| 10 ডিসেম্বর 2024
Categories
উপন্যাস পুনঃপাঠ সাহিত্য

উপন্যাস: মন্ত্র । বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় 

আনুমানিক পঠনকাল: 150 মিনিট

মানুষ যেমন ভিন্ন-ভিন্ন হয় দেশে-দেশে, আকাশে উড়ে বেড়ানো মেঘেরাও কি তাই? আর মেঘ থেকে যে বৃষ্টি নেমে আসে সেও স্থান অনুযায়ী আলাদা-আলাদা? নইলে চার-পাঁচ দিন আগে বৃষ্টিতে ঝুপ্পুস ভিজলেন, কিচ্ছু হল না, অথচ কাল দুপুরে দু’-তিন মিনিট ভিজেছেন বড়জোর, ঠান্ডা লেগে গলাব্যথা, নাক বন্ধ, এমনকী জ্বরও?

কেন এমনটা হল ভাবছিলেন উত্তরণ। ভাবার ফাঁকে নেজ়াল ড্রপটা বারদুয়েক নাকে নেওয়ার অবসরে আবারও খেয়াল করলেন, সবাই সবার সঙ্গে কথা বলার নাম করে শো-অফ করছে। এটাই কি এখানকার দস্তুর?

সোমনাথ একবার চোখের ইশারায় সব ঠিক আছে কি না জিজ্ঞেস করল, কিন্তু উত্তরণ কোনও জবাব দেওয়ার আগেই দু’টি অল্পবয়সি মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে দিল। ওর স্বাভাবিকতা দেখে কিছুটা অবাকই হলেন উত্তরণ। কাল রাতে ওই ফোনটা পেয়ে তিনি তো ধরেই নিয়েছিলেন, বানচাল হয়ে গিয়েছে সব। রাত তখন প্রায় বারোটা বাজে, জ্বরের ওষুধের পাশাপাশি একটা স্লিপিং পিলও খেয়ে ফেলেছেন বলে আস্তে-আস্তে তলিয়ে যাচ্ছেন ঘুমের দেশে, তখনই বেজে উঠেছিল ফোনটা। একবার পুরো বেজে গিয়ে যখন আবারও বাজছে, হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা কাছে নিয়ে জড়ানো গলায় উত্তরণ বলেছিলেন, “হ্যালো?”

“আপনি বাবার বন্ধু? বাবার বই উদ্বোধন করতে যাচ্ছেন? আপনি জানেন বাবা কেমন লোক? ওপাশে একটা মেয়ের গলা ফেটে পড়েছিল রাগে।

“কে বলছেন?” আধো-অচেতনেই জিজ্ঞেস করেছিলেন উত্তরণ।

“আমি তনয়া, আপনার বন্ধু সোমনাথের মেয়ে। আপনাকে এত রাতে ফোন করেছি, কারণ বাবা এই একটু আগে ঘুষি মেরে আমার আর মায়ের মুখ ফাটিয়ে দিয়েছে। এখনও রক্ত পড়ছে মায়ের। আপনাকে ঘটনাটা জানালাম। এরপর বাবার কয়েকজন কলিগ, ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর, সবাইকে জানাব।”

“সোমনাথ হঠাৎ এরকম করতে গেল কেন?” উত্তরণের ঘুম উড়ে গেল এক লহমায়।

“বাবা মদ খেয়ে এসে প্রায় রোজই বাওয়ালি করে। কিন্তু এখন তার মাত্রাটা বেড়েছে, কারণ আপনার মতো হুজ়-হু’রা বাবাকে বেলুনের মতো ফোলাচ্ছেন। সেই তোল্লাই পেয়ে লোকটা ধরাকে সরা জ্ঞান করছে। মায়ের গায়ে হাত তুলছে। আমারও। বাধা দিতে গেলে আরও হিংস্র হয়ে যাচ্ছে। আজকে তো এমন মেরেছে যে আমার একটা কানের পর্দা বোধহয় ফেটে গিয়েছে। এসবের জন্য কে রেসপনসিবল বলুন?”

উত্তরণ একটু চুপ করে থেকে বললেন, “আমার খুব খারাপ লাগছে তোমার কথা শুনে। কিন্তু তুমি আমাকে কেন অ্যাকিউজ় করছ ঠিক বুঝতে পারছি না।”

“আপনাকে বলব না তো কাকে বলব? আপনি কাল বাবার বই লঞ্চ করবেন বলে বাবা নিজেকে সেলেব্রিটি ভাবছে। আর বাড়ি ফিরে এসে আমাদের ওপর চটে যাচ্ছে, কারণ আমরা তো বাবাকে স্টার হিসেবে ট্রিট করতে পারব না, তাই না?”

“তোমার যে কানে লেগেছে তুমি সেই কানে মোবাইল চেপে কথা বলছ তো?”

“ওটা নিয়ে আপনার না ভাবলেও চলবে। কিন্তু আপনাকে যে রিকোয়েস্টটা করছি, সেটা রাখবেন। কাল আসবেন না বাবার বই লঞ্চ করতে।”

উত্তরণ কথাটা শুনে একপলক চোখ বন্ধ করতেই দেখতে পেলেন, একটা ঝলমলে কার্ডে সবার আগে ওঁর নামটা লেখা। সোমনাথের বইপ্রকাশ অনুষ্ঠানের মুখ্য আকর্ষণ যে উনিই। কথা দিয়েও সেখানে না যাওয়া অধর্ম হবে না?

উত্তরণের নীরবতার সুযোগে আরও অনেক কথা বলে গেল তনয়া। উত্তরণ তার কিছুটা শুনতে পেলেন, পেলেন না আরও বেশি। একটা সতেরো-আঠেরো বছরের মেয়ে, প্রায় অচেনা একজনকে মাঝরাতে ফোন করে, নিজের বাবার সম্বন্ধে এত কথা বলতে বাধ্য হচ্ছে কেন? কী এমন হল যে সোমনাথকে এখন প্রত্যেক দিন মদ খেয়ে বাড়ি ফিরে বউ আর মেয়েকে পেটাতে হয়?

উত্তরটা না পেলেও তনয়ার ফোনটা ছাড়ার পর অন্য একটা প্রশ্ন বড় হয়ে উঠেছিল। সোমনাথ না তনয়া, কার কথা রাখবেন উত্তরণ? না, তনয়ার কথাই রাখতে হবে। যে বাবা মেয়েকে এলোপাথাড়ি মারতে পারে, সে যতই বন্ধু হোক তাকে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়। এই কথাটা মনে আসতেই একটা দিশা পেলেন উত্তরণ। আর তারপরই সুপ্তিকে পেয়ে গেলেন নাগালে।

সকালে সামান্য দেরি হল ঘুম ভাঙতে। চশমাটা চোখে দিয়ে মোবাইল অন করতেই দেখলেন, সাতটা মিসড কল অ্যালার্ট। বোঝাই যাচ্ছিল, কে সকাল হতে না হতেই ফোন করছে, তবু নিশ্চিত হওয়ার জন্য আঙুল ছোঁয়াতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠল সোমনাথের নাম। উত্তরণ রিংব্যাক করার কোনও প্রয়োজন বোধ না করে বাথরুমে চলে গেলেন। গায়ে হালকা টেম্পারেচার থাকলেও গিজার চালিয়ে স্নান করলেন ভাল করে। স্নানের সঙ্গে-সঙ্গে গত রাতের সমস্ত স্লানিমা যেন ধুয়ে যাচ্ছিল শরীর থেকে, তার সঙ্গেই জেট ল্যাগের অবশিষ্ট ক্লান্তিটুকুও। স্নান সেরে জপে বসেছেন, তখনই আবার ফোন আসা শুরু হল। জপের মধ্যেই হাত বাড়িয়ে ভাইব্রেশনে থাকা মোবাইলটাকে বন্ধ করে আবার যথাস্থানে রাখার সময় উত্তরণের মনে হল, গতকাল এয়ারপোর্ট থেকে নতুন সিম নিয়েই ফোন করা উচিত হয়নি সোমনাথকে। যদিও সোমনাথ জানতই যে উত্তরণ আসছেন, তবু ফোনটা আজ সকালে করলেও চলত। সেক্ষেত্রে সোমনাথ খানিকটা সংযত থাকত আর গতকাল রাত্রে সোমনাথের মোবাইল থেকে নম্বর পেয়ে তনয়া উত্তরণকে ফোন করতে পারত না। আচ্ছা, তখন কোথায় ছিল সোমনাথ? কী করছিল?

সোমনাথের ভাবনা থেকে মন সরিয়ে নিজেকে জপে স্থিত করলেন উত্তরণ। জপ শেষ হওয়ার পরপরই ঘরের ফোনটা ফের বাজতে শুরু করল।

উত্তরণ ধরতেই ওপার থেকে কাঁদো-কাঁদো গলায় সোমনাথ বলে উঠল, “প্লিজ় আমাকে যেতে দে তোর ঘরে।”

উত্তরণ অনুমতি দেওয়ার মিনিটখানেকের মধ্যেই ঘরে ঢুকে পড়ল সোমনাথ। বিন্দুমাত্র ভণিতা না করে বলল, “কাল রাতে তুই যা শুনেছিস, তার পুরোটাই মিথ্যে। বরং তার উলটোটা ঘটেছে। আমায় মেরেছে মেয়ে আর মেয়ের মা। ওরা আমাকে প্রায়ই মারে।”

“কেন মারে?”

“আমি জানি না। কাল একটা ছোট্ট ব্যাপার নিয়ে ঝামেলা শুরু হয়েছিল। সেখান থেকে বিশ্রী ঘটনা ঘটে গেল। আমার ভিসিকে অবধি আমার মেয়ে ফোন করেছিল, জানিস! অথচ আসল কালপ্রিট ওরাই। এই দ্যাখ আমার চোখের নীচে কাটা দাগ। আজকে কীভাবে ক্যামেরা ফেস করব, আমি জানি না। কিন্তু তোকে আসতেই হবে।”

উত্তরণ একটু ফাঁপরে পড়ে গেলেন। মেয়ে বাবার সম্বন্ধে বলছিল, এখন আবার বাবা এসে মেয়ের সম্বন্ধে বলছে। কাকে বিশ্বাস করবেন? একটা দোলাচলের মধ্যে পড়ে চুপ করে গেলেন উত্তরণ। সোমনাথ ততক্ষণে একদম অন্য গল্প শোনাতে শুরু করে দিয়েছে, যেখানে ও নিজেই অত্যাচারিত।

উত্তরণ শুনতে-শুনতে জিজ্ঞেস করে বসলেন, “তুই আলাদা থাকি না কেন?”

সোমনাথ জবাব দিল, “আমার জীবনে তো ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই। তাই আমার একা থাকতে ভয় করে। কিন্তু তাকে অনেস্টলি বলছি, মেয়ের হাতে মার খেতে শুরু করেছি যেদিন থেকে, সেদিন থেকে আমার মনে হয়, পরদিন ভোরের সূর্য দেখলেই বা কী আর না দেখলেই বা কী?”

“এভাবে না ভেবে মেয়ের মুখোমুখি বোস। ও তো ভালই কথা বলতে পারে, কাল শুনলাম।”

“যা শুনেছিস তার দ্বারা চালিত হোস না প্লিজ়, আজ একবার আয়। নইলে লজ্জায় মাথা কাটা যাবে আমার। তুই বলবি, মাথা কি আদৌ আছে? হয়তো নেই, তবু বলছি, আমার রিকোয়েস্টটা রাখ। নইলে পাবলিকলি বেইজ্জত হয়ে গিয়ে আমাকে সুইসাইড করতে হবে।”

সোমনাথের ওই কথার পর আর না এসে উপায় ছিল না উত্তরণের। তা ছাড়া উত্তরণ নিজে যখন চরম বিপদে তখন সোমনাথ বহু দিন যোগাযোগ থাকা সত্ত্বেও যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, উত্তরণ তা ভুলে যান কেমন করে? আসার পথে চোখে ভাসছিল সোমনাথের নিজের থুতনি, চোখের তলা দেখিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা যে মার আসলে ও-ই খায়। ওর মুখের প্রত্যেকটা দাগ যেন ফুটপাথের এক-একটা দোকান, ভিতরের সব পসরা মেলে ধরেছে। মানুষ তার কষ্ট, আঘাত, একটু সহানুভূতি পাওয়ার জন্য খুলে দেখাতে চায়। চাইতেই পারে। তাতে কি দোষ আছে কিছু?

কলকাতার একটি অভিজাত ক্লাবের লনে নিজের লেখা প্রথম বইয়ের প্রকাশ উপলক্ষে এলাহি পানভোজনের আয়োজন করেছিল সোমনাথ। উত্তরণ বইয়ের আবরণ উন্মোচন করার সঙ্গে-সঙ্গেই শুরু হয়ে গেল মদের ফোয়ারা। এমনটা তো কই বিদেশে হয় না! সেখানে লোকে প্রকাশিত বইটার সম্বন্ধে জানতে আসে। কিন্তু এখানে অধিকাংশ লোক গলা ভেজাতেই এসেছে। আকণ্ঠ মদ্যপ হওয়ার ব্যবস্থা থাকলেই বইটার সম্বন্ধে উৎসাহ দেখাবে তারা, নচেৎ নয়। হয়তো সেই জন্যই অন্যদের বক্তৃতা সংক্ষেপ করিয়ে উত্তরণের হাতে তাড়াতাড়ি মাইক তুলে দিয়েছিল সোমনাথ। কিন্তু যতই প্রধান বক্তা হোন না কেন, উত্তরণ সামনের শ্রোতৃমণ্ডলীর উশখুশ খেয়াল করেছিলেন, তাই দীর্ঘায়িত করেননি নিজের বক্তব্য। প্রায় পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজ়েন্টেশনের মতো করে ছুঁয়ে গিয়েছিলেন সাম্প্রতিক ঘটনার প্রেক্ষিতে সোমনাথের লেখা বইটির বৈশিষ্ট্যগুলোকে। বলতে-বলতে নজর গিয়েছিল সোমনাথের মেয়ে তনয়ার দিকে। কৈশোর আর যৌবনের মধ্যে ভাসমান এক উচ্ছল প্রাণপ্রতিমা! কেউ আলাপ না করালেও চিনতে অসুবিধে হয়নি, কারণ সোমনাথের মুখ কেটে বসানো মেয়েটির মুখে। কালকের ঘটনার পরও ও এসেছে আজকের অনুষ্ঠানে? উত্তরণের প্রথমে অবাক লাগলেও, পরে ভালই লাগল। ঘটনাটা যেদিক থেকেই ঘটুক, যে-ই মারুক বা মেরে থাক, আজ যে সেটা অগ্রাহ্য করে তনয়া এসেছে বাবার অনুষ্ঠানে, সেটা একটা সদর্থক ঘটনা৷ নশ্বর এই জীবনে কোনও ঝগড়াই যে অবিনশ্বর নয়, তার এক জ্বলন্ত প্রমাণ। আর এসব বাদ দিলেও বাবা এবং মেয়ের মধ্যে কোনও ভুল বোঝাবুঝিই যে দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হতে পারে না, তনয়ার উপস্থিতি সেই সত্যকে তুলে ধরছিল বলে আরও ভাল লাগছিল উত্তরণের।

মঞ্চ থেকে নামার পর উত্তরণের ইচ্ছে করছিল তনয়ার সঙ্গে কথা বলতে। ওর মা, কোয়েলিও কি এসেছে? আচ্ছা, ওরা বিব্রত বোধ করবে না তো উনি ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে? এই দোটানার ভিতরেই খবরের কাগজের সাময়িকীর সেই মেয়েটি আবার ওঁর ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য সামনে এসে পীড়াপীড়ি করতে লাগল। এখানে আসার মুহূর্তে মেয়েটি যখন সামনে এসেছিল, তখন একরকম ভাগিয়েই দিয়েছিলেন উত্তরণ। মনে হয়েছিল, ওঁর ইন্টারভিউ কেন পড়বে লোকে? চতুর্দিকে যেখানে ফিল্মস্টার কিংবা খেলোয়াড়দের নিয়ে হুড়োহুড়ি, সেখানে কোনও দার্শনিকের কথা কেন শুনবে কেউ? সবাই তার কথা শুনতে চাইছে যে যেন-তেন-প্রকারেণ সফল হয়েছে। সেখানে কেউ যদি এসে বলে, সাফল্যের ধারণাটাই ভ্রান্ত, সাফল্য আসলে মেথরের বালতিতে ধরে রাখা অরেঞ্জ স্কোয়াশ বা ম্যাঙ্গো সিরাপ, লোকে মারতে যাবে না তাকে?

মেয়েটি অবশ্য কোনও অজুহাতই শুনতে রাজি ছিল না। নাছোড়বান্দার মতো ঘ্যানঘ্যান করেই যাচ্ছিল। উত্তরণ বাধ্য হয়ে ওকে একটু অপেক্ষা করতে বলে খাবার টেবিলের কাছে গেলেন। দেখলেন, গ্লাসের পর গ্লাস ফাঁকা হচ্ছে আর ভর্তি হয়ে যাচ্ছে পলকে।

এই সন্ধ্যায় এখানে জড়ো হওয়া বেশির ভাগ লোকই বোধহয় ওই হুইস্কির মধ্যে আলতো নেমে যাওয়া বরফের টুকরোর মতো। প্রথমে নিজেকে অটুট রাখলেও ধীরে-ধীরে গলে যাচ্ছে। গলে যাওয়াটাই হয়তো সময়ের ধর্ম, সমাজের ধর্ম। উত্তরণের মনে হচ্ছিল, ওঁকেও কোথাও একটা গলে গিয়ে মিশে যেতে হবে। নইলে যে যন্ত্রণা নিয়ে আমেরিকা থেকে ভারতে এসেছেন, সেই যন্ত্রণা আরও বাড়বে।

খানিকটা সেই কারণেই বারটেন্ডার যখন সোমনাথের নির্দেশে সিঙ্গল মল্টের একটা বড় পেগ বানিয়ে দিল, উত্তরণ না নিয়ে পারলেন না। এমন নয় যে এখনও ছুতমার্গ বেঁচে আছে, কিন্তু মদ ওঁর পছন্দের বিষয়ও নয় তাই বলে। ভিতরের তোলপাড় বাড়লেও সোমনাথকে তিনি ‘না’ বলে দিতেন, যদি না তনয়া ওঁকে দেখেই পিছন ফিরে কারওর সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে যেত। উত্তরণ একবার ভাবলেন, নিজে থেকে কাছে গিয়ে একটু কথা বলবেন, কিন্তু যে এড়াতে চাইছে তাকে কাছে টানার চেষ্টা অর্থহীন। যদিও বুঝতে পারছিলেন যে তনয়া হয়তো ওঁর মুখখামুখি হতে লজ্জা পাচ্ছে। পারছিলেন বলেই পিছিয়ে এলেন। কিন্ত… পিছিয়ে এলেও মনের অস্বস্তিটা কাটল না। এই মেয়েটা যে উত্তরণের পিতৃহৃদয়ের ক্ষতটা জাগিয়ে তুলেছে কাল রাতের ওই একটা ফোনে!

গলা নয়, সেই ক্ষততেই যেন সিঙ্গল মল্ট ঢাললেন উত্তরণ। খুব তাড়াতাড়ি গ্লাসটা শেষ করে, দ্বিতীয়বারের জন্য ভরিয়ে নিলেন। তারপর এগিয়ে গেলেন সেদিকে, যেখানে ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য সেই সাংবাদিক অপেক্ষা করছিল। কাছে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসতেই, মেয়েটি তৃতীয়বারের জন্য জানাল যে ওর নাম, লোপামুদ্রা।

উত্তরণ একটু তেতো গলায় বললেন, “বলুন কী জানতে চান?”

“স্যার এবার দেশে ফিরেছেন। কাজে না ছুটি কাটাতে?”

বোধহয় তাড়াতাড়ি প্রথম গ্লাসটা শেষ করেছেন বলেই উত্তরণের ভিতরে সামান্য প্রগলভতা কাজ করছিল। লোপামুদ্রার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, “কাজ ব্যাপারটা একটা আলেয়া, জানেন! কোনটা কাজ আর কোনটা অকাজ, পৃথিবীর মানুষ তা এখনও বুঝে উঠতে পারেনি। ধরুন যারা বুকে বোমা বেঁধে নিজেদের উড়িয়ে দেয় আর মরে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে অজস্র লোককে খুন করে, তাদের কাছে সেটা কিন্তু কাজ।”

“ওরা তো একটা মিথ্যা বিশ্বাসে ভর করে…” লোপামুদ্রা বলে উঠল উত্তরণের কথার মধ্যেই।

“সত্যি আর মিথ্যা বিচার করা কি এত সহজ? শঙ্করাচার্য বলেছিলেন, ‘ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা।’ এবার জগৎ যদি মিথ্যাই হয়, তা হলে এই জগতের মধ্যে যে ঈশ্বরকে দেখছি সেই ঈশ্বরও সত্য কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।”

“যথার্থ জ্ঞান না থাকলে এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে না।”

উত্তরণ হেসে ফেললেন, “যথার্থ” ব্যাপারটার সংজ্ঞা আগের পৃথিবীতে যেরকম ছিল, আজকের পৃথিবীতে সেরকম নেই। একটি ছেলের কথা বলি। সে কবিতা লিখে হামেশাই ফেসবুকে পোস্ট করত। দু’-চার ডজন লাইকও পেত। হঠাৎ একদিন সে একটি ঝকঝকে মার্সেডিজ়ে পিঠ ঠেকিয়ে ছবি তুলে পোস্ট করে। দু’-তিন ঘণ্টার মধ্যে হাজার লাইক পড়ে যায় সেই ছবিতে। তার মানে ছেলেটির পরিচিত যে লোকেরা ওর কবিতা দেখে চুপ করে থাকত, তারা ওর মার্সেডিজ়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারছে! ওই গাড়িটা যে মুহূর্তে সে কিনেছে, সেই মুহূর্ত থেকেই সে সমাজের চোখে জয়ী। আর এই ভ্রম ছেলেটির মধ্যেও সঞ্চারিত হচ্ছে, সে নিজেও নিজেকে জয়ী ভেবে নিচ্ছে। তার থেকেও সাংঘাতিক একটা ব্যাপার হতে পারে। ধরা যাক, ছেলেটি গাড়িটা কিনতেই পারেনি। সে তার বন্ধুর মার্সেডিজ়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তা হলেও কিন্তু তার মনে এই ব্যাপারটা প্রতিষ্ঠা পেয়েই যাচ্ছে, মার্সেডিজ় কিনতে পারাই সফলতা, বাকিটা ব্যর্থতা। আপনাকে কথাগুলো বললাম কারণ আমার বন্ধু সোমনাথের যে বইটির প্রকাশ উপলক্ষে আজ আপনি এখানে এসেছেন, সেটি জীবনচর্যার উপর কয়েকটি প্রবন্ধের সঙ্কলন। কিন্তু কেউ কি নিজের জীবন দিয়ে সেটার বিচার করবে? করলে ভাল; কিন্তু এখানে এসে আমার মনে হচ্ছে, খানাপিনা কীরকম হল, কোন কোন বিখ্যাত ব্যক্তি এলেন, তার উপরেই নির্ভর করছে পেজ থ্রি-তে বইটির প্রকাশ সংক্রান্ত খবর বেরোবে কি না।”

“আপনি একদম ঠিক বলেছেন স্যার, ব্যাপারটা ওরকমই। তবু তারই মধ্যে আমরা আলাদা কিছু করার চেষ্টা করছি, এটুকু দাবি করতে পারি।”

“করুন দাবি। তবে সেই দাবি মেটানোর জন্য ক’জনকে পাবেন, সেটাই কথা।”

“কোনও বাঙালি দার্শনিক আজ অবধি আপনার জায়গায় পৌঁছতে পারেননি। এই ব্যাপারটা নিয়ে যদি কিছু বলেন …”

“একটাই কথা বলব, এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। ব্রজেন্দ্রনাথ শীল বা বিমলকৃষ্ণ মতিলাল যে স্থাপত্য রচনা করেছেন, আমি তার দু’টো-একটা ইট এদিক-ওদিক করছি মাত্র। আসলে দর্শন মানে তো শুধু ‘দর্শন’ নয়, দর্শন মানে ইতিহাস, অর্থনীতি কিংবা সমস্ত মানববিদ্যার সাধ্যমতো নিবিড় পাঠ। রবীন্দ্রনাথের কথায়, ‘অসীমের নূতন সন্ধান’। সেই সন্ধান শতাব্দীর পর শতাব্দী চলতেই থাকে। খোঁজ করার মানুষগুলো কেবল পালটে যায়।”

“চিরন্তনের মধ্যে সাম্প্রতিককে আবিষ্কার করবেন বলেই কি ‘গীতা’-র উপরে কাজ শুরু করেছিলেন?”

“ছোটবেলা থেকেই ‘গীতা’ খুব জরুরি গ্রন্থ বলে মনে হত আমার, আজও হয়। মানুষ কীভাবে নিজের জীবনের মুখোমুখি হবে, ‘গীতা’য় তার একটা রূপরেখা আছে। সেটা আজ আরও বেশি প্রয়োজনীয় বলে বোধ করি।”

“বিদেশে পড়িয়ে আপনার মতো খ্যাতি খুব কম লোকই পেয়েছেন। কীভাবে দেখেন এই খ্যাতিকে?”

“পড়ানোর সঙ্গে খ্যাতির কী সম্পর্ক বলুন তো? আমার ছাত্রছাত্রীরা যখন আমার সামনে আসে, আমি তাদের কোনও নির্দেশ দিই না। বরং আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করি একটা সমন্বয়ে আসার। ছাত্র আর শিক্ষক, বোধ আর বিস্ময়, অক্ষর আর দৃষ্টির সমন্বয়। যদি আমি ন্যায়ের দিকে তাকাই, ন্যায় কিন্তু বলছে এই জগৎ যোলো প্রকার পদার্থের সমন্বয়ে গঠিত। প্রমাণ, প্রমেয়, সংশয়, প্রয়োজন, দৃষ্টান্ত, সিদ্ধান্ত, অবয়ব, তর্ক ইত্যাদি ইত্যাদি। এই ষোলোটি পদার্থের যে স্বরূপ, তাদের পারস্পরিক সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য, এদের সমন্বয়েই জাগতিক কর্মবন্ধন থেকে মুক্তিলাভ সম্ভব। শিক্ষাও তো মুক্তিরই পথ। মুক্তি কীসের থেকে? ঈর্ষা-হিংসা-ক্ষোভ-পরশ্রীকাতরতা থেকে। এবার যে মুক্তি দেবে, সে-ই আবার খ্যাতিও এনে দেবে? কখনও হয়?” উত্তরণ বড় একটা চুমুক দিলেন গ্লাসে।

মাথাটা হালকা ঝিমঝিম করছে, নেশার ঝাঁকুনি লাগছে শরীরে। উত্তরণ সামনে বসা মেয়েটির দিকে তাকালেন ভাল করে। সাংবাদিকতাই ওর কাজ, কিন্তু ওর শখ সম্ভবত নিজেকে সুন্দর করে সাজানো। বৈদেহী নিজের ইচ্ছায় বা অভ্যাসে উত্তরণকে যা-যা চিনিয়েছিল, সেইসব ক্লেনজার, ময়েশ্চারাইজ়ার, মাস্কারা, টোনার সবকিছুর একটা সাইনবোর্ড হয়ে মেয়েটি সামনে বসে আছে। কীভাবে ওর সঙ্গে কথা গুটিয়ে আনবেন ভাবতে-ভাবতে উত্তরণ বললেন, “আমাদের জীবনে দর্শন আসলে একটা বিয়োগচিহ্নের মতো। অভিজ্ঞতা থেকে যেমন আমরা প্রতিদিনের ভাবনা সঞ্চয় করি, তেমনই ভাবনা দিয়ে প্রতিদিনের অভিজ্ঞতাকে ছেঁকে নিতে হয়। কারণ আমাদের অভিজ্ঞতাগুলো সবসময় আমাদের ভাবনা অনুযায়ী ঘটে না। এবার আমার অভিজ্ঞতার বাজে অংশটুকু ছেকে যে ভাবনাটুকু আমি নিজের কাছে রাখতে চাই, যেটা নিয়ে পরের দিন আবার রাস্তায় বেরোতে পারব, সেটাই দর্শন। তাই দার্শনিকের কাজটা অনেকটা ডেন্টিস্টের মতো।”

“মানে?”

“দাঁতে পাথর হলে ডেন্টিস্ট যেমন স্কেলিং করে দেন, দার্শনিকের কাজও তেমনই। জীবনটাকে যদি আমি একটা দাঁত হিসেবে ধরি… আমাদের প্রত্যেকের জীবনে অনেক পাথর জমা হয়ে যায় নিজেদের অজান্তেই। জীবনটাকে চালিয়ে যেতে গেলে পাথরগুলো বার করে দিতে হয়। দর্শন ওই নিষ্কাশনের কাজটা করে। পাথর হটিয়ে দন্তরুচি কৌমুদীকে ফুটিয়ে তোলে।”

“কী অপূর্ব বললেন স্যার। মনে হচ্ছিল যেন গান শুনছি।”

“আমি কিন্তু গানের বিরাট কিছু সমঝদার নই। ধ্রুপদী, রবীন্দ্রসংগীত, শুনি সবই, কিন্তু যে গান সবচেয়ে ভালবাসি, তাতে খোল আর করতাল ছাড়া সঙ্গে কোনও বাজনা লাগে না। ঘোর মধ্যরাতে বা একদম ভোরে, ‘হরেকৃষ্ণ হরেকৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে-হরে, হরেরাম হরেরাম, রাম-রাম হরে-হরে…’ শুনেছেন কখনও? যে সংকীর্তনে মহাপ্রভু গৌরাঙ্গ সারা বাংলাকে মাতিয়ে দিয়েছিলেন, এ হচ্ছে সেই সংকীর্তন। যখনই শুনি গায়ে যেন সমুদ্রের বাতাস এসে লাগে।”

“কেমন করে এই ভালবাসাটা তৈরি হল?”

“তা আমি নিজেও খুব ভাল জানি না। ছোটবেলায় আমার শ্মশানে যাওয়ার অভ্যেস ছিল। যে শ্মশানের কথা বলছি, সেখানে তখনও ইলেকট্রিক চুল্লি আসেনি। একটা করে মৃতদেহ আসত আর কাঠের চিতায় তাকে শোওয়ানোর পর, জ্বলে উঠত আগুন। সেই আগুন পা থেকে মাথা পর্যন্ত গ্রাস করে নিত ধীরে-ধীরে আর-একসময় দোদোমা ফাটার মতো ফেটে যেত মাথাটা। ওই শব্দটার সামনে দাঁড়িয়ে ভীষণ আতঙ্কিত হয়ে পড়তাম। জীবনের সবকিছু এত ভঙ্গুর যে ওই একটা আওয়াজেই তার পরিসমাপ্তি? আমার একটা বিপরীত আওয়াজের, অন্য কোনও শব্দের খুব প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। সেটাই আমি সংকীর্তনের মধ্যে পেয়েছিলাম। ‘হরে’, ‘রাম’ আর ‘কৃষ্ণ,’ শব্দ ততা মোটে তিনটে। সুরও ছিল সাদামাটা। তবু তাদের মেলবন্ধনেই আমি একটা নতুন পৃথিবীকে পেতাম, যে পৃথিবীতে মৃত্যু যতটা সত্যি, মাধুর্যও ততটাই। আর মাধুর্য ছাড়া আপনি মৃত্যুর সঙ্গে লড়বেন কী দিয়ে?”

“কিন্তু মৃত্যু তো এখন আচমকা এসে পড়ে…”

“মৃত্যু সবসময়ই আচমকা আসে। মানুষ আগে আরও বেশি অসহায় ছিল। তখন প্লেগে, কলেরায়, যুদ্ধে দেশকে-দেশ উজাড় হয়ে যেত। এখন সেই অসহায়তা অনেকটা জয় করা গিয়েছে। মানুষের গড় আয়ু একশোর কাছাকাছি হতে যাচ্ছে। আমেরিকায় এমন রিসার্চ চলছে যার দৌলতে একটা তিরিশ বছরের মানুষকে পরীক্ষা করে বলে দেওয়া যাবে সত্তর বছরে তার কী রোগ হবে। চল্লিশ বছর আগে থেকে সে প্রিকশন নিতে পারছে। তাই আজকের ভয়টা মৃত্যু নিয়ে তত নয়, কারণ যা অনিবার্য তাকে যদি আমি ঠেলতে-ঠেলতে অনেকটা পিছনে নিয়ে যাই, তা হলে সে একসময় প্রার্থিতও হয়ে উঠতে পারে।”

“আজকের মূল ভয়টা কী?”

“ভয়টা হল, মানুষ তার দৈনন্দিন যাপনে হিংসার কাছে হেরে যাচ্ছে। একটা লেখা পড়ছিলাম, সাম্প্রতিক ভারতের মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকা সম্পর্কে। সেখানে গ্রামের পর গ্রামে মাওবাদীরা এসে বলে যাচ্ছে, তাদের দলে যোগ না দিলে গুলি খেয়ে মরতে হবে। তারপরই পুলিশ এসে শাসাচ্ছে যে মাওবাদীদের সম্বন্ধে খবর না পেলে তারা রাতে গ্রামবাসীদের ঘর জ্বালিয়ে দেবে। এই দ্বৈত হিংসার মাঝখানে পড়ে মানুষ ছটফট করছে। কোথাও একটা মুক্তির রাস্তা খুঁজছে। পাচ্ছে না।”

লোপামুদ্রা সাক্ষাৎকার নিয়ে চলে যাওয়ার পরও ক্লাবের লনে ঝিম মেরে কিছুক্ষণ বসে রইলেন উত্তরণ। একটু দূরেই অভিজাত নারী-পুরুষদের জটলা সামান্য হালকা হলেও, উৎসাহে ভরপুর। কিছুক্ষণ আগে সোমনাথ যাঁর সঙ্গে আলাপ করিয়েছিল, সিনেমার সেই পার্শ্বচরিত্রের অভিনেতার সঙ্গে সেলফি নেওয়ার ধুম চলছে তখনও। সোমনাথ বারদুয়েক উত্তরণের সামনে এসে, ইন্টারভিউ শেষ হলেই ওই হুল্লোড়ে গিয়ে যোগ দিতে বলেছে। তৃতীয়বার আসার আগেই উত্তরণ ওকে একটা মেসেজ পাঠিয়ে জানিয়ে দিলেন যে, তিনি এবার বেরিয়ে যাবেন। মেসেজটা খেয়াল করে সোমনাথ যখন দৌড়ে এল প্রায়, ততক্ষণে উত্তরণ ক্লাবের গেটের সামনে।

“এভাবে কাউকে না বলে-কয়ে পালিয়ে যাওয়ার মানেটা কী? তোর সঙ্গে ছবি তুলবে বলে…”।

“আমি এখানে যে কাজটা করতে এসেছিলাম, সেটা হয়ে গিয়েছে। আমাকে আর আটকে রাখিস না।” সোমনাথকে থামিয়ে দিয়ে উত্তরণ বললেন।

ওঁর গলার আওয়াজে এমন কিছু ছিল যার জন্য সোমনাথ আর কথা বাড়াতে পারল না। শুধু উত্তরণের হাতদুটো ধরে নীরবে কৃতজ্ঞতা জানাল আর জানানোর সময় চোখের এক ফোঁটা জল এসে পড়ল উত্তরণের হাতে।

উত্তরণ সোমনাথকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “সব ভাল হবে। ভাল থাকিস।”

কথাগুলো বলে গাড়িতে গিয়ে বসতেই উত্তরণের মাথার মধ্যে বেজে উঠল বহু দিন আগে শোনা একটা কথা, ‘যত খারাপ সময়ই আসুক, জপ কমানো চলবে না।’

সত্যসেবী আশ্রমে থাকতে যাওয়ার পরপরই বিজয়দা অর্থাৎ স্বামী অমলানন্দের মুখে উত্তরণ শুনেছিলেন কথাটা।

একদিন ভোরবেলা উঠে পড়তে বসবেন, বছর বারো-তেরোর উত্তরণ, তখনই বিজয়দা ওঁকে ডেকে বলেছিলেন যে পড়াশোনার পাশাপাশি নিত্য জপও চালিয়ে যেতে হবে। পৃথিবীর সব অমঙ্গল থেকে ওই জপই রক্ষা করাবে। জপ তার চারপাশের বাতাসকেও শুদ্ধ করে তোলে। তাই যে অহরহ জপ করে, তাকে কোনও অপবিত্রতা ছুঁতে পারে না, গ্রাস করতে পারে না কোনও ভয়। নিজেকে কখনও অরক্ষিত বোধ করে না সে।

গাড়ির মধ্যের এসি চালু হতেই মাথাটা একটু পিছনে হেলিয়ে দেওয়া উত্তরণের নিজেকে অরক্ষিত মনে হল। মনে হল, সামনের পৃথিবী যেন ছোরা কিংবা পিস্তল হাতে মারতে আসছে আর উত্তরণ যুক্তির ভাষায় কথা বলছেন; জানতে চাইছেন, কেন মারবে, কী এমন শত্রুতা! কিন্তু যে মারবে বলে অস্ত্র উঠিয়েছে, সে তো যুক্তির পরিধির বাইরে চলে গিয়েছে। এই সময়টাই তেমন। উত্তরণের আজকের জীবনটা তারই একটা বাই-প্রোডাক্ট।

এই সময়, এই জীবন থেকে একটু নিস্তার পেতে চাইছিলেন উত্তরণ। দু’টো চোখের পাতা পরস্পরের সঙ্গে লেগে গিয়ে সেই সুযোগটা করে দিল। বহু বছর আগের একটা সকালে পৌঁছে গেলেন এক অবিশ্বাস্য গতিতে, যে গতি কোনও মিসাইলেরও নেই, আছে কেবল স্মৃতির। স্মৃতি আর মন কি হাত ধরাধরি করে চলে? নইলে ওই ঝাপসা দুপুরটা এত স্পষ্ট হয়ে উঠল কার ঝাড়পোঁছে?

রাস্তা দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে একটা দোতলা বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে অকারণে ঘেউঘেউ করা কোনও কুকুরকে মুখ ভেংচেছিল একটা বাচ্চা ছেলে। আর সেই কুকুর, এলাকার একমাত্র বুলডগ, তৎক্ষণাৎ ছাদ থেকে লাফ মেরেছিল বাচ্চাটাকে ধরবে বলে। কিন্তু লাফ দিয়ে মাটিতে পড়ার সময় পা মচকে যায় কুকুরটার। ভয়ে অবশ হয়ে যাওয়া ছেলেটা বুঝতে পারে, এবারের মতো বেঁচে গিয়েছে। প্রাণপণে দৌড় লাগায় সে। দৌড়তে-দৌড়তে ভাবতে থাকে, পা মচকে না গেলে ওই মস্ত কুকুরটা ছিঁড়ে-কামড়ে ছিন্নভিন্ন করে দিত তাকে।

কয়েকদিন পর সে প্রথমবার একটি আশ্রমে গিয়ে এক জটাধারী সাধুকে প্রণাম করে। প্রণাম করামাত্র সেই সাধু বাচ্চাটিকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলেন, “কুকুর কি মানুষের কথা বোঝে? ওভাবে কুকুরের সঙ্গে কথা বলতে নেই বাবা।”

বাচ্চাটা অবাক হয়ে যায়। সাধু কীভাবে জানলেন ওর কুকুরকে ভ্যাংচানোর কথা, ভেবে আকুল হয়ে যায়। কিন্তু মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করতে পারে না কিছু। সাধু মহারাজের গা থেকে ভেসে আসা সুগন্ধে কেমন একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে যায়।

উত্তরণের সেই প্রথম দেখা ব্রহ্মচারী ঠাকুরকে। সেদিন সত্যসেবী আশ্রম থেকে বেরিয়ে আসার সময় থেকেই জটাজুটধারী সেই সন্ন্যাসীর মূর্তি ক্রমাগত ভেসে উঠছিল চোখের সামনে। বোধ হচ্ছিল, ওই সন্ন্যাসীকে ছেড়ে আর-একটি মুহূর্ত থাকাও অসম্ভব।

খুব অল্প বয়সে বাবাকে হারান উত্তরণ। হঠাৎ স্ট্রোকে ওঁদের গোটা পরিবারকে ঘূর্ণিঝড়ের মুখে ফেলে পঞ্চভূতে মিশে যান বাবা। বাবার মৃত্যুর পর কমপ্যাশনেট গ্রাউন্ডে চাকরি পেয়েছিল মা। কিন্তু সেই চাকরির ধকল নিতে না পেরে মায়ের শরীর ভাঙতে থাকে। খুব দ্রুত এতটাই অবনতি হয় যে দুই ছেলে নিয়ে শ্বশুরের বাড়িতে এসে উঠতে হয়। সেই বাড়িটা তখন পুরোটাই উত্তরণের ছোটকাকার দখলে। কাকিমা এবং কাকু যে খুব ভালভাবে নিয়েছিল ওঁদের পাকাপাকি এই বাড়িতে চলে আসা তা নয়, কিন্তু মুখের উপর কিছু বলতে পারেনি। মা মাইনে পেয়ে প্রায় পুরোটাই তুলে দিত কাকিমার হাতে, সে কারণেও কিছুটা ঠান্ডা ছিল সম্ভবত। কিন্তু ওদের কাছে ভাল হতে গিয়ে নিজের ওষুধপত্রও ঠিকঠাক কিনত না মা। ফল যা হওয়ার তাই হল। একদিন মাথা ঘুরে পড়ে গেল রাস্তায়। ধর্মতলার মোড় থেকে ট্যাক্সি করে অচেনা লোকেরা মাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেল।

অ্যানুয়াল পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে উত্তরণ তার একটু আগেই বাড়ি ঢুকেছেন। মাকে রেজ়াল্ট দেখানোর জন্য ছটফট করছে যে ছেলে, অচৈতন্য মাকে কেউ ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে এলে কেঁদে উঠবে না সে? কিন্তু কাঁদতে দেখে যদি ধমক দিয়ে যায় নিজের কাকিমাই? উত্তরণ সেই প্রথম কান্না গিলে নিতে শিখেছিলেন।

হাসপাতাল থেকে আধখানা হয়ে ফিরে এসেছিল মা। অফিস যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল অনির্দিষ্টকালের জন্য। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বদলে গিয়েছিল কাকু আর কাকিমার ব্যবহার। উত্তরণ মাঝে-মাঝে মাকে বলতেন ওঁদের পুরনো ভাড়াবাড়িতে ফিরে যাওয়ার কথা। মা ভয় পেত। টাকাপয়সার নয়, টাকা তো এখানে আরও বেশি দিতে হত… দুটো বাচ্চাকে নিয়ে ল্যাজেগোবরে হওয়ার ভয়। নিজের উপর বিশ্বাসটাই চলে গিয়েছিল মায়ের। সেই ভয়টা একটু-একটু করে সঞ্চারিত হচ্ছিল উত্তরণের মধ্যেও। ওঁরও মনে হত, মা হঠাৎ করে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলে ভাইকে নিয়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন? তেমন কিছু হলে, কাকু বা কাকিমা থাকতে দেবে এখানে?

ব্রহ্মচারী ঠাকুরের কাছে প্রথমবার যাওয়ার দিন থেকেই সেই ভয়টা কমতে শুরু করল। উত্তরণের মনে হতে লাগল, কেউ একজন আছেন যিনি সর্বাবস্থায় রক্ষা করবেন। সত্যসেবী আশ্রমে যার হাত ধরে যাওয়া, সেই সুধীরমামা মায়ের দূর সম্পর্কের ভাই। মামা-ই একদিন বলেছিল যে একজন সিদ্ধপুরুষের কাছে নিয়ে যাবে, যাঁর দেওয়া আশীর্বাদি ফুলে সব অসুখ ভাল হয়ে যায়। কথাটা শোনা ইস্তক মা উত্তরণকে বারবার করে বলত ওই আশ্রমে যাওয়ার কথা। আসলে মায়ের তখন খড়কুটো সামনে পেলে তাকেও আকড়ে ভেসে ওঠার বাসনা…

উত্তরণ গিয়েছিলেন মায়ের ইচ্ছামতো সত্যসেবী আশ্রমে, সুধীরমামার হাত ধরে। ওঁরা তখন থাকতেন দমদম দু’নম্বর এয়ারপোর্টের কাছে উত্তরণের ঠাকুরদা বাড়ি করেছিলেন ওখানেই। আর বাবার চাকরির সূত্রে উত্তরণ জন্মের পর থেকেই ছিলেন হাওড়া ময়দানের কাছাকাছি। সেখানে জমিও কেনা ছিল ওঁদের। কিন্তু দমদমে চলে আসতেই কাকু এবং কাকিমা মিলে মাকে বোঝাতে থাকে যে ওই জমিটা রেখে দিলে হয়তো একদিন জবরদখল হয়ে যাবে, তার চেয়ে ভাল খদ্দের যখন আছে তখন ওটা বেচে দেওয়াই শ্রেয়। প্রথম-প্রথম রাজি না থাকলেও ওদের লাগাতার চাপের সামনে বেশিদিন প্রতিরোধ খাড়া করতে পারেনি মা। কিন্তু জমিটা বিক্রি হয়ে যাওয়ার অল্পদিন পরেই জানতে পেরেছিল যে বাজারদরের চেয়ে অনেক কমে জমিটা নিজের শালার কাছেই বিক্রি করিয়েছে কাকু।

“তুমি ওদের ডেকে জিজ্ঞেস করো, কেন এরকম করল ওরা?” উত্তরণ মাকে বলেছিলেন।

বড় ছেলেকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকা মা জবাব দিয়েছিল, “জিজ্ঞেস করেছিলাম। কিন্তু তোর কাকিমা বলল যে, বিক্রি করে টাকা যখন পেয়ে গিয়েছি তখন ওই জমির সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্ক নেই। আর সম্পর্ক যখন নেই, তখন কে কিনেছে না কিনেছে, তাই নিয়ে প্রশ্ন করার অধিকারও নেই… আত্মীয়রা এভাবে ঠকায় আত্মীয়দের?” মা জিজ্ঞেস করেছিল কান্না থামিয়ে।

উত্তরণ কোনও জবাব খুঁজে পাননি কথাটার। মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল তাই।

মনখারাপ নিয়েই ওই বাড়িতে থাকাটা একটা অভ্যাসের মতো হয়ে গিয়েছিল। ব্রহ্মচারী ঠাকুরের কাছে যাওয়ার আগের দিন তা আরও বেড়ে গিয়েছিল কারণ বিনা দোষে কাকিমার কাছে গালে চড় খেতে হয়েছিল।

চড় খাওয়ার কারণটা ছিল অদ্ভুত। ভোট আসছে বলে কোনও এক প্রার্থী স্কুল থেকে ঘরে ফেরা বাচ্চাদের দশ টাকা করে দিচ্ছিলেন, সঙ্গে একমুঠো করে লজেন্স। দেওয়ার সময় একগাল হেসে বলছিলেন, “বাবা-মাকে বলবে ভোটটা আমাকেই দিতে, কেমন?” ভদ্রলোকের দু’জন স্যাঙাত হাতে একটা লিফলেট ধরিয়ে দিচ্ছিল সেই মুহূর্তেই। তাতে তাঁরই হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে থাকা ছবি ছাপা। কাকুর ছেলে সন্দীপন টাকা আর লজেন্স দু’টোই নিলেও, উত্তরণ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ওঁর কীরকম ভাল লাগেনি ব্যাপারটা। সন্দীপন নিজেকে উত্তরণের ভাই বলে পরিচয় দিয়ে উত্তরণের ভাগের লজেন্স আর টাকা চাইতে গিয়েছিল। কিন্তু দাবড়ানি খেয়ে ফিরে আসে। সেই রাগেই সে মায়ের কাছে নালিশ করে এবং কোনও কিছু তলিয়ে না দেখেই কাকিমা ঠাস করে চড়িয়ে দেয় উত্তরণকে।

“ছোট ভাই নিতে পারে আর তুমি পারো না? কোথাকার সাধুপুরুষ তুমি? ঢাকাটা পেলে তোমার মায়ের আপেল আর বেদানার খরচটা তো অন্তত উঠত।” কাকিমা চিৎকার করে বলেছিল।

মায়ের জন্য কবে আপেল কিংবা বেদানা আনা হয়েছিল মনে করতে পারেননি উত্তরণ। তাও ঘাড় গোঁজ করে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিলেন। নিজের মনে বিড়বিড় করেছিলেন, এমনি এমনি টাকা নেব কেন, অচেনা-অজানা লোকের থেকে?

উত্তর না পেয়ে মাথা আরও গরম হয়ে গিয়েছিল কাকিমার। উত্তরণকে আর-একটা চড় মেরে রান্নাঘরে ঢুকে গিয়েছিল।

উত্তরণ মাকে বলেননি পর্যন্ত ঘটনাটা। কিন্তু রাত্রে মা যখন কাছে টেনে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, “আমি মরে গেলে রাস্তায়-রাস্তায় ভিক্ষে করিস ভাইকে নিয়ে, তবু এখানে থাকিস না,” তখন চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা গরম জল গড়িয়ে পড়েছিল। তবে তৎক্ষণাৎ মনে হয়েছিল, কান্না থামিয়ে শক্ত হওয়া দরকার, কারণ ওঁর অসুস্থ মা প্রতিজ্ঞা করছে এই ঘটনার প্রতিশোধ নিয়ে তবে মরার।

সত্যসেবী আশ্রমের ভজন কুটিরে যখন সুধীরমামার হাত ধরে উত্তরণ প্রবেশ করলেন, তখন ব্রহ্মচারী ঠাকুর কৃষ্ণের প্রতিজ্ঞাভঙ্গের গল্প বলছিলেন।

“কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তিনি কোনওরকম অস্ত্র ধারণ করবেন না, এমনটাই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন কৃষ্ণ। এই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করার জন্য অর্জুনের রথের সারথি হলেন তিনি। কিন্তু যুদ্ধ চলাকালীন ভীষ্মও প্রতিজ্ঞা করলেন যে কৃষ্ণকে তিনি অস্ত্র ধারণ করাবেনই। একদিন ভীষ্মের একের পর এক তিরে অর্জুন বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেন। ভীষ্মের অভিজ্ঞতার সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে তাঁর ধনুক গেল ভেঙে। তিরবিদ্ধ, রক্তাক্ত অর্জুন শেষমেশ কৃষ্ণের হাত ধরে বললেন যে কৃষ্ণ আর তাঁর রথের সারথি না থেকে নেমে যেন সামনে এসে দাঁড়ান। তিনি কৃষ্ণের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রাণত্যাগ করতে চান। অর্জুনের এই অবস্থা দেখে কৃষ্ণ নিজের প্রতিজ্ঞা বিসর্জন দিয়ে অর্জুনের রথের একটা চাকা খুলে হাতে নিয়ে ভীষ্মকে বধ করার জন্য অগ্রসর হলেন। সেই ভয়ংকর রূপ দেখে ভীষ্ম মুহূর্তে অস্ত্র ত্যাগ করে বলে উঠলেন যে কৃষ্ণ স্বয়ং প্রতিজ্ঞা করেছিলেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তিনি অস্ত্র ধারণ করবেন না। অথচ অর্জুনকে বিপর্যস্ত দেখে আত্মহারা হয়ে সেই তিনিই নিজের প্রতিজ্ঞা ভাঙলেন। আর সারা পৃথিবী তা প্রত্যক্ষ করল। কৃষ্ণকে দিয়ে এইটুকু করানোই যে তাঁর অভীষ্ট ছিল, ভীষ্ম সে কথাও বলতে ভুললেন না।”

শুনতে-শুনতে কোন ভাবসাগরে তলিয়ে গিয়েছিলেন উত্তরণ। ব্রহ্মচারী ঠাকুর থামতেই মনে হল, ঈশ্বর যদি প্রতিজ্ঞা ভাঙতে পারেন, মানুষ কেন পারবে না? আজ বাড়ি ফিরে মাকে বলতে হবে প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিজ্ঞা ভেঙে ফেলতে। মা সুস্থ হয়ে উঠুক, সেটাই প্রতিশোধ, সেটাই প্রাপ্তি।

প্রাপ্তির তখনও বাকি ছিল উত্তরণের। ঠাকুরের ভজন-কুটির থেকে বেরোনোর ঠিক আগে যে ঘটনাটা ঘটল, সেটা বোধহয় উত্তরণকে শান্তি আর সাহস দিতেই ঘটালেন ব্রহ্মচারী ঠাকুর।

একটি লোক এসে ঠাকুরকে প্রণাম করে কোনও কথা না বলে, একশো টাকার একটা নোট এগিয়ে দিল।

ব্রহ্মচারী ঠাকুর লোকটির চোখের দিকে স্থির তাকিয়ে বললেন, “টাকা থাকলেই দেওয়া যায়, না টাকা দিলেই নেওয়া যায়?”

কথাটা শুনে লোকটা একটু ঘাবড়েই গেল সম্ভবত, কিন্তু তারপর সে কী করল তা আর উত্তরণ খেয়াল করেননি, কারণ ততক্ষণে আনন্দের একটা উদ্দাম স্রোত আছড়ে পড়েছে ওঁর মনে। যায় না। টাকা থাকলেই দেওয়া যায় না আর দিলেই নেওয়াও যায় না।

রাতে ঘরে ফিরে মাকে কথাটা বললেন উত্তরণ। ভাবলেন মা বুঝি ওঁর মতোই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠবেন। কিন্তু নির্জীব মা একটা ম্লান হাসি হেসে জিজ্ঞেস করলেন, “আমার অসুখ সেরে যাবে সেরকম কোনও দৈব ওষুধ দিলেন?”

