| 25 এপ্রিল 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

নজরুল-বিদ্রোহের স্বরূপ ও ‘বিদ্রোহী’ কবিতা । মুহম্মদ নূরুল হুদা

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

বল বীর –

বল উন্নত মম শির!

শির নেহারি’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!

১৯২১ সালের ডিসেম্বর, ক্রিসমাসের রাত। কলকাতার ৩/৪সি, তালতলা লেনের একটি বাড়িতে বসে কাঠ পেন্সিলে এই কালজয়ী কবিতা লিখতে শুরু করেন সদ্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধফেরত বাইশ বছরের যুবক কাজী নজরুল ইসলাম।

বিশ্লেষকদের ভাষায়, রবীন্দ্র জমানার সাহিত্য থেকে বেরিয়ে সেটি নতুন এক সাহিত্য ধারার সূচনা হলো।

একশো বছর পরেও সেই কবিতার আবেদন ফুরায়নি, রয়ে গেছে আগের মতোই।

১৯২২ সালের ৬ই জানুয়ারি শুক্রবার সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকায় প্রথম ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি ছাপা হয়। বৃষ্টি হওয়ার পরেও কাগজের চাহিদা এতো হয়েছিল যে, সেই সপ্তাহে ওই কাগজটি দুইবার মুদ্রণ করতে হয়েছিল। আমরা এখানে এই অবিস্মরণীয় কবিতাটির উপর বিশিষ্ট কবি ও নজরুল-বিশেষজ্ঞ মুহম্মদ নূরুল হুদা-র একটি পাঠ-সমীক্ষণমূলক রচনা প্রকাশ করলাম।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


 
সমূলক হোক অমূলক হোক, বিদ্রোহের কোনো স্বীকৃত ব্যাকরণ নেই। বিদ্রোহ স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বতোৎসারিত, সর্বগ্রাসী ও সংক্রামক। প্রচলের বিপরীতে প্রতিক্রিয়া বা প্রতিবাদই বড় কথা নয়, আসল কথা নিজেকে ভেতর ও বাহির থেকে মুক্ত করে আপন শক্তির মহিমায় অবলোকন করা, তারপর ব্যক্তি ও সমষ্টির জন্য সেই আত্মশক্তিকে ইতিবাচকভাবে প্রয়োগ করা। এইভাবে একটি সফল বিদ্রোহ সময়ের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে কালক্রমে এমন একটি কর্মপদ্ধতিতে বিবর্তিত হয়ে যায়, যা নিজেকে ও অন্যকে মানুষের সামগ্রিক প্রয়োজনে ইতিবাচক সক্রিয়তায় বিকশিত হওয়ার সুযোগ উন্মুক্ত করে। বিদ্রোহেরও শুরু আছে, অগ্রগমন আছে, বিবর্তন আছে আর পরিণতি আছে। প্রতিটি বিদ্রোহ পরিণতির পর আবার আরেকটি প্রচলের জন্ম দেয়, যা কালক্রমে আরেকটি বিদ্রোহের বীজকে সঙ্গোপনে লালন করে। অর্থাৎ বিদ্রোহ কেবল একবার ঘটে না, বার বার ঘটে। জীবন নবায়িত হয়, নবায়িত হয় চাহিদা, নবায়িত হয় নতুন সময়ের নতুন দ্রোহের সম্ভাবনা। এই বিদ্রোহ-বয়ান দীর্ঘায়িত করা যায় আরো বহুদূর, তাতে পুনরাবৃত্তি যেমন যেমন বাড়ে, তেমনি বাড়ে অত্যুক্তি।
 
