মৃণালের ‘খণ্ডহর’ যান্ত্রিক যুগে আশার বেঁচে থাকার গল্প: বিধান রিবেরু

Reading Time: 7 minutes

আজ ২২ সেপ্টেম্বর গদ্যকার ও চলচ্চিত্র সমালোচক বিধান রিবেরু’র জন্মতিথি।ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো।


‘আপনার পৃথিবী সম্পর্কে যা আন্ডারস্ট্যান্ডিং সেই আন্ডারস্ট্যান্ডিং নিয়েই আপনি রিয়েলিটিকে বিচার করছেন। সুতরাং এটাও সাবজেক্টিভ, ভীষণ পার্টিজান, ভীষণ ইন্টারপ্রিটেটিভ।’- মৃণাল সেন (২০১৫ :১৯০)

মেজাজের দিক থেকে মৃণাল সেনের ‘খণ্ডহর’ (১৯৮৩) ছবিটি আগের ছবিগুলোর চেয়ে আলাদা। ষাট ও সত্তরের দশকে ঋজু রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সংবলিত পরিচালকের যে লড়াকু চেহারা ধরা পড়ে, তা আশির দশকে চোখে পড়ে না। তার মানে এই নয়, মৃণাল অরাজনৈতিক হয়ে উঠেছিলেন পরবর্তী দশকে। বরং বলা যেতে পারে, তিনি রাজনীতিকে আবিস্কার করার চেষ্টা করছিলেন পরিবারে; মানবিক সম্পর্কের ভেতরে। তা ছাড়া ততদিনে কলকাতার রাজনৈতিক চিত্র, সামাজিক মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল- সবকিছুই পাল্টে গেছে অনেকখানি।

মৃণাল এক সময় ছবি বানিয়েছেন ঔপনিবেশিক মানসিকতার বিরুদ্ধে, বেকারত্ব নিয়ে; ক্ষুধা, দারিদ্র্য, বৈষম্য, দুর্ভিক্ষ, নকশালবাড়ি আন্দোলন, রাগী ও প্রতিবাদী যুবক, শ্রমিক-কৃষক-জনতার বিপ্লব এবং মধ্যবিত্তের দোদুল্যমান চরিত্র নিয়ে। আমরা তাঁর কলকাতাত্রয়ী :’ইন্টারভিউ’ (১৯৭০), ‘কলকাতা ৭১’ (১৯৭২) ‘পদাতিক’ (১৯৭৩); ‘কোরাস’ (১৯৭৪), ‘একদিন প্রতিদিন’ (১৯৭৯), ‘আকালের সন্ধানে’ (১৯৮০) ইত্যাদি ছবির কথা জানি। সেই একই পরিচালক পরবর্তী সময়ে ‘খারিজ’ (১৯৮২) বা ‘খণ্ডহর’-এর মতো ছবি বানাচ্ছেন। যেখানে পারিবারিক ও মানবিক সম্পর্ককে খুঁড়ে কখনও মধ্যবিত্তের সংকট, কখনও বা প্রযুক্তিনির্ভর শহুরে মানুষদের যান্ত্রিক ও ব্যবসায়িক মনোবৃত্তির আড়ালে রাজনৈতিক শ্রেণিচরিত্রকেই আবিস্কারের চেষ্টা করেছেন।

‘খণ্ডহর’ ছবিটির কথা যদি ধরি, যে গল্প থেকে এই ছবিটি বানানো হয়েছে, প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘তেলেনাপোতা আবিস্কার’, সেই গল্পকে বলা হয় বাংলা সাহিত্যের অন্যতম রহস্যময় গল্প। এমন এক গল্প নিয়ে যখন মৃণাল সেনের মতো রাজনীতি-সচেতন পরিচালক ছবি বানান, তখন বুঝতে হবে সেখানে ঊনপ্রেমে ভীরু প্রেমিক কিংবা গ্রামীণ নারীর সৌন্দর্য অথবা শহুরে দৃষ্টিতে স্রেফ গ্রামের ভগ্নদশা দেখাতে চান না মৃণাল। অথচ অনেক চলচ্চিত্র সমালোচক ওসব নিয়েই আলোচনা করেছেন।