উত্তরণ একটু দমে গিয়েও মুহূর্তের মধ্যে সামলে নিলেন নিজেকে, “দিয়েছেন তো। রাতে শোওয়ার সময় প্রতিদিন তিনবার ব্রহ্মচারী ঠাকুরের নাম বালিশে লিখবে। লিখলেই দেখবে শরীর ভাল লাগছে। লিখতে-লিখতে সেরে যাবে তুমি।”

সম্পূর্ণ বানিয়ে কথাটা বলেননি উত্তরণ। আশ্রম থেকে বেরোনোর সময় ঠাকুরের একজন শিষ্য আর-একজনকে এই কথাটাই বলছিলেন। উত্তরণের মাথায় গেঁথে গিয়েছিল। মা যখন নিরাশায় তলিয়ে যেতে-যেতে একটা কোনও ভরসা পেতে মুখ তুলে তাকিয়েছিল, তখন ওই কথাটাই মাথায় ঝিলিক দিয়েছিল উত্তরণের। শুধু মাকে বলাই নয়, নিজেও সেই রাত থেকেই বালিশে ব্রহ্মচারী ঠাকুরের নাম লিখতে শুরু করেন উত্তরণ। যখন মা, “আমি মন থেকে বলছি আমার এই ছেলেটাকে আপনিই নিন” বলে উত্তরণকে ব্রহ্মচারী ঠাকুরের কাছে সমর্পণ করে আসে আর রাতে আশ্রমের একটি ঘরে শুতে গিয়ে উত্তরণ জানতে পারেন যে বালিশ মাথায় দিয়ে শোওয়ার বিলাসিতা আশ্রমিকদের জন্য নয়, তখন কোনও শারীরিক কষ্টের কথা মনেও আসেনি। শুধু মনে হয়েছিল, ঘুমোনোর আগে ঠাকুরের নাম কোথায় লিখবেন?

ব্রহ্মচারী ঠাকুর উত্তরণকে চাওয়ামাত্র মা রাজি হয়ে গিয়েছিল। মা বোধহয় তেমন কিছুই শুনতে চাইছিল। আসলে শরীর সামান্য সারলেও মায়ের নিজের উপর ভরসা তখনও ফিরে আসেনি। তাই নিজের থেকে আলাদা করে বাঁচাতে চাইছিল সন্তানদের। ভাই এতই ছোট যে ওর ক্ষেত্রে সে সুযোগ আসেনি তখনও। উত্তরণকে ব্রহ্মচারী ঠাকুর চেয়ে নিতে মা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল।

উত্তরণের নিজেরও কি খুব খারাপ লেগেছিল? কাকিমার চড়-থাপ্পড়, কাকুর অবহেলা, মায়ের অসুস্থতা -এই সমস্ত কিছুর চাপ ওঁকে কুঁকড়ে রাখত দিনরাত। উলটোদিকে প্রথম দেখার মুহূর্ত থেকেই ব্রহ্মচারী ঠাকুরের দুর্নিবার টান ওঁর অনেক বন্ধন আলগা করে দিয়েছিল। কলকাতার উত্তর শহরতলি ছেড়ে দক্ষিণ কলকাতার প্রান্তে, গড়িয়া থেকে অনেকটা ভিতরে, সত্যসেবী আশ্রম ওঁর নতুন ঠিকানা হয়ে উঠল, অচিরেই। কেবল মাঝে-মাঝে ভাইয়ের কথা মনে করে একটু আনচানানি হত। মা কি পারছে, ওই বাচ্চাটাকে ঠিকমতো সামলাতে? সে দুশ্চিন্তা অবশ্য স্থায়ী হত না বেশিক্ষণ। ব্রহ্মচারী ঠাকুরের কাছে যেমন সহজে নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন, নিজের সব ভয়-ভাবনাকেও তাঁর চরণে তুলে দিতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। কেবল ঠাকুর-নির্ভর হয়ে থাকার এক নতুন আনন্দ তখন গ্রাস করেছে উত্তরণকে।

ছুটন্ত গাড়ির মধ্যে বসে উত্তরণের ক্রমাগত মনে হতে লাগল, সময়ই সবচেয়ে বড় প্রতারক। সে শুধু নিজে পালটায়, মানুষের ভিতরটাকে পরিবর্তিত করে না। নইলে আজ এত বছর পরও কেন একইরকম জাগরূক সেই যন্ত্রণা! নচিকেতার বাবা নিজের ছেলেকে যমকে দান করেছিলেন। নচিকেতা সেই দানের মর্যাদা রক্ষা করেছিলেন। কিন্তু উত্তরণ তো পারলেন না, কেবল ঠাকুরের হয়ে থেকে জীবনভর শুধু ঠাকুরের কাজই করতে। অথচ সেরকমটাই হওয়ার কথা ছিল না কি? কেন বিচ্যুত হতে হল? কেবল নিয়তিই কি দায়ী তার জন্য, নাকি উত্তরণের নিজের মধ্যেও সেই পুণ্যস্রোতে ভেসে থাকার দম ছিল না?

আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতিমান অধ্যাপক হিসেবে আজ যত লোকই চিনুক, যতই দেশ-বিদেশ করে বেড়ান, গুরুর কাজে নিজের জীবন অতিবাহিত করার যে স্বপ্ন উত্তরণ দেখেছিলেন, তা ভেঙে যাওয়ার বেদনা কার সঙ্গে ভাগ করে নেবেন তিনি? পৃথিবীর মানুষজন দিনরাত্রি শুধু আরও বেশি কিছু পাওয়ার আশায় ছুটছে। তাদের কে বোঝাবে যে বৈরাগ্যের জন্যও কারওর মনে তীব্র আকুতির জন্ম সম্ভব? প্রচুর ব্যাঙ্ক-ব্যালেন্স, বিলাসবহুল বাড়ি বা গাড়ি, সবকিছুই সেই মানুষটার কাছে অভিশাপ বলে মনে হতে পারে, তার মন দিনরাত্রি হাহাকার করতে পারে একখণ্ড গেরুয়া কাপড়ের জন্য, যার দাম খুবই সামান্য, কিন্তু দাম দিলেই যাকে কেনা যায় না, অর্জন করতে হয়।

সেই অর্জন না করতে পারার যন্ত্রণা, উত্তরণকে যেন দশ দিক থেকে আক্রমণ করল। মনে হতে লাগল, জীবনের সব কৃত্রিম সাফল্য, যার জন্য কলকাতায় আসামাত্রই উত্তরণকে এই মেকি অনুষ্ঠানের সভাপতি করে আনা হয়েছে, একটা শিকারি পাখির মতো আকাশে উড়িয়ে দিয়েছে ওঁকে। মুখে শিকার নিয়ে সেই পাখিটা অনেক উঁচুতে উড়ছে। কিন্তু যত উঁচুতেই যাক না কেন, সে কিছুতেই নিস্তার পাচ্ছে না তার বুকে বিঁধে থাকা বুলেটটার হাত থেকে রক্তক্ষরণ চলছেই।

একবার আশ্রমে যাওয়ার কথা ভাবলেন উত্তরণ। কিন্তু কীভাবে যাবেন, পেটে মদ, মুখে গন্ধ নিয়ে? প্রবল আত্মধিক্কারে নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করল উত্তরণের। যেমন প্রায়শই হয়। আর তখনই সিগন্যালে আটকে যাওয়া গাড়ির বন্ধু জানলার এপাশ থেকে রঘুকে দেখলেন।

এসির ভিতরেও ঘামতে থাকা উত্তরণ গাড়ির কাচ নামিয়ে ভাল করে তাকালেন পথের ধারে মাছ নিয়ে বসে থাকা লোকটার সামনে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে। হ্যাঁ, রঘুই তো। ওরকম টিয়াপাখির মতো নাক, আশ্রমে আর-একটাও ছিল না। উত্তরণ যখন আশ্রমে আসেন, তার কয়েকদিন আগেই এসেছিল রঘু। ওদের বাড়ি ছিল রানাঘাটে। রঘুর বাবা ট্রেনে-ট্রেনে লজেন্স ফিরি করতেন। শীতের এক ভোরে কুয়াশার মধ্যে লাইন পার হতে গিয়ে ট্রেনে কাটা পড়েন। একসময় সব শুনে থাকলেও, কার হাত ধরে রঘুর আশ্রমে আসা, তা এখন আর মনে পড়ল না উত্তরণের। বরং রঘুর সূত্রে মনে পড়ে গেল নিজের ছেলেবেলার হাজারও কথা।

মা পয়সার অভাবে পৈতে দিতে পারেনি বড় ছেলের। উত্তরণ আশ্রমে আসার পর আর-একজন দরিদ্র ব্রাহ্মণ সন্তানের সঙ্গে ওঁর পৈতে হয়। পৈতের পর গঙ্গায় দণ্ডি ভাসাতে গিয়ে উত্তরণের মনে হয়েছিল দু’টো স্রোত দু’দিক থেকে টানছে ওঁকে। একদিকে বিপুল, বিস্তৃত গঙ্গা, অন্যদিকে জ্যোতির্ময় সন্ন্যাসী ব্রহ্মচারী ঠাকুর। দু’টো টানের মধ্যে ঠাকুরের টানই যেন জোরালো। দণ্ডি ভাসিয়ে আশ্রমে ফেরার পর, আশ্রমের সবকিছু যাঁর নখদর্পণে থাকত, সেই বিজয়দা উত্তরণকে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়েছিলেন। আর রঘুকে বলেছিলেন আশ্রমের রান্নাঘর থেকে দই-চিঁড়ে মেখে নিয়ে আসতে।

উত্তরণ একটু উশখুশ করছিলেন কারণ ছোট থেকে তিনি শুনেছেন এবং দেখেছেন যে দণ্ডি ভাসিয়ে ফিরে আসার দিনটা অব্রাহ্মণের হাতে খায় না সদ্য ব্রাহ্মণরা। কিন্তু রঘুরা তো…

বিজয়দা ওঁর মনের কথা পড়তে পেরেই যেন বললেন, “তোমার অস্বস্তির কোনও কারণ নেই। আশ্রমে আমরা কেউ বামুন-কায়েত-বদ্যি-মাহিষ্য-শূদ্র নই। আমাদের একটাই পরিচয়, আমরা ব্রহ্মচারী ঠাকুরের সন্তান। আমি যে তোমার সামনে বসে আছি, আমিও তো ব্রাহ্মণ ছিলাম না পূর্বাশ্রমে, তাই বলে কি আমি ঠাকুরের কিছু কম সেবাইত?”

উত্তরণ লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললেন।

বিজয়দা বললেন, “হ্যাঁ, এবার তোমার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, সবাই যখন একই, তখন তোমায় কেন পৈতে দিলেন ঠাকুর? উত্তরটা হল, আমরা আমাদের পরম্পরা বিসর্জন দেব না, আবার একই সঙ্গে প্রচলিত নিয়মগুলোর সংস্কার করতেও পিছপা হব না। মানে…”

“কাঁটাটুকু ফেলে দিয়ে মাছটা খাব, তাই তো?” চুপচাপ ঘরে ঢুকে আসা রঘু বলে উঠল।

“তোকে বলেছি না, আশ্রমের সীমানার মধ্যে মাছ-মাংসের কথা তুলবি না?” বিজয়দা রেগে যাওয়ার ভান করে হাত উঁচু করে থাপ্পড় দেখালেন রঘুকে।

আশ্রমে থাকতে গেলে যে সমস্ত কথা তুলতে নেই, তার অনেক কিছুই অবশ্য রঘু মাঝে-মাঝেই তুলত। উত্তরণ বাধা দিতে গেলে বলত, মনের মধ্যে যখন কথাগুলো আসে তখনই তো ঠাকুর জানতে পেরে যান, তবে আর মুখে না বলার ফায়দা কোথায়? বরং মন আর মুখ এক হলেই ঠাকুরের কৃপা পাওয়া যায়।

রঘুর কথার উত্তরে খুব বেশি কিছু বলতে পারতেন না উত্তরণ। আবার কথাগুলো মেনেও নিতেন না।

একদিন একটা পিকচার পোস্টকার্ড দেখিয়ে রঘু বলেছিল, “এই হিরোইনটাকে চিনিস? একদম ডায়মন্ড হারবারের ডাব। যত শাঁস, তত জল।”

কথাটার মাথামুণ্ডু বুঝতে পারেননি, কিন্তু রঘুর জোরাজুরিতে উত্তরণ কার্ডটা হাতে নিয়ে দেখেছিলেন, নীল শাড়ি-পরা একটা মেয়ের ছবি। ছবিটা রঘুর হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, “মেয়েটা মুখটা ওরকম করে আছে কেন?”

“চুমু খাওয়ার আগে মুখটাকে ওরকম করতে হয়। মেয়েরা করে, ছেলেরাও। চুমু খেয়েছিস কোনওদিন কাউকে?”

উত্তরণ ছিটকে চলে এসেছিলেন রঘুর সামনে থেকে। একদম ভাল লাগেনি কথাগুলো। মনে হয়েছিল সাদা দুধের গামলায় কে যেন কালো কালি ঢেলে দিচ্ছে।

“এই কথাটা আবার স্বামীজিদের বলতে যাস না যেন!” রঘু পিছন থেকে চেঁচিয়েছিল।

উত্তরণ ছুটে চলে আসার সময় ধাক্কা খেয়েছিলেন অনিলদার সঙ্গে। অনিলদার সন্ন্যাস নাম ছিল বিরজানন্দ। কিন্তু আশ্রমের এ মাথা থেকে ও মাথা সবাই ‘অনিলদা’ বলেই ডাকত তাঁকে। আশ্রমের প্রকাশনা বিভাগ এবং মাসিক পত্রিকার দায়িত্বে ছিলেন অনিলদা। তা ছাড়া আরও হাজারটা কাজ নিজেই ঘাড়ে টেনে নিতেন। কিন্তু মেজাজ হারাতেন না কখনও।

ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন উত্তরণ, অনিলদাই ধরে নেন ওঁকে। উত্তরণ নিচু হয়ে যখন প্রণাম করছেন, তখন বললেন, “তাড়াহুড়ো করে কোথায় যাচ্ছিলে?”

উত্তরণ জবাব দিতে না পেরে চুপ করে ছিলেন।

অনিলদা বললেন, “আমাদের যেখানে পৌঁছনোর, আমরা তো সেখানে পৌঁছেই গিয়েছি। সারা জীবন উদভ্রান্তের মতো ঘুরেও লোকে যার নাগাল পায় না, তুমি তো ঠাকুরের সেই শ্রীচরণে একদম ছোটবেলাতেই ঠাঁই পেয়েছ। কত ভাগ্যবান বলো তো তুমি! আর তাড়াহুড়ো কীসের?

উত্তরণের নিজেরও তাই মনে হত। তিনি ভাগ্যবান। না হলে সন্ন্যাসীদের এত ভালবাসা এবং স্বয়ং ঠাকুরের এমন অহৈতুকী করুণা কীভাবে লাভ করলেন? পৈতের পরপরই ঠাকুর দীক্ষা দিয়েছিলেন ওঁকে। তার কয়েকদিনের মধ্যেই আশ্রমের রাধাগোবিন্দ মন্দিরে পুজোর কাজে স্বামী অভয়ানন্দকে সাহায্য করার দায়িত্ব পান উত্তরণ।

তখন সময়টা যেন এক অনন্ত ভাবের আবেশে কেটে যেত। ভোরে উঠেই স্নান সেরে মন্দিরে গিয়ে ঠাকুরের বেদি সাজাতেন উত্তরণ। অভয়ানন্দ যেভাবে দেখিয়ে দিয়েছিলেন, সেভাবেই ফুলে-ফুলে বৃন্দাবন করে তুলতেন সবটা। তারপর ধ্যানে বসতেন। ধ্যান যখন শেষ হত, ততক্ষণে ঠাকুরের নিত্যপুজো শুরু হয়ে যেত। উত্তরণ নিবিষ্ট হয়ে দেখতেন অভয়ানন্দ কীভাবে ঠাকুরের পুজো করছেন। প্রতিটা মন্ত্র, প্রত্যেকটি আঙ্গিক মনে-মনে একেবারে মুখস্থ করে নিতেন। তারপর পুজো শেষ হয়ে গেলে, ঠাকুরের প্রসাদ নিয়ে ফিরে আসতেন নিজের ঘরে। ঠাকুরের দৃঢ় নির্দেশ ছিল উত্তরণকে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হবে একদম আগের মতো, তাই নতুন যে স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন, তার দিকে সাড়ে দশটা বাজলেই রওনা দিতেন।

স্কুল থেকে ফিরে সামান্য বিশ্রাম নিয়ে বৈকালিকী প্রার্থনায় যোগ দিতেন। ‘ভবসাগর তারণ কারণ হে/ রবিনন্দন বন্ধন খণ্ডন হে/ শরণাগত কিঙ্কর ভীত মনে/ গুরুদেব দয়া করো দীনজনে…’ গাইতে-গাইতে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে নামত এক-একদিন। আবার মনে হত, ভয় কীসের? ভয় কাকে? গুরুদেব তো পৃথিবীর সবটুকু স্নেহ আর ভালবাসা মিশিয়ে আশ্রয় দিয়েছেন।

সান্ধ্য প্রার্থনার পর ঘরে ফিরে গিয়ে পড়তে বসতেন উত্তরণ। ঠাকুর বলেই দিয়েছিলেন, পড়াশোনা করতে-করতে উঠে এসে উত্তরণের আরতিতে যোগ দেওয়ার দরকার নেই। তবু সন্ধ্যারতি শুরু হওয়ার ঘণ্টাটা বাজলেই, ভিতরটা কেমন ছটফট করে উঠত। মনে হত সবাই যখন গাইবে, ‘সচ্চিদানন্দ বিগ্রহ, গুরু কৃপাহি কেবলম’, তখন একমাত্র তিনিই বাদ থাকবেন, তা কী করে হয়?

দুর্দান্ত খোল বাজাত রঘু আর হারমোনিয়ামে সুর ধরতেন রঞ্জিতদা। ওই খোল আর হারমোনিয়ামের যুগলবন্দি উত্তরণকে টেনে আনত মন্দিরের চাতালে। সবার সঙ্গে তিনিও গেয়ে উঠতেন, “গুরু বলো রে/হরি বলো রে…”

আরতির শেযে শান্তিজল নিয়ে খেতে যেতেন। সন্ন্যাসীরা সাধারণত রান্নাঘরে বসেই প্রসাদ পেতেন। আশ্রমের অন্যান্য আবাসিক এবং গৃহী ভক্তদের জন্য নির্দিষ্ট ছিল ব্রহ্মানন্দ ভবন। রঘু পরিবেশন করত সেখানে আর উত্তরণের থালায়, ডাব্লু হাতায় করে, অনেকটা ডাল ঢেলে দিয়ে মজা দেখত সময়-সময়।

একদিন পরীক্ষার আগে পড়ায় এতই নিমগ্ন ছিলেন উত্তরণ যে আরতিতেও উঠে যাননি, তারপর প্রসাদ নিতেও না। আশ্রমিকদের দরজায় ছিটকিনি লাগানোর নিয়ম ছিল না, কিন্তু পড়তে-পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বলেই উত্তরণ খেয়াল করেননি কখন গুরুদেব এসে দাঁড়িয়েছেন ঘরের ভিতর। যখন উত্তরণের ঘুম ভাঙল, গুরুদেবের হাত তাঁর শিষ্যের মাথায়।

“তুমি না খেলে পরে আমি কীভাবে খাই বলো তো?” ব্রহ্মচারী ঠাকুর জানতে চাইলেন।

উত্তরণ কিছুক্ষণ থমকে থেকে কেঁদে ফেললেন। তাঁর মনে হল, মায়ের পর আর কেউ কোনওদিন তিনি অভুক্ত থাকলে জেগে থাকেননি। ঠাকুর শুধু বাবা নন, তিনি মা-ও।

বাবা একদিনের ভিতর চলে যাওয়ার পর মা ছিল ভরসা। এবার তিন দিনের জ্বরে মা মারা যেতে যখন অশৌচ পালন করতে দমদমের বাড়িতে গেলেন উত্তরণ, ঠাকুরের নির্দেশে প্রায় প্রতিদিন আশ্রমের কেউ না কেউ যেত ওঁর সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু যে ছেলেটা চব্বিশ ঘণ্টাই উত্তরণের সঙ্গে থেকে ওঁদের দুই ভাইয়ের হবিষ্যি বানিয়ে দেওয়া থেকে রাতের মশারি টাঙানো অবধি সবটাই করত, সে আর কেউ নয়, রঘু।

উত্তরণ নতুন করে চিনেছিলেন রঘুকে তখন। অনেকটা ভালবাসা আর সাহস নিয়ে ছেলেটা উত্তরণের পাশে দাঁড়িয়েছিল। ভাইয়ের কী হবে ভেবে উত্তরণ ভেঙে পড়তেন মাঝে-মাঝে। তাই দেখে রঘু বলত, “ব্রহ্মচারী ঠাকুর যদি তোর ভার নিয়ে থাকেন, তা হলে তোর ভাইকে নিশ্চয়ই ফেলে দেবেন না। তুই ঠাকুরের আশ্রয়ে আছিস, তোর এত চিন্তা কীসের?”

চিন্তা থেকে মনখারাপ, সেখান থেকে শরীর খারাপ। এমনটাই ছিল রঘুর থিয়োরি। সেই মনখারাপ কাটাতেই মায়ের শ্রাদ্ধশান্তি করে আশ্রমে ফিরে আসা উত্তরণকে একদিন জোর করেই একটা হিন্দি সিনেমা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল রঘু। সেটাই ছিল উত্তরণের জীবনে প্রথম হিন্দি সিনেমা দেখা। খুব ছোটবেলায় মা কিংবা বাবার কোলে চেপে যে দু-তিনটে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলেন, সেগুলো সবই বাংলা কিংবা ইংরেজি ছিল।

“হিন্দি সিনেমাই আসল সিনেমা। না দেখলে লাইফ বৃথা।” হলে ঢোকার সময় বলছিল রঘু।

সিনেমাটা দেখতে দেখতে উত্তরণের মনে হচ্ছিল জীবন এমনিও বৃথা। নইলে আশ্রমিক হয়েও তিনি কীভাবে ঠাকুরের কাছে গোপন করে এমন একটা গর্হিত কাজ করতে চলে এসেছেন।

ইন্টারভ্যালের সময় উত্তরণ রঘুর কাছে বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার অনুমতি চাইলেন।

রঘু হেসে উঠল, “আভি তো পিকচার শুরু হোগা দোস্ত। বোস চুপ করে।”

উত্তরণের কান্না পেয়ে গেল সেই হাসির আওয়াজে। ইচ্ছে হল ছুটে বেরিয়ে যান হল ছেড়ে। কিন্তু যে রঘু মায়ের মৃত্যুর পর অতখানি করেছে, তার মনে আঘাত দিতেও মন চাইছিল না।

উত্তরণ তাই চুপচাপ সিনেমাটা দেখলেন রঘুর পাশে বসে। শেষের দিকে ছবি না দেখে কাঁদলেন। ঠাকুরের অবাধ্য হয়েছেন, এই বোধ কুরে-কুরে খেতে থাকল ভিতরটা।

“তুই কিন্তু আশ্রমের কাউকে বলবি না যে আমরা সিনেমা দেখতে এসেছিলাম। আমি বলব যে তোকে নিয়ে কালেকশনে এসেছিলাম।” ফেরার পথে রঘু বলল।

“কালেকশনে?” উত্তরণ যেন ইলেকট্রিক শক খেলেন।

“হ্যাঁ তা-ই। তাতে অসুবিধে কী?” রঘু রাস্তার ধারের একটা দোকান থেকে সিগারেট কিনে ঝুলতে থাকা জ্বলন্ত নারকেল দড়ি দিয়ে ধরাল।

ঠাকুর তাঁর শিষ্য-ভক্তদের সবাইকে বাড়িতে মঙ্গলঘট রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং প্রত্যহ সেই মাটির ঘটে স্নানের পর, খাওয়ার আগে, একমুঠো করে চাল রাখতে বলেছিলেন। সেই চাল মাসের নির্দিষ্ট এক বা দু’দিন আশ্রমিকরা সংগ্রহ করতেন শিষ্য-ভক্তদের বাড়ি থেকে। সেই সংগৃহীত চাল দিয়ে সারা মাস আশ্রমবাসী এবং আশ্রমে প্রসাদ পেতে আসা মানুষদের অন্নসংস্থানই শুধু হত না, দরিদ্র শিষ্য-ভক্তদের মধ্যে বিতরণও করা হত সেই চাল।

“ঠাকুর শুধু আশ্রমবাসীর পেট ভরানোর জন্য মঙ্গলঘট প্রতিষ্ঠা করাননি, মঙ্গলঘটের চাল বিলি না করলে তাহেরপুর, কুপার্স ক্যাম্প, অশোকনগর, চাকদা, কাঁচরাপাড়া, দত্তপুকুর, বারাসত, বিরাটির অনেক উদ্বাস্তু পরিবার না খেয়ে মরত।” বিজয়দা বলেছিলেন উত্তরণকে।

এত পবিত্র একটা ব্যাপার নিয়ে মিথ্যে বলবে রঘু? উত্তরণ শিউরে উঠলেন।

“বন্ধুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করিস না।” আশ্রমে ঢোকার মুখে রঘু আবার বলল।

না, বিশ্বাসঘাতকতা উত্তরণ করেননি, গুরুদেব কিংবা কোনও সন্ন্যাসীর কাছে গিয়েই বলেননি সেদিন তিন ঘণ্টা মঙ্গলঘটের চাল কালেকশনের নাম করে কোথায় ছিলেন। কিন্তু সেই না-বলার অভিঘাত, সহস্র সাপের দংশন হয়ে দিনরাত্রি কামড় দিত ওঁকে। যখন সকালে ঠাকুরের পুজোয় সাহায্য করতেন কিংবা সন্ধ্যারতির সময় করতাল বাজাতেন অথবা রাত্রে প্রসাদ নিতে যেতেন, উত্তরণের মনে হত যে ওঁর মতো পাপিষ্ঠের কোনও অধিকার নেই আশ্রমে থাকার। যখন গুরুদেবের মুখোমুখি হতেন, তখনই সবচেয়ে বেশি করে মনে হত কথাটা।

“গুপ্ত পাপ প্রকাশ্য পাপের চাইতে অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। জন্মের পর জন্ম এর ফল ভোগ করতে হয়।” ব্রহ্মচারী ঠাকুর একদিন বলছিলেন ভজন-কুটিরে বসে।

উপস্থিত সব শিষ্যই কথাটা শুনলেন, কিন্তু সারা গায়ে বিছুটি ঘষা খাওয়ার জ্বালা শুরু হল শুধু উত্তরণের।

সেদিনই দুপুরে বিজয়দা উত্তরণকে ডেকে আশ্রমের লাইব্রেরিতে একটি বই দিয়ে আসতে বলেন। তখনও বিমলেশদা লাইব্রেরি খোলেননি বলে, উত্তরণ নিজের বিছানার পাশে রেখে দেন বইটাকে। তারপর একেবারে ভুলে যান।

কয়েকদিন পর স্কুলের জন্য বেরোনোর সময় ঠাকুরের সামনে পড়ে যান উত্তরণ। ব্রহ্মচারী ঠাকুর উত্তরণের মাথায় হাত রেখে বলেন, “জায়গার জিনিস জায়গায় রাখতে হয়, ভুলে গেলে চলে না।”

উত্তরণ একছুটে নিজের ঘরে গিয়ে বইটা নিয়ে, দিয়ে আসেন লাইব্রেরিতে। কিন্তু সেদিন রাতে পড়াশোনায় মন দিতে পারেন না। কেবলই মনে হতে থাকে, ঠাকুরের কথার নিহিত অর্থ অনেক বড়। ঠাকুরের দয়ায় আশ্রমে জায়গা পেলেও, উত্তরণের জায়গা আশ্রম নয়। গুরুদেবের কাছে সত্য গোপন করা কোনও ভণ্ড, প্রতারকের জায়গা সত্যসেবী আশ্রম হতে পারে না।

যন্ত্রণা এত প্রবল হয়ে ওঠে যে উত্তরণ ছুটে যান ঠাকুরের শয়নকক্ষের দিকে। বাইরে দাঁড়িয়ে হাপুস কাঁদতে থাকেন। কাঁদতে কাঁদতে একসময় বসে পড়েন দেওয়াল ঘেঁষে। ঘড়িতে ঢং-ঢং করে বারোটা বাজতেই খুলে যায় ঘরের দরজা। ব্রহ্মচারী ঠাকুর এসে সামনে দাঁড়ান। স্বপ্ন দেখছেন ভেবে চুপ করে থাকেন উত্তরণ।

“মন যদি অনুতাপে দগ্ধ হয়, তা হলেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়ে যায়… আর তুমি তো নিজের ইচ্ছায় যাওনি।” ব্রহ্মচারী ঠাকুর বললেন।

ঠাকুর সব জানেন! উত্তরণ অবাক চোখে তাকালেন।

“রঘু আমার কাছে এসে সব বলেছে। আর তোমার যে মত ছিল না, সে কথাও বারবার করে জানিয়েছে।”

ব্রহ্মচারী ঠাকুরের কথায় রঘুকেও নতুন করে চিনলেন উত্তরণ। উত্তরণকে বারণ করে, ও নিজেই ঠাকুরের কাছে এসে সব অপরাধ স্বীকার করে গিয়েছে? অদ্ভুত ছেলে তো!

সেই অদ্ভুত ছেলেটাই এখন লোক হয়ে গিয়েও অদ্ভুত কাণ্ডই করছে। বারবার মাছ বিক্রেতার সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে, আবার পিছিয়ে আসছে। উত্তরণ গাড়ি থেকে নেমে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে রঘুর কাঁধে হাত রাখলেন। রঘু চমকে পিছন ফিরে প্রায় আধমিনিট ধরে দেখল উত্তরণকে। তারপর, “বুবাই!” বলে জড়িয়ে ধরল।

কতদিন পরে ডাকনাম ধরে কেউ ভাকল। উত্তরণের মনে হল, ওঁর অতীত যেন পায়ে হেঁটে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। রঘুর গায়ের গন্ধের ভিতর দিয়ে কুড়ি বছর আগের পৃথিবী প্রত্যক্ষ হয়ে উঠল। একসঙ্গে ইস্কুলে যাওয়া থেকে বৃষ্টিভেজা পর্যন্ত।

“বিজয়দার মৃত্যুর দিনই লাস্ট দেখেছিলাম তোকে। তার কয়েকদিন পরেই তো তুই…” রঘু হাত দিয়ে প্লেন উড়ে যাওয়ার ভঙ্গিমা করল।

“কার থেকে খবর পেয়েছিলি?”

“আশ্রমে গিয়েছিলাম, তখনই শুনেছিলাম। শুনেই খুব মনখারাপ হয়ে গিয়েছিল। আফটার অল, তোকে মহারাজের সিটে দেখব, তুই ঠাকুরের প্রতিনিধি হয়ে দীক্ষা দিবি…”

“এসব আর বলিস না রঘু। এই কথাগুলো আমার শোনার অধিকার নেই।” উত্তরণ থামিয়ে দিলেন রঘুকে।

“নেই কেন? তুই বিদেশে প্রফেসর হয়েছিস, খুনখারাপি তো করিসনি যে ঠাকুরের কাজ আর করতে পারবি না। ঠাকুর চাইলে আবারও আশ্রমে ফিরবি না, কে বলতে পারে?” |

উত্তরণ কেঁপে উঠলেন রঘুর কথায়, “কী বলছিস তুই?”

“ঠিকই বলছি। আমি তো কয়লাখনির লেবার হয়ে ধানবাদে চলে গিয়েছিলাম। তারপর একটা ফাউন্ড্রিতে চাকরি নিয়ে মধ্যপ্রদেশের রিমোট এরিয়ায়। সেখান থেকে অসমের চা-বাগানে। আমি কোনওদিন ভেবেছিলাম, আশ্রমের হাফ কিলোমিটারের মধ্যে জমি কিনে বাড়ি করতে পারব? আমার ওয়াইফ তত বেহালায় ওর মাসির দেখে দেওয়া ফ্ল্যাট কেনার জন্য খেপে উঠেছিল। কিন্তু আমার মাথায় সারাক্ষণ ঘুরঘুর করত, ‘গুরুর কাছে বাসে হয় কাশীবাসের ফল’। তবে সত্যি বলছি, নিজের থেকে কিছু করতে পারতাম না… গুরুদেবই হাতে করে আমার বাড়িটা বানিয়ে দিলেন। দু’কাঠা জমির ওপর, কিন্তু ভিতরে ঢুকলে মনে হবে অনেকটা জায়গা। চল না আজ আমার বাড়িতে গিয়ে থাকবি? সারা রাত জেগে গল্প করব।”

“আজ না রে, পরে একদিন। কিন্তু তুই এখানে কী করছিলি?”

“আমার শ্বশুরবাড়ি এখান থেকে পাঁচ মিনিট। মেয়ের পরীক্ষা চলছে বলে, বউ ক’দিন এখানেই আছে। তোর সঙ্গে সেই বিজয়া চলে যাওয়ার দিন আলাপ করিয়ে দিয়েছিলাম, ভুলে গেছিস?”

উত্তরণ কথা ঘোরাতে চেয়ে বললেন, “বউ-মেয়ে বাড়িতে নেই তো মাছওয়ালার সামনে কেন?”

“নিজেকে খেতে হবে না?” রঘু হেসে উঠল।

“কিনছিলি তো না! খালি এগোচ্ছিলি আর পিছোচ্ছিলি।” উত্তরণ বললেন।

“তোর মতো ডলারে যদি কামাতাম, তা হলে কি আর পিছছাতাম রে ভাই? আমাদের যে মাস গেলে ব্যাঙের আধুলি সম্বল। তাই দিয়েই সারাটা মাস…”

কথাটা শুনে লজ্জা পেয়ে গেলেন উত্তরণ। পুরোটা না জেনে ধারণা করে ফেলার লজ্জা।

“তোকে কিন্তু একদিন আসতেই হবে, আমার বাড়িতে। আমরা একসঙ্গে আশ্রমে যাব, কেমন?”

উত্তরণ আবারও চমকে উঠলেন। ঠাকুরের ইচ্ছা ছাড়া ঠাকুরকে কেউ প্রণামও করতে পারে না, বিজয়দা ওঁকে একবার বলেছিলেন। ঠাকুর কি তবে চাইছেন যে উত্তরণ আবার ভজন-কুটিরে ঢুকে প্রণাম করুন তাঁকে?

গাড়িতে ওঠার পরও ভাবনাটা গেল না মাথা থেকে। রঘু কি নিজেই কথাটা বলল? এমনি-এমনি? নাকি ও উপলক্ষ মাত্র? ওকে দিয়ে ব্রহ্মচারী ঠাকুরই কথাটা বলালেন?

“এখন কোনদিকে যাব স্যার?” ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল।

‘যেদিকে দুচোখ যায়’ বলতে গিয়ে উত্তরণ থমকে গেলেন। বললেন, “হোটেলের দিকে চলো।”

রাস্তার লাল আলো সবুজ হয়ে গিয়েছে ততক্ষণে।

হোটেলে ফিরে ফের একবার গরম জলে অনেকক্ষণ ধরে স্নান করলেন উত্তরণ। সমস্ত গ্লানি ধুয়ে যাক, শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে এমনটাই ভাবছিলেন তিনি। স্নান সেরে বেরিয়ে মনে হল, এই যে দশ বছরের মেয়েটাকে কলকাতায় এনে, ক্ৰেশে রেখেছেন, হোটেলে নিজের কাছে রাখেননি, এটা কি অন্যায় নয়? কিন্তু নিজের কাছে রাখলে তো ঠিকমতো দেখভাল করতে পারতেন না। তার চেয়ে ও যেখানে আছে সেখানে অনেক যত্নে আছে। আচ্ছা, বড় হয়ে ওঁর মেয়েও যদি বাবার সম্বন্ধে কাউকে ফোন করে অভিযোগ করে? কথাটা মনে হওয়ামাত্রই যন্ত্রণা আর স্বস্তি একসঙ্গে দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে এল। না, ওঁর মেয়ে আর যা-ই করুক, ফোনে কাউকে অভিযোগ জানাবে না।

রঘু, উত্তরণের বিরুদ্ধে ওঁর কাছেই অভিযোগ জানাচ্ছিল। কেন উত্তরণ আশ্রমে থাকলেন না, কেন বিদেশে চলে গেলেন, আমেরিকার বিলাসে-ব্যসনে কেন ডুবিয়ে দিলেন নিজেকে?… উত্তরণ ঘরের টিভিটা মিউট করে চালিয়ে ভাবছিলেন, তবে কি আরামের জীবন খুঁজতেই আমেরিকা গিয়েছিলেন?

ঠাকুর কিংবা বিজয়দার সঙ্গে কোনও ভক্ত-শিষ্যের বাড়ি গেলে তাঁরা যখন ফল-মিষ্টি ইত্যাদি দিয়ে আপ্যায়ন করতেন, উত্তরণ প্রায় পুরোটাই আশ্রমে নিয়ে এসে রান্নাঘরের ভাণ্ডারী গোপালদার হাতে জমা করে দিতেন, সবার মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার জন্য। একবার ঠাকুরের সম্পন্ন শিষ্য রমণী সাহা উত্তরণের হাতে পাঁচশো টাকা দিয়ে বলেছিলেন, “পুজোর সময় যা ইচ্ছা হয় কিনো।” উত্তরণ টাকাটা নিয়ে গিয়ে জমা করে দিয়েছিলেন আশ্রমের ক্যাশিয়ার মাধবদার হাতে। পরে বিষয়টা জানতে পেরে বিজয়দা ডেকে বলেছিলেন যে উত্তরণ চাইলে টাকাটা নিজের কাছেও রাখতে পারতেন। উত্তরণ মাথা নেড়েছিলেন। মনে হয়েছিল, আলাদা করে কারওর কাছ থেকে কিছু নেওয়ার দরকারটা কোথায়, যখন ঠাকুর কোনও অভাবই রাখেননি?

উচ্চ মাধ্যমিকে দুর্দান্ত রেজ়াল্টের পর যখন কলেজে ভর্তির সময় এল, তখন ঠাকুর একবারও কলকাতার সেরা কলেজ থেকে ফর্ম তুলতে বা সেখানে ভর্তি হতে বারণ করলেন না। আশ্রমের কোনও এক সন্ন্যাসীই কো-এডুকেশন-এর ব্যাপারটা তুলেছিলেন। ঠাকুর তাঁকে চুপ করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন যে, দিন আর রাত্রি যেমন পৃথিবীতে চিরন্তন, তেমনই নারী আর পুরুষও। উত্তরণ কলেজে পড়াশোনা করতে যাচ্ছেন, পাশের বেঞ্চে ছেলে না মেয়ে তাই নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনও দরকার নেই।

“পাশের বেঞ্চে যতক্ষণ, ততক্ষণ মাথা না ঘামালেও চলবে। কিন্তু যদি কোনও মেয়ে এসে একদম পাশেই বসে পড়ে?” কলেজে ক্লাস শুরু হওয়ার আগের দিন রাতে উত্তরণের ঘরে এসে জিজ্ঞেস করলেন বিজয়দা।

উত্তরণ কোনও কথা না বলে তাকালেন বিজয়দার দিকে।

বিজয়দা নস্যি নিতেন মাঝে-সাঝে। সামান্য নস্যি নিয়ে বললেন, “চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে দুটো সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ, জানো তো। ব্রাহ্মমুহূর্ত এবং গোধূলি। প্রথমটায় রাত্রির ভিতর থেকে দিন জন্ম নিতে শুরু করে। আর দ্বিতীয়টায় দিন গিয়ে মিশে যায় রাত্রির মধ্যে। তাই ব্রাহ্মমুহূর্তে সাধক নিজের সঙ্গে ঈশ্বরের সংযোগ চেয়ে সাধনায় বসেন। আর দ্বিতীয়টায় জগতের মঙ্গলকামনায় প্রার্থনা করেন! উষালগ্ন সাধকের, গোধূলিলগ্ন সংসারীর।”

“বুঝতে পারছি বিজয়দা।”

“কিন্তু কেন তোমাকে কথাগুলো বলছি তা এখনও বোঝোনি। যখন কলেজে যাবে, ক্লাস করবে, কলেজ থেকে ফিরবে, তখন তোমার ভিতর সবসময় সেই ব্রাহ্মমুহূর্তকে জাগ্রত রেখো। রাত্রির ভিতর থেকে জন্ম নিয়েও দিন যেমন নিজেকে আলাদা করে রাত্রির থেকে, মায়ের পেট থেকে জন্ম নেওয়া সাধকও তেমন নারীর থেকে দূরত্ব রচনা করেন। না পারলেই সংসার গ্রাস করে নেবে তাঁকে। গোধূলি, রাত্রির দিকে ধাবিত হবে।”

“আশীর্বাদ করুন, যেন পারি।”

“তোমাকে পারতেই হবে বুবাই। তোমার উপর যে এই আশ্রমের অনেক কিছু নির্ভর করছে।” বিজয়দা উত্তরণের মাথায় জপ করে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।

সেই রাতটা কিছুতেই ঘুমোতে পারলেন না উত্তরণ। পায়চারি করতে থাকলেন ঘরের মধ্যে। মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল একটাই কথা। অন্য যারা কলেজে আসছে তারা একটি বাড়ি থেকে আসছে, কিন্তু উত্তরণ কলেজে যাচ্ছেন সত্যসেবী আশ্রম থেকে। অন্যরা স্রেফ স্টুডেন্ট, উত্তরণ প্রতিনিধি। ওঁর প্রতিটি আচরণের নিরিখে কেবল ওঁর নয়, সত্যসেবী আশ্রমের মূল্যায়ন হবে।

ঠাকুরকে প্রণাম করে কলেজের দিকে রওনা হবেন বলে উত্তরণ ভজন-কুটিরে এসেছেন, ঠাকুরের কাছে বসে থাকা এক রিটায়ার্ড বিচারক জানতে চাইলেন, উত্তরণের অনার্স কী বিষয়ে।

“দর্শন।” উত্তরণ বললেন।

“তোমার গুরু-দর্শন তো হয়েছে। তা হলে আর দর্শন নিয়ে চিন্তা কী?” ঠাকুর হেসে উঠলেন।

সমস্ত ভার নেমে গেল উত্তরণের। মনে হল, গুরুদেবের আশীর্বাদ প্রতিটি ক্ষণে, প্রতিটি মুহূর্তে ওঁকে রক্ষা করবে।

গুরুদেব রক্ষা করবেন মানে যে ঝড়-ঝাপটার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে, তা তো নয়। কলেজে যাওয়ার প্রথম দিন থেকেই প্রচুর টিটকিরির মুখে পড়তে হল উত্তরণকে। কলেজে ঢুকতে আওয়াজ, বেরোনোর সময় আওয়াজ, ক্লাসে কিছু বলার জন্য উঠে দাঁড়ালে প্যাঁক। প্রথম-প্রথম উত্তরণের খারাপ লাগত, কিন্তু অনিলদাকে গিয়ে ব্যাপারটা বলায় অনিলদা একটা টোটকা বলেছিলেন। তাতে অনেকটা কাজ হয়েছিল। টোটকাটা আর কিছুই নয়, যে যাই বলুক, তার দিকে তাকিয়ে হাসা। স্রেফ হাসা। যাকে খ্যাপানো হচ্ছে, সে যদি হাসে তা হলে যে খ্যাপাচ্ছে তার বিড়ম্বনার অন্ত থাকে না।

তবে শুধু হাসিই নয়, একটা সময়ের পর উত্তরণের মেধা এবং ব্যক্তিত্বও গোটা কলেজকে ওঁকে অন্য চোখে দেখতে বাধ্য করল। পার্ট ওয়ানে ফার্স্ট হওয়ার পর ব্যাপারটা অনেকেরই মাথার মধ্যে গেঁথে গেল যে ধুতি-ফতুয়া পরা এই ছেলেটা গড়পড়তা পাঁচজনের থেকে বিদ্যায়, বৈদগ্ধে অনেকটা এগিয়ে।

তবে তার মধ্যে কি ঘটনা ঘটেনি? উত্তরণের গায়ে একবার দোলের আগের দিন মদ ছিটিয়ে দিয়েছিল কিছু ছাত্র নামধারী লুম্পেন। তখন ওঁরই এক সহপাঠী দীপ্ত খেপে উঠে ছুটে গিয়েছিল ছেলেগুলোর দিকে।

ওই ছেলেগুলোর একটার চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকাতে-ঝাঁকাতে দীপ্ত জিজ্ঞেস করেছিল, “পারবি? পড়াশোনা, চরিত্র, কোনও কিছুতে ওই ছেলেটার সমকক্ষ হতে পারবি?”

উত্তরণকে কলেজে দাঁড় করিয়েই, কে জানে কোত্থেকে, দীপ্ত নতুন একটা পাঞ্জাবি কিনে এনেছিল আর খানিকটা বাধ্য করেছিল উত্তরণকে সেটা পরতে। তারপর নিজের গাড়িতে করে ওঁকে পৌঁছে দিয়েছিল গড়িয়া অবধি। কোনও বারণ শোনেনি।

সেদিনের পর থেকে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী বাড়ির ছেলে দীপ্ত অনেকটা কাছে চলে এসেছিল উত্তরণের। সবকিছু থেকে দূরে-দূরে থাকার অভ্যাস সত্ত্বেও উত্তরণ ওকে সরিয়ে দিতে পারেননি নিজের বৃত্ত থেকে।

“কিন্তু তুমি আমাকে গাড়ি করে পৌঁছে দেওয়ার ধকলটা নিতে চাও কেন প্রায়-দিনই?” উত্তরণ জিজ্ঞেস করেছিলেন ওকে।

“পৌঁছে কোথায় দিই? খানিকটা এগিয়ে দিই মাত্র।”

“কলেজ স্ট্রিট থেকে যাদবপুর খানিকটা? এতে সময় নষ্ট হয় না তোমার?”

“সারা দিন যাদের সঙ্গে মিশি… সেসবের পর কিছুটা সময় তোর সান্নিধ্য পেলে, আমার পুণ্য হয়। আর তার চাইতেও বড় কথা, ফিলোসফি পড়তে এসেছি, একটু সাধুসঙ্গ না করলে চলবে কী করে?” উত্তরণ ‘তুমি’ বললেও, দীপ্ত ‘তুই’ বলেই সম্বোধন করত।

“দার্শনিক হতে গেলেই যে সাধু হতে হবে তার কিন্তু কোনও মানে নেই। সেদিন ক্লাসে কেপিসি যাঁকে আধুনিক দর্শনের জনক বলে বলছিলেন, সেই দেকার্ত কিন্তু সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে যুদ্ধ করতে চলে গিয়েছিলেন।”

“আমিও তো যুদ্ধই করছি ভাই, তোর জন্য।”

“মানে?” একটু অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালেন উত্তরণ।

“আরে কলেজে যে দক্ষিণপন্থী অংশটা আছে তারা ভোটে দাঁড় করাতে চাইছে তোকে।

“ভোটে? আমাকে?”

“এত অবাক হওয়ার কী আছে?”

“না, এতদিন টিটকিরি দিত তো সবাই…”

“এখনও হয়তো অল্প কয়েকজন দেয়। কিন্তু যে ছেলেটা কোনওরকম টোন-টিটকিরিকে পরোয়া না করে টানা দু’বছর ধুতি-পাঞ্জাবি পরে কলেজ করছে, ফার্স্ট হচ্ছে ইউনিভার্সিটির পরীক্ষায়, সে এখন বেশির ভাগ ছেলেমেয়ের কাছেই ইয়ার্কির পাত্র নয়, উলটে একটা আইকন। সেই আইকনকে ভোটে দাঁড় করিয়ে ছাত্রনেতারা বৈতরণী পার হতে চাইবে না?”

উত্তরণ এতই অবাক হয়ে গেলেন কথাটা শুনে যে তৎক্ষণাৎ কোনও জবাব মুখে এল না। স্তব্ধ হয়ে শুধু ভাবতে থাকলেন, এ কেবলই গুরুকৃপা।

“কী ভাবছিস?” দীপ্ত জিজ্ঞেস করল।

“ভাবছি আমার গুরুদেবের কথা। যিনি ঝঞ্ঝাকেও বসন্তের বাতাস করে দিতে পারেন।”

“ওরা প্রোপোজ়াল দিলে তুই কি দাঁড়াবি?” দীপ্ত জিজ্ঞেস করল।

“কখনওই না। আমি এ জীবনে আমার ঠাকুরের কাজ ব্যতিরেকে অন্য কোনও কাজের সঙ্গে জড়াব না।”

“ব্বাবা! কী কনফিডেন্স! কিন্তু লাইফ কী জিনিস জাননা তো না! কবে কখন কার সঙ্গে জড়িয়ে যাবে, টেরটিও পাবে না।”

উত্তরণ বলবেন ভাবলেন, ‘কনফিডেন্স নয় সংকল্প’। কিন্তু সে কথা না বলে বললেন, “ঠাকুর জড়াতে দেবেন না।”

“ওকে মহারাজ। জড়াবেন না। কিন্তু আমি আপনার হয়ে একটা জায়গায় কথা দিয়ে ফেলেছি, সেখানে উপস্থিত হয়ে আমাকে উদ্ধার করতেই হবে।” সিগন্যাল লাল হতেই স্টিয়ারিং থেকে হাতটা সরিয়ে উত্তরণের হাতটা ধরল দীপ্ত।

সেমিনারটার শীর্ষক ছিল, ‘কমিউনিজ়ম ভারতীয় ভাবধারা নয়’। প্রস্তাবের বিপক্ষে বলতে গিয়ে উত্তরণ প্রায় বোমা ফাটালেন। উপস্থিত শ্রোতৃমণ্ডলীর কাছে জানতে চাইলেন, যিনি কী আনা হয়েছে না দেখে যা আনা হয়েছে, তা-ই পাঁচ ছেলেকে সমান ভাগে ভাগ করে নিতে বলতে পারেন, সেই কুন্তীকে কমিউনিস্ট বলা যাবে না কেন? কেন কমিউনিস্ট বলা যাবে না, চণ্ডালকেও দ্বিজশ্রেষ্ঠ হিসেবে স্বীকার করে নিতে কুণ্ঠিত না হওয়া মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যকে? যিনি একশো বছরেরও আগে সমাজের সমস্ত পতিতাদের জন্যও বেলুড় মঠের দরজা খুলে দিতে বলেছিলেন, সেই স্বামী বিবেকানন্দ সাম্যবাদী নন? আরও আগে যদি চলে যাওয়া যায়, তা হলে ঋগ্বেদের সেই কবি, যিনি রচনা করেছিলেন, ‘সংগচ্ছধ্বং সংবদধ্বং সংবোমনাং সিজানতাম’, অর্থাৎ, ‘এসো আমরা এক কথা বলি, এক সঙ্গে চলি, এক হোক আমাদের মন’, তাঁকে কী বলব আমরা?

হাততালিতে হল ফেটে পড়ছিল, তখনই কোথাও থেকে একটা বেড়ালের ডাক শোনা গেল। তারপর একজন উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল, “আপনি কি মার্ক্স এবং এঙ্গেলসকে নস্যাৎ করে দিতে চাইছেন?”

উত্তরণ খুব শান্ত গলায় বললেন, “সনাতনী ভাবধারা কাউকেই নস্যাৎ করার পক্ষপাতী নয়। কারণ এর মূল কথাটিই হচ্ছে, ‘যত মত, তত পথ’। একটিই মাত্র মত এবং পথের তত্ত্বে ভারতের আত্মাকে ছোঁওয়া যাবে না।”

এবারের হাততালি আরও স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছড়িয়ে পড়ল গোটা হলে। আর এবার কোনওদিক থেকে বেড়াল-কুকুরের ডাক ভেসে এল না।

কলেজ থেকে বেরোনোর সময় একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। একটি মেয়ে এগিয়ে এসে প্রণাম করল উত্তরণকে। উত্তরণ বাধা দেওয়ার চেষ্টায় বলে উঠলেন, “কী করছেন?”

মেয়েটি ওঁর দিকে চোখ তুলে বলল, “প্রণাম। মনে-মনে তো রোজই করি। আজ যখন পা ছুঁয়ে করার সুযোগ পেয়েছি, তখন ছাড়ি কেন?”

এবার মেয়েটিকে চিনতে পারলেন উত্তরণ। কয়েকমাস আগে যখন অন্য একটি মেয়ে এগ বা মাটন রোলের ভুক্তাবশিষ্ট ছুড়ে মেরেছিল উত্তরণের দিকে, তখন এই মেয়েটিই ছুটে গিয়ে তাকে এক থাপ্পড় মেরেছিল। উত্তরণ কোনওরকম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করে কলেজ থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন সেদিন। আজ জিজ্ঞেস করলেন, “কোন ইয়ার?”

“ফার্স্ট ইয়ার। ফিলোসফি। আমার নাম অনসূয়া।”

“আচ্ছা।” উত্তরণ পা চালালেন।

অনসূয়া বলে উঠল, “একটা রিকোয়েস্ট ছিল। আমায় পড়াবেন?”

আবার চমকে উঠলেও উত্তরণ তা প্রকাশ করলেন না। নিচু গলায় বললেন, “আমি নিজেই এখনও শিখছি।”

কথাগুলো বলে উত্তরণ বেরিয়ে এলেন, কিন্তু সেদিন সন্ধ্যায় যখন জপে বসেছেন তখন ওঁকে বিস্মিত করে, অনসূয়ার মুখ ভেসে উঠল দুই ভুরুর মাঝখানে।

উত্তরণ চমকে উঠে, চোখ খুলে আবার বন্ধ করলেন। কিন্তু সেই একই মুখ ভেসে উঠল। কেমন একটা ভয় পেয়ে গেলেন উত্তরণ। এরকম তো আগে কখনও হয়নি।

দীক্ষা পাওয়ার পরপর বিজয়দা ওঁকে একদম কাছে বসিয়ে বোঝাতেন চারপাশের বেশির ভাগ মানুষ কীরকম গুহ্য-লিঙ্গ-নাভিতে আটকে আছে। তারা আহার এবং মৈথুনে লিপ্ত হয়ে তার বাইরের কিছু অনুভব করতে পর্যন্ত পারে না। এর পরের ধাপ হচ্ছে, যারা হৃদয় অবধি পৌঁছেছে এবং তার পর যারা কণ্ঠ পর্যন্ত। তারও পরে তারা, যারা দুই ভুরুর মাঝবরাবর, আজ্ঞাচক্র পর্যন্ত আসতে পেরেছে। একদম শীর্ষ সাধকরা পারেন কুণ্ডলিনীকে সহস্রারে জাগ্রত করতে। কিন্তু উত্তরণের কপালের মাঝখানে যে জায়গাটায় স্বয়ং ব্রহ্মচারী ঠাকুরের পায়ের স্পর্শ লেগেছে, ধ্যানের সময় সেখানে একটি মেয়ের ছবি ভেসে উঠল কেন?

নিদারুণ মনোবেদনায় আসন ছেড়ে উঠে বেশ অনেকক্ষণ পায়চারি করলেন উত্তরণ। তারপর ঠাকুরের কাছে গেলেন, নিজের অপরাধ বা ব্যর্থতা স্বীকার করতে। তখনই ঠাকুরের শয়নকক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অনিলদা জানালেন যে শরীর ভাল নয় বলে ঠাকুরকে তাড়াতাড়ি শুইয়ে দেওয়া হয়েছে।

উত্তরণের মনটা ছটফট করতে লাগল। রাতের আরতিতে যোগ দিলেও মন দিতে পারলেন না। ফিরে এসে পড়ার বই খুলেও খুব কিছু সুবিধা হল না। শুধু ভাবতে থাকলেন, কী অপরাধ হল, কেন ঠাকুরের দর্শন পেলেন না?

কেন ওই মেয়েটার মুখ, যা বিকেলেই ভুলে যাওয়ার কথা, রাতেও এতটা স্পষ্ট?

কাশীতে সত্যসেবী আশ্রমের শাখা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময়, ঠাকুরের নির্দেশে বেশ কিছুদিন কাশীতে গিয়ে ছিলেন উত্তরণ। সান্ধ্য প্রার্থনার শেষে কাশীর রাস্তায় বেরিয়ে পড়তেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা এদিক-ওদিক হেঁটে বেড়াতেন, এক-একদিন এক-একটা ঘাটে গিয়ে বসতেন। মণিকর্ণিকা ঘাটে অনেক-অনেক চিতা জ্বলতে দেখার পাশাপাশি, অদ্ভুত একটি লোকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। রামলাল শ্রীবাস্তব নামের সেই লোকটি, স্বজনেরা চিতায় চড়ানোর আগে মৃতদেহের ছবি তুলে রাখত। কালো কাপড়ে অর্ধেক ঢাকা ওর ওই পুরনো ক্যামেরায় জীবনের ছবি ছিল না কোনও, সবই মৃত্যুর ছবি। শেষ ছবি না তুলিয়ে কোনও দল শবদেহ সৎকার করার দিকে এগিয়ে গেলে রামলাল এবং তার খুদে অ্যাসিস্ট্যান্ট চিৎকার করে ডাকত তাদের।

“তোমার খারাপ লাগে না, দিনরাত এই মরে যাওয়া লোকেদের ছবি তুলতে?” উত্তরণ একদিন জিজ্ঞেস করেছিলেন রামলালকে।

“এটাই তো আমার রুজি-রুটি।” রামলাল জবাব দিয়েছিল।

“হোক রুজি-রুটি। অস্বস্তি হয় না?”

“অস্বস্তি হবে কেন? মৃত্যু মানে তো মুক্তি, হর দর্দ সে ছুটকারা!”

রামলালের ওই কথাটা মাথায় নিয়েই তারপর বেশ কিছুদিন কাশীর রাস্তায় হেঁটেছিলেন উত্তরণ। একদিন হাঁটতে-হাঁটতে শহরের সীমানা ছাড়িয়ে বিরাট থামের উপর দাঁড়িয়ে থাকা সেই মস্ত দোতলা ব্রিজটার সামনে এসে থমকেছিলেন। মনে হয়েছিল, জীবন যেন শহর আর মৃত্যু তার চাইতে অনেক উঁচুতে দাঁড়িয়ে থাকা ওই ব্রিজটা। অলঙ্ঘনীয়।

কাশীর আশ্রমের দায়িত্বে ছিলেন সন্ন্যাসী নির্মলানন্দ, সবাই যাঁকে দিলীপদা বলে ডাকত। উত্তরণকে কাছে ডেকে এক-একদিন রাতে গল্প করতেন দিলীপদা। উত্তরণের কথা শুনে একদিন বললেন, “কাশীর নাম বারাণসী কেন বলো তো? বরুণা আর অসী নদীদুটো এখানেই গঙ্গায় এসে মেশে বলে ওই দুটো নদীর নামে কাশীর নাম।”

“নদীদুটো কোথায়?”

“ওদের আর দেখতে পাওয়া যায় না। ওরা গঙ্গায় মিশে গিয়েছে। কিন্তু ওদের নামটা শহরের নামের সঙ্গে মিশে অক্ষয় হয়ে আছে। আমরা সবাই ওই নদীগুলোর মতোই। একটা মহানদীতে মিশে যাব। কিন্তু আমাদের নামটা কোথাও থাকবে কি?”

উত্তরণ কোনও জবাব দিতে পারেননি। নিজের প্রশ্নের উত্তরও পাননি পুরোপুরি। কেবল রাতে ঘুমোনোর সময় মনে হত, শুধু ওই ব্রিজটার মতোই নয়, কাশী বিশ্বনাথের গলির মাঝখানে দাঁড়ানো ষাঁড়টার পিঠের কুঁজটার মতো মৃত্যু উঁচু হয়ে আছে চারপাশের সবকিছুর থেকে।

পার্ট-টু’র শেষ পরীক্ষাটা দিয়ে আশ্রমে ফেরার সময় যখন গেটের বাইরে অসংখ্য লোককে আছাড়িপিছাড়ি খেয়ে কাঁদতে দেখলেন, উত্তরণ তখনই টের পেয়ে গেলেন ভিতরে কী সর্বনাশ হয়েছে। আর কী আশ্চর্য, সেই মুহূর্তে ওঁর রাগ হল ব্রহ্মচারী ঠাকুরের উপরে। আগের দিন সন্ধ্যায় যখন দরজার বাইরে থেকে প্রণাম করলেন, তখন একবার কেন ভিতরে ডেকে ঠাকুর সতর্ক করে দিলেন না যে চব্বিশ ঘণ্টার ভিতরেই এই আশ্রমের সঙ্গে জড়িত সবার মাথায় বাজ ভেঙে পড়বে? অসুস্থ ছিলেন ঠিকই, কিন্তু মহাপুরুষের অসুস্থতা কি সাধারণ মানুষের অসুস্থতার মতোই? যার থেকে পরিত্রাণের রাস্তা নেই?

“ঠাকুরের দেহটা কষ্ট পাচ্ছিল। তাই ঠাকুর তাকে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিলেন।” অনিলদা কাঁদতে-কাঁদতে বলে উঠলেন।

‘হর দর্দ সে ছুটকারা’! উত্তরণের মাথার মধ্যে বেজে উঠল রামলালের কথাটা।

“ঠাকুরের শরীরকেও যন্ত্রণা পেতে হয়?” অস্ফুটে বলে উঠলেন উত্তরণ।

“শরীর ধারণ করলেই যন্ত্রণা পেতে হবে।” জিশু খ্রিস্ট যন্ত্রণা পাননি? বুদ্ধ কিংবা রামকৃষ্ণ পরমহংস পাননি?” অনিলদা উত্তরণের কথাটা শুনতে পেয়ে বলে উঠলেন।

উত্তরণ সেই প্রথম অনুভব করলেন, “অনিবার্যের কোনও প্রতিকার নাই’, ঠাকুরের এই কথাটার মানে। একই সঙ্গে, ‘অনিবার্য’ শব্দটিকেও নতুন করে চিনলেন।

ঠাকুরকে সমাধিস্থ করা হল আশ্রমের ভিতরেই। শিষ্য-ভক্তদের ঐকান্তিক আগ্রহে সেই সমাধিস্থল ঘিরে গড়ে উঠতে শুরু করল সমাধিমন্দির। উত্তরণ সবটার ভিতরে ছিলেন বলেই হয়তো বা কাঁদতে পারছিলেন না। কাঁদলেন সেদিন, যেদিন রেজ়াল্ট বেরোল আর দেখার আগেই শুনলেন যে রেকর্ড ব্রেক করা নম্বর পেয়ে তিনি প্রথম হয়েছেন ইউনিভার্সিটিতে।

“জানেন বিজয়দা, এইটথ পেপারের পরীক্ষা দেওয়ার দিন চোখ বন্ধ করলেই আমি দেখতে পাচ্ছিলাম ঠাকুরের পা আমার মাথার উপর।”

“নরলীলা সংবরণ করলেও তাঁর পা যে সবসময় তোমার মাথার উপরেই থাকবে, সেটাই তোমায় জানাচ্ছিলেন ঠাকুর।”

“আমার পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি দেহরক্ষা করেননি, পাছে আমার রেজ়াল্ট খারাপ হয়…” উত্তরণ কেঁদে ফেললেন।

“রেজ়াল্ট তো শুধু তোমার নয় উত্তরণ। রেজ়াল্ট যে গুরুদেবেরও। তুমি ফার্স্ট হওয়া মানে, গুরুদেবেরও ফার্স্ট হওয়া। এইটা বোঝো তো? তোমার ভিতর দিয়ে ঠাকুরও যে প্রচারিত হবেন, প্রসারিত হবেন সারা পৃথিবীতে। আমি আর ক’দিনের জন্য।” বিজয়দা হাসলেন।

উত্তরণ বুঝতে পারলেন না, ব্রহ্মচারী ঠাকুর স্থূলদেহ ত্যাগ করার পর, ঠাকুরের প্রতিনিধি হিসেবে যিনি সদ্য আশ্রমের সভাপতির আসনে বসেছেন, সেই বিজয়দা কেন এইরকম কথা বলছেন।

উত্তরণকে চুপ দেখে বিজয়দা বললেন, “তোমার মনে প্রশ্ন জাগছে বুঝতে পারছি। কিন্তু আমি তো আমার কথা বলছি না, বলছি ঠাকুরের ইচ্ছার কথা, যা আজ নয় কাল তোমাকে জানতেই হবে।”

“আজই বলুন।”

“বলছি। ঠাকুরের ইচ্ছা যতটুকু বুঝতে পেরেছি তাতে… আগামী দিনে তুমি তাঁর নাম ছড়িয়ে দেবে ভক্ত-শিষ্যদের মধ্যে।”

“আমি? আমার কী যোগ্যতা?”

“যোগ্যতা-অযোগ্যতার বিচার কি তুমি করবে?”

“আমি তা বলিনি বিজয়দা। কিন্তু ছোট থেকে আমি তো এই আশ্রমেই বড় হয়েছি। আমি তো শুনেছি, আপনি কীভাবে মঙ্গলঘটের চাল সংগ্রহ করে আশ্রমে ফেরার পথে রাস্তায় পড়ে গিয়ে ভয়ংকর আহত হয়েছিলেন। কিন্তু সেই পা-ভাঙা অবস্থাতে হাসপাতালে যাওয়ার পথেও চালের বস্তা নিজের কাছছাড়া করেননি।”

“ওসব পুরনো কথা, বাদ দাও।”

“কেন বাদ দেব? শুরুদেবের মুখেই তো শোনা। অনিলদা সকালে মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়েও দুপুর পর্যন্ত মাসিক পত্রিকার ফাইনাল প্রুফ দেখে, পাতা ছেড়ে তারপর বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছিলেন। কিন্তু আমার এমন কোন আত্মত্যাগ আছে ঠাকুর বা আশ্রমের জন্য যে আমি ঠাকুরের নাম ছড়াতে পারি?”

“নিজেকে অনেক বড় করে দেখছ বুবাই। তুমি কী পারো বা পারো না সেটা তুমি ঠিক করবে না, ঠিক করবেন ঠাকুর। আর ঠাকুরের নাম ছড়ানো মানে ‘বিজয়’ বা ‘উত্তরণ’ এর মতো কোনও নামের প্রচার নয়, ঠাকুরের প্রদত্ত নাম দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে দেওয়া। মনে রেখো, নাম এবং নামী অভেদ। নামই ঠাকুর, ঠাকুরই নাম। নাম করতে পারা মানেই ঠাকুরের সঙ্গে থাকা। এবার এই সত্যটা হচ্ছে জুঁইফুলের মতো খানিকটা সাদা ভাত। সেই ভাত তুমি কলাপাতায় দাও, মাটির পাত্রে দাও, কিংবা সোনার থালায় দাও, ভাতের রং পালটাবে, না, স্বাদ পালটাবে?”

উত্তরণ আর কোনও কথা না বলে বিজয়দাকে একটা প্রণাম করে নিজের ঘরে ফিরে এলেন। ঠাকুরের যে প্রতিকৃতি ওঁর ঘরের দেওয়ালে ছিল, তার সামনে গিয়ে চুপ করে দাঁড়ালেন।

এম এ-তে ভর্তি হওয়ার পরপরই নতুন তৈরি হওয়া সমাধিমন্দিরে পুজোর দায়িত্ব পেলেন উত্তরণ। প্রবীণ সন্ন্যাসী বিশুদ্ধানন্দজি অসুস্থ, ভোরবেলা উঠতে পারেন না, বিজয়দা তাই খানিকটা কুণ্ঠার সঙ্গেই জিজ্ঞেস করেছিলেন যে উত্তরণ ভোরের পুজোটা করে দিতে পারবেন কি না।

“আপনি আদেশ করলে নিশ্চয়ই পারব।”

“না, তোমাকে তো রাত জেগে পড়াশোনা করতে হয়…”

“তাতে কী? আমি কি সেই ক্লাস নাইনে পড়ার সময় থেকে রাধাগোবিন্দ মন্দিরে অভয়ানন্দজির সঙ্গে পুজোয় বসিনি?”

“বসেছ, কিন্তু ঠাকুর নিজেই তোমাকে সেই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন, তুমি বি এ-ক্লাসে ভর্তি হওয়ার পর তোমার উপর চাপ পড়ে যাবে বলে। তাই ভাবছি…”

“আপনারা একটু বেশিই ভাবেন আমায় নিয়ে। আমি বলছি, কোনও চাপ পড়বে না, আমায় দয়া করে সমাধিমন্দিরের নিত্যপূজার ভার দিন।”

বিজয়দা হেসে ফেললেন, “চাইছ যখন, করো।”

পরদিন থেকে ভোরে উঠে সমাধিমন্দিরে পুজো করতে বসতেন উত্তরণ। আর গুরু-মহারাজের পুজো করতে পারার আনন্দ সারাদিন ঘিরে রাখত ওঁকে। কিন্তু পৃথিবীতে আনন্দের ভাগ কিছু কম বলেই হয়তো এম এ সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস শুরু হওয়ার সময়ই চিকেন পক্স হল উত্তরণের। পক্স থেকে সেরে ওঠার পর শরীর এত দুর্বল হয়ে গেল যে রোজ ইউনিভার্সিটি আসা-যাওয়াই সমস্যা হয়ে দাঁড়াল।

“তুই এভাবে ক্লাস করতে পারবি না। তোকে কাছাকাছি কোথাও হস্টেল কিংবা বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতে হবে।” দীপ্ত একদিন ফিরতি পথে বলল।

“গ্র্যাজুয়েশনের তিন আর এম এ-র এক, এই চার বছর তো এইভাবেই ক্লাস করলাম।”

“এখন আর পারবি না। তোর শরীর দেবে না। তুই গাড়িতে বসে কথা বলতে-বলতে ঘুমিয়ে পড়িস বিকেলে। তা হলে কীভাবে ট্রেনের ওই ভিড় সামলে ফিরবি, কোনওদিন আমি না এলে?”

উত্তরণ লজ্জা পেয়ে গেলেন, ঘুমের কথা শুনে। মনে হল, দীপ্তর উপর তিনি অহেতুক চাপ সৃষ্টি করছেন। একদিন দীপ্তকে একরকম ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে একটা ট্রামে উঠে পড়লেন। ধর্মতলায় নেমে মেট্রোয় চেপে টালিগঞ্জ। সেখান থেকে বাসে যখন উঠেছেন গড়িয়া পেরিয়ে নামবেন বলে, উত্তরণের মনে হল শরীরটা আর বশে নেই। হাওয়া এসে ছুঁয়ে দিলেই উলটে যাবেন।

পরদিন শনিবার ছিল, তার পরদিন রবিবার। উত্তরণ দুপুরে ঘুমিয়ে পড়লেন, আর ঘুমের ভিতর বেশ একটা স্বপ্নও দেখছিলেন যখন রতনদা এসে তুলে দিয়ে বলল যে ওঁর এক বন্ধু প্রেসিডেন্ট মহারাজের সঙ্গে দেখা করতে চাইছে। উত্তরণ কথাটা শুনেই বাইরে বেরিয়ে দেখলেন, দীপ্ত দাঁড়িয়ে আছে নাটমন্দিরে।

উত্তরণ ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন দেখে দীপ্তই বলল, “তোর আশ্রমে চলে এলাম বলে রাগ করলি?”

“আশ্রম গুরুদেবের। সেখানে যার ইচ্ছে সে-ই আসতে পারে।” উত্তরণ বললেন।

“আমি কিন্তু একটা কাজে এসেছি। তোদের প্রেসিডেন্ট মহারাজের সঙ্গে একবার দেখা করব।”

“কিন্তু কেন?”

“সেটা মহারাজকেই বলব।”

নাছোড়বান্দা দীপ্তকে বিজয়দার ঘরে নিয়েই যেতে হল। বিজয়দাকে প্রণাম করে একটা-দুটো সাধারণ কথার পর দীপ্ত হঠাৎ বলে উঠল, “উত্তরণ যদি এম এ-তেওঁ ফার্স্ট হয়, সেটা আপনাদের আশ্রমের পক্ষেও একটা বিরাট গৌরবের ব্যাপার হবে, তাই না?”

বিজয়দা কিছু না বলে তাকালেন দীপ্তর দিকে।

দীপ্ত সপাটে বলল, “এত দূর থেকে ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে উত্তরণের পক্ষে দারুণ কিছু করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে এখন যখন ওর শরীরটাও ভাল যাচ্ছে না। আপনি যদি অনুমতি দেন তবে আমি উত্তরণের জন্য ইউনিভার্সিটির কাছাকাছি একটা জায়গা দেখে দিতে পারি।”

“হস্টেলে কি ও থাকতে পারবে?” বিজয়দা সামান্য দ্বিধার সঙ্গে বললেন।

“আমি ওকে বাড়ি দেখে দেব। একটা বাড়ির আলাদা ঘরে ও নিজের মতো থাকবে। ওকে আমার বাড়িতেও নিয়ে যাচ্ছি না, কারণ সেটা হয়তো ওর ইগোতে লাগবে।”

‘ইগো’ শব্দটা বিজয়দা কী বুঝলেন কে জানে। বললেন, “সন্ন্যাসীর তো কোনও অহংকার থাকার কথা নয়। সে গাছের তলায়ও শুয়ে থাকতে পারে। বুবাই যেখানে জপ-ধ্যান করতে পারবে, নিজের মতো থাকতে পারবে, সেরকম একটা জায়গায় যদি ওর ব্যবস্থা করে দিতে পারো, আমার আপত্তি নেই।”

উত্তরণ এই এতক্ষণে বলে উঠলেন, “আমি যাব না।”

“তুমি আশ্রম ছেড়ে যাচ্ছ না। আশ্রমের কাজে তোমাকে বাইরে পাঠানো হচ্ছে।”

“ঠিক বলেছেন মহারাজ। তুই ফার্স্ট হয়ে আবার আশ্রমে ফিরে আসবি। তাতে তো আশ্রমেরই লাভ।”

দীপ্ত এমনভাবে প্লিড করল যে কথাটায় শিলমোহর পড়ে গেল।

কিন্তু বাক্স-প্যাঁটরা গুছিয়ে দীপ্তর ঠিক করা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার সময়, উত্তরণের বুক ভেঙে যাচ্ছিল। যাওয়ার আগে বিজয়দা কাছে ডেকে জড়িয়ে ধরলেন। উত্তরণ হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন বিজয়দার বুকে মাথা রেখে।

“এই একটা বছর, সন্ন্যাসীরা যেমন হিমালয়ে যান, তেমন তুমিও তপস্যা করতে যাচ্ছ। এটা ঠাকুরেরই ইচ্ছে ধরে নাও। তোমাকে প্রথম হতে হবে, তাই—না?”

“কিন্তু আমি প্রথম না হলেই বা কী বিজয়দা?”

“তুমি তোমার জন্য প্রথম হচ্ছ না। তোমাকে ঠাকুরের জন্য প্রথম হতে হবে। ঠাকুরের যে প্রিয় শিষ্য, সে কি কখনও কোথাও দ্বিতীয় হতে পারে?”

উত্তরণ থমকে গেলেন বিজয়দার কথা শুনে। তারপর বিজয়দাকে প্রণাম করে বেরিয়ে পড়লেন।

উত্তর কলকাতায় গৌরীবাড়ির কাছে উত্তরণের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল দীপ্ত। পুরনো একটা বাড়ির দোতলায় একটা বড় ঘর, একটা ছোট ঘর, অ্যাটাচড বাথরুম, রান্নার জায়গা, ছোট্ট বারান্দা মিলিয়ে উত্তরণের থাকার জায়গাটাকে একটা ছিমছাম ফ্ল্যাট বলাই সমীচীন। জায়গাটায় বেশ একটা বনেদি কলকাতার সুবাস ঘুরে বেড়াত। শিয়ালদা কাছে, কলেজ স্ট্রিটও দূরে নয়। যাতায়াতের সময় থেকে এক ধাক্কায় প্রায় চার ঘণ্টা বেঁচে যাওয়ায় পড়াশোনার জন্য বাড়তি অনেকটা সময় পেয়ে গেলেন উত্তরণ। তবু বিকেলবেলা ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে আশ্রমের জন্য মন কেমন করত ওঁর। সান্ধ্য প্রার্থনার আওয়াজ শোনার জন্য ছটফট করে উঠত ভিতরটা। তখন, ঠাকুরঘর বানিয়েছিলেন যে ছোট ঘরটাকে, সেখানে জপে বসতেন উত্তরণ। অনেক-অনেকক্ষণ জপের শেষে শান্ত হয়ে যেত মাথাটা। উঠে ভাতে-ভাত বসাতেন স্টোভে।

একতলায় যে ছেলেগুলো থাকত, তারা কোনওদিন হাতিবাগান, কখনও এসপ্ল্যানেডের কোনও হল থেকে সিনেমা দেখে ফিরত প্রায় মাঝরাতে। ওদের হুল্লোড়ের শব্দে প্রথম-প্রথম একটু অসুবিধে হত উত্তরণের। পরে মনে হত, জীবনকে তিনি যেভাবে দেখেন, জীবন তো শুধু সেরকমই নয়। এক-এক জায়গায় এক-একরকম তার প্রকাশ। দেখতে হবে, শুনতে হবে, নিজের বিশ্বাসে অটলও থাকতে হবে।

নীচের ছেলেগুলোর কাছে নানা সময়ে আসা মেয়েদের হাসি আর চিৎকার দোতলায় উঠে আসত। উত্তরণ যখনই বাইরে থেকে ফিরতেন বা বাইরে যেতেন, তখনই মেয়েগুলো নানারকম আওয়াজ দিত ওঁর উদ্দেশ্যে। ওদের উৎসাহে ছেলেগুলোও চেগে উঠত, নয়তো অন্য সময় ওরা একদমই বিরক্ত করত না।

কলেজে ঢোকার পরপরই যে ঠাট্টা-তামাশার মুখোমুখি হতে হয়েছিল, গ্র্যাজুয়েশনে প্রথম হয়ে তার আওতার বাইরে চলে এসেছিলেন উত্তরণ। ছেঁড়া জিনস আর গাঁজার ছিলিমের বিপ্রতীপে একটা অন্যরকম আদর্শই হয়ে উঠেছিলেন, বলা যায়। ধুতি-পাঞ্জাবি পরা একটা বাইশ-তেইশের ছেলের সঙ্গে অধ্যাপকরাও সম্ভ্রমের সঙ্গে কথা বলতেন।

দীপ্তর দেখে দেওয়া বাড়িতে এসে আবার সেই পুরনো দিনগুলোকে যেন ফিরে পেলেন উত্তরণ। ওই টিটকিরি, ওঁকে দেখলেই আজেবাজে অশ্লীল কথার চালাচালি… উত্তরণের বোধ হত, তিনি বোধহয় কিম্ভুত কেউ।

“তোকে নিয়ে ওদের প্রবলেম একটাই। সেটা কি তুই বুঝতে পারিস?” দীপ্ত একদিন উত্তরণের ঘরে এসে বলল।

“কী করে বুঝব?”

“ব্যাপারটা আর কিছুই নয়, তুই যে মেয়েগুলোকে পাত্তা দিস না, সেটাই ওদের রাগের কারণ। সেই রাগ থেকেই ওরা ছেলেগুলোকে তাতায়।”

“কিন্তু আমি কে এমন যে…”

“যে-ই হোস। ওদের বাজে লাগে। ওদের দেখে যে সিটি দেবে তাকে নিয়ে ওদের কোনও সমস্যা নেই, কিন্তু একবার ফিরেও যে লোকটা দেখবে না, তাকে নিয়ে…”

“এখানে যে এইসবের সম্মুখীন হতে হবে, আমার জানা ছিল না।” উত্তরণ বলে উঠলেন।

“আমিই কি জানতাম নাকি? আমাদের ফ্যামিলিরই বাড়ি এটা, আমার এক কাকার ভাগে পড়েছে। সে বিদেশে থাকে বলে কেয়ারটেকারের হাতে দায়িত্ব। আর তার ফলেই, যা হওয়ার তা হয়েছে। নীচের তলায় একটা মেস বানিয়ে দিয়েছে, অথচ যে কোনওদিন সন্ধ্যার পরে এলে মনে হবে, বৃন্দাবনের লীলাক্ষেত্রে প্রবেশ করলাম।”

“বৃন্দাবনের লীলাক্ষেত্র সত্যিই কেমন ছিল, জানা আছে?”

দীপ্ত হেসে উঠল, “উপমাটা তোর ভাল লাগল না, তাই না? বেশ আমি বদলে দিচ্ছি। পার্ক স্ট্রিটের ক্যাবারে বানিয়ে রেখেছে জায়গাটাকে। এবার ঠিক আছে?”

উত্তরণ কোনও উত্তর না দিয়ে দীর সামনে থেকে সরে গেলেন।

দীপ্ত সেদিন কিছু না বললেও পরে একদিন এসে জিজ্ঞেস করল, “জীবনে সবসময় কি এত সংযত, এতখানি সতর্ক হয়ে চলা যায়? লাইফে তো মাঝে-সাঝে একটু ক্যাজ়ুয়ালও হবে লোকজন, তাই না?”

“অসতর্ক কথা বললে কিংবা অনর্থক আলাপে জড়ালে সাধনা বাধাপ্রাপ্ত হয়। জপের সময় মন অশান্ত হয়ে ওঠে। জপ তো শুধু আঙুলের উপর দিয়ে আঙুল চালানো নয়।”

“শরীরের উপর দিয়ে শরীর চালানোও কিন্তু প্রেম নয়। সেখানেও ভালবাসা লাগে।” দীপ্ত আলটপকা বলে উঠল, একটা সিগারেট ধরিয়ে।

রাত্রে ও চলে যাওয়ার পরও কথাটা ভুলতে পারেননি উত্তরণ। মনেও রাখতে চাননি তাই বলে। পরদিন জপ করতে বসে কথাটা মাথায় এলে, উত্তরণ কথাটাকে চলে যেতে দিলেন। একাগ্র হয়ে ভাবার চেষ্টা করলেন, আঙুলের মধ্যে মনকে সঞ্চারিত করা যায় কীভাবে। কেমন করে মনের বিদ্যুৎ আঙুলের মধ্যে দিয়ে শরীরে প্রবেশ করতে পারে। ওই বিদ্যুতটাই তো ঠাকুর। যাঁর অদর্শনেও দর্শন।

পবিত্রতার এমন একটা আলাদা গন্ধ আছে যে তার মধ্যে থাকতে-থাকতে অন্য কিছু মনকে আর টানে না। উত্তরণের অনেকদিন ধরে ইচ্ছে জেগেছিল, যেখানে আছেন সেই ঘরটায় একটা দিন গুরুদেবের নামগান হোক। উত্তরণের অনুরোধেই আশ্রমের তপন, রতন, স্বামী পরমানন্দ আর ষষ্ঠী এক রোববার বিকেলে এসেছিল ওঁর ঘরে। খোল-করতাল নিয়ে উত্তরণের ঘরের চেয়ারে বসানো ঠাকুরের প্রতিকৃতির সামনে সারা সন্ধ্যা নামগান করে ঠাকুরকে নিবেদন করা ভোগই প্রসাদ হিসেবে গ্রহণ করেছিল সবাই মিলে।

সেদিন রাতে উত্তরণের মনে হয়েছিল, এতদিন একটা মেসের ঘরে তিনি ছিলেন। কিন্তু আজকে এই চারজন আসায় ওঁর আস্তানাটাও আশ্রমেরই একটা অংশ হয়ে উঠল।

সুগন্ধ তো সেই মাটিতেই, যে মাটিতে গোলাপ ফুটে আবার ঝরে পড়ে। নইলে মাটির নিজের কী এমন ক্ষমতা যে সুগন্ধ ছড়াবে?

ভূমিকম্প হওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তেও কি মাটিতে পা রেখে বোঝা যায় যে পরের মুহূর্তে ভূমিকম্প হবে? জীবনের দুর্ঘটনাগুলোও সেভাবেই আসে। কিংবা কে জানে হয়তো তারও প্রস্তুতি থাকে কোথাও। উত্তরণের কী দরকার ছিল পূজা সম্বন্ধে কোনও মন্তব্য করার দীপ্তর কাছে? সেরকম স্বভাব তো ওঁর নয়। এইসব ব্যাপার নিয়ে ভাবাও ওঁর কাজের মধ্যে পড়ে না। তবু দীপ্ত ওঁর এতটা বন্ধু, উত্তরণের জন্য এত কিছু করে, সেই জায়গা থেকেই হয়তো দীপ্তর বান্ধবী পূজার প্রতি একটা স্নেহ কাজ করত উত্তরণের।

পূজাকে এই ঘরেও বারদুয়েক নিয়ে এসেছিল দীপ্ত। উত্তরণ প্রাথমিক আড়ষ্টতা কাটিয়ে কথা বললেও ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’তে নামেননি কিছুতেই। তাই নিয়ে দীপ্ত আর পূজা ওঁর সামনেই হেসে গড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু উত্তরণ নিজেকে পরিবর্তন করতে পারেননি বা চাননি। বন্ধু যতই কাছের হোক, বন্ধুর বান্ধবীর সঙ্গে একটা দূরত্ব রাখা প্রয়োজন, ওঁর মন বলেছিল।

কিন্তু সেই পূজাকেই ট্যাক্সির ভিতরে অন্য পুরুষের বুকে মাথা রেখে হাসতে দেখে উত্তরণের স্বাভাবিক বৈরাগ্য ধাক্কা খেল। কয়েক মুহূর্তের জন্য ওঁর পা দুটো যেন গেঁথে গেল মাটিতে। পূজার কাঁধে হাত দিয়ে ছেলেটি পূজার মুখটা নিজের কাছে টেনে আনছিল। তখনই পূজার চোখ পড়ল উত্তরণের উপর। পড়ামাত্র ওর মুখটাও কি ফ্যাকাশে রক্তশূন্য হয়ে যায়নি? ওই দৃশ্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় উত্তরণ খেয়াল করেননি।

দু’দিন পরে দীপ্তই ইউনিভার্সিটিতে উত্তরণকে ধরল। একটু অস্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করল, “তুই পূজাকে কার সঙ্গে দেখেছিস? কী অবস্থায় দেখেছিস?”

উত্তরণ এটা নিয়ে কথা বলতে চাইছিলেন না। রুচিতে আটকাচ্ছিল।

দীপ্ত বলে উঠল, “পূজাই আমাকে বলেছে যে তুই দাঁড়িয়ে গিয়েছিলি ওদের ওই অবস্থায় দেখে। ইউ ওয়্যার এনজয়িং দ্য সিন। শোন, ইফ শি ইজ় আ ব্যাড গার্ল, আই উইল ডিল উইথ হার, বাট পুরো সত্যিটা আমার জানা দরকার।”

গায়ে কে যেন চাবুক মারল। উত্তরণ এনজয় করছিলেন দৃশ্যটা?

“তোর মতো তো সবাই সন্ন্যাসী হবে না, তাই বলব অতটা শকড না হয়ে, যা দেখেছিস, বলে ফেল।”

“সন্ন্যাসী হোক বা না হোক, একজনের সঙ্গে সম্পর্ক থাকাকালীন আর-একজনের গলা জড়িয়ে বসে থাকাটা কোনও কাজের কথা নয়।” উত্তরণ বোধহয় জীবনে প্রথমবার এইভাবে কথা বললেন।

“আই সি। শোন, যে ছেলেটার সঙ্গে পূজাকে দেখেছিস সে একটা নোবডি। আমাদের রিলেশন আমাদের জায়গা থেকে ঠিকই আছে, তুই অকারণে মেজাজ গরম করিস না।”

দীপ্ত কথাগুলো বলে চলে গেল। কিন্তু উত্তরণ বুঝতে পারলেন যে কোথাও যেন একটু তাল কাটল। তা হলে কি এটা সত্যি যে যেখানে কামিনী এসে দাঁড়ায় সেখানেই দুই ভাই কিংবা দু’জন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মধ্যেও বিরোধ লাগে!

মানুষ কি ঘটনার মধ্যে নিজেই জড়ায়, নাকি নিয়তি তাকে জড়িয়ে দেয়? সেদিন ওই মুহূর্তে সিগন্যালের লাল আলো জ্বলে না উঠলে পূজাকে ওভাবে দেখার প্রশ্নই উঠত না। কিন্তু দেখার পরও উত্তরণ কোনও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেননি কোথাও। তা হলে দীপ্ত এসে ওঁকে ওইসব বলে গেল কেন? হ্যাঁ, দৃশ্যটা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু অপ্রত্যাশিত কোনও কিছুর সামনে সেটুকু হওয়ারও কি অধিকার নেই মানুষের?

“অধিকারবোধ থেকেই প্রবলেমগুলো হয়, কিন্তু একটু পজ়েসিভ না হলে প্রেমও তো হয় না।” তিন-চার দিন পর দীপ্তই আবার উত্তরণের ঘরে এসে বলল।

উত্তরণ চুপ করে রইলেন।

দীপ্ত আগের দিনের মতো উত্তেজিত ছিল না। শান্ত গলায় বলল, “পূজা চমকে গিয়েছিল তোকে ওখানে দেখে। তারপর ভেবেছিল যে তুই আর পাঁচটা ছেলের মতো আমাকে ব্যাপারটা বলবি। তুই আলাদা মানুষ, এই বিশ্বাসটুকু রাখতে পারলে আমার কাছে পূজাকে মুখ খুলতেই হত না আর আমিও কিছু জানতাম না। আমাদের সম্পর্কটাও টিকে যেত।”

“মানে?” উত্তরণ প্রশ্নটা করে বসলেন।

“মানে একটাই। ইটস ওভার। পূজা যদি রং চড়িয়ে কথা না বলত, পার্টলি তোকে দায়ী করে বাঁচতে না চাইত, তা হলে বুঝতাম যে কোথাও একটু সততা আছে ওর মধ্যে। কিন্তু এখন আমার কাছে জলের মতো পরিষ্কার যে ও একটা মিথ্যুক। কিংবা তার থেকেও বেশি। শি ইজ় আ বিচ।”

উত্তরণ শিউরে উঠলেন, “যার প্রতি ভালবাসা, তাকে এতটা অশ্রদ্ধা করা উচিত?”

“ভালবাসলেই তো ঘেন্নাটা বেশি করে জন্মায়। শ্রীদেবী কার বুকে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে আছে তাতে তো আমার কিছু যায়-আসে না, তাই—না? কিন্তু যাকে ভালবেসেছি তার বিশ্বাসঘাতকতাটা বুকে লাগে।”

“হয়তো বিশ্বাসঘাতকতা নয়। হয়তো…”

“রিলেশনশিপে থাকা একটা ছেলে আর-একটা মেয়ের মধ্যে একজন যখন তৃতীয় কারওর সঙ্গে জড়ায়, তখন তাকে বিশ্বাসঘাতকতাই বলে। সাধু-সন্ত মানুষ তুই, এই ব্যাপারগুলো বুঝবি না। অবশ্য না বোঝাটা আশীর্বাদ। আমি যেদিন থেকে বুঝতে পেরেছি, সেদিন থেকে আমার অতীত-ভবিষ্যৎ একদম কালো হয়ে গিয়েছে। পিচ ব্ল্যাক।”

“বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে ব্যাপারটা থেকে।”

“সেটা আমিও জানি। একটা ফালতু মেয়ের কথা ভেবে জীবন নষ্ট করার কোনও মানে হয় না। কিন্তু এখানে থাকলে আমি পূজাকে ভুলতে পারব না। তাই দু’মাসের জন্য দিল্লি যাচ্ছি। ব্যবসার কিছু কাজও আছে ওখানে। জানি পড়াশোনার ক্ষতি হবে অনেকটাই, হয়তো এ বছর ড্রপ দিতেও হতে পারে। তবু নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ। হয়তো এতটা খারাপ লাগবে না সবকিছু।” দীপ্ত এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল উত্তরণকে।

তারপর পিছনে না তাকিয়ে বেরিয়ে গেল।

পুরো কালো হয়ে গেলে একরকম, কিন্তু চোখের সামনে যখন ধীরে ধীরে কালো হচ্ছে, তখন কী করতে পারে মানুষ? উত্তরণ কী করতে পারলেন যখন আসন থেকে হ্যাঁচকা টানে ওঁকে তুলে এনে সিঁড়ি দিয়ে নামাতে লাগল পুলিশের দুটো কনস্টেবল? ওরা লাথি মেরে ঘরে কেন ঢুকল, সেটা ভেবেই বিস্মিত হয়ে ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন উত্তরণ। ওরা ওঁকে হেঁচড়ে তুলে নিতে একেবারে বোবা হয়ে গেলেন।

নামানোর সময় দু’জনের একজন বলল, “পাঁচশো টাকা দিলে এখনও ছেড়ে দিতে পারি। নইলে কিন্তু একতলার হারামিগুলোর সঙ্গে এক লক-আপে ভরে দেব।” কেন ওঁকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, টাকাই বা কেন দিতে হবে, এরকম হাজারও প্রশ্ন ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়তে লাগল উত্তরণের মাথায়। কিন্তু কথা বেরোল না মুখ দিয়ে।

উত্তরণের কাছ থেকে কোনও সাড়া, বা বলা ভাল টাকা না পেয়ে একতলার কয়েকটা ছেলে আর তাদের কাছে আসা কয়েকটা মেয়ের সঙ্গে ওঁকে একই ভ্যানে তুলে দেওয়া হল। আশেপাশের বাড়ির বেশ কিছু বাসিন্দা নিজেদের গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, কী হচ্ছে দেখতে। তাঁদের সামনে দিয়েই পুলিশের ভ্যানটা থানার দিকে এগিয়ে গেল।

থানার মেজবাবু সবাইকে জেরা করতে-করতে উত্তরণের সামনে এসে একটু থমকে গেলেন। ধুতি-ফতুয়া পরা ছেলেটাকে একটু অন্যরকম মনে হল বলেই হয়তো জানতে চাইলেন উত্তরণের পরিচয়।

উত্তরণ অনেক কষ্টে এটুকুই বললেন যে তিনি ইউনিভার্সিটিতে পড়েন। ফাইনাল ইয়ার। কিন্তু কিছুতেই বলে উঠতে পারলেন না, ফার্স্ট হয়েছিলেন গ্র্যাজুয়েশনে।

“ওই বাড়িটার একতলায় যে ছেলেগুলো থাকত, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন মেয়েদের ঘরে ডেকে এনে ন্যাংটো করে তাদের সঙ্গে জাপটাজাপটি করে ক্যামেরায় ছবি তুলত। সেই ফিল্ম ক্যাসেট করে বিক্রি করত। মানে, পর্নোগ্রাফিক র্যাকেট চালাত রীতিমতো। বুঝতে পেরেছেন?”

উপর থেকে একটা হাতুড়ি যেন উত্তরণের মাথায় এসে পড়ল। ‘পর্নোগ্রাফি’ শব্দটা অনেক আগে তিনি শুনেছেন। কিন্তু ড্রেনের জল দূর থেকে দেখা একরকম। সেটা যদি গায়ে এসে পড়ে?

“আমি এসবের কিছুই জানি না, বিশ্বাস করুন। আমি আশ্রমে থাকতাম, মানে এখনও থাকি। যাতায়াতের সুবিধার জন্য এখানে এসে উঠেছি কয়েকদিন…” উত্তরণের গলা দিয়ে দলা-পাকানো শব্দগুলো উঠে এল।

“আমার স্ত্রী হসপিটালাইজ়ড। কাল বা পরশু ওর একটা ক্রিটিক্যাল অপারেশন হবে। আমাকে এখান থেকেই এখন একবার হাসপাতালে যেতে হবে। কাল সকালে এসে আপনার কেসটা দেখব। আপনি যে ফেঁসে গিয়েছেন সেটা বুঝতে পারছি, কিন্তু পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা, জানেন তো? আপাতত রাতটা এখানেই বসে থাকুন। কাল সকালে এসে দেখছি কী করা যায়।”

“এই মালটাও হারামি স্যার। ‘লক-আপ’এ ভরে দিন।” সেই কনস্টেবলটা বলে উঠল।

“তুমি বেশি কথা বোলো না মজুমদার। এই ভদ্রলোক বাইরেই চেয়ারে বসে থাকবেন। তারপর ওঁকে কোর্টে চালান করব না গাড়ি ডেকে বাড়ি পাঠাব, সেটা কাল সকালে আমি বড়বাবুর সঙ্গে কথা বলে ঠিক করব।” মেজোবাবু ঝাঁঝিয়ে উঠলেন।

কিন্তু মেজোবাবু বেরিয়ে যাওয়ার মিনিটদশেকের মধ্যে ওই মজুমদার উত্তরণের ফতুয়া ধরে টান মেরে লক-আপ’এ ভরে দিতে-দিতে বলল, “টাকা দেবে না, আবার সতী সাজবে। মর শালা!”

উত্তরণ ওই আধো-অন্ধকার ঘরটায় ঢুকেই টের পেলেন, অসহ্য দুর্গন্ধ। পেচ্ছাপ-পায়খানার সঙ্গে পাপ মিশলে বোধহয় এমনই গন্ধ বেরোয়।

“খুব খারাপ লাগছে ব্রাদার। আমাদের সঙ্গে তুমিও জড়িয়ে গেলে।” লক-আপ-এ বসে থাকা একটা ছেলে বলে উঠল।

“জড়িয়েই যখন গিয়েছ তখন একটু বন্ধুত্ব করে নিয়ো আমাদের সঙ্গে। নইলে সময় কাটবে কী করে?”

“এখন কবে জামিন পাব, আদৌ পাব কি না, কোনও ঠিক তো নেই।” আর-একটা ছেলে বলে উঠল।

উত্তরণ ওদের কথার কোনও জবাব না দিয়ে বসে রইলেন। ওঁর মনে পড়তে লাগল, মায়ের মৃত্যুর পর শ্মশানে বসে থাকার রাত্রিটার কথা। অনেক মৃতদেহ এসেছিল সেদিন, মায়ের পালা আসতে-আসতে ভোর হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সেই রাত্রিটার মধ্যে কোথাও একটা পবিত্রতা ছিল। মা নিজের শরীর ছেড়ে দিয়ে মিশে যাচ্ছে আকাশে, বাতাসে, জলে… সেই ভাবনাটার মধ্যে পরিত্রাণ ছিল কোথাও। এখন যেখানে বসে আছেন সেটা যেন একটা রৌরব নরক। কীভাবে মুক্তি মিলবে এখান থেকে?

শেষ রাতের দিকে ঘুমে জড়িয়ে গিয়েছিল চোখটা। সকাল হতেই লক-আপের দরজাটা খুলে একটা লোক চিৎকার করল, “এই ধুতি-ফতুয়া, বাইরে আসুন।”

উত্তরণ তাকিয়ে দেখলেন, লোকটা গতকাল রাতের সেই কনস্টেবল নয়। ওই তিনটে ছেলে পরস্পরকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে ছিল। উত্তরণ ওদের দিকে একবার তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। লক-আপ থেকে বেরিয়ে যে ঘরটায় গিয়ে ঢুকলেন সেটা থানার ওসি-র ঘর। সেখানে তখন ওসি ছাড়াও মেজোবাবু এবং কাল রাতের সেই কনস্টেবল উপস্থিত। এ ছাড়াও অন্য দু’জন ছিলেন সেই ঘরে। দুই সন্ন্যাসী। বিজয়দা এবং অনিলদা।

“আমি খুব দুঃখিত আপনাকে গতকাল রাতে লক-আপ-এ থাকতে হয়েছে বলে। চিন্তা করবেন না, আপনি এক্ষুনি ছাড়া পেয়ে যাবেন। স্যার জানামাত্রই ইনিশিয়েটিভ নিয়েছেন। ওই মজুমদার হারামজাদা টাকার জন্য এরকম করে। ওকে ক্লোজ় করা হয়েছে।” মেজোবাবু বললেন।

ঘরের কোণে দাঁড়ানো মজুমদার নিচু গলায় কী একটা বলে উঠল।

থানার ওসি চেঁচিয়ে উঠলেন, “চুপ শালা শুয়োর।” তারপরই বিজয়দা আর অনিলদাকে বললেন, “সরি মহারাজ। আমাদের প্রফেশনের ভাষা, বোঝেনই তো!” আপনারা আধঘণ্টা বসুন, তার ভিতরেই যেটুকু যা ফরম্যালিটি আছে…”

অনিলদা ওসিকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “আমরা কিন্তু জামিন জাতীয় কিছু চাইছিই না। আপনাকে প্রথমেই বলেছিলাম যে উত্তরণ ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট, তাই ওর নামে থানায় কোনও রেকর্ড থাক, এটা একেবারেই কাম্য নয়।”

“আমাদেরও তো কিছু বাধ্যবাধকতা থাকে।” মেজোবাবু বললেন।

“কিন্তু আপনারাই তো বললেন যে ব্যাপারটার মধ্যে ওকে ভুলবশত জড়ানো হয়েছে?” বিজয়দা বলে উঠলেন।

“একদমই ভুল করে। আসলে এমনই নোংরা কেস যে কিছু অ্যাকশন নিতেই হত। লোকাল প্রেশারও ছিল। কিন্তু তাই বলে যে এটার সঙ্গে বিন্দুমাত্র জড়িত নয়, তার নাম এই কেসে থাকবে না।” ওসি বললেন।

“কিন্তু কাল রাতে উত্তরণ মুখার্জির নাম যে লেখা হয়ে গেল…”

মেজোবাবুকে থামিয়ে দিয়ে ওসি বলে উঠলেন, “তুমি বাদ দাও তো। হোয়াইট ইঙ্ক দিয়ে মুছে অন্য একটা বানানো নাম বসিয়ে দেওয়া যাবে ওখানে। কোনও চিন্তা করবেন না মহারাজ। স্যার আমায় বলে দিয়েছেন, আপনাদের যাতে কোনও অসুবিধে না হয় তা দেখতে।”

মিনিট পনেরোর মধ্যে থানার বাইরে বেরিয়ে এসে একটা ট্যাক্সিতে উঠলেন বিজয়দা, অনিলদা এবং উত্তরণ। ওসির কথায় থানার লোকই ধরে দিয়েছিল ট্যাক্সিটা। অনিলদা বলা সত্ত্বেও উত্তরণ ওঁদের পাশে না বসে সামনে গিয়ে বসলেন। ওঁর মনে হচ্ছিল সারা শরীরে যেন পাঁক লেগে আছে।

ট্যাক্সিটা চলতে শুরু করলে বিজয়দা বললেন, “ভুল আমার, তোমার নয়। আমার আশ্রমের সম্পদকে আমি যদি বাইরে রাখি, তা চুরি হয়ে যেতে পারে। তার গায়ে কাদা লাগতে পারে। তোমাকে এখানে পাঠানো আমার উচিত হয়নি। তোমার সেই বন্ধুর কথা শুনে.”

অনিলদা বিজয়দার কথার মধ্যেই বলে উঠলেন, “থাক ওইসব বিশ্লেষণ। উজ্জ্বলকে আশ্রমে ফিরে একটা ফোন করে দিতে হবে, ও সাহায্য না করলে সমস্যা বাড়ত।

“হ্যাঁ, আমার তরফ থেকে ওকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ো।” বিজয়দা বললেন।

“ও কৃতজ্ঞতা চায় না, আশীর্বাদ চায়।” অনিলদা বললেন।

“আশীর্বাদ করার ক্ষমতা কি আমাদের আছে অনিল? কাজ হয় কিছু আমাদের আশীর্বাদে?”

বিজয়দার প্রশ্নের উত্তরে অনিলদা কিছু বলার আগেই উত্তরণ জিজ্ঞেস করলেন, “আপনারা ট্যাক্সিতে এলেন কেন? আশ্রমের গাড়ির কী হল?”

“কিছুই হয়নি। কিন্তু তোমার সঙ্গে যা হয়েছে তা আশ্রমের অন্য কারওর কান অবধি পৌঁছক, আমরা চাইনি।” বিজয়দা বললেন।

“আপনারা জানলেন কী করে?”

“গুরুদেব জানিয়েছেন।” বিজয়দা বললেন।

উত্তরণ উত্তরে কিছু না বলতে পেরে চুপ করে রইলেন।

ট্যাক্সিটা যখন প্রায় আশ্রমের কাছে চলে এসেছে, বিজয়দা জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি আজ সকালে জপ করেছিলে বুবাই?”

এই এতক্ষণে কান্নাটা বুক থেকে গলায় উঠে এল উত্তরণের।

পক্স সেরে গেলে মুখের দাগও মিলিয়ে যায় এক সময়ে, কিন্তু ওই একরাত্রি হাজতবাসের ক্ষত এমন ফালাফালা করে গিয়েছিল উত্তরণের অন্তরকে যে আশ্রমে ফিরে এলেও সেই আগের স্বস্তি আর শান্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। প্রতি মুহূর্তে মনে হত, যতটা পবিত্রতা থাকলে আশ্রমের সমস্ত কাজ করা যায়, ততখানি পবিত্রতা বোধহয় ওঁর মধ্যে আজ আর নেই। তাই পুজোর কাজ কিংবা ঠাকুরের সমাধি সাজানোর চাইতে আশ্রমের পায়খানা-বাথরুম পরিষ্কার করা বা উঠোন ঝাঁট দেওয়ার কাজে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন।

কয়েকদিন পরে বিজয়দা এক সন্ধ্যায় উত্তরণকে ঘরে ডেকে দরজা ভেজিয়ে দিয়ে বললেন, “একটা কথা তোমায় জানানো দরকার। হয়তো পরে বললেও হত, কিন্তু কবে কী হয়, তাই বলে রাখাই ভাল। এই শরীরটার ক্যানসার ধরা পড়েছে।”

উত্তরণ চমকে তাকালেন, আর সেই অবস্থাতেও খেয়াল করলেন, বিজয়দা ‘আমার’ না বলে এই শরীরটার বললেন।

উত্তরণ চুপ করে আছেন দেখে বিজয়দা বললেন, “আমি এটা নিয়ে বেশি হইচই চাই না। তাতে আশ্রমের কাজ ব্যাহত হবে। কিন্তু আমার যেটা জানা দরকার তা হল, তুমি নিজে কতটা প্রস্তুত হতে পেরেছ বলে তোমার মনে হয়?”

“কী ব্যাপারে?”

“তোমার কি স্মৃতিবিভ্রম হয়েছে নাকি? তোমায় আমি জানাইনি, ঠাকুরের ইচ্ছা কী? তিনি কোন কাজের জন্য তোমায় নির্বাচন করে গিয়েছেন?” বিজয়দা যেন খানিকটা বিরক্ত।

“আমি ভিতর থেকে সাড়া পাই না।”

“সাড়া পাও না মানে?”

“মানে আমার সঙ্গে যা ঘটেছে, তারপর…”

“তুমি নিজের সঙ্গে ঘটা একটা খারাপ ঘটনা নিয়েই বুঁদ হয়ে আছ। অথচ আগামী দিনে এই আশ্রমের গুরুদায়িত্ব তোমার উপরেই। গুরুদেবের ভাবধারার প্রচার, প্রসার কীভাবে হবে তা নিয়ে ভাবতে হবে তো তোমায়। তোমার এম এ পরীক্ষার আর ক’দিন বাকি?”

“চার-পাঁচ মাস মতো।”

“তারপর?”

“ভাবছিলাম পিএইচ ডি-টা করব। ঠাকুরের বাণীর আলোকে ‘শ্রীমদ্ভাগবত গীতা’র উপর কাজ করার কথা ভেবেছি।”

“তার থেকে জরুরি কাজ এখন আমাদের সামনে বুবাই। ভুবনেশ্বরের শাখা আশ্রমের নাটমন্দির অসম্পূর্ণ হয়ে পড়ে আছে। আমাদের টাকা নেই যে এই মুহূর্তে তা সম্পন্ন করি। ঠাকুরের নামে যে দাতব্য চিকিৎসালয়গুলো চলে, প্রতিদিন সেখানে বেশি-বেশি মানুষ আসছেন। কিন্তু আমরা সেই অনুযায়ী ওষুধ কিংবা ডাক্তারের জোগান দিতে পারছি না। এসবের জন্য আরও অর্থের জোগান চাই, প্রভাবশালী মানুষদের সাহায্য চাই। সবথেকে আগে যেটা চাই তা হল, আরও নতুন-নতুন শিষ্য-ভক্ত। সবাই সম্মিলিত হয়ে ঠাকুরের কাজে ব্রতী হলে, সত্যসেবী আশ্রমের কাজ আরও ব্যাপ্তি পাবে। আমার যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে, আমি বুঝতে পারছি। তাই বলছি, তোমাকে ঈশ্বর সাধকোচিত চেহারা এবং শক্তি দিয়ে পাঠিয়েছেন। পড়াশোনা তো অনেক হল, এবার ঠাকুরের জন্য তোমাকে জীবন উৎসর্গ করতে হবে।”

বিজয়দার কথার উত্তরে কিছু বলতে পারলেন না উত্তরণ। ওঁর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে লাইব্রেরিতে গিয়ে বসলেন। চোখের সামনে রাধাকৃষ্ণন-এর ‘দ্য প্রিন্সিপ্যাল উপনিষদ’স বইটা মেলে ধরলেন, কিন্তু পাতাগুলো উলটে যেতে থাকল হাওয়ায়। অক্ষরগুলো চোখে ধাক্কা খেয়ে ফিরে যেতে লাগল পৃষ্ঠায়। একটি ব্যাখ্যাও মাথার ভিতর পর্যন্ত পৌঁছতে পারল না।

বইয়ে মাথা রেখে চোখ বুজে ফেলেছিলেন ক্লান্ত উত্তরণ। অনিলদা এসে পিঠে হাত রাখতেই চমকে উঠলেন।

অনিলদা বললেন, “সেদিন বিজয়দা কেন তোমায়, জপ করেছ কি না জিজ্ঞেস করেছিলেন জানো?”

“না।” উত্তরণ অস্ফুটে বললেন।

“বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী একবার তাঁর প্রিয় শিষ্য কুলদানন্দ ব্রহ্মচারীকে বলেছিলেন, ‘কুলদা, তুই জপে ফাঁকি দিচ্ছিস।’ কুলদানন্দ অবাক হয়ে গিয়ে জানিয়েছিলেন যে তিনি তো সারাক্ষণই জপ করেন। উত্তরে বিজয়কৃষ্ণ পালটা প্রশ্ন করেন, ‘পায়খানা-বাথরুমে যখন যাস তখন জপ করিস?’ উত্তর না দিতে পেরে কুলদানন্দ যখন চুপ তখন বিজয়কৃষ্ণ বলেন ‘কেন করিস না রে? ওখানে আমি নেই?’”

“তাই বলে ওই লক-আপে…”

অনিলদা উত্তরণকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “হ্যাঁ লক-আপে। শুধু লক-আপে নয়, স্টেশনে, রাস্তায়, ফুটপাথে, ঠাকুর সর্বত্র উপস্থিত। তুমি যে রাতটা হাজতে ছিলে, সেই রাতটা আমরা কেউ তোমার সঙ্গে থাকতে পারিনি। কিন্তু গুরুদেব সারাক্ষণ ছিলেন। তোমার ভিতরেই জেগে ছিলেন।”

“এমনটা হল কেন আমার সঙ্গে?”

“তুমি তো একবারও ভাবছ না আরও কী-কী হতে পারত তোমার সঙ্গে! তোমায় কোর্টে তোলা হতে পারত। সাত দিনের পুলিশ কাস্টডি হতে পারত। জেলও হয়ে যেতে পারত বছরখানেকের। ঠাকুর চেয়েছিলেন বলেই একজন বড় পুলিশ অফিসারের মুখ থেকে আমরা খবর পেলাম। ছুটে যেতে পারলাম তোমায় ছাড়িয়ে আনতে।

“কে সেই অফিসার? ‘উজ্জ্বল’ বলে যাঁর কথা বলছিলেন সেদিন, তিনিই? আমার তো তাঁকে একটা ধন্যবাদ জানানো দরকার।”

“তিনি ধন্যবাদের আশায় কাজ করেননি বুবাই। তাই তাঁর সঙ্গে তোমার কথা না বললেও চলবে। আর বাকি সবাই তো মাধ্যম মাত্র। তোমায় রক্ষা করেছেন, ঠাকুর স্বয়ং।”

“তা হলে এখন আমি…”

উত্তরণকে আবারও থামিয়ে দিয়ে অনিলদা বললেন, “আগে যেমন ছিলে, ঠিক তেমনই থাকবে। থাকবে কী, তেমনই আছ। মনে রেখো ঠাকুরের সন্তানকে ঠাকুর কাদায় পড়তে দেন না, নিজের কোলেই রাখেন।”

অনিলদার কথায় সামনের ধোঁয়াটা কেটে গেলেও ভিতরের গুমোট কাটল না। উত্তরণ আশ্রমে থেকেই ইউনিভার্সিটি যাতায়াত করা শুরু করলেন! মধ্যে একদিন ষষ্ঠীকে সঙ্গে নিয়ে ওই ফ্ল্যাট থেকে নিজের বইপত্র আর ঠাকুরের প্রতিকৃতি নিয়ে এলেন কেবল। ফ্ল্যাটের ভিতর সব গোছাতে সময় লাগল হয়তো দশমিনিট কিন্তু উত্তরণের মনে হচ্ছিল দশ ঘণ্টা। যতক্ষণ ওখানে ছিলেন, প্রতিটা পল যেন চাবুক মারছিল, আত্মায়।

কলেজ স্ট্রিটের রাস্তায় দিনদশেকের মাথায় রজত বলে একটি ছেলে ওঁকে জিজ্ঞেস করল, “কী একটা ঝামেলা হয়েছে শুনলাম?”

উত্তরণ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন কোনও উত্তর না দিয়ে। ছেলেটা সামনে থেকে সরে গেল একসময়। তারপর যে ক’দিন ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছেন, উত্তরণের অবচেতনে কেউ একটা বলে উঠেছে, এই বুঝি আবার কেউ এসে জানতে চাইল, কোন গন্ডগোলে হাজতে থাকতে হয়েছিল।

শাস্তির ভয়টাই শাস্তি। আতঙ্কের জন্য অপেক্ষাই সবচেয়ে বড় আতঙ্ক। উত্তরণ সেই যন্ত্রণা ভিতরে বয়েই এম এ পরীক্ষা দিলেন আর দেওয়ার পরপরই বিজয়দার আদেশে ভুবনেশ্বরে গেলেন। ভৌগোলিক দূরত্ব যে মানুষকে শান্তিও দিতে পারে, ভুবনেশ্বর না এলে তা বুঝতেন না উত্তরণ। শাখা আশ্রমের যাবতীয় কাজের মধ্যে ডুবে গিয়ে ওঁর আর মনেও পড়ত না, ইউনিভার্সিটি কিংবা পিএইচ ডি-র কথা। ভুলে যাচ্ছিলেন সেই এক রাতের ভয়াবহতার স্মৃতিও!

জগন্নাথদেবকে দর্শন করবেন বলে পুরী গেলেন একদিন উত্তরণ। যে দিন পুজো দিলেন সে দিন সন্ধ্যায় সমুদ্রের তটে বসে ওঁর কেবলই মনে পড়ছিল মন্দিরের পাণ্ডা মধুসুদন মহাপাত্রের বলা কথাগুলো। ঠাকুরের তিরোধানের দিন মধুসূদন নাকি বিগ্রহে বিলীন হয়ে যেতে দেখেছিলেন গুরুদেবকে। কিন্তু উত্তরণ তো ছোটবেলা থেকে ঠাকুরের কাছেই শুনেছেন যে, ‘চমৎকার’ কোনও সাধকের বিষয় নয়। ওটা ম্যাজিশিয়ানের কাজ। তা হলে?

রাত বাড়তে উত্তরণ নিজের মনেই উত্তরটা পেলেন, রবীন্দ্রনাথের একটা লাইনে। ‘ফুরায় যা তা ফুরায় শুধু চোখে’। মন যাকে প্রবল ভাবে চাইছে চোখ বন্ধ করে তাঁকে দেখতে পাওয়াই প্রেম কিংবা ভক্তি। সেটা ছাড়া শুধু জ্ঞানের আলোয় পৃথিবী চলত না। প্রিয়তমকে যদি শিল্পে দেখতে পান শিল্পী, ভক্ত তাকে বিগ্রহে দেখতে পাবেন না কেন?

প্রশ্নটা মাথায় নিয়ে পরদিন সকালে ভুবনেশ্বরে ফিরে উত্তরণ শুনলেন, ওঁর সঙ্গে কথা বলবেন বলে ফোন করেছিলেন অনিলদা। শাখা আশ্রমের ল্যান্ডলাইন থেকে কলকাতায় ফোন করে উত্তরণ জানলেন যে এম এ-র রেজ়াল্ট বেরিয়েছে। খবরটা শুনে বিন্দুমাত্র আগ্রহ বা উৎকণ্ঠা জন্ম নিল ভিতরে। ঠাকুরের কাজে যিনি ব্রতী, তাঁর আবার আলাদা করে কোন পরীক্ষা? কীসের রেজ়াল্ট? কেবল মনে হল, এত দ্রুত আড়াই-তিন মাস সময় কেটে গেল?

আনরিজ়ার্ভড কমপার্টমেন্টে চেপে হাওড়া স্টেশনে নেমে উত্তরণ একবার ভাবলেন আশ্রমে ফিরে যাবেন। পরক্ষণেই মনে হল, তা হলে আবার কাল আসতে হবে। পড়াশোনার সঙ্গে সম্পর্ক যখন চুকিয়েই দেবেন ভেবেছেন, তখন আবার একদিন নষ্ট করে লাভ? তাই কলেজ স্ট্রিটের বাসেই উঠলেন শেষে।

ডিপার্টমেন্টের মুখেই দেখা হয়ে গেল অনিন্দ্য সেনের সঙ্গে। উত্তরণের পিঠ চাপড়ে স্যার বলে উঠলেন, “কনগ্রাচুলেশনস, ফার্স্ট বয়।”

ইউনিভার্সিটির পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়ার খবর পেয়ে সাধারণত খুব আনন্দ পাওয়ার কথা। কেন তবে প্রবল একটা নিরাসক্তি গ্রাস করল উত্তরণকে? কেন মনে হল লাস্ট হলেও তেমন কিছু ফারাক হত না?

অনিন্দ্য সেন জিজ্ঞেস করলেন, “কোথায় বেপাত্তা হয়ে গিয়েছিলে বলো তো? কী নিয়ে পিএইচ ডি করবে কিছু ঠিক করলে?”

“আমি পিএইচ ডি করব না।”

“পাগলের মতো কথা বলছ কেন?”

“না স্যার, সজ্ঞানেই বলছি। আমি অন্য কাজ করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”

“তোমার ওই আশ্রম?”

উত্তরণ চুপ করে রইলেন।

স্যার বললেন, “করো না যত খুশি নামগান। বি এ, এম এ-র মতো রোজ ক্লাসে তো আর আসতে হবে না। লাইব্রেরি আর ইউনিভার্সিটির সময়টুকু বাদ দিয়ে গলায় খোল ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়বে।”

উত্তরণ হেসে ফেললেন, “গলায় খোল ঝুলিয়ে ঘোরা ছাড়াও আশ্রমিকের অনেক কাজ থাকে। আপনাকে বোঝাতে পারব না হয়তো।”

“আমি বুঝতে চাইও না, ইউনিভার্সিটির চল্লিশ বছরের রেকর্ড ভেঙে দেওয়া ছেলেটা কেন পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে গায়ে ভস্ম মেখে ধ্যান করবে! কাল একটা মাধ্যমিক ফেল বা পাস গ্র্যাজুয়েট ছেলে হিমালয় চলে যেতে পারে সাধু হতে। কিন্তু তুমি অ্যাকাডেমিকস ছেড়ে দিলে ভবিষ্যতের কত ছাত্রছাত্রী বঞ্চিত হবে ভেবে দেখেছ?”

“সেসব ভাবার অধিকার আমার নেই স্যার।

অনিন্দ্য সেন উত্তরণের দু’টো কাঁধ ধরে ঝাঁকাতে শুরু করলেন, “কেন নেই? তুমি কি ক্রীতদাস?”

“না। আমি নির্বাচিত।”

“নির্বাচন কে করেছেন?”

“আমার ঠাকুর, স্যার।”

“তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, তিনি সত্যিই যদি তোমার মঙ্গল চেয়ে থাকেন, তা হলে পড়াশোনার জগৎ থেকে তোমায় ছিনিয়ে নেবেন না অন্তত। যাও তাঁকে আজই জিজ্ঞেস করো, তিনি কী চান। যা উত্তর পাবে, আমাকে বলবে।”

স্যারের কাছ থেকে সরে এসে উত্তরণ ভাবলেন, কেন তিনি বলতে পারলেন না যে তাঁর ঠাকুর এখন আর স্থূলদেহে নেই ! প্রশ্ন করামাত্র আর উত্তর পাওয়া যায় না তাঁর থেকে। তাঁর উত্তর বুঝে নিতে হয়।

কিন্তু সত্যিই যদি জিজ্ঞেস করতেন, কী হত ঠাকুরের উত্তর? ঠাকুর তো উত্তরণকে মন দিয়ে পড়াশোনা করতে বলেছিলেন। একবারও তো বলেননি এম এ-র পর পড়া ছেড়ে দিতে। তা হলে বিজয়দা যা চাইছেন আর ঠাকুর যা চেয়েছিলেন, দুইয়ের মধ্যে কোথাও কি কোনও…

ইউনিভার্সিটির গেট পেরিয়ে উদভ্রান্তের মতো রাস্তা ধরে হাঁটছিলেন উত্তরণ। মাথার ভিতরে একটা অনিঃশেষ কাটাকুটির খেলা চলছিল। ধ্যান না গবেষণা, ব্ৰত না বিস্তার?

হঠাৎ একটা হ্যাঁচকা টানে কক্ষচ্যুত হয়ে যেন অন্য কোনও পৃথিবীতে আছড়ে পড়লেন উত্তরণ। প্রবল শব্দে একটা বাস পেরিয়ে গেল পাশ দিয়ে। চেতন-অবচেতনের মাঝখানে আবিষ্কার করলেন একটি মেয়ে জড়িয়ে ধরে আছে ওঁকে।

প্রাথমিক ঘোরটা কেটে যেতে যতক্ষণ… উত্তরণ কাঁপতে শুরু করলেন থরথর করে।

অনসূয়া নিজের আলিঙ্গন থেকে ওঁকে মুক্তি দিয়ে বলল, “মারবেন? নিজে মরে গিয়ে আমাদের সবাইকে মারবেন?”

সেদিন রাতে বারবার ওই কুড়ি বা তিরিশ সেকেন্ডের অভিঘাত কাঁপিয়ে দিচ্ছিল উত্তরণকে। মনে হচ্ছিল, অনসুয়া ওঁকে জড়িয়ে ধরল কেন? আবার মনে হচ্ছিল, যদি অনসূয়া জড়িয়ে না ধরত, তা হলে কী হত? অপঘাতে মৃত্যু হলে তো নরকে যেতে হয় বলে শুনেছেন। অন্যদিকে, ‘নারী নরকের দ্বার’, শুনেছেন তা-ও। কিন্তু নরকে যাওয়া থেকে যে বাঁচায়, সে নিজেই কীভাবে নরকের দরজা হয়?

পরদিন ভোরে গুরুপূজা করতে-করতে মন শান্ত হয়ে এল অনেকটা। সত্যসেবী আশ্রমের ভিতরে কিংবা বাইরের ধর্মসভায় উত্তরণ কতবার ব্রহ্মচারী ঠাকুরকে বলতে শুনেছেন, “মেয়েদের নিষ্ঠা, বিশ্বাস, উদ্যম ও ঐকান্তিকতার প্রয়োজন আছে আমার। মেয়েরাই সংসারের মেরুদণ্ড। প্রতিটি সংসারকে আদর্শ সংসারে পরিণত করার গুরুদায়িত্ব তাদের উপরেই ন্যস্ত। তারাই নিজ-নিজ সন্তানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে, পুরুষরা ভুল পথে চললে তাদের ঠিক পথে নিয়ে আসে৷” কই, মেয়েদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই সর্বনাশ হয়ে যাবে, এমন কথা কখনও তো বলেননি ঠাকুর!

ঠাকুর না বললেও মানুষ বলে। আর মানুষের জিভে লাগাম দেবে, কার সাধ্য? বিজয়দার সেবাইত সন্তুর ডাক পেয়ে বিজয়দার ঘরে যেতেই উত্তরণ বুঝতে পারলেন সেই কথা।

গুরুদেবের পুরনো শিষ্যদের অন্যতম কমলাক্ষ গুহ উত্তরণকে দেখেই গলা তুললেন, “আপনি ওকেই জিজ্ঞেস করুন না, কাল সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের রাস্তা ধরে একটা মেয়ের হাতে হাত ঢুকিয়ে হাঁটছিল কি না?”

উত্তরণের মাথায় কেউ যেন বন্দুক ঠেকিয়ে ট্রিগারটা টেনে দিল। সত্যিই তো, অনসূয়ার ওঁকে বাসের মুখ থেকে ছিনিয়ে আনাতেই শেষ হয়ে যায়নি ব্যাপারটা। মেয়েটা তারপর উত্তরণের হাত ধরে হেঁটেছিল বেশ কিছুক্ষণ। উত্তরণ তখন এমন মানসিক অবস্থায় ছিলেন যে ওকে বারণ করার কথাও মনে আসেনি। স্থিতি ফিরে আসার পরও ওই আলিঙ্গনের ব্যাপারটাই মাথায় ঘুরছিল, আলাদা করে হাত ধরে হাঁটার কথাটা ভুলেই গিয়েছিলেন।

“ঠাকুর না চাইলে আমি তখন ওখান দিয়ে যাব কেন? ঠাকুরই নিশ্চয়ই চাইছিলেন যে ওই সব কীর্তিকলাপ আমার চোখে পড়ুক আর আমার মাধ্যমে আপনিও জানুন, কীরকম অপদার্থকে আপনি আশ্রমের নতুন সন্ন্যাসী করবেন বলে ঠিক করেছেন!” কমলাক্ষ গুহ বলে উঠলেন।

উত্তরণ শুনতে-শুনতে ভাবছিলেন, কমলাক্ষ গুহ যে ওখান দিয়ে যাচ্ছিলেন, সেটা যদি ঠাকুরের ইচ্ছে হয়ে থাকে, তা হলে অনসূয়া এসে যে ওঁকে বাঁচাল, সেটা কার ইচ্ছে ছিল?

“কমলাক্ষদা যা বলছেন তা কি সত্যি?” কেমন একটা ধরা গলায় জিজ্ঞেস করে উঠলেন বিজয়দা।

“একটা বাসের মুখে পড়তে যাচ্ছিলাম কাল। ওই মেয়েটিই আমাকে বাঁচায়। তারপর ঠিক কী হয়েছিল…”

“কী হয়েছিল, সেটা তো আমিই বলে দিলাম। তুমি সেই রাধিকাকে জড়িয়ে ধরে বৃন্দাবনের পথে হাঁটতে শুরু করলে। আরও কিছু করেছ কি না জানি না অবশ্য। ছ্যাঃ। বিজয়দা, এইসব ব্যভিচারীদের কিন্তু আশ্রমে আমরা মেনে নেব না, আগেই বলে দিচ্ছি?” উত্তরণকে থামিয়ে দিয়ে বললেন কমলাক্ষ গুহ।

বিজয়দা একটা হাত তুলে থামতে বললেন কমলাক্ষকে। তারপর উত্তরণের চোখে চোখ রেখে বললেন, “তুমি কি সংসার ধর্মের কথা ভাবছ? অধঃপতনের রাস্তায় একটা পা পড়েছে বলে মার্বেলের গুলির মতো শেষ ধাপ পর্যন্ত নামতে হবে? তুমি জানো না ঠাকুরের ইচ্ছা কী? ঠাকুর তো চাননি, তুমি অধ্যাপনা কিংবা অন্য কোনও চাকরি করো, বিয়ে-থা করে সন্তান মানুষ করো। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর নাম তুমি পৌঁছে দেবে সারা পৃথিবীতে। সে কথা ভুলে গিয়েছ?”।

“ভুলিনি। এই পৃথিবীর যেখানেই থাকি…”

“যেখানেই থাকি মানে কী? তুমি কি স্যুট-প্যান্ট পরে বিদেশ যাওয়ার পরিকল্পনা করছ?”

“আপনি ভুল বুঝছেন বিজয়দা।”

“বোঝার তুমি কী বাকি রেখেছ বুবাই? যেদিন দুর্ঘটনা ঘটেছিল, সেদিন আমি খবর পাওয়ামাত্র অনিলকেনিয়ে ছুটে গিয়েছিলাম। কিন্তু কাল যে দৃশ্য কমলাক্ষদা দেখেছেন স্বচক্ষে, তাতে তুমি জড়িত নও, আমি কীভাবে দাবি করব?”

“হাতে দই, পাতে দই, তবু বলে, কই, কই? ওর সেই মুখ আছে যে নিজেকে নির্দোষ দাবি করবে?” কমলাক্ষ গুহ বললেন।

আশ্চর্য, এত অপমানের মধ্যেও উত্তরণ নিজেকে ঘেন্না করার মতো কিছু পেলেন না। ওঁর বারবার মনে হচ্ছিল, সেদিন লক-আপ থেকে ছাড়াতে যেমন অনিলদা আর বিজয়দাকে থানায় পাঠিয়েছিলেন ঠাকুর, কাল ওই ছুটন্ত বাসের মুখ থেকে রক্ষা করতে অনসূয়াকেও ঠাকুরই পাঠিয়েছিলেন। তারপর কিছুক্ষণের জন্য যদি বিহুলতা এসে গ্রাস করে থাকে উত্তরণকে, তার দায় কি ওঁরই?

বিজয়দার মনের ভিতর তখন অন্য তোলপাড় চলছিল নিশ্চয়ই। নইলে হঠাৎ করে উঠে দাঁড়িয়ে, তাঁর ঘরের দেওয়ালে ঠাকুরের যে প্রতিকৃতি আছে তার দিকে তাকিয়ে কেন বললেন, “ঠাকুর, আমি পারলাম না! আপনি যে দায়িত্ব আমাকে দিয়েছিলেন, আমি তা পালন করতে পারলাম না।” বলেই উত্তরণকে অবাক করে ঠাকুরের ছবিতে মাথা ঠুকতে লাগলেন।

“মহারাজ আপনি থামুন। কী করছেন?” বলতে-বলতে উত্তরণ উঠে গিয়ে বিজয়দার হাতটা ধরলেন।

বিজয়দা এক ঝটকায় নিজের হাতটা সরিয়ে নিয়ে বললেন, “আমায় ছুঁয়ো না তুমি। আমার জ্বালা করছে।”

বিজয়দার সেবাইত সন্তু ছুটে এসে ধরে না ফেললে হয়তো মাটিতেই পড়ে যেতেন তিনি, একটা অঘটন ঘটে যেত তখনই। কিন্তু চৌকিতে বসে পড়ার পরও তাঁর মুখ-চোখ রক্তবর্ণ হয়ে রইল রাগে। যেন পলকে বিস্ফোরণ ঘটবে।

বিজয়দা গ্লাস থেকে নয়, একটা ঘটি থেকে আলগা করে জল খেতেন। বরাবর। সন্তু নিজে থেকেই ঘটিটা তাঁর দিকে এগিয়ে দিতে সেটা উঁচু করে এক ঢোঁক জল খেলেন বিজয়দা। দ্বিতীয় ঢোঁকটা খাওয়ার সময়ই হাত থেকে ঘটিটা পড়ে গেল। গায়ের গেরুয়া গেঞ্জি, চৌকির উপর পাতা চাদর — সব ভিজে গিয়েছে, ঘটিটা গড়াতে গড়াতে থেমে গিয়েছে সামনের মেঝেয়, সেই অবস্থায় বিজয়দা বললেন, “মনে রেখো বুবাই, ‘শিব রুষ্ট হলে গুরু রক্ষা করে তারে, গুরু রুষ্ট হলে কেহ রক্ষিতে না পারে। তুমি গুরুদেবের সঙ্গে কথার খেলাপ কোরো না।”

“এটা কথার খেলাপ? আগামী জগদ্ধাত্রী পুজোয় আপনি যাকে সন্ন্যাস দেবেন বলে ঘোষণা করে দিয়েছেন, সে যখন একটি মেয়েকে জড়িয়ে ধরে হাঁটে, সেটা কথার খেলাপ নয়, ঘোরতর অপরাধ। সেই অপরাধ আপনি মেনে নিতে পারেন, আমি মানব না। সামনের ট্রাস্টি মিটিংয়ে…”

কমলাক্ষ গুহকে থামিয়ে দিয়ে বিজয়দা চিৎকার করে উঠলেন, “কী চান আপনি? আমি খুন করব বুবাইকে? সে ক্ষমতা যদি থাকত আমার, তা হলে এখনই ওর প্রাণটা নিয়ে আপনাকে শান্তি দিতাম। কিন্তু গুরুদেব যে আমায় বিশেষভাবে বলে গিয়েছিলেন এই ছেলেটাকে পাখির মায়ের মতো আগলে রাখতে।”

“আগলে হয়তো রেখেছেন, কিন্তু সন্ন্যাসী কিংবা ব্রহ্মচারী হওয়ার উপযুক্ত করে তৈরি যে করতে পারেননি, তার সাক্ষী তো আমি।” কমলাক্ষ গুহ বললেন।

“তার দোষ তো বিজয়দার নয়, আমার। আমি সেই অপরাধের শাস্তিস্বরূপ আজই যদি আশ্রম ছেড়ে চলে যাই, আপনি বিজয়দাকে নিষ্কৃতি দেবেন?” উত্তরণ স্বভাববিরুদ্ধ ঢঙে গলা তুললেন।

“এখানে নিষ্কৃতি দেওয়ার কথা উঠছে না, আশ্রমের পরিবেশ পবিত্র রাখার কথা হচ্ছে।”

“আমি চলে গেলেই তো পরিবেশ পবিত্র হয়ে যাবে। তা হলে আর সমস্যা কোথায়?”

“সমস্যা তো আমি তৈরি করিনি, দুধ-কলা খাওয়া যেসব কালসাপ এখানে আছে, সমস্যা তারাই।” কমলাক্ষ উঠে দাঁড়ালেন।

বিজয়দা দু’টো হাত দিয়ে মাথা চেপে বসেছিলেন, হাতদু’টো সরিয়ে বলে উঠলেন, “চলে যাও বুবাই, তুমি নিজের মুখে যা বলেছ, তাই করো। এখানে থেকে এত কথা শুনতে হবে না তোমায়।”

দুপুরে যখন নিজের সামান্য জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়েছেন উত্তরণ, তখন হন্তদন্ত হয়ে ওঁর ঘরে ঢুকলেন অনিলদা। ঢুকেই জড়িয়ে ধরলেন উত্তরণকে।

সেই স্পর্শের মধ্যে একটা কিছু ছিল, উত্তরণ কেঁদে ফেললেন।

অনিলদা ওঁকে শান্ত হওয়ার সময় দিয়ে বললেন, “এক সপ্তাহ কাশী কিংবা নবদ্বীপের শাখা আশ্রমে গিয়ে ঘুরে এসো। হাওয়া ঠান্ডা হয়ে যাবে ততদিনে।”

“কিন্তু আমার ভিতরের আগুনটা তো জ্বলতেই থাকবে অনিলদা।”

“লোকের কথায় অত পাত্তা দিলে চলে না। ‘লোককে পোক মনে করতে হয়’ সময়-সময়। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, ওই লোকটার অত জাতক্রোধ কেন তোমার উপর?”

“এভাবে বলছেন কেন? উনি তো ঠাকুরের পুরনো শিষ্য।”

“তাতে কী? এই আধ্যাত্মিক জগতে যদি থাকো, তা হলে দেখবে যে এমন অনেকে ভক্ত সেজে আছে যারা আদতে খুব নিচু মানসিকতার। তোমার মনে প্রশ্ন জাগবে, এইসব লোক মঠ-মিশনের ভিতরমহলে ঢুকল কী করে? একটু তলিয়ে ভাবলে বুঝবে, এই লোকগুলো বাইরে থাকলে সমাজ-সংসারের আরও বড় ক্ষতি হয়ে যেত। মহাপুরুষরা তাই এদের নিজেদের কাছে ধরে রাখেন। শিব যেমন বিষ ধারণ করেছিলেন গলায়। ব্রহ্মচারী ঠাকুরও তেমন কতবার যে নীলকণ্ঠ হয়েছেন।”

“আগেরবার ঠাকুরের জন্মোৎসবের সময় আমি যখন সমাধিমন্দিরে ছিলাম, তখন উনি এসে আলাদা করে তিন-চারটে প্রসাদী মিষ্টির প্যাকেট চেয়েছিলেন।”

“তুমি দাওনি?”

“আমি বলেছিলাম যে দিতে হলে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অজস্র শিষ্য-ভক্তের সবাইকেই দিতে হবে। উনি একটু আড়াল করে ওঁর হাতে তুলে দিতে বলেছিলেন। সেটা মানা সম্ভব হয়নি আমার পক্ষে। কিন্তু অনিলদা, আমার মনে হয় না যে উনি সেই রাগে এই কাণ্ডটা ঘটিয়েছেন। হয়তো সত্যিই একটি মেয়ের হাত ধরে আমাকে হাঁটতে দেখে খারাপ লেগেছিল ভদ্রলোকের।”

“আচ্ছা বুবাই, বুদ্ধদেব যখন সাধনায় বসে প্রায় মারা যাচ্ছিলেন, তখন তাঁর হাতে পায়েস তুলে দিয়েছিলেন সুজাতা। আমরা যদি সেই সময়টায় চলে যাই, পায়েসের বাটি দেওয়া কিংবা নেওয়ার সময় সুজাতার হাত কি বুদ্ধের হাতে লাগেনি? কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয়েছিল তাতে?”

“কিন্তু আমি তো কোনও সাধনায় বসিনি। বাসে কাটা পড়তে-পড়তে না পড়ে, আমার বোধবুদ্ধি তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিল।”

“তোমার জায়গায় আমি থাকলে, আমারও যেত।”

“কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই আমার মতো কারওর হাত ধরে হাঁটতেন না রাস্তা দিয়ে।”

“কে বলতে পারে বুবাই? বিশ্বামিত্র কি আমার চেয়ে কম ক্ষমতাসম্পন্ন ঋষি ছিলেন? তাঁর ধ্যানভঙ্গ হয়নি?”

“আমার সব গুলিয়ে যাচ্ছে।”

“তাই তো বললাম, কয়েকটা দিন ঘুরে এসো।”

“কয়েকদিনের মধ্যেই আবার আমাকে আশ্রমে দেখা গেলে, বিজয়দাকে এত কটুকাটব্যের মুখোমুখি হতে হবে যে মহারাজের শরীর আরও খারাপ করবে।”

“দ্যাখো, প্রেসিডেন্ট মহারাজের ভাগ্যে যদি কটু কথা থাকে, তা হলে তুমি না থাকলেও শুনতে হবে। যেমন তোমার ভাগ্যে যদি আশ্রমের বাইরে যাওয়া থাকে, তা হলে আমি আটকাতে পারব না। আমি শুধু বলব, হঠকারী কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ো না।”

“নিচ্ছি না। শুধু ঠাকুরের ওই কথাটা, নিজের ক্ষতিতে ভয় পেয়ো না, দেখো যেন আশ্রমের ক্ষতি না হয়, এটা মেনে চলার চেষ্টা করছি।”

“তোমার সত্যিই মনে হচ্ছে যে তুমি থাকলে, আশ্রমের ক্ষতি হবে? মনে হলে, তোমাকে আটকাব না। কিন্তু এই ভাবনাটা সাময়িক, আমার মন বলছে। তোমার মন যখন বলবে, তখন ফিরে এসো।”

“ফিরতে চাইলেই ফিরতে পারব?”

অনিলদা হেসে উঠলেন, “কেন পারবে না? তবে আগে বলো, যাবে কোথায়?”

আশ্রম থেকে বেরিয়ে উত্তরণের মনে হল, যেখানেই যান ওঁকে আগে একবার অনসূয়ার কাছে যেতে হবে। জিজ্ঞেস করতে হবে, গতকাল একসঙ্গে হেঁটে যাওয়ার সময় উত্তরণ কি এমন কিছু করেছেন, যা অন্যায়? কমলাক্ষবাবুর কাছে যা গর্হিত, অনসূয়ার কাছে সেটাই হয়তো উচিত। পৃথিবী এক-একটা চশমার ভিতর দিয়ে এক-একরকম। তবু আশ্রমিকের একটা লক্ষণরেখা তো থাকেই। আর কাল সেই লক্ষণরেখা অতিক্রম করেছিলেন উত্তরণ। কিন্তু সেটা কি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে?

প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়ার জন্য অনসূয়ার কাছে যাওয়া জরুরি। কিন্তু কোথায় ওর বাড়ি? কালই একবার আবছা শুনেছিলেন উত্তরণ, বরানগরের কোন একটা পাড়ায়। কিন্তু কী সেই রাস্তার নাম, গলির কত নম্বর বাড়িতে ওরা থাকে, কিছু না জেনে কোথায় গিয়ে খুঁজবেন?

শিয়ালদায় নেমে উত্তরণের মনে হল, খোঁজার তেমন দরকারও নেই। কালকের কাজটার পরিণামে যখন আশ্রম ছেড়ে বেরিয়েই আসতে হয়েছে, তখন কাজটা কেন, কী ভেবে করেছিলেন, তা জানা, না জানা সমান।

অজস্র থেমে থাকা ট্রেনের ভিতর দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে উত্তরণ টের পেলেন, তিনি নিজেও একটা থেমে থাকা ট্রেন। কোথাও যাওয়ার নেই, ফেরার নেই কোথাও। তিনি ঠিকানা হারিয়ে ফেলেছেন। আর ঠিকানা যে হারিয়ে ফেলেছে, সে-ই স্বাধীন।

ব্যাগের ভিতরে একটা চাদর ছিল, সেটা বিছিয়ে স্টেশনেই শুয়ে পড়লেন উত্তরণ। কিছুক্ষণ পরে ঘুমিয়ে পড়লেন, দৈবী করুণাতেই হয়তো-বা। হঠাৎ কে যেন ধাক্কা দিয়ে তুলে দিল। উত্তরণ চোখ মেলে দেখলেন, রাত তখনও ভোর হয়নি।

“দেতা হ্যায়। বাবু দেতা হ্যায়। আধবুড়ো যে লোকটা বলল, সে-ই নির্ঘাত ওঁকে ঠেলে তুলে দিয়েছিল।

উত্তরণ দেখলেন, এক অবাঙালি ভদ্রলোক মিষ্টি আর কচুরি খাওয়াচ্ছেন। স্টেশনের ভিখিরিদের। সেই সকালের পর থেকে আর কিছু খাওয়া হয়নি বলেই বোধহয় ভিখিরিদের মধ্যে বসে হাত পেতে নেওয়া সেই কচুরি আর মিষ্টি যখন মুখে গেল, অদ্ভুত ভাল লাগল। খুব তৃপ্তি করে খেলেন উত্তরণ। তারপর স্টেশনের কল থেকে জল খেয়ে আবার ফিরে এলেন যেখানে চাদরটা পেতেছিলেন, ঠিক সেখানে। শুতেই, ঘুম আবার এসে হাত বুলিয়ে দিল চোখে।

লাইব্রেরির যে বইগুলো কাছে ছিল, আশ্রম থেকে বেরোনোর সময় সেগুলো সঙ্গে করে এনেছিলেন উত্তরণ। স্টেশনে ক’দিন থাকতে হবে তার ঠিক নেই ভেবে ইউনিভার্সিটিতে বইগুলো ফেরত দিতে গেলেন। ফেরার সময় অনসূয়ার সঙ্গে দেখা হতেই যখন ও জিজ্ঞেস করল যে তক্ষুনি আশ্রমে ফিরতে হবে কি না, উত্তরণ কিছুতেই মিথ্যে বলতে পারলেন না।

“আশ্রমে আর ফিরতে হবে না মানে?” অনসূয়া উত্তরণের কথা বুঝতে পেরেই জিজ্ঞেস করল।

উত্তরণ চুপ করে রইলেন।

“চুপ করে থাকবেন না, বলুন! কোথায় যাবেন এখান থেকে?”

“শিয়ালদা স্টেশনে।”

“আপনি কি ওখানেই আছেন নাকি?”

“কাল রাতটা ছিলাম।”

উত্তরণকে অবাক করে অনসূয়া কেঁদে ফেলল, “আমার জন্যই এটা ঘটল, তাই না?”

“তা কেন হতে যাবে? আমি এমনিই…”

অনসূয়া উত্তরণকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “যারা জীবনে একটিও মিথ্যে বলেনি, তারা মিথ্যে বলতে গেলেই ধরা পড়ে যায়, আপনি জানেন না? আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি, আমার সঙ্গে আপনাকে রাস্তায় কেউ দেখতে পেয়েছে আর তার ফলেই আপনাকে আশ্রম থেকে বেরিয়ে আসতে হয়েছে। কী, তাই তো?”

“তুমি কি অন্তর্যামী?” উত্তেজনায় উত্তরণ আর “আপনি” বলতে পারলেন না অনসূয়াকে।

“আমি আদৌ কী বা কে, আপনি জানার চেষ্টা করেছেন কোনওদিন? করেননি যখন, তখন বাদ দিন। শুধু বলুন, আমি যদি আপনার সঙ্গে আশ্রমে গিয়ে বলি যে দোষ আমার, আপনার নয়, তা হলে কি ওরা আপনাকে ফিরিয়ে নেবে?”

“আমাকে কেউ তাড়িয়ে দেয়নি। আমি নিজেই বেরিয়ে এসেছি।”

“কেন?”

“আশ্রমিকদের যে নিষ্ঠা, যে সংযম বজায় রাখতে হয়, তা রাখতে পারিনি বলে।”

“তার দায় তো আপনার নয়, আমার। আমিই আপনার হাত ধরেছিলাম হাঁটার সময়।”

“কিন্তু তুমি তো আমায় বাঁচিয়েছ কাল।”

“ঠিক বলেছেন। আমিই বাঁচিয়েছি। আর বাঁচিয়েছি যখন, তখন আপনার জীবনের উপর আমার একটা অধিকার জন্মায়। সেই অধিকার থেকেই বলছি, আপনাকে আমার বাড়িতে থাকতে হবে। শিয়ালদা স্টেশনে আপনাকে আমি শুয়ে থাকতে দিতে পারি না।”

“আমি তোমার বাড়িতে গিয়ে থাকতে পারব না। তুমি বরং…”

“বরং?”

উত্তরণ বাক্যটা সম্পূর্ণ করতে পারলেন না। অনসূয়াকে কাছাকাছি একটা ঘর খুঁজে দেওয়ার কথা বলতে গিয়ে ওঁর আচমকা মনে হল, সেই ঘরটার উপর বা নীচেও যদি পর্নোগ্রাফিক র‍্যাকেট চলে?

উত্তরণকে থেমে যেতে দেখে অনসূয়া ব্যস্ত গলায় বলে উঠল, “আপনার সব ইফস অ্যান্ড বার্টস নিয়ে পরে ভাবলেও চলবে। আপাতত চলুন আমার সঙ্গে।”

উত্তরণের দোটানার সুযোগে অনসূয়া উত্তরণকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেল। বরানগরের রামকৃষ্ণ মিশনের কাছেই ওদের বাড়ি। অনসূয়ার মা নেই, দাদা ইঞ্জিনিয়ার এবং চাকরিসূত্রে জার্মানিতে থাকে। বাড়িতে লোক বলতে অনসূয়া আর ওর বাবা জয়ন্তবাবু।

“আমার মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হওয়ার চার দিন আগে মা মারা যায়। আমি তিন দিনের কাজ সেরে পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলাম। কীভাবে যে পাশ করেছিলাম, জানি না। তারপর থেকে এভাবেই চলছে।” বলল অনসূয়া।

“আমি যতদিন কলেজে মাস্টারি করেছি, ততদিন ও ভোর সাড়ে পাঁচটায় উঠত, এখন রিটায়ার করে যাওয়ার পর, ছ’টায় ওঠে বোধহয়।” অনসূয়ার বাবা জয়ন্ত বসু বললেন।

“না, না। সাতটায় উঠি এখন।” অনসূয়া হাসতে-হাসতে বলে উঠল।

উত্তরণ কোনও কথা না বলে তাকালেন অনসূয়ার দিকে। কত সহজে সব দায়িত্ব মাথায় তুলে নিয়েছে মেয়েটা। কিন্তু ওকে দেখে একবারও বোঝার উপায় নেই যে অনেক ঝড়ঝঞ্ঝা পেরিয়ে এসেছে। মেয়ে জাতটাই হয়তো এমন যে মাথায় সিন্দবাদের বোঝা নিয়েও হাসতে পারে। কিন্তু মেয়েদের সম্বন্ধে কিছু বলার এক্তিয়ার তো উত্তরণের নেই। মেয়েদের ব্যাপারে তিনি জানেন কী?

“আপনার জন্য দোতলায় দাদার ঘরটাই ভাল হবে। দক্ষিণের জানলা দিয়ে রোদ, হাওয়া দুই-ই আসবে।” অনসূয়া বলল।

“কিন্তু আমি তোমাদের বাড়িতে থাকব কোন অধিকারে?” উত্তরণ কেমন একটা গলায় বলে উঠলেন।

“মানুষের বাড়িতে থাকতে মানুষের অধিকার লাগে না তো?” অনসূয়ার বাবা বলে উঠলেন। তারপর বললেন, “তাও যদি অসুবিধে বোধ করো তা হলে অনসূয়ার শিক্ষক হিসেবে থাকবে।”

উত্তরণ একবার তাকালেন অনসূয়ার দিকে। কিছু বললেন না।

অনসূয়া এক মিনিট চুপ থেকে বলল, “আপনি আমাদের বাড়িতেই থেকে গেলে, ভীষণ খুশি হব আমি আর বাবা দু’জনেই। কিন্তু আপনাকে জোর তো করতে পারি না। তাই আপনি না চাইলে…”

জয়ন্ত অনসূয়াকে থামিয়ে বলে উঠলেন, “ওর না চাওয়ার কথা উঠছে কোত্থেকে?”

অনসূয়া হেসে ফেলল, “সেসব নিয়ে পরে আলোচনা করা যাবে। আপাতত আপনি স্নান করে আসুন। সকাল থেকে কিছু খেয়েছেন?”

উত্তরণ মাথা নাড়লেন।

“খিদে-তেষ্টা পায় না আপনার? নাকি যোগবলে জয় করেছেন সেটা?”

উত্তরণ হাসলেন এতক্ষণে, “খুব খিদে পেয়েছে।”

“শিগগির স্নান করে আসুন। আমি ততক্ষণে… কিন্তু আপনি আমার হাতের রান্না খাবেন তো?” অনসূয়ার গলাটা কেমন ভেঙে গেল।

“খাবে না কেন?” অনসূয়ার বাবা খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

“আসলে আমরা কায়স্থ তো। তাই জিজ্ঞেস করছি।” অনসূয়া গলাটা একটু নামিয়ে বলল।

উত্তরণ সামান্য চুপ করে থেকে বললেন, “আমার ঠাকুরকে জানলে তুমি এ প্রশ্ন করতে না। ঠাকুরের এক প্রিয় শিষ্য শান্তিদা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। ঠাকুর তাঁকে দেখতে হাসপাতালে গেলে শান্তিদা বলেছিলেন যে হাসপাতালে যারা খেতে দেয় তাদের কী জাত তিনি জানেন না। কথাটা শুনে ঠাকুর আচারনিষ্ঠ শান্তিদার মাথায় হাত বোলাতে-বোলাতে বলেছিলেন, “তোমাকে সকালে যে খেতে দেয় সে রাম। আর তোমাকে বিকালে যে খেতে দেয় সে কৃষ্ণ।”

অনসূয়ার মুখে হাসি ফুটল কথাটা শুনে।

শীতসকালের রোদের মতো সেই হাসিটার দিকে তাকিয়ে উত্তরণ বললেন, “তবে আমি কিন্তু নিরামিষ খাই।”

অনসূয়া মাথা নাড়ল শুনে। কিছু বলল না।

শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে উত্তরণ টের পেলেন, নিজের ইচ্ছায় কিছুই করছেন না। একটা অন্ধ নিয়তি ওঁকে ঠেলতে-ঠেলতে নিয়ে যাচ্ছে এদিক থেকে ওদিক। সেই নিয়তির উপর ঠাকুরের নিয়ন্ত্রণ আছে নিশ্চয়ই! তা নইলে আজও তো শিয়ালদা স্টেশনেই ওঁর বসে থাকার কথা। তার বদলে অনসূয়ার বাড়িতে…

অনসূয়ার বেড়ে দেওয়া ভাত খেতে-খেতে উত্তরণের মনে হল, রামও নয়, কৃষ্ণও নয়। এই মেয়েটি সাক্ষাৎ জগদ্ধাত্রী। নয়তো মায়ের পর কোনও মেয়ে তো কোনওদিন ভাত বেড়ে দেয়নি। জল এসে গেল উত্তরণের চোখে। কান্না সংবরণ করে তিনি খেলেন তৃপ্তি করে। তারপর দুপুরে ঘুমোলেন বেশ কিছুক্ষণ।

সন্ধেবেলা জপের শেষে যখন খানিকটা দিশেহারা হয়ে উত্তরণ ভাবছেন, এরপর কী করবেন, কোথায় যাবেন, অনসূয়া এসে দাঁড়াল সামনে।

“আমার একটা কথা আপনি রাখুন। আপাতত এখানেই থাকুন। আমি কথা দিচ্ছি, কোনও অসুবিধে হবে না। কেউ আপনার জীবন কিংবা সাধনায় ব্যাঘাত ঘটাবে না।”

“তোমরা কি ঘরভাড়া নেবে আমার থেকে?” কথাটা বলেই উত্তরণ বুঝলেন, ভুল করেছেন।

অনসূয়ার মুখটা ম্লান হয়ে গেল। ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে ও একবার তাকাল উত্তরণের দিকে, কিছু বলল না।

সেই না-বলা কথার ব্যথা অনেকক্ষণ ভেসে রইল ঘরটায়। উত্তরণ মনে-মনে অস্থির হয়ে উঠলেন। হাঁটতে বেরোবেন বলে দরজার কাছে এসেছেন, অনসূয়া সামনে এসে দাঁড়াল আবার।

“আপনি কি চলে যাচ্ছেন?” জিজ্ঞেস করল অনসূয়া।

“জানি না।” উত্তরণ ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন।

রাস্তায় বেরিয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে-হাঁটতে উত্তরণের মনে পড়ে যাচ্ছিল ব্রহ্মচারী ঠাকুরের কথা। ঠাকুর বলতেন, “কল্পনায় সৃষ্ট আর দৃষ্ট বিনাশশীল এবং চক্রাকারে ঘূর্ণমান অতি চঞ্চল এই জগৎ, অলীক এক বিভ্রম স্থান। এখানে এক ব্রহ্মই নানা রূপে প্রকাশিত হন। তাঁর ভিন্ন-ভিন্ন রূপ নেই। ভিন্ন বলে যা মনে হয়, তা নেহাতই মায়া বা স্বপ্ন।” তা হলে এই অনসূয়ার মধ্যে দিয়ে কি সেই একই ব্ৰহ্ম নিজের লীলা প্রকাশ করছেন না?

নিশ্চয়ই করছেন। নিশ্চয়ই ঠাকুরই ওঁকে দেখে রাখার জন্য এই সময়ে এই মেয়েটিকে পাঠিয়েছেন। ভাবতে-ভাবতে উত্তরণ ফিরে এলেন অনসূয়ার বাড়িতে। রাতের খাওয়া-দাওয়ার পর অনসূয়া যখন ওঁর সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদতে শুরু করল, উত্তরণ সরে যেতে পারলেন না।

“আপনিই আমার ঈশ্বর, বিশ্বাস করুন। আমি আপনাকে কোনওভাবে বিরক্ত করব না কোনওদিন, কিন্তু আপনি প্লিজ় এই বাড়িতেই থেকে যান। আপনি রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরে বেড়াবেন, স্টেশনে শুয়ে থাকবেন, বেখেয়ালে বাসের নীচে চাপা পড়তে যাবেন, এ আমি সহ্য করতে পারব না।”

অনসূয়া চলে যাওয়ার পরও উত্তরণের মাথার মধ্যে ওর বলা কথাগুলো বাজতে থাকল।

সেদিন রাতে উত্তরণ একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলেন। দেখলেন যে কোনও সমুদ্রের পাড়ে তিনি আর অনসূয়া দাঁড়িয়ে আছেন এবং মস্ত একটা ঢেউ সমুদ্রের মাঝখান থেকে উঠে তাঁদের দিকে এগিয়ে আসছে। সেই ঢেউটার ভিতর একটা পদ্ম। সেই পদ্মে গুরুদেব স্থিত হয়ে আছেন। স্বপ্নের ভিতরে ঢেউটা ভাঙল না, কিছুতেই ভাঙল না। ভোরে ঘুম ভাঙতেই উত্তরণের মনে হল, যে পৃথিবীতে ছেলেরাই মেয়েদের পিছনে ছুটে বেড়াচ্ছে অহরহ, সেখানে একটা মেয়ে ওঁকে এত ভালবাসছে, এ-ও কি ঠাকুরের ইচ্ছে ছাড়া সম্ভব?

১০

খাওয়া-পরার চিন্তা চলে গেলে মানুষের মাথার প্রায় সব ভারই নেমে যাওয়ার কথা। কিন্তু উত্তরণ যে সন্ন্যাসী হওয়ার ব্রত নিজের অন্তরে লালন করেছেন এতদিন, আজ সেই ব্রতচ্যুত হয়ে বাঁচবেন কী করে! উত্তরটা নিজের অজান্তে অনসূয়ার বাবা-ই একদিন দিয়ে দিলেন ওঁকে। বললেন যে, যখন বাইরের সমস্যাগুলো পাহাড়প্রমাণ হয়ে ওঠে, তখন বইগুলোকে আঁকড়ে ধরা ছাড়া একজন স্কলারের আর কিছুই করার থাকে না।

উত্তরণ অন্ধের যষ্টির মতো আঁকড়ে ধরলেন জয়ন্তবাবুর বলা কথাটাকে। দিন নেই রাত নেই, নিজেকে ডুবিয়ে দিলেন পড়াশোনায়।

“আপনাকে বাইরে বেরোতেও হবে না। যে বই যখন দরকার আমাকে বলে দেবেন, আমি লাইব্রেরি থেকে তুলে নিয়ে আসব।”

শুধু বই তুলে আনাই নয়, দুষ্প্রাপ্য যেসব বই ইস্যু করা হয় না, শুধু পড়তে দেওয়া হয়, ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইব্রেরিতে বসে সেগুলো কপি করে আনত অনসূয়া।

সেই সময়টা দেশ বদলাচ্ছে, দুনিয়ার দেখাদেখি বিশ্বায়ন কেবল কড়াই নাড়ছে না, ভারতের ঘরের ভিতর ঢুকে এসেছে। কিন্তু অনসূয়ার একমুখী জীবন যেন তিন হাজার বছর আগেকার কোনও তপোবন থেকে উঠে এসে, উত্তরণকে কেন্দ্রে রেখেই পাক খেয়ে চলেছে।

উত্তরণ মাঝে কয়েকদিন নিজেই ন্যাশনাল লাইব্রেরি যাচ্ছিলেন। তাতে খানিকটা ক্ষুন্ন হয়ে অনসূয়া ওঁকে জিজ্ঞেস করে, “আমি কি ঠিকমতো কপি করতে পারছি না?”