প্রতিটি বিদ্রোহের শুরুতে এই ‘অতি’-র একটি ইতিবাচক ভূমিকা আছে। যেমন আছে নজরুল-বর্ণিত বিদ্রোহের : ‘শির নেহারি আমারি, নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির’। বিদ্রোহের সঙ্জ্ঞা-বয়ানে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ আজ শুধু একটি কাব্যভাষ্য নয়, বরং একটি সচল নমুনা। সচল এ-কারণে যে, এই নমুনাকে ব্যাখ্যাকারী আবার নিজের মতো করে আত্মস্থ করে পুনর্বিন্যাস করতে পারে। এখানে কবির আত্ম-উপলব্ধি ও সত্যান্বেষণের পথও দৃশ্যমান। তবে এই কাব্যভাষ্যের আলোকে নজরুলের বিদ্রোহের স্বরূপ নির্ণয়ের আগে আমরা কবির আরেকটি অত্যাবশ্যকীয় জবানবন্দীর শরণ নিতে পারি, যেখানে কবি স্বয়ং তাঁর বিদ্রোহ সম্পর্কে অকপট স্বীকারোক্তি করেছেন। ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ নামক এই স্বীকারোক্তি প্রমাণ করে তিনি তাঁর নিজের বিদ্রোহ সম্পর্কে পূর্ণরূপে সচেতন ছিলেন। কবির কাজ তাঁর ভিতর যে জাগ্রত দেবতা বা ভগবান আছেন, তাঁর আদেশ মান্য করে ‘সত্য’ প্রকাশ করা। আর ঔপনিবেশিক রাজশক্তি বা অন্য যে কোনো ক্ষমতাপ্রভুর কাছে এই সত্য প্রকাশ করাটাই বিদ্রোহের সামিল। ‘কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন। আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা, ভগবানের বাণী। সে বাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যায়-বিচারে সে-বাণী ন্যায়-দ্রোহী নয়, সত্যদ্রোহী নয়। সে বাণী রাজদ্বারে দণ্ডিত হতে পারে, কিন্তু ধর্মের আলোকে, ন্যায়ের দুয়ারে তাহা নিরপরাধ, নিষ্কলুষ, অম্লান, অনির্বাণ, সত্য-স্বরূপ।’ (রা.জ., নজরুল) খুব সহজেই বোঝা যাচ্ছে নজরুল ধর্ম, ভগবান তথা যুগ যুগ ধরে মানবসমাজে সদাচার-বাহিত যে সত্য, যা সর্বমানবিক কল্যাণের সহায়ক বলে সর্বমান্য, সেই সত্যবাণী উচ্চারণ করাটাকেই ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছেন, আর ক্ষমতাপ্রভু তাকেই রাজদ্রোহ তথা বিদ্রোহ ভেবে ভীত হচ্ছেন। বিষয়টা নজরুল অধিকতর খোলাসা করে আরো বলছেন, ‘আমি শুধু রাজার অন্যায়ের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করি নাই, সমাজের, জাতির, দেশের বিরুদ্ধে আমার সত্য-তরবারির তীব্র আক্রমণ সমান বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে, তার জন্যে ঘরে-বাইরের বিদ্রোহ, অপমান, লাঞ্ছনা, আঘাত আমার ওপর পর্যাপ্ত পরিমাণে বর্ষিত হয়েছে, কিন্তু কোনো কিছুর ভয়েই নিজের সত্যকে, আপন ভগবানকে হীন করি নাই, লোভের বশবর্তী হয়ে আত্ম-উপলব্ধিকে বিক্রি করি নাই, নিজের সাধনা-লব্ধ বিপুল আত্মপ্রসাদকে খাটো করি নাই, কেননা আমি যে ভগবানের প্রিয়, সত্যের হাতের বীণা; আমি যে কবি, আমার আত্মা যে সত্যদ্রষ্টা, ঋষির আত্মা।’ এখানে কবি তাঁর বিদ্রোহের ক্ষেত্রসমুহকেও চিহ্নিত করেছেন। রাজশক্তির বাইরেও যুগ যুগ ধরে সমাজে, জাতিতে, দেশে ও বিশ্বে যে মিথ্যাচার জগদ্দল পাথর হয়ে বিরাজ করছে, নজরুল তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। নজরুলে উক্তি ও তাঁর রচিত গদ্যপদ্যনাটকসহ তাবৎ রচনা-সম্ভার বীক্ষণ করে আমরা বলতে পারি, তাঁর বিদ্রোহের নাম আত্মশক্তির উপলব্ধিজাত সত্যোচ্চারণ আর তার প্রকাশ-ক্ষেত্র বিভিন্ন। যেমন ব্যক্তি-বিদ্রোহ, সামষ্টিক বিদ্রোহ, রাজনৈতিক বিদ্রোহ, আর্থ-সামাজিক বিদ্রোহ, ভাষা-বিদ্রোহ, সাংস্কৃতিক বিদ্রোহ, নান্দনিক বিদ্রোহ তথা সর্বমানবিক বিদ্রোহ। বিদ্রোহের ক্ষেত্রসমূহ এই হয়তো আরো দীর্ঘতর হতে পারে।
নজরুলের ভাষা-বিদ্রোহ ও নান্দনিক বিদ্রোহ অপেক্ষাকৃত কম আলোচিত। কবিতায় ও গদ্যে নজরুল যে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র শৈলীর অধিকারী ছিলেন, তার কারণ তিনি প্রচলিত অপ্রচলিত বিদেশী শব্দের পাশাপাশি বাঙালির সর্বগোত্রের ভাষিক, সাংস্কৃতিক ও আত্মিক স্বাতন্ত্র্যসূচক শব্দও বাকবিধিকেও সমন্বিত করেছিলেন। নজরুলের ভাষা সমকালের ও সর্বকালের বাঙালির সমগ্রত্বেরও ভাষা। ‘আমার সুন্দর’ প্রবন্ধে তাঁর প্রয়োগ-বাহিত বিচিত্র সুন্দরের ব্যাপকতা দেখিয়েছিলেন। এই বিষয়টি অন্যত্র আরো বিশ্লেষেণের দাবি রাখে।
 
ফিরে আসা যাক ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়। এখানে নজরুল তার বিদ্রোহকে সঙ্গতকারণেই ‘আমি’ প্রতীকে ব্যঞ্জনাময় করেছেন এবং নিজেকে অজেয় বলে উপলব্ধি করেছেন। তাইতো ‘বিদ্রোহী’ আত্মশক্তিকে উদ্বোধিত করার লক্ষ্যে প্রথমেই কবির সরব ঘোষণা : ‘বল বীর, বল উন্নত মম শির!’
 
‘বীর’ বলার সঙ্গে সঙ্গেই আত্ম-দর্শন, আত্ম-উপলব্ধি, আত্মশক্তি, আত্মজয়, আত্ম-স্বীকৃতি, আত্মসম্মান ইত্যাকার বহুমাত্রিক আত্ম-প্রসঙ্গ বলয়িত হতে থাকে। আর তার প্রত্যাশিত অনুষঙ্গ হয়ে আসে ‘আমি’ সর্বনাম, যা এই সৃষ্টিবিশ্বের প্রতিটি প্রাণী ও অপ্রাণীর জন্যে প্রযোজ্য।
 
আসলে এই সৃষ্টিবিশ্ব অসংখ্য ‘আমি’-র যোগফল হয়ে একটি সামষ্টিক আমি। তাই ‘আমি’-র মৌলার্থ যে কোনো সচেতন সত্তা। এই সচেতনতা আমার সঙ্গে তোমার বা তার সঙ্গে আমার দূরত্ব বিলীন করে সকল ব্যক্তিসত্তাকে একটি ভারসাম্যময় সূত্রে গ্রথিত করে। সকল সচেতন শক্তিসত্তার মধ্যে ‘আমি’-র এই সর্বব্যাপী একরৈখিকতা আপাত-অদৃশ্য; যা দৃশ্যমান তা হলো এই ‘আমি’-র বহুরূপতা, যা নানা রূপকে বিভাজিত ও উদ্ভাসিত।
 
এই বিভাজন আনে একধরনের দৃশ্যমান বৈপরীত্য ও বৈচিত্র্য। এই বিভাজন ক্ষেত্রবিশেষে তৈরি করে বিশেষ দল, গোত্র বা গোষ্ঠি; যা বিভাজিত অন্য দল, গোত্র, গোষ্ঠি বা অনুরূপ কোনো সঙ্ঘ-রূপকের সঙ্গে দ্বন্দ্বে প্রবৃত্ত হয়; অর্থাৎ শুরু হয় গোষ্ঠি-দ্বন্দ্ব, গোত্র-দ্বন্দ্ব, জাতি-দ্বন্দ্ব, মানব-দ্বন্দ্ব, কিংবা প্রাণী-দ্বন্দ্ব ইত্যাদি।
 
ফলত নজরুলের ‘বিদ্রোহী’-র নির্মাণ প্রক্রিয়ায় স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বতোৎসারিত প্রকরণেই ‘আমি’ বিচিত্র রূপকে বিচিত্র অর্থ-ঐশ্বর্যে সাংঘর্ষিক ঘূর্ণিময়তায় বলয়িত হয়েছে। এখানে একটি কেন্দ্র থেকে অজস্র আমি উৎসারিত বা উৎক্ষিপ্ত হচ্ছে কেন্দ্রাতিগভাবে; কিংবা বলা যায়, অসংখ্য আমি অসংখ্য বৃত্ত-প্রান্ত থেকে ধাবিত হচ্ছে একটি কল্পিত কেন্দ্রের দিকে, কেন্দ্রাভিগ পদ্ধতিতে। অর্থাৎ একটি গ্রেনেড বা তজ্জাতীয় কোনো অগ্নিগোলক প্রচ-বেগে বিস্ফোরিত হওয়া এবং চূর্ণ-খণ্ডগুলো আবার কেন্দ্রের দিকে ফিরে আসার মতো এক অভাবনীয় ব্যাপার।
 
নজরুল যে তার ১৩৯-পঙক্তির এই কবিতায় প্রায় ততবার ‘আমি’ বা সমগোত্রীয় সর্বনাম ব্যবহার করেছেন, এই ব্যবহার কিন্তু এখানেই থেমে নেই, কিংবা শেষ পঙক্তিতে এসেও থেমে নেই এর পঙক্তি-সংখ্যা; কেননা সম্প্রসারণশীল, বিবর্তনশীল ও সংঘর্ষশীল এই কাব্যভাষ্য মূলত প্রান্তমুক্ত; কতকটা সম্প্রসারণশীল এই বিশ্বপ্রকৃতির মতো, যার শুরুও নেই শেষও নেই।
বিশ্বপ্রকৃতি বা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রসঙ্গ যৌক্তিক এ কারণেই যে নজরুল এই কবিতার প্রথম স্তবকেই প্রসঙ্গত উত্থাপন করেছেন মহাবিশ্ব, মহাকাশ, চন্দ্রসূর্যগ্রহতারা, ভূলোক দ্যুলোক, খোদার আসন, বিশ্ববিধাত্রী, চির-বিস্ময়, রাজটীকা, রুদ্র ভগবান আর দীপ্ত জয়শ্রীর কথা।
বক্তব্যের অন্তবর্য়িত অনুক্রম অনুযায়ী কবিতাটিকে মোট দশটি স্তবকে ভাগ করা যায়। প্রথম স্তবকে ‘আমি’-র শক্তিময়তার পাশাপাশি বিজয়ের প্রত্যয় নিনাদিত, আর এই বিজয়ের জন্যে প্রয়োজন আঘাতকারীর ‘আমি’-র ধ্বংসাত্মক রূপ, যা কবিতাটির ১১ থেকে ২৭ পঙক্তি পর্যন্ত ঘূর্ণিত : ‘আমি ঝঞ্ঝা, আমি ঘূর্ণি/ আমি পথ সম্মুখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’। শক্তির উদ্বোধন ও সংহারচিত্রের পরই হঠাৎ শুরু হলো মিলনের নৃত্য-পাগল ছন্দ। ২৮ থেকে ৩৭ পঙক্তি পর্যন্ত আমি এমন এক মুক্ত জীবনান্দ, যে শত্রুর সাথে গলাগলি করে, আবার মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে।
 

