| 29 মার্চ 2024
Categories
প্রযুক্তি ও বিস্ময়

২৫ বছর বয়সে নোবেল বিজয়

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

আজ এমন একজন তরুনের গল্প বলবো যিনি ১৬ বছর বয়সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, আর মাত্র তিন বছরের মাথায় পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ও গণিতের মতো মৌলিক বিজ্ঞানের তিনটি শাখায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেছেন। এরপর তিনি একের পর এক বিস্ময় উপহার দিয়েছেন। যেমন,কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে ভর্তি হলেন তিনি, প্রথম দুই বছর গণিত অধ্যয়ন করার পর তৃতীয় বছরে বিষয় পরিবর্তন করে পদার্থবিজ্ঞান পড়তে শুরু করলেন, আর অনার্সসহ আবার স্নাতক ডিগ্রি পেলেন। তাঁর বয়স তখন ২২। বিস্ময়ের সেখানেই শেষ নয়, তার পরের বছর অর্থাৎ ২৩ বছর বয়সে তিনি আবিষ্কার করলেন এমন একটি সূত্র, যা তাঁর নামের সঙ্গে জুড়ে রইল তাঁর মৃত্যুর পরও আজ অবধি। সেখানেই শেষ হলো না। মাত্র ২৫ বছর বয়সে ১৯১৫ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার জয় করলেন তিনি। যারা খোঁজখবর রাখেন তারা নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন তাঁর পরিচয়! হ্যাঁ, তিনি উইলিয়াম লরেন্স ব্র্যাগ।

কিন্তু যার কথা বলছি, তাঁর ক্ষেত্রে কিছুতেই অবাক হলে চলবে না। কারণ,  এক্স-রে ব্যবহার করে স্ফটিকের গঠন বিশ্লেষণের জন্য যৌথভাবে তাঁর বাবা উইলিয়াম হেনরি ব্র্যাগের সঙ্গে জিতে ছিলেন নোবেল পুরস্কার। ২০১৪ সালে মালালা ইউসুফজাই শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জয় করার আগ পর্যন্ত প্রায় ১০০ বছর ধরে লরেন্স ব্র্যাগই ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ নোবেল পুরস্কারজয়ী।যে কাজের জন্য এই পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি, সেটি নিয়ে কথা বলব। তবে তার আগে একটা কাকতালীয় ঘটনার কথা না বললেই নয়।


১৮৯০ সালে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেডে লরেন্সের জন্ম । সেখানেই তাঁর পূর্বপুরুষের বাস। প্রতিভাবান ছিলেন ছোটবেলা থেকেই, তাতে আর সন্দেহ কী! নইলে কি আর ১৬ বছর বয়সে অ্যাডিলেড ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার যোগ্য হয়ে ওঠেন? ঘটনা সেটা নয়। তিনি যে সূত্রটি প্রণয়ন করেছিলেন সেটি এক্স-রে প্রয়োগ করে বস্তুর গঠন, বিশেষ করে স্ফটিকের গঠন জানার একটা উপায় দেখিয়েছিলেন। সেই এক্স-রে আবিষ্কার করেছিলেন উইলহেম কোনার্ড রন্টজেন, লরেন্সের জন্মের পাঁচ বছর পর ১৮৯৫ সালে। তো, ওই বছরেই সাইকেল চালাতে গিয়ে হাত ভেঙে যায় শিশু লরেন্সের। তাঁর বাবা আরেক পদার্থবিজ্ঞানী উইলিয়াম হেনরি ব্র্যাগ, যিনি তখন ছিলেন অ্যাডিলেড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তত দিনে রন্টজেনের আবিষ্কারের কথা জেনেছেন। এক্স-রে ব্যবহার করে ভাঙা হাড়ের ছবি দেখা যাবে কি না, এ নিয়ে তাঁর একটু কৌতূহল হলো। পরীক্ষাটি তিনি নিজের ল্যাবরেটরিতে বসেই করলেন, ছেলের ভাঙা হাতের অবস্থা দেখলেন এক্স-রে ব্যবহার করে, প্রথমবারের মতো। সেটিই ছিল শল্যচিকিৎসাবিদ্যায় এক্স-রের প্রথম ব্যবহার, অস্ট্রেলিয়ার প্রথম এক্স-রে রিপোর্ট এবং এখন পর্যন্ত সেটি সযত্নে সংরক্ষণ করা আছে। তো, বড় হয়ে সেই লরেন্স তাঁর প্রথম গবেষণাটি শুরু করলেন এক্স-রের ব্যবহার নিয়েই এবং পরবর্তী সময়ে, প্রায় সারা জীবনই তিনি এক্স-রে ব্যবহার করেছেন নানা গবেষণায়।
উইলিয়াম লরেন্স ব্র্যাগের ওই কাজের একটা পটভূমি আছে, সেটা একটু বলি। এখন এক্স-রে ব্যাপারটি আমাদের কাছে যত সহজলভ্য ও পরিচিত, তখন মোটেই তা ছিল না, বলাই বাহুল্য। রন্টজেন যখন এটি আবিষ্কার করেন, তখন এর ধরন-ধারণ, প্রকৃতি-বৈশিষ্ট্য কিছুই জানা ছিল না। তিনি শুধু দেখেছিলেন, এ রশ্মিটি আলোর মতো নয়; বরং কঠিন পদার্থ ভেদ করে, এমনকি দেয়াল ভেদ করেও অন্য জায়গায় যেতে পারে। যেহেতু এর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কিছুই তাঁর জানা ছিল না, তাই এর নাম তিনি দিয়েছিলেন এক্স-রে। মানে অজানা রশ্মি আর কি! এই অজানা রশ্মির চরিত্র-বৈশিষ্ট্য নিয়ে তখন সব বিজ্ঞানীই কমবেশি দ্বিধান্বিত ছিলেন। একেকজনের একেক মত। তবে এটি যেহেতু কঠিন পদার্থ ভেদ করে যেতে পারে, তাই এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য যে খুবই কম, সেটি বুঝতে খুব বেশি সময় লাগেনি বিজ্ঞানীদের।

ব্র্যাগের উদ্ভাবিত এক্স–রে বর্ণালী–বীক্ষণযন্ত্রব্যাপারটা একটু ব্যাখ্যা করা যাক। বিদ্যুৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গরাশির যে অংশটি দৃশ্যমান রূপে আমাদের কাছে পরিচিত, সেটিকে আমরা আলো বলে জানি; সাতটি রং আছে এর, সবাই জানি। এই সাত রঙের তরঙ্গদৈর্ঘ্য সাত রকমের। বেগুনির সবচেয়ে কম, লালের সবচেয়ে বেশি। কিন্তু বেগুনির চেয়েও কম তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বা লালের চেয়ে বেশি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের কোনো রশ্মি কি নেই? হ্যাঁ, আছে তো! আমরা অন্তত দুটো নাম তো শুনেছি, অতিবেগুনি আর অবলোহিত। ওগুলো কিন্তু আমরা দেখতে পাই না। শ্রবণযোগ্য শব্দের যেমন একটা সীমা আছে (২০ থেকে ২০ হাজার হার্টজ কম্পাঙ্কের শব্দ আমরা শুনতে পাই, কমবেশি হলে শোনা যায় না), আলোর ব্যাপারটাও ওই রকম। তো, এই দৃশ্যমান আলো স্বচ্ছ কঠিন পদার্থ—যেমন কাচ—ভেদ করে যেতে পারে; কিন্তু অস্বচ্ছ কঠিন পদার্থ—যেমন কাঠ—ভেদ করতে পারে না। এর কারণ কী? কারণ হলো, এই আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য কাচের আন্তআণবিক দূরত্বের চেয়ে কম, ফলে কাচের দুই অণুর মাঝখান দিয়ে সে বেরিয়ে যেতে পারে; কিন্তু কাঠের আন্তআণবিক দূরত্বের চেয়ে বেশি, ফলে যেতে চাইলেও পারে না, বাধা পড়ে যায়।
তাহলে এক্স-রে যায় কীভাবে? এর কারণ একটাই হতে পারে, এক্স-রের তরঙ্গদৈর্ঘ্য কাঠের ভেতরকার আন্তআণবিক দূরত্বের চেয়েও কম। তার মানে হলো, কাঠ বা ইট বা সিমেন্টের ভেতরে যে অণুগুলো ঘন হয়ে শক্তভাবে বসে আছে, তাদের ভেতরে ফাঁকা জায়গা অকল্পনীয় রকমের কম। কিন্তু এক্স-রের তরঙ্গদৈর্ঘ্য এতই কম যে সেই অতিনগণ্য ফাঁক দিয়েও সেটি বেরিয়ে যেতে পারে। তা না হয় বোঝা গেল, কিন্তু আরেকটা প্রশ্ন তো ওঠেই। আলো তো বিদ্যুৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গ, এক্স-রেও যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে আলোর যেসব বৈশিষ্ট্য আছে, এই অচেনা রশ্মিরও কি সেসব থাকবে? যেমন প্রতিফলন, প্রতিসরণ, ব্যতিচার বা ইন্টারফেরেন্স, অপবর্তন বা ডিফ্র্যাকশন প্রভৃতি? হ্যাঁ, থাকার কথা।
ব্যাপারটা পরীক্ষা করতে চাইলেন কেউ কেউ। তাঁদের একজন জার্মানির বিজ্ঞানী ম্যাক্স থিওডর ফেলিক্স ফন লাওয়া। এক্স-রের অপবর্তন সম্ভব কি না, ভাবছিলেন তিনি। আলোকে যদি খুব সরু ছোট একটা ছিদ্রের ভেতর দিয়ে পাঠানো হয় এবং ছিদ্রের ওপারে যদি একটা পর্দা থাকে, তাহলে আলোটি সরলরেখায় গিয়ে সোজা ওই পর্দার ওপর পড়বে না। পড়বে ছড়িয়ে। এটাই অপবর্তন এবং এটি ঘটে আলোর তরঙ্গধর্মের জন্য। আবার এই ছড়িয়ে পড়ার কারণে আলোকতরঙ্গগুলোর মধ্যে ব্যতিচার ঘটে, মানে একে অপরের ওপর প্রতিস্থাপিত হয়, যার ফলাফল দেখা যায় পর্দার ওপর, কয়েকটি উজ্জ্বল রেখার উপস্থিতির মাধ্যমে।
.কিন্তু এক্স-রে তো সাধারণ আলো নয়, তার চরিত্র বুঝতে হলে খুব সরু কোনো ছিদ্র বানাতে হবে। ধরুন, একটা কাচের ওপর আপনি দাগ টানতে লাগলেন; এত সরু, এত সরু, এতই সরু যে…না, থাক অতটা বোঝানো যাবে না। অত সরু দাগ টানা কঠিন ব্যাপার না? তো, ফন লাওয়া ভাবলেন, এত কষ্ট করার দরকার কি? স্ফটিকের ভেতরে পরমাণুগুলো তো সুবিন্যস্তভাবে সাজানো থাকে। অর্থাৎ তাদের একটা সুনির্দিষ্ট বিন্যাস থাকে। যদি স্ফটিকের ভেতর দিয়ে এক্স-রে প্রবেশ করানো যায়, তাহলে ওই অণুগুলোর ভেতর দিয়েই তো সেটি পার হয়ে যাবে এবং যাওয়ার সময় অপবর্তন হবে। ১৯১২ সালে লাওয়া জিঙ্ক সালফাইড স্ফটিকের ভেতর দিয়ে এক্স-রে প্রবেশ করিয়ে পরীক্ষাটি করলেন এবং কাঙ্ক্ষিত ও অনুমিত ফলাফল পেলেন। অর্থাৎ, তিনি প্রমাণ করলেন যে এক্স-রে আলোর মতোই বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। আর এ কাজটির জন্যই ১৯১৪ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হলেন তিনি।
১৯১২ সালে লাওয়া যে পরীক্ষাটি করেছিলেন, সেটি নিয়ে ভাবছিলেন লরেন্স ব্র্যাগ। কীভাবে বিষয়টিকে আরও সুনির্দিষ্টভাবে প্রকাশ করা যায়, কীভাবে একটা গাণিতিক রূপ দেওয়া যায়, সেটাই ছিল তাঁর ভাবনার বিষয়। সে বছরই অর্থাৎ ১৯১২ সালেই লরেন্স পেয়ে গেলেন সমাধান; আর তা প্রকাশ করলেন তাঁর বিখ্যাত সূত্র—ব্র্যাগস ‘ল অব এক্স-রে ডিফ্র্যাকশন’ নামে। এ এমন এক সূত্র বা সমীকরণ—স্ফটিকের ভেতর দিয়ে এক্স-রে প্রবেশ করালে তা কত ডিগ্রিতে বেঁকে কোন দিক দিয়ে বেরোবে সেটি জানা যায়। আবার ওই দূরত্ব যদি জানা যায়, তাহলে অজানা তরঙ্গদৈর্ঘ্যের একটা রশ্মি পাঠিয়ে কত কোণে বেঁকে বেরিয়ে এল, সেটা পরিমাপ করে সেই অজানা দৈর্ঘ্যটি জানা যাবে। আবার কত ডিগ্রিতে বেঁকে এল, সেটি দেখে পরমাণুগুলো পরস্পর থেকে কত দূরে কোথায় অবস্থিত তা-ও জানা যাবে, যদি এক্স-রের তরঙ্গদৈর্ঘ্যটি জানা থাকে। মানে, এক সূত্রের বহুমাত্রিক ব্যবহার।

তত দিনে লরেন্সের বাবা উইলিয়াম হেনরি ব্র্যাগ এক্স-রে স্পেকট্রোমিটার আবিষ্কার করে ফেলেছেন। এই যন্ত্র দিয়ে সহজেই এক্স-রের তরঙ্গদৈর্ঘ্য মাপা যেত এবং সূত্রটি আবিষ্কার করার জন্য যে পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো লরেন্স করেছিলেন, তা এই যন্ত্র দিয়েই। আর সে জন্যই পিতা-পুত্রকে একসঙ্গে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। এই সূত্র আবিষ্কারের ফলে একটি স্ফটিকের অন্তর্গত গঠন কেমন, সেটি এর ভেতরে চোখ না রেখেও কেবল এক্স-রে বা অন্য কোনো আলোর প্রবেশ ঘটিয়ে বোঝা সম্ভব হয়ে ওঠে।

বস্তুর ভেতরকার রহস্যময় এ জগৎটি বুঝতে ও জানতে ব্র্যাগের ওই সূত্র ১০০ বছর ধরে আমাদের সহায়তা করে আসছে। আর এটি তিনি আবিষ্কার করেছিলেন খুবই তরুণ বয়সে। মাত্র ২৩ বছর বয়সে। নোবেল পুরস্কারও তিনি জয় করেছিলেন খুবই তরুণ বয়সে। আর প্রায় ১০০ বছর ধরে তিনিই ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ নোবেলজয়ী।

এরপর উইলিয়াম লরেন্স ব্র্যাগ আরও অনেক কাজ করেছেন। পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র ব্যবহার করে জীববিজ্ঞানের গবেষণার কাজ শুরু করেছিলেন তিনিই। ডিএনএ আবিষ্কারের জন্য যে দলটি একসঙ্গে কাজ করেছিল, তিনি ছিলেন তার অন্যতম সদস্য। তবে এসব কাজ আরও পরের ঘটনা। আজ আমরা শুধু তাঁর তরুণ বয়সের বিস্ময়কর আবিষ্কার নিয়ে কথা বলতে চেয়েছি; সে কারণে সেসব নিয়ে আর কথা বাড়ালাম না।

এই প্রতিভাবান বিজ্ঞানী ছিলেন সাহিত্য আর চিত্রকলারও ভক্ত। বাগান করতেও দারুণ ভালোবাসতেন। শখ ছিল শেল, ডিম ইত্যাদি সংগ্রহ করা। ৫০০ ধরনের শেল তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহে ছিল। আবিষ্কার করেছিলেন ক্যাটলফিশের এক নতুন প্রজাতি; তাঁর নামেই যার নাম রাখা হয় সেপিয়া ব্র্যাগি—এসব আরও কত কী! প্রতিভাবানদের যে কত রকমের খেয়াল, তার কি কোনো হিসেব থাকে!

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত