শেক্সপীয়ার বলেছিলেন বটে, নামে কী-ই বা এসে যায় ! তবু “আঞ্চলিক সিনেমা”, “কমিউনিটি সিনেমা”, “গণ-সিনেমা” এসব অনেক নামই আমরা বিভিন্ন সময় ভেবেছি। শেষমেষ “যৌথ সিনেমা” (Film Collective) শব্দটিই আমাদের কাছে বেশী গ্রহণীয় মনে হয়েছে।
এখন এই “যৌথ সিনেমা” বলতে আমরা ঠিক কী বোঝাতে চাইছি ? কারণ সিনেমা তো চিরকালই ছিল এক যৌথ বিষয়। একা একা কে কবে একটা গোটা ছবি তৈরী করতে পেরেছে ?
আসলে আমরা যখন যৌথ সিনেমার কথা বলছি তখন এ অর্থে বলছি না যে সিনেমায় অনেক কলাকুশলী, অভিনেতা-অভিনেত্রী থাকে বলে কাজটা যৌথভাবে করা হয়ে থাকে। আমরা “যৌথ” শব্দটি বলছি এ অর্থে যে ছবিটার জন্যে অর্থ বা সম্পদ যৌথভাবেই সংগ্রহ ও বিনিয়োগ করা হবে এবং শ্রমটাও দিতে হবে- যৌথভাবে। আমরা সবাই জানি সৃষ্টি ব্যক্তিকেন্দ্রিক। অধিক-সন্ন্যাসীতে-গাজন-নষ্ট এ প্রবাদও মিথ্যা নয় ! একটি ছবি একজন পরিচালকই পরিচালনা করবেন। তা’ না হলে সে ছবি কোনোই শৈল্পিক পরিণতি পাবে না। সে ব্যাপারে আমরা অতঁর দর্শনেই বিশ্বাসী। সৃষ্টিটা হোক নির্মাতার একক সৃষ্টিই। কলাকুশলীরা চলচ্চিত্রকারের বক্তব্যকে তুলে ধরতে সাহায্য করবেন মাত্র। সেক্ষেত্রে তা’ হলে যৌথতার প্রশ্নটা কেন আসছে ? আসছে সৃষ্টি ব্যক্তিগত হলেও ছবিটার জন্যে অর্থ, শ্রম, মেধা ও অন্যান্য সম্পদ বিনিয়োজিত হবে যৌথভাবে। সেক্ষেত্রে কেউ বলতেই পারেন সমবায়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্র নির্মাণের বিষয়টি তো নতুন নয়। আমরা তা’ হলে নতুন কী বলছি ?
এই পর্যায়ে আমাদেরকে বাংলাদেশের বিকল্প সিনেমার জন্ম, বিকাশ ও বর্তমান পর্যায় সম্পর্কে কিছু কথা বলে নিতে হবে। তা’ না হলে আমরা ঠিক কী বলতে চাইছি সে বিষয়টি হয় তো তেমন পরিষ্কার হবে না।
বাণিজ্য পুঁজি ও তাদের দোসর কর্পোরেট মিডিয়ার বিপরীতে দাঁড়িয়ে শিল্পসম্মত ছবি তৈরীর কাজটা কোনো দেশে, কোনো যুগেই সহজ ছিল না। দেশে দেশে স্বাধীন চলচ্চিত্রনির্মাতাদের ইতিহাস আমাদের সে কথাই বলে। বাংলা- দেশের চলচ্চিত্রের জগতেও অনেক নির্মাতাই একটা আন্তরিক চেষ্টার পরেই হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন; শাকের-নিয়ামত- “সূর্য দীঘল বাড়ী”, সালাউদ্দীন জাকী- “ঘুড্ডি”, কবীর আনোয়ার- “সুপ্রভাত”। ব্যতিক্রম এক আলমগীর কবির যিনি স্রােতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে একটার পর একটা ভালো ছবি তৈরীর চেষ্টা করে গেছেন। আলমগীর কবির অবশ্য ব্যতিক্রম অনেক দিক থেকেই।
মধ্য-আশির দশকে আমরা যখন এদেশে স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবির মাধ্যমে বিকল্পধারার কাহিনীছবি নির্মাণের সূচনা করি তখন অনেকেই, এমনকী আলমগীর কবির ভাইও কিন্তু মনে করতেন যে, কেবল বড় দৈর্ঘ্যরে ছবি তৈরীর মাধ্যমেই পূর্ণদৈর্ঘ্য বাণিজ্যিক ছবির অপসংস্কৃতি ও স্থূল বাণিজ্যিকতার বিরুদ্ধে লড়াইটা করা সম্ভব। তবে সে সময় বয়সে তরুণ আমরা যেহেতু বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক চলচ্চিত্রধারার খবরাখবর রাখতাম এবং নানা সাংস্কৃতিক ও গণসংগঠনে জড়িত ছিলাম, ফলে বিকল্পভাবে স্বল্পদৈর্ঘ্যরে ছবি তৈরী করে তা’ যে জনগণকে বিকল্পভাবে দেখানোও সম্ভব এই আত্মবিশ্বাসটা আমাদের ছিল। আমরা প্রথমে স্বল্প দৈর্ঘ্যরে ছবির কথাই ভেবেছিলাম কারণ সেটা আমাদের আর্থিক সঙ্গতির মধ্যে ছিল। “হুলিয়া”-“আগামী” এসব ছবি সেই চিন্তারই ফসল।
“আগামী”-“হুলিয়া” যে কেবল এফডিসি-র মূলধারার চলচ্চিত্রের বাইরে বিকল্পভাবে তৈরী করা হয়েছিল তাই-ই নয়, দেখানোও হয়েছিল সম্পূর্ণ বিকল্পভাবে। অর্থাৎ সিনেমা হলের বাইরে। ঢাকার ক্ষেত্রে শাহবাগের পাবলিক লাইব্রেরী মিলনায়তনে, আর ঢাকার বাইরে হলে বিভিন্ন জেলা-উপজেলার ছোট ছোট অডিটোরিয়ামে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ক্লাসরুমে, এমন কী খোলা মাঠে পর্দা টাঙ্গিয়েও। এ ব্যাপারে আমাদের সহায়ক ছিল বিভিন্ন জেলার ফিল্ম সোসাইটিগুলো, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও ছাত্র-যুব সংগঠনগুলো। আমাদের নিজেদেরও ১৬ মি:মি: প্রজেকশন ইউনিট ছিল। আমাদের দর্শনটা ছিল মানুষ যদি শিল্পসম্মত ছবির কাছে নিজে না আসে, সেক্ষেত্রে শিল্পসম্মত ছবিকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। আমরা ওই পুরনো প্রবাদটির কথা জানতাম যে দুধ স্বাস্থ্যের জন্যে ভালো আর মদ ক্ষতিকর হলেও মদওয়ালা ডাটে তার দোকানে বসে থাকে আর লোকেরা দূরদূরান্ত থেকে তার দোকানে এসে মদ কিনে খায়। কিন্তু দুধ স্বাস্থ্যের জন্যে উপকারী হলেও বেচারা দুধওয়ালাকেই তার দুধের কলস কাঁধে নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে তা’ বিক্রী করতে হয় ! আমাদের ছবিগুলির ক্ষেত্রে আমরা সেটাই করেছি। “আগামী”-“হুলিয়া” বাংলাদেশের সব জেলায় এবং একশ’ ছাপ্পান্নটি উপজেলায়, এমন কী অনেক গহীন গ্রামাঞ্চলেও দেখানো হয়েছিল, যা সবচে’ সফল কোনো বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রও কখনো দেখানো হয়নি। তবে এভাবে বিকল্পভাবে কেবল “আগামী” -“হুলিয়া”-র মতো কাহিনীছবি নয়, প্রামাণ্যচিত্রও দেখানো হয়েছে এবং তাতে প্রচুর দর্শক সমাগমও হয়েছে। তারেক মাসুদ-ক্যাথেরীন মাসুদের “মুক্তির গান” প্রামাণ্যচিত্রটির প্রদর্শনীগুলির কথা স্মরণ করুন। মনে পড়ে গৌতম ঘোষ আমাদের এরকম এক প্রামাণ্যচিত্রের প্রদর্শনী দেখতে এসে দর্শকদের সুদীর্ঘ লাইন দেখে মুগ্ধ হয়ে আমাকে বলেছিলেন; “বলেন কী ! এঁরা প্রামাণ্যচিত্র দেখছেন টিকিট কেটে ! আমাদের ওখানে (মানে কলকাতায়) এটা তো ভাবাই যায় না !”