কিন্তু মিলনের এই আকাঙ্খার পর পরবর্তী দুই পঙক্তিতে ‘আমি’ আবার মহামারী, ভীতি, শাসন-ত্রাসন ও সংহার রূপকে আবির্ভূত। তারপর ৪২ থেকে ৫১ সংখ্যক পঙক্তিতে আবার আছে উদ্দাম ইতিবাচকতা, হোমশিখা, উপাসনা, নিশাবসানের আকাক্সক্ষা। আর এই অংশের ৪৯তম পঙক্তিতেই আছে সেই জাদুকরী সরল স্বীকারোক্তি : ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি, আর হাতে রণতূর্য’। পড়তে পড়তে হঠাৎ মনে হয় কবিতাটি তো এখানেও শেষ হতো পারতো। কেননা সৃষ্টি-ধ্বংস-সৃষ্টির যে দ্বান্দ্বিক স্বতঃশ্চলতার প্রক্রিয়া এই কবিতায় বলয়িত, তার একটি পর্যায় এখানে এসে পূর্ণতা পেয়েছে। এ পর্যন্ত ‘আমি’ মূলত বিশ্বপ্রকৃতির বিভাজিত ও সংঘর্ষশীল চূর্ণ-চিত্র হিসেবে আবির্ভূত।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com
বাঁ দিক থেকে নলিনীকান্ত সরকার, উমাপদ ভট্টাচার্য ও নজরুল ইসলাম।

 
৫৩ থেকে ৮৬ পর্যন্ত পঙক্তিতে এসেছে নানা ব্যক্তিপ্রতীক, বিচিত্র পুরাণ-প্রতীক, মানবসভ্যতার আদি থেকে বর্তমান পর্যন্ত নানা প্রসঙ্গের বিরোধাত্মক অগ্রগমন। কবিতাটির সম্পাদিত ভাষ্যের সর্বশেষ পঙক্তি (১৩৯তম) পর্যন্ত মোটামুটি এই দ্বান্দ্বিকতাই অব্যাহত। তবে এর ভিতরেই আছে আত্মশনাক্তির নির্ণায়ক পঙক্তি : ‘আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ’ (৮৬তম) কিংবা ‘আমি উত্থান, আমি পতন, আমি অচেতন চিতে চেতন / আমি বিশ্ব-তোরণে বৈজয়ন্তী, আমি অচেতন-চিতে চেতন।’ (৮৭-৮৮তম) এখানে এসে কবিতাটি দ্বিতীয়বার সমাপ্তির পর্যায়ে উপনীত হয়েছিলো বলে মনে হয়। কেননা এই দুই পঙক্তিতে অচেতন ও চেতন প্রসঙ্গের পাশাপাশি মানব-বিজয়-কেতনের মাধ্যমে মানব-‘আমি’র জয় বিঘোষিত। পরের ৫১ পঙক্তিতে (৮৯-১৩৯) ‘আমি’র পৌণপুনিক আবির্ভাবের পাশাপাশি যে নতুন প্রসঙ্গটি উত্থাপিত সেটি হলো : স্থিতি। সেই স্থিতি আসবে সকল সংঘর্ষের পর, অত্যাচারীর খড়্গ-কৃপাণ থেমে যাবার পর, যা একটি আশাবাদ মাত্র। বাস্তব বিশ্বে যে নিত্যনতুন আধিপত্য, অত্যাচার, নিপীড়ন, সংঘর্ষ কেবল বাড়ছেই – সেটি এই মানববিশ্বে যেমন, তেমনি মহাবিশ্বের বস্তুতে-বস্তুতে বা বস্তুতে-অবস্তুতে বা অন্যবিধ রূপান্তরপ্রবণ সত্তায়-সত্তায়। কাজেই বিদ্রোহীর শান্ত হওয়ার যে স্থিতি-সম্ভাবনা, তা সুদূরপরাহত। তাই এই দ্রুতরেখ পাঠে আপাত-ইতি টেনে বলা যায়, এই অনিকেত পাঠের মতো বিদ্রোহীর অন্তর্কাঠামোও আরো বহুবিধ ইঙ্গিতপ্রবণ।
 
আসলে এই কবিতায় নজরুল তাঁর অধীত ও জ্ঞানগম্য তাবৎ অলঙ্কার প্রয়োগ করেন। মূল চরিত্রটির প্রতীক ‘শিব’, আর তাঁকে কেন্দ্র করেই বলয়িত হচ্ছে কবিতাটির সৃষ্টিবিশ্ব। এই কেন্দ্রীয় চিত্রকল্প ছাড়াও এতে আছে অজস্র যৌগিক শব্দগুচ্ছ, তৎসম-তদ্ভব-দেশি শব্দের পাশে আরবি-ফারসি-গ্রিক ইত্যাদি বিদেশি শব্দের সুসমঞ্জস প্রয়োগ, বৃত্তানুপ্রাস, অন্ত্যমিল, মধ্যমিল, আবৃত্ত পদ, অনুপ্রাসায়ন, রূপকায়ন, প্রতীকায়ন, পুরাণ প্রয়োগ (হিন্দু, মুসলিম, গ্রিক, সিমেটিক), ঘূর্ণিচিত্র, লোকশ্রুতি, কিংবদন্তী — সর্বোপরি স্বরমাত্রিক ছন্দের স্বতঃস্ফূর্ত ও কুশলী প্রয়োগ।
 

উপরন্তু, কবি এক্ষেত্রে বিষয় আর শৈলীর অন্তর্বয়নের পদ্ধতিও অবলম্বন করেছেন। তিনি নানাব্যঞ্জনায় কেবল আমি সর্বনামটিই ব্যবহার করেছেন শতাধিক বার। এই ‘আমি’-র একাধিক ব্যবহার ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতার চরণবিন্যাসের কথা মনে করায়। একইভাবে শব্দ ও বিষয়ের দূরান্বয়ী সম্পর্কের কারণে এই কবিতার প্রেরণা-স্থল হিসেবে কেউ কেউ মোহিতলালের ‘আমি’ কথিকা, আবার সেই সূত্রে ক্ষেত্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অভয়ের কথা’ কিংবা ‘বেদান্তাশ্রিত তত্ত্ব’-এর কথাও স্মরণ করে থাকেন। আবার কেউ কেউ এই কবিতায় ওয়াল্ট হুইটম্যানের ‘সং অব মাইসেল্ফ’-এর অনুরণনও লক্ষ্য করেছেন। আধুনিক কালের প্রায় সব রচনাই এই ধরনের ইন্টারটেক্সুয়ালিটি তথা অন্তর্ভাষ্যের ফসল, যা মূলত শিল্পস্রষ্টার চেতন-অবচেতন ও অচেতন স্তরে ক্রিয়াশীল। এই ধরনের নানামাত্রিক পরিগ্রহণজাত সফল সৃষ্টি অবশ্যই মৌলিক সৃষ্টি। তাই বহুরৈখিক পরোক্ষ-প্রত্যক্ষ গ্রহণ-বর্জন-পরিশীলনের মধ্য দিয়েই নতুন ও মৌলিক সৃষ্টি হয়ে উঠেছে এই বিদ্রোহী। এই তর্ক কালে কালে আরো শাণিত, আরো প্রাণিত, দলিলীকৃত ও মননগ্রাহ্য হবে, সন্দেহ নেই।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


 
‘বিদ্রোহী’-তে উচ্চারিত বিদ্রোহের পাশাপাশি তার শব্দ-সঙ্গীত-চিত্র-ব্যঞ্জনায় যে নানাতলীয় মুক্তির ইশারা অন্তর্বয়িত, তার একটি অসম্পূর্ণ তালিকায়নও করা যেতে পারে। এই তালিকায়নের কেন্দ্রীয় বাণী ‘মুক্তি’। আর এর বিভিন্ন সনাক্তযোগ্য পরিপ্রেক্ষিত হচ্ছে : ভাষিক মুক্তি, ছান্দিক মুক্তি, সাঙ্গীতিক মুক্তি, আলঙ্কারিক মুক্তি, প্রাকরণিক মুক্তি, নান্দনিক মুক্তি, ব্যক্তিক মুক্তি, জাতীয় মুক্তি, আর সবশেষে সর্বমানবিক মুক্তি ইত্যাদি। পরম্পরাময় ওক্সিমোরন বা বিরোধাভাস, অতিকথন, সম্প্রসারণশীল চিত্রকল্প, কনসীট, উৎপ্রেক্ষা, প্রতীকময়তা, যৌগিক শব্দবন্ধ, তর্কাকুল বর্ণনাবৈভব, সম্বোধন ও স্বীকারোক্তিমূলক বহুময়তায় প্রকীর্ণ এই কবিতাভাষ্য অবশ্যই বিশ্বভাষার এক স্ফিংকস-সদৃশ রহস্যময়তা, যা মহাকালের সমান বয়সী। প্রায় শতবর্ষী এই সৃষ্টিভাষ্যের রহস্যভেদের দায় মূলত আমাদেরই, আমরা যারা নৈর্ব্যক্তিক ও নান্দনিক বোদ্ধা হওয়ার দাবিদার।
 
