bidhan saha

ইরাবতী এইদিনে গল্প: তিন টেউরী । বিধান সাহা

Reading Time: 3 minutes
আজ ২১ মার্চ কবি, কথাসাহিত্যিক, সম্পাদক ও চিত্রশিল্পী বিধান সাহা’র শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।

০১.
প্রিমিটিভ আর্ট নিয়া মরতেছি। পিকাসো মশাই হবো-কালে যে কাজগুলান করছিলেন তার মধ্যে কিছু কাজ নাকি প্রিমিটিভ আর্টের গোত্রভুক্ত হইয়া আছে। সেগুলান নিয়া এসেইনমেন্ট করতে হইবে। একাডেমিক। এইবার ঠেলা সামলাও! একে তো অফিস নিয়া আছি মহা ফাঁপোরকলে, তার উপর পড়াশুনা। সামনে পূজা-ঈদ, হাতে টাকা পয়সা নাই, আউটসোর্স কইরা যে দু-এক পয়সা কামামু তারও জো নাই।

তো প্রিমটিভিজম— আমাগোরে এলাকার বাগদী সম্প্রদায়ের কথা কইলে বাবুরা ক্ষেইপা যান। বাগদীরা দাস। কালো। বাগদী-বউরা মানুষের বাড়ীতে বাড়ীতে হাতারন্তি কইরা চলে। কেউ কেউ চাতালে কাম করে। আর পুরুষ মানুষ গুলান দাঁড়কি বানায়, কেউ কেউ মুগি সুতা আর ফলসি দিয়া জাল বোনে। আর হাটবারে হাটে নিয়া বেচে। তাহাদের মধ্যে যাহারা অতি আধুনিক তাগোরে বউগুলান বড়জোর খ্যাতা সিলাই করে আর আধুনিক বাগদী পুরুষ গুলান রিক্সা চালায় নয়তো সেলুনে কাম করে। তাহারা ‘ভদ্রলোক’ শব্দটিকে অতি কষ্টে উচ্চারণ করে ‘ভোদ্দরনোক’। তাহারা ‘আমি’ কে বলে ‘হামি’। তাহারা ভদ্রলোক হইয়া উঠিতে চায়।

বাগদীরা শুনছি হবো-কালে আফ্রিকা থেকে আসছিলেন। যখন পিকাসো সাহেব প্রিমিটিভিজম নিয়া গোপনে ছাইপাশ আঁকতে শুরু করছিলেন। এইকথা আমার অনুমান মাত্র। তবে বাস্তব হইলো অনিল বাগদীর একটা মেয়ে আছে। সুকুমারী। সেদিন মাত্রাবৃত্তে হাঁইটা যাইতে দেখলাম। লাল ফিতা দিয়া চুলগুলা স্বরবৃত্তে বান্ধা। শামীমরে জিঙ্গাস করছিলাম- কেডা রে?
– সুকু
– সুকু? এইডা আবার কেডা?
– আরে সুকুমারী, অনিল বাগদীর মেয়ে। পড়ালেখা করে। এই কলেজেই। আই এ ফাস্ট ইয়ার।

সুকু লেখাপড়া কইরা বড় হইবো। বাবুগো ঘরের বউ হইবো। হয়তো মনে মনে স্বপ্ন দেখতাছে। আর কিছু না হোক, অন্তত এই একটা স্বপ্ন বাস্তবায়নের ভার আমার। নিজ দায়িত্বে নিয়া নিছি। সুকু একবার আনমনে আমার দিকে যেইভাবে তাকাইছিলো, তাতে আমি আর তারে ফিরাইতে পারি নাই। পুরা আউলা-ঝাউলা হয়া গেছি। গোপনে বইলা দিছি- ভাবতাছো ক্যান, আছি না !!

০২.
সকুর আজকাল দেহের ভেতর শুক্লাচতুর্দশী। সুকুর আজকাল মনের ভেতর অন্তমিলের হাওয়া। সুকু হাসিতে হাসিতে ধায়। সুকু ভাসিতে ভাসিতে বায়। সুকু অনেক উপাখ্যানের ভেতর দিয়া সুকুমারী হইয়া উঠিতে চায়। জানা গেল টাওয়ার-পট্টির সজল তাহার সহপাঠি। সজল ভালো ক্রিকেট খেলে। দেখতে মাশাল্লা খারাপ না। শরীরের রগগুলা য্যান ফাইটা বাইর হইয়া সুকুরে প্যাঁচায়া ধরতে চায়। তাহার স্পোর্টি গ্লাসের উপ্রে একদিন সুকু নিজের মুখ দেইখা খিল খিল কইরা হাইসা উঠবো। এইসব সে ভাবে। ভাবে আরো কিছু। সেদিন শামীম কইলো এইসব বৃত্তান্ত। গোপন সোর্সের ভিত্তিতে সে আরো জানতে পারছে সুকু আর সজল ঘাসের জমিনে বইসা রঙিন জামানার স্বপ্ন দেখতাছে।

ঐদিকে হৃদয় বাগদী বহুদিন ধইরা রিক্সা চালায়। একদিন সে ঢাকায় যাইবো। ঢাকায় গিয়া অফিসার গো রিক্সায় তুইলা চালাইতে চালাইতে সেও একদিন গ্রামে ফিরা অফিসার হইয়া যাইবো। জাল বোনার পরিবর্তে এমন বাসনা সে বহুদিন ধইরা বুইনা গেছে। বাসনা আরো কিছু আছে। হৃদয় বাগদীর সেইসব গোপন বাসনার রঙিন কাব্য তার জিগ্নি দোস্ত সাত্তার হুজুর শামীমের দোকানে আইসা বয়ান করে। সাত্তার হুজুরের সেইসব তর্জমা মন দিয়া শোনে হাওলদার পাড়ার তাপস, শামীমের দোকানের কর্মচারী আরিফ, সুমন, সোনারুপাড়ার নাজমুল, বিশ্বজিৎ, ঢাকা টেইলার্সের খালেক, বারিক আরো অনেক গুলা কামহীন পোলাপাইন। কামহীন মানে কামহীন নয়। ইহা কার্যহীন বলিতে চাহিতেছি। সেইসব পোলাপাইন রন্ধ্রে রন্ধ্রে কামোন্মত্ত। একেকটা জিগার ডাল য্যান। আঁঠা বাইর হইয়াই থাকে। তাহারা সাত্তার হুজুরের গল্প শুনিয়া শুনিয়া আরো একটু বয়স বাড়ায়া নিতে চায়। সেইসব গল্প শুনিতে শুনিতে তাহাদের কাপড়ের অন্ধকারে হঠাৎ কী যেন ফুলিয়া ফুলিয়া ওঠে। তখন সুকু অদ্বিতীয় নয়, হৃদয়ও হৃদয় নয়। প্রতিটি পোলাপাইন তখন একেকজন হৃদয় বাগদী হইয়া ওঠে। প্রতিটি হৃদয় বাগদী তখন তাহাদের নিজ নিজ কল্পিত কামীনি, সুকুরে কল্পনা করিতে করিতে তালে-বেতালে হাত মারে। আর সুকু বহুভাগে বিভক্ত হইতে হইতে হঠাৎ খিল খিল করিয়া হাসিয়া ওঠে, তাহার খোঁপায় গুজিয়া দেয়া সজলের ভামোট ফুলের কথা ভাবিতে ভাবিতে।

০৩.
হৃদয় বাগদী প্রতিদিন সুকুর কলেজে যাওয়া দেখে। আসা দেখে। রিক্সা খাড়া কইরা একদিন হাউস কইরা কয়- চল্, তোক আইজ কলেজে নিয়া যাই।
– ক্যা? যামু ক্যা? আমি তোর রিক্সাত যামু ক্যা?
কী জানি! কোনদিন হৃদয় বাগদী সবার চোখ ফাঁকি দিয়া তারে কিছু কইছিলো কিনা! হাত-ফাত দিছিলো কিনা কে জানে! হৃদয় বাগদীর পুরাডাদিন মাটি কইরা দিয়া সুকু আজকাল খালি টাওয়ারের স্বপ্ন দেখে। যে টাওয়ার বায়া ওঠা একটা লাউয়ের ডগা বাতাসে একবার এদিক একবার ওদিক দুলেতেছে। সেই লাউয়ের ডগা দেইখা সজলের বাপ-মাও আশায় আছে— একদিন…

হৃদয় বাগদী মনে মনে কান্দে। হৃদয় বাগদী বুঝে যায় সুকু আর বাগদী নাই। সে এখন বাগদী গোত্র ছাইড়া বাবু গোত্রে নাম লেখাইতেছে। হৃদয় বাগদী বুঝে যায় ঘটনা আর ঘটনা নাই।

সুকু এইসব বোঝেনা। সে স্বপ্ন দেখতেছে। আশায় আছে বাবুগো ঘরের বউ হইবো। সে শিক্ষিত হইতেছে। প্রিমিটিভিজমের জানালা ভাইঙ্গা সুকু আজ রঙিন কয়ড়া উড়ায়া দিতেছে দক্ষিণ আকাশে।

জানা গেল, সুকুমারীর নিজস্ব আঙিনায় পাঁচ মাস হইলো কোন লাল পতাকা উড়তেছে না।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>