ভারতের বিবাহের ইতিহাস (পর্ব -৪) । অতুল সুর
জ্ঞাতিত্ব ও স্বজন বিবাহ
আমরা আগের অধ্যায়েই দেখেছি যে প্রাচীন ভারতে নানারকম বিবাহপ্রথা প্রচলিত থাকলেও শেষ পর্যন্ত মাত্র একরকম বিবাহই আদর্শ বিবাহ হিসাবে নিষ্ঠাবান হিন্দুসমাজে গৃহীত হয়েছিল। এই বিবাহ নিম্পন্ন হতো মন্ত্র উচ্চারণ, হোমাদি যজ্ঞ কৰ্ম সম্পাদন ও সপ্তপদীগমন দ্বারা । উত্তরকালে হিন্দুসমাজে এরূপ বিবাহই একমাত্র বৈধবিবাহরূপে গণ্য হয়েছিল। আমরা আরও দেখেছি যে, এরূপ বিবাহে কতকগুলি জ্ঞাতিত্বমূলক বিধি পালন করা হতো।
ভারতের জ্ঞাতিত্বমূলক সংগঠন দ্বিপার্থিক। পিতা এবং মাতা, এই উভয়েরই কুল বা বংশ অবলম্বন কবে জ্ঞাতিসমূহ নির্ধারিত হয়। এই উভয়কুলেই উধ্বতন প্রত্যেক জ্ঞাতিরই ভিন্ন ভিন্ন সংজ্ঞ আছে। তবে বিবাহ সম্পর্কে এই সকল জ্ঞাতিবর্গের পদমর্যাদা ভারতের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন রকমের। উত্তর ভারতে পিতৃকুলেব উধ্বতন সাতপুরুষের এবং মাতৃকুলের উধ্বতন পাঁচপুরুষের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ। এই নিষেধবিধিকে সপিণ্ডবিধি বলা হয়। কিন্তু দক্ষিণ ভারতে ও পশ্চিম ভারতে অনেক স্থানে সপিণ্ডবিধির শ্লথতা দেখা যায়। এ সকল জায়গায় মামাতো বোন ও পিসতুতো বোন বাঞ্ছনীয় পাত্ৰী হিসাবে পরিগণিত হয়। দক্ষিণ ভারতে তামিল ব্রাহ্মণদের মধ্যে মামার সঙ্গে ভাগ্নীর বিবাহও প্রচলিত আছে । সুতরাং বিবাহ সম্পর্কে সপিণ্ড বিধি দক্ষিণ ভারতে পূর্ণভাবে পালিত হয় না। তবে সহোদরা বা পিতৃকন্তর সঙ্গে বিবাহ হিন্দুসমাজে কোন জায়গাতেই হয় না।
আরো পড়ুন: ভারতের বিবাহের ইতিহাস (পর্ব -৩) । অতুল সুর
বাঞ্ছনীয় বিবাহ যে মাত্র মাতুলকন্যা বা পিতৃম্বসার কন্যার মধ্যেই নিবদ্ধ, তা নয়। অপর শ্রেণীর জ্ঞাতিদের সঙ্গেও কোথাও কোথাও বিবাহের প্রচলন আছে। দেবরণ বা দেবর কর্তৃক বিধবা ভাবীকে বিবাহ এর অন্যতম । বর্তমানে এরূপ বিবাহ যদিও অত্যন্ত সীমাবদ্ধ, তবুও কালান্তরে যে এরূপ বিবাহ ভারতে ব্যাপক ছিল, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। বর্তমানে দেবরণ মাত্র উত্তর ভারতের কতিপয় জাতির মধ্যে ও বাংলা-ওড়িষ্যার নিম্ন শ্রেণীর মধ্যে প্রচলিত আছে। বর্তমানে যে ক্ষেত্রে দেবরণ প্রথা প্রচলিত আছে, সে ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মৃত্যুর পর তার বিধবা বিনা অনুষ্ঠানে দেবরের গৃহে গিয়ে কনিষ্ঠ ভ্রাতৃজায়ার সহিত সপত্নীরূপে বসবাস করতে সুরু করে। উত্তর ভারতে এরূপ রীতির নাম হচ্ছে “ঘর বঠেলি ।” তবে একথা বলা উচিত যে, উত্তর ভারতে বহুজাতির মধ্যে এই প্রথা প্রচলিত থাকলেও উচ্চবর্ণের হিন্দুসমাজে এব কোন চলন নেই। ১৯২৯ সালে “ম্যান ইন ইণ্ডিয়া” পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রবন্ধে বর্তমান লেখক দেখিয়েছিলেন যে, বাঙালী সমাজে জ্ঞাতিত্বমূলক এমন অনেক আচার ব্যবহার আছে যার দ্বারা প্রমাণিত হয় যে বাঙ্গালী সমাজেও এক সময় দেবরণ ও শু্যালিকাবরণ প্রচলিত ছিল । বর্তমানে বাংলাদেশের হিন্দুসমাজে উচ্চবর্ণের মধ্যে এরূপ রীতি প্রচলিত না থাকলেও বাউরি, বাগদি ও সাওতাল সমাজে এর প্রচলন আছে। ওড়িষ্যার নিম্ন শ্রেণীর জাতিসমূহও এই প্রথা অনুসরণ করে।
ভারতের কোন কোন জায়গায় এখনও বহুপতি গ্রহণ প্রথার প্রচলন আছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বামীর সহোদর ভ্রাতারাই অন্তান্ত স্বামী হিসাবে কার্যকর থাকে। যে সমাজে ভ্রাতৃত্বমূলক বহুপতিত্ব প্রচলিত আছে সে সমাজে একই স্ত্রীর উপর সকল ভ্রাতারই সমান যৌন অধিকার বিদ্যমান থাকে। যদিও বহুপতিত্ব আজ উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের মাত্র কয়েকটি জাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ, তথাপি এরূপ চিন্তা করবার যথেষ্ট অবকাশ ব্যাপকতা ছিল ।
দুটি বিশেষ ধরনের জ্ঞাতিত্বমূলক বিবাহ উত্তর-পূর্ব সীমান্তের আদিবাসী সমাজে প্রচলিত আছে। আসামের গারো জাতির লোকেরা বিধবা শ্বাশুড়ীকে বিবাহ করে এবং লাখেব, বাগনি ও ডাফলা জাতির লোকেরা বিধবা বিমাতাকে বিবাহ করে।
বা অতুলকৃষ্ণ সুর (৫ আগস্ট ১৯০৪ – ২ জানুয়ারি ১৯৯৯) ছিলেন বিশিষ্ট ঐতিহাসিক, নৃতাত্ত্বিক, অর্থনীতিবিদ, লেখক ও কলকাতা বিশেষজ্ঞ। ভারতীয় সভ্যতার উৎস নির্ণয়ে যাদের অবদান উল্লেখযোগ্য তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম। অর্থনীতিবিদ হলেও ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, সংখ্যাতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয়ে তার অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল।