আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিটবাইরে বেশ শীত সেদিন। রায়বাহাদুরের বাড়ির বৈঠকখানায় বসে বেশ গল্প জমেছিল। আমরা অনেকে ছিলাম। ঘন ঘন গরম চা ও ফুলুরি মুড়ি আসাতে আসর একেবারে সরগরম।
রায়বাহাদুর অনুকূল মিত্র একজন মস্ত বড় শিকারি। আমরা কে তাঁর কথা না শুনেছি? তাঁর ঘর ঢুকে চারিদিকে চেয়ে শুধু দেখবে মরা বাঘ ও ভালুকের চামড়া, বাঘ–ভালুকের মুখ বাঁধানো ঘরগুলো দেখে মনে হয় ট্যাক্সিডারমিস্টের কারখানায় বুঝি এসে পড়লাম।
কিন্তু সেদিন আর একজন লম্বা মত প্রৌঢ় ব্যক্তিকে রায়বাহাদুরের অতি কাছে বসে থাকতে দেখে ও শিকার সম্বন্ধে দু-একটি কথা বলতে শুনে বেশ অবাক হয়ে গেলাম। রায়বাহাদুরের সামনে শিকারের কথা বলে এমন লোক তো আজও দেখিনি। যে অনুকূল মিত্র জীবনে ত্রিশটি রয়েল বেঙ্গল পনেরোটি লেপার্ড মেরেছেন, ভালুক ও বুনো শুয়োরের তো লেখা-জোখা নেই‚ এছাড়া আছে গণ্ডার, আছে বাইসন, আছে অজগর পাইথন, আছে শজারু, আছে কাক বক হাঁস, এ-হেন রায়বাহাদুরের পাশে বসে শিকারের কথা বলা! নাঃ, লোকটা কে হে? বড় কৌতূহল হল জানবার।
উপেনবাবু, আমাদের উপেন মাইতি আপন মনে চা খেয়েই চলেছেন, তাঁকে দেখে বললাম‚ ও উপেনবাবু, ঐ লোকটি কে?
উপেনবাবু, যেন হঠাৎ ভয় পেয়ে বলে উঠলেন‚ অ্যা? কই, কে ?
—ঘাবড়াবেন না। ওই আধ-বুড়ো লোকটি কে?
—বিজ্ঞ শিকারি নিধিরাম ভট্টাচার্য।
-নামটা যেন নৈয়ায়িক পণ্ডিতের মত শোনালো। আপনি অনায়াসে বলতে পারতেন‚ নৈয়ায়িক নিধিরাম সার্বভৌম।
—তা শিকারের ব্যাপারে উনি বড় কেউকেটা নন। ওর ‘শিকারযোগ বই পড়েননি? তিনটে এডিশন হয়ে গেল। আসুন আলাপ করিয়ে দিই।
আমার সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল। নিধিরাম ভটচাজ যে কোনকালে চাল-কলা-বাঁধা পুরুত ছিলেন না‚ তা তাঁর কথাবার্তার ধরনে আগেই বুঝেছিলাম, এখন সেটা আরো ভাল করে জানা গেল। নানা স্থানের বাঘ-ভালুকের শিকার কিভাবে হয় সে গল্প করলেন। রাত্রে কিভাবে গাছের উপর বসে কাটিয়েছেন, কোন জঙ্গলে একবার বাঘের মুখে পড়েছিলেন, ইত্যাদি নানা গল্প। লোকটি ভাল গল্প বলতে পারেন। এমন সুন্দর, নিখুঁত ভাবে গল্প বলছিলেন যে আমরা ঘটনাবলী যেন চোখের ওপর ঘটতে দেখছি। আরও দেখলাম, নিধিরাম বেশ প্রকৃতি-রসিক ব্যক্তি। জ্যোৎস্না রাত্রি ও বর্ষণমুখর শ্রাবণ রাত্রিগুলির এমন সুন্দর বর্ণনা দিচ্ছিলেন মুখে মুখে! আমি বললাম একটা কিছু আশ্চর্য ঘটনা বলুন। নিধিরাম ভটচাজ বললেন‚ সবই আশ্চর্য। বনের সব ব্যাপারই আশ্চর্য।
—তবুও কী? ভুতের গল্প? ভুত দেখিনি কখনো চোখে।
বা-রে, এ আবার অতি অদ্ভুত লোক। বাঙালী হয়ে ভূতে বিশ্বাস করে না এমন লোক তো দেখিনি! পরে কথার ভাবে বুঝলাম তিনি তন্ত্রমন্ত্রে বিশ্বাসী। বললাম‚ আপনাদের তন্ত্রশাস্ত্রে ভূত মানে না?
