| 20 এপ্রিল 2024
Categories
অন্য দেয়াল প্রবন্ধ

বিবর্তন, সংস্কৃতি ও প্রযুক্তি: পুঁজিবাদের ভুল আশ্বাস

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

বহুদিন হয়ে গেলো, তত্বকথা নিয়ে চেঁচাই না। এজন্য অনেকে আমাকে ভণ্ড গালাগাল করেছেন। অনেকে ভেবেছেন লোকটা বুঝি মরেই গেছে। কেউ ভেবেই বসেছেন, নিজের মাথা মগজ বেচে দিয়ে ঘরের কোণে পড়ে আছি, হয়ে গেছি দালালি কবুতর।
দেশে এত বেশি পোস্টমডার্নিস্ট লোকজন, তাদের জানাতে একটু বলি, ভাই কোন মশাল মিছিলে না গেলেই কেউ দালালী কবুতর হয়ে যায়না। আর ওসব মশাল ফশাল জ্বালিয়ে মশা তাড়ানো যেতে পারে। আপনার দাসত্বের সামাজিক সম্পর্ক যেটা জয় বাবা কার্ল মার্ক্স বলে গেছে উৎপাদন সম্পর্ক, সেটা পোড়ানো যাবেনা।
তখন অবশ্য জবাব আসবে, সেটার জন্য রক্ত ঝরাতে হবে, রাস্তায় থাকতে হবে। পোস্ট মডার্নিস্ট বলবেন, আরে এসব আরোপিত বাস্তবতা, সামাজিক নির্মাণ ভেঙ্গে কী হবে? তোমার শেকল ভাঙ্গার গান আরেক খানা নির্মাণই বটে।
আজকে হঠাৎ সপ্তাহান্তের শেষে ভাবলাম, আমার অন্তরের বান্দরকে আবার জাগাই। সবার প্রশ্নের জবাব না দিতে পারলেও, চর্চাটা চালিয়ে যেতে চাই।
প্রথমে শুরু করি আত্মপক্ষ সমর্থনে। চেল্লামিল্লি করছিনা, সব ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিতে চাইছিনা, চুপ মেরে বসে আছি; এই অভিযোগ খণ্ডাতে চাইছিনা। কারণ, ঢেউএর বাড়াবাড়ি সমূদ্রতীরে হয়, যত গভীর সমূদ্রে যাবেন, ওকে খুব লক্ষী ছেলে মনে হয়।
এবার বাকিটা। একটা সাধারণ ভুল ধারণা দিয়ে শেষ করবো। যেকারণেই হোক, স্কুল কলেজে এক বাক্যে ইতিহাস, দর্শন, সমাজতত্ব চিন্তার কারণেই হোক, বা অন্য যেকোন কারণে; আমাদের মনে হয়, নতুন কোন অর্থনৈতিক, সামাজিক ব্যবস্থা মনে হয় শতাব্দির শেষে, হ্যাপি নিউ ইয়ার বলে সবাই মেনে নিয়েছে। শত শত বছরের সামন্ত প্রভূরা হঠাৎ করে তাদের ব্যবসা পত্তর গুটিয়ে পুরোদস্তুর পুঁজিবাদী ব্যবসায়ী হয়ে গেছেন।
এই ধারণাটা বেশ গোলেমালে পিরিত না করার মত। বিষয়টা বোঝার জন্য মানব সংস্কৃতির ইতিহাসে ডুব দেয়া জরুরি। বুঝতেই পারছেন নৃবিজ্ঞানের ছাত্র, ওটা না করলে আমি বিশেষ আনন্দ পাইনা।
বেশিদূরে যাবোনা, হান্টার-গ্যাদারার সমাজ থেকে তখন মানুষ কৃষি সমাজের দিকে আগাচ্ছে। এমনিতে তো আর হয়নি, শিকারিরাও তেমন একদিনে তাদের ধনুক পাতি ঘরে তুলে কৃষিতে মনোযোগ দেননি। এতো গেল সামাজিক ঘটনা। কিন্তু আমাদেরকে খানিক প্রযুক্তির দিকে মন দেয়া দরকার।
কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক আচরণ মানে একোনমিক বিহেভিয়ার যদি পালে হাওয়া পেতে চায়, তার কিছু প্রযুক্তি লাগবে। যেমন ধরেন ঝুড়ি বোণার প্রযুক্তি, ছোট হালকা ধরণের কোদাল, পানি বহন করার প্রযুক্তি। জ্বি হাঁ ফ্রেন্ডস, রোমানস এ্যান্ড কান্ট্রিমেন, এগুলাও প্রযুক্তি। প্রযুক্তি মানেই ব্লুটুথ নিয়ে ঝাঁ চকচকে আইফোন ১০ কী ১৫ না। ঝুঁড়ি কোদালের প্রযুক্তির সাথে বীজ সংরক্ষণ প্রযুক্তিরও মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে হবে।
এসব হবার পরে সামাজিক সম্পর্ক আর চুক্তিতে দুটো বড় পরিবর্তন আসবে। শিকারি শ্রেণী হঠাৎ করে তাসদের গুরুত্ব হারাবে। কৃষকরা গুরুত্ব পাবে। বীজ সংরক্ষকরা বিশাল ট্যালেন্ট হিসেবে পরিচিতি পাবে। মানে এখন যেমন ট্যালেন্ট মানেই স্টিভ জবস, সেসময় ট্যালেন্ট মানেই আম্বালু-গাম্বালু নামের বীজ সংরক্ষণের ভাঁড়ার বানাতে জানা লোক হইতো বিশাল ট্যালেন্ট।
তাহলে এইযে শিকার করতে জানা লোকগুলার কী হবে? এরা প্রথমে সমাজে গুরুত্ব হারাবে। কিন্তু তাদের দক্ষতার বড়ো একটা দিক হলো ভায়োলেন্স। এই ভায়োলেন্স কাজে আসে কী করতে? লোকজনকে লাইনে রাখতে। শস্য ভাগাভাগির সময় লোকদের লাইনে রাখতে এদের দরকার। যে বেটা প্রথম এই ব্যাপার ধরতে পেরেছে, সেই প্রথম রাজা হয়েছে।
এরপরে অস্ত্র প্রযুক্তির উন্নয়ন, কৃষি প্রযুক্তির উন্নয়ন, সংরক্ষণ প্রযুক্তির উন্নয়ন সব মিলিয়ে আর্থ-সামাজিক সম্পর্কের আমূল পরিবর্তন। নতুন শ্রেণীর উদ্ভব, জমি মালিকের উদ্ভব। সাথে সাথে ইউনিফর্ম পরিহিত গুণ্ডা বাহিনীর ও উদ্ভব। মানে যাকে এখন আদর করে কমিশন সোলজার বলে। কমিশন সোলজারের ধারণাটি সহজ। বিত্তশালী লোক তোমার খাওয়া পরার ব্যবস্থা করবে, বদলে তুমি তার জমির সুরক্ষা দেবে, সেই জমিতে যারা চাষাবাদ করে তাদের জমি বাঁচাবে, ফসল যাতে আরেক লোকে নিয়ে যেতে না পারে সেই ব্যবস্থা করবে।
এই সামাজিক সম্পর্কটার সুরত বদলেছে দিনে দিনে, গুণ্ডার বদলে কখনো তাদের বলা হয়েছে মাস্কেটিয়ার, রেড আর্মি, মিলিটারি, নেভি সিল, পুলিশ আরও মেলা কিছু। কিন্তু তারা আসলে ক্ষমতার সেবক। সেই প্রাচীন আমলের সামন্তপ্রভূ কিংবা আম্বালু-গাম্বালু ঝুড়িওয়ালার নিয়োগ দেওয়া বেকার শিকারি থেকে তাদের মেলা পার্থক্য নেই।
এখানেই পুঁজিবাদের সমস্যাটা লুকানো। আমরা ধরেই নিচ্ছি, বাজারের হাতে ছেড়ে দিলেই সব সমস্যার সমাধান। কিন্তু ভুলে যাচ্ছি, সামাজিক সম্পর্কের বা সামাজিক চুক্তির ধরণটা স্রেফ বাজার মূল্য বা অর্থনীতির উপরে নির্ভর করেনা। যে বহুদিন ধরে সামন্ত প্রভূ, তার পক্ষে অস্ত্র, বিত্ত, জমি ইত্যাদি দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা খুবই সহজ। কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যক্তিবর্গ এই কথা মানতে নারাজ। আমরা মানতে নারাজ। কারণ স্কুল আমাদের শিখিয়ে দিয়েছে, আধুনিক যুগে ওসব হয়না, সবাই খুব র‍্যাশনাল, কেউ লোভি না, পুঁজিবাদি বাজারে সবাই সমান।
খালি নিজের গ্রামের বাজারের কথা চিন্তা করুন। বাজারে মাছ ওঠার আগেই, দারোগা বাবুর বাড়িতে বেশ তাজা মাছটা চলে যায়। পাড়ার মাতবরের বিশাল মোটরসাইকেল আরোহী বাহিনী এসে সদাই উঠিয়ে নেয়। বিনিময়ে দোকানি, “জয় মহারাজের জয়” বলে “যা দেন তাই সই’ বলে কম দামেও বেচে। অথচ বাজারের তো এমন হবার কথা ছিলনা।
আধুনিক কিছু প্রযুক্তি এসেছে, দার্শনিক প্রযুক্তি আর মেশিন প্রযুক্তি। দার্শনিক প্রযুক্তির মধ্যে রাষ্ট্র একরকম। এখানে বলা হয়েছে, রাজা গজা কেউ নেই। এই বিশাল গুণ্ডা বাহিনী (পুলিশ, মিলিটারি) আর তাদের শাসন লোকের কাছে গ্রহণযোগ্য করার লোক (আইন, আদালত, আইনজীবি) এরা হলো গিয়ে জনগণের সেবক। মানে আগে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ছিলেন মানব, এখন সেটাকে টেনে নিয়ে একটি ধারণাতে ফেলা হয়েছে। কারণটা সহজ, আইডিয়াজ আর বুলেটপ্রুফ।
কিন্তু, গত বিলিয়ন বছরের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করে একটা জিনিস পরিষ্কার, মানুষ আসলে পুরনো সামাজিক চুক্তি এবং সম্পর্কগুলো ঝেড়ে ফেলেনা, খালি বিবর্তন করে। আমূল বদলাবার জন্য জানের ভয় দরকার। যেটা কোলনিয়ালিজম করে ফেলেছে। পোস্ট মডার্নিজম বলবে এসবই নির্মাণ। তবে কচি তাত্বিক ভাই ও বোনেরা, কোলনিয়ালিজম হয়ে গেছে, মানুষ মরেছে, ইউরোপিয় কটা দেশের চিন্তা চেতনা আমরা নিজেদের মধ্যে নিয়ে ফেলেছি। সর্বনাশ যা হবার হয়ে গেছে। তাই “এসবই নির্মাণ” বলে চুপ করে মজা দেখাটা আমার হয়না আসলে।
যেটা বলছিলাম, প্রতিযোগিতা কোনকালেই সমান হবেনা। ওখানে গায়ের জোর, রাজনৈতিক ক্ষমতা, পরিবার, যৌনতা সব যোগ হয়। মোট কথা সংস্কৃতি যোগ হয়। পুঁজিবাদের সাফল্য ওখানেই, সে সংস্কৃতি বদলে ফেলতে পেরেছে। যে সংস্কৃতিতে আগে টাকার স্বপ্ন দেখা অন্যায় ছিল, সেখানে এখন অর্থের পাহাড় দেখাতে পারাই সুখ।
তাতে অবশ্য সমস্যাও বাড়ছে। কারণ, সেই টাকার স্বপ্ন সবার হাতে ধরা দেয়নি। কারণ ঐযে বললাম, প্রতিযোগিতা সমান হয়না। সাথে সাথে প্রযুক্তি প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে। ডট কম কালচারের দৌড় বাড়ায় হয়তো সিলিকন ভ্যালিতে উঠতি বড়লোক হয়েছে। কিন্তু স্যার সেখানেও মনোপলি। ফোনের বাজারে এপল আর স্যামসাং। কম্পিউটারে উইন্ডোজ আর ম্যাক। তারা এখন আইনজীবির বাহিনী বানিয়ে শিশুশ্রমকেও ভালো এবং উপকারী প্রমাণ করিয়ে ছাড়বে, বলে দেবে মাতৃত্বকালিন ছুটি একটা বাতিল কনসেপ্ট, ওটি দিলে তো বেবিসিটারের চাকরি চলে যাবে। অথচ রাষ্ট্রের তো এমন হবার কথা ছিলনা, রাষ্ট্র বলেছিল বাজার সবার, প্রতিযোগিতা সবার।
এরফলে আবার বিশাল লাভের অংকের বিপরীতে তৈরি হয়েছে দরিদ্র শ্রমিক। মধ্যবিত্ত যে শ্রেণী রাষ্ট্রের উদ্ভবের ফলে তৈরি হয়েছিল, উচ্চশিক্ষার ফলে যে রাজনীতি সচেতন জনগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছিল, তারা মৃতপ্রায়। বাজার, রাষ্ট্রীর গুণ্ডা আর আদালত সবই আবার সেই সামন্ত প্রভূ আর উদ্বৃত্ব খাদ্যশস্যের হাতে বন্দি। আমাদের গণতন্ত্র ভেঙ্গে দিতে এক সোশ্যাল মিডিয়া মগুলের পাঁচ মিনিট লাগেনা। তার কোন শাস্তিও হয়না। কারণ তার ভাড়া করা দার্শনিক গুণ্ডারা আছে।
প্রযুক্তি বদলেছে স্যার। আগে ভায়োলেন্স করতো লেঠেলরা। এখন করে কালো কোট আর গাউন পরা মুখবাজ সন্ত্রাসীরা। ওদের মালিকেরা টাকার বিনিময়ে আপনাকে দিয়েই আপনার দাসত্ব যায়েজ করিয়ে নেবে। আপনিও করবেন, আমিও করবো আসলে। কারণ বাজার লেঠেল বাহিনী, আইন বাহিনী দিয়ে ঘেরা। না খেতে পেয়ে মরে গেলেও আপনি বাজারের কাছে রেহাই পাবেন না। প্রতিদিন টাকা দিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার কিনতে হবে ঐ সবকিছুর মালিকের কাছে। রাজা নামে নেই বটে, কাজে আছে।
তবে এখনো আশা আছে। প্রযুক্তির বদলের সাথে আমাদের তাল মেলাতে হবে। অক্টোবর বিপ্লবের স্বপ্ন থেকে বের হতে হবে। কথা বলতে হবে। রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় প্রযুক্তি এখনো আইন, পলিসি। ওখানেই যেতে হবে। শ্রমের ন্যায্যমূল্য চাইতে হবে, ট্যাক্স দিতে হবে অতীব ধনীদের। ইউনিভার্সাল হেলদ কেয়ার, হায়ার এডুকেশন এবং সোশ্যাল রিসার্চ বাড়াতে হবে।
কৃষকের শ্রমের মূল্য চাইবার জন্য পলিসি পর্যায়ে কাজটাই আজকের এই পরিবেশে বিপ্লব স্যার। মার্ক্স ভুল কিছু বলেননি, তিনি আজও প্রাসঙ্গিক। খালি ম্যানিফেস্টোটা একটু বদলেছে, এই যা। কারণ রক্তপাত কোন সমাধান না। লেনিন ও হুট করেই রক্তপাতে যাননি। অক্টোবর বিপ্লব সফল করার রসদ যুগিয়েছিল জার্মানি। টাকা দিয়ে আর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে। কম্যুনিজম নিয়ে না চিল্লিয়ে, ওটার জন্য কাজ করাটাই ভালো।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত