গীতরঙ্গ: আসামের বিহু । অরুনাংশু চট্টোপাধ্যায়

Reading Time: 3 minutes

গুয়াহাটি এয়ারপোর্টটা কলকাতার তুলনায় খুবই ছিমছাম। ততটা ব্যস্ত নয়। কিন্তু পুরোদস্তুর ঝক ঝকে চকচকে। দেখে মনে হবেই হ্যাঁ এটা একটা ইন্টারন্যাশানাল বিমান আড্ডাই বটে। বিমানবন্দরের পোশাকি নাম ‘লোকপ্রিয় গোপীনাথ বারদোলি’।

এখনকার আবহাওয়া এখন বেশ মনোরম। মানে আমি আশ্বিন মাসের কথা বলছি। কলকাতায় এখন শারদীয়ার রেশ চলছে। টান টান উত্তেজনা। আমাদের তথা গোটা বাঙালির শ্রেষ্ঠ ও প্রধান উৎসব শারদোৎসব পশ্চিমবঙ্গের প্রধান মিলনোৎসব দুর্গোৎসব বললেও বেশি বলা হবে না। যাই হোক শারদোৎসব নিয়ে নতুন করে বলার বা জানাবার বিশেষ কিছু নেই। তাই আমি এখন আসামের প্রধান ও শ্রেষ্ঠ উৎসব ‘বিহু’র কথা বলব।

১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে ইয়ান্ডাবু চুক্তিতে ব্রিটিশ গভরমেন্ট ভারতের অন্তর্ভুক্ত করেন এই রাজ্যকে। তার আগে এখানকার নাম ছিল কামরূপ। অহোম রাজাদের সাম্রাজ্য ছিল। তাদের রাজত্বকালে কামাখ্যা মন্দির স্থাপিত হয়। তাও আনুমানিক ১২২৮ সালে। সতীর দেহত্যাগের কাহিনী কারো নিশ্চয় অজানা নয়। সেই পৌরাণিক কথাও এই কামাখ্যা মন্দিরকে ঘিরে রয়েছে। ৫১ পীঠের অন্যতম কামরূপ কামাখ্যা। নীলাচল পাহাড়ের মাথায় এই মন্দির অবস্থিত। অম্বাবচীর সময় দারুন উৎসব হয়। ভিড়ে জমজমাট।

আমাদের অসম যার স্থানীয় নাম অখম নামেও জানা যায়, হিমালয়ের দক্ষিণে তার অবস্থান। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভুটান ও বাংলাদেশ। প্রধান নদ ব্রহ্মপুত্র। এগুলো জানানোর বিশেষ কোনো কারণ নেই। তবে অনেক পুরনো রাজ্য হিসাবে পরিচিতি করাতে গেলে এটুকু তথ্য লাগবেই। এখানকার সবটাই একটু বেশি বনেদি ।

বিহু আসামের জাতীয় উৎসব তা আগেই বলেছি। বলা হয়নি যেটা সেটা হল বিহু সব জাতির উৎসব, কৃষি ভিত্তিক উৎসব। বিহু তিন রকম ভাবে পালন করা হয়।

১) ব’হাগ বিহু বা রঙ্গালী বিহু। ২) কাতি বিহু বা কাঙ্গালী বিহু। ৩) মাঘ বিহু বা ভোগালী বিহু।

বিহু শব্দের উৎপত্তি নিয়ে বিস্তর মতভেদ রয়েছে। কারো মতে বিষুবতের সংস্কৃত থেকে বিহু এসেছে। বৈদিক বিষুবত মানে যখন দিন রাত সমান হয়। আবার বিহু থেকে বৈ। বৈ মানে উপাসনা। হু কথার অর্থ গোরু। বাংলায় যেটা হল গোরুর উপাসনা। মানে বকলমে কৃষকদের উৎসব। বিষ্ণুপ্রসাদ রাভার মতে বিহু শব্দটা কৃষিজীবি ডিমাসা জনজাতির ভিতর বেশি করে প্রচলিত। তাঁরা দেবতা ব্রাই শিবরাই কে শস্য উৎসর্গ করেন। বি যেখানে প্রার্থনা। শু কথার অর্থ শান্তি ও সমৃদ্ধি। সেখানে বিশু কথার অপভ্রংশ হয়ে বিহু তে এসে ঠেকতে সময় লাগেনি। আবার হু মানে অর্থদান করাও বোঝায়।

ব’হাগ বিহু বা রঙ্গালী বিহুঃ

এটাই বড় ও প্রধান বিহু, যৌবনের উৎসব। বসন্তের শুরুতে টানা সাত দিন ধরে এই উৎসব চলে। চৈত্র সংক্রান্তি থেকে বৈশাখের ছয় তারিখ অবধি। সাত দিনের আলাদা আলাদা নাম রয়েছে। একে সাত বিহুও বলে। চাষিরা ধান তৈরির জন্য জমিপ্রস্তুত করে। মহিলারা নাড়ু, পিঠে তৈরি করে।

এটা এক মস্ত রেয়াজ। প্রথম দিন গোরু পুজো হয়। তাই এটা গোরু বিহু। পরদিন মআনুহ বা মানুষ পুজো হয়। পয়লা বৈশাখে আমাদেরই মতো নতুন বছরকে নতুন পোশাকে বরণ করে নেওয়া হয়। তৃতীয় দিন দেবতার মূর্তি পুজো করা হয়। দেবতাকে স্নান করিয়ে প্রার্থনা করার রেওয়াজ। ব্রহ্মপুত্রের উত্তর পাড়ে এই অনুষ্ঠান করা হয়। এর নাম গোঁসাই বিহু। তাছাড়া বিহুর গান, নাচ আলাদা ভাবে রচনা করা হয়। বিভিন্ন জন জাতি যেমন বোড়ো, তিবা, কাছাড়ি সম্প্রদায়ের মানুষজন প্রতিভা প্রকাশের সুযোগ পায়। তাই তাদের কাছে এর গুরুত্ব অপরিসীম। তাঁরা যে বাদ্য যন্ত্র ব্যবহার করে তার মধ্যে ঢোল, পাশা, বাঁশি অন্যতম।

কাতি বিহু বা কাঙ্গালী বিহুঃ

কার্ত্তিক মাসের সংক্রান্তিতে এই বিহু উদযাপিত হয়। ঠিক তখনই আউস ধানের চাষ শেষ হয়। কৃষকদের শস্য ভাণ্ডার তখন শূন্য। ফলনশীল মাঠে তখন তুলসীগাছ রোপণ করা হয়। মেয়েরা মাটির তৈরি প্রদীপ ‘সাঁকি’ জ্বালায়। আমাদের এখানে যেমন আকাশ প্রদীপ জ্বালানো হয় পূর্ব পুরুষদের উদ্দেশ্যে। ওখানের কৃষকরাও একটা বাঁশ দণ্ড দিয়ে দীপ জ্বালায়। স্থানীয় নাম আকাশ বন্তি বা আকাশি গঙ্গা। সঙ্গে ‘রোয়া-খোয়া’ নামক মন্ত্র উচ্চারণ করা হয় তাদের বিশ্বাস পোকামাকড়ে কোনভাবেই ফসল নষ্ট করতে পারবে না। সকল অশুভ শক্তি রয়েছে পরাজিত হবে ওই মন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমে। সন্ধ্যায় গৃহপালিত পশুদের পিঠে খাওয়ানো হয়। এতে মৃতদের আত্মার শান্তি ও স্বর্গের পথ সুগম হয়।

মাঘ বিহু বা ভোগালী বিহুঃ

মাঘ মাসে এই উৎসব পালন করা হয়। ভোগালী শব্দটা ভোগ বা খাদ্য থেকে এসেছে। মূলত পৌষ সংক্রান্তির দিন থেকেই তিনদিন ধরে এই উৎসব পালন করা হয়। এটাকে অনেকে উরুকা উৎসবও বলে। যুবকরা খড় দিয়ে ‘ভেলাঘর’ কুটির তৈরি করে। রাতে ‘মেজি’ নামক আগুন জ্বালিয়ে বনফায়ারের মতো এর চারপাশ জুড়ে বিহুর গান ও নাচের আসর বসে। বাদ্যযন্ত্র বাজে। সকলে এক সঙ্গে বসে খাবার খায়। পরের দিন স্নান সেরে মূল মেজিতে আগুন দেওয়া হয়। সেই আগুন যজ্ঞের মতো পবিত্র। তারা ভীষণ মান্য করে সেই আগুনটাকে। সুপুড়ি, পিঠে ইত্যাদি আহুতি দেওয়া হয় তার মধ্যে। বিকাল বেলায় মোষের লড়াই, মোরগ লড়াই এর মাধ্যমে উৎসব শেষ হয়।

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>