যেমন চলচ্চিত্র সমালোচক প্রলয় শূর বলছেন, ‘যামিনীর ওই স্টিল ফটো  a thing of beauty,  পরের কথাটুকু সবাই জানেন। এ ছবিতে মৃণাল বাবু আমাদের যে অভিজ্ঞতাটা পাইয়ে দিলেন এ জন্যে তাঁর কাছে আমাদের ঋণ অপরিমেয়। আপনার হৃদয়ের মধ্যে যে হৃদয়টুকু আছে, সেটুকুর জন্যই ছবিটা আপনার ভালো লেগে যায়- অথচ ওখানে যামিনীর মায়ের কঠিন ব্যাধি, যামিনী একা, যেখানে পরিচালকের অনুভূতির সঙ্গে মিলেছে তাঁর পর্যবেক্ষণ। ছবি শেষ হয়ে যায়, কী যেন নেমে আসে আমার মেরুদণ্ডে।’ (প্রলয় ১৯৮৭ :১০৫)

শতদ্রু চাকী বলছেন, “রবীন্দ্রনাথের ‘পোস্টমাস্টার’, প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘তেলেনাপোতা আবিস্কার’ এবং তুর্গেনিভের ‘এশিয়া’র মতো মৃণাল সেনের ‘খণ্ডহর’ও শেষ পর্যন্ত এক কাপুরুষের কাহিনী। যে কাপুরুষতার শিকড় রয়েছে এই আমাদেরই দেশে, কালে।” (শতদ্রু ২০১৭ :৩১১) শুধু তাই নয়, চাকী মনে করেন, গল্পের নায়ক, তার কথায় ‘কাপুরুষটি’কে ছবিতে মৃণাল চিত্রগ্রাহক হিসেবে দেখিয়েছেন। কারণ পল্লীর বিষণ্ণ পরিবেশে নাকি এতে ‘সপ্রতিভ আধুনিকতা কন্ট্রাস্ট’ হিসেবে ভালো লাগবে তাই। ভুল পাঠ। কেন ভুল, সেটা পরিস্কার হবে একটু পরই। তার আগে চলুন আরও একজন সমালোচকের মন্তব্য দেখি।

অস্ট্রেলিয়ার চলচ্চিত্র সমালোচক জন ডব্লিউ হুড ‘খণ্ডহর’ সম্পর্কে বলছেন, ‘ছবিটি অতীত ও বর্তমানের মিলেমিশে যাওয়া নিয়ে অধিক সজাগ। সময়, স্থান ও মানবিক মূল্যবোধের সীমা নিয়েই আগ্রহী এই ছবি। আর সবার উপরে ছবিটি হলো খুবই সরল ও অ-জটিল এক সমতলের ওপর মানুষের জটিল সম্পর্কের সংবেদনশীল উন্মোচন।’ (জন ১৯৯৩ :৮৮) হুড মনে করেন, মৃণালের ছবিতে চিহ্নবিদ্যার দুর্বোধ্যতা বা বুদ্ধির ওপর চাপ কম থাকে। সে জন্য মৃণালের দর্শক ছবিগুলো দেখে প্রতিদিনকার জীবন থেকে পালাতে নয়, বরং পুনরায় প্রাত্যহিকের অভিজ্ঞতা নিতে। (জন ১৯৯৩ :৮৯)

এই তিন সমালোচকের দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্নেষণ করলে দেখা যায়, মৃণালকে তাঁরা সঠিক তর্জমা করতে পারেননি। সঠিক তর্জমা কী, সেই আলোচনায় প্রবেশের আগে ‘খণ্ডহর’ ছবির কাহিনী সংক্ষেপে বলে নেওয়া যাক। ছবিতে দেখা যায়, তিন বন্ধু- দীপু, সুভাষ, অনিল। তারা হুট করে একদিন গ্রামে বেড়াতে যায়; দীপুদের গ্রামে। সেখানে গিয়ে গল্পের নায়ক সুভাষের সঙ্গে পরিচয় হয় দীপুর দূরসম্পর্কের আত্মীয়া যামিনীর। যামিনী বিবাহযোগ্যা, কিন্তু বিয়ে হচ্ছে না। নিরঞ্জন নামে এক যুবক তাকে বিয়ের কথা দিলেও পরে সে আর ফিরে আসেনি। যামিনীর মা পক্ষাঘাতগ্রস্ত। সে বিশ্বাস করে, নিরঞ্জন একদিন ফিরে আসবে এবং তার মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে যাবে, তার কর্তব্য ফুরাবে। এই আশা নিয়েই কেটে যাচ্ছিল মা ও মেয়ের ছোট্ট সংসার। এমন সময় তাদের গ্রামে আসে ওই তিন বন্ধু। গ্রামটি তেমন উন্নত নয়। যেতে হয় গরুর গাড়িতে চেপে। অজ-পাড়াগাঁ। আর যামিনীরা যে বাড়িতে থাকে, সেটি ধরে আছে বিলুপ্ত রাজন্যের ভেঙেচুরে ক্ষয়ে যাওয়ার স্বাক্ষর। যে ক’টি ঘর ভালো আছে সেখানেই দিন গুজরান করে যামিনী আর অন্ধ মা।

একদিন দীপু ও সুভাষ যামিনীর অচল মাকে দেখতে আসে। তখন যামিনীর দৃষ্টিহীন মা ভাবে, নিরঞ্জন এসেছে। বৃদ্ধ মানুষ আশাহত হোক, সেটা কেউই চায়নি; না যামিনী, না দীপু, না সুভাষ। যামিনীর মা ভেবেছে, দীপুর সঙ্গে আসা সুভাষই হলো নিরঞ্জন। বৃদ্ধা কথা আদায় করে নেয় ‘নিরঞ্জন’ যেন দ্রুত তার মেয়েকে ঘরে তুলে নেয়। নিরঞ্জনরূপী সুভাষ মিথ্যা আশ্বাস দেয়। এর মধ্যেই যামিনী ও সুভাষের ভেতর একটা অবলা ভালো লাগা কাজ করতে শুরু করে। সেই ভালো লাগায় ছেদ পড়ে বিদায় বেলায়। যাওয়ার আগে চিত্রগ্রাহক সুভাষ ভাঙাচোরা দালানের এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা যামিনীর ছবি তোলে। সেই ছবিটিই পরে আমরা দেখি ঝুলে আছে সুভাষের স্টুডিওতে। সেখানে সুভাষ ছবি তোলায় ব্যস্ত। ক্যামেরা ক্লোজ হয় যামিনীর স্থিরচিত্রের দিকে। আর দর্শকের কানে আসতে থাকে স্টুডিওর ব্যস্ততা ও শহরের যান চলাচলের আওয়াজ। এখানেই শেষ হয় ছবিটি।