পরিশেষে নিবেদন করি, আমরা যারা বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে বাঙালির জাতিরাষ্ট্রিক বিজয় দেখেছি, তাদের চোখে স্বদেশে ও স্বকালে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’র মূর্তিমান প্রতিকৃতির নাম ৭ই মার্চের ভাষণদানরত হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, যিনি ঊর্ধলোকে তর্জনী উঁচিয়ে সামষ্টিক বাঙালির স্বাধীনতা ঘোষণার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী ব্যক্তিমানুষের প্রান্তমুক্ত বিদ্রোহী সত্তার বাস্তব অভিব্যক্তিকেই মূর্ত করে তুলেছেন। ব্যক্তিবাঙালি আর সর্বকালের সর্বপ্রান্তের ব্যক্তিমানুষের শক্তিমত্তার এই জয়গান মূলত প্রাকৃতিক-অপ্রাকৃতিক তাবৎ প্রতিকূলতাজয়ী মানবিক শক্তিরই অনিবার্য স্বীকৃতি। সভ্যতার ইতিবাচক অগ্রগমণের প্রয়োজনে যুগে যুগে এই মূর্ত প্রতীক বার বার ভিন্ন ভিন্ন অভিব্যক্তিতে আবির্ভুত হতে পারে। বিশ্বব্যাপী ‘বিদ্রোহী’র এই মঙ্গলশক্তির জয় হোক।
 
তারই পাশাপাশি আমরা আরো বলবো, ‘বিদ্রোহী’ কবিতার নান্দনিক পুনর্জন্মের কথা। আমাদের ব্যক্তিগত পাঠ-অভিজ্ঞতা হচ্ছে, এই কবিতা যতবার পাঠ করি ততবার তার চঞ্চল শব্দ-চিত্র-সঙ্গীত আমাকে নতুন নতুন ইশারা দেয়, অর্থ ও বাণীর ক্ষেত্রে ভিন্নতর অলটারনেটিভ বা বিকল্পের ক্ষেত্র উন্মোচিত করে। এখানে নজরুল কি লিখেছেন, কি বলেছেন তা বড় কথা থাকে না, কিংবা এই ভাষ্যটি সীমিত থাকে না নজরুলের প্রার্থিত বক্তব্যে বা প্রকরণেও। বরং নজরুল তথা এই কবিতার স্রষ্টা কবিতাটির সঙ্গে বিযুক্ত হয়ে পড়েন। সচেতন ও অনুসন্ধিৎসু পাঠকই তখন এই কবিতার নতুন দ্যোতনা-স্রষ্টার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। এটি ‘বিদ্রোহী’ কবিতাভাষ্যের এমন একটি স্রষ্টা-নিরপেক্ষ স্বয়ংক্রিয় শক্তি, যা প্রতিটি চেতনাজাগর পাঠে কবিতাটির নতুন নান্দনিক জন্ম দেয়। ‘বিদ্রোহী’র এই নান্দনিক পুনর্জন্মই কবিতা হিসেবে এর শেষ্ঠত্বেরও সুগ্রাহ্য মাপকাঠি। জয় হোক নজরুলের এই নবায়নপ্রবণ নান্দনিকতারও।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত