minutes
কিছু দিন আগে পুরনো ফাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতে আমার মায়ের হাতে লেখা একটি কাগজ পেলাম। তাতে একটা ভুলভাল যতিচিহ্ন ব্যবহারের নমুনা আছে। গল্পটা হয়তো অনেকেরই জানা। তবু বলি। একজন গ্রাম্য গৃহবধূ তার স্বামীকে চিঠি লিখছে। সে লিখতে জানে কিন্তু যতিচিহ্নের ব্যবহার জানে না। শুধু দেখেছে লেখার মধ্যে মধ্যে লম্বা লম্বা দাগ টানা থাকে। সেও চিঠিটা লিখে মাঝে মাঝে দাগ টেনে দিল। তার ফলে চিঠিটা দাঁড়াল এ রকম। ‘‘তোমার পত্র পাইয়া দুঃখিত। অন্তঃকরণে শান্তি পাইলাম সমস্ত খবর লিখিতে। বলিয়াছ বলিয়া লিখিতেছি ভাসুরঠাকুর একটি ছাগল। কিনিয়াছে রোজ একসের করিয়া দুধ দেয়। কলাপাতা ও কচি কচি ঘাস খাইয়া মা দুইবার বমি করিয়াছেন পুরুতঠাকুরের মুখে। সব শুনিবে। গ্রামের চাষীরা সব খেজুরগাছ।…ইত্যাদি।
ভুল জায়গায় যতিচিহ্ন দিলে কী যে ভয়ংকর ব্যাপার হতে পারে! কবিতার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তাই। ভুল জায়গায় থামলে আবৃত্তিকার বা শ্রোতার বিপদ না হোক, সমস্যা হতেই পারে, বিশেষ করে অর্থ-উদ্ধারের ক্ষেত্রে। গল্প নয়, অভিজ্ঞতার কথা বলি। ছোটবেলায় শুনতাম কেউ কেউ একটা গান করছেন, ‘‘আমার সকল দুখের প্রদীপ/জ্বেলে দিবস/গেলে/করব নিবেদন’’। খুব ধন্ধে পড়তাম। দিবস আবার জ্বালবে কী? একটু বড় হয়ে ধন্ধটা কেটেছে। মনে হয়েছে তালের প্রয়োজনে ওভাবে কাটতে হচ্ছে। আরও বড় হয়ে লক্ষ করেছি, তাল না কেটেও কেউ কেউ ঠিক করে গানটা গাইছেন, ‘‘আমার সকল দুখের প্রদীপ জ্বেলে/দিবস গেলে/করব নিবেদন’’। কিছু দিন আগে আমার পরিচিত একটি বাচ্চা স্কুল থেকে ফিরে মাকে বলেছিল, ‘‘আজ আমাদের স্কুলে একটা গান শিখিয়েছে। খুব ভাল গান। কচুরির গান।’’ তারপর সে গানটি গেয়েও শুনিয়েছিল, ‘‘আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লু/কোচুরির খেলা’’। কচুরির প্রতি আকর্ষণবশতই কি না কে জানে, সে আবার ‘লু’টা খুব ছোট করে বলছিল আর তারপর একটু থামছিল।
আর একবার ছোটদের শেখাচ্ছিলাম প্রমোদ বসুর কবিতা ‘শারদকথা’। কবিতাটির প্রথম চারটে লাইন এরকম—
‘‘ঢাক বাজে, শাঁখ বাজে, কাঁসি বাজে, আর/বুকে বাজে আশ্বিন তাই বারবার।/আর বাজে নীল মেঘ সাদা মেঘ জুড়ে/ ছুটির ডানার গান আকাশের সুরে।’’
একটি বাচ্চা নিজে নিজে লাইনগুলো পড়ে থমকে গেল। বলল, ‘‘নীল মেঘ বাজে, মানে কী?’’ ওকে ছন্দ বলেছে মেঘের পরে থামতে। তাই থেমেছে। আর তার পরেই অর্থে হোঁচট খেয়েছে। ওকে বললাম, ‘‘নীল মেঘ বাজে না। তুমি ‘আর বাজে’ বলার পরে থামো, তারপর বাকিটা একসঙ্গে বলো। তাহলেই মানেটা বুঝতে পারবে’’। ও তাই করল। তারপর বলল।,‘‘এবার বুঝেছি’’।
এই থামার একটা পারিভাষিক নাম আছে—যতি। আগের বার ছন্দ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছিলাম, ছন্দ মানে পা তোলা আর পা ফেলার খেলা। এই পা ফেলে থেমে যাওয়াটাই যতি। শুধু পা তুলে যেমন চলা যায় না, থামতেও হয়, তেমনই নির্দিষ্ট জায়গায় না থামলে ছন্দের গতিও ব্যাহত হয়। কিন্তু ছন্দ বজায় রাখতে গিয়ে অনেক সময় ভুল জায়গাতেও থামি আমরা। যে উদাহরণগুলো একটু আগে দিলাম, তাতেই সেটা স্পষ্ট। এটাই ছন্দযতি আর ভাবযতির সংঘাত। এ সব ক্ষেত্রে একটু হিসেব করে নিতে হয়।
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল মধুসূদন দত্তের কথা। বাংলায় অমিত্রাক্ষর ছন্দ এনেছিলেন মধুসূদন। এই ছন্দে অন্ত্যমিল নেই। পঙক্তিটি ঘুরে চলে আসে পরের লাইনে। বাঙালি পাঠক হোঁচট খেয়েছিলেন এই ছন্দে।
‘‘সম্মুখ সমরে পড়ি বীরচূড়ামণি
বীরবাহু, চলি যবে গেলা যমপুরে
অকালে, কহ হে দেবি অমৃতভাষিণী, ….’’
পয়ার আর ত্রিপদীতে অভ্যস্ত বাঙালির মনে হয়েছিল সব অর্থহীন কথা। ‘‘অকালে কহ হে দেবি…’’ কথাটার মানে হয় না। মধুসূদন কমা চিহ্ন ব্যবহার করেছিলেন, কিন্তু মনে রাখতে হবে বাঙালি পাঠক তখনও যতিচিহ্নের ব্যবহারে অভ্যস্ত নন। মধুসূদনই প্রথম বাংলা কবিতায় যতিচিহ্ন ব্যবহার করেছিলেন। যাই হোক, পাঠকেরা যে বোঝেননি তার কারণ তাঁরা ভুল জায়গায় থেমেছিলেন।
এখন প্রশ্ন, কবিতা বলার সময় আমরা কি শুধু ছন্দের প্রয়োজনেই থামব? অন্য কোথাও থামব না? নিশ্চয়ই থামব। পথ চলার সময় আমরা কি শুধু চলার প্রয়োজনেই পা ফেলি? অন্য কোথাও কি থামি না? রাস্তা পার হব—ট্রাফিক সিগনাল খোলা। আমাদের থামতে হয়। কিংবা দূর থেকে একটা চেনা-চেনা মুখ দেখা গেল, একটু থমকে দাঁড়ালাম। কবিতার ক্ষেত্রেও তাই। মাঝে মাঝে আমরা থামি, আপাত কোনও কারণ ছাড়াই, কয়েক সেকেন্ডের জন্য। এই থামাটাও যতি। তবে এর ইংরেজি নামটা বেশি উপযুক্ত—pause.
কবিতার কোথায় থামব এমন? একটা সহজ উত্তর—যেখানে প্রসঙ্গ বদলায়, কিংবা মুড বদলায়। ধরুন, জীবনানন্দ দাশের কবিতা, রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থের।
বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ
খুঁজিতে যাই না আর, অন্ধকারে জেগে উঠে ডুমুরের গাছে
চেয়ে দেখি ছাতার মতন বড়ো পাতাটির নীচে বসে আছে
ভোরের দোয়েলপাখি—চারিদিকে চেয়ে দেখি পল্লবের স্তূপ
জাম-বট-কাঁঠালের-হিজলের-অশথের করে আছে চুপ,
ফণীমনসার ঝোপে শটিবনে তাহাদের ছায়া পড়িয়াছে…
এই পর্যন্ত কবি দেখছিলেন তার চারপাশকে। তার পর তিনি চলে গেলেন অতীতে ‘‘মধুকর ডিঙা থেকে না জানি সে কবে চাঁদ চম্পার কাছে/এমনই হিজল-বট-তমালের নীল ছায়া….
এই দুটো অংশে দু’এক সেকেন্ড থামতেই হয়। না হলে দ্বিতীয় অংশটা প্রথম অংশের থেকে আলাদা হয় না। কিংবা ধরুন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দুই পাখি’ কবিতাটি। কবিতাটিতে চারটি স্তবক। প্রথম তিনটি স্তবকে রয়েছে দুই পাখির কথোপকথন। চতুর্থ স্তবকে শুরু হচ্ছে কবির নিজস্ব কথা, ‘‘এমনি দুই পাখি দোঁহারে ভালবাসে…’’ তৃতীয় আর চতুর্থ স্তবকের মাঝে সামান্য থামলে ভাল। কেননা মুড বদলাচ্ছে, প্রসঙ্গ বদলাচ্ছে। বর্ণনা থেকে কবিতা বাঁক নিচ্ছে উপলব্ধির দিকে।
আরও একটা ক্ষেত্রে pause-এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। pause সাসপেন্স তৈরি করে। নাট্যমুহূর্ত তৈরি করে। ‘ব্রাহ্মণ’ কবিতাটির কথা বলি। ছান্দোগ্য উপনিষদের গল্প। মূল গল্প থেকে কবিতায় একটু সরে গেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাতে কবিতাটিতে নাটকীয়তা বেড়েছে। সে প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। আমরা কবিতাটাই আলোচনা করছি। শেষ অংশের কথা বলি। ‘‘পরদিন/তপোবন তরুশিরে প্রসন্ন নবীন/জাগিল প্রভাত।’’ সেই সুন্দর সকালে ব্রাহ্মণবালকেরা বেদপাঠ করছে ঋষি গৌতমের আশ্রমে। সে সময় সত্যকাম এসে জানাল তার পিতৃপরিচয়। জানাল, সে গোত্রহীন। তার কোনও পিতৃপরিচয় নেই। সে কথা শুনে ছাত্ররা কেউ হাসল, কেউ ধিক্কার দিল। উঠে দাঁড়ালেন ঋষি গৌতম— ‘‘উঠিলা গৌতম ঋষি ছাড়িয়া আসন….’’ এর পরেই একটা অদ্ভুত সাসপেন্স তৈরি হয়। গল্পটা আমরা সবাই জানি, কবিতাটা অনেক বার পড়া। তবু যত বারই পড়ি, এই অনুভূতিটা হয়। আমরা জানি, এর পর কী ঘটবে। তবু মনে হয়, ‘‘এ বার কী হবে?’’ গল্পের পটভূমিতে ছাত্ররাও এই একই সাসপেন্সে রয়েছে। এই পুরো পরিস্থিতিটা সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলতে পারে ছোট একটা pause। ‘‘উঠিলা গৌতম ঋষি ছাড়িয়া আসন’’-এর পরে একটা ছোট থামা। তা হলেই ঋষি গৌতমের উঠে দাঁড়ানো আর সত্যকামকে স্বীকৃতি দেওয়ার মুহূর্তটা জ্বলজ্বল করে উঠবে আমাদের সামনে। এই মুহূর্তটা সমস্ত গল্পের থেকে আলাদা হয়ে বেরিয়ে আসবে।
এই থামা, এই বিরতির একটা সুন্দর নাম আছে নাটকে। নাটকের পরিভাষায় এই pause-কে বলে প্রেগন্যান্ট pause। একটা নতুন মুহূর্ত, বিশেষ মুহূর্তের জন্মের সম্ভাবনা নিয়ে আসে এই pause। সে নিজে চুপচাপ থাকে, কিন্তু জন্ম দেয় এক বিরাট মুহূর্তের। সেই মুহূর্তের জন্মের আগে থমকে দাঁড়ায় দর্শক, শ্রোতা। নিজের ভাবনায় গুছিয়ে নেয় নিজেকে। তার পরেই জন্ম নেয় এক বিস্ময়, হয়তো বা চরম নাট্যমুহূর্ত।
আমরা যখন লিখি, প্রতিটি শব্দের ভিতরে ফাঁক দিই। আপাত ভাবে সে ফাঁকের কোনও প্রয়োজন নেই। সেই ফাঁক জায়গার অপচয় মাত্র। কিন্তু একটুও ফাঁক না রেখে সেই শব্দগুলোকে যদি পরপর সাজিয়ে দিতাম আমরা, তা হলে কি পড়তে পারতেন? পারতেন না। pause সেই না-লেখা জায়গাটুকু। সে জায়গা বোঝার, ভাবার সুযোগ দেয়। কিছু না বলেও তাই সে অনেক কথা বলে যায়।

One thought on “ভুল জায়গায় যতিচিহ্ন ভয়ঙ্কর | ব্রততী বন্দোপাধ্যায়

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>