প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্পে নায়কটি শুধুই নায়ক; তার কোনো নাম নেই, এমনকি পেশাও নেই। কিন্তু মৃণাল সেন তাকে একটি নাম দেন এবং হাতে ধরিয়ে দেন ক্যামেরা। এই ছোট্ট পরিবর্তনের কারণেই ছবিটি হয়ে ওঠে মাস্টারপিস। আমরা জানি, যান্ত্রিক পুনরুৎপাদনের যুগে ক্যামেরা এক দারুণ সংযোজন, যা দিয়ে শিল্প রচনা করা যায় এবং সেই শিল্পকর্মটি বারবার উৎপাদনও করা যায়। বাল্টার বেনিয়ামিন মন্তব্য করেছিলেন, একটি শিল্পকর্মের পুনঃউৎপাদন সম্ভব হওয়ার ফলে সেই কাজটি তার ‘অরা’ বা একমাত্র থাকার গৌরব হারায়। এতে শিল্প অনেক বেশি গণমানুষের কাছাকাছি আসতে পারে। এক কথায়, শিল্পের গণতন্ত্রায়ন হয়। আরেক ধাপ এগিয়ে যদি দেখি, তাহলে দেখব এই গণতন্ত্রায়নের পাশাপাশি ব্যবসায়িক মনোবৃত্তিও যোগ হয়। ধরুন, মোনালিসার ছবিটি পুনঃউৎপাদন করে কত লোকেই তো পয়সা কামাচ্ছে! কাজেই যান্ত্রিক পুনঃউৎপাদনের কারণে বলা যায় মানুষের কাছে আসলটির জন্য যেমন টান কমেছে, তেমনি নকলটিকে পণ্য হিসেবে খরিদ করতেও তার আটকাচ্ছে না। এবার দেখুন সুভাষের অবস্থা। সে নির্ঘাত ভুলেই গেছে যামিনীর কথা। যদিও যামিনীর একখানা ছবি টাঙানো রয়েছে তার স্টুডিওতে। সে হয় তো অভ্যস্ত হয়ে গেছে ছবিটায়। কিন্তু ছবিটি স্টুডিওতে কেন? সুভাষের বাড়িতেও তো থাকতে পারত। শিল্পকর্ম হিসেবে এই স্থিরচিত্রটির যে মূল্য তৈরি হয়েছে, সেটিকে স্টুডিওতে টাঙিয়ে রেখে নিজের মূল্যই কি বাড়াতে চাচ্ছে না সুভাষ? যেন খদ্দের এসে তার এই শিল্পকর্মটির প্রশংসা করে! সেখানে আসল যামিনী নেই; সে কেবলই ছবি। আসল যামিনী হারিয়ে গেছে সময়ের স্রোতে। শহুরে ব্যস্ততা, গাড়িঘোড়ার চলাচল, কর্কশ শব্দ আর স্টুডিওর পেশাদারি জীবনের ঘূর্ণিপাকে। কিন্তু যামিনীর এক টুকরো স্থিরচিত্র বাজারে মানে স্টুডিওতে ঝুলে আছে এক ধরনের পণ্য হয়ে। পুনঃউৎপাদনের যুগ তো পণ্যায়নের যুগও বটে। তাই নিস্তব্ধ সেই পল্লীর যামিনী পুনঃউৎপাদিত হয়ে ঠাঁই পায় ব্যস্ত নগরের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের দেয়ালে।

এই ছবিটির মধ্য দিয়ে মৃণাল নিজের ভাবাদর্শ থেকে সরে যাননি, যে ভাবাদর্শ আমরা তাঁর রাজনৈতিক চলচ্চিত্রে দেখেছি। যুগ যুগ ধরে বঞ্চনা ও দারিদ্র্যের কথা বারবারই ফিরে এসেছে সেসব ছবিতে। ‘খণ্ডহর’ও সেই একই বিষয় ধারণ করে আছে, শুধু প্রকাশভঙ্গি আলাদা। গ্রামের সেই ভগ্নপ্রায় প্রাসাদপ্রতিম দালানটি যেন যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকা শোষণ ও বঞ্চনার প্রতীক। যেখানে ধুঁকে ধুঁকে মরছে যামিনী ও তার মায়ের মতো মানুষ। তারা সর্বদা আশায় আশায় থাকে, নিরঞ্জনের মতো কেউ এসে তাদের উদ্ধার করবে। ভুলে গেলে চলবে না, নিরঞ্জনের আরেক অর্থ ভগবান বা দেবতাও বটে। কিন্তু কোনো দেবতা যখন তাদের উদ্ধারে এগিয়ে আসে না, তখন এক নকল দেবতা এসে মিথ্যা আশ্বাস দেয়। এই নকল দেবতার নাম সুভাষ। সুভাষের অর্থ প্রিয়ভাষী, বিয়ের কথা তো মেয়ের মায়ের কাছে প্রিয় হবেই। সেই প্রিয় কথায় হয় তো কিছুদিন দুঃখ ভুলে থাকা যায়, কিন্তু সেখান থেকে মুক্তি মেলে না। কারণ সুভাষ শেষ পর্যন্ত মুনাফাচালিত চঞ্চলমতি শহরেরই প্রতিভূ, সে কোনো যিশুখ্রিষ্ট নয় যে পরিত্রাণ দেবে। তাই সে চলে আসার পর যাদের অন্ধকারে থাকার কথা তারা অন্ধকারেই থেকে যায়।

খেয়াল করে দেখুন, মেয়েটির নাম যামিনী, মানে রাত্রি। তবে তাদের মনের ভেতর আশা আছে, একদিন ভোর হবে। অর্থাৎ হয় তো একদিন যামিনীর বিয়ে হবে, বা তারা খণ্ডহর ছেড়ে মজফফরপুরে চলে যাবে, যামিনীর দিদির বাড়িতে। এই আশা আছে বলেই তারা ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে আছে। মা-মেয়ে কী করবে সেটা মৃণাল শেষ পর্যন্ত বলে দেননি। তাই মৃণালের কাছে ছবিটি ‘A film of hope, not of despair.’ (মৃণাল ২০১৫ :১৯৫)

ইতিহাসে যতই বঞ্চনা ও দারিদ্র্য থাকুক, তার পাশাপাশি মানুষ আশাবাদ জাগ্রত রেখেছে বলেই মানব সভ্যতা সামনের দিকে এগিয়েছে। কলকাতাত্রয়ীর শেষ ছবি ‘পদাতিক’-এ সুমিতকে যে তার বাবা বলে- সাহসী হও, আর সুমিতও একটি ভরসার জায়গা পায় আন্দোলন জারি রাখার; সেটার অপর নামই আশাবাদ। পরবর্তী ছবি ‘কোরাস’-এও শেষ পর্যন্ত বিপ্লবেই ভরসা রাখেন মৃণাল। একইভাবে যামিনীর স্থির মুখচ্ছবির ভেতর আশার আলোটি জ্বালিয়ে রাখেন পরিচালক। এই প্রজ্বলিত প্রত্যাশা ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। চলচ্চিত্র সমালোচক শিলাদিত্য সেন ঠিকই ধরতে পেরেছেন ঐতিহাসিক পটভূমিতে মৃণালের গতিমুখ। তিনি বলেন, ‘ইতিহাসের চাপেই তো তেলেনাপোতায় তিরিশের দশকে যা আবিস্কার করেছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, আশির দশকে এসে তাই পুনরাবিস্কার করতে হয় মৃণাল সেনকে। দীর্ঘ দুশ’ বছর উপনিবেশের অঙ্গ হিসেবে থাকতে থাকতে গ্রামজীবন ইতিমধ্যে নিঃশেষ করে ফেলেছে তার অফুরান প্রাকৃতিক বৈভব। আর ব্রিটিশদের আইনানুসারে তো কবেই বিচ্ছেদ ঘটে গেছে মফস্বলের সঙ্গে মেট্রোপলিসের।’ (শিলাদিত্য ২০১৭ :৩১৯)

এর সঙ্গে যোগ করে বলতে চাই, শহরের মেকি মানুষেরাই মাঝেমধ্যে গ্রামের দরিদ্র মানুষের কাছে ত্রাতা হিসেবে হাজির হয়। প্রকৃত অর্থে তারা ত্রাণকর্তা নয়, ভান করে মাত্র। যেমনটা আমরা দেখি সুভাষকে, যামিনীর বেলায়।

কাজেই সমালোচকদের জবাবে বলতে চাই, সুভাষ এখানে কাপুরুষ নয়, যামিনীও শুদ্ধ ‘আ থিং অব বিউটি’ নয়। তাদের একজন যান্ত্রিক পুনঃউৎপানের যুগে পুঁজিবাদের তৈরি মানুষ, অন্যজন দারিদ্র্য ও আশার মাঝে বেঁচে থাকা মানুষ, যে কি-না পরে প্রথম মানুষের দ্বারা পণ্যে পরিণত হয়। এর পর হুড যেমনটি বলছিলেন, মৃণালের কাজে চিহ্নের ব্যবহার সেভাবে নেই, তাই মাথাও খাটাতে হয় না। এটাও তো ভুল। ‘খণ্ডহর’-এর বেলায় সুভাষের হাতে থাকা ক্যামেরার চেয়ে বড় চিহ্ন আর কী হতে পারে! এ ছবিতে যে বহু স্তর রয়েছে, সেটা কি মাথা খাটানো ছাড়া ধরা পড়বে দর্শকের চিন্তায়?

তাই বলব, উল্লিখিত তিন আলোচক মৃণালের চিন্তাকে অনুসরণ করতে পারেননি। অবশ্য দুনিয়াকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি যার যে রকম, সে সেভাবেই দুনিয়াকে বা চারপাশকে ব্যাখ্যা করবে। মৃণাল সেন দুনিয়ায় দেখতে চেয়েছেন মানুষের জন্য মানবিক মর্যাদা ও সাম্য। তিনি সবার জন্য সম্মানজনক বেঁচে থাকার পথ ও মত আবিস্কারে রত ছিলেন, বিশেষ করে ‘বাইশে শ্রাবণ’-এর (১৯৬০) পর থেকে। সেটিই তাঁর কণ্ঠস্বর, সেটিই তাঁর অন্বেষার বস্তু। সে জন্য তিনি আশা বাঁচিয়ে রাখতে চান। হাল না ছাড়ার পক্ষেই তাঁর অবস্থান। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়াকেই তিনি সত্য বলে মানেন। সে জন্যই মৃণাল বলেছেন, “‘খণ্ডহর’ ও ‘জেনেসিস’-এ আমি যা বলতে চেয়েছি তা একেবারে নতুন কিছু নয়। ‘আকালের সন্ধানে’ বা তারও আগের ‘একদিন প্রতিদিন’-এ তার ইঙ্গিত আছে। ‘একদিন প্রতিদিন’ থেকে আমি যে প্রশ্নগুলো তুলেছি, নিজেকে প্রশ্ন করা, নিজের ভেতরের শত্রুকে খুঁজে পাওয়া, এটা কিন্তু পলিটিক্যাল সিন থেকে পালিয়ে আসা নয়। আমি মোটেই তা মনে করি না। আজকে যা ছবি করছি, সেটা কিন্তু ‘একদিন প্রতিদিন’ কিংবা অন্য ছবি যেখানে নিজের ভেতরকার কথাটা ভেবেছি, নিজেকে রিয়েলিটির মুখোমুখি দাঁড় করাতে চেষ্টা করেছি, তা থেকে আলাদা কিছু নয়। আমি বরাবর বলে আসছি,  We have always been chased by our own time। (মৃণাল ২০১৫ :১৮৪)


পুঁজি

মৃণাল সেন, ২০১৫, আমি ও আমার সিনেমা, কলকাতা :বাণীশিল্প।

প্রলয় শূর, ১৯৮৭, জীবনের আর এক নাম যামিনী, মৃণাল সেন, প্রলয় শূর সম্পাদিত, কলকাতা :বাণীশিল্প।

শতদ্রু চাকী, মৃণাল সেন-এর ‘খণ্ডহর’- কয়েকটি গল্প ও কিছু কথা, চলচ্চিত্র চর্চা (চলচ্চিত্রবিষয়ক পত্রিকা), প্রসঙ্গ মৃণাল সেন :চলচ্চিত্র সমালোচনা, বিভাস মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত, (সংখ্যা-২৪, ১৪ মে ২০১৭), কলকাতা।

শিলাদিত্য সেন, বস্তু > প্রতীক :পারাপার না পরিণতি, চলচ্চিত্র চর্চা (চলচ্চিত্রবিষয়ক পত্রিকা), প্রসঙ্গ মৃণাল সেন :চলচ্চিত্র সমালোচনা, বিভাস মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত, (সংখ্যা-২৪, ১৪ মে ২০১৭), কলকাতা।

প্রেমেন্দ্র মিত্র, ২০০১, তেলেনাপোতা আবিস্কার, প্রেমেন্দ্র মিত্রের শ্রেষ্ঠ গল্প, সৌরীন ভট্টাচার্য সম্পাদিত, কলকাতা :দে’জ পাবলিশিং।

John W. Hood, 1993, Chasing the Truth : The Films of Mrinal Sen, Calcutta : Seagull Books.

 

 

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>