এখন এই যে “বিকল্প সিনেমা”, “বিকল্প সিনেমা” বলছি, এর সংজ্ঞাটা কী ? বৈশিষ্ট্যসমূহই বা কী ? কোন্ ছবিকে বলব বিকল্প সিনেমা ?
শিল্পের কোনো রকম সংজ্ঞা দেওয়া সব সময়ই জটিল। তবে কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্যসমূহকে তো চিহ্নিত করাই যায়।
প্রথমত: বলি এসব ছবির বিষয়বস্তু। একটা মৃতদেহ গরুর গাড়ীতে করে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে ঘুরে মৃতের স্বজনদের খোঁজা হচ্ছে- “চাকা”, কিম্বা পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ববঙ্গের এক মফস্বল শহরে একটা হিন্দু পরিবারের জীবনে কী বিপর্য্যয় নেমে এল- “চিত্রা নদীর পারে”, কোনো সিনেমার বিষয়বস্তু হিসেবে এগুলো এমন সব বিষয় মূলধারার চলচ্চিত্র যা কখনোই গ্রহণ করত না। বিষয়বস্তুগতভাবেই এসব ছবি— বিকল্প।
এরপর ধরুন ছবির নির্মাণ প্রক্রিয়া। বাংলাদেশে মূলধারার বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র মূলত: এফডিসি-তে ৩৫ মি:মি:-য়ে তৈরী হোত। সেক্ষেত্রে এফডিসি-র বাইরে ১৬ মি:মি:-য়ে ছবি তৈরীও ছিল একটা বিকল্প ধারণা। উৎপাদন শক্তিতে পরিবর্তন এনে আমরা উৎপাদন সম্পর্কেও পরিবর্তন ঘটাতে পেরেছিলাম। ৩৫ মি:মি:-য়ের পরিবর্তে ১৬ মি:মি:-য়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের ফলে আমরা নিজেরাই আমাদের নিজেদের ছবির প্রিন্টের মালিক হতে পেরেছি। পরে আমরা ১৬ মি:মি: বাদ দিয়ে ডিজিটাল মাধ্যমে ছবি তৈরী করেছি। বিকল্প সিনেমা পথটা দেখিয়েছে। বর্তমানে অনেক গড়িমসির পর, মূলধারার বাণিজ্যিক জগতও এখন, ডিজিটাল মাধ্যমেই ছবি নির্মাণ ও প্রদর্শন শুরু করেছে। তবে আমাদের কাছে ছবির ফর্মাটটি কখনোই তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এবং এখনও তাই-ই রয়েছে, ছবির- বিষয়বস্তু।
ছবির দৈর্ঘ্যও একটা নিয়ামক বিষয়। মূলধারার চলচ্চিত্র মূলত: দুই-আড়াই ঘন্টার পূর্ণদৈর্ঘ্যরে চলচ্চিত্র। মুক্তিযুদ্ধের সময় জহির রায়হান নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ্যরে “স্টপ জেনোসাইড” প্রামাণ্যচিত্রটা ছিল এক সীমান্তভাঙ্গা কাজ। স্বল্পদৈর্ঘ্যরে এই শক্তিশালী প্রামাণ্যচিত্রটিতে বিকল্পধারার সব লক্ষণই ছিল বিদ্যমান। তবে স্বল্প দৈর্ঘ্যরে কাহিনীচিত্রের ধারণাটা এদেশে আবার ছিল একটা নতুন ধারণা। আমাদের তৈরী “হুলিয়া” ছবিটার দৈর্ঘ্য ছিল আটাশ মিনিট, “আগামী”-র পঁচিশ মিনিট। পরে অবশ্য বড় দৈর্ঘ্যরে অনেক ছবিও আমরা বানিয়েছি এবং বিকল্পভাবেই সে সব ছবি দেখানো হয়েছে। আসলে আমরা কখনোই বাণিজ্যিক পুঁজির দুই ঘন্টা দৈর্ঘ্যরে বেঁধে দেওয়া সময়ের দাসত্ব করতে চাইনি। মুক্ত দৈর্ঘ্যরে অন্বেষা আজো শিল্পী হিসেবে আমাদের- স্বাধীনতার অন্বেষা। আমি যেমন আটাশ মিনিটের ছবি তৈরী করেছি- “হুলিয়া”, তেমনি তিন ঘন্টা পঁয়ত্রিশ মিনিটের সম্পূর্ণ অবাণিজ্যিক দৈর্ঘ্যরে ছবিও বানিয়েছি- “১৯৭১”। দৈর্ঘ্যরে এই যে অবাণিজ্যিক রূপ, এটাও বিকল্প বিষয়।
এছাড়া রয়েছে অর্থায়নের ক্ষেত্রটি। বিকল্প ছবিগুলি খুবই স্বল্প বাজেটে তৈরী। মূলধারার চলচ্চিত্রে সাদা ও কালো দু রকম ব্যবসায়ী পুঁজিই খাটে। ইদানীং কোনো কোনো প্রাইভেট টেলিভিশন চ্যানেল ও ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে কর্পোরেট পুঁজিও বাংলাদেশের সিনেমায় আসছে। কিন্তু বিকল্প চলচ্চিত্র প্রায় গোটাটাই নানা রকম দান-অনুদান-ঋণের দ্বারা নির্মিত। এক ধরণের অঘোষিত “ক্রাউড ফান্ডিং”। অর্থের এই ভিন্ন উৎসও একটা বিকল্প বিষয়।
মূলধারার ছবি তারকাকেন্দ্রিক। কিন্তু বিকল্প ধারার ছবিগুলিতে অভিনয় করেন মূলত: গ্রুপ থিয়েটারের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা কিম্বা সাধারণ মানুষেরা।
আসলে একটা ছবির চিত্রনাট্যের বিষয়বস্তু, শুটিংয়ের ধরণ, অভিনেতা-অভিনেত্রী, অর্থায়ন, এ সব কিছুই বিকল্প হওয়া কাম্য। কোনো কোনো ছবির সব উপাদানই ছিল বিকল্প- “চাকা”, “নদীর নাম মধুমতী” বা “চিত্রা নদীর পারে” আবার কোনো কোনো ছবির এক বা একাধিক অনুষঙ্গ হয়তো বিকল্প।
তবে বিকল্প সিনেমার সবচে’ বড় বৈশিষ্ট্যটা হচ্ছে সিনেমা হলের বাইরে বিকল্পভাবে এসব চলচ্চিত্রের প্রদর্শন। বাংলাদেশে বর্তমানে সিনেমা হলে ছবি দেখানোর ব্যাপারটা একটা রূপান্তর প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। এদেশে এক সময় নয় শ’ মতো সিনেমা হল ছিল। বর্তমানে মাত্র শ’ চারেক টিঁকে আছে। প্রায় পাঁচ শ’ সিনেমা হল- গন উইথ দি উইন্ড ! হয় সেগুলো পুরো ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে অথবা সেগুলোকে শপিং মলে পরিবর্তন করা হয়েছে। তাছাড়া দীর্ঘদিন ধরে মূলধারায় অত্যন্ত নি¤œস্তরের ছবি তৈরী হওয়াতে রুচিশীল দর্শকেরাও ইদানীং আর সিনেমা হলে তেমন যাচ্ছেন না। বিষয়টা আমরা অনেক দিন থেকেই লক্ষ্য করেছি। তাই শুরু থেকেই আমাদের চিন্তাটা ছিল সিনেমা হলকেন্দ্রিক নয়, জনগণকে আমাদের ছবিগুলো দেখাতে হবে বিভিন্ন মিলনায়তনে— বিকল্পভাবে। এর ফলে হলমালিক-পরিবেশক-প্রদর্শকদের মুনাফাগৃধœুতা ও ওদের অশুভ একচেটিয়া কর্তৃত্বের বাইরে থেকে আমরা স্বাধীনভাবেই আমাদের ছবিগুলি প্রদর্শন করতে পেরেছি। জনগণকে সিনেমা হলের বাইরে ছোটবড় বিভিন্ন মিলনায়তনে ছবি দেখানোর এই চেষ্টাটা সেই “আগামী” -“হুলিয়া”-র দিনগুলো থেকেই আমরা আজো করে চলেছি।
আমাদের ছবিগুলো নিয়মিতভাবে দেখানোর জন্যে আমরা নিজেরা একটা ছোট ফিল্ম সেন্টারও গড়েছি। কিন্তু দু:খের বিষয় যে আমার সহযোদ্ধা অনেকেই তাঁদের ছবির স্বত্ব কোনো প্রাইভেট টেলিভিশন চ্যানেলকে দিয়ে ফেলেছেন। ফলে তাঁদের ছবিগুলি জনগণকে দেখানোর ক্ষেত্রে তাঁরা আর স্বাধীন নন। এখন নিজের সৃষ্টির উপর অধিকার, প্রত্যেক শিল্পীরই এক বিশেষ শৈল্পিক অধিকার। সেই অধিকারকে হারিয়ে ফেললে, বিকল্প সিনেমার জগতে হাঁটা কষ্টকর।
পুঁজির একটা নোংরা দিক আছে। তা’ হচ্ছে, সব কিছুকেই তা’ নোংরা করে ফেলে। এখন সিনেমা বানাতে অর্থ লাগে। বেশ বড় অঙ্কের অর্থ। সে টাকাটা আসবে কোত্থেকে ? পুঁজির জগতকে তাই পুরোপুরি এড়িয়ে চলা সম্ভবও নয়। প্রয়োজন সুকৌশলী হওয়া। বুঝে বুঝে পা ফেলা। এ আসলে এক সূক্ষ্ম দড়িপথে দ্বান্দ্বিকভাবে হাঁটা। আর এ পথে সামান্য ভুল পা ফেললে হয় আপনি কর্পোরেট পুঁজির মাকড়সার জালে আটকে যাবেন অথবা অর্থাভাবে সিনেমাটাই আর বানাতে পারবেন না। আমার বড় কিছু ছবি সেভাবেই তৈরী। বিত্তবানদের অর্থ সাহায্য নিয়েছি, কিন্তু কখনোই, আমার তৈরী ছবি বিকল্পভাবে দেখানোর স্বাধীনতাটাকে বিসর্জন দিয়ে নয়।
এস্টাব্লিশমেন্ট আপনাকে দু’ভাবে ধ্বংস করতে পারে। এক, আপনার কাজের ব্যাপারে সম্পূর্ণ নীরবতা পালন করে, ইংরেজীতে যাকে বলে, kill by silence । আমাদের ছবিগুলোর অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংবাদও না ছেপে এদেশের কর্পোরেট পুঁজির মালিকানাধীন পত্র-পত্রিকা ও বৈদ্যুতিন মিডিয়া যেরকমটি করে থাকে। আবার কর্পোরেট পুঁজির, যেমন কোনো প্রাইভেট টিভি চ্যানেল বা মাল্টিন্যাশনাল ফোন কোম্পানীর খুব দূর্বল ছবিগুলোকেও, ওদের পেটোয়া মিডিয়া ব্যাপক প্রচার করে থাকে। এটা ওরা করে যাতে বিকল্পধারার নির্মাতারা এক সময় হতোদ্যম ও নিরুৎসাহী হয়ে এ পথ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়ে কর্পোরেট পুঁজির সেবাদাসে পরিণত হয়। অস্ত্রটি খুবই মারাত্মক, এই নীরবতা, যা আপনাকে বা আপনার ফিল্ম ইউনিটকে, চরমভাবে হতাশ করে ফেলতে পারে। বাংলাদেশের বর্তমান প্রাইভেট টেলিভিশন চ্যানেলগুলির সৌভাগ্য যে তাদের জন্মের প্রায় একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক বড় পুঁজির বেশ কয়েকটি মাল্টিন্যাশনাল টেলিফোন কোম্পানী এদেশে এল যাদের ব্যবসাটা হাজার হাজার কোটি টাকার। এসব ট্রান্সন্যাশনাল কোম্পানীর অনেক কিছুরই প্রয়োজন। যেমন তাদের পণ্যের প্রচারের জন্যে প্রয়োজন বিজ্ঞাপন চিত্রনির্মাতা ও তা’ প্রচারে প্রয়োজন টেলিভিশন চ্যানেলের। যেহেতু প্রচারের জন্যে তারা অনেক অনেক টাকা ব্যয় করে ফলে তাদের বিজ্ঞাপনচিত্রের লোভনীয় জগতের হাতছানিতে আমরা অনেক সম্ভাব্য চলচ্চিত্র নির্মাতাকে হারিয়েছি যারা বিকল্পধারার ছবি নির্মাণে এলে এ ধারাটি আরো শক্তিশালী হোত। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় গোটা বিশেক প্রাইভেট টিভি চ্যানেল চলছে। কিন্তু এসব টেলিভিশন চ্যানেলগুলো এতটাই স্থূল ও ফিলিস্টাইন তা’ বোঝা যায় এ থেকে যে এতগুলি চ্যানেলের একটি চ্যানেলেও চলচ্চিত্র বিষয়ক কোনো মননশীল প্রোগ্রাম আমরা দেখি না।
পুরষ্কার যদিও কোনো শিল্পের চূড়ান্ত মাপকাঠি নয়, তবুও শিল্পীর কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পুরষ্কারের একটা গুরুত্ব রয়েছে। কিন্তু এদেশে বিভিন্ন সময়েই পুরষ্কারগুলির ক্ষেত্রে নানা অনৈতিক প্রভাব খাটানো, উৎকোচ, ইত্যাদির মাধ্যমে বিকল্পধারার ছবিগুলিকে বঞ্চিত করার অপচেষ্টা আমরা দেখেছি। কর্পোরেট পুঁজি ও তাদের দোসর মিডিয়ার অশুভ হাত খুবই লম্বা ও তা’ অনেক দূর পর্যন্তই প্রসারিত। মন্ত্রণালয়, এমন কী, রাষ্ট্রীয় পুরষ্কার পর্যন্তও ! কী জাতীয় পুরষ্কার, কী অনুদান, কী বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ছবি পাঠানো, এসব ব্যাপারে কোনো কোনো বাণিজ্যিক টেলিভিশন চ্যানেলের অনৈতিক প্রভাব মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের উপরও আমরা কার্য্যকর হতে দেখেছি। আর বাংলাদেশের সরকারী আমলাদের কিনতে তো বেশী টাকা লাগে না। মোটামুটি মাঝারি আকারের একটা খাম বা বিদেশ ভ্রমণের একটা টিকিট হলেই চলে ! মনে আছে এদের চক্রান্তের কারণেই এদেশে তৈরী অন্যতম সেরা এক ছবি “মাটির ময়না”-কে জাতীয় পুরষ্কার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। ফলে এ পথে বাঁধার অন্ত নেই। বিকল্পধারার পথ তাই যেমন স্বল্পমেধার মানুষদের জন্যে নয়, তেমনি নয় স্বল্পধৈর্য্যরে মানুষদের জন্যেও। আপনার স্লায়ু হতে হবে ভালো ওপেনিং ব্যাটসম্যানের মতো, যার দিকে একটার পর একটা বাউন্সার বা ইয়র্কার ছোঁড়া হলেও যে রইবে লক্ষ্যে স্থির ও অবিচল। ক্রীজে টিঁকে থাকার কৌশলগুলি খুব ভালোভাবে আয়ত্তে আনতে হবে। তা’হলেই কেবল আপনি এক সময় উইকেটের চারধারে স্বাধীনভাবে পিটিয়ে খেলতে পারবেন।
আরেক ভাবেও এস্টাব্লিশমেন্ট আপনাকে ধ্বংস করতে পারে। তা’ হচ্ছে নানা অর্থহীন পুরষ্কার দিয়ে আপনার অহংকে সুড়সুড়ি দেয়া এবং আপনার মনে “মুই-কী-হনু-রে”-র বোধ জাগিয়ে আপনাকে এস্টাব্লিশমেন্টের পদতলে এনে ফেলা। এ ধরণের পুরষ্কারের থালায় বিষ !
বৃহৎ পুঁজি যেভাবে এদেশের সিনেমায় আসছে- বাংলাদেশের নব্যধনীদের দূর্নীতির পুঁজি, ভারতীয় মাড়োয়ারী পুঁজি, আন্তর্জাতিক বড় পুঁজি, তাতে সত্যিকার শিল্পসম্মত ছবি তৈরী ক্রমশ:ই কঠিন হয়ে পড়বে। আমরা শুধু টাকার অঙ্ক শুনব। অমুকের ছবি পাঁচ কোটি টাকার, অমুকের ছবি ছয় কোটির ! কিন্তু শিল্প তেমন দেখতে পাব না। তাছাড়া প্রতিষ্ঠিত ও ভাগ্যবান দু’একজন হয়তো কর্পোরেট পুঁজির আনুকুল্যে ছবি বানানোর সুযোগ পাবেন, অন্যেরা কী করবে ?
এই সর্বগ্রাসী পুঁজির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েই বানাতে হবে শিল্পসম্মত বিকল্প সিনেমা। আর তা’ বানাতে হবে- যৌথভাবে। অন্য পথ তেমন আর খোলা নেই। একের বোঝা দশের লাঠি ! চলচ্চিত্র যৌথতার শিল্প। যৌথভাবে কাজ করার মানসিকতাটা তাই অর্জন করতেই হবে। সে কারণেই আমরা Film Collective বা যৌথ সিনেমার কথা বলছি। বলতে পারেন, সম্পদ সংগ্রহ করলাম যৌথভাবে, কিন্তু ছবি তো তৈরী করবে একজন। অন্যদের কী হবে ? তিষ্ঠ ! আপনাদের যৌথতাবোধ যদি টিঁকে থাকে আপনার সুযোগও এক সময় আসবে।
আমাদের তরুণ বয়সেও পুঁজির বাঁধা কিছু কম ছিল না। এফডিসি-কেন্দ্রিক বাণিজ্যিক পুঁজির শক্তিশালী বাঁধা ছিল যা বাণিজ্যিক পত্র-পত্রিকা বা সরকারী আমলাদের মাধ্যমে আমাদের বিরুদ্ধে তারা মোটা দাগে ব্যবহারের চেষ্টা করত। এখন বাংলাদেশের কর্পোরেট পুঁজি আরো শক্তিশালী ও সুসংহত হয়েছে। ফলে বাঁধাগুলোও হয়েছে বেশ সূক্ষ্ম।
অনেক সময় আমাদের আন্দোলনকে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এদেশে কোনো বাণিজ্যিক থিয়েটার আগে ছিল না। ফলে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনকে কোনো শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বেড়ে উঠতে হয়নি। মঞ্চ নাটকের প্রচার ও প্রসারে তারা খোলা মাঠ পেয়েছিলেন। কিন্তু এদেশে একটা শক্তিশালী বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল। ফলে বিকল্প সিনেমাকে প্রতি পদেই অনেক বাঁধা পেরিয়ে এগোতে হয়েছে।
বাণিজ্যপুঁজির সিনেমা হচ্ছে পুঁজিঘন। কিন্তু যৌথ সিনেমা হবে শ্রমঘন। পুঁজির অভাবটা গায়ে-গতরে খেটে পোষাতে হবে। বিকল্প সিনেমার নির্মাতারা অবশ্য দীর্ঘদিন ধরেই এদেশে সেটা করে আসছেন। তাই যৌথ সিনেমা বা Film Collective -য়ের কাজকে এদেশের বিকল্প সিনেমার অভিজ্ঞতাকে ধারণ করেই গড়ে তুলতে হবে।
তবে যৌথ যে কোনো কাজেরই যেমন একটা আনন্দ রয়েছে, তেমনি কিছু ঝামেলার দিকও আছে। জন ফোর্ডকে একবার একজন জিজ্ঞেস করেছিলেন; “সিনেমা বানানোর সবচে’ আনন্দের দিক কী ?” জন ফোর্ড বলেছিলেন; “অনেকের সঙ্গে কাজ করার আনন্দ।” তারপর প্রশ্ন ছিল; “সব চেয়ে বিরক্তিকর দিক কী ?” “অনেকের সঙ্গে কাজ করতে হয় !” জন ফোর্ডের উত্তর।
যে যৌথ সিনেমার কথা বলছি, এক অর্থে তা’ কিছুটা আঞ্চলিক সিনেমাও। মানে চট্টগ্রাম বা রাজশাহীর একটি ছেলে বা মেয়েকে ছবি তৈরীতে এখন আর ঢাকায় আসতে হবে না। হাই-ডেফিনেশন ক্যামেরা এখন সর্বত্রই পাওয়া যায়। ছবিটাতে অভিনয় করবে স্থানীয় নাট্যকর্মীরা। এডিটিং প্যানেলও কোনো সমস্যা নয়। আপনার ল্যাপটপেই আপনি ছবি সম্পাদনা করতে পারবেন। ঢাকার কয়েকজন মিলে একটা সিনেমা তৈরী করতে পারলে একটা মফস্বল শহরে বসেও কয়েকজন তা’ পারবে না কেন ? তবে যৌথ সিনেমা কেবলই আঞ্চলিক সিনেমা বা কমিউনিটি সিনেমা হবে না। বিষয়টা ঠিক স্থানিক নয়। এটা একটা মানসিকতার নাম- যৌথভাবে একটা চলচ্চিত্র সৃষ্টি করার মানসিকতা।
এখন যেটা লাখ টাকার প্রশ্ন যে ছবি বানানোর খরচটা উঠবে কী করে ? এটা মনে রাখতে বিকল্প সিনেমা ঠিক আর্থিক লাভের কোনো ক্ষেত্র নয়। কোনো শিল্প সৃষ্টিই সে লক্ষ্যে করা হয় না। টাকা বানিয়ে ধনী হতে চাইলে আপনার বরং অন্য পেশায় যাওয়াই ভালো হবে। একটা ভালো ছবি তৈরী হবে মূলত: শিল্প সৃষ্টির তাড়নায়। ব্যবসায়িক কোনো বিবেচনায় নয়। তবে ছবির বাজেটটা কম রাখতে হবে। নইলে শিল্পী হিসেবে অর্থলগ্নীকারকের কাছে আপনি আপনার স্বাধীনতাটা হারাবেন এবং আপনাকে আপনার ছবিতে নানা ব্যবসায়িক উপাদান ঢোকাতে হবে। ছবির শিল্প-সম্ভাবনা ওখানেই শেষ হয়ে যাবে।