—তন্ত্রশাস্ত্র আমি পড়িনি। মতর-তন্তরের কথা বলছি।
—ও! কিরকম মন্তর-তন্তরের? সব বাজে, ভুয়ো।
—আমি একেবারে অতটা যেতে রাজি নই। মন্তরের শক্তি নিশ্চয়ই আছে।
—ঐ করে করে দেশটা উচ্ছন্নে গেল। আপনারা ইংরেজি লেখাপড়া শিখেও এইসব মানেন ?
এইবার নিধিরাম ভটচাজের ওপর আমার শ্রদ্ধা হল। আশ্চর্য মানুষ তো? আধুনিক মনোবৃত্তিসম্পন্ন প্রৌঢ় ব্যক্তি। আমি বললাম‚ সুন্দরবনে আপনি গিয়েছেন?
—অনেকবার। এই মন্তর-তন্তর সম্বন্ধে সেখানকার একটি ঘটনা বলি।
আমি বেশ এগিয়ে গিয়ে বসলাম তাঁর কাছে। দিনটা এইসব গল্প শুনবার উপযুক্ত বটে।
সেবার কাকডাঙার ট্যাঁকে আমাদের বজরা লেগেছিল। আমাদের যিনি শিকারের গরু, খুলনার উকিল সীতাকান্ত রায়ের ভাইপো শ্যামাচরণ রায় ছিলেন আমাদের সঙ্গে। কথাটা উলটে বলা হল। আসলে তাঁর সঙ্গেই আমরা গিয়েছিলাম। নইলে আমাদের অবস্থার লোক আর বজরা কোথায় পাবে বলুন।
যেখানে বজরা বাঁধা হল সেখানটা একটা খালের মুখ। গভীর বনের মধ্যে দিয়ে এসে এখানে নদীতে পড়েছে কাকডাঙার খাল। খালের দৃশ্য বড় সুন্দর। দুধারে হেঁতাল ঝোপ, বনের মধ্যে গরান আর গোলপাতার গাছ। জলের ধারে টাইগার ফার্নের জঙ্গল। এই টাইগার ফার্নের জঙ্গলের মধ্যেই সাধারণত বড় বড় বাঘ আত্মগোপন করে থাকে। শ্যামাচরণ রায় ফর্সিতে তামাক খেয়ে নিয়ে আমাদের বললেন‚ কাকডাঙার-খালে ডিঙি ওঠাও।
ডিঙি বেয়ে আমরা চললাম খালের মধ্যে দিয়ে। সুন্দরবনে যাঁরা কখনো যাননি তাঁরা বুঝতে পারবেন না‚ এইরকম খাল বেয়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাবার সময় কী চমৎকার রূপ চোখে পড়ে সুন্দরবনের। কখনো হেঁতাল ছোপ, কখনো বন্য লেবুর জঙ্গল, গোল গাছের সারি, কোথাও বা বাতাবি লেবুর মত প্রচুর ফল হয়ে আছে। কোথাও বা হলদে ফুল ফুটে আলো করে আছে বন্য লতা। কেয়া ছোপে কেয়া ফল ফুটে বাতাসকে মিষ্টি করেছে।
অনেকে বলেন সুন্দরবন বড় একঘেয়ে। তাঁরা গভীর জ্যোৎস্না রাত্রে এ বনের চেহারা কখনো দেখেননি, অন্ধকারে দেখেননি সূর্য উঠবার আগে রাঙা আলোয় মোড়া নিতম্ব বনানীর রূপ, শোনেননি এর বিচিত্র বিহঙ্গ-কাকলি। আমার গুরু, শ্যামাচরণ রায় এত ভালবাসতেন এই বন যে‚ বাড়িতে বলেছিলেন তিনি মারা গেলে তাঁর দেহটি যেন সুন্দরবনে সমাধিস্থ করা হয়। তাঁর আত্মা এতে শান্তি পাবে।
আমি বললাম‚ তিনি বেঁচে আছেন?
—দেহ কি সমাধিস্থ করা হয়েছিল বনের মধ্যে?
-না। হিন্দুর দেহ সমাধিস্থ করা নিয়ে গোলমাল হয় সমাজে। তাই হয়নি।
—বড় দুঃখের কথা। তারপর বলুন।
—শুনুন তারপর, কিন্তু একটা কথা, সবটা শেষ হয়ে না গেলে কোন প্রতিবাদ করতে পারবেন না।
—বেশ, বলুন। নিধিরামবাবু ভালভাবে তামাক টেনে দম নিয়ে অনেকখানি ধোঁয়া ছেড়ে তারপর আবার বলতে লাগলেন:
অনেক দূরে চলে গেলাম খাল বেয়ে। সত্যি কথা বলতে কি, শিকার করার নেশার চেয়েও এই ঘন বনভূমির দৃশ্য আমাকে পেয়ে বসেছিল। যখন প্রায় মাইলখানেকেরও বেশি চলে গিয়েছি নদী থেকে, ‘তখন খালের ধারের বনঝোপের মধ্যে থেকে কে যেন বলে উঠল‚ বাবু, ও বাবুরা।
আমরা চমকে উঠলাম। ডিঙির হিন্দু, মাঝি বলে উঠল‚ রাম রাম!
শ্যামাচরণ রায় গলা উঁচু করে ডাঙার দিকে চেয়ে বললেন‚ আঃ, চপ কর সবাই। কে ওখানে?
ক্ষীণ ঘরে কে বললে‚ বাবু আমি।
—কে তুমি? কোথায় তুমি, সামনে বেরিয়ে এস।
—এই যে বাবু, আমি, হেতাল ছোপের পাশেই বসে।
সত্যি এতক্ষণ লোকটাকে দেখতে না পাওয়ার দরুন ওর স্বর অশরীরীর কণ্ঠনিঃসৃত বলে ভ্রম হচ্ছিল বটে, এবার লোকটাকে সবাই দেখতে পেলে। ওই তো বসে আছে হেঁতাল ঝোপের ডাইনে। ওকে আগেও দেখা গিয়েছিল, এবার বুঝলাম। কিন্তু আলো-ছায়ায় জলের মধ্যে দিয়ে ওকে গাছের কাটা গুঁড়ির মত দেখাচ্ছিল। আমরা দস্তুরমত অবাক হয়ে গিয়েছিলাম ওকে ওখানে একা বসে থাকতে দেখে। সুন্দরবনের সঙ্গে যাঁদের পরিচয় আছে, তাঁরা বুঝবেন এরকম বনের মধ্যে একা বসে থাকতে বাতুলেও ভয় পায়।
শ্যামাচরণ রায় বললেন‚ ও‚ বেশ। তা ওখানে কী করছ?
—বাবু, হেঁতালের ফল খাচ্ছিলাম। বড্ড খিদে পেয়েছে। গরিব লোক!
কথাটার ঠিক জবাব হল না। খিদে পাওয়া তো শরীরের ধর্ম, সেটা আশ্চর্যের ব্যাপার নয়, এ জঙ্গলে ঢুকলে পাকা কুল ছাড়া যে আর কিছু খাবার পাওয়া যায় না তাও ঠিক। কিন্তু তুমি এখানে এলে কী করে?
-বাবু, আমি ফকির মানুষ। ভয়-ডর করলি আমাদের চলে? আমারে একটু, নৌকায় তুলে নেবেন বাবু? কাল–রনঘাটের ট্যাঁকে আমাকে নাবিয়ে দিলে হেঁটে পীরের দরগায় গিয়ে রাত কাটিয়ে কাল সক্কালে বাড়ি যাব। নেবেন বাবু?
—কাল-রনঘাটের কাছে মানিক সেনের পাড়ায়।
শ্যামাচরণবাবু, কিছু বলবার আগে আমাদের ডিঙির মাঝি দুজন আপত্তি জানিয়ে বললে‚ নেবেন না বাবু! ডিঙির নিয়ম জানেন তো, সুন্দরবনে চলতি ডিঙিতে পথের লোক তুললে সে বড্ড অপয়া। বাবু, যাচ্ছেন যখন একটা শুভ কাজে।
শ্যামাচরণবাবু, রেগে বললেন‚ তোদের কী বুদ্ধি!
—আমার শিকার হোক আর না হোক, ওকে এখানে ফেলে যাব বাঘের মুখে? নিয়ে চল ওকে।
আর এর পরে কী কথা চলবে? ডিঙি থামিয়ে তাকে উঠিয়ে নেওয়া হল। আমাদের মনে হল লোকটা একজন ফকির। সাজ-পোশাক দেখে অন্তত তাই আমার মনে হয়েছিল। হিন্দু, কি মুসলমান, বাইরের সাজ দেখে বোঝ শক্ত। আমরা চুপ করে আছি। শ্যামাচরণ রায় বললেন‚ কী সাধনা ?
—বাঘ আনবার মন্তর জানি কিনা, তার সাধনা। আমি বললাম সেটা আবার কী?
—আছে বাবু। আমার গুরু, আমায় শিখিয়েছেন।
শ্যামাচরণবাবু বললেন‚ হাঁড়ির মধ্যে মুখ দিয়ে ডাকো?
—না বাবু। মন্তরে বাঘ আসবে।
—আমরা শিকার করতে চলেছি। তুমি বাঘ এনে দিতে পারলে দশ টাকা বকশিশ পাবে।
—ফাঁকি দেবার চেষ্টা করবে না।
লোকটাকে আমরা ততক্ষণে সবাই ঘিরে বসেছি। শ্যামাচরণবাবু, বললেন—সুন্দরবনে এক-একজন লোক আছে, যারা শিকারির সামনে বাঘ হাজির করে পয়সা রোজগার করে। তারা তো হাঁড়ির মধ্যে মুখ দিয়ে ডাকে জানি। তুমি সে দলের নও?
—আপনাকে আগেই বলেছি বাবু। মন্তর আসল জিনিস। বাঘ টেনে আনে।
এই সময় আমরা নিধিরাম ভটচাযকে জিজ্ঞাসা করলাম‚ হাঁড়ির মধ্যে মুখ দিয়ে ডাকার ব্যাপারখানা বুঝলাম না তো?
নিধিরামবাবু, আমাদের বুঝিয়ে দিলেন
এক শ্রেণীর লোকের পেশা হচ্ছে এই। তারা ঝোপের মধ্যে বসে হাঁড়ির মধ্যে মুখ দিয়ে বাঘের আওয়াজ নকল করে ডাকে, তাতে নর-বাঘ সেখানে ছুটে আসে এবং শিকারির বন্দুকের পাল্লায় ধরা দেয়। পাঁচ টাকা ছিল ওদের ফি যুদ্ধের আগে। এখন কত জানি না।
আমরা বললাম‚ এমনভাবে বাঘ আসতে আপনি দেখেছেন?
—অনেক দেখেছি। তবে সব সময় সফল হয় না ওদের চেষ্টা। বাঘ হয়ত সে জঙ্গলে নেই কিংবা কাছে নেই। নয়তো মানুষের সাড়া পেয়ে পিছিয়ে গিয়েছে। সে অবস্থায় কী হবে?
—তারপর শুনুন। আমি ঘুন শিকারি, মস্তরে বাঘ এনে দেয় এমন কথা কখনো শুনিনি। শিকার কত এগিয়ে গেল তাহলে ভাবুন তো? শিকারের শখ যাঁদের আছে তারা জানেন একটা জ্যান্ত বাঘের পেছনে কী খাটনিটাই করতে হয় তাকে শিকার করতে। জঙ্গল ঠ্যাঙাও, নয়তো মাচান বেঁধে রাত জাগো। সোজা কষ্ট মশায়? আর সে জায়গায় যদি মন্তরে বাঘ আসে, তবে শিকার কত সোজা হয়ে গেল বলুন! পাঁচের জায়গায় দশ টাকা দিতে কেন তারা আপত্তি করবে?
—তারপর ঘণ্টা দুই কেটে গেল, কাকডাঙার খালের মাজায় এসে আমরা নোঙর করলাম।
—খালের অর্ধেকটা পার হয়ে এসে। যাই হোক সন্ধে হয়ে এল। আমরা সাহস করলাম না এখন ডাঙায় নামতে। রাত্রের খাবার সঙ্গে করে আনা হয়েছিল, তাই খেয়ে সবাই ডিঙিতে শুয়ে রাত কাটিয়ে দিলাম। সমস্ত রাত উত্তেজনায় শ্যামাচরণবাবুর ঘুম নেই চোখে। তিনি শুধু, বসে বসে ফকির সাহেবের আজগুবি মন্তরের কথা শুনছিলেন। সে কতবার সাধনা করেছে বনের মধ্যে এই বাঘ আনার জন্যে। গভীর থেকে গভীরতর জঙ্গলে বসে এই মন্তরের সাধনা করাই তার কাজ। আরও কত কি যে বাজে গল্প! সারাদিন খেটেখুটে রাতে যে একটু, ঘুমবে, তার উপায় নেই।
কিন্তু শ্যামাচরণ রায় স্বয়ং ফকির সাহেবের মুরুব্বি। তাঁর কথার উপর কথা বলবে কে? আমরা চুপচাপ শুয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করলাম। শেষরাতের দিকে খানিকটা কৃতকার্য যে হইনি তাও নয়।
আমি বললাম‚ একটা কথা। আপনারা কাকডাঙা খালের মাঝামাঝি এলেন কেন? বজরা ছেড়ে আসার হেতু কী?
হেতু খুব স্পষ্ট। বজরায় বসে তো শিকার চলবে না! বজরা আছে নদীতে, তার একদিকে জঙ্গল, অন্যদিকে কূলকিনারা দেখা যায় কি না যায়। ছোট খালের মধ্যে না গেলে দুদিকের জঙ্গল তো তুমি দেখতে পাচ্ছ না। তুমি তো জঙ্গলে চড়ুইভাতি করতে আসনি?
নিধিরাম ভটচাজ একটু, তর্কপ্রিয় লোক। কেউ তাঁর কথার প্রতিবাদ পাছে করে এই আশঙ্কায় সর্বদাই কোমর বেধে তর্কের জন্য তৈরি হয়ে থাকেন এবং গল্প শুরু করবার সময়ে কেন যে বলেছিলেন আমার কথার কোন প্রতিবাদ করতে পারবে না গল্প শেষ না হওয়া পর্যন্ত, এখন তা বুঝলাম। আমরা তাঁকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম‚ আপনাকে মাঝে মাঝে প্রশ্ন করছি জানবার আগ্রহে, আপনার গল্পের খুঁত ধরবার জন্য নয়। বলে যান আপনি।
নিধিরাম ভটচাজ বললেন‚ খুব ভাল কথা। শোন তারপরে। আমার এ গল্প শেষ হয়ে এসেছে। যা কিছু প্রতিবাদ করবার গল্পের শেষে করতে তো তোমাদের বলছি।
ডিঙি নোঙর করে সারারাত্রি সেখানে থাকবার সময়ে সে-রাত্রেই বুঝতে পারা গেল, কী ভয়ানক জায়গায় আমরা এসেছি। জ্যোৎস্না রাত্রির আলো-ছায়া বার বার কেঁপে কেঁপে উঠে ভেঙে ভেঙে যেতে লাগল বাঘের গর্জনে। কাকডাঙার খাল সম্বন্ধে শ্যামাচরণ রায় বিবেচনায় ভুল করেননি। ভোরে উঠে শ্যামাচরণবাবুকে বললাম‚ চমৎকার জায়গায় এসেছেন।
শ্যামাচরণ রায় বললেন‚ কাঁচা শিকারির কথা হয়ে গেল!
বনের বাঘ আর শিকারির বাঘ এক নয়। ওরকম বাঘ ডাকে সুন্দরবনের বহু জায়গায়। কিন্তু চোখে দেখতেও পাবে না কোনদিন একটি। তাই তো ফকির সাহেবকে ধরেছি। এখন ফকির সাহেবের দয়া সকালের রোদ বেশ উঠলে আমরা সবাই ডিঙি থেকে নেমে বনের মধ্যে ঢুকলাম। আধমাইলটাক দূরে একটা ফাঁকা জায়গা আছে বনের মধ্যে, তাকে বলে হাতল বাদিয়ার ডাঙা। সেখানে আমরা রান্না করে খাব পরে।
আমরা জিনিসপত্র নিয়েই নামলাম, নয়তো কে আবার এ বনের মধ্যে দিয়ে ডিঙিতে ফিরবে রান্নার জিনিস নিতে। মাঝি দুজনকেও সঙ্গে নিলাম, এ নির্জন জঙ্গলে তারা দুটি প্রাণী ডিঙিতে বসে থাকতে রাজি নয়।
দুদিকে ঘন গরান আর হেঁতালের জঙ্গল, টাইগার ফার্নের ঘন সমাবেশ, পা বাঁচিয়ে চলতে হয় শুলোর ভয়ে। সমস্যা হল গাছের বায়ব্য শিকড়, কাদা থেকে মাথা তুলে তীক্ষ্ণ সড়কির মত খাড়া হয়ে থাকে, ঝরা পাতার তলায় পা দিলেই রক্তপাত। দু-ধারে বন, মাঝখান দিয়ে জুড়ি পায়ে চলার পথ।
ফকির সাহেব সকলের আগে, তার পেছনে গুরুজী শ্যামাচরণ রায়, তাঁর পিছনে দুজন লোক, তারপর আমি, সর্বশেষে মাঝি দু’জন।
হঠাৎ এক জায়গায় কি একটা শব্দ হল, শ্যামাচরণবাবু ও লোক দু’জন চমকে দাঁড়িয়ে গেল। আমি একটু, অন্যমনস্ক হয়ে ছিলাম, ব্যাপারটা না বুঝতে পেরে এগিয়ে গেলাম।
বললাম‚ কী হল? থামলেন যে?’
সেই সময় নজর পড়ল, দলের পুরোভাগে ফকির সাহেব ছিলেন, তিনি নেই। বলতে যাচ্ছি‚ ফকির সাহেব বুঝি…
শ্যামাচরণবাবু, বললেন‚ উঃ সর্বনাশ! এমন কাণ্ড কখনো—উঃ!
তাঁর পেছনের লোকটি তখনো আড়ষ্টভাবে দাঁড়িয়ে। একজন বললে‚ উঃ! বাবুর ডান পাশের ছোপ থেকেই তো…
শ্যামাচরণবাবু আড়ষ্ট গলায় বললেন‚ আহা, গরিব লোক! আমিই মন্তর আওড়াতে বলেছিলাম ওকে মনে মনে।
ব্যাপার তখনি শুনলাম। ডানদিকের টাইগার ফার্নের বন থেকে ভীষণ এক রয়্যাল টাইগার লাফিয়ে পড়ে ফকির সাহেবকে তুলে নিয়ে গিয়েছে।
চেয়ে দেখে মনে হল বাঁ দিকের হেতাল ছোপের মাথা যেন তখনো নড়ছে। আমি রুদ্ধ নিঃশ্বাসে বললাম‚ তারপর ? পাওয়া গেল ফকির সাহেবকে ?
—তা কখনো যায়! ওই শেষ। একটা হিংলাজের দানার মালা কেবল একটি হেঁতালের ডালে বেধে ঝুলছিল। আমরা অনেক খুঁজেছিলাম। শ্যামাচরণ রায় বড় শিকারি, বাঘের ধরন-ধারণ তাক-বাক অনেক কিছু জানেন। কিছুই করতে পারলেন না। নামও জানিনে ফকির সাহেবের যে কাউকে কোথায় খবর দেব।
আমার গুরুজী শ্যামাচরণ রায় বলতেন, লোকটি সত্যিই গুণী ছিল। মন্তরের জোরে বাঘ আকর্ষণ সে ঠিকই করেছিল, আমার অসর্তকতায় মারা পড়ল ও। বাঘকে আকর্ষণ করতেই শিখেছিল, বাঘের হাত থেকে বাঁচার মন্তর তো শেখেনি!
অপরাহ্ণের দিকে আমরা খোঁজাখুঁজি শেষ করে কাকডাঙার খাল বেয়ে বজরা ধরলাম নদীতে। মন সবারই এত খারাপ হয়ে গেল যে‚ সেবার আমাদের শিকারে আর কোন উৎসাহই রইল না। শ্যামাচরণবাবুকে একটা কথা আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম‚ গুরুজী, ফকির সাহেবকে দলের আগে আগে যেতে কে বলেছিল? আপনি তো জানেন নিরস্ত্র অবস্থায় আগে আগে ওভাবে যেতে নেই? শ্যামাচরণ রায় বলেছিলেন‚ বিশ্বাস করিনি যে। বোগাস বলে ভেবেছিলাম তোমাদের মত।
কথাসাহিত্যিক। ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ সেপ্টম্বর পশ্চিমবঙ্গের চবিবশ পরগনা জেলার কাঁচরাপাড়ার নিকটবর্তী ঘোষপাড়া-মুরারিপুর গ্রামে মাতুলালয়ে জন্ম। তাঁর পৈতৃক নিবাস ওই জেলারই ব্যারাকপুর গ্রামে। পিতা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন সংস্কৃত পন্ডিত; পান্ডিত্য ও কথকতার জন্য তিনি ‘শাস্ত্রী’ উপাধিতে ভূষিত হন।
স্বগ্রামের পাঠশালায় বিভূতিভূষণের পড়াশোনা শুরু হয়। তিনি বরাবরই একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন। এন্ট্রান্স (১৯১৪) ও আইএ (১৯১৬) উভয় পরীক্ষায় তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। বিএ (১৯১৮) পরীক্ষায়ও তিনি ডিসটিংকশনসহ পাস করেন। পরে এমএ ও আইন বিষয়ে ভর্তি হয়েও পাঠ অসমাপ্ত রেখে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি হুগলির একটি মাইনর স্কুলে শিক্ষকতার পেশা গ্রহণ করেন। কিছুদিন তিনি ‘গোরক্ষিণী সভা’র ভ্রাম্যমাণ প্রচারক হিসেবে বাংলা, আসাম, ত্রিপুরা ও আরাকানের বিভিন্ন অঞ্চল ভ্রমণ করেন। পরে তিনি খেলাৎচন্দ্র ঘোষের বাড়িতে সেক্রেটারি ও গৃহশিক্ষক এবং তাঁর এস্টেটের ভাগলপুর সার্কেলের সহকারী ম্যানেজার হন। পরে ধর্মতলাস্থ খেলাৎচন্দ্র মেমোরিয়াল স্কুলে কিছুদিন শিক্ষকতা করার পর তিনি গোপালনগর স্কুলে যোগদান করেন এবং আমৃত্যু সেখানেই কর্মরত ছিলেন।
১৩২৮ বঙ্গাব্দের (১৯২১) মাঘ প্রবাসীতে প্রথম গল্প ‘উপেক্ষিতা’ প্রকাশের মধ্য দিয়ে বিভূতিভূষণের সাহিত্যিক জীবন শুরু হয়। ভাগলপুরে চাকরি করার সময় ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি পথের পাঁচালী রচনা শুরু করেন এবং শেষ করেন ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো: অপরাজিত (১৯৩১), মেঘমল্লার (১৯৩১), মৌরীফুল (১৯৩২), যাত্রাবদল (১৯৩৪), চাঁদের পাহাড় (১৯৩৭), কিন্নরদল (১৯৩৮), আরণ্যক (১৯৩৯), আদর্শ হিন্দু হোটেল (১৯৪০), মরণের ডঙ্কা বাজে (১৯৪০), স্মৃতির রেখা (১৯৪১), দেবযান (১৯৪৪), হীরামানিক জ্বলে (১৯৪৬), উৎকর্ণ (১৯৪৬), হে অরণ্য কথা কও (১৯৪৮), ইছামতী (১৯৫০), অশনি সংকেত (১৯৫৯) ইত্যাদি।
পথের পাঁচালী বিভূতিভূষণের শ্রেষ্ঠ রচনা। প্রথম রচিত এই উপন্যাসের মাধ্যমেই তিনি বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন। অপরাজিত পথের পাঁচালীরই পরবর্তী অংশ। উভয়গ্রন্থে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের ছায়াপাত ঘটেছে। প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় পথের পাঁচালীকে চলচ্চিত্রে রূপদানের মাধ্যমে তাঁর পরিচালক জীবন শুরু করেন এবং এর জন্য তিনি দেশিবিদেশী বহু পুরস্কার লাভ করেন। তিনি অপরাজিত এবং অশনি সংকেত উপন্যাস দুটি অবলম্বনেও অসাধারণ চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রশংসিত হন। পথের পাঁচালী উপন্যাসটি ভারতীয় বিভিন্ন ভাষাসহ ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
নিভৃতচারী এই কথাশিল্পীর রচনায় পল্লীর জীবন ও নিসর্গ রূপায়ণে বাংলার আবহমানকালের চালচিত্র ও মানবজীবনের অন্তর্লীন সত্তা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর রচনায় প্রকৃতি কেবল প্রকৃতিরূপেই আবির্ভূত হয়নি, বরং প্রকৃতি ও মানবজীবন একীভূত হয়ে অভিনব রসমূর্তি ধারণ করেছে। মানুষ যে প্রকৃতিরই সন্তান এ সত্য তাঁর বিভিন্ন রচনায় প্রতিফলিত হয়েছে। প্রকৃতির লতাপাতা, ঘাস, পোকামাকড় সবকিছুই গুরুত্বের সঙ্গে স্বস্বভাবে তাঁর রচনায় স্থান পেয়েছে। প্রকৃতির অনুপুঙ্খ বর্ণনার মধ্য দিয়ে বিভূতিভূষণ গভীর জীবনদৃষ্টিকেও তুলে ধরেছেন। তবে তাঁর রচনায় নিম্ন মধ্যবিত্ত বাঙালির জীনবচিত্র ও সমকালের আর্থসামাজিক বাস্তবতাও সমভাবে উন্মোচিত হয়েছে। তাই বাংলা কথাসাহিত্যে শরৎচন্দ্রের পরে বিভূতিভূষণই সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় সাহিত্যিকের মর্যাদা পেয়েছেন।
সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি বিভূতিভূষণ সম্পাদনার দায়িত্বও পালন করেন। তিনি চিত্রলেখা (১৯৩০) নামে একটি সিনেমা পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তাছাড়া হেমন্তকুমার গুপ্তের সঙ্গে যৌথভাবে তিনি দীপক (১৯৩২) পত্রিকা সম্পাদনা করেন। ইছামতী উপন্যাসের জন্য বিভূতিভূষণ মরণোত্তর ‘রবীন্দ্র-পুরস্কার’ (১৯৫১) লাভ করেন। ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর ব্যারাকপুরের ঘাটশিলায় তাঁর মৃত্যু হয়।
Related