জ্যাঁ ককতো বলেছিলেন, সিনেমা সত্যিকারভাবে জনগণের শিল্প হবে যখন ক্যামেরার দাম কলমের মতো আর ফিল্মের দাম কালির দামের মতো সস্তা হবে। আজ সে সম্ভাবনাটা কিছুটা সৃষ্টি হয়েছে। ডিজিটাল সিনেমা ছবির বাজেট অনেকখানিই কমিয়ে এনেছে। আমরা হিসেব করে দেখাতে পারি, জেলা বা মফস্বল শহরে বসে আট-দশ লক্ষ টাকাতেও একটা ছবি তৈরী করা সম্ভব। অনেককেই হয়তো সেক্ষেত্রে দিতে হবে স্বেচ্ছাশ্রম। কিন্তু তারপরও এই প্রশ্ন রয়েই যায়, ওই অর্থটা তো যোগাড় করতে হবে। এখানে কোনো সহজ সমাধান নেই। দান-অনুদান-ঋণ নানা ভাবেই এ অর্থ সংগ্রহ করতে হবে। তবে লগ্নীকৃত অর্থটা পুরো ব্যক্তিগত না হওয়াই ভাল। যৌথভাবেই অর্থটা সংগ্রহ করা উত্তম। কর্পোরেট পুঁজির কাছ থেকেও আমাদের কিছু কৌশল শিখতে হবে। প্রত্যেক জেলা শহরেই কিছু ব্যবসা-বাণিজ্য আছে, বিত্তবান ব্যক্তিরা আছে, কিছু দোকান-পাট আছে। সেসব উৎস থেকেও অর্থ সংগ্রহ করতে হবে এবং ছবির গায়ে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সেসব অর্থ যোগানদাতাদের নাম লিখতে হবে। তাতে ছবির সতীত্ব মোটেই নষ্ট হবে না। কারণ একটা শিশুও জানে যে ছবি বানাতে অর্থ লাগে। এক-দেড় কোটি টাকা হয়তো এভাবে যোগাড় করা সম্ভব হবে না, তবে আট-দশ লক্ষ টাকা সম্ভব। ছবির বাজেট তাই সেই অঙ্কে নামিয়ে আনতে হবে। যৌথ সিনেমার ধারণাটা ব্যক্তি সিনেমার চেয়ে ভালো এই কারণেও যে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টাটাও তখন একটা যৌথ দায়িত্ববোধের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে, ব্যক্তির একক অসহায় প্রচেষ্টা নয়। যেহেতু সাংস্কৃতিক কাজে এদেশে ব্যাঙ্ক ঋণ বা প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পাওয়া তেমন সম্ভব নয় ফলে অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণ সংগ্রহ করতে হবে। ব্যক্তিগত পর্যায়েও। আপনার নিয়ত ঠিক থাকলে ঋণ পাওয়াটা অসম্ভব নয়। তবে ছবি তৈরীর পর সে ঋণ শোধ করতে হবে। অন্যথায় ধারাবাহিকভাবে ছবি তৈরী করে যাওয়া সম্ভব হবে না।
সিনেমা তৈরী তো একটা আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা। মূলত: অর্থের যোগানটাই হচ্ছে প্রধান ও সবচে’ বড় সংগ্রাম। আর, যে ব্যক্তি তার ছবির জন্যে কিছু অর্থ সংগ্রহ করতে পারবেন না, তিনি বিকল্পধারার চলচ্চিত্রনির্মাতাও হতে পারবেন না। কারণ সিনেমা মাধ্যমটাই ব্যয়বহুল।
তাছাড়া প্রথমেই বড় ছবি বানাতে হবে কে বলেছে ? খুবই অল্প পয়সায় স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি তৈরী করেও আপনি আপনার সৃজনশীলতা ও মেধার ছাপ রাখতে পারেন। বিন্দুতে-সিন্ধু-ধরার কাজটাও এক বড় প্রতিস্পর্ধা। আমাদের নিজেদের যাত্রাও “আগামী” -“হুলিয়া” এসব ছোট দৈর্ঘ্যরে ছবির মাধ্যমেই ঘটেছিল এবং এসব ছবি ছিল খুবই, খুবই স্বল্প বাজেটের।
তাছাড়া কেবল কাহিনীছবি কেন ? প্রামাণ্যচিত্রের মাধ্যমেও আপনি আপনার মেধা, মনন ও সৃজনশীলতার ছাপ রাখতে পারেন। ছবি তৈরীর আসল উদ্দেশ্য কী ? উদ্দেশ্য জীবনসত্যকে তুলে ধরা। তো সত্যের কাছে আপনি দু’ভাবেই পৌঁছতে পারেন। কাহিনীর মাধ্যমে, আবার প্রামাণ্যতার মাধ্যমেও। বরং প্রামাণ্যচিত্রের মাধ্যমেই আপনি সত্যের বেশী কাছাকাছি পৌঁছতে পারবেন। আর প্রামাণ্যচিত্র তৈরীতে তেমন বেশী অর্থ লাগে না। মনে রাখবেন বাংলাদেশে বিষয়ের কোনো শেষ নেই বরং প্রামাণ্যচিত্রের বিষয়ের ক্ষেত্রে এ দেশ আসলেই একটা স্বর্ণখনি বিশেষ এবং বাংলাদেশের বেশ কিছু প্রামাণ্যচিত্র ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিকভাবে সম্মানও পেয়েছে।
তবে ছবির খরচটা ওঠানোর ব্যাপারে যে লড়াই সে ব্যাপারে আমি কোনো রকম ভুল সঙ্কেত দিতে চাই না। কারণ এ সমস্যার কোনো সহজ সমাধান নেই। বরং পথটা খুবই কষ্টকর ও দীর্ঘমেয়াদী। আমাদের নিজেদেরও এ ব্যাপারে অনেক কষ্ট স্বীকার করতে হয়, এবং সর্বদা সফলও হই না। তবে যা যা করতে হবে তা’ হচ্ছে, ছবি শেষ হলে নিজ নিজ শহর এবং আশেপাশের অঞ্চলের মিলনায়তনগুলো ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রজেক্টর নিয়ে ঘুরে ঘুরে দর্শনীর বিনিময়ে জনগণকে ছবিটা দেখিয়ে টাকা তুলতে হবে, যেমনটি আমরা বিকল্প সিনেমার নির্মাতারা করে থাকি। তবে ছবি যদি ভালো না হয়, আর দর্শকেরা যদি ছবি দেখতে না আসেন, সে দোষ কিন্তু দর্শকের নয় ! আলমগীর কবির ভাই সব সময় জোর দিতেন সারা দেশে ছড়ানো ছোটখাটো মিলনায়তনগুলোর উপর। জেলা-উপজেলার এ সব মিলনায়তনকে এ ধরণের ছবি প্রদর্শনের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। উদ্যোগটা হতে হবে স্থানীয়। এবং যৌথ উদ্যোগ। শিল্পসম্মত চলচ্চিত্রের প্রসারে আমরা বিভিন্ন জেলায় কিছু ফিল্ম সোসাইটি গড়েছি- খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, বরিশাল যারা এসব শো-য়ের ব্যাপারে ভূমিকা রাখবেন। তবে বর্তমানে এসব ফিল্ম সোসাইটির কোনোটা সক্রিয় আছে কোনোটা তেমন নেই। স্থানীয় ফিল্ম সোসাইটির টিঁকে থাকা ও দক্ষতার এটা অনেকটাই নির্ভর করে স্থানীয় সংগঠকদের যোগ্যতার উপর। আমরা মনে করি আমাদের কাজ হচ্ছে- বাতি জ্বালানো। তবে আমরা এ-ও জানি, ওই যে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন “তোর সকল বাতি জ্বলবে না” ! তবে কেবল ফিল্ম সোসাইটিগুলি নয়, গ্রুপ থিয়েটারগুলি, কোনো সাংস্কৃতিক দল বা নিছক কয়েকজন তরুণ-তরুণীর দলও যৌথ সিনেমার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বিকল্পভাবে ছবি নির্মাণ ও প্রদর্শনের কাজটা করতে পারে।
তাছাড়া জেলায় জেলায় এখন ডিশ চ্যানেল চলে। স্থানীয়ভাবে বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করে এসব ডিশ চ্যানেলে ছবি দেখানো সম্ভব। এটা একটা নতুন সম্ভাবনা। বিকল্প সিনেমাকে এই সম্ভাবনাটার সুযোগ নিতে হবে। এবং ছবি ভালো হলে ঢাকার বড় কোনো প্রাইভেট টেলিভিশন চ্যানেলও আগ্রহ দেখাতে পারে। সেখান থেকেও কিছু অর্থ পাওয়া সম্ভব।
ছবির ডিভিডি বিক্রীও কিছু আয়ের সংস্থান যোগাতে পারে। এছাড়া ইন্টারনেটে ছবি বিক্রীর নানা সম্ভাবনা ইদানীং ক্রমশ: সৃষ্টি হচ্ছে। সে ব্যাপারেও বিশেষ উদ্যোগী হতে হবে। আর ছবি যদি সত্যিকারের ভালো হয়, সেক্ষেত্রে আর্ন্তজাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ও আন্তর্জাতিক বাজারও অসম্ভব কিছু নয়।
এ সব কিছু থেকেই কিছু অর্থ আয় করা সম্ভব। তবে সে আয় কখনোই খুব বড় কিছু একটা হবে না। যৌথ সিনেমা টিঁকে থাকতে পারবে কেবল, যদি জনগণ দর্শনীর বিনিময়ে আপনার ছবি দেখতে আসে। যদি ছবির বাজেট কম থাকে তা’ হলেই কেবল এভাবে ছবি দেখিয়ে ছবির পুরো খরচটা তোলা সম্ভব। স্বল্পব্যয়ে ছবি তৈরী তাই আমাদের শিখতেই হবে। কারণ পুঁজির সর্বগ্রাসী আগ্রাসনকে এড়িয়ে স্বাধীনভাবে ছবি তৈরীর ওটাই একমাত্র পথ।
তবে প্রথম কাজটা হচ্ছে ছবি তৈরীর কারিগরী প্রশিক্ষণটা ভালোভাবে শেখা। এর কোনো বিকল্প নেই। প্রদীপ জ্বালানোর আগে সলতে পাকানোর একটা দীর্ঘমেয়াদী ও ধৈর্য্যশীল পর্ব থাকে। মনে রাখতে হবে, কেউ “স্বভাব কবি” হতে পারেন, কিন্তু “স্বভাব চলচ্চিত্রকার” হওয়া যায় না। চলচ্চিত্র একটা প্রযুক্তিগত মাধ্যম এবং সে প্রযুক্তিটা আপনাকে শিখতেই হচ্ছে। সে কারণে সিনেমা ও ক্যামেরার উপর নানা কোর্স, ওয়াকর্শপ, এসব করাটা জরুরী।
কোনো ছবিকে মানুষের মনে দাগ কাটাতে চাইলে ছবির বক্তব্যটা সাহসী হতে হবে। এমন বক্তব্য থাকতে হবে যা মানুষ সরকারী বা কর্পোরেট মিডিয়ায় পায় না। ভালো হয় যদি আপনি দীর্ঘদিন সোপ-অপেরা বা টিভি নাটক দেখা থেকে বিরত থেকে দেশ-বিদেশের ধ্রুপদ ছবিসমূহ দেখেন। কারণ এসব টিভি নাটকের প্রভাবটা অবচেতনে কাজ করে যায়। তা’ থেকে বেরিয়ে সিনেমার ভাষায় সিনেমা বানানো ক্রমশ: কঠিন হয়ে পড়ে। আর সে প্রভাব এড়াতে না পারলে আপনার ছবি দেখতে নাটক-নাটক লাগবে। দর্শনীর বিনিময়ে দর্শক কেন তা’ দেখতে আসবেন যখন ঘরের আরামে বসেই বিনে পয়সায় তারা ওরকম টিভি-নাটক দেখতে পাচ্ছেন।
কোনো পণ্যের বিজ্ঞাপনচিত্রের জন্যে হয়তো ঝা চকচকে দামী ক্যামেরার প্রয়োজন পড়ে, প্রয়োজন পড়ে ক্যামেরার কাজের নানা গিমিকের, কিন্তু সত্যিকার সৃজনশীল কাজে, মানুষের জীবন নিয়ে ছবির জন্যে, যে কোনো ক্যামেরা হলেই চলে। কী ক্যামেরা দিয়ে তৈরী হয়েছিল; “পথের পাঁচালী” ? এদেশের “চাকা” বা “চিত্রা নদীর পারে” ? তাই ভালো ছবি তৈরীতে দামী ক্যামেরাই মুখ্য বিষয় নয়। ওই যে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন;“রূপে তোমায় ভোলাব না, ভালবাসায় ভোলাব !” ফলে নতুন নতুন দামী ক্যামেরার পেছনে না ছুটে বিকল্প সিনেমার পরিচালকের উচিৎ হবে তার ছবিকে আরো মানবিক ও শিল্পিত করা।
আসলে সেই ক্যামেরার কাজই ভালো ক্যামেরার কাজ যা ছবির কাহিনীকে, বা আপনার বক্তব্যটাকে, সঠিক চিত্রকল্পের মাধ্যমে সবচে’ নান্দনিকভাবে তুলে ধরতে পারে। এক্ষেত্রে ক্যামেরার দাম বা মান তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় নয়। বরং ক্যামেরার কাজের অতিরিক্ত দেখানেপনা সৃজনশীলতাহীন ও দূর্বল শিল্পীরই কাজ। আর এখন তো আপনি আপনার মোবাইল ফোনেই ছবি শুট্ করতে পারেন ! আর ছবির সম্পাদনা ? নানা রকম সফ্টওয়ারই বর্তমানে বাজারে মেলে। সেসব দিয়ে আপনার শুটিংকৃত মেটেরিয়াল নিয়ে এডিটিং টেবিলে বা আপনার ল্যাপটপে বসে আপনি অনেক রকম কায়দা-কানুনই করতে পারেন। হলিউডের অতিরিক্ত স্পেশাল-এফেক্ট আকীর্ণ ছবিগুলিতে যা আমরা এখন হামেশাই দেখছি। তবে ছবি কেবল স্পেশাল-এফেক্টের হলে চলচ্চিত্রনির্মাতা হিসেবে আপনার কৃতিত্বটা আর রইল কোথায় ? কৃতিত্ব তো সেই সফ্টওয়ার আবিষ্কর্তার। ফলে ওই পথে বেশী না হেঁটে আপনার ছবিকে হতে হবে মৌলিকভাবে সৃজনশীল। হতে হবে বিচিত্র মানবচরিত্র ও আমাদের দেশের বৈচিত্র্যময় মানবজীবনের নানা ঘটনা ও অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। মানুষই হতে হবে সিনেমার মূল আধেয়, ক্যামেরার গিমিক বা কোনো এডিটিং সফ্টওয়ারের চমক নয়। আর মনে রাখতে হবে যে প্রথম ছবিতেই আপনি একটা “পথের পাঁচালী” বানিয়ে ফেলতে পারবেন না। প্রথম ছবি অনেকটাই হবে হাত মক্সের ছবি। তেমন সফল না-ও হতে পারেন। তবে তাতে হতাশ হলে চলবে না।
আমরা বুঝি, নিজেরা অর্থ সংগ্রহ করে যৌথভাবে একটা ছবি তৈরীর কাজ সহজ নয় মোটেই। তাছাড়া বাঙ্গালীরা যৌথভাবে কাজ করতে পারে না এমন দূর্নাম রয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন, বাঙ্গালী যখন একা লড়ে তখন দশজনের মতো লড়ে আর যখন দশজনে মিলে লড়ে তখন একজনের মতোও লড়তে পারে না ! আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিতে কোথায় যেন যৌথতাবোধের একটা অভাব রয়েছে। যৌথ সিনেমার জন্যে সেটাও এক প্রতিস্পর্ধা। সে প্রতিস্পর্ধায় উৎরাতে প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট দর্শন, অনুপ্রেরণাদায়ী নেতৃত্ব ও দায়বদ্ধ কর্মস্পৃহা। তা’ হলেই কেবল সফল হওয়া যাবে। আমার নিজের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি পঁচিশ বছর ধরে আমরা প্রায় একই ফিল্ম ইউনিট নিয়ে কাজ করে এসেছি। আমাদের কোনো অসুবিধা হয়নি।
আসলে ব্রত হতে হবে কঠিনেরে বাসিলাম ভাল। সে কভু করে না বঞ্চনা। কেউ কেউ এই কঠিন কাজগুলো আসলে করতে চান না। এবং কাজটা না করার একটা-না-একটা হ্যামলেটীয় অজুহাত অবচেতন মনে ঠিকই খুঁজে নেন। তবে আসল হচ্ছে— কাজটা করে ফেলা।
আর মনে রাখতে হবে, ওই যে জীবনান্দ দাশ বলেছিলেন; “সকলেই কবি নহে, কেহ কেহ কবি”। অনেকেই হয়তো বিকল্পের পথে হাঁটবে, কিন্তু ম্যারাথন দৌড়ের শেষে পৌঁছাবে কেবল তারাই যারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও অর্জুনের চোখের মতো যাদের লক্ষ্য স্থির। অন্যরা পথে ঝরে পড়বে। জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো শিল্পের জগতেও, ডারউইনের সেই সেরা-যোগ্যর-টিঁকে থাকার নিয়মটাই চলে এসেছে। আর নিয়মটা বেশ— নির্মমই !
আর অর্থের প্রশ্নে বলব; “I never promised you a rose garden”! বিকল্প সিনেমার পথ কোনো কালেই কুসুমাস্তীর্ণ কোনো পথ নয়, বরং এ রাস্তায় পথে পথেই পাথর ছড়ানো ! ওই যে রবীন্দ্রনাথের কচ বলেছিল দেবযানীকে তার এই বিদ্যা তাকে দেবে কেবলই; “দু:খ নব নব।” কয়েকজন মিলে যৌথভাবে একটা ছবি তৈরীর জন্যে অর্থ সংগ্রহ করা ও পরে ছবিটা দেখিয়ে দেখিয়ে সে অর্থ তোলা কষ্টসাধ্য, খুবই পরিশ্রমসাধ্য এক কাজ। ইদানীং আবার বিকল্প সিনেমার দর্শকও বেশ কমে গেছে। তাদেরকে আবার আমাদের প্রদর্শনীগুলোতে ফিরিয়ে আনতে হবে। এ কাজটাও সহজ নয়। তবে বিকল্প সিনেমা নিয়ে আমাদের প্রায় সিকি শতাব্দীর কাজের অভিজ্ঞতায় বলব, এসব কাজগুলি কঠিন অবশ্যই, তবে অসম্ভব নয়।
সব দেবীর মধ্যে শিল্পদেবীর খাই সবচে’ বেশী। ভক্তের কাছে সবচে’ বড় আত্মত্যাগ দাবী করে সে। আর সে আত্মত্যাগ করতে পারলেই কেবল আপনি শিল্পের অসীমতার স্বাদটা পাবেন। অন্যথায় সকলই গরল ভেল ! তাই শিল্পী হতে গেলে, এবং স্বাধীন শিল্পী হতে চাইলে তো বটেই, আপনাকে অনেক বড় বড় আত্মত্যাগের জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে। “আমাকে যে সব দিতেই হবে” এই কথাটি বিশ্বাস করতে হবে গভীরভাবে এবং সেভাবেই নিজেকে প্রস্তুত করে গড়ে তুলতে হবে। অর্থ, প্রতিষ্ঠা, পরিবার, এই সকল ক্ষেত্রেই কিছু আত্মত্যাগের জন্যে তৈরী থাকতে হবে। অর্থগৃধœু কর্পোরেট পুঁজি ও ফিলিস্টাইন কর্পোরেট মিডিয়ার রমরমার এই যুগে আপনার অনেক সাধনার, অনেক কষ্টের ছবিটার, তেমন কোনো সাফল্য আপনি হয়তো চোখে দেখতে পাবেন না। তবে সৃষ্টির আনন্দটা তো পাবেন। গীতার ওই যে উপদেশটি, “কর্মেই তোমার অধিকার, ফলে নয়,” তা’ তো সব কালে সব সৎ শিল্পীর জন্যেই প্রযোজ্য।
আসলে পাওয়া-না-পাওয়ার গেরস্থ হিসেব দিয়ে কোনো মহৎ কাজ হয় না। শিল্প সৃষ্টিই একটা বেহিসাবী কাজ। আর বিকল্প সিনেমা তো পুরোপুরিই এক ক্ষ্যাপামি- “আমাদের খেপিয়ে বেড়ায়, খেপিয়ে বেড়ায়, খেপিয়ে বেড়ায় যে !” সৃষ্টির ওই ক্ষ্যাপামিটা থাকতে হবে। তাহলেই কেবল হিসেব-নিকেষের গেরস্থ খাঁচাটা থেকে মুক্তি ঘটবে। আর ও খাঁচায় বন্দী থেকে মহৎ কোনো শিল্প সৃষ্টি সম্ভবও নয়। অন্তত: সিনেমায়। ঋত্বিক ঘটকের উদাহরণ তো বাঙ্গালীর সামনেই আছে !
তবে প্রকৃত সৃজনশীল মানুষেরা তাদের চলার পথ কিন্তু এক সময় ঠিকই খুঁজে পাবে। আর যারা সৃজনশীল নয়, তারা তত্ত্বের ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে পথে বসে পড়বে, কিম্বা অলস পন্ডিতী করে জীবনের মূল্যবান সময়গুলো নষ্ট করবে, কিন্তু সামনে এগোতে পারবে না। আর যে প্রকৃত শিল্পী, যার ভেতরে সৃষ্টির তাড়নার ক্ষেপামিটা আছে, সে ঠিকই দেখবে এক সময় তার “চলার বেগে পায়ের তলায় রাস্তা জেগেছে।” চীনাদের বর্ণমালায় “সঙ্কট” আর “সম্ভাবনা” একই শব্দ। কপোর্রেট পুঁজির আগ্রাসন আজ আমাদের সামনে এক সঙ্কট, আমাদের তাকে সম্ভাবনাতে পরিণত করতে হবে। তাই সব কিছুই দেখতে হবে— দ্বান্দ্বিকভাবে।
বিকল্প সিনেমার প্রাণভোমরাটা আমরা অনেক কষ্টে বাঁচিয়ে রেখেছি। একে এখন সারা দেশে কার্য্যকরভাবে ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন। সে লক্ষ্যে জেলায় জেলায় জাতীয় চলচ্চিত্র উৎসব গড়ে তোলার একটা চেষ্টা শুরুতে আমাদের ছিল। সে রকম এক উপলক্ষ্যেই বগুড়া থেকে ফেরার পথে যমুনা নদীতে আলমগীর কবিরের দু:খজনক মৃত্যু ! এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবার একটা ঐতিহাসিক দায় রয়ে গেছে বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরামের। কিন্তু শর্ট ফিল্ম ফোরাম ইদানীং ক্রমশ:ই একটা ফেস্টিভ্যাল-আয়োজক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে পড়ায় এ ব্যাপারে তার কার্য্যকর ভূমিকা তারা অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছে। শর্ট ফিল্ম ফোরাম আয়োজিত আন্তর্জাতিক এই চলচ্চিত্র উৎসবটি অবশ্য খুবই ইতিবাচক একটা উদ্যোগ এবং এই উৎসবটি এদেশের মানুষকে নানা ধরণের চলচ্চিত্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছে। তাছাড়া এই উৎসবের আরেকটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে এটা এক ব্যতিক্রমী চলচ্চিত্র উৎসব যেখানে চলচ্চিত্রনির্মাতারা নিজেরাই একটা চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজক। তবে চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করা ছাড়াও বিকল্প সিনেমার বিকাশে আরো অনেক কাজ আছে এবং বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরামকে তাই নতুন করে আবার বিকল্প সিনেমার প্রচার ও প্রসারে নেতৃত্বের দায়িত্বটা নিতে হবে। শর্ট ফিল্ম ফোরামের জন্ম হয়েছিল একটা প্রতিবাদী চেতনা থেকে। সেই প্রতিবাদী অবস্থানটাকে বজায় রাখতে হবে। অন্যথায় কর্পোরেট পুঁজির সর্বগ্রাসী আগ্রাসনে শর্ট ফিল্ম ফোরাম তার আদর্শগত অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হবে না। বর্তমানের কেবলই এক ফেস্টিভ্যাল-আয়োজক প্রতিষ্ঠান থেকে, শর্ট ফিল্ম ফোরামের যা আদি রূপ, তাকে সেই বিকল্প সিনেমার প্রকৃত নির্মাতা ও নির্মাণকর্মীদের সংগঠন হয়ে উঠতে হবে। ঢাকাকেন্দ্রিকতা কাটিয়ে জেলা-উপজেলায় চলচ্চিত্রিক কর্মকান্ডকে ছড়িয়ে দেবার আন্তরিক ও নানা সাংগঠনিক চেষ্টা নিতে হবে। বছরে একবার দেশের কোনো একটা জেলা শহরে জাতীয় চলচ্চিত্র উৎসব করার যে চর্চাটা আগে ছিল পুনরায় সেটা চালু করতে হবে।
সিনেমা যেহেতু যৌথতার এক শিল্প, ফলে একা নয়, যৌথভাবেই বর্তমানের এই দু:সময়টা পাড়ি দিতে হবে। কর্পোরেট পুঁজির স্থূল আগ্রাসনকে মোকাবেলা করে শিল্পসম্মত ছবি তৈরীতে এগিয়ে আসতে হবে। আর তা’ করতে হবে যৌথভাবে- Film Collective । বিকল্প সিনেমার পুরো যাত্রাটাই হচ্ছে স্রােতের বিপরীতে নৌকা বাওয়া। যৌথ সিনেমার ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটবে। সহজ কোনো পথ নেই। আর যে যৌথ সিনেমা বা Film Collective -য়ের কথা আমি বলছি সে পথের শেষটা কী তা’ আমরা এখনও পুরো জানি না। তবে জানি উদ্দেশ্য সৎ ও উদ্যোগ মহৎ হলে, পথই দেখাবে পথ। জনগণের সৃজনশীলতার উৎসমুখটাকে খুলে দিতে হবে। তা হলেই ঘটবে নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ। অসংখ্য মানুষ তখন চলচ্চিত্র নির্মাণে এগিয়ে আসবে। বর্তমান সহজলভ্য প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে যে কোনো মানুষই তখন ছবি বানাতে পারবেন। যৌথভাবে। চলচ্চিত্র তখন সত্যিকার একটা গণতান্ত্রিক শিল্প হয়ে উঠবে। জ্যাঁ ককতোর, ও আমাদের স্বপ্নও, সেদিন সফল হবে।
প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক। তিনি বাংলাদেশ ফিল্ম ইন্সটিটিউটের পরিচালক ও বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরামের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট। শিল্পকলায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ২০১৭ সালে একুশে পদকে ভূষিত করে।
সরি তানভীর
ঢাকায় শেষ গিয়েছিলাম ২০১২র ডিসেম্বরে।