“তুমি কেন এত কিছু করছ নিজের পড়াশোনার ক্ষতি করে? আমার খুব খারাপ লাগে।” উত্তরণ উত্তরে বললেন।

“আপনি কেন আপনার ঠাকুরের কাজ করেন?”

“কাজ কিছুই করতে পারিনি, কিন্তু তার আগে বলি, তুলনাটা ভুল হল। ঠাকুর তো আমার ঈশ্বর।”

“আর আপনি আমার। আগেই তো বলেছি।” অনসূয়া হেসে ওঠে।

উত্তরণ বুঝতে পারেন এই মেয়ের সঙ্গে তর্ক করে কোনও লাভ নেই। এ যা মনে করবে তা করবেই। তার চেয়ে ঈশ্বরই যখন এতটা সুবন্দোবস্ত করে দিয়েছেন তখন তার সদ্ব্যবহার করবেন না কেন?

সকালে উঠে পুজোয় বসতেন উত্তরণ। অনসূয়া ওদের ঠাকুরঘরে ওঁর জন্য আলাদা একটা জায়গা তৈরি করে দিয়েছিল। নিজে সত্যসেবী আশ্রমে গিয়ে উত্তরণের জন্য ঠাকুরের বড় একটা ল্যামিনেট করা ছবি কিনে এনেছিল।

ঠাকুরের সেই প্রতিকৃতির সামনে বসে ধ্যান-জপ করতে-করতে উত্তরণের চোখ থেকে গড়িয়ে নামত জল। কীভাবে তিন বছরের উপরে একদিনও আশ্রমে না গিয়ে বেঁচে আছেন, এই প্রশ্নটাতেই তোলপাড় হয়ে যেত হৃদয়। ওঁর রিসার্চ গাইড অনিন্দ্য সেন নিজে নাস্তিক হয়েও খানিকটা বুঝতেন উত্তরণের মনোবেদনা। ঈশ্বর যে কেবলমাত্র অস্তিত্ব নন, তিনি যে শুভ বোধের ভিতরেও বিরাজমান, এই ধারণার দিকে উত্তরণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন তিনি, ওঁর বর্তমান অবস্থার কথা জেনে। তাতে যে উত্তরণ খুব কিছু শান্তি পেতেন তা নয়, তবু স্যারের সহৃদয়তা ছুঁয়ে যেত ওঁকে। মাসে অন্তত দু’বার যখন রানাঘাটে আশ্রমের বোর্ডিং স্কুলে থাকা ভাইকে দেখতে যেতেন, ভাইকে নিয়ে ঘুরতে বেরোতেন, ওকে খাওয়াতেন কোনও একটা হোটেলে, কিনে দিতেন যা তোক কিছু, তখন মনের মধ্যে ভিড় করে আসত পুরনো কথা। হয়তো ওঁর মনের অবস্থার কথা খেয়াল করেই বোর্ডিংয়ের দায়িত্বে থাকা স্বামী অজয়ানন্দ, উত্তরণ বর্তমানে কোথায় আছেন, কী করছেন, সেসব জিজ্ঞেস করতেন না একেবারেই। উত্তরণ প্রতি বার ভাবতেন যে স্বামীজি নিশ্চয়ই বলবেন, ‘আশ্রমের সবাই তোমার জন্য খুব কষ্টে আছে, তুমি আশ্রমে ফিরে যাও, বিজয়দা তোমাকে যেতে বলেছেন।’ কিন্তু অজয়ানন্দ কখনওই এরকম কিছু বলতেন না। একরাশ গ্লানি আর মনখারাপ নিয়ে ট্রেনে শিয়ালদা ফিরতে-ফিরতে উত্তরণের মনে হত, তিনি কক্ষ থেকে ছিটকে গিয়েছেন। এতটাই ছিটকে গিয়েছেন যে আর ফিরে আসা সম্ভব হবে না।

সম্ভব-অসম্ভবের হিসেব মানুষ একরকমভাবে করে আর ভাগ্য অন্যভাবে। একটা বাড়িতে দিনের পর দিন থাকলে সামান্য কিছু দায়িত্ব তো পালন করতেই হয়। সেই জায়গা থেকেই উত্তরণ হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন জয়ন্তবাবুকে। অনসূয়ার ইউনিভার্সিটির পরীক্ষা ছিল সেদিন। ডাক্তার দেখিয়ে বেরোনোর পথেই ওঁর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় বিজয়দার সেবাইত সন্তুর।

একটু মোটা হয়েছে সন্তু। দাড়ি রেখেছে। প্রথমটায় উত্তরণ চিনতে পারেননি ওকে। সন্তুই এগিয়ে এসে বলল, “তুমি এখনও ধুতি-পাঞ্জাবিই পরো?”

মুহূর্তে অনেক বছরের কুয়াশা কেটে গেল। উত্তরণ হাত বাড়িয়ে সন্তুর হাতটা ধরে বললেন, “তুমি এখানে?”

“মহারাজ তো খুব অসুস্থ। মনে হয় না আর ধরে রাখা যাবে। এই হাসপাতালেই আছেন।

আশ্রম থেকে বেরিয়ে আসার বছরখানেকের মাথায় একবার বিজয়দার অসুস্থতার খবর পেয়েছিলেন উত্তরণ। বোধহয় ভাইয়ের বোর্ডিংয়ে গিয়েই। কিন্তু এখন কী এমন হল যে সন্তুর মনে হচ্ছে বিজয়দা আর বাঁচবেনই না? ক্যানসার কি তার শেষ থাবা বসিয়ে দিয়েছে?

“আমি যাই। একটু পরে আবার ভিড় হয়ে যাবে।”

“সন্তু, আমাকে একবারটি নিয়ে যাবে বিজয়দার কাছে?”

“যাবে তুমি? এসো। আমার কাছে দুটো কার্ড আছে।” সন্তু সহজভাবেই বলল।

অনসূয়ার বাবাকে কিছু বলতেই হল না। উনি উত্তরণের কাঁধে হাত রেখে নিজেই জানালেন যে একটু অপেক্ষা করতে ওঁর কোনও অসুবিধে হবে না।

উত্তরণ সন্তুর হাতটা ধরে এগিয়ে গেলেন তিনশো এগারো নম্বর বেডের দিকে।

“মহারাজকে সবাই কেবিনে ভর্তি হওয়ার কথা বলেছিল। কিন্তু উনি কিছুতেই আশ্রমের বেশি টাকা খরচ হতে দেবেন না। কী অদ্ভুত লোক বলো তো। অবশ্য প্রথমে তো প্রাইভেট হাসপাতালেই আসতে চাইছিলেন না।”

উত্তরণ শুনছিলেন আর ওঁর বুকের পাঁজর মোচড়াচ্ছিল। একইরকম রয়ে গেলেন বিজয়দা। সেই মঙ্গলঘট কালেকশনের যৌবন থেকে জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছেও। ঠাকুরের প্রত্যেকটি শিষ্যের কাছে এটাই তো কাম্য যে, সে ধরে থাকবে ঠাকুরকে। বিজয়দা পেরেছেন, সম্পূর্ণ পেরেছেন।

সন্তুর সঙ্গে যে কেবিনটায় ঢুকলেন উত্তরণ তাতে আরও তিনজন পেশেন্টের সঙ্গে বিজয়দাও শুয়ে আছেন। লোহার খাটটার সামনে উত্তরণ গিয়ে দাঁড়ানোর কিছুক্ষণ পরেই বিজয়দা চোখ মেলে চাইলেন। স্মৃতির একটা সাইক্লোন উত্তরণকে উড়িয়ে নিয়ে গেল, হাসপাতালের ওই কেবিন থেকে দূর অতীতে, যেখানে সুজির হালুয়া হাতে বিজয়দা ডাকছেন “বুবাই খাবে এসো।” নিজেকে সামলে নিয়ে উত্তরণ সামনে তাকিয়ে দেখলেন, বিজয়দার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। বিজয়দা হাতটা বাড়িয়ে উত্তরণের হাত ছুঁলেন একবার। বিড়বিড় করে কী যেন বললেন।

উত্তরণ তেমন কিছু শুনতে পেলেন না, কেবল ‘গুরুদেব’ শব্দটা ছাড়া। মনে হল, গুরুদেব যেন হাসপাতালের ঘরে, ওঁর আর বিজয়দার মধ্যে সুক্ষদেহে বিচরণ করছেন। না-বোঝা কথার ভিতরে জেগে রয়েছে ঠাকুরের বাণী, ঠাকুরের আশীর্বাদ।

“আপনি সুস্থ হয়ে উঠবেন বিজয়দা। আমি আপনাকে প্রণাম করে আসব।”

বিজয়দা কোনও উত্তর দেওয়ার আগেই ঘরে অন্য লোক ঢুকে পড়ল। উত্তরণ নিজের কথা অসমাপ্ত রেখেই বেরিয়ে এলেন।

পরদিন বিকেলে আবারও একবার বিজয়দাকে দেখার আশায় দুপুর-দুপুর বেরিয়ে পড়েছিলেন উত্তরণ। কিন্তু হাসপাতালের গেটের সামনেই পরিচিত-অপরিচিত কয়েকজনকে বলতে শুনলেন যে বিজয়দা আর নেই। ঘণ্টাখানেক আগেই তাঁর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয়েছে আশ্রমের দিকে।

খবরটা শুনে উত্তরণের মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিল। তিনি গড়িয়ার একটা বাসে উঠে বসলেন। গড়িয়া থেকে অটোয় উঠে আশ্রমের সামনে নামলেন। কেমন যেন পা কাঁপতে লাগল আশ্রমে ঢোকার আগে। যে আশ্রম তাঁর নিশ্বাস নেওয়ার বাতাস, আজ সেখানে প্রবেশ করার মুহূর্তে এত কীসের দ্বিধা? আসলে পাকাপাকিভাবে আশ্রমে যেদিন থাকতে এসেছিলেন, সেদিন বিজয়দাই হাত ধরে ভিতরে নিয়ে গিয়েছিলেন ওঁকে। আর আজ বিজয়দার মরদেহ শায়িত আছে আশ্রমের চাতালে। আচ্ছা, পুনর্জন্ম বলে কি সত্যিই কিছু আছে? সেখানে কি ভালবাসার মানুষদের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় আবার? নাকি যে শাস্ত্রে যা-ই লেখা থাক, মানুষের এই একটাই জীবন, একবারই বেঁচে থাকা? সেরকমটা হলে বিজয়দার সঙ্গে কখনওই কোথাও আর দেখা হবে না উত্তরণের। কিন্তু যদি পুনর্জন্ম থেকেও থাকে, তা হলেও বিজয়দা কি আর জন্মাবেন? তাঁর তো মুক্তি পেয়ে যাওয়ার কথা, তিনি যে শুদ্ধাত্মা।

ভিড়ের ভিতর থেকে কে যেন একটা হাত ধরে টান দিল। উত্তরণ চমকে দেখলেন, রঘু। নিজেকে ছাপিয়ে একটা কান্না উঠে এল উত্তরণের। রঘুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন তাই। কাঁদতে-কাঁদতেই মনে হচ্ছিল, বিজয়দা যা বলেছিলেন, তা যে হয়নি তাতে একরকম ভালই হয়েছে। কী ওঁর তেজ কিংবা শক্তি? কী এমন অবদান যে আশ্রমের শীর্ষস্থানে বসবেন? কিন্তু তাই বলে উত্তরণ কি আশ্রমের কেউ নন? বিজয়দা নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন যে তাকে যেন সমাধিস্থ না করে দাহ করা হয়। সেই নির্দেশ মেনে আশ্রম থেকে অসংখ্য মানুষের পদযাত্রা যখন শ্মশানের দিকে এগোচ্ছে, তার মধ্যে মিশে গিয়ে উত্তরণ টের পেলেন যে আশ্রমের একজন ছিলেন, আছেন, থাকবেনও।

শ্মশানে নামগানের পর বিজয়দাকে যখন চন্দনকাঠের চিতায় শুইয়ে দেওয়া হল, তখন মুখাগ্নিক অনিলদাকে ছুঁয়ে থাকল সব আশ্রমিকরা, কিন্তু উত্তরণকে কেউ ডাকল না। ওঁর খুব ইচ্ছে করছিল পিছনের কাউকে ছুঁয়ে থাকতে, দ্বিধার জেরে পারলেন না। উত্তরণ যেন কালাপানি পার করা সেই মানুষটা, যে আর ঘরের একজন হতে পারবে না। বিজয়দার মরদেহ ছাই হয়ে যাওয়ার পর সবাই যখন কলসি করে জল ঢালতে লাগল চিতায়, উত্তরণের বড় সাধ হল এক কলসি জল তিনিও ঢালেন। ওঁর হাতের জলেও দাহ জুড়িয়ে যাক আশ্রমের প্রেসিডেন্ট মহারাজের, উত্তরণের আপনের চেয়েও আপন বিজয়দার।

কিন্তু চার বছর অনেকটা সময়। কাশী থেকে আসা এক অবাঙালি সন্ন্যাসী এখন আশ্রমের গুরুত্বপূর্ণ পদে। উত্তরণ কলসি হাতে এগিয়ে যেতেই তিনি হাত তুলে বাধা দিয়ে জানালেন যে বিজয়দার চিতায় জল ঢালার অধিকার কেবল আশ্রমের সন্ন্যাসী এবং ব্রহ্মচারীদের। কোনও বাইরের লোকের নয়। কথাটা শুনে আশ্রমেরই দু’-চারজন একটু চমকে উঠলেও কোনও প্রতিবাদ এল না কারওর থেকে।

উত্তরণ ছিটকে সরে এলেন চিতার সামনে থেকে। তারপর প্রায় ছুটে শ্মশান থেকে বেরিয়ে এলেন। মাথার মধ্যে বোমার মতো ফাটতে লাগল ওই শব্দটা, বাইরের লোক। সত্যিই তো, উত্তরণ বাইরের লোক। যাকে কোনও মেয়ে কখনও জড়িয়ে ধরেছে, সে কী করে সন্ন্যাসীদের সঙ্গে এক পঙক্তিতে দাঁড়িয়ে জল ঢালতে পারে আশ্রম সভাপতির নির্বাপিত চিতায়? কেউ না দেখুক, গুরুদেব তো দেখেছেন সবটা। তিনি কী করে অনুমতি দিতেন উত্তরণকে? দেননি। ঠিক করেছেন। এই যে এখন বুকের ভিতরটা জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে, সেটাও নিশ্চয়ই ব্রহ্মচারী ঠাকুর চাইছেন বলে। তবে কি সত্যি-সত্যি গুরুর সঙ্গে প্রতারণা করেছেন উত্তরণ? এমন পাপ করেছেন যার প্রায়শ্চিত্ত হয় না?

সন্ন্যাসীর তো শ্ৰাদ্ধ হয় না, তিনি তাঁর নিজের শ্রাদ্ধ নিজেই করে যান। তবু তাঁর স্মরণে ভাণ্ডারা হয়। সেখানে কত মঠ-মিশনের কত সন্ন্যাসী এসে মন্ত্রোচ্চারণ করে প্রসাদ গ্রহণ করেন। বিজয়দার ভাণ্ডারায় অনাহূতের মতো গিয়ে সেইসব মন্ত্রোচ্চারণের ভিতর নিজের জীবনের হারিয়ে যাওয়া মন্ত্রটা খুঁজতে শুরু করলেন উত্তরণ। কিন্তু পেলেন না। কেবল উপলব্ধি করলেন, পরশপাথর হারিয়ে ফেলা সহজ, ফিরে পাওয়া ভীষণ কঠিন।

আশ্রমের নতুন সভাপতি স্বামী বিরজানন্দ, উত্তরণের অনিলদা, ওঁকে কাছে ডেকে বললেন, “কোনও সংকোচ কোরো না।”

কেন অনিলদাকে বলতে হল ওই কথা? নিজের বাড়িতে কি কেউ সংকোচ করে? আসলে এই বাড়িতে আর উত্তরণের ঠাঁই নেই, সে কথাই হয়তো ঠাকুর অনিলদার মাধ্যমে শুনিয়ে দিলেন ওঁকে।

ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই। কিন্তু এই সত্যসেবী আশ্রমে যদি ঠাঁই না থাকে, তা হলে এই কলকাতা শহরে, এই বাংলায়, এই ভারতবর্ষেও তিনি থাকতে পারবেন না। কক্ষ থেকে ছিটকেই যখন গিয়েছেন, তখন অনেক দূরে চলে যেতে হবে। যাতে কারওর আর মনে না পড়ে যে তিনি কখনও এখানে ছিলেন। একশো কিলোমিটার গতিতে গাড়ি চালাতে গিয়ে দিল্লিতে অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায় দীপ্ত। পড়াশোনা শেষ না করে ওর ওই দুম করে কলকাতা ছেড়ে দিল্লি চলে যাওয়ার পিছনে উত্তরণও তো কিছুটা দায়ী। পূজার ঘটনাটা যদি না চোখে পড়ত ওঁর? হয়তো ঝামেলা পাকত না, দিল্লি যেত না দীপ্ত। আচ্ছা, খুব স্পিডে আসা কোনও গাড়ি উত্তরণকে একটা ধাক্কা মেরে দীপ্তর কাছেই পৌঁছে দিতে পারে না? বারবার নিশ্চয়ই অনসূয়া ওঁকে বাঁচানোর জন্য পাশে থাকবে না।

পিএইচ ডি-র থিসিস জমা করেই পোস্ট-ডক্টরাল কাজের জন্য আমেরিকার বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে চিঠি লিখতে শুরু করলেন উত্তরণ। উত্তরও আসতে শুরু করল দ্রুতই।

অনসূয়া একদিন ওঁর ঘরে এসে বলল, “ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে, শিকাগোর ইলিনয়, আটলান্টার এমরি আপনাকে ডাকছে। আপনি কোথায় যাবেন?”

“সত্যসেবী আশ্রম। গড়িয়া।” অন্যমনস্ক হয়ে জবাব দিলেন উত্তরণ।

“কিন্তু সেখানে কর্তৃপক্ষ কি আর আপনাকে রাখতে চায়?”

“জানি না।”

“জানেন। স্বীকার করতে লজ্জা কিংবা ভয় পান। আর ওদিকে বিরাট একটা পৃথিবী দু’হাত বাড়িয়ে ডাকছে আপনাকে। অতীতে যা ছিল তা অতীতে থাক, মনে যা আছে তা মনে। আপনাকে সামনের দিকে তাকাতে হবে।”

“আমি এখান থেকে চলে গেলে খারাপ লাগবে না তোমার?”

“লাগবে তো। ভয়ংকর খারাপ লাগবে। আমি ডাইরেক্ট পিএইচ ডি না করে এম ফিল-এ কেন ভর্তি হয়েছিলাম জানেন? যাতে দু’-তিন বছর পর আপনার আন্ডারেই পিএইচ ডি করতে পারি।”

“তা হলে?”

“তা হলে কিছু নয়। আপনাকে যেতে হবে। আমার খারাপ লাগবে বলে, আপনার ভাল হওয়াটা আটকে রাখব, সেরকম মেয়ে মনে হয় আমাকে? এতদিন তো দেখছেন?”

“না, মনে হয় না। আর কী যে মনে হয়, সেটা এক্ষুনি বুঝিয়ে বলতেও পারব না। কিন্তু তুমি শিয়োর, আমেরিকায় গেলে ভাল হবে আমার?”

অনসূয়া কোনও জবাব না দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মিনিটপাঁচেক পরে যখন ফিরে এল, তখন ওর হাতে একটা ম্যাগাজ়িন। ম্যাগাজ়িনটা খুলে তার দুটো পাতা উত্তরণের দিকে মেলে ধরল অনসূয়া।

“কীসের ছবি এটা?” উত্তরণ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

“দেখুন ভাল করে।”

উত্তরণ দেখলেন, অজস্র লোহার শিক ছবিটায়। কিন্তু শিকগুলোর দিকে একদৃষ্টিতে তাকালে একটা মুখের অবয়ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

অনসূয়া বলল, “দক্ষিণ আফ্রিকার একটা ছোট্ট শহরে নেলসন ম্যান্ডেলার জন্য বানানো হয়েছে এটা। কয়েক বছর আগে। এই ভাস্কর্যটার নাম, রিলিজ়। আমি আপনাকে এটা দেখাচ্ছি কারণ গত চার বছরের বেশি সময় আপনাকে কাছ থেকে দেখে আমার মনে হয়েছে, আপনিও এরকম একটা লোহার শিকের আড়ালে আটকে আছেন। আপনার এই ধর্ম, এই সন্ন্যাস, এই জপ-তপ আপনাকে বোধহয় আনন্দের বদলে কষ্টই দিয়েছে। একটা প্রতিভার সামনে অনেকগুলো লোহার শিক দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, নেলসন ম্যান্ডেলার সামনে শাসকরা যেমন দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। আপনাকে এই শিকগুলো উপড়তে হবে। শিকাগো থেকে নিউ ইয়র্ক নিজের মেধাকে ছড়িয়ে দিতে হবে। কারণ নিজেকে বেঁধে রেখে আপনি, নিজের প্রতি তো বটেই, ঈশ্বরের প্রতিও চরম অবিচার করছেন।”

“তুমি কী বলছ তুমি জানো?”

“হ্যাঁ জানি। আর একই সঙ্গে জানি যে নিজের স্বার্থে কিছুই বলছি না। সেক্ষেত্রে বলতাম, আমায় বিয়ে করুন।”

“হোয়াট?”

“কেন, আপনি বোঝেন না যে আমি ভালবাসি আপনাকে? প্রতিটা মুহূর্ত আপনার চিন্তাই আমার ভিতরে পাক খায়? এই পৃথিবীতে আমার চেয়ে বেশি আপনার জন্য কেউ ফিল করে না, আপনি অনুভব করতে পারেন। না?” অনসূয়ার গলাটা ভেঙে গেল বলতে-বলতে। ও ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

অনসূয়া ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরে উত্তরণ চুপ করে বসে রইলেন। চোখটা বন্ধ করে ফেললেন এক সময়। ধ্যানে গুরুদেবকে স্মরণ করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ওই লোহার শিকগুলো জ্যান্ত হয়ে সামনে এসে দাঁড়াল। মনে হল, ওঁর পরিধি, ওঁর স্মৃতি, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, সবকিছু থেকে বেরিয়ে একটা নতুন পৃথিবীতে নিজেকে প্রতিস্থাপিত করতে হবে। উত্তরণ গুরুদেবের দেওয়া বীজমন্ত্র জপ করছিলেন। হঠাৎই কী মনে হল, ঠাকুরের নাম উচ্চারণ করতে গেলেন একবার। ওঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, ‘রিলিজ়’!

১১

একটা সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকতে গেলে কী প্রয়োজন? অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, ইত্যাদি-ইত্যাদি। কিন্তু শুধু সেটুকুতে সন্তুষ্ট থাকে কতজন? যার এক আছে সে চায় দুই, যার দুই আছে সে চায় চার, যার চার সে আট। মানুষ নিয়ত নিজের সামনে নিজের জন্য একটা টার্গেট ঝোলায়। একটা ফিনিশিং লাইন এঁকে প্রাণপণ চেষ্টায় সেখানে পৌঁছনোর চেষ্টা করে। যে পাড়ার দলে খেলছে, সে চায় দেশের হয়ে খেলতে। যে ছোট চাকরি করছে, সে বড় চাকরি করতে। যে বিঘেতে চার মন ফসল ফলাচ্ছে, সে চায় ছ’মন ফলাতে। এই যে আরও, আরও, পাওয়ার চেষ্টা, এই চেষ্টা থেকে একজন সন্ন্যাসীও কি সম্পূর্ণ মুক্ত? তিনিও তো চান সাধনার আরও উঁচু স্তরে পৌছঁতে। কিন্তু সেই সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছনোর পরও সন্ন্যাসীকে আবার নেমে আসতে হয় লোকালয়ে। লোকশিক্ষার জন্য। রামকৃষ্ণদেব থেকে ব্রহ্মচারী ঠাকুর পর্যন্ত তারই প্রমাণ। প্লেনটা যখন চক্কর কাটছিল নিউ ইয়র্কের মাটি ছোঁওয়ার আগে, উত্তরণের মাথায় তখন এই সমস্ত ভাবনা ঘুরছিল। এর আগে দিল্লি কিংবা ফ্রাঙ্কফুর্টে একের পর এক এয়ারপোের্ট পার হওয়া, প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় উত্তরণের মনে হচ্ছিল গুরুদেব যেন ওঁকে হাত ধরে পার করে দিচ্ছেন। আসলে উত্তরণ তো একটা ঘটনাস্রোতে গা ভাসিয়েছেন মাত্র। আর সেই ঘটনাস্রোত যে গুরুদেবেরই তৈরি করা নয়, কে বলবে?

নিউ ইয়র্কে নেমে, ইমিগ্রেশনের আগে, প্রসাধনে ব্যস্ত এক যুবতীর আয়নায় নিজের প্রতিকৃতি দেখে চমকে গেলেন উত্তরণ। সাদা শার্ট, সাদা প্যান্ট। এ কার চেহারা! এই মানুষটি তো চেনা নয়। মনে পড়ছিল আমেরিকা যাওয়ার আগে অনসূয়া নিয়ে গিয়েছিল বড় একটি দোকানে। সেখানে সমস্ত কিছু পাওয়া যায়। এঁর জন্য কালো প্যান্ট পছন্দ করেছিল অনসূয়া। কিন্তু গুরুদেব কালো পছন্দ করতেন না, বিজয়দার কাছে শুনেছিলেন উত্তরণ। উত্তরণ সরিয়ে দিয়েছিলেন সেই প্যান্ট। বদলে একটা সাদা প্যান্ট বেছে নিয়েছিলেন। স্কুলজীবনের হাফ-প্যান্টের পর প্রথম প্যান্ট-শার্ট পরে দোকানের ট্রায়াল-রুমে নিজেকে একটা কিম্ভুতকিমাকার প্রাণী বলে মনে হচ্ছিল উত্তরণের। কিন্তু যে দেশে পা রাখতে যাচ্ছেন, তার নিয়ম অনুযায়ীই তো চলতে হবে।

নিউ ইয়র্ক যখন ওঁর আমেরিকায় প্রবেশ ‘বৈধ’ ঘোষণা করল পাসপোর্টে একটি ছাপ্পা মেরে, মনে হল অদেখা পৃথিবী উন্মুক্ত হয়ে গেল ওঁর সামনে। পরবর্তী গন্তব্যের দিকে এগিয়ে গেলেন উত্তরণ।

আটলান্টা এয়ারপোর্ট সম্ভবত আমেরিকার সবথেকে বড় এয়ারপোর্ট। পথ আর ফুরোয় না। উত্তরণ টার্মিনালের ট্রেনে উঠে নির্দেশ মতো নামলেন, চার-পাঁচটা স্টপ পরে। লাগেজ কালেক্ট করে অবশেষে যখন বেরোলেন তখন আকাশজোড়া মেঘ থেকে অল্পস্বল্প বৃষ্টি হচ্ছে। একটা শাটল ট্যাক্সিতে যখন ইউনিভার্সিটির হস্টেলে পৌঁছলেন তখন বৃষ্টির তেজ বেড়েছে। রিসেপশনে লরা বলে একটি মেয়ে একটা প্লাস্টিকের কার্ড দিল। ওঁর ঘরের চাবি। লিফটে উঠে এসে বারবার সেই চাবি দরজার হাতলের সঙ্গে লাগিয়েও দরজা খুলতে পারলেন না উত্তরণ। নেমে এলেন নীচে। লরাকে সাহায্যের জন্য বললেন।

লরা শুধু বলল, “ইউ ক্যান ডু ইট। গো অ্যান্ড ট্রাই।”

উত্তরণ সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-উঠতে অনুভব করলেন, এটাই এদেশের মন্ত্র। এখানে কেউ কাউকে সাহায্য করার জন্য হাত বাড়িয়ে নেই। নিজের সমস্যা নিজেকে সমাধান করতে হবে।

উত্তরণ সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-উঠতে অনুভব করলেন, এটাই এদেশের মন্ত্র। এখানে কেউ কাউকে সাহায্য করার জন্য হাত বাড়িয়ে নেই। নিজের সমস্যা নিজেকে সমাধান করতে হবে।

নিজের চেষ্টাতেই উত্তরণ দরজা খুলতে পারলেন এক সময়। ভিতরে ঢুকে আলো জ্বালালেন। একটা ছিমছাম ঘর, একটা বিছানা, একটা পড়ার টেবিল, একটা চেয়ার, অন্য পাশে আরও একটা টেবিল। সেটা বোধহয় খাওয়ার জন্য। তার পাশেই ফ্রিজ আর মাইক্রোওয়েভ আভেন।

উত্তরণ সবটা একবার দেখে জুতো ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। তারপর দু’-তিন ঘণ্টার জন্য কোনও ভয়ান ছিল না। ঘুমটা ভাঙতে দেখলেন ঘড়িতে রাত্রি এগারোটা বাজে। উঠে পড়লেন উত্তরণ। চারদিকে তাকিয়ে ঘরটা কীরকম ফাঁকা-ফাঁকা বোধ হতে লাগল। তৎক্ষণাৎ ব্যাগ থেকে ঠাকুরের ল্যামিনেট করা ছবিটা বার করে পড়ার টেবিলের উপরে রাখলেন। রেখেই মনে হল, ঘরটা একটা চেহারা পেয়েছে। চোখে পড়ল, মাইক্রোওয়েভের উপর একটা ব্রাউন পেপারের ঠোঙা। এটা কি আগেও ছিল? কই, ঘরে ঢুকে তো খেয়াল করেননি। উত্তরণ ঠোঙাটার সামনে এগিয়ে গেলেন। ঠোঙাটার ভিতরে দু’টো আপেল, একটা কলা, একটা মাফিন। গুরুদেবই কি তবে রেখে গেলেন, শিষ্য অভুক্ত থাকবে বলে? উত্তরণ ঠোঙা থেকে বার করে আপেলে দাঁত বসালেন।

এই সেই আপেল, যা খাওয়ার জন্য ইভ আদমকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। এই আপেল থেকেই পৃথিবীর বিস্তার। একই সঙ্গে সমস্ত জ্ঞানের, আবার সমস্ত পাপের আকর। সেই আপেলে কামড় দিয়ে উত্তরণের মনে হল, জ্ঞানের থেকে পাপ, কে আলাদা করবে? কিন্তু যে জ্ঞান আহরণ করতে আমেরিকা এসেছেন, সেই জ্ঞানের প্রতি পদে যদি পাপের ছোঁয়া থাকে? উত্তরণ ঠাকুরের ছবির দিকে তাকালেন।

পরদিন সকালে ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে উত্তরণ দেখা করলেন ড. ফ্রেজ়ারের সঙ্গে। ফ্রেজ়ারের তত্ত্বাবধানেই উত্তরণের পোস্ট-ডক্টরাল কাজ করার কথা। ডক্টরেটের ক্ষেত্রে যেমন গাইড, পোস্ট-ডক্টরালের ক্ষেত্রে যাঁরা পথনির্দেশ করেন, তাঁদের বলে হোস্ট। তবে এক্ষেত্রে কাজ প্রায় পুরোটাই নিজেকে করতে হয়। নির্দেশ প্রায়শই হয়ে দাঁড়ায় ইশারামাত্র।

উত্তরণের সঙ্গে অবশ্য অনেক কথাই বলছিলেন ফ্রেজ়ার। ইংরেজির সঙ্গে ভাঙা-ভাঙা সংস্কৃত মিশিয়ে। ফ্রেজ়ার বহুবার ভারতবর্ষে গিয়েছেন। দর্শনের অধ্যাপনা করতে গিয়ে সংস্কৃত শেখা জরুরি মনে হয়েছিল, তাই সংস্কৃতও শিখেছেন বেশ খানিকটা। হরিদ্বারে একটা বাড়িও আছে সাহেবের, মাঝে-সাঝে গিয়ে থাকার জন্য। কথা বলতে-বলতে ফ্রেজ়ার হঠাৎ ভারতের গুরুবাদ নিয়ে কথা তুললেন। কোন গুরুর ক’জন অবৈধ সঙ্গিনী, কার বিছানার তলায় কয়েক কোটি টাকা পাওয়া গিয়েছে, কার সিন্দুকে এক কেজি সোনা, কে রাত্রিবেলা সুন্দরীদের ডেকে পাঠান নিজের ঘরে, এসব নিয়ে বলতে আরম্ভ করলেন।

উত্তরণ শুনতে-শুনতে ভাবছিলেন, সত্যিকারের গুরু কাকে বলে ফ্রেজ়ার জানেন না। আসল সন্ন্যাসী ফ্রেজ়ার কখনও দেখেননি। উত্তরণ দেখেছেন। উত্তরণ তাঁর আশ্রয়ে বড় হয়েছেন। গুরুদেব একবার উনুনে ভাত বসিয়ে ধ্যান করছিলেন কোনও পাহাড়ি এলাকায়। ধ্যানের একাগ্রতা ভাতের গন্ধে টলে যাচ্ছিল বলে, উঠে গিয়ে হাঁড়িসুন্ধু উনুন থেকে তুলে নীচের নদীতে ছুড়ে ফেলে দেন। ব্যস, জীবনে আর কখনও অন্ন মুখে তোলেননি। সাবুর উপর ভর করে কাটিয়ে দিয়েছেন ইহজীবনের শেষ প্রহর পর্যন্ত। ঠাকুরের মূল্যবান জিনিসপত্র যে কাঠের বাক্সে থাকত, সেখান থেকে তাঁর দেহত্যাগের পর কেবল একটা রুদ্রাক্ষ আর একটা শালগ্রাম শিলা পাওয়া গিয়েছিল। না, জীবন্ত, জ্বলন্ত সত্যের মতো সন্ন্যাসীর সংস্পর্শে আসেননি ফ্রেজ়ার, বোঝাই যাচ্ছে।

সম্পূর্ণ বা অল্প ধারণা থাকলেও কোনও বিষয় নিয়ে কথা বলতে মানুষের আটকায় না। ফ্রেজ়ার তাই এমনভাবে কথা বলে যাচ্ছিলেন যেন ভারতের গুরুদের তিনি হাতের তালুর মতো চেনেন। নিজের জায়গা থেকে ঠিকই বলছিলেন হয়তো। যে ‘গুরু’ নামধারী ভণ্ডগুলো সাদা চামড়ার শিষ্যা পেলেই শুয়ে পড়তে চায় কিংবা তৃতীয় শ্রেণির অলৌকিক কাণ্ডকারখানা দেখিয়ে ভক্তদের পয়সা হাতাতে চায়, ফ্রেজ়ারদের সঙ্গে সেই লোকগুলোর মোলাকাতই তো হয় বেশি।

উত্তরণ ‘হ্যাঁ, হুঁ’-তে কথার উত্তর দিচ্ছিলেন। প্রথম দিনই ফ্রেজ়ারের সঙ্গে তর্কে প্রবৃত্ত হতে ওঁর মন চাইছিল না।

সত্যসেবী আশ্রমেই থাকতেন শতদ্রুদা। রসায়নের অসাধারণ ছাত্র। আশ্রম থেকে বেরিয়ে গিয়ে বড় চাকরি নিয়েছিলেন, সংসারও করেছিলেন। কিন্তু স্ত্রী বাঁচেননি বেশিদিন। উত্তরণ আমেরিকা যাচ্ছেন শুনে শতদ্রুদা বলেছিলেন, “আশ্রমের ভিতরে থাকলেই শুধু গুরুসেবা হয়, বাইরে থাকলে হয় না, এমনটা নয়। গুরুদেবের সেই কথাটা ভুলে যেয়ো না, যেখানে উনি বলছেন, ‘আমি বিশ্বরূপ ভগবানের পূজা করি। তোমরা আমাকে এই একটিমাত্র শরীরে সীমাবদ্ধ ভাবিয়ো না। আমি তোমাদের ভিতরেও আছি।”

উত্তরণের মনে হল, এই যে তিনি ফ্রেজ়ারের সামনে বসে আছেন, ওঁর হৃদয়ে থাকা ঠাকুরও সেখানেই আছেন। ওঁর প্রতিটা কথার ভিতর দিয়ে ওঁর গুরুরও পরিচয় ফুটে উঠছে।

উত্তরণ নিজের কাজের ব্যাপারে সামান্য বললেন ফ্রেজ়ারকে।

ফ্রেজ়ার শুনলেন। উত্তরে খুব একটা কিছু বললেন না। কিন্তু দশ দিনের মধ্যেই উত্তরণের কাজের ধরন সাহেবের মনে সম্ভবত একটা ভাললাগা জাগাল। ফ্রেজ়ার একদিন রাত্রে উত্তরণকে নেমন্তন্ন করলেন নিজের বাড়িতে।

সাহেবের বাড়িতে গিয়ে উত্তরণ দেখলেন, মার্থা বলে ফ্রেজ়ারের এক ছাত্রী আর রবার্ট বলে এক ছাত্র আপ্যায়নের দায়িত্বে। মার্থা উত্তরণেরই বয়সি হবে। রবার্ট আর-একটু ছোট, বাইশ কিংবা তেইশ। মার্থা সিঙ্গল পেরেন্ট বলে ওর ছোট্ট মেয়েটাকেও নিয়ে এসেছে, আর রবার্ট এখনও অবিবাহিত। কিন্তু যাকে দেখে সত্যি করে অবাক হলেন উত্তরণ, সে ফ্রেজ়ারের স্ত্রী পলা।

“এ আমার তিন নম্বর স্ত্রী।” ফ্রেজ়ার নিজেই পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় বললেন।

কী অবলীলায় একটা সাতান্ন বছরের লোক একটা সাতাশ-আটাশ বছরের মেয়েকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে পারে এই দেশে! সারা দেশটা যেন একটা ঘূর্তির জলে ডুব দিয়ে মাথা তুলছে, আবার ডুব দিচ্ছে, উত্তরণ ভাবছিলেন।

ভারতে যাতায়াত আছে বলে ফ্রেজ়ার উত্তরণের জন্য নিরামিষ রান্নাই করিয়েছিলেন। শুধু একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন তাঁর স্কলার ‘ফিশ-ইটিং ভেজিটেরিয়ান’ কি না। অনসূয়া ওঁকে মাছ ধরাতে পারেনি অনেক চেষ্টাতেও, তাই মাথা নেড়ে ‘না’-ই বললেন উত্তরণ। ফ্রেজ়ার সঙ্গে-সঙ্গে উত্তরণকে নিরামিষ পদগুলো দেখিয়ে দিলেন। রুমালি রুটি, একটু কাঁচা-কাঁচা রাজমার ডাল আর পনিরের তরকারি। তার পাশেই বিফ, পর্ক সমস্ত কিছু ছিল। সেগুলোর ছোঁয়া নিরামিষেও লাগছিল কিনা সেই কথাটা উত্তরণের একবার মনে হল। কিন্তু তেমন কিছু রেখাপাত করল না। অতলান্তিকের জল পেটে পড়ার ফল হয়তো। উত্তরণ প্লেটে খাবার তুলে নিলেন ইচ্ছেমতো৷

খাওয়ার পরে উত্তরণ ওয়াইন খাবেন না জেনে একটা মকটেলের গ্লাস হাতে ধরিয়ে প্রফেসর ফ্রেজ়ার জিজ্ঞেস করলেন, “ভারতীয় মতে ভক্ত কে?”

উত্তরণ জবাব দিলেন, “যার আপন-পর ভেদ নেই, যিনি ইন্দ্রিয়কে জয় করেছেন, যিনি সংসারে ঈশ্বরের চরণ ছাড়া আর সবকিছুকে মূল্যহীন বলে মনে করেন, তিনিই ভক্ত।”

একটু চুপ করে থেকে ফ্রেজ়ার হো-হো করে হেসে উঠলেন। হাসতে-হাসতেই বললেন, “তা হলে সংসারে যিনি নিজেকে ঈশ্বর ভেবেছেন, যখন যাঁকে ভালবাসতে ইচ্ছে করেছে ভালবেসেছেন, যিনি সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, বাচ্চার সঙ্গে বাচ্চা হয়ে, বৃদ্ধের সঙ্গে বৃদ্ধ হয়ে মিশেছেন, যিনি জীবনের কোনও আকাঙ্ক্ষাকেই নিজের সাধ্যমতো অপূর্ণ থাকতে দেননি, তিনি ভক্ত নন?”

উত্তরণ কোনও জবাব দিলেন না।

ফ্রেজ়ার বলে চললেন, “তোমার কি মনে হয় যে তাঁর উপর ভগবানের অভিশাপ পড়বে? যদি তা-ই হত, তবে তো ভগবান তাঁকে শাস্তি দিতেন। উলটে ভগবান তাঁকে সবকিছু দিলেন কেন? যারা সারাক্ষণ ভয় পেয়ে সবকিছু থেকে দূরে সরে রইল, তারাই ঈশ্বরের থেকে সব কিছু পাবে? যারা ভোগ করল তারা পাবে না? কোনও যুক্তি আছে? শুনে রাখো, খাওয়ার সময় প্রতিটা গ্রাসেই শরীরের পুষ্টি হয় আর ক্ষুধার নিবৃত্তি হয়। বেঁচে থাকার প্রতিটা মুহূর্ত দিয়ে, মানুষের প্রত্যেকটা আকশনের মধ্যে দিয়েই ভগবৎ স্বরূপের উপলব্ধি ঘটে। ভোগের মধ্যে দিয়েই তো বৈরাগ্য আসে, ভোগ ছাড়া বৈরাগ্য আসবে কোত্থেকে?”

উত্তেজিত হয়ে নিজের সাহেবি উচ্চারণে ফ্রেজ়ার একটা-দু’টো সংস্কৃত শ্লোক বলতে লাগলেন। খানিকটা চার্বাক ঘেঁষা সেই শ্লোকগুলো।

উত্তরণ শুনলেন চুপ করে। শুনে গেলেন।

পরের সপ্তাহে ফ্রেজ়ার উত্তরণকে একটা সেমিনার অ্যাটেন্ড করতে সান ফ্রানসিসকো পাঠালেন। সেখানে গিয়ে ফ্রেজ়ারের বলা কথাগুলো অন্য একটা সুরে বেজে উঠল। উত্তরণ পরিচিত হলেন অনন্যসুন্দর একটা শহরের সঙ্গে, যেখানে একদিকের রাস্তা উঁচু হয়ে পাহাড়ের দিকে চলে গিয়েছে, আর-একদিকের রাস্তা পাহাড় থেকে নিচু হয়ে সমুদ্রে এসে মিশেছে। সমুদ্রের ধারে মস্ত বড় বাজার, সেখানে ফিশারম্যানস হোয়ার্ফ-এ মাছ ভেজে বিক্রি করছে চিনে আর কোরীয়রা। রাস্তার মোড়ে-মোড়ে ব্যাঞ্জো আর গিটার বাজিয়ে গান গাইছে গায়কেরা, যারা মূলত কৃষ্ণাঙ্গ। অজস্র মানুষের অসংখ্য প্রাণ সারাদিন ফানুসের মতো হাওয়ায় উড়ে বেড়াচ্ছে। যেন কোথাও কোনও দুঃখ নেই, দুঃখী নেই।

শহরটায় ঘুরতে-ঘুরতে উত্তরণের মনে হল, জীবনের এই উচ্ছাসের দিকটাও মিথ্যে নয়। উত্তরণ দেখলেন একটা বিরাট বড় যুদ্ধজাহাজ প্রশান্ত মহাসাগরের তটেই দাঁড় করানো। মানুষের জীবনযজ্ঞের মধ্যে মৃত্যুলীলার আয়োজন যে সদা বর্তমান, সেটাই যেন মনে করিয়ে দিচ্ছে জাহাজটা। সান ফ্রানসিসকোর ইতিহাস যে মিউজ়িয়মে ধরা আছে সেই মিউজ়িয়মটা ঘুরে দেখলেন উত্তরণ। তারপর একা-একা হেঁটে গেলেন তটরেখা ধরে। দেখলেন, সমুদ্রের জল এসে ধাক্কা মারছে পাথরে। উত্তরণ সেই পাথরে পা রেখে সমুদ্রের মুখোমুখি বসলেন। তর্পণ করলেন বাবার আর মায়ের। তারপর ব্রহ্মচারী ঠাকুরকে অঞ্জলি দিলেন। ঠাকুর তো অবিনশ্বর। তাঁর তো তর্পণ হয় না।

১২

যখন আটলান্টায় ফিরে এলেন, তখন উত্তরণের অন্দরে অনেক তোলপাড় ঘটে গিয়েছে। ‘গীতা’র দশম অধ্যায় নিয়ে কাজ করছিলেন উত্তরণ, যেখানে ভগবান বলছেন যে তিনি রাজর্ষিদের মধ্যে মনু, দৈত্যদের মধ্যে প্রহ্লাদ, হাতিদের মধ্যে ঐরাবত, ধাতুর মধ্যে সোনা, সরোবরের মধ্যে সমুদ্র, পুরোহিতদের মধ্যে বশিষ্ঠ, সেনাপতিদের মধ্যে কার্তিক, আরও কত কিছুর মধ্যে কত কী। উত্তরণের মনে হচ্ছিল, আমেরিকা দেশটা সংশ্লিষ্ট সব নাগরিকদের মধ্যে কেবলই আনন্দ হয়ে বিভিন্ন শাখায় বিভিন্ন রাস্তা ধরে ছুটছে। সেই আনন্দে পূর্ণতা আছে কি নেই কেউ জানে না, কিন্তু সেই আনন্দকে শুধুমাত্র ভোগ বলে নস্যাৎ করা বোকামি।

ফ্রেজ়ার একদিন কথায়-কথায় বলেছিলেন যে সবাই যদি সন্ন্যাসী হয়ে যেত, তা হলে পৃথিবী পঞ্চাশ বছর পরই থেমে যেত।

উত্তরণ অবাক হয়ে তাকাতে ফ্রেজ়ার হেসেছিলেন, “নতুন জন্ম ছাড়া পৃথিবী চলত কী করে? যৌনতার মতো বড় শক্তিকে বাদ দিয়ে পৃথিবীর চলার অন্য কোনও রাস্তা আছে?”

উত্তরণ প্রশ্নটার সামনে থমকে গিয়েছিলেন। সত্যিই তো, নতুন জন্ম ছাড়া সন্ন্যাসী-ব্রহ্মচারীরাই বা আসতেন কোত্থেকে? আর এই নতুন জন্ম তো শুধু শারীরিক নয়। ভয়হীনতার জন্মটাও জন্ম। রবি ঠাকুরের সেই গানটা মনে পড়ছিল, ‘ভয় হতে তব অভয় মাঝে নূতন জন্ম দাও হে’। উত্তরণ অল্পদিনেই টের পেয়েছিলেন যে এই দেশটা কাউকে খুব বেশি ভয়ে বাঁচতে দেয় না। এখানে কোনও স্কুলে আমেরিকার রাষ্ট্রপতির স্ত্রী গিয়ে কোনও বাচ্চার কাঁধে হাত দিলে সেই বাচ্চাটা বলে উঠতে পারে, ‘ও তুমি এসেছ? আমি ভাবছিলাম বোধহয় কোনও ফিল্মস্টার আসবে।’ ইউনিভার্সিটির নোবেল প্রাইজ় পাওয়া প্রফেসরকে সেই ইউনিভার্সিটির বাথরুম যে পরিষ্কার করে সে-ও সন্ধে ছ’টার পর নাম ধরে ‘হাই’ বলতে পারে আর যাকে বলা হচ্ছে সেই প্রফেসরও ‘হ্যালো’ বলেই উত্তর দেয়।

এম এ পরীক্ষার আগে-আগে একবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লার্ক হরিমাধববাবুর মেয়ের বিয়েতে গিয়েছিলেন উত্তরণ। হরিমাধববাবু ওঁকে খুব পছন্দ করতেন বলে নেমন্তন্ন ফেরাতে পারেননি। কিন্তু বিয়েতে গিয়ে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখেছিলেন। ডিন আসতেই একেবারে পায়ের কাছে পড়ে গেলেন হরিমাধববাবু। মনে হচ্ছিল শরীরের হাড়-পাঁজরা গুঁড়িয়ে দিয়ে নিজেকে ধন্য করবেন। কিছু বলতে পারেননি, বলার উপায় ছিল না বলে, কিন্তু উত্তরণের খারাপ লেগেছিল।

সেই খারাপ লাগার স্মৃতি থেকেই উত্তরণ প্রতিনিয়ত অনুভব করতেন যে আমেরিকা নিজের দোষ-গুণ নিয়েই মানুষের অভ্যন্তরীণ ক্রীতদাসত্ব থেকে মানুষকে অনেকাংশে মুক্তি দেয়। অন্যের দেশে না হলেও, নিজের ভৌগোলিক সীমার মধ্যে। আর হয়তো সেই সীমার ভিতরের অসীমকে চেনানোর জন্যই ফ্রেজ়ার এদিক-ওদিক সেমিনারে পাঠাতেন উত্তরণকে। যত না বলতে, তার চেয়ে বেশি শুনতে। উত্তরণেরও খুব ভাল লাগত, বাসে-ট্রেনে চেপে আমেরিকার মহল্লা, শহর, মানুষ চিনতে চিনতে যেতে। সেই ভাললাগা ভিতরে নিয়েই ইউনিভার্সিটিতে সারাদিন হাড়ভাঙা খাটনির পরেও, ফ্রেজ়ারের কথায় এক ঘণ্টার নোটিসে মেমফিস যেতে রাজি হয়ে গেলেন উত্তরণ।

আটলান্টা থেকে মেমফিস কম-বেশি চার ঘণ্টার পথ। তার উপর বাসটা প্রায় তিন ঘণ্টা লেট। আমেরিকাতেও যে এমনটা হয়, জানতেন না উত্তরণ। যখন বাসে উঠলেন, শরীর ভেঙে আসছে ঘুমে। কিন্তু পাশে বসা মেয়েটি সেই সময় পৃথিবীতে সদ্য আসা মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে খেলছে। কিছুটা কৌতুহল, কিছুটা বিতৃষ্ণায় যন্ত্রটির দিকে তাকালেন উত্তরণ। দেশে থাকতে একে দেখেননি, এখানে এসে দেখছেন। এ কি যন্ত্র, নাকি সারাক্ষণ মানুষকে বেঁধে রাখার এক কৌশল? কোথাও কেউ কারওর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে খুব বেশিক্ষণ থাকতে পারবে না। সংযুক্ত থাকতে হবে, রেডারের মধ্যে থাকতে হবে। মেয়েটা মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে রেখেছিল, পাশে বসা উত্তরণের চোখে আলো এসে পড়ছিল। উত্তরণ দু’-তিনবার খুব নম্রভাবে মেয়েটিকে অনুরোধ করলেন, যদি হাত দিয়ে একটু আড়াল করা যায় আলোটা। ওঁর একটু ঘুমের প্রয়োজন, তাও জানালেন। কিন্তু মেয়েটা পাত্তাই দিল না। খারাপ লাগল উত্তরণের। এরা কি শ্বেতাঙ্গ বলে অন্য কাউকে মানুষ মনে করে না?

বাসটা এক ঘণ্টা পরে থামল, অক্সফোর্ড বলে একটা জায়গায়। এদের এখানকার বাস এক ঘণ্টা-দেড় ঘণ্টা পরপর থামে। যে কোনও গ্যাস স্টেশনে টয়লেট থেকে শুরু করে ছোটখাটো ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, সবই থাকে। বাস থেকে নেমে, ওয়াশরুম হয়ে উত্তরণ যখন আবার বাসে উঠছেন, বাসের ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল, “ইজ় এভরিথিং অলরাইট?”

দশবারের মধ্যে ন’বার উত্তরণ এই প্রশ্নটার উত্তরে ঘাড় নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলে চলে আসতেন। কিন্তু ভয়ংকর ক্লান্ত ছিলেন বলেই হয়তো তিনি ওই মেয়েটি, তার হাতের মোবাইল এবং নিজের অসুবিধের কথা বলে ফেললেন।

বাসের ড্রাইভার ওঁর কথার কোনও উত্তর না দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে মেয়েটির কাছে গিয়ে কথা বলতে শুরু করল। আধ মিনিটেরও কম সময়ে উত্তরণকে লক্ষ করে ড্রাইভার বলে উঠল, “আর অসুবিধে হবে না। আসলে মেয়েটা বোবা আর কালা তো, তাই আপনার কথা বুঝতে পারেনি।”

উত্তরণের পিঠে যেন সপাং করে একটা চাবুক পড়ল। জীবনে এই প্রথম নালিশ করলেন আর এমন একজনের বিরুদ্ধে করলেন যে সেই নালিশটাই ঘুরে এসে ওঁকে মারল। আশ্চর্যের বিষয়, মানুষ মানুষের সম্বন্ধে এইরকম কত ধারণা নিয়ে থাকে, আর যতক্ষণ না আঘাত পায়, সেই ধারণা বদলায়ও না। উত্তরণ যদি নালিশ না করতেন, তা হলে কি বুঝতে পারতেন যে মেয়েটা আসলে কী! বরং ওই ভ্রান্তিটাই মনে-মনে বহন করতেন যে মেয়েটা যারপরনাই উদ্ধত। সেদিক থেকে সত্যিটা জানতে পেরে ভালই তো হয়েছে। কিন্তু তাও উত্তরণ এত গ্লানি বোধ করছিলেন কেন?

কেন চোখ জলে ভরে গেল যখন বারবার ওঁর হাতদুটো ধরে ক্ষমা চাইছিল সেই সতেরো-আঠেরোর মেয়েটা। আর তাতেও অপরাধের স্খলন হয়নি ভেবে যখন ওঁকে জড়িয়ে ধরল মেয়েটা, উত্তরণের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল কেন এক লহমার জন্য?

সেই দমবন্ধ অবস্থাতেই ব্রহ্মচারী ঠাকুরের কথা ভাবছিলেন উত্তরণ। ঠাকুর বলতেন, ‘পুণ্যঞ্চ পরোপকারে, পাপঞ্চ পরপীড়নে।’ পরের উপকারেই যত পুণ্য আর পরকে পীড়ন করার মধ্যেই সব পাপ। আচ্ছা, অপমান কি পীড়ন নয়? তা হলে কি মেয়েটিকে অপমান করছেন উত্তরণ, তাকে জড়িয়ে না ধরে? বাস অ্যাক্সিডেন্টের হাত থেকে বাঁচানোর পর অনসূয়া যখন ওঁকে জড়িয়ে ধরেছিল রাস্তার মধ্যে, তখন উত্তরণ নিজের বোধে ছিলেন না। সেদিন ওই ঘটনাটা না ঘটলে পরের কোনও কিছুই ঘটে না আর উত্তরণের আমেরিকায় আসাও হয় না। তাতে ব্রহ্মচারী ঠাকুর আদৌ রুষ্ট হয়েছিলেন কিনা উত্তরণ জানেন না। কিন্তু আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলের এক শহর থেকে অন্য শহরে যাওয়ার পথে, চলন্ত বাসের মধ্যে উত্তরণ যখন নিজের কাঠ হয়ে যাওয়া হাতদুটোকে সচল করে জড়িয়ে ধরলেন ওই বোবা-কালা মেয়েটাকে, ওঁর মনে হল ঠাকুর অলক্ষ্যে তৃপ্তির হাসি হাসছেন। নইলে আকাশের চাঁদটা অত ঝলমল করছে কেন?

১৩

মানুষের কতরকম চেহারা, কত ছদ্মবেশ, কত আয়না। তবু তার মধ্যে কিছু মানুষ থাকে যারা পাঁচ মিনিটেই অন্যকে আপন করে নিতে পারে, আত্মীয় বানিয়ে ফেলতে পারে। আটলান্টার সঞ্জয় পাল সেরকমই একজন। হো-হো করে হাসা, জোরে-জোরে কথা বলা ভদ্রলোকের স্বভাব। আর নেশা হল, নতুন কোনও বাঙালি শহরে এসেছে জানতে পারলেই তাকে আটলান্টা ঘুরিয়ে দেখানো এবং আটলান্টার বাঙালি সমাজে পরিচিত করে দেওয়া।

উত্তরণের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। উত্তরণ সবকিছু থেকেই একটু সরে থাকতে চাইতেন। কিন্তু সঞ্জয়দা কাউকে খুব বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না। বিশেষ করে যাদের একবার মনে ধরে যেত, তাদের তো নয়ই।

উত্তরণের ইউনিভার্সিটিরই বায়োলজির প্রফেসর রুদ্রশিবের সুত্রে সঞ্জয়দার সঙ্গে আলাপ উত্তরণের। রুদ্রশিব কবিতা লিখত। সেই সূত্রে অনেকের সঙ্গে পরিচয় ছিল। উত্তরণকে প্রায় জোর করেই সে নিয়ে গিয়েছিল একটা অনুষ্ঠানে। সেখানেই সঞ্জয়দার চোখে পড়ে যান উত্তরণ।

লোকটা এই গান গাইছিল তো ওই একটু গিটারটা টেনে নিয়ে দু’বার তারে হাত বুলিয়ে নিচ্ছিল। আসলে যেটা করছিল, সেটা হল, সবার খাওয়া-দাওয়ার তদারকি। আর সেটা করতে গিয়েই হয়তো চোখে পড়ে থাকবে যে উত্তরণ দাঁতে কুটোটি না কেটে বসে আছেন।

“ঝট করে এই মাংসটা টেস্ট করে বলো তো, সঞ্জয় শেফ কেমন বেঁধেছে।” উত্তরণের সামনে এক বাটি মাংস হাতে দাঁড়িয়ে গেলেন ভদ্রলোক।

উত্তরণ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সরে যেতে গেলেন, কিন্তু সঞ্জয়দা নাছোড়বান্দা। পারলে চামচে করে তুলে খাইয়ে দেন উত্তরণকে।

রুদ্রশিব উত্তরণের আচার-আচরণ বেশ খানিকটা জানত। ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পেরে এগিয়ে এসে ফিসফিস করে কিছু বলল সঞ্জয়দাকে। কিন্তু সঞ্জয়দার অভিধানে কোনও ফিসফিসানির জায়গা ছিল না। সবই লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার।

“আশ্রমিক? কোন আশ্রমে থাকে? আমেরিকার ওই ফ্রি-সেক্স আশ্রমগুলোতে?” বেশ জোরেই জিজ্ঞেস করলেন সঞ্জয়দা।

“আরে ধ্যাত! দেশে আশ্রমে থাকত। এখানে এসেও সেই নিয়মকানুনগুলো মেনে চলে।” রুদ্রশিব বিরক্ত গলায় বলল।

“আরে ইন্ডিয়াতে প্রেমাশ্রমে থাকত না বৃদ্ধাশ্রমে থাকত, তাই দিয়ে আমেরিকায় কী? আমরা যে যার পূর্বাশ্রম দেশের ফুটপাতে, নর্দমায়, কিচেনে, বাথরুমে ফেলে এসেছি। ফেলে এসে, এখানে যে যার মতো বেঁচেবর্তে আছি। পাপ করছি, পাপের বেতন পাচ্ছি, হিসেব বরাবর হয়ে যাচ্ছে।”

“ক’পেগ টেনেছ অলরেডি?” রুদ্রশিব জানতে চাইল।

“যতগুলোই টানি, মাংসের টেস্টটা যা হয়েছে না, তোমার বড়-বড় হোটেলের রাঁধুনিরা ফেল করে যাবে। তোমার সন্নিসি বন্ধু তো খেল না, তুমি খেয়ে বলো।” সঞ্জয়দা হেসে উঠলেন।

ওই হাসিটাই লোকটার ট্রেডমার্ক। ওটা দিয়েই শেষমেশ মানুষের মন জিতে নিত লোকটা। উত্তরণ প্রথমে যেটাকে অবজ্ঞা ভেবেছিলেন, কিছুদিন যেতেই বুঝলেন, সেটা সঞ্জয় পালের সারল্য। আর সেই সারল্যের সামনে গলবে না, এমন পাষাণ-হৃদয় কমই আছে।

“সন্ন্যাসী হতে গেলে কিন্তু একটু পাহুর-দিল হতে হয়।” সঞ্জয়দা হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললেন।

উলটোদিকের সোফায় বসে কফি খাচ্ছিলেন উত্তরণ। কিছু না বলে একবার তাকালেন বক্তার দিকে। ভাবতে লাগলেন, প্রথমদিন যে লোকটাকে দেখে অস্বস্তি হচ্ছিল, সেই লোকটা দুবার ফোন করে আর-একবার আচমকা উত্তরণের ঘরে গিয়ে এমনই মজিয়ে দিল যে, উত্তরণ সটান নেমন্তন্ন রক্ষা করতে ওঁর বাড়িতে চলে এলেন, যা আমেরিকায় আসা ইস্তক আর কারও ক্ষেত্রেই করেননি।

উত্তরণকে কফি দিয়ে গিয়েছিলেন যে ভদ্রমহিলা তিনি ফিরে এলেন একটা ভর্তি প্লেট হাতে।

“নাও, আমার বাগানের কুমড়োফুলের বড়া খাও। এতে কোনও আশ্রম কিংবা ধর্মের কোনও আপত্তি থাকতে পারে না।” বলেই আবারও হেসে উঠলেন সঞ্জয়দা।

উত্তরণ একটু থমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আমেরিকায় কুমড়োফুল?”

“আমেরিকায় কী নেই বলো তো? একজন বড় রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ছিলেন জানো, এক-দুবার উত্তর আমেরিকার বঙ্গ সম্মেলনেও এসেছেন। রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে বলতে উঠলেই, গলা কাঁপিয়ে বলতেন, ‘রবীন্দ্রনাথে কী নাই!’ আমিও নিউ ইয়র্কের মুড়ি, শিকাগোর জিলিপি আর আমাদের আটলান্টার শিঙাড়া খেতে-খেতে বলি, আমেরিকায় কী নাই? অবশ্য বিশ বছর আগে যখন এসেছিলাম তখন কিছুই মিলত না। আজ মেলে সবকিছু।

ভাল লাগলে মানুষের প্রতিরক্ষা কাজ করে না। সঞ্জয়দার প্রতি ভাললাগা তৈরি হয়ে গেল বলেই ছোটবেলার কথা, আশ্রমে আসার কথা, ব্রহ্মচারী ঠাকুরের কৃপার কথা বলতে শুরু করেছিলেন উত্তরণ।

সঞ্জয়দা উত্তরণের হস্টেলের ঘরে চুপচাপ শুনছিলেন। আজ বললেন, “আমি বস এসব ব্যাপারে বিশেষ কিছুই জানি না। কিন্তু একটা কথা তোমায় বলি, ওই তোমাদের বেদে না উপনিষদে ভগবান বলেছেন না, ‘আমি এক, আমি বহু হব’? তবে তো ভগবান ক্রিয়েশন বাড়ানোর কথাই বলছেন। এবার সেক্স ছাড়া ক্রিয়েশন বাড়বে কী করে? তোমাদের মতো ব্রাইট যুবকেরা যদি সন্ন্যাসী হয়ে থাকে, তা হলে ভবিষ্যতের পৃথিবী তো লুম্পেন আর ক্রিমিন্যালে ভরে যাবে। সেটা কিন্তু কোনও কাজের কথা নয়।”

ফ্রেজ়ারের কথাগুলোই উত্তরণ একটু অন্যভাবে বলতে শুনছিলেন সঞ্জয়দাকে। নাকি, ফ্রেজ়ার কিংবা সঞ্জয় পাল নির্বিশেষে এই কথাগুলো আমেরিকার? যারা দেশটার সঙ্গে সম্পর্কে আসবে, সবাইকেই শুনতে হবে!

“আরে ও প্রথম দিন এসেছে, ওকে এত বিরক্ত করছ কেন? ওকে ওর মতো থাকতে দাও না। কতই বা বয়স ওর? যদি টানার হয়, সংসারই টেনে নেবে। ওকে কিছু করতে হবে না।” উত্তরণের প্লেটে আরও দুটো বড়া দিতে এসে ভদ্রমহিলা বললেন।

সঞ্জয়দা খুশি হয়ে উঠলেন কথাটা শুনে। “দারুণ বলেছ কমলিকা। সংসারই আমাদের টেনে নেয়, আমাদের সংসারকে টানতে হয় না। আচ্ছা উত্তরণ, কমলিকা যে যৌবনে সুন্দরী ছিল, সেটা ওকে এখন দেখলেও বোঝা যায়, তাই না?”

“এবার আপনি আমাকে বিব্রত করছেন সঞ্জয়দা। আমি ঠিক এভাবে কাউকে দেখতে অভ্যস্ত নই।”

“উফফ এই ছেলেটাকে নিয়ে আমি মরে যাব! আরে একটা মহিলার রূপ নিয়ে একটু নিরপেক্ষ মতামত আশা করতে পারব না তোমার থেকে? তুমি কী?”

“আবার তুমি জ্বালাতন করা শুরু করলে ছেলেটাকে? ও আর আসবেই না তোমার বাড়িতে! এখনই হয়তো ভাবছে কখন পালাব?” কমলিকা ঝাঁঝিয়ে উঠলেন।

“না বউদি, তেমনটা ভাবিনি আমি। সঞ্জয়দা একটু মজা করে কথা বলেন, জানি সেটা।”

উত্তরণের কথাটার পরপরই পিনপতনের নিস্তব্ধতা নেমে এল সারা ঘরে। কিছুক্ষণ পরে কমলিকা বললেন, “আমি কারওর বউ নই, তাই কারওর বউদি হওয়ারও যোগ্যতা আমার নেই। তুমি আমাকে ‘কমলিকাদি’ বলে ডেকো উত্তরণ। জাস্ট ‘কমলিকা’ও বলতে পারো।”

উত্তরণ ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে, একবার কমলিকা আর একবার সঞ্জয়দার মুখের দিকে তাকালেন।

সঞ্জয়দা নিঃশব্দে দুটো চুমুক দিয়ে বললেন, “ভাল মানুষ নই গো মোরা, ভাল মানুষ নই। কমলিকা আমার স্ত্রী নয় উত্তরণ। তাই বলে রক্ষিতাও নয়।”

“কী বলছেন, কিছু বুঝতে পারছি না।”

“বুঝবে, এখানকার বাঙালিদের সঙ্গে তোমার খুব একটা মেলামেশা নেই, তাই। থাকলে আগেই বুঝতে। অবশ্য আমার বাড়িতে তুমি এসেছ, খাওয়া-দাওয়া করেছি আমরা একসঙ্গে, এটা চাউর হলে, লোকজন নিজের দায়িত্বে তোমাকে এসে জানিয়ে যাবে যে আমি কতটা খারাপ, আমার বউ থাকতেও একটা বাঙালি রক্ষিতা আছে, আমেরিকার আইনকে কলা দেখিয়ে তাকে আমি নিকটাত্মীয়া হিসেবে নিজের বাড়িতেই রেখে দিয়েছি, ইত্যাদি-ইত্যাদি।

“এসব শুনে আমার কী লাভ? শুনতে যাবই বা কেন?” উত্তরণ উঠে দাঁড়ালেন।

“তুমি তো বিরাট ব্যবসায়ী হে! যা শুনে লাভ হয়, শুধু তা-ই শোনো! কিন্তু সংসারে মানুষ তো নিজের দুঃখ-কষ্টের কথাই অন্যকে বলতে চায়। তাই শুনে লাভ না হলেও, মানুষ শোনে মানুষের কথা। সেটাই সভ্যতা, সেটুকুই মানবিকতা। তুমি বোসে। এখনই যাওয়ার কোনও সিন নেই।”

“সঞ্জয়, ও যেতে চাইলে যাক। হয়তো ওর অস্বস্তি হচ্ছে এই পাপের পরিবেশে থাকতে।”

“চাইলেও এখান থেকে পুণ্যের পরিবেশে ও যাবেটা কী করে? সাধু মহারাজ তো এখনও গাড়ি চালাতেই শেখেননি। শেখা থাকলে পরে আমার একটা গাড়ি দিয়ে দিতাম। এখন সেই আমাকেই তো পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে। বসুক অতএব…”

“কিন্তু তুমি ড্রিঙ্ক করে…”

“‘ছাড়ো তো ড্রিঙ্ক। এর তিনগুণ মদ খেয়ে তোমায় নিয়ে ফিরিনি? তখন আবার রাস্তায় নিশ্বাস পরীক্ষা হচ্ছিল। যে লোকটা চেক করছিল সে গাধাট-ই বলতে হবে, নয়তো আমাকে যেতে দিল কেন? কিংবা কে জানে, ব্যাটাচ্ছলে নিজেও খেয়ে ছিল হয়তো। তাই এক গন্ধে অন্য গন্ধ চাপা পড়ে গিয়েছে। জীবনে তো সেটাই হয়, তাই— না?”

“তোমার নেশা হয়ে গিয়েছে সঞ্জয়। তুমি আধ ঘণ্টা ঘুমিয়ে এসো। আমি কথা বলছি উত্তরণের সঙ্গে।”

“সে তুমি বলতেই পারো। কিন্তু ঘুমোলে নেশা কেটে যায়, কে বলল তোমায়? তুমি চলে যাওয়ার পর তো কত ঘুমিয়েছি, কেটেছে?”

“কেটে যাওয়া উচিত ছিল। তুমি চেষ্টা করোনি ঠিকমতো।”

“করেছিলাম গো করেছিলাম। আর চেষ্টার আছেটা কী, প্রথম এখানে আসার পর থেকে যে মুখে রক্ত-ওঠা পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে যেতাম, তাতে বাপের নামই মনে থাকত না, অন্য কিছু তো দূর অস্ত্! তার মধ্যেই ভেরোনিকার সঙ্গে পরিচয়। কমলিকা, তুমি তো জানো ভেরোনিকার কথা, জানো না? সে কী মেয়ে ছিল রে ভাই উত্তরণ, পুরো আগুনের গোলা। রেস্তরাঁয় বাসন মাজলে কী হবে, এক-একটা বুক পুরো পৃথিবীর সাইজ়ের! আর ফ্যাটফেটে ফরসা ছিল না বলে আরও ভাল লাগত আমার। ট্যুরিস্টরা যেমন নতুন স্পটের টানে ভেসে যায়, আমি ওই গোলার্ধের টানে ভেসে গেলাম। তার কাছে কোথায় তোমার গীতা-পুরাণ। শুধু ঘি আর আগুন, আগুন আর ঘি!”

কমলিকাদি কড়া গলায় বললেন, “আবার এসব গল্প শুরু করলে?”

“আরে আমাকে যখন চিনছে, তখন পুরোটাই তো চিনবে। তা ছাড়া মেক্সিকান মেয়েদের সেক্স অ্যাপিল প্রচণ্ড। কাল যদি উত্তরণের জীবনে একটা মেক্সিকান মেয়ে আসে, তা হলে ও কতটা ব্রহ্মচর্য বজায় রাখতে পারবে, আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। ভেরোনিকা একটা জার্মানের সঙ্গে ভেগে না গেলে, আমি ওই মেক্সিকানই বিয়ে করতাম, ইতালিয়ানের চক্করে পড়তাম না।”

“তুমি কি না চাইতেই চক্করে পড়ে যাও?” কমলিকাদি ব্যঙ্গের গলায় বললেন।

সঞ্জয়দা বোধহয় শ্লেষটা ধরতে পারলেন না। তিনি বলে চললেন, “ইতালিয়ান মেয়েরা একটু নরম-সরম, সংসারী গোছের হয় তো! আর সারা আমাকে যেভাবে আঁকড়ে ধরেছিল, কাটিয়ে বেরোতে পারিনি। চাইওনি হয়তো।

উত্তরণ শুনতে-শুনতে একটা ধাঁধার মধ্যে পড়ে যাচ্ছিলেন।

সঞ্জয়দা যেন সেটা বুঝতে পেরেই বলে উঠলেন, “আমি বলব তুমি এখন কী ভাবছ? ভাবছ যে সঞ্জয় পালের মেক্সিকান বান্ধবী ছিল, ইতালিয়ান বউ আছে, তা হলে এই ভদ্রমহিলা কে? আরে, কমলিকা গুপ্ত আমার প্রেমিকা, মাই ফার্স্ট লাভ।” বলতে-বলতে হাতে ধরা গ্লাসটা শেষ করে দিয়ে বললেন, “তোমার সত্যিই চলবে না?”

উত্তরণ ঘাড় নাড়লেন।

সঞ্জয়দা আবার প্রসঙ্গে ফিরে গিয়ে বললেন, “কফিই খাও তবে। বাট ভেবো না যে আমি নেশা করে বলছি। সম্পূর্ণ সজ্ঞানে বলছি, প্রেম কী, সেই বোধ, কমলিকার মধ্যে দিয়েই এসেছিল জীবনে। ও আমার প্রথম প্রেমিকা।”

“প্রেমিকা না ছাই। আমি তোমার বাড়ির ঝি।”

“কমলিকা, আমি বহুবার তোমাকে এভাবে কথা বলতে বারণ করেছি। তুমি আমার দেবী, মাই গডেস। কার এত হিম্মত যে ঝি মনে করবে তোমাকে?”

“হিম্মতের দরকার নেই। এমনিই সবাই মনে করে। দু’দিন পরে এই উত্তরণও করবে দেখে নিয়ো।”

“না, মনে করবে না। উত্তরণ সেরকম ছেলে নয়। আর কেউ করলেও, আই কেয়ার আ ফিগ। কারণ আমি জানি যে তুমি এই বাড়িতে ঝি হিসেবে আসসানি। সঞ্জয় পালের বাড়িতে তোমার পজিশন কখনও ঝি-এর হতে পারে না।”

“সে তোমার বউ তিন মাসের জন্য ফ্রান্সে ছেলের কাছে গিয়েছে বলে আমি রানি সেজে আছি। যেদিন সারা ফিরবে তার পরদিনই…”

“কী হবে পরদিন? তোমার সঙ্গে সাংঘাতিক দুর্ব্যবহার শুরু করবে? করেছে আজ পর্যন্ত?”

“করেনি কারণ ইউরোপিয়ান ভাবধারায়, মানুষকে ঝি হিসেবে ভাবাটা বাঙালিদের মতো মজ্জাগত নয়। তবু আমি আমার পজ়িশনটা কখনও ভুলতে পারি না। ভোলা উচিত নয়। একটাই শুধু আক্ষেপ যে, নিজেরই ভুলে, যে বাড়ির মালকিন হতে পারতাম সেখানে ঝি হয়ে আছি।”

ব্যাপারটা একেবারেই পরিষ্কার না হলেও উত্তরণ জিজ্ঞেস করে পরিষ্কার করে নিতে চাননি। প্রথমত সাংসারিক ব্যাপারে ওঁর তেমন কোনও আগ্রহ ছিল না। তার চেয়েও যেটা গুরুত্বপূর্ণ, তা হল বিতর্কিত ব্যাপারে প্রশ্ন করে সঞ্জয়দা কিংবা ওই সদ্য পরিচিতা ভদ্রমহিলা, কাউকেই বিব্রত করতে মন করেনি।

সেদিন রাতে না খেয়ে আসতে দেননি কমলিকাদি। কিন্তু কোথাও একটা তাল কেটে গিয়েছিল বলে খাওয়ার টেবিল থেকে আনন্দ উধাও হয়ে গিয়েছিল। সঞ্জয়দা ঝিম হয়ে শুয়েছিলেন সোফায়। গাড়ি করে উত্তরণকে ফেরত দিয়ে আসার সময়ও তেমন কোনও কথা বলেননি। শুধু উত্তরণ নেমে যাওয়ার সময় তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন।

সেই দৃষ্টিতে এমন কিছু ছিল যা উত্তরণকে চুপ করে থাকতে দেয়নি। উত্তরণ প্রায় বাধ্য হয়েছিলেন জিজ্ঞেস করতে, “কিছু বলবেন সঞ্জয়দা?”

“তুমি যেখানে থাকো সেটাকে ‘হাউস হোটেল’ বলে, তাই না?”

“হ্যাঁ। জানি না কেন, হস্টেল’ শব্দটা ব্যবহার করে না এরা।”

সঞ্জয়দা বললেন, “ভালই করে। অন্য শব্দটার ব্যাপ্তি অনেক বেশি।”

দু’সপ্তাহ পরে উত্তরণ আবার যেদিন সঞ্জয়দার অনুরোধ ফেলতে না পেরে ওই বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলেন, সেদিন সঞ্জয়দা হাসতে হাসতে বললেন, “দেখলে তো আবার আমার ‘হাউস হোটেলে’ আসতে হল তোমায়? ভাবছ, এটা বাড়ি বাড়ি হলে তো নিজের মনের মানুষকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিয়েই রাখতে পারতাম। প্রেমিক-প্রেমিকারা হোটেলে গেলেও লুকিয়ে-লুকিয়ে থাকে, জানো তো?”

“প্রেমিক-প্রেমিকারা হোটেলে অন্তত একসঙ্গেই থাকে, একটাই ঘরে। এখানে তো সেই স্বাধীনতাও নেই আমাদের। তবু তার জন্য এই বাড়িটা ‘হোটেল’ হয়ে যায় না। এটা বাড়িই। সঞ্জয় আর সারার বাড়ি। আর ওদের ছেলে শুভায়ুর বাড়ি। সারা সামনের সপ্তাহে ফিরে আসবে, সঞ্জয়কে আবার দূরত্ব রেখে মিশতে হবে আমার সঙ্গে, তাই সেন্টিমেন্টাল হয়ে গিয়ে এইসব শোনাচ্ছে তোমাকে।”

“না, আমি আসলে সত্যিটা বলতে চাইছি উত্তরণকে। নয়তো অন্য কেউ যখন আমার আর তোমার নামে নর্দমা উপুড় করবে, খারাপ লাগবে ওর।”

নর্দমাকে যে পাশ কাটিয়ে যেতে চাইছে, নর্দমা তাকেও কীভাবে যেন ছুঁয়ে যায়। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতাতেই দেখেছেন উত্তরণ। তাই জোর দিয়ে বলতে পারলেন না যে নর্দমার পরোয়া করেন না তিনি।

সঞ্জয়দার শেষ কথাগুলো শুনে কমলিকাদি রেগে গেলেন, “নর্দমা ওগরালেই নর্দমাটা সত্যি হয়ে যায় নাকি? শোনো উত্তরণ, তুমি পরে যেখান থেকে যা-ই শোনো না কেন, সত্যিটা হল, সঞ্জয়ের কোনও দোষ নেই। সঞ্জয়দের পাড়ায় আমাদের মামাবাড়ি ছিল। সেখানেই প্রথম আমাকে দেখে ও মাঝে-মাঝে গিয়ে থাকতাম তো ওখানে। ওর তরফ থেকে ব্যাপারটা লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইটই হয়েছিল।”

“আর আপনার তরফ থেকে?” উত্তরণ তো রোবট নন, তাই জিজ্ঞেস করে বসলেন।

“আমি জানি না। একটা ভাললাগা নিশ্চয়ই তৈরি হয়েছিল, কিন্তু সেটা তীব্রতায় সঞ্জয়ের প্যাশনের ধারেকাছে আসত না। আমাদের গাড়ির পিছন-পিছন সাইকেল নিয়ে ফলো করতে গিয়ে ও একবার লরির তলায় চলে যাচ্ছিল।”

“গেলে ভালই হত, কি বলো?”

“বাজে বোকো না তো। অবশ্য বাজে বকাই তোমার স্বভাব। তখনও বকতে। কিন্তু বকলে কী হবে, আমি বুঝতে পারতাম যে এই ছেলেটা আমাকে ভালবাসে। পাগলের মতো ভালবাসে।”

“উত্তরণকে বলো, তুমি কেন ভালবাসোনি?”

“সঞ্জয় স্ট্রাগলিং পরিবারের ছেলে ছিল বলে আমি ভরসা রাখতে পারিনি ওর উপর। আসলে জীবনের লাক্সারিগুলো চেয়েছিলাম। তাই বাড়ি ঠিক করে দেওয়া ইঞ্জিনিয়ারকে বিয়ে করেছিলাম। সেই লোকটা যখন আমাকে বেল্ট খুলে মারত, তার রক্ষিতা এসে যখন আমার মুখের উপর আঙুল তুলত, তখন বুঝতে পেরেছিলাম কত বড় ভুল করেছি। স্লিপিং পিল খেয়ে সুইসাইড করার চেষ্টা করেছিলাম। পারিনি। বেঁচে ফিরে এসেছিলাম, একরাশ লজ্জা মাথায় নিয়ে। তার কিছুদিন পরই সেই ইঞ্জিনিয়ার আর তার রক্ষিতা ঘাটশিলায় ছুটি কাটাতে গিয়ে গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। কিন্তু আমার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা এমনই ছিল যে আমার স্বামীর সম্পত্তির এক কণাও আমি পাইনি।”

“মামলা করেননি?”

“ওদের প্রচুর কানেকশন ছিল, ক্ষমতার সব কেন্দ্রে। লড়েও বিশেষ কিছু করতে পারতাম না। তবু লড়া যেত। কিন্তু যে আমাকে ভালবাসেনি কোনওদিন, তার কিছু নিতেই ঘেন্না করছিল প্রথমত। জীবনের প্রয়োজনে তাও হয়তো চাইতাম, কিন্তু যা ন্যায্যত আমার, তাও যে পাব, সেই বিশ্বাসটাই হারিয়ে ফেলেছিলাম তখন। হারার আগেই হেরে বসে থাকতাম প্রতিটা জুয়ায়। শুধু যে কোনও উপায়ে জীবনটা কাটিয়ে দিতে চাইছিলাম, এটা-ওটা করে। করেওছি। কতরকমের চাকরি যে ধরেছি আর ছেড়েছি, বিশ্বাস করতে পারবে না।”

“দেখতে সুন্দর ছিল বলে, বেশিদিন টিকতে পারত না কোথাও। হায়নারা ঝাঁপিয়ে পড়ত।”

“এই ‘দেখতে সুন্দর’ কথাটা কি সবসময় পাস্ট টেনসেই বলতে হবে সঞ্জয়?” হেসে উঠলেন কমলিকাদি। তারপর উত্তরণের দিকে তাকিয়ে বললেন, “সঞ্জয়ের সঙ্গে এগারো বছর পরে কোথায় আবার আমার দেখা হল, বলতে পারো?”

“কোথায়?”

“সঞ্জয় ফুল-টাইম কাজের লোক চেয়ে কলকাতার একটা খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। একশোর কাছাকাছি মহিলা এসেছিল বিজ্ঞাপনে সাড়া দিয়ে। আমেরিকায় যেতে পারবে, সেই আশায়।”

“সেই ইন্টারভিউতেই সঞ্জয়দা আবার আপনাকে দেখেন?” উত্তরণ খানিকটা চমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

কমলিকাদি কোনও জবাব দেওয়ার আগেই সঞ্জয়দা বলে উঠলেন, “সারা সেই সময় ভীষণ অসুস্থ বলে আমি ইন্ডিয়ায় গিয়ে ওই ভুলভাল বিজ্ঞাপনটা দিয়ে ফেলেছিলাম। তাই বলে কমলিকাকে কাজের লোক হিসেবে আমেরিকায় নিয়ে আসিনি। ভগীরথ যেভাবে গঙ্গাকে মাথায় করে নিয়ে এসেছিল, সেভাবে নিয়ে এসেছি আমার প্রথম প্রেমকে।”

“প্রেম কই? যা আছে সব ধ্বংসস্তূপ।” কমলিকাদি বিষগ্ন গলায় বলে উঠলেন।

উত্তরণের কেমন মনে হল যে কমলিকাদিও নেশা করেছেন। হাতে গ্লাস দেখতে পাওয়া যাক বা না যাক।

“যদি ধবংসস্তূপ হয়ে গিয়ে থাকে, তা হলে সে তোমার একার নয়। আমাদের দু’জনেরই যৌবনের ধ্বংসপ। আমার যৌবন তোমার সঙ্গেই শেষ হয়ে গিয়েছিল।” সঞ্জয়দা নিজের জন্য ড্রিঙ্ক বানাতে-বানাতে বললেন।

“তোমার যৌবন কখনওই শেষ হয়নি। তোমার জীবনে তারপরে অনেক মহিলা এসেছে। তোমার সন্তান হয়েছে, সংসার হয়েছে। সবকিছু শেষ হয়ে গিয়েছে একা আমার। আর সেটাই ঠিক হয়েছে, কারণ আমি তোমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। লোভের দিকে পা বাড়িয়েছিলাম। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু, কে না জানে।” বলতে-বলতে কমলিকাদি দেওয়ালে মাথা ঠুকতে আরম্ভ করলেন।

সঞ্জয়দা গ্লাসটা নামিয়ে এক ঝটকায় উঠে দাঁড়িয়ে পিছন থেকে গিয়ে কমলিকাদিকে জড়িয়ে ধরলেন।

উত্তরণ সোফায় স্ট্যাচুর মতো বসে রইলেন। মনে হল এখান থেকে গিয়ে বেরিয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু কীভাবে বেরোবেন এখনই?

উত্তরণ আছেন না নেই পরোয়া না করে সঞ্জয়দা বলে যেতে থাকলেন, “সারা এখানে থাক বা না থাক, এই বাড়িতে তোমার জায়গা সবসময় আছে, ছিল, থাকবে।”

“আর সমাজের কুৎসা?”

“কোন সমাজ? কিছু নিন্দুকের? কে পাত্তা দেয়? ওরা যখন নেমন্তন্নের লিস্ট করে, তখন বিধবা আর বিপত্নীকদের বাদ দেয়। আমি নিজে দেখেছি। আসলে ওরা ভাবে যে এরা ফ্রি র‍্যাডিক্যাল। কার না কার সঙ্গে জড়িয়ে যাবে। তাই সবসময় জোড়ায়-জোড়ায় চায় সবকিছু। আচ্ছা, মানুষ কি পায়রা?” বলতে-বলতে উত্তরণকে একটা হাত দেখিয়ে সঞ্জয়দা কমলিকাদিকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেলেন।

উত্তরণের খুব খারাপ লাগল। ওঁকে ইশারায় অপেক্ষা করতে বলে কোথায় গেলেন সঞ্জয়দা আর কমলিকাদি? এভাবে চলে যাওয়ার মানে কি? উত্তরণ এখন থাকেনই বা কী করে, চলেই বা যান কীভাবে?

ভাবতে-ভাবতে প্রায় ঘণ্টাখানেক চুপ করে বসে রইলেন উত্তরণ। তারপর সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আলতো ধাক্কা দিতে শুরু করলেন প্রত্যেকটা দরজায়। কিন্তু দিয়েও কোনও সাড়া না পাওয়ায় প্রথম দরজাটার পাল্লাদুটো ধরে ঠেলা দিলেন। জনশূন্য ঘরটায় কেবল একটা মৃদু আলো জ্বলতে দেখলেন। এবার দ্বিতীয় দরজাটায় ঠেলা মারতেই ভিতরে যা দেখলেন তাতে একটা আগ্নেয়গিরি ঝলসে উঠল ওঁর দু’চোখের মাঝখানে। কাঁপতে-কাঁপতে নীচে নেমে এলেন উত্তরণ। দরজা খুলে বেরিয়ে যাওয়ার আগে পিছন ফিরে তাকালেন না একবারও।

বাইরে তখন নিকষ কালো রাত্রি। কনকনে বাতাস।

১৪

“তোমার কিংবা আমার বাবা-মা, অথবা পৃথিবীর সব বাবা-মা’ই একদিন ওই অবস্থায় ছিল বলেই আমরা এই পৃথিবীতে এসেছি, তাই না উত্তরণ?” সঞ্জয়দা সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়লেন লম্বা করে।

সেদিন রাত্রে যা ঘটেছে তারপরে উত্তরণের কথা বলতেই ইচ্ছে করছিল না সঞ্জয় পালের সঙ্গে। তাই বলে মানুষটাকে তাড়িয়েও দিতে পারেননি দরজার মুখ থেকে, ভিতরে এনে বসিয়েছেন। কিন্তু সেদিন সেই ঠান্ডার মধ্যে আটলান্টার রাস্তায় বেরিয়ে যেতে হয়েছিল যাঁর জন্য, তাঁকে দেখে উৎফুল্লও হতে পারছিলেন না উত্তরণ।

“কোথায় ছিলে সেদিন রাতে? কীভাবে বাড়ি ফিরলে?” সঞ্জয়দা উত্তরণের ঘরে ঢুকেই জিজ্ঞেস করলেন।

“পথে-পথে ঘুরছিলাম। আরও কিছুক্ষণ ঘুরলে হয়তো মরেই যেতাম। সামনে একটা পাব পেয়ে সেখানে গিয়ে বসেছিলাম। রাতটা ওখানেই কাটল।”

“উত্তরণ মুখার্জি শেষে পাবে গিয়ে বসল?”

“কী করব, আমার বসার জন্য সিংহাসন তো কেউ সাজিয়ে রাখেনি রাস্তার কোথাও। আর ওই ঠান্ডার মধ্যে, বাইরে আর আধ ঘণ্টা থাকলে…”

“ডবল নিউমোনিয়া হয়ে মরে যেতে, তাই তো?” সঞ্জয়দা উত্তরণকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন।

“কী বলতে চাইছেন?”

“কিচ্ছু না। শুধু চাইছি তুমি ভাবো, কেন তোমার ক্যাটেগরির একটা ছেলেকে পাবে ঢুকতে হল?”

“কী করব, উপায় ছিল না।”

“আমিও সেটাই বলতে চাইছি, উপায় থাকে না। যদি আটলান্টা না হয়ে মিনিয়াপোলিস বা বস্টন হত, তুমি পাঁচ মিনিটও রাস্তায় টিকতে পারতে না। আমাকে আর কমলিকাকে ওই অবস্থায় দেখার পরও আবার আমার বাড়িতেই হয়তো ফিরে এসে কড়া নাড়তে।”

“কখনও নয়। ওই অশালীনতা দেখার পর, কিছুতেই আর…”

“কীসের অশালীনতা? দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ পরস্পরের কাছাকাছি আসবে, এর মধ্যে অশালীনতা কোথায়? অশালীনতা বা অসভ্যতা যদি কিছু হয়ে থাকে সেদিন রাত্রে, সেটা তুমি করেছ।”

“অসভ্যতা করেছি? আমি?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ। তুমি। কোন আক্কেলে তুমি আমাদের ঘরে ঢুকে পড়েছিলে?”

“আমি অন্তত ছ’বার দরজায় নক করেছি। কেবল ওই ঘরের নয়, প্রত্যেকটা ঘরের। কিন্তু কোনও সাড়া পাইনি।”

“সাড়া পাওনি তো নীচে নেমে বসে থাকতে, বা ঘুমিয়ে পড়তে পারতে। দুম করে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢোকার কী ছিল?”

“আশ্চর্য! আমি বাড়ি ফিরতাম না?”

“কেন, কোন প্রিন্সেস ডায়ানা তোমার জন্য অপেক্ষা করছিল? একটা রাত আমার বাড়িতে থেকে গেলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত?”

“আমায় মাফ করবেন, আমি আপনার সঙ্গে ঝগড়া করতে পারব না।”

সঞ্জয়দা কথা বলতে-বলতে হঠাৎ কেঁদে ফেললেন, “ঝগড়া আমিও করতে আসিনি রে ভাই। আমার ভিতরটা যদি তোমাকে দেখাতে পারতাম। সেখানে আলাস্কার থেকেও বেশি ঠান্ডা। সেই শীতে আত্মা জমে বরফ হয়ে যায়। তার থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্যই, সেই রাতে…”

“আমি আপনাদের বিব্রত করব বলে ঘরে ঢুকে পড়িনি সঞ্জয়দা। ঢোকার পরেও প্রাথমিক আঘাতটুকু কাটিয়ে উঠতে যতক্ষণ লাগে, তার থেকে বেশি এক সেকেন্ডও…”

“আমি জানি। সংসার সম্পর্কে জ্ঞান নেই বলেই তুমি বুঝতে পারোনি, পুরুষ আর নারী একসঙ্গে কোনও নিভৃত জায়গায় গেলে, কীসের জন্য যায়! সেই বোধ থাকলে তুমি আমাদের খুঁজতে না, অপেক্ষা করতে আমাদের জন্য।”

“জানি না। তবে এটুকু বুঝতে পারছি, আপনাদের বাড়ি যাওয়াই ভুল হয়ে গিয়েছিল আমার।”

“ভুল নয়, কিচ্ছু ভুল নয়। মানুষ মানুষের সঙ্গে না মিশলে বাঁচবে কী করে? ওরকম হয়, হয়ে যায়। মন থেকে মুছে ফেলতে হয়। আমার স্ত্রী সারা ইউরোপ থেকে ফিরে এসেছে। ওর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়ার জন্য একটা উইকএন্ডে তোমায় আবার নিয়ে যাব…”

“মাফ করবেন, আমার পক্ষে আর ওই বাড়িতে যাওয়া সম্ভব নয়।”

“সম্ভব নয় কেন? ওখানে তুমি একজন বিবাহিত পুরুষকে অন্য একজন নারীর সঙ্গে নগ্ন হয়ে শুয়ে থাকতে দেখেছ, তাই?”

সঞ্জয়দার চাঁচাছোলা প্রশ্নগুলো আবার সেই মুহূর্তে নিয়ে যাচ্ছিল যেখানে উত্তরণ, সুতোহীন দুই নারী-পুরুষকে, ক্রিয়াশীল নয়, ঘুমন্ত অবস্থায় দেখেছিলেন। কিন্তু সেই ঘুমের গায়ে এমন একটা আশ্লেষ লেগে ছিল, যা ব্রহ্মচর্য পালন করে আসা উত্তরণকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। এমন একটা পর্ণগ্রাসের ছায়া লেগে ছিল ওই ঘরের হালকা নীল আলোয়, যা পৃথিবীর সব জ্যোৎস্নাকে প্রশ্নচিহ্নের মুখে ফেলে দিতে পারে।

সিঁড়ি দিয়ে প্রায় ছুটে নেমে এসে যখন দরজা খুলে বেরিয়েছিলেন উত্তরণ, ওঁর মনে পড়ে গিয়েছিল একবার অনসূয়াকে, স্নান করছে এমন অবস্থায় দেখার কথা। তখন উত্তরণের, ওই বাড়িতে বসবাসের প্রায় এক বছর হয়ে গিয়েছে। সারা সকাল কার্ল পপারের একটা বই ঘেঁটে ক্লান্ত উত্তরণ ছাদে উঠেছিলেন টবের গাছগুলোয় একটু জল দেবেন বলে। প্রথমে খেয়ালও করেননি, কিন্তু শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখেন ছাদের যে অংশটায় শেড দেওয়া, সেখানে বসে ছাদের কলটা খুলে, বালতি থেকে মগে করে জল তুলে গায়ে ঢালছে অনসূয়া। উত্তরণের উপস্থিতি টের পেয়ে একটুও বিব্রত না হয়ে অনসূয়া বলেছিল যে বাড়ির জলের লাইন খারাপ হয়ে যাওয়ায়, পাম্প চালালে জল উপরে ট্যাঙ্কে উঠছে কিন্তু ট্যাঙ্ক থেকে নীচে নামছে না। তাই লাইন মেরামতির আগে, ছাদে উঠে স্নান করা ছাড়া গতি নেই।

কথাটা শুনেই উত্তরণ জানতে চেয়েছিলেন, “লাইন খারাপ তো বুঝলাম। কিন্তু একতলার চৌবাচ্চায় আমার স্নানের জল কোত্থেকে এল?”

“আমিই ছাদ থেকে বালতি করে নিয়ে গিয়ে ভরে রেখেছি।” স্নান করতে-করতেই জবাব দিয়েছিল অনসূয়া।

অনসূয়ার উত্তরটা শুনে উত্তরণের চোখ ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল। আর, কে জানে কেন, খুব রাগ হয়েছিল মেয়েটার উপর। মাথার ভিতর দপদপানো রাগ আর চোখ থেকে নামা জল খুব সাংঘাতিক জুটি, অন্য সবকিছুকে মুছে দেয় স্লেট থেকে। উত্তরণের মাথা থেকে তাই মুছে গিয়েছিল, অনসূয়া শাড়ি গায়ে জড়িয়ে জল ঢালছিল, নাকি নাইটি পরে। রাতের ওই পাবে বসেও ওঁর মনে পড়েনি সে কথা। কিন্তু সেই গরমের দুপুরে বরানগরের ছাদে ওঁদের কথোপকথনের সঙ্গে ‘সারা’ নামের এক ইতালিয় মহিলার অনুপস্থিতিতে সঞ্জয় আর কমলিকার পরস্পরকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকার কোনও তুলনা হয় না।

“মকটেল খেলে, পাবে গিয়ে?” সঞ্জয়দা জানতে চাইলেন।

উত্তরণ কোনও উত্তর দিলেন না।

“আচ্ছা তোমার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যখন রুক্মিণীদেবীকে বাদ দিয়ে সত্যভামার সঙ্গে শুতেন, তখন কি শোওয়ার আগে তোমার মতো সন্নিসির অনুমতি নিতেন?”

উত্তরণের বলার খুব ইচ্ছে হল, “বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কৃষ্ণচরিত্র’ পড়ে দেখবেন, সেখানে বঙ্কিম বলেছেন যে কৃষ্ণের একটিই স্ত্রী, বাকিটা রটনা।” কিন্তু মুখ খুললেন না।

তখনই, হয়তো খানিকটা মরিয়া হয়েই, বাবা-মায়ের প্রেম এবং প্রত্যেকটি মানুষের পৃথিবীতে আসার পিছনের অমোঘ কারণের কথা উত্তরণকে মনে করাতে চাইলেন সঞ্জয়দা। কিন্তু তার একবার ছিঁড়ে গেলে সহজে আর লাগানো যায় না। লাগলেও আগের সেই সুর তাতে আর বাজে না।

উত্তরণের কাছে উত্তর না পেয়ে এক সময় চলেই গেলেন সঞ্জয়দা। ছ’মাসের মধ্যে একটা ধ্রুপদী সংগীতের অনুষ্ঠানে এবং একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে দেখা হলেও, কথা হয়নি তেমন। দ্বিতীয় দফায় যে ভদ্রমহিলা সঞ্জয়দার সঙ্গে ছিলেন, তিনিই বোধহয় তাঁর বৈধ স্ত্রী। তাঁর সামনে বলেই হয়তো আড়ষ্ট ছিলেন সঞ্জয়দা। কিন্তু সেই গানের আসরে তো একাই ছিলেন, তখনও সেভাবে কথা বললেন কই! উত্তরণ কারণগুলো খোঁজার চেষ্টা করে আর নিজেকে যন্ত্রণা দেননি। পিছনের রাস্তার দিকে না তাকানোই তো ভাল।

সামনের রাস্তাতেই পিছনের চিহ্ন পড়ে থাকে। সেদিন ভাইয়ের পার্ট ওয়ান পরীক্ষায় পাশ করার কথা শুনে ভাল ছিল মনটা। ইচ্ছে করছিল আগের মতো ওকে নিয়ে ঘুরতে যান, খাওয়ান কোনও দুর্দান্ত হোটেলে, এখন তো ছেলেটা কলকাতায় থাকে। উত্তরণের মতো সে নয় একেবারেই, তবু পড়াশোনা করে মোটামুটি একটা জায়গায় পৌঁছতে পারবে ছেলেটা, উত্তরণ বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন। ঠাকুরের কৃপা ব্যর্থ হবে না কখনওই, ভাবতে-ভাবতে এগোতে গিয়ে উত্তরণ দেখেন, সঞ্জয়দা দাঁড়িয়ে আছেন ওঁর অ্যাপার্টমেন্টের সামনেই।

উত্তরণকে দেখতে পেয়েই সঞ্জয়দা ওঁর হাতদুটো জড়িয়ে ধরে বললেন, “একটা প্রার্থনা নিয়ে এসেছি, ‘না’ বলতে পারবে না কিন্তু।”

উত্তরণ ভদ্রলোকের চোখের আর্তির দিকে তাকিয়ে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিতে পারলেন না।

১৫

অন্য কিছু হলে উত্তরণ কিছুতেই রাজি হতেন না, কিন্তু সঞ্জয়দা যে দুর্গাপুজো করার অনুরোধ নিয়ে এসেছিলেন! কীভাবে ‘না’ বলতেন উত্তরণ? সঞ্জয়দার মুখে কথাটা শুনেই চলে গিয়েছিলেন সেই সময়ে, যখন ব্রহ্মচারী ঠাকুর ওঁকে বিশুদ্ধানন্দজির সহযোগী হিসেবে দুর্গাপূজা করতে পাঠাচ্ছেন, যাদবপুরের এক বারোয়ারি পুজোয়। সেখানকার পূজা যিনি করবেন বলে ঠিক ছিল, হঠাৎ করে মা মারা যাওয়ায় তিনি পুরোহিত হতে অসমর্থ হয়ে পড়েন সে-বছর। কিন্তু দুর্গাপুজো যাতে বন্ধ না হয়, তা নিশ্চিত করতেই ঠাকুর তাঁর একজন সন্ন্যাসীকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তন্ত্রধারক হিসেবে উত্তরণকে দিয়েছিলেন সঙ্গে।

“একজন সন্ন্যাসীকে ক্লাবে পুজো করতে পাঠাচ্ছেন?” বিজয়দা এসে জিজ্ঞেস করেছিলেন ঠাকুরকে।

“প্রয়োজন হলে আমি নিজে যেতাম। মায়ের পূজার থেকে বড় তো এই গেরুয়া বস্ত্রটা নয়?” ঠাকুর উত্তর দিয়েছিলেন।

বিজয়দা আর কিছু না বলে, সরে গিয়েছিলেন সামনে থেকে।

সঞ্জয়দা যখন উত্তরণকে বলছিলেন যে তিনি আটলান্টার ভিড় থেকে, চেনা বাঙালিদের থেকে দূরে সরে যেতে চাইছেন, একটু শান্তি পেতে চাইছেন নতুন একটা দুর্গাপুজোর সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে, উত্তরণ ভাবছিলেন বলবেন যে অচেনা বাঙালিরাও তো চেনা হয়ে উঠবে শিগগিরই। তখন তাদের থেকে কোথায় পালাবেন? নাকি জীবনভর এই পালানোর খেলা চলতেই থাকবে?

বলেননি, কারণ লোকটা যে মাতৃ-আরাধনার কথা বলতে এসেছিল। আটলান্টা থেকে কম-বেশি সত্তর কিলোমিটার বা তেতাল্লিশ-চুয়াল্লিশ মাইলের দূরত্বে গ্রিফিন শহরে বসবাস করা পঁচিশ-তিরিশ ঘর বাঙালি এ বছরই প্রথম নিজেরা মিলে দুর্গাপুজোর আয়োজন করেছে। নামে বারোয়ারি হলেও, একেবারেই ঘরোয়া একটা পূজা। দুনিয়ার সব বাঙালির সঙ্গেই যেহেতু কোনও না কোনওভাবে সঞ্জয়দার যোগাযোগ, তাই ওখানকার উদ্যোক্তারা ওঁকেই ধরেছিল পুরোহিত জোগাড় করে দেওয়ার জন্য। সেই অনুরোধ আসামাত্রই সঞ্জয়দার মনে পড়েছে উত্তরণের কথা।

চার দিনের পুজো দু’দিনে করার ব্যাপারে রীতিমতো দ্বিধা ছিল উত্তরণের, কিন্তু ‘যস্মিন্ দেশে যদাচার’-এর ধুয়ো তুলে সঞ্জয়দা ওঁকে রাজি করিয়ে ফেললেন। সঞ্জয়দার পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিল না যে উত্তরণের কাছে এই প্রস্তাবটা গুরুদেবের নির্দেশ হয়েই এসেছে, মা দুর্গার পূজার মধ্যে দিয়ে উত্তরণ আর-একবার ফিরে যাওয়ার রাস্তা পেয়েছেন নিজের শৈশবে, যেখানে মহাষ্টমীর দিন ব্রহ্মচারী ঠাকুর স্বয়ং যজ্ঞে বসতেন এবং সেই যজ্ঞের বিভূতি পাওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যেত ভক্ত-শিষ্যদের মধ্যে।

গ্রিফিন শহরটার মধ্যে বলার মতো তেমন কিছুই নেই, শুধু সত্যদাস বলে এক আমেরিকান বাবার ডেরা আছে কাছাকাছি। এই ভদ্রলোক নাকি যৌবনে ঘোর নাস্তিক ছিলেন এবং তেড়ে নেশাভাঙ করতেন। একবার ভারতে গিয়ে কোন এক সন্ন্যাসীকে এলএসডি খাইয়ে মজা দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই সন্ন্যাসী এলএসডি হজম করে বসেছিলেন সাহেবের সামনে, বিন্দুমাত্র বিকার হয়নি তাঁর। ওই একটি ঘটনায় রবার্ট স্যামসন নিজের পুরনো পথ ছেড়ে ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার রাস্তা বেছে নেন। আমেরিকার নানা প্রান্ত ঘুরে নিজের জন্মস্থান গ্রিফিনেই ফিরে আসেন জীবনের উপান্তে। খুব বেশি লোক যে তাঁর বাড়ি চেনে তা নয়, তবে দশ-কুড়িজন লোকের ভিড় সবসময়ই লেগে থাকে সেখানে, কারণ প্রতি উইকএন্ডে নামগান হয় ওই বাড়িতে। আমেরিকার একটা ছোট্ট শহরে এসে ‘হরে-কৃষ্ণ, হরে-রাম’ শুনতে পাবেন, স্বপ্নেও ভাবেননি উত্তরণ। কিন্তু গ্রিফিনে পা রেখে একটা শুক্রবারের বিকেলে খোল-করতালের আওয়াজ আর তারকব্রহ্ম নাম সংকীর্তনের মধ্যে ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে বেরিয়ে আসার সময় মনে হচ্ছিল, আমেরিকায় পা রাখাটা এঁকে ‘রিলিজ’ করে দেয়নি, বরং আরও পোেক্ত একটা বাঁধনে বেঁধেছে গুরুদেবের সঙ্গে। তাই প্রায় প্রতিটি রাস্তার মোড়েই তিনি ঠাকুরের ইচ্ছাকে ফলবতী হতে দেখছেন নিজের জীবনে।

“দু’-একটা চমৎকার জায়গা আছে ধারেকাছে। রাতের দিকে তোমাকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসব।” সঞ্জয়দা বললেন।

উত্তরণ বললেন, “আমার যা দেখার ছিল, দেখা হয়ে গিয়েছে। আপনি আমায় পুজোর জায়গায় নিয়ে চলুন।”

কোত্থেকে একটা ‘পুরোহিত দর্পণ’ জোগাড় করে এনেছিলেন সঞ্জয়দা। কিন্তু চার দিনের পুজো আড়াই দিনে করার ফ্যাচাং অনেক। তার উপর পূজার নির্ঘণ্ট নয়, শনি-রবির সুবিধা দেখে পুজো করতে হয় বলে এখানে তিথি ধরে সংকল্প করা যায় না। কারণ যে শনিবার অষ্টমীর অঞ্জলি দেবে এখানে প্রবাসীরা, আসলে সেদিন হয়তো একাদশী তিথি। তবু ঈশ্বর যেমন এক পলের ভিতরে কোটি কল্পান্ত ভরে দেন, উত্তরণও তেমন নিজেকে ঈশ্বর ভেবে তিথি-নক্ষত্ৰ-বিধানের পরোয়া না করেই পুজো শুরু করলেন। দেবী দুর্গার প্রাণপ্রতিষ্ঠা কবে যে মানুষ, তাকে তো ঈশ্বর হতেই হবে!

স্মৃতিকে যতদূর সম্ভব ধারালো করে সেই বেলগাছটার কাছে নিয়ে গেলেন উত্তরণ, যার তলায় বসে আশ্রমের প্রবীণ সন্ন্যাসী বিশুদ্ধানন্দজি দেবীর বোধন করেছিলেন কখনও।

আচমনের পর বিষ্ণুস্মরণ, স্বস্তিবাচন… তারপর একে-একে স্বস্তিসূক্ত পাঠ, সংকল্প, ঘটস্থাপন, ভূপসারণ, মাতৃকান্যাস, গঙ্গা-যমুনা-লক্ষ্মী-সরস্বতী বন্দনা, পুজোয় নিজেকে হারিয়ে ফেললেন উত্তরণ। যখন উচ্চারণ করছিলেন, “তামগ্নিবর্ণাং তপসা জ্বলন্তীং/বৈরোচনীং কর্মফলেষু জুষ্টাম।/ দুর্গাং দেবীং শরণমহং প্রপদ্যে/ সুতরসি তরসে নমঃ,” উত্তরণের শিরায়-শিরায় একটা লাভাস্রোত বয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, দুর্গম ভবসাগর থেকে উদ্ধার করবে বলে নৌকা চালিয়ে তাম্রবর্ণা একটি মেয়ে এসে উপস্থিত হয়েছে, গ্রিফিন শহরের ওই হলে। দেখতে না পেলেও, তাকে অনুভব করছে অনেকেই। সেই মেয়েটিই সব মেয়ের অন্তরে, আবার সব মেয়ের আশ্রয়ও সেই মেয়েটিই। কালিকাপুরাণ তাই বলছে, যিনি যোগনিদ্রা মহামায়া, তিনিই জগদ্ধাত্রী জগন্ময়ী। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ জানাচ্ছে, অম্বিকা, বৈষ্ণবী, গৌরী আর পার্বতীর মধ্যে কোনও তফাত নেই। ব্রহ্মার শক্তিস্থল যে ব্রহ্মাণী, সে-ই আবার নারায়ণের শক্তির উৎস নারায়ণী। যে মহামায়া, সে-ই মহালক্ষ্মী।

পুজোর সঙ্গে-সঙ্গে শাস্ত্রের ব্যাখ্যা দিয়ে যাচ্ছিলেন উত্তরণ। অঞ্জলির মন্ত্র পড়ানোর সময় বলছিলেন প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্যের মানে। উপস্থিত প্রত্যেককে একাত্ম করে নিতে চাইছিলেন আরাধনায়।

ফলও হচ্ছিল নিশ্চয়ই। নইলে এক ফাঁকে সঞ্জয়দা এসে বলবেন কেন, “সবাই বলছে, এরকম পুজো কখনও দেখেনি। তোমাকে প্রণাম করার জন্য খেপে উঠেছে সব ইয়ং মেয়েরা। কোথায় জড়িয়ে ধরবে, তা নয়…”

সঞ্জয়দাকে থামিয়ে দিয়ে উত্তরণ বললেন, “মা দুর্গাকে প্রণাম করতে বলুন, তা হলেই হবে।”

সঞ্জয়দা এক মুহূর্ত চুপ করে গিয়ে বললেন, “কমলিকা এলে খুব আনন্দ পেত।”

“নিয়ে এলেন না কেন কমলিকাদিকে?”

“আসবে ভেবেছিল। কিন্তু আমার সঙ্গে এলেই এখানকার অনেকে কৌতূহলী হয়ে উঠত। কমলিকা তখন নিজের কী পরিচয় দিত?”

পরিচয়? মা দুর্গার কাছে আসতেও পরিচয় জরুরি? সত্যি, পৃথিবীর নিয়ম অদ্ভুত! উত্তরণ নীরব হয়ে গেলেন।

“কিন্তু তোমার মন্ত্রপাঠ ইত্যাদির যেহেতু ভিডিয়ো রেকর্ডিং হচ্ছে, কমলিকা পরে সবটাই দেখতে পাবে। দুধের স্বাদ ঘোলেই মেটাক আপাতত। তবে আমার কপাল ভাল বলতে হবে। সেই কোন ছোটবেলায় পড়েছিলাম, ‘ত্বং হি দুর্গা দশপ্রহরণধারিণী/ কমলা কমলদল বিহারিণী…’ মাতৃভূমি আর মা এক হয়ে গিয়েছিলেন পড়তে-পড়তে। তুমি যেভাবে পুজো করছ, দেখতে-দেখতে মনে হচ্ছে, দেবী আর দেশ যে শুধু এক হয়ে যায় তা-ই নয়, দেবী আর স্বর্গও এক হয়ে যায় সময়-সময়।” সঞ্জয়দার গলা ধরে এল।

নরকের অভিজ্ঞতা আগেও হয়েছে। কিন্তু স্বর্গ যেখানে, সেখানেই যে নরক নেমে আসতে পারে, তার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না উত্তরণ। দর্পণে প্রতিমার বিসর্জন সম্পন্ন করে যখন শান্তিজল দিতে উঠে দাঁড়িয়েছেন, তখনই হুল্লোড় শুরু হল। পুজো চলাকালীন প্রায় সারাক্ষণই একটা ঘোরের মধ্যে ছিলেন বলে উত্তরণ প্রথমে খেয়াল করেননি চিৎকার-চেঁচামেচিটা। কিন্তু শান্তিজল দেওয়া শেষ হয়ে যাওয়ার পরও যখন সেটা থামল না, তখন বিরক্ত হয়ে হলের যেদিক থেকে আওয়াজটা আসছিল, সেদিকে তাকালেন একবার।

মাতালটা ততক্ষণে চিৎকার করতে-করতে মা দুর্গার বেদির কাছে চলে এসেছে। পিছন থেকে দু’-তিনজন টেনে ধরে রাখতে পারছে না লোকটাকে।

“আমি অন্যায় কী বলছি? আমি তো স্বীকার করছি ও হেব্বি পুজো করেছে। আমি জাস্ট বলতে চাইছি যে, এই লোকটার বহুমুখী প্রতিভা। পর্নোগ্রাফিটাও দারুণ করে।”

কথাটা মুখ দিয়ে বেরোনোমাত্রই সঞ্জয়দা ঠাসিয়ে একটা চড় লাগিয়ে দিল ছেলেটার গালে, “এক্ষুনি চুপ কর, ইতর কোথাকার!”

ছেলেটা ঝাঁঝিয়ে উঠল, “ভুল বলছি নাকি? মিথ্যে বলছি? আমি আর আপনাদের পুরোহিত একটা রাত্রি সেম লক-আপে ছিলাম না? ও অবশ্য টান্টু মাল, পরদিন সকালেই ম্যানেজ করে ছাড়া পেয়ে গিয়েছিল, আমাকে শালা তেইশ দিন কয়েদ থাকতে হয়েছিল। কিন্তু চার্জ তো একই ছিল দু’জনের বিরুদ্ধে — পর্নোগ্রাফি বানানো আর ছড়ানো। সেই অপরাধে, ধারা কত ভুলে গেছি এখন, আমি আর উনি…কী ঠাকুরমশাই, একবার একটু সাড়া দাও! নইলে সবার সামনে বেইজ্জত হয়ে যাচ্ছি তো! জাস্ট বলল যে তুহিন ঘোষ আর তুমি একসঙ্গে, এক লক-আপে রাত কাটিয়েছ! যদি বাপ-কা-বেটা হও, তা হলে বলো।”

উত্তরণ স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইলেন ছেলেটার দিকে। এই ছেলেটাই ছিল সেদিন রাত্রে ওঁর পাশে? কেন তবে কিছু মনে করতে পারছেন না? কিন্তু ছেলেটা যখন এত জোর দিয়ে বলছে, তখন নিশ্চয়ই এও ছিল ওঁর সঙ্গে সেই কালরাত্রিতে!

কী করবেন এখন উত্তরণ? সবার সামনে স্বীকার করবেন সেই কথা? কিন্তু স্বীকার করার সঙ্গে-সঙ্গেই অর্ধসত্যটা যে সত্যি হয়ে যাবে! উত্তরণ হাজতে ছিলেন, এই কথা যারা শুনবে, তাদের একজনও কি মানবে যে বিনা দোষে হাজতে যেতে হয়েছিল ওঁকে? এবং পুলিশ ছেড়ে দেওয়ার সময় দুঃখপ্রকাশ করেছিল? উত্তর যদি, ‘না’ হয়, তা হলে সত্যসেবী আশ্রমের একজন শিষ্য হিসেবে মিথ্যাকে কীভাবে উনি সত্যের প্রতিষ্ঠা দেবেন? আবার এই তাণ্ডবের সামনে চুপ করেই বা থাকবেন কেমন করে?

মদ খেলে মানুষ বেশি বকে, উত্তরণ আমেরিকাতে এসেই খেয়াল করেছেন। তুহিন ঘোষও অনর্গল বকে যাচ্ছিল। ওর ওই বকবকানিতে সেই রাত্রিটা সহস্র ফণা মেলে কালনাগ হয়ে উঠল গ্রিফিন শহরের বুকে। সত্যসেবী আশ্রম থেকে দূরে, কলকাতা থেকে কত দূরে, সেই ঘটনার সময়কাল থেকে বহুদূরে দাঁড়িয়েও উত্তরণ নিজের মুখে-চোখে আগুনের ঝাপটা টের পেতে লাগলেন। ক্যানসার যেমন রিল্যাপস করে, ওই বিভীষিকা যেন সেভাবেই রিল্যাপস করল। এরপর এখান থেকে ওই ছেলেটার বকে যাওয়া শব্দগুলো চার থেকে আট, ষোলো থেকে চৌষট্টি হবে। ওগুলো তাড়া করবে উত্তরণকে, ঘিরে ধরবে… রটনা হয়ে, কুৎসা হয়ে। যে কুৎসার ভয়ে কমলিকাদি সঞ্জয়দার সঙ্গে দুর্গাপুজোয় যোগ দিতে আসতে পারেননি গ্রিফিনে, সেই কুৎসাই উত্তরণকেও একটা গর্তে নিয়ে গিয়ে ফেলবে। মাটি চাপা দিয়ে মারবে ওঁকে। কুৎসা যারা শোনে তারা বিচার করে না তার পিছনে ভিত্তি আছে না নেই। লোকে কুৎসা বিশ্বাস করতে চায় বলেই তার এত বাজার।

কিন্তু উত্তরণ অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছিলেন, ঠাকুর ওই অমানিশার স্মৃতি আর ফিরতে দেবেন না ওঁর জীবনে। কখনও আর ওই বিষবাষ্প ছুঁয়ে যাবে না ওঁকে৷ তা হলে? দুর্গাপূজা করতে এসে কি কোনও অন্যায় করেছেন? যদি না করে থাকেন, তবে কেন? কেন অকারণে ওঁকে সহ্য করতে হবে, না-করা অপরাধের গ্লানি? দেশ পেরিয়ে বিদেশেও? সারা জীবন হয়তো এই ময়লা কলুষিত করবে উত্তরণকে, যদি না জীবন শেষ হয়ে যায় এখনই, এখানেই।

উত্তরণ এই চিৎকার এবং ঝামেলা সহ্য করার মতো মানসিক অবস্থায় ছিলেন না। সঞ্জয়দা ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই গাড়িতে ওঁকে বসিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন গ্রিফিন থেকে। স্টার্ট দিয়ে শুধু বললেন, “কোথাকার কোন মাতাল-দাঁতাল কী বলল, তাতে বেশি পাত্তা দিয়ো না। তুমি যা খেল দেখিয়েছ, তাতে গোটা গ্রিফিন মুগ্ধ। আমার ধারণা মা দুর্গা নিজেও। আই অ্যাম রিয়েলি প্রাউড অফ ইউ।”

“মা দুর্গা যা খেল দেখালেন, তাতে আমিও মুগ্ধ।” উত্তরণ হেসে উঠলেন।

ওঁর ওই কথা আর হাসির মধ্যে কি অস্বাভাবিক কিছু ছিল? নইলে গাড়ি স্লো করে ওঁর দিকে তাকালেন কেন সঞ্জয়দা?

“কী হয়েছে তোমার উত্তরণ? একটা ফালতু ঘটনাকে তুমি এত গুরুত্ব দিচ্ছ কেন? লোকে তোমার করা, শ্লোকগুলোর ব্যাখ্যা নিয়ে কথা বলছে। অমন উচ্চারণ আর ওরকম বিশ্লেষণ জীবনে শোনেনি ওরা। আর তুমি ওই পাগলের প্রলাপ নিয়ে…”

“আজকে যারা কথাটাকে পাগলের প্রলাপ মনে করছে, কাল তাদেরই মনে সংশয় জাগ্রত হবে! তারা তো লোকটাকে বহুদিন ধরে চেনে। সে তো গ্রিফিনে আমার মতো আগন্তুক নয়। ওদের প্রতিবেশী। এবার সেই লোকটা মাতাল অবস্থাতে নতুন পুরোহিতের সম্বন্ধে যা বলল, তা কেন বলল? কিছুই কি সত্যতা নেই তার মধ্যে? লোকজন ভাববেই।”

“ভাবলে ভাববে! কে কী ভাবল না ভাবল, তা নিয়ে তোমার কী? বিখ্যাত লোকেদের নিয়েই ভুলভাল গল্প ছড়ায়। আর তুমি এখন বিখ্যাত! আমি হলফ করে বলতে পারি। শুধু গ্রিফিনে নয়, আটলান্টাতেও। পরেরবার আটলান্টার দু’-তিনটে পুজো কমিটি তোমায় অ্যাপ্রোচ করবে, মিলিয়ে নিয়ো।”

সঞ্জয়দা ভবিষ্যতের কথা বলছিলেন, আর উত্তরণ ভাবছিলেন অতীতের কথা। স্পষ্ট টের পাচ্ছিলেন যে ওই অতীত ওঁকে ছাড়বে না। গুরুদেব বলেছিলেন, সাধনপথ থেকে বিচ্যুত না হতে। কিন্তু ওই কয়েক ঘণ্টা উত্তরণকে এমন ধাক্কা মেরেছে যে তিনি সাধনপথ শুধু নয়, সুস্থ স্বাভাবিক জগৎ থেকেই একেবারে ছিটকে সরে গিয়েছেন। আর কখনও ফিরতে পারবেন না।

“তুমি কী ভাবছ বলো তো?” আটলান্টায় ঢুকতে-ঢুকতে সঞ্জয়দা জিজ্ঞেস করলেন।

উত্তরণ ততক্ষণে চোখ বন্ধ করে ওঁর ঘরের খাটের নীচে থাকা ইনসেক্ট কিলারের বোতলটা দেখতে পাচ্ছেন। ঘরে কোনও পোকাই নেই, তবু ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে কিনেছিলেন বোতলটা। এইভাবে কাজে লাগাবেন বলে?

“উত্তরণ, এবার কিন্তু আমার রাগ হচ্ছে তোমার উপর।”

“আচ্ছা সঞ্জয়দা, যদি শোনেন যে সত্যিই আমি পর্নোগ্রাফিক র‍্যাকেটের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে একটা রাত্রি হাজতে ছিলাম, অভিযোগটা যাচাই করার আগেই ঘেন্না করতে শুরু করবেন আমায়?”

“এই প্রশ্নের উত্তরটা তুমিও জানো৷ তাই কথা বাড়ানো অবান্তর।”

“এড়িয়ে যাবেন না প্লিজ়। উত্তরটা জানা দরকার।”

“এড়িয়ে যাচ্ছি না তো। ওই তুহিন, গতকাল রাতে আমার কাছে এসেই ওর আষাড়ে গপ্পো ফেঁদে বসেছিল। তখন যেমন পাঁচ মিনিটের মাথায় ভাগিয়ে দিয়েছিলাম ওকে, ভবিষ্যতেও…”

“গতকালও এই নিয়ে কথা হয়েছে?”

“আর সবকিছুর মতো, কুৎসারও একটা প্রস্তুতি থাকে, ভুলে যেয়ো না। যারা সবার সামনে কারওর নামে কুৎসা করবে ঠিক করে, তারা আগে দু’তিন জনের সামনে কথাগুলো বলে দেখে নিতে চায়, কেমন রেসপন্স আসছে। কাল আমি ওকে থ্রেট দিয়ে দূর করে দিয়েছিলাম একরকম। তারপরও ও কীভাবে সাহস পেল, জানি না?”

“কিন্তু আমি তো ওই ছেলেটার কোনও ক্ষতি করিনি। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে পুলিশ আমায় তুলে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বিশ্বাস করুন…”

“স্টপ ইট। তুমি বলবে তারপর তোমায় বিশ্বাস করব আমি? তুহিন যেটা করেছে, সেটা কেন করেছে বোঝার জন্য আইনস্টাইন হওয়ার দরকার নেই।”

“কেন করেছে?”

“হিংসে। পাতি হিংসে। ও তিন বছর এই শহরে থেকে যা পায়নি, তুমি একদিনে সেই সম্মান, সেই প্রতিপত্তি পাচ্ছ, সেটা ওর সহ্য হয়নি। আর হয়নি বলেই জেলে থাকার বৃত্তান্ত শুনিয়ে ও তোমার বদনাম করতে চাইছিল। আর সেই নোংরামিটাকে আউটবার্স্ট হিসেবে দেখানোর জন্য মাতাল হয়ে কিংবা সেজে এসেছিল।”

“বদনাম তো করে দিল সঞ্জয়দা। শেষ করে দিল আমায়।”

“তুমি এবার নামো তো গাড়ি থেকে। তোমার ঘর এসে গিয়েছে। ভাল করে ঘুমোও। কাল-পরশু এসে আমি স্বামী বিবেকানন্দের উপর একটা বই দিয়ে যাব। স্বামীজি সম্বন্ধে যদি ‘মিট ইটিং সোয়ামি’, ‘হ্যাজ় মেনি ফরেন গার্লফ্রেন্ডস’ লিখতে পারে সেই সময়ের নিন্দুকেরা, তা হলে তুমি কোন হরিদাস পাল? পাত্তা দিয়ো না, স্রেফ পাত্তা দিয়ো না।”

“আপনি পাত্তা দেন না? যখন আপনার আর কমলিকাদির নামে…”

“আমার তো সন্ন্যাসী বা ব্রহ্মচারীর ট্রেনিং নেই। তোমার আছে। তুমি দেবে কেন? জাস্ট ফরগেট।” গাড়ি ঘুরিয়ে চলে যাওয়ার আগে বলে গেলেন সঞ্জয়দা।

উত্তরণের মনে দাগ কাটল না কথাগুলো। বরং ওই ইনসেক্ট কিলারের বোতলটা ওঁকে টানতে লাগল। উত্তরণ স্বামীজি নন। ব্রহ্মচারী ঠাকুরও নন। তাই পারবেন না। কুৎসার এই সাইক্লোন নিতে পারবেন না। তার চেয়ে নিজেকে শেষ করে দেবেন। বোতলটা কিছু তো কাজে লাগুক।

লিফটে ওঠার আগে, “মুখার্জি, মুখার্জি” শুনে রিসেপশনে বসা মেয়েটার দিকে তাকালেন উত্তরণ। জেনিফার ওঁকে ইশারায় ডাকল। উত্তরণ সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই একটা সাদা খাম ধরিয়ে দিল হাতে।

খামের উপরে কিছুই লেখা ছিল না, উত্তরণের নামটাও নয়। খামটা ছিঁড়ে চিঠিটা পেতেই তাই চমকে গেলেন উত্তরণ। সত্যসেবী আশ্রমের বর্তমান সভাপতি বিরজানল, মানে অনিলদা চিঠি লিখেছেন ওঁকে। তিন-চার লাইনের চিঠি। অনিলদা তাঁর পূর্বাশ্রমের কিছু টাকা উত্তরণের নামে জমা করে রেখেছেন। অনিলদার দেহাবসানের পর, উত্তরণ যেন সেই টাকাটা সংগ্রহ করে নেন, এইটুকুই তাঁর ইচ্ছা। গুরুদেবের কাছে উত্তরণের মঙ্গলকামনা করে অনিলদা চিঠি শেষ করেছেন। কোথাও এতটুকু বাড়তি কথা নেই। একজন সন্ন্যাসী তাঁর সঞ্চিত অর্থ এমন একজনের হাতে দিয়ে যাচ্ছেন, যে আমেরিকায় এসে তাঁকে একটা ফোনও করেনি।

গুরুদেব, আপনি আমায় ভোলেননি! আত্মহত্যা করতে দেবেন না বলে, আজ এই মুহূর্তেই চিঠিটা পাঠিয়েছেন। ভাবতে-ভাবতে উত্তরণের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল দু’-এক ফোঁটা কান্না।

“নো ব্যাড নিউজ়, আই হোপ?” জেনিফার ভয়ের গলায় বলে উঠল।

“গুড নিউজ়। বাট হু ব্রট দিস লেটার ফর মি?”

জেনিফার একটা কাগজ ওঁর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, যে এনেছে সে নিজের নামটা লিখে রেখে গিয়েছে এখানে।

উত্তরণ যন্ত্রচালিতের মতো কাগজটা হাতে নিয়ে দেখলেন, একটাই শব্দ বাংলায়। ‘অনসূয়া’।

১৬

হোটেলের ঘরে শুয়ে থাকতে থাকতে উঠে দাঁড়ালেন উত্তরণ। বর্তমান আর অতীত যখন জায়গা বদলাবদলি করে খেলে তখন দিশা পাওয়া যায় না, কোন ঘরে থাকবেন আর কোনটা ছেড়ে আসবেন। সেই রাতেও আর-একটু হলে অন্য একটা ঘরে চলে যাচ্ছিলেন উত্তরণ। জীবন আর মৃত্যু একই বাড়ির ভিতর দু’টো আলাদা-আলাদা ঘরই তো। মৃতেরাও ক্ষেত্রবিশেষে জীবিত, আবার জীবিতরাও মৃত, সময়-সময়। ওঁর ভাই-ই যেমন উত্তরণকে ‘মৃত’ ঘোষণা করে সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়েছে। কেন মৃত? না, উত্তরণ ভাইকে আমেরিকায় নিয়ে আসেননি বলে।

অনসূয়ার কথা ভাবতে গিয়ে, ভাইয়ের কথা মনে পড়ে গেল উত্তরণের। কতদিন দেখেননি ছেলেটাকে। দেখা তো দূর, কথাও হয় না আর। তবু কলকাতায় এসেছেন বলেই হয়তো উত্তরণের সেই বাচ্চাটার কথা মনে পড়ছিল, যাকে কাঁধে করে ঘুরেছেন এক সময়। আশ্রমে চলে আসার আগে, মা বেশি অসুস্থ থাকলে, নিজের হাতে ভাত মেখে ভাইকে খাইয়ে দিয়েছেন এক-একদিন। যখন কলকাতায় থেকে কলেজে পড়ত কোনও-কোনও মাসে দু’বার টাকা পাঠাতে হত উত্তরণকে, তখনও একবার আমেরিকা থেকে, দু’সপ্তাহের জন্য দেশে গিয়ে উজ্জীবনকে নিয়ে কামাখ্যায় গিয়েছিলেন, সেখানে হোটেলে ভাত মেখে খাইয়ে দিয়েছিলেন ছোট ভাইকে।

“আমেরিকা কি চিড়িয়াখানা যে চাইলেই নিয়ে আসা যায় কাউকে? আমেরিকায় আসা হয়তো সহজ, কিন্তু থেকে যাওয়ার প্রক্রিয়া অনেক জটিল। সেটা দিন-দিন জটিলতর হচ্ছে।” উত্তরণ তবু বলতে বাধ্য হলেন একদিন।

“গল্প দিস না। আমি একটা টিভি প্রোগ্রামে দেখেছি, লোকে কিউবা থেকে সাঁতরে আমেরিকায় চলে যাচ্ছে, মেক্সিকো থেকে চুপি-চুপি ঢুকে পড়ছে আমেরিকায়। তাদের মধ্যে ক’জন ফিরে আসছে? তুই আমাকে একবার নিয়ে তো চল, তারপর কীভাবে থেকে যেতে হয়, আমি বুঝব।”

“কী করবি তুই, আমেরিকায় এসে? কে চাকরি দেবে তোকে?”

“কেন, তোদের ইউনিভার্সিটিতে পিয়োন-ফিয়োন নেয় না?”

“আমেরিকায় ওইভাবে রিক্রুটমেন্ট হয় না রে।”

“দরকার নেই চাকরির! আমি ট্যাক্সি চালাব, ওই বড়-বড় দোকানগুলোয় ট্রলি ঠেলব, কিছু না কিছু করে ঠিক থেকে যাব।”

“আমি বুঝতে পারছি না, একটা অনার্স গ্র্যাজুয়েট ছেলে হয়ে তুই এতটা অসম্মান মেনে নিবি কেন? তার থেকে তুই দেশে চাকরির চেষ্টা কর, চাকরি না পেলে প্রাইভেট টিউশন…”

“তোর বাতেলা রাখ তো তোর কাছে। দাদা আমেরিকায় নামজাদা প্রফেসর আর ভাই কলকাতায় ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরছে, কেউ ভাল চোখে দেখবে?”

“আমি কী করছি, কোথায় আছি তাই দিয়ে তোর বিচার হবে কেন?”

“হবে না-ই বা কেন? রাখীর বাবা-মা চান যে আমি তাঁদের মেয়েকে নিয়ে গিয়ে আমেরিকার কোথাও একটা সংসার পাতি।”

“রাখী কে?”

“আমার উড-বি ওয়াইফ। বলেছিলাম তোকে ওর কথা।”

“তোকে ভালবাসে?”

“অবভিয়াসলি।”

“কিন্তু ভালবাসলে তো আমেরিকায় যাওয়ার উপর সংসার পাতা নির্ভর করবে না। গড়িয়ায় পাতলেই বা ক্ষতি কী? ভালবাসা থাকলে খুব কিছু তফাত হওয়ার তো কথা নয়।”

“এটা তোর ফিলোসফির ক্লাস নয় যে তুই লেকচার দিবি আর আমি বসে-বসে শুনব। কিছু করতে পারবি কি না আমার জন্য, সেটা বল।”

“তুই যেভাবে চাইছিস, সেভাবে হয়তো সত্যিই পারব না।”

“পারবি না, না চাইবি না?”

“দ্বিতীয়টাও ঠিক। আমি চাইব না যে আমার ভাই আমেরিকায় এসে বাসন মাজার কাজ করুক।”

“এটাই আন্দাজ করেছিলাম। তোর মতো স্বার্থপর লোকের কাছে অন্য কিছু আশা করাও অন্যায়। চিরকাল শুধুনিজের স্বার্থই বুঝে এসেছিস। মামরে বেঁচেছে, নইলে মাকেও দেখতিস না। আমাকে বোর্ডিংয়ে রেখে দায় এড়িয়েছিলি…”

“আর কী-কী করেছি বল, বলে হালকা হ।”

“সাধু সাজিস না। সাধু সাজতে আশ্রমে গিয়েছিলি। সেখানেও গুরুদেবের সঙ্গে বেইমানি করে আমেরিকায় পালিয়েছিস। স্বার্থপর না হলে তো ইন্ডিয়ায় থেকে আশ্রমের মঙ্গলঘট কালেকশন করতিস, সেবা করতিস ঠাকুরের।”

“ঠিকই বলেছিস। আচ্ছা আমি যদি আমার স্বার্থপরতাকে বিসর্জন দিই, আবার ভারতে ফিরে এসে আশ্রমবাসী হয়ে যাই, মঙ্গলঘটের চাল তুলতে যাই, গোয়ালঘর পরিষ্কার করি, তুই খুশি হবি?”

“এসব তুই কখনওই করবি না, খালি আমাকে কাটানোর জন্য বুকনি দিচ্ছিস। তুই কত বড় শয়তান, আমি চিনি না? তোর ভালমানুষির মুখোশ খুলে গিয়েছে, আর কাউকে তুই ভোলাতে পারবি না?”

“ভোলাতে চাইলে তো আমেরিকাতেই নিয়ে যেতাম। ভুলে থাকতিস, ভাল ভাবতিস আমায়।”

“তা নিয়ে যাবি কেন? আমি ভাল থাকি, তুই চাস না তো! তবে তুই নিজেও কোনওদিন সুখী হতে পারবি না, বলে দিলাম তোকে। নেভার। মিলিয়ে নিস?” উজ্জীবন চিৎকার করে উঠল।

সেই শেষ কথা ভাইয়ের সঙ্গে। তবু তারপরও উত্তরণ যখনই ডলার পাঠিয়েছেন, তা ব্লটিং পেপারে কালির মতো মিলিয়ে গিয়েছে। সব কথোপকথন, সব সম্পর্ক ভেঙে পড়ার পরেও ডলার হয়তো মাধ্যম হিসেবে কাজ করতে পারে। ডলারই হয়তো সেই ধ্রুবতারা, অনাত্মীয়তার ঘন অন্ধকারেও যা জ্বলজ্বল করে।

অনসূয়ার আমেরিকায় আসতে কত ডলার খরচ হয়েছে, তার কতটুকু স্কলারশিপের টাকা আর কতটা ওর নিজের, উত্তরণ জানেন না। কেবল এটুকু বুঝতে পারেন যে, অনসূয়া আমেরিকায় এসেও ডলারের পরোয়া করবে না, যেমন টাকার তোয়াক্কা করেনি ভারতে থাকতে। উত্তরণের জন্য নিজেকে আর নিজের সবকিছু খরচ করার মধ্যেই ছিল ওর চরম আনন্দ। সেই আনন্দ আবারও পেতে চায় বলেই কি আটলান্টায় ছুটে এসেছিল মেয়েটা?

গ্রিফিন থেকে পুজো সেরে ফেরার পরের ছ’দিন-ছ’রাত্রি অসহ্য উৎকণ্ঠায় কাটালেন উত্তরণ। কাউকে কিছু বলতে পারলেন না, নিজেকে বোঝাতেও অপারগ হলেন। কাজ করতে পারছিলেন না, খেতে-ঘুমোতেও নয়। প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, এই বুঝি অনসূয়া আসবে, এখন না এলেও একটু পরেই আসবে। তারপর একটা করে দিন যখন পেরিয়েছে, অথচ অনসূয়া আসেনি, উত্তরণের মনে হতে শুরু করল, যে চিরকুটটা তিনি হাতে পেয়েছিলেন, সেটা সত্যিই তো? নাকি কোনও হ্যালুসিনেশন? কিন্তু অনিলদার লেখা ওই চিঠিটা কীভাবে এল? নিশ্চয়ই অনসূয়া আশ্রমে গিয়েছিল আর ওর হাত দিয়ে অনিলদা পাঠিয়েছেন চিঠিটা।

সেটাই স্বাভাবিক, সেটাই হওয়ার কথা। কিন্তু রোববার রাতের পর থেকে শুক্রবার হয়ে গেল, অনসূয়া কোথায়? এল না কেন? কেন একটা ফোনও করছে না উত্তরণের ইউনিভার্সিটিতে?

অনসূয়ার ছবি তো উত্তরণের কাছে নেই। চেহারার বর্ণনা দিয়ে কি একবার মিলিয়ে নেবেন জেনিফারের সঙ্গে, এই মেয়েটাই এসেছিল কি না? লরা যেমন প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলত না, জেনিফার অনেকটা খোলামেলা। কথা বলে, উত্তর দেয়। অনসূয়ার আসা নিয়ে দু’-একটা কথা জানার জন্য রিসেপশনে জেনিফারের খোঁজ করলেন উত্তরণ। কিন্তু শুনলেন যে জেনিফার ব্যক্তিগত ছুটিতে আছে। বুকটা ধক করে উঠল উত্তরণের। সেই রাতেও জেনিফার হয়তো ছুটিতেই ছিল, কিন্তু গুরুদেব উত্তরণকে বাঁচিয়ে রাখবেন বলে মেয়েটার প্রতিমূর্তি বসিয়ে রেখেছিলেন রিসেপশনে। ‘অনসূয়া’ লেখা যে কাগজটা গত ছ’দিনে চারশো চবিবশবার নাড়াচাড়া করলেন উত্তরণ, সেটাও হয়তো, অনিলদার চিঠিটার মতোই, ঠাকুরের স্বহস্তে লিখে দেওয়া।

ঠাকুরের ছবির দিকে তাকিয়ে উত্তরণের চোখ জলে ভরে গেল। কিন্তু সেই কান্না যে ঠাকুরের জন্য নয়, সেটা কি ঠাকুরের অজানা থাকল?

আমেরিকায় আসার কয়েকদিন আগে ভিসা সংক্রান্ত কোনও একটা কাজে কলকাতার আমেরিকান কনস্যুলেটে আসছিলেন উত্তরণ। ভোরের বাস ফাঁকা-ফাঁকাই ছিল৷ উত্তরণের ঠিক সামনের সিটে গেরুয়াধারী দুই সন্ন্যাসী বসেছিলেন। উত্তরণ তাঁদের তত খেয়াল করতেন না, যদি না তাঁদের কথাবার্তা কানে আসত।

এক সন্ন্যাসী আর-একজনকে বলছিলেন, “সংসারে আশ্রয় নিতে হতেই পারে, কিন্তু সংসারে জড়িয়ে যাওয়াটা কোনও কাজের কথা নয়।”

“যে আশ্রয় দিল তাকে কী বলব তবে? তার তো একটা আশা তৈরি হতে পারে।

“কিছুই বলবে না। ঈশ্বরের কাছে তার মঙ্গলকামনা করে তুমি তোমার পথে এগিয়ে যাবে। কারওর আশা পূরণ করার দায় তো সন্ন্যাসীর হতে পারে না। সাধন-ভজন করাটা সন্ন্যাসীর কাজ।”

“কিন্তু তাতে যদি মনে আঘাত দেওয়া হয়?

“কেউ মনে আঘাত পেলে তোমার কিছু করার নেই। তোমার গেরুয়ায় যাতে দাগ না লাগে, সেটাই তোমাকে দেখতে হবে।”

হিন্দিতে কথা বলছিলেন সন্ন্যাসী দু’জন। কিন্তু ভোরের বাতাসে তাঁদের কথাগুলো উত্তরণের কাছে মাতৃভাষার চেয়েও প্রাঞ্জল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। বাস থেকে নেমে কনস্যুলেটের দিকে যেতে-যেতে, কনস্যুলেট থেকে ফেরার পথে, উত্তরণ বুঝে গিয়েছিলেন কী করতে হবে।

আমেরিকায় পৌঁছে, কেবল পৌঁছনোর সংবাদটুকু দেওয়া ছাড়া তাই অনসূয়ার সঙ্গে আর একটাও কথা বলেননি উত্তরণ। ওকে নিজের আস্তানার ঠিকানা দেননি। ইউনিভার্সিটির ঠিকানায় ওর চিঠি এলে, খুলে দেখেননি পর্যন্ত। পড়লে পাছে দুর্বল হয়ে যান, উত্তর দিতে গিয়ে নিজেকেই যদি দিয়ে দেন নিজের অজান্তে? দূরত্বে মনের উপর চাপ তো আরও বেশি পড়ে।

বারবার মনে হয়েছে তিনি অন্যায় করছেন, কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়েছে সেই সন্ন্যাসীর কথা। জড়িয়ে যেতে-যেতে, কোথাও তো একটা ছাড়িয়ে নিতে হবে। ছাড়িয়ে না নিলে তো ঘি হয়ে আগুনে, ভাল হয়ে ভাতে, শিশির হয়ে ঘাসে মিশে যেতে হবে। স্বতন্ত্র অস্তিত্বই থাকবে না।

কিন্তু গত পাঁচ দিনের টানাপড়েনে উত্তরণের কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, মানুষ আর পাঁচজনের মধ্যে থাকে বলেই তার পরিচয়ের দরকার হয়। একা একটা জঙ্গলের মধ্যে থাকা মানুষের কোনও পরিচয়ের প্রয়োজন নেই। সে ওই গাছপালা, পশুপ্রাণী সবার থেকে স্বতন্ত্র বটে, কিন্তু তার কোনও আলাদা অস্তিত্ব আছে কি?

যে মেয়েটার সঙ্গে আমেরিকায় আসা ইস্তক একবারের বেশি দু’বার কথা বলেননি, তার বিহনে এই যে ছটফট করছেন উত্তরণ, তা কি ভালবাসা? নিজের কাছেই জানতে চাইলেন উত্তরণ। উত্তরে স্পষ্ট একটা হ্যাঁ এল না। অনেক মন্থনশেষে অনুভব করলেন যে কোথাও তিনি নিজের সেই অকলঙ্ক ইমেজটাকেও খুঁজছেন। যে ইমেজ দিনরাতের প্রতিটা সেকেন্ড-মিনিট, অনসূয়ার চোখে দেখতে পেতেন উত্তরণ। দেখতে পেতেন বলেই নিজেকে আরও উচুতে ধরে রাখার ইচ্ছে হত। সেতারের তারের মতো। যাতে আঙুল ছোঁয়ালেই মুর্চ্ছনার সৃষ্টি হয়।

কিন্তু গ্রিফিনের ওই আধ ঘণ্টা নিজের কাছেই অনেকটা ধ্বংস করে দিয়েছে উত্তরণকে। মনে হচ্ছে আঙুল ছোঁয়ালে ‘উত্তরণ’ অবয়বটার ভিতর থেকে কেবল কাদা উঠে আসবে। সেই দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা দূর করতেই উত্তরণ চাইছিলেন, অনসূয়া অন্তত একবার ওঁর সামনে এসে দাঁড়াক।

কিন্তু অনসূয়া সত্যিই কি এসেছে আমেরিকায়?


আরো পড়ুন: ও নাইটিঙ্গেল । বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়


১৭

অনসূয়া এল ঠিক ছ’দিনের মাথায়, পরের শনিবার সকালে। এসেই কোনও ভণিতা না করে উত্তরণকে জিজ্ঞেস করল, “আমি যে আসতে পারি, এসে আবার তোমার সামনে দাঁড়াতে পারি, তুমি ভাবোনি, তাই না?”

অপারেশনের পর রোগীর জ্ঞান আসার মুহূর্তে যেমন চারদিকটা কুয়াশায় ঢাকা থাকে, উত্তরণও তেমন একটা কুয়াশার সামনেই দাঁড়িয়েছিলেন। কেবল মনে হচ্ছিল, যে অনসূয়া ওঁকে ‘আপনি’ ছাড়া অন্য কিছু বলেনি কোনওদিন, সে কীভাবে, এত সহজে, ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করছে!

“ভগবানকে কি ভক্ত ‘আপনি’ বলে ডাকে?” সেদিন দুপুরে নিজের হাতে রান্না করে উত্তরণকে বেড়ে দিতে দিতে অনসূয়া যেন সেই প্রশ্নটারই উত্তর দিয়ে দিল, প্রশ্নের ঢঙে।

উত্তরণ নীরব থেকে মেয়েটিকে দেখছিলেন। থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট আর টি-শার্ট পরা মেয়েটির সঙ্গে বছরতিনেক আগের মেয়েটির পোশাক-আশাকে হয়তো অনেকটাই তফাত, সেই লম্বা বেণির জায়গা নিয়েছে কাঁধ-ছোঁওয়া চুল, কিন্তু ভিতরে-ভিতরে একই থেকে গিয়েছে মেয়েটা। ওর ধ্যান-জ্ঞান যে ছিল, সে-ই আছে।

অনেকদিন পর কেউ ভাত বেড়ে খেতে দিল বলে একটু বেশিই খেয়ে ফেললেন উত্তরণ। খেয়ে উঠে চোখটা ঘুমে জড়িয়ে আসছিল। ঘুমটা তাড়াবেন বলে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কোথায়-কোথায় অ্যাপ্লাই করেছিলে?”

“ইউনিভার্সিটি অফ এথেন্সে পেলে ভাল হত, জর্জিয়া স্টেট-এর ভিতরেই জায়গাটা। এক ঘণ্টা ড্রাইভ করলেই চলে আসতাম। কিন্তু কপাল অত ভাল নয় আমার। ন্যাশভিল-এও হয়ে যাচ্ছিল, তবে ওখান থেকে তোমার ডেরা আরও দূর হয়ে যেত। তাই শেষমেশ কলম্বিয়ার সাউথ ক্যারোলাইনা ইউনিভার্সিটিতেই…”

“তুমি তো পড়াশোনা করতে আসছিলে, আমার কাছে তো…”

উত্তরণকে থামিয়ে দিয়ে অনসূয়া বলে উঠল, “শিষ্যা কি গুরুর অনেক দূরে থেকে পড়াশোনা করতে পারে?”

“আমি কারওর গুরু নই অনসূয়া। হওয়ার যোগ্যতাই নেই। নিজের গুরুর প্রকৃত শিষ্যই হওয়া হল না।”

“কে বলল? তা যদি না হতে পারতে তা হলে অনিল মহারাজ তোমার জন্য টাকা জমাতেন?”

“সেটা অপত্য স্নেহ বলতে পারো। বিজয়দা আর অনিলদা কী যে ভালবাসতেন আমাকে…” গলা ধরে এল উত্তরণের।

“ভালবাসার কারণ ছিল, তাই বাসতেন। তোমার মতো ক’জন এসেছিল আশ্রমে? তুমি আশ্রমের জুয়েল।”

“এসব বোলো না, শোনাও পাপ।”

“পাপ হলে, সেই পাপ স্বামী বিরজানন্দ করেছেন। তিনিই তো আমাকে বললেন কথাটা। আমি আমেরিকায় আসছি শুনে, ওই চিঠিটা আমার হাত দিয়ে তোমায় পাঠিয়েছেন। তুমি কী গো, ওঁদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখোনি? আচ্ছা, কেন ফোন করোনি, কেন চিঠি লেখোনি আশ্রমের কাউকে?”

“তুমি যখন আমার জীবনী লিখবে, তখন উত্তর দেব। এখন বলো, এই ইউনিভার্সিটি অফ সাউথ ক্যারোলাইনা কেমন? ধারে-ভারে?”

“আমি কি অত বিচার করতে গিয়েছি নাকি? আমি শুধু খোঁজ করছিলাম, ওখান থেকে আটলান্টা পৌঁছতে কতক্ষণ লাগবে। যখন দেখলাম, সওয়া তিন ঘণ্টা মতো, তখন আর দ্বিতীয়বার ভাবিনি।”

“আমার কাছে আসাটাই মোক্ষ ছিল?”

“অবশ্যই। নইলে সাড়ে তিন ঘণ্টা ড্রাইভ করে…”

“একটু আগে সওয়া তিন বললে যে?”

“সাড়ে তিনই লাগে। আসার পথে অগাস্টায় একটা স্যান্ডউইচ ব্রেক নিয়েছিলাম, পনেরো-কুড়ি মিনিটের। তবে কলম্বিয়া খুব সুন্দর। যখন নিয়ে যাব দেখবে, কঙ্গারি নদীটা শহরটাকে একটা আলাদা রূপ দিয়েছে। তা ছাড়া ফোর্ট জ্যাকসন…”

“সেটা কী?”

“জানো না? ইউএসএ-র সবথেকে বড় আর্মি ইনস্টলেশন, ফর বেসিক কমব্যাট ট্রেনিং। মাটিতে দাঁড়িয়ে যে সৈনিকরা যুদ্ধ করে, তাদের সবচেয়ে বড় সাপ্লাই সেন্টার বলতে পারো। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় হাজার-হাজার সৈন্য এখান থেকে প্যাঁচঘোঁচ শিখে এশিয়ায় যেত।”

ভিয়েতনাম, সৈন্য, আর্মি ইনস্টলেশন… কীরকম ঠান্ডা লাগছিল উত্তরণের। ঘর সেন্ট্রালি হিটেড হওয়া সত্ত্বেও। কয়েকদিন আগেই একটা সেমিনারে বলতে এসে একজন অধ্যাপক বলছিলেন, ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় আমেরিকান সৈন্যদের মধ্যে একটি নোট বিলি হয়। তাতে লেখা ছিল, ‘যা কিছু হলুদ চামড়ার আর হেঁটে-চলে বেড়ায়, তা-ই শত্রু।’ অবশ্য শত্রুতার ধারণা আরও ছড়ানো ছিল। গেরিলা যোদ্ধারা গ্রামেই আশ্রয় পায়, সুতরাং গ্রাম উড়িয়ে দেওয়া না গেলে গেরিলারা আশ্রয় পেতেই থাকবে, এই তত্ত্বে বিশ্বাসী কর্তৃপক্ষ কত-কত বাঁধ ধ্বংস করে দিয়েছে, গুড়িয়ে দিয়েছে কত স্কুল…

“কী ভাবছ? আমেরিকার সৈন্যরা কত অত্যাচার করেছে দেশ-বিদেশে?”

“তুমি কি থট রিড করতে পারো নাকি এখন?”

“আর কার ক্ষেত্রে কী পারি তা জানি না, কিন্তু তোমার মাথায় আর মনে কী চলছে তা স্পষ্ট বুঝতে পারি। তাই তো ন’হাজার মাইল দূরত্ব কাটিয়ে চলে এলাম। তাও দুশো পনেরো মাইল দূরত্ব রয়ে গেল।” অনসূয়া হেসে উঠল।

“কিন্তু আমি যা ভাবছিলাম সেটা হল…”

অনসূয়া উত্তরণকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “কী ভাবছ বুঝতে পেরেছি। কিন্তু কথাটা হল, শুধু তো খারাপ করেনি, ভালও করেছে অনেক। জায়গায়-জায়গায় আমেরিকান লাইব্রেরি বানিয়েছে, যা না থাকলে আমাদের পড়াশোনার অনেক অসুবিধে হয়ে যেত। আর খারাপ যা করার, তা তো সেনাবাহিনী করেছে, দুনিয়ার কোথায় সেনাবাহিনী সম্বন্ধে অভিযোগ থাকে না? পাকিস্তানের সেনা কী করেছিল একাত্তরে? লাখ-লাখ বাঙালিকে নির্বিচারে মারেনি? হাজার হাজার বাড়িতে, দেবস্থানে আগুন দেয়নি? অসংখ্য বাঙালি মেয়েকে গণধর্ষণ করেনি? চরম অত্যাচার নামিয়ে আনেনি একটা জাতির উপর? ভারতীয় সেনা নিয়ে কোথাও কারওর কোনও নালিশ নেই? পৃথিবীতে কবে কার সৈন্যরা ধোয়া তুলসীপাতা ছিল?”

উত্তরণের মনে হল, অল্পদিনেই অনসূয়া অনেক বেশি আমেরিকান হয়ে গিয়েছে, যা তিনি তিন বছরের উপরে আমেরিকায় এসেও হতে পারেননি। যদিও খোলা মনে বিচার করলে, অনসূয়ার কথাগুলোকেও ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মন্দ’-র পাশাপাশি আমেরিকার অনেক ‘ভাল’-কে উত্তরণ নিজেই তো উপলব্ধি করেছেন বিগত কয়েক বছর ধরে।

উত্তরণকে চুপ করে যেতে দেখে অনসূয়া বলল, “সৈন্যদের থেকে তুমি কম অত্যাচারী? ওরাও রাস্তায় দেখা হলে হাসে, নড করে… তুমি আমেরিকা চলে এসে সব যোগাযোগ ছিন্ন করে দিলে। চিঠির উত্তর অবধি দাওনি, ফোন নম্বর দেওয়া তো দূরের কথা।”

“আমি তোমার অনেক ক্ষতি করেছি। আর ক্ষতি করতে চাইছিলাম না।”

“এইসব যাত্রার ডায়ালগ অন্যকে শোনাবে। এখানে কে রাঁধছে, কী খাচ্ছ, কেমন আছ, গাড়ি চালাতে শিখলে কি না, ঠান্ডা কীভাবে সামলাচ্ছ ভেবে আমি ঘুমোতে পারতাম না।”

অনসূয়ার কথা বলার ধরন চমকে দিচ্ছিল উত্তরণকে। কিন্তু কোথাও একটা ভালও লাগছিল ওঁর। মনে হচ্ছিল, বহুদিন পর নিজের কেউ, কাছের কেউ ওঁকে হাওয়ায়-হাওয়ায় স্পর্শ করে আছে। গলা নামিয়ে উত্তরণ বললেন, “এখানে তুত ঠান্ডা পড়ে না তো?”

“এখন আমি এসে গেছি, আর একেবারেই ঠান্ডা লাগবে না।” বলতে-বলতে অনসূয়া উত্তরণের খাটে এসে বসল।

উত্তরণ একটু সরে বসলেন, অভ্যাসবশতই। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার ডক্টরেটের বিষয় নিয়ে কিছু বলো।”

“‘দ্য ডিসইউনিটি অফ মর‍্যাল জাজমেন্ট,’ ওয়র্কিং টাইটেল এটাই হয়েছে।”

“একটু ডিটেলে বলো।”

“বলছি। তবে তার আগে বলো, তুমি মার্কণ্ডেয় মুনির গল্পটা শুনেছ তো?”

“কোনটা?”

“যেখানে মার্কণ্ডেয় মুনিকে কৃষ্ণ নিমন্ত্রণ পাঠিয়েছেন, আর তিনি বলরামকে মুখের উপর অপমান করে বলেছেন, ‘গোয়ালার ভাত খাই না।’ বলরাম খুব রেগেমেগে ফিরে এসে কৃষ্ণকে কথাটা বলতেই, কৃষ্ণ দাদাকে হাতে-পায়ে ধরে আর-একবার মুনির কাছে পাঠালেন, কানে-কানে একটা কথা বলে দিয়ে। বলরাম, মার্কণ্ডেয় মুনিকে আবার নিমন্ত্রণ করতে যেতেই মুনি ভীষণ রেগে উঠলেন। তখনই বলরাম বলে বসলেন যে তাঁর ভাই একটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে বলেছে, গোয়ালার ঘরের ভাত কি কুকুরের মাংসের চেয়েও খারাপ? মার্কণ্ডেয় কথাটা শুনে চমকে গেলেন, কারণ মহাপ্রলয়ের সময় তিনি যে কুকুরের মাংস খেয়ে প্রাণধারণ করেছিলেন, তা তো কেবল বিষ্ণুরই জানা। তা হলে কে নেমন্তন্ন করেছে তাঁকে?”

“হ্যাঁ, শুনেছি। কিন্তু হঠাৎ এই গল্প?”

“গল্পটা তোমায় বলতাম না। কেন বললাম বলো তো? আমি খাটে বসতেই এই যে তুমি সরে বসলে, এটা খুব খারাপ লাগল আমার। আগে হলে কিছুই বলতাম না, কারণ তুমি যা করো, যা বলো সবই দৈব ব্যাপার বলে ভাবতাম। এখনও যে ভাবি না তা নয়, কিন্তু তোমার কয়েকটা কনফিউশন একটু দূর করা উচিত বলে মনে হয়।”

“আমার কোনও কনফিউশন নেই।”

“আছে গো, আছে। তুমি হাজতে, ক্রিমিনালদের গায়ে গা ঠেকিয়ে বসে থাকতে পারো, কিন্তু অনসূয়া খাটে এসে বসলে তোমায় সরে বসতে হয়। কেন? কী হবে তোমার গায়ের সঙ্গে আমার গা ঠেকে গেলে? মহাপ্রলয়?”

উত্তরণের মুখটা সাদা হয়ে গেল অনসূয়ার কথা শুনে।

“কী হল, ওরকম স্ট্যাচু হয়ে গেলে কেন?”

“তুমি জানো, গ্রিফিনে কী হয়েছিল?”

“না, জানি না। আমি তো কলকাতার কথা বলছি।”

“কে বলেছিল তোমায়?”

“শুনেছিলাম ইউনিভার্সিটিতে। কে বলেছিল, আর মনে নেই।”

“আমাকে খারাপ মনে হয়নি তোমার?”

“একটুও নয়। যাকে রোজ নিজের চোখে দেখছি, তাকে লোকের কথায় খারাপ বা ভাল মনে হতে যাবে কেন? সে কী, আমি তো জানি।”

“কিন্তু সেই হাজতে আমার পাশে বসে থাকা লোকটা আমেরিকায় এসেছে। গ্রিফিনে দুর্গাপুজো করতে গিয়েছিলাম আমি, তখন সে চিৎকার করতে শুরু করে। এখন সবাই সব জেনে গিয়েছে।”

“জানলে জেনেছে। আবার ভুলে যেতে কতক্ষণ?”

“কিন্তু আমার নামের সঙ্গে যে কলঙ্ক…”

“সূর্য যেমন পশ্চিমদিকে উঠতেই পারে না, তুমিও তেমনই ননাংরা কিছুতে জড়িত থাকতেই পারো না। কেউ মাইক নিয়ে বললেও লোকে বিশ্বাস করবে না।”

“কিন্তু খোঁচা তো দেবে! খোঁটা তো দেবে! যেমন তুমি দিলে। কেন দিলে, কেন?” বলতে-বলতে কেঁদে ফেললেন উত্তরণ।

উত্তরণের কান্নার থেকে অনেক জোরে কেঁদে উঠল অনসূয়া। কাঁদতে-কাঁদতে বলল, “তোমার জন্য এই কষ্টটা আমি রোজ পেয়েছি। যবে থেকে তুমি আমার চোখের সামনে নেই, তবে থেকে, প্রতিটা মিনিটে পেয়েছি। আর তুমি বলছ, তুমি যোগাযোগ করলে নাকি ক্ষতি হয়ে যেত আমার। যে মেয়েটা তোমায় দেখবে বলে অতক্ষণ গাড়ি চালিয়ে এসেছিল আগের রবিবার, তারপর আবারও একই ডিসট্যান্স পার করে রাত্রি দেড়টায় ফিরেছে, তাকে বলছ! যে আমেরিকায় এসেই গাড়ি চালানোর লাইসেন্স বার করেছে তোমার কাছে আসবে বলে, তাকে বলছ! তুমি খোঁটা দাওনি আমায়?”

উত্তরণ কথাগুলো শুনতে-শুনতে কেমন একটা অন্যরকম কষ্ট অনুভব করলেন। অনুভব করলেন বলেই বললেন, “তুমি এসে চলে গিয়েছ ভেবে আমারও কষ্ট হচ্ছিল। তুমি সাত সমুদ্র পারে, সেটা একরকম, কিন্তু তুমি এখানেই, অথচ দেখা হল না…”

“আমার সঙ্গে দেখা হওয়া বা না হওয়ায় কী এসে যায় তোমার?”

“বারবার মনে হচ্ছিল একবার যদি…”

“একবার কী?”

উত্তরণ উত্তর দিতে পারলেন না।

উত্তর না পেয়ে অনসূয়া যখন নিজের সবটুকু আবেগ নিয়ে জড়িয়ে ধরল ওঁকে, ছাড়াতেও পারলেন না মেয়েটাকে।

ছাড়াতে চাইলেন কি না, তা-ই বা কে জানে।

১৮

উত্তরণের ভিতরে অস্বস্তি থাকলেও অনসূয়া এতটাই আত্মবিশ্বাসী যে কোনও সংশয়ই ওকে স্পর্শ করত না। উত্তরণের দ্বিধার উত্তরে ওর তাই সাফ জবাব ছিল যে, একটা বাড়িতে যদি দু’জন চার বছরের উপর থাকতে পারে, একটা ঘরে দু’জনের একসঙ্গে থাকতেই বা অসুবিধে কী?

উত্তরণের কাছে উত্তর ছিল না বলেই অনসূয়া থেকে গেল শনিবার রাতটা। পরদিন সন্ধ্যায় কলম্বিয়া ফিরে যাওয়ার আগে উত্তরণকে নিয়ে আটলান্টা ঘুরতে বেরোল।

গাড়িতে অনসূয়ার পাশে বসে উত্তরণ খেয়াল করলেন যে আটলান্টায় বেশ কিছুদিন হয়ে গেলেও, এই মেয়েটা বোধহয় ওঁর থেকে বেশিই চেনে রাস্তাঘাট।

“এর কারণ কী বলো তো? তুমি সবসময় স্বর্গের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক নিয়ে চিন্তিত, আর আমি পৃথিবীর সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক নিয়ে ভাবি। অতএব এটা তো স্বাভাবিক যে আমি একটু বেশি চিনব জাগতিক সবকিছু।” মার্টিন লুথার কিং (জুনিয়র)-এর বাড়ির সামনে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে বলল অনসূয়া।

বাড়িটা আগে দু-একবার দেখলেও, এখানে আসা হয়ে ওঠেনি। আজ অনসূয়া ওঁকে এখানে কেন নিয়ে এল জিজ্ঞেস করবেন ভেবে, ওর মুখের দিকে তাকালেন উত্তরণ।

অনসূয়া একটু মুচকি হেসে বলল, “এখানে তোমাকে নিয়ে এলাম কেন, সেটাই জিজ্ঞাসা তো? উত্তরটা হল, মার্টিন লুথার কিং বলতেন যে, ‘ইউ হ্যাভ টু বি এক্সট্রিম ইন লাভ।’ আমি চাই যে তুমি এই কথাটা একটু শোনো। ভালবেসে একটু উথালপাথাল হও। তা হলেই তুমি আমাকেও বুঝতে পারবে।”

“বুঝলেও কি আমি তোমার মতো হতে পারব অনসূয়া? আমরা তো শুধু দুটো আলাদা শরীর নই, দুটো আলাদা মানুষ। আলাদা-আলাদা মনোবৃত্তি আমাদের, আলাদা-আলাদা স্বপ্ন, চিন্তা, সংকল্প।”

উত্তরণ বললেন বটে, কিন্তু বলতে-বলতেই বুঝছিলেন যে অনসূয়ার তীব্র প্যাশনের সামনে ওঁর কথাগুলো দাঁড়াতে পারছে না। দাঁড়াচ্ছে না বেদ-বেদান্ত কিছুই, থই পাচ্ছে না লক-হিউম-হেগেল-রাসেল। ভালবাসা আসলে এমনই এক টর্নেডো, যা সবকিছু উড়িয়ে নিয়ে যায়। জ্ঞান কিংবা তর্ক দিয়ে তার মোকাবিলা করা যায় না। যায় না বলেই অনসূয়া যতবার বলত, “তুমি আমার মতো ইনটেন্সলি ভালবাসতে পারো না, পারবেও না,” ততবারই খুব অসহায় বোধ করতেন উত্তরণ।

আরও একটা পরিবর্তন হয়েছিল অনসূয়ার। যে কোনও আলোচনায়ও এখন মেয়েদের দৃষ্টিকোণ তুলে ধরতে চাইত। বারবার করে লোপামুদ্রা, গার্গী, অপালার কথা বলে জিজ্ঞেস করত, নারী কেন মন্দিরের গর্ভগৃহে ঢুকতে পারবে না? নারীর গর্ভগৃহ থেকেই তো প্রত্যেকটি মানুষের পৃথিবীতে আসা। তা হলে কীভাবে অপবিত্র হতে পারে একটা মেয়ে?

উত্তরণ প্রথম-প্রথম একটু বিব্রত হতেন, কীভাবে অনসূয়া এত তার্কিক হয়ে উঠল সেটা ভাবতেন। কিন্তু প্রতি শুক্রবার করে অনসূয়ার আসা আর রোববার ওর ফিরে যাওয়ার মধ্যে যে একসঙ্গে থাকা, তা উত্তরণের দৃষ্টিভঙ্গিও পালটে দিচ্ছিল অনেকটা।

অনসূয়ার সঙ্গে এক ঘরে থাকলেও আলাদাই শুতেন উত্তরণ। কিন্তু অত নিয়মকানুন তো পুরুষ আর নারীর মধ্যে চলে না, তাই হামেশাই দেখতেন ডিভান ছেড়ে খাটে ওঁর পাশে কিংবা খাট ছেড়ে ডিভানে নিজের হাঁটুতে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে অনসূয়া। ভোরের প্রথম আলোয় উত্তরণের ঘুম ভাঙলেও অনসূয়ার ভাঙত না। তখনই উত্তরণ খেয়াল করতেন, একটি মেয়ের সঙ্গে থাকা মানে কেবল তার শরীরটার সঙ্গেই থাকা নয়… তার চুলের গন্ধ নেওয়া বা তার বুকে মুখ ডোবানোই নয়। একটি মেয়ের সঙ্গে থাকা মানে কোথাও নিজের নিশ্বাস সেই মেয়েটির ফুসফুসে ঢুকছে অনুভব করা এবং একইভাবে সেই মেয়েটির নিশ্বাস নিজের ফুসফুসে ধারণ করা।

“তোমার এই টোনড মিল্কের মতো জীবন, যেখানে একটুও ট্রান্স ফ্যাট নেই বলে কোনও সর পড়ে না, সেখানে আমি কীভাবে টিকে যাওয়ার চেষ্টা করছি, এই প্রশ্ন যে আমি নিজেকে নিজে করি না, তা ভেবো না। সবসময়ই করি।” অনসূয়া বলল।

“কী উত্তর পাও?”

“উত্তর পাই যে আমার সবটা জুড়েই তুমি, শুধু তুমি।”

“কিন্তু তোমার তো অসুবিধে হয় আমার মতো নিরামিষ খেয়ে থাকতে।”

“যাক আমেরিকা তোমায় কিছুটা হলেও চেঞ্জ করতে পেরেছে তা হলে। কলকাতায় থাকতে তুমি কোনওদিন খবর নাওনি, আমি কী খাচ্ছি না খাচ্ছি। খবর নাওনি বলেই জানোনি যে আমি অনেকদিন মাছ-মাংস ছেড়ে দিয়েছিলাম। বাবা মাছ না খেয়ে থাকতে পারত না বলে বাবার জন্য বাজার করতাম। কিন্তু সেই রান্নাটা পুষ্পমাসিই করত। আমার কেমন মনে হত, মাছ খেয়ে বা রান্না করে তোমার কাজ করা উচিত নয়।”

“আমাকে কখনও বলোনি তো?”

“আমি ভেবেছিলাম তুমি নিজেই বুঝে নেবে। কিন্তু তুমি কবে কখন আমার কথা বুঝেছ? তুমি স্টেটসে চলে আসার পরও প্রায় মাসছয়েক আমি নিরামিষই খেতাম, এমন অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। তারপর যখন মেল-এর পর মেল পাঠিয়েও কোনও উত্তর পেতাম না, চিঠির পর চিঠি গারবেজে গিয়ে জমা হত হয়তো, তখন …”

“আমাকে খুব খারাপ লোক মনে হল, তাই তো?”

“তুমি আসলে কীরকম, সেটা আর খুব একটা ম্যাটার করে না আমার কাছে। আমার মনে তোমার যে ইমেজটা আছে, সেটাই সর্বগ্রাসী। অন্তত আমার জন্য।”

“তুমি তাই আমেরিকায় আমার ঘরে এসেও মাছ খাও না?

“আসলে তোমার ঘরটা এত পবিত্র যে আমার কেমন বাবো-বাধো ঠেকে…”

“মাছ-মাংস খেলে ঘর অপবিত্র হয়ে যাবে না। দেশে যখন আবার খাওয়া শুরু করেছিলে, এখানেও খেয়ো। যা খেতে ইচ্ছে করছে তা খাওয়ার মধ্যে কোনও দোষ নেই। আমি খাই না কারণ আমার ইচ্ছে করে না। আশ্রমে যাওয়ার পর থেকেই আর করেনি।”

অনসূয়া একটু চুপ করে থেকে বলল, “আমেরিকায় মাংসের গায়ে রক্ত লেগে থাকে না, খেয়াল করেছ? শাইলক রক্তের থেকে মাংসকে আলাদা করতে পারেনি, কিন্তু আমেরিকা পেরেছে। সব এমন নিটলি প্যাকেজড যে কোথাও এতটুকু রক্তের দাগ নেই। কিন্তু সেই আমেরিকাও তোমার থেকে আমাকে আলাদা করতে পারল না। আশ্চর্য না?”

“আশ্চর্য তো বটেই। ক্লিন-শেভন সন্ন্যাসী মহারাজ আর অনসূয়া ইউএসএ-র ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে বাজার করছে একসঙ্গে, অ্যামেজ়িং নয়? কিন্তু তোদর বিয়ের খবর তো পাইনি!” পিছন থেকে যে ছেলেটা বাংলায় বলে উঠল, উত্তরণ তাকে ইউনিভার্সিটিতে দেখে থাকলেও, নাম মনে করতে পারলেন না।

অনসূয়া এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল, “খবর পাওনি, কারণ এখনও আমরা বিয়ে করিনি প্রতিমদা।”

প্রতিম হেসে উঠল, “লিভ-টুগেদার করছিস? সন্ন্যাসী ঠাকুরের সঙ্গে লিভ-টুগেদার?”

উত্তরণের মাথাটা নিজের অজান্তেই একটু নিচু হয়ে গেল। কিন্তু অনসূয়া স্ট্রেট ব্যাটে বলটা খেলল।

“উত্তরণ কি তোমাকে দীক্ষা দিতে গিয়েছিল যে ও সন্ন্যাসী ঠাকুর হবে? আর যদি হয়েও থাকে, সন্ন্যাসীর বিয়ে করার মধ্যে আমি তেমন পাপ দেখি না, জানো! পাপ দেখি একটি মেয়েকে ফাঁসিয়ে দিয়ে তারপর তাকে অ্যাবর্ট করতে বাধ্য করে, তাকে ছাড়াই আমেরিকা চলে আসার মধ্যে। বাই দ্য ওয়ে, চৈতালি ভাল আছে এখন?”।

কথাটা শুনেই প্রতিম ছিটকে সরে গেল সামনে থেকে। বোধহয় ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকেই পালিয়ে গেল।

উত্তরণ অবাক চোখে তাকালেন অনসূয়ার দিকে।

অনসূয়া একটু হেসে বলল, “ঠাকুর বলেছিলেন না যে, না কামড়ালেও ফোঁস করতে হয়। যে যেরকম তাকে ঠিক সেরকম ভাষায় উত্তর না দিলে উত্তরটা লোকটা পর্যন্ত পৌঁছয় না।”

“কিন্তু আমি ঠিক চিনতে পারলাম না ওকে। আমাদের ডিপার্টমেন্টেই ছিল?”

“না, হিস্ট্রি পড়ত। পড়াশোনায় কতটা ভাল ছিল জানি না, তবে ঘাগু ছিল প্রচণ্ড। আমায় টার্গেট করেছিল একটা সময়।”

“তুমি রাজি হলে না কেন?” ঘরে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন উত্তরণ।

“দুটো কারণে। এক আমি তোমাকে, কেবল তোমাকেই ভালবেসেছি। আর দুই, উপরচালাক লোক আমার অসহ্য লাগে।”

“আমেরিকায় এসে তুমি কিন্তু খুব চ্যাটাং-চ্যাটাং কথা বলতে শিখেছ?”

অনসূয়া হেসে উঠল, “তোমার অসুবিধে হচ্ছে তাতে? আমি চলে যাব? কিন্তু এখন যদি চলেও যাই, আর কখনও না আসি, তবু প্রতিমের সৌজন্যে সারা দুনিয়া জানবে যে আমরা একসঙ্গে থাকতাম। কেউ বিশ্বাস করবে যে আমরা এখানে দুটো চালের দানার মতো আছি? আমাদের মধ্যে কোনও সংযোগ হয়নি?”

“আমি তো সংযোগের থেকে নিজেকে বাঁচাতে চেয়েছি অনসূয়া। আমি তো একটা আধ্যাত্মিকতার মধ্যে থাকার চেষ্টা করেছি প্রতিনিয়ত। তবে কেন অকারণ গসিপ আমাকে ঘিরে থাকবে বলো তো?” খানিকটা স্বার্থপরের মতোই বলছেন বুঝেও, না বলে পারলেন না উত্তরণ।

“এটাই হয়তো তোমার ঠাকুরের ইচ্ছা। তোমার ঠাকুর নিশ্চয়ই চান তুমি সংসার করো।”

“হতে পারে না।”

“কেন পারে না? বিজয়দার কথা ধোরো না, তোমার ঠাকুর নিজে তোমাকে কিছু বলেছিলেন?”

“বিজয়দাকে তুমি চেনো না বলে বলছ। বিজয়দার মধ্যে দিয়ে কথাটা এলেও, ওটা আসলে…”

“তোমার মুখ থেকে স্বামী অমলানন্দের বিষয়ে যা-যা শুনেছি তাতে ওঁর প্রতি আমার সর্বোচ্চ শ্রদ্ধাই আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বলছি, উনি হয়তো ঠাকুরের কথাটাকে নিজের মতো করে ইন্টারপ্রেট করেছিলেন। ঠাকুর কী চেয়েছিলেন, তুমি কী করে জানবে? তুমি গেরুয়া কাপড় পরে ঠাকুরের কাজ করতে পারবে, ট্রাউজ়ার্স আর টি পরলে পারবে না? আর তা-ই যদি হত, ঠাকুর তোমার স্বপ্নে আসছেন না কেন? কেন বারণ করছেন না তোমাকে? কেন বলছেন না যে তুমি বিরাট অপরাধ করছ একটি মেয়েকে প্রতি সপ্তাহে দু’দিন তোমার ঘরে রেখে, এক্ষুনি ওই অনসূয়াকে বের করে দাও?” বলতে-বলতে অনসূয়া খিমচে ধরল উত্তরণের বুকের কাছটা।

“ঠাকুর কী চেয়েছেন আমি সত্যিই বলতে পারব না। কিন্তু আমি তো চাইনি।” উত্তরণ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।

“কী চাওনি? আমি যখন স্নানে যাই আর তুমি আমার স্নানের শব্দ শোনো, সেই শব্দ তোমার ভিতরে কোনও দৃশ্যের জন্ম দেয় না? যখন আমি ঘুমের মধ্যে পাশ ফিরি আর তুমি চোখ মেলে একবার আমার দিকে তাকিয়ে চোখটা সরিয়ে নাও, তখন তোমার কিছু হয় না? তোমার একটা ট্রেনিং আছে, আমি জানি। কিন্তু সমস্ত ট্রেনিংয়ের পরেও শিম্পাঞ্জি যেমন শিম্পাঞ্জিই থাকে, সমস্ত সংযমের শেষেও একজন রক্তমাংসের পুরুষ একটি পুরুষই। সে পাথর হয়ে যায় না।” বলতে-বলতে উত্তরণকে জড়িয়ে ধরল অনসূয়া। ওঁর ঠোঁটে ঠোঁট রাখল নিজের।

উত্তরণ বাধা দিতে গিয়েও পারলেন না যখন টের পেলেন যে ওঁর ঠোঁটদুটোও সাড়া দিচ্ছে।

সেই সাড়া দিতে দিতে উত্তরণের ভয়টা আনন্দে অনূদিত হতে শুরু করল। ঠাকুর বলেছিলেন, ‘সোনার গায়ে পারা লাগলে সোনা কালো হয়ে যায়।’ কিন্তু কই, তিনি তো কালো হয়ে যাচ্ছেন না! বারাণসীর আশ্রমে চেতনানন্দ বলে একজন তান্ত্রিক আসতেন। কথায়-কথায় উত্তরণকে তিনি জানিয়েছিলেন যে একা শিবলিঙ্গের কোনও অর্থ হয় না, যতক্ষণ না তা যোনিপীঠের উপর স্থাপিত হয়। নারীহীন পুরুষ আর রাত্রিহীন দিন একই ব্যাপার।

উত্তরণের প্রথমে মনে হচ্ছিল, অনসূয়ার প্রত্যেকটা চুমু ওঁর মুখে সেভাবে পড়ছে, যেভাবে জিশুর গায়ে পেরেক পড়েছিল। কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে হল, পুরাকালের কোনও অপ্সরার মতো, ধ্যান ভাঙিয়ে ওঁকে সজীব করে তুলছে অনসূয়া, একটা কাষ্ঠখণ্ডকে আনন্দময় অস্তিত্বের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সেই আদরে ডুবে যেতে-যেতেও উত্তরণ, কে জানে কেন, সামলে নিলেন নিজেকে।

“অনসূয়া থামো। আমাদের আগে স্বামী-স্ত্রী হতে দাও। আমাদের মাঝখানে একটা মন্ত্রকে জন্ম নিতে দাও।”

“সেই মন্ত্র তো আমরা এখানে এই মুহূর্তে উচ্চারণ করতে পারি।”

“না। তার একটা স্থান-কাল-পাত্র আছে।”

কথাটা বলে অনসূয়াকে থামিয়ে দিলেন উত্তরণ। পরদিনই আটলান্টার একটি মন্দিরে গিয়ে অনসূয়ার সিঁথিতে সিঁদুর টেনে দিলেন। সেই সময় উত্তরণের মনে হচ্ছিল যে ঠাকুর চেয়েছিলেন এক, আর তিনি করলেন অন্য কিছু৷ ঘরে ফেরার মুহূর্তে খেয়াল পড়ল, বিজয়া বলতেন যে ঠাকুরের ইচ্ছে ছাড়া একটা পাতাও নড়ে না। তা হলে অনসূয়া আর ওঁর বিয়ে কীভাবে ঠাকুরের ইচ্ছা ব্যতিরেকে হতে পারে?

উত্তরণ ভেবেছিলেন আটলান্টার কয়েকজনকে ডেকে খাওয়াবেন ওঁদের বিয়ে উপলক্ষে। কিন্তু সঞ্জয়দাকে ফোনে না পেয়ে বিনা নোটিসে তাঁর বাড়ি গিয়ে যখন একজন শ্বেতাঙ্গ মহিলার কাছে শুনলেন, সঞ্জয়দা ওখানে থাকেন না আর, দমে গেলেন ভিতরে ভিতরে। মনে হল, বাড়িতে থেকেও দেখা করলেন না সঞ্জয়দা, হয়তো গ্রিফিনের ঘটনার প্রতিবর্ত্ম ক্রিয়াতেই। একটা সংকোচ ঘিরে ধরল উত্তরণকে।

অনসূয়া ব্যাপারটা বুঝেই বলল, এখনও যেহেতু ওঁরা দু’জনে দুই শহরের বাসিন্দা, তাই এক্ষুনি ব্যাপারটা চাউর করে লাভ নেই। কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে পরে দেখা যাবে।

‘জিজ্ঞাসা করবে কোথায়? আমি তো সামাজিক গেট-টুগেদারগুলোয় যাওয়া বন্ধই করে দিয়েছি।” উত্তরণ বললেন।

“রাস্তাঘাটে দেখা হলেও করতে পারে। প্রতিম যেমন করেছিল।”

“কিন্তু আমি তো ফেরারি আসামীও নই যে সারা জীবন পালিয়ে বেড়াব।” উত্তরণ চিৎকার করে উঠলেন।

অনসূয়া ওঁর দিকে তাকাল। বরফে আগুন লেগেছে দেখে অবাকই হল।

মানুষের চিৎকারের বিপ্রতীপে থাকে প্রকৃতির নিস্তব্ধতা। তাই প্রকৃতির সামনে এসে চুপ করে যায় মানুষ। নিজেকে তুচ্ছ, অনেকের ভিতরে এক বলে অনুভব করে। লেক ল্যানিয়র-এ দু’দিনের জন্য এসে, সেই অনুভবই হল উত্তরণের।

অনসূয়াই খুঁজে বার করেছিল লেকটার হদিশ। প্রায় চল্লিশ হাজার একর জুড়ে ষাট বর্গমাইল জল আর জল। কবি সিডনি ল্যানিয়রের নামে নামাঙ্কিত হ্রদটায় কত যে পাখি!

“বিউফোর্ড বাঁধ বানানোর পাশাপাশি ওরা এই হ্রদটাও বানিয়েছিল। যাতে প্রকৃতিকে একদিকে বাঁধলে, অন্যদিকে খুলে দেওয়া যায়।” অনসূয়া বলল।

হ্রদের জলে ঢেউ না থাকলেও চলাচল ছিল। একটা হালকা স্রোত সাদা আলোর মতো কিনার অবধি এগিয়ে আসছিল, আবার ফিরে যাচ্ছিল। সেদিকে তাকিয়ে বসে থাকতে-থাকতে উত্তরণ বললেন, “তুমিও কি আমাকে বেঁধে রাখার পাশাপাশি খুলে দিতে চাও?” বলতে-বলতে ওই উন্মুক্ত চরাচরে হয়তো জীবনে প্রথমবার সচেতনে বাসনাকে অনুভব করলেন উত্তরণ। একই সঙ্গে টের পেলেন, যে সংশয়, যে দ্বিধা ওঁকে কুরে-কুরে খেয়ে এসেছে এতদিন, প্রকৃতিতে তার কোনও অনুরণন নেই। সে মুহূর্তমাত্ৰ থামে না। না মৃত্যুতে, না জরায়, না যন্ত্রণায়, না আনন্দে, না বার্ধক্যে, না যৌবনে।

উত্তরণের আলিঙ্গনে ধরা দিয়ে অনসূয়া বলল, “আমি ছাড়া অন্য কোনও মেয়ে তোমার জীবনে আসতেই পারে না, এই বিশ্বাসেই তো লড়ে গেলাম। আর এই বিশ্বাস আছে কেন জানো? তোমার জীবনে আসার জন্য তপস্যা করতে হয়। সেই তপস্যার শক্তি আমি ছাড়া অন্য কোনও মেয়ের মধ্যে দেখেছ তুমি? তোমার জন্য তপস্যা করেছি বলেই তোমার অপেক্ষায় শান্ত থাকতে পেরেছি। আমি জেনেছি, একদিন আমার এই তপস্যা তোমাকে আমার দিকে টেনে আনবে। তোমার ভিতরে যে ঝরনাটা আছে, সেই ঝরনাটাকে সমুদ্র করে তুলবে।”

সেই রাত্রে উত্তরণ নিজের শরীরের নীচে এক নারীকে আবিষ্কার করলেন, নিজেকেও নতুন করে চিনলেন।

অনসূয়া বলছিল, “আমি এখনও তোমার পুরোটা পাইনি। হিমশৈলের চূড়াটুকু মাত্র পেয়েছি। বাকি সবটুকু তোমার সাধনায় লুকিয়ে আছে। আমি জানি।”

উত্তরণ প্রবল ক্লান্তি আর ভাললাগায় ডুবে যেতে-যেতে বললেন, “সমস্ত ভালবাসার শেষেও আমার ওই সাধনাটুকু বাঁচিয়ে রেখো অনসূয়া। ওটাই আমার দাঁড়ানোর জায়গা। এটা বাদ দিয়ে দিলে, আমি কেবল ইট-কাঠ-পাথরের টুকরো।”

“আমি তোমার থেকে কিছু বাদ দিতে চাইনি। চাই না। শুধু তোমাকে তোমার সবটুকু নিয়ে পেতে চাই।”

সমস্ত প্রতিরোধ খসে যাওয়ার মুহূর্তে ফুল যেভাবে ঝরে পড়ে ডাল থেকে মাটিতে, উত্তরণ সেভাবেই যেন ঝরে পড়লেন এতদিনের কৃচ্ছ্রসাধন থেকে।

ওঁর মনে হতে লাগল, শরীরের উরু, জঙ্ঘা, নাভি, স্তন, সমস্ত অতিক্রম করে নারী হল বালি, আর পুরুষ সমুদ্রের জল, যা বালির ভিতরে প্রবেশ করে যায়। একবার প্রবেশ করার পর জলকে আর আলাদা করে চেনা যায় না, শুধু ভেজা বালির গায়ে তার চিহ্ন থাকে। সেই বালি আর সমুদ্রের মিলন, সেই প্রকৃতি-পুরুষ দ্বৈতবাদই উদ্‌যাপন করে দুনিয়া।

উত্তরণ যখন এইসব ভাবছেন, তখন উদ্যাপন নয়, সমর্পণের সততায় অনসূয়া জড়িয়ে ছিল নিজের স্বামীকে। জড়িয়ে ধরেই রইল, যতক্ষণ না ভোরের পাখির প্রথম গানটা বাতাসের সঙ্গে মিশে গেল।

১৯

অনসূয়া কিছুটা উদ্যোগ নেওয়ার জন্যই হোক, বা একেবারে নতুনরকম কাজ বলেই হোক, উত্তরণ ওঁর নিজস্ব ‘গীতা’-ব্যাখ্যার জন্য অনেক জায়গায় সমাদৃত হচ্ছিলেন। ওঁর থিসিস বই হিসেবে ছাপতে চাইছিলেন দু’জন প্রকাশক। বিষয়টা অভিনব ছিল বলেই হয়তো দেশ-বিদেশের সেমিনার থেকে ডাক আসছিল। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুনের সামনে যদি কৃষ্ণের বদলে বুদ্ধ কিংবা জিশু থাকতেন, তা হলে কী বলতেন ওঁরা অর্জুনকে? যুদ্ধ করতে, নাকি অস্ত্র তুলে রাখতে? উত্তরণের সহপাঠী সুব্রত একবার এই প্রশ্নটা করেছিলেন ওঁকে, এম এ ক্লাসে। উত্তরণ তখন কোনও উত্তর দিতে পারেননি। কিন্তু সুব্রতর প্রশ্ন দিয়ে শুরু হয়ে, দ্বন্দ্ব এবং মীমাংসার ভিতর দিয়ে এগোতে-এগোতে শেষ অবধি উত্তরণের থিসিস মানুষের ভিতরকার সেই দ্বৈততা তুলে আনে, যা যুদ্ধ করতে-করতে শান্তি চায়, আপাত-শান্তির মধ্যে যুদ্ধের জন্য খেপে ওঠে।

অনসূয়া রিসার্চ করছিল নৈতিক আচরণের ফাঁকফোকর নিয়ে। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে আমরা যেমন, অন্যরাও কি তেমন? আমাদের নিজেদের জন্য যা পরীক্ষা, অন্যদের ক্ষেত্রে তা-ই তো পাপ! ‘হোয়াট ইজ় সিন ফর আদার্স, ইজ় অ্যান এক্সপেরিমেন্ট ফর আস। অনসূয়ার থিসিসের সাব-হেডিং ছিল এটাই।

পোস্ট-ডক্টরাল কাজের সূত্রে তিন-সাড়ে তিন বছর আটলান্টায় কাটিয়ে উত্তরণ ভাবছিলেন, অনসূয়ার কতটা কাছাকাছি চাকরি নেওয়া যায়।

ওদিকে অনসূয়া উত্তরণকে বলে বসল, “আমি না, তোমায় ঠিক বুঝতে পারি না।”

উত্তরণ ওর মুখ থেকে থার্মোমিটারটা বার করে জ্বর দেখছিলেন তখন। টেম্পারেচার দেখে থার্মোমিটারটা ঝাঁকাতে-ঝাঁকাতে বললেন, “না বোঝার মতো কিছু করার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি আমি।”

“আমার জ্বর হয়েছে বলে আটলান্টা থেকে তিন ঘণ্টা ড্রাইভ করে আসাটাকেই স্বামী হওয়ার অতুলনীয় নিদর্শন বলে মনে কোরো না। তোমার জায়গায় যে হাজ়ব্যান্ড থাকত, সে একই কাজ করত।”

“তাই তো বললাম, স্বাতন্ত্র্য বলে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই আমার। এখন সবাই যা করে, আমিও তাই করি। বাসন মাজা থেকে গাড়ি চালানো, বাজার থেকে লন্ড্রি — সব। শুধু সংসারটাই যা লং ডিসট্যান্স।”

“সংসার লং ডিসট্যান্সই থাকবে। বাট টেল মি ওয়ান থিং, আর ইউ সরি ফর দ্যাট?”

“সরি কেন হব?”

“না, এই যে তোমাকে সাংসারিক সব কাজ করতে হচ্ছে, তার জন্য আমাকে দায়ী মনে হয়?”

“স্টেটসে বাঁচতে গেলে তো গাড়ি চালাতেই হত। তবে সত্যিটা স্বীকার করতে যদি বলল, এতটা রাস্তা চালাতে আমার বেশ ভয়ই করছিল। তুমি তো শুধু ওই অগাস্টা শহরে একবার থামো, আমি গোটা জার্নিটায় তিনবার না চারবার থামলাম।”

“গাড়িটা এখানেই রেখে যাও তুমি। বাসে ফিরে যেয়ো আটলান্টায়।”

“পাগল, আমাকে বেরোতে হবে না?”

“তুমি তো ড্রাইভিং না শিখেই দিব্যি চালিয়ে নিয়েছিলে দেড়-দু’বছর। শেখার পরও বোধহয় এক লপ্তে পাঁচ মাইলের বেশি চালাওনি কোনওদিন তোমার ওই সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়িটা। আমি না এলে হয়তো আরও বহু বছর ওটাই চলত, ওভাবেই চলত। আমিই তোমাকে…”

“বাজে বকা বন্ধ করো। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠো।”

“কিন্তু আমার সুস্থতা যদি তোমার অসুস্থতার কারণ হয়? তুমি যে জীবন চাও না, তার দিকে যদি আমার তথাকথিত সুস্থ মস্তিষ্ক ছুটিয়ে নিয়ে যায় তোমাকে? অন্যায় হবে না?”

“তুমি আর-একটু ঘুমোনোর চেষ্টা করো।”

“ঘুম আসবে না। তুমি আমায় বলো, কেন তুমি আমার কাছাকাছি থাকার কথা ভাবছ?”

“এটা একটা প্রশ্ন হল অনসূয়া? একটি দম্পতির একজন আর-একজনের কাছে থাকতে চাইবে না?”

“কিন্তু আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, কারণ এটা নয়। আমার অন্যায় হলে ক্ষমা কোরো, কিন্তু আমি মিথ্যাচার করতে পারব না তোমার সঙ্গে।”

“কী হয়েছে বলো তো তোমার? আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না।”

“না বুঝেই আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দাও। তুমি পোস্ট-ডক্টরাল অ্যাসোশিয়েট না হয়ে পোস্ট-ডক্টরাল ফেলো-ই রয়ে গেলে কেন?”

“দুটোর মধ্যে তেমন কোনও ফারাক নেই। তাই অত ভাবিনি…”

“অবশ্যই ফারাক আছে। পোস্ট-ডক্টরাল অ্যাসোসিয়েটরা স্যালারি পায়, ফেলোরা পায় স্টাইপেন্ড! অ্যাসোসিয়েটদের নাম ইউনিভার্সিটি পে-রোলে থাকে, তারা এমপ্লয়ি হিসেবে গণ্য হয়, চিকিৎসার খরচাপাতি পায়, আরও হাজার সুবিধের হকদার তারা।”

“একই সঙ্গে তাদের গলায় একটা বকলস থাকে, তারা দু’পা এগোতে গেলে ইউনিভার্সিটি এক পা পিছনে টানে…”

“পিছনে টানলে না-হয় পিছিয়ে আসতে। কিন্তু আসল কারণ তো সেটা নয়। কারণটা হল, ফেলো-দের প্রতি মুহূর্তে পারফর্ম করতে হয় না গ্রান্ট পাওয়ার জন্য। তারা আক্ষরিক অর্থেই অনেক বেশি স্বাধীন…”

“হ্যাঁ, সেই কারণেই…”

“অনেক কম সুবিধা সত্ত্বেও, তুমি ফেলো-ই থেকে গিয়েছ। অ্যাসোসিয়েট হওয়ার চেষ্টাও করোনি। তানইলে তো তোমাকে প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটরের আন্ডারে কাজ করতে হত। সুবিধা নেওয়ার পাশাপাশি ডেডলাইন সামলাতে হত। তোমার সাধন-ভজনের অনেক ক্ষতি হয়ে যেত।”

“তুমি শেষে টন্ট করছ আমায়?”

“আমি মন থেকে বলছি সোনা, টন্ট করার ইচ্ছে আমার মনের ত্রিসীমানাতেও নেই। এই যে এখন তুমি আমার কাছাকাছি থাকবে বলে আটলান্টার পাট চুকিয়ে টেনেসি, শার্লট, চার্লসটন, অ্যালাবামা যেখানে হোক একটা চাকরি জোটাতে চাইছ, তার কারণও তো ওই একই। কাজের তত চাপ নেই, এমন কোথাও ঢুকতে পারলে তোমার আধ্যাত্মিক যাত্রা ব্যাহত হয় না।”

“বিকল্প আছে তোমার কাছে?”

“অবশ্যই। আর সেটা তোমার মাথাতেও ঘাই মারেনি, এমনটা মানতে আমি রাজি নই।”

“হেঁয়ালি না করে বললা।”

“হেঁয়ালির প্রশ্নই ওঠে না। আমেরিকার আইভি লিগ ইন্সটিটিউশনগুলোর নাম তুমি জানো না, তা তো নয়। সেরারা যেখানে পড়ায়, গবেষণা করে, সেরার সেরা হয়ে কেন সেখানে যাবে না তুমি?”

“হার্ভার্ডে পড়ালেই পড়ানো?”

“কেবল হার্ভার্ডের কথা তো বলিনি। ব্রাউন, ইয়েল, কর্নেল কী দোষ করল?”

“ব্রাউন ইউনিভার্সিটি কোথায়?”

“প্রভিডেন্সে।”

“আর ইয়েল?”

“কানেটিকাট। কিন্তু আমি কি জিকে-র পরীক্ষা দিচ্ছি?”

“দিলে পাশ করতে পারবে? প্রভিডেন্স আর কানেটিকাটে কীরকম ঠান্ডা পড়ে, তোমার কোনও আইডিয়া আছে?”

“ঠান্ডার জন্য চান্স ছেড়ে দেব? ওখানে মানুষ বেঁচে নেই?”

“কিন্তু আমি যদি কলকাতার মতোই ওয়েদার, এমন কোনও জায়গায় পেয়ে যাই, মরতে যাব কেন…”

“তোমার কথা শুনে দেওয়ালে মাথা ঠুকতে ইচ্ছে করে আমার। ঠান্ডা বেশি বলে নাকি লোকে আইভি লিগ ইন্সটিটিউশনে যাবে না! এ অনেকটা সোনা দেখে চোখ বন্ধ করে হাঁটার মতো ব্যাপার। আচ্ছা, নিউ জার্সিতে তো তত ঠান্ডা নেই, তাহলে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি নয় কেন?”

“ইউ-পেন বাদ দিলে ফিলাডেলফিয়া শহরটাও তো দিব্য রঙিন।”

“ইয়ার্কি মেরো না। আছে আমার প্রশ্নের উত্তর তোমার কাছে?”

“না নেই। কিন্তু তোমার কাছেও আমার প্রশ্নের উত্তর নেই অনসূয়া। কী আছে কি ‘আইভি লিগ’ শব্দটার মধ্যে প্রচুর মশলা দেওয়া খাবার মানেই ডাল-ভাত-আলুভাজার চেয়ে সুস্বাদু?”

“এসব কুযুক্তি দিয়োনা। যে সুখ’ আইভি লিগের একজন হয়ে পাওয়া যায়…”

“আমি পাব না। আমার যা খ্যাতি, প্রতিপত্তি হওয়ার, তা ওই তথাকথিত সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েই জুটবে। আর যদি না পাওয়ার হয় তা হলে দরকার নেই। আমার এক বন্ধু বলত যে এই ‘ফ্যাসিজ়ম অফ হ্যাপিনেস’ থেকে মুক্তি আবশ্যক। সবাই সবসময় তুরীয় অবস্থায় থাকতে পারে না। যন্ত্রণা, বেদনা জীবনের জরুরি অঙ্গ, তারই ভিতর থেকে সুখ উঁকি মারবে মাঝে-সাঝে, কুয়াশার ভিতর থেকে রোদ যেভাবে উঁকি দেয়।”

“এইসব তোমার কোনও বন্ধুর কথা, না তোমার নিজেরই?”

“সন্দেহ করাও শুরু করলে?”

“সন্দেহ নয়, জাস্ট ভাবছিলাম।”

“ঠিকই বলেছ, সেরকম কোনও বন্ধুই নেই আমার। হয়নি। হলে, কী নিয়ে কথা বলতাম? সব আলোচনাই তো সেভিংস, নয়তো সেক্স কিংবা পলিটিক্স নিয়ে। তুমি খুব খারাপ ভাবতে পারো, কিন্তু সদ্য পরিচিতদের সঙ্গে কথা শুরু হলেই, কাশীর সেই পাগলা সাধু আত্মানন্দের কথা মনে পড়ে যায় আমার। সারাদিন এই ঘাট থেকে ওই ঘাটে ঘুরে গঙ্গার জল পরীক্ষা করে বেড়াতেন আত্মানন্দ। পছন্দ হলে মাথায় দিতেন, নয়তো মুখের ভিতরে নিয়ে কুলকুচি করে ফেলে দিতেন। সেই সাধু কী বলতেন জাননা? বলতেন, ‘তোরা বলিস মানুষ। আমি তো মানুষ দেখি না। আমি দেখি কারওর ভিতর শকুন, কেউ বা শেয়াল, কারওর মধ্যে যাঁড়, কারওর ভিতর বাছুর, কিংবা কুকুর। মানুষ পাই কই?’”

“আমি তোমায় অনর্থক কষ্ট দিলাম। আমার মানসিকতাটাই এরকম। ক্ষমা করে দিয়ো।”

“ক্ষমার প্রশ্নই ওঠে না। তুমি যা মনে করেছ, বলেছ।” উত্তরণ উঠে দাঁড়ালেন।

“আবার আসবে তো? নাকি রাগ করে…” অনসূয়া কথাটা শেষ করল না।

“আমি না এলে, তুমি যাবে। আমরা তো স্বামী-স্ত্রী। আর স্বামী-স্ত্রী তো সাত দিনের জন্য হয় না, সারা জীবনের জন্য হয়।”

“আমি তোমার স্ত্রী, শুধু এটাই কি তোমার কাছে যাওয়ার ভিসা আমার? তুমিও কি কেবলমাত্র স্বামীর পরিচয়ে আমার কাছে এসছে?”

“এই তর্কগুলো পরেও করা যাবে অনসূয়া। তুমি এখন অসুস্থ।”

“আমি তর্ক করিনি, একটা প্রশ্ন করেছি। তার উত্তর না পেলে আরও অসুস্থ হয়ে যাব। প্লিজ় বোসো আর-একটু। একবার বলো, একা আমিই কি ভালবেসে এলাম তোমাকে, তুমি কি কোথাও কিছু ফিল করো না?”

“আমার অনুভব আমি তো তোমার মতো করে ব্যক্ত করতে পারি না। তা ছাড়া আমার মনে হয়, ‘ভালবাসি’ বলে ভালবাসা জাহির করারও কোনও অর্থ হয় না। সারা জীবনের একাগ্রতা দিয়ে ভালবাসা বোঝাতে হয়।”

“আমি তোমার গুরু নই উত্তরণ, আই অ্যাম জাস্ট অ্যানাদার রেচেড গার্ল, হু হ্যাপেনস টু লাভ ইউ, হোপলেসলি, শেমলেসলি অ্যান্ড…”

“ফিয়ারলেসলি৷” উত্তরণ অনসূয়াকে কথাটা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে বলে উঠলেন।

আধশোওয়া হয়ে নিজের হাতদুটো বাড়িয়ে দিল অনসূয়া।

উত্তরণ মাথা ঝুঁকিয়ে চুমু খেলেন ওকে।

মহাকাল একটা মুহূর্তে এসে স্থির হল।

২০

পরের চার-পাঁচটা বছর যেন ঝড়ের বেগে উড়ে গেল। অনসূয়া নিজের পিএইচ ডি শেষ করে মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট-ডক্টরাল ফেলো হিসেবেই যোগ দিল। উত্তরণ নর্থ ক্যারোলাইনা রাজ্যের ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছিলেন, আইভি লিগের সদস্য না হলেও যার খ্যাতি আমেরিকার সর্বত্র। কিন্তু মেরিল্যান্ডে প্রাচ্য দর্শনের একজন অধ্যাপকের পদ খালি হতেই, ডিউক-এর চাকরি ছেড়ে দিয়ে মেরিল্যান্ডে চলে এলেন উত্তরণ।

“ডিউক ছেড়ে লোকে হার্ভার্ডে যায়, উনি মেরিল্যান্ডে এলেন!” অনসূয়া স্বগতোক্তি করল।

“আমাদের ভিতরের এই তিন-চার ঘণ্টার দূরত্বটা অনেকদিন চলছে বলে তোমার মনে হয় না?”

“কী করব, আমি তো ডিউক-এ পেলাম না। পেলে চাকরি ছাড়তে হত তোমাকে।”

“তোমার কী মনে হয় জানি না, কিন্তু আমার আমেরিকার প্রায় সবক’টা শহরকেই একরকম লাগে। আমাদের দেশে অনেক দারিদ্র্য, কিন্তু একটা বৈচিত্র্যও রয়েছে। কাশীর সঙ্গে পটনাকে কেউ গুলিয়ে ফেলতে পারবে না হাজার চেষ্টা করেও শান্তিপুর আর নবদ্বীপও আলাদা-আলাদা বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। কিন্তু এখানে যে শহরেই যাই, হরেদরে সেই একইরকম। হয়তো অত চমৎকার রাস্তাঘাট বলেই…”

অনসূয়া থামিয়ে দিল উত্তরণকে, “মোটই না। নিউ ইয়র্ক, আর-পাঁচটা শহরের মতো নাকি?”

“নিউ ইয়র্ক আলাদা, শিকাগো বা সান ফ্রানসিসকোও আলাদা। কিন্তু সংখ্যায় ক’টা এই শহরগুলো? বেশির ভাগই ওই থোড়-বড়ি-খাড়া… বাহ্যিকভাবে যাও বা আলাদা, ভিতরে সব এক।”

“কী বলছ তুমি? আমেরিকার দক্ষিণের লোক ফিউডাল মানসিকতার, উত্তরের লোক অনেক মুক্তমনা।”

“সেটা আপাত-ধারণা অনসূয়া। উত্তরের কারখানাগুলোর জন্য প্রচুর শ্রমিক দরকার ছিল। তারা তুলোখেতে আটকে থাকলে অসুবিধে হচ্ছিল কারখানার মালিকদের। ওহায়ো নদীর ওপাশে থাকলে ক্রীতদাস আর সাঁতরে এপারে চলে এলে ফ্রি-ম্যান, এই গল্পগুলো অর্থনৈতিক প্রয়োজন থেকেই উঠে এসেছে। তাই বলে তাদের জুতোয় অন্য কেউ পা গলালে উত্তরাংশের লোকেরা কিছু কম প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। হ্যাঁ, দক্ষিণে গুলি করে মেরেছে, জ্যান্ত পুড়িয়ে দিয়েছে, কিন্তু বস্টনে যখন সাদাদের স্কুলে কালোদের অ্যাডমিশন দেওয়া শুরু হল, তখন রায়ট বাধেনি?”

“আমাদের বাচ্চা হলে, কোন স্কুলে পড়বে? সাদাদের না কালোদের?”

উত্তরণ এই প্রশ্নটার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না, খানিকটা চমকে গিয়ে বললেন, “মানুষের স্কুলে পড়ুক, সেটুকুই চাইব। কিন্তু এই দেশে বা এই পৃথিবীতেই, তেমন স্কুল আদৌ আছে কি না…”

“না থাকলেও, বাচ্চা তো একটা চাই-ই। আমি তো সে কারণেই অ্যাসোসিয়েট হলাম না, ফেলো হয়েই রইলাম। মনে আছে, কত ঝাড় দিয়েছিলাম তোমায়?”

“আমরা কি সত্যিই প্রস্তুত সন্তানের জন্য? যে যার নিজের কাজ নিয়ে, পড়াশোনা নিয়ে এত ব্যস্ত আমরা…”

“নোবেল প্রাইজ় যারা পায়, তাদের বাচ্চা হয় না? সেদিন একটা আর্টিকল পড়ছিলাম নোবেল লরিয়েটদের পারিবারিক জীবন নিয়ে। তিনটে-চারটে করে বাচ্চা প্রত্যেকের…”

“ওরা পারে।”

“আমরাও পারব। তুমি যখন মেরিল্যান্ডে চলেই এসেছ, তখন…”

“কিন্তু আমাদের নিজেদের বাড়ি-ই তো নেই এখনও…”

অনসূয়া অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল, “বহতা পানি আর রমতা যোগী। আমার সন্নিসি ঠাকুর যে এখন মার্কিন মুলুকে বাড়ি বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন! শোনো, বাড়ি পাঁচ বছর পরেও কেনা যাবে, কিন্তু বাচ্চা আসতে যত দেরি হবে তত কমপ্লিকেশন বাড়বে…”

অনসূয়ার আগের কথাটায় খানিকটা আঘাত পেয়েই হয়তো উত্তরণ রোগে উঠলেন, “বাচ্চা-বাচা করে খেপে উঠলে কেন হঠাৎ? মাথার ঠিক আছে তো?”

“মাথা তোমারই ঠিক নেই। অবশ্য তুমি তো সমাজে বাস করো না, তোমার ভাবের রাজ্যে থাকো, তাই ঠিক থাকলেই বা কী আর না থাকলেই বা কী? উইক এন্ড পার্টিগুলোয় যেতে হলে বুঝতে আমার কথা।”

“কেন যাব? অন্যের বউয়ের কোমর ধরে লোকে নাচছে, তা দেখতে?”

“তুমি কি নিজের বউয়ের কোমর ধরে কোনওদিন নেচেছ?”

“তোমার থেকে এই প্রশ্নটা আশা করিনি। যখন করলেই, তখন জিজ্ঞেস করি, তুমি কি সেরকম কোনও আশা নিয়ে আমাকে বিয়ে করেছিলে?”

“না। করিনি।”

“তা হলে হিমালয় পর্বতের সামনে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের ঢেউ দেখতে চাইছ কেন?”

“সবসময় দার্শনিকের মতো বাণী দিয়ো না তো?”

“কী করব, দর্শনই যে আমার বিষয়। আমি তো ট্যাঙ্গো নাচে পিএইচ ডি করিনি।”

অনসূয়া ফুপিয়ে উঠল, “তুমি জানো না, আমাদের নিয়ে আলোচনা হয়? আমাদের আদৌ কোনও সেক্স লাইফ আছে কি না, সেটাই এখানকার অনেকের গবেষণার বিষয়। আমার কানে আসে সব।“

“গসিপটাই এখন গবেষণা নাকি? কিন্তু আমাদের তো উইকএন্ড রিলেশনশিপ। আমি যেমন মেরিল্যান্ডে আসি, তুমিও তো ডারহ্যামে যাও। কই, আমি তো শুনিনি কিছু।”

“একটা ছেলেকে শুনতে হয় না, মেয়েকে হয়। তা ছাড়া কলম্বিয়া কিংবা ডারহ্যামে ক’টা আর বাঙালি, এখানে বাঙালি সংখ্যায় অনেক বেশি।”

“চুলোয় যাক সংখ্যা। স্বামী বিবেকানন্দ যখন আমেরিকা জয় করে ভারতে ফিরে গিয়েছিলেন, তার পরও তৎকালীন মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন বেলুড় মঠকে ‘প্লেজ়ার হাউস’ ছাড়া অন্য কিছুর স্বীকৃতি দিতে চায়নি। বিবেকানন্দের কিছু এসে গিয়েছে তাতে?”

“তুমি বিবেকানন্দ নও। আর শোনো, সম্রাটের দরবার, গৃহস্থের বেডরুম, সন্ন্যাসীর ভজন-কুটির… সন্ন্যাসী হতে পারেনি বলে তোমার বেডরুমটা তো আর মন্দির হয়ে যাবে না।”

“এসব কী বলছ অনসুয়া?”

“কী বলছি জানি না। কিন্তু আমি আর এত কথা নিতে পারি না।” অনসূয়া চুপ করে গেল।

কিন্তু ও যে নিঃশব্দে কাঁদছে, উত্তরণের বুঝতে অসুবিধে হল না।

উত্তরণ ইউনিভার্সিটিতে যাবেন বলে বেরিয়ে গেলেন। তখনকার মতো ব্যাপারটা ধামাচাপা পড়ে গেল। হয়তো তলিয়েই যেত, কিন্তু সপ্তাহখানেকের মধ্যেই মেরিল্যান্ডের একটা কলেজ ক্যাম্পাসে একজন সাইকোপ্যাথ লাইট মেশিনগান চালিয়ে ষোলোটা ছেলেমেয়েকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে খুন করে দিল। হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে যুঝতে থাকল আরও দশ-বারোজন।

তাদের মধ্যে একজন করে যখন মারা যেতে থাকল, শিউরে উঠতে লাগলেন উত্তরণ। খবরের কাগজে পড়লেন, টিভিতে দেখলেন, খুনি নাকি মানসিকভাবে অসুস্থ। আচ্ছা, একটা বাইশ-তেইশ বছরের ছেলের মধ্যে কতখানি অসুস্থতা থাকতে পারে যে, সে এতগুলো লোককে গুলি করে মেরে দেবে?

প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে একা হয়ে যেতে শুরু করলেন উত্তরণ। কিন্তু সেই একা হয়ে যাওয়ার মুহূর্তেও ওঁর মনে হচ্ছিল, বৈরাগ্যের ভিতরে একটা মায়া থাকা চাই। সেই মায়ার স্বাদ দিয়েছিলেন বলেই ব্রহ্মচারী ঠাকুর লক্ষ-লক্ষ ভক্ত-শিষ্যের আশ্রয় হয়ে উঠেছিলেন। মায়া ছাড়া বৈরাগ্য, মাখন ছাড়া পাউরুটির মতোই রুক্ষ।

খরখরে একটা জীবনের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে উত্তরণ অনুভব করছিলেন যে পৃথিবীতে ধর্মনিষ্ঠ কামের প্রয়োজন আছে। মৃত্যুর ওই ঘনঘোর বীভৎসতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে একমাত্র জন্ম। আর প্রাণীর জন্ম তো কামকে বাদ দিয়ে সম্ভব নয়।

অনসূয়া সেদিন অনেক রাত অবধি পড়ছিল। উত্তরণ পিছন থেকে গিয়ে একটা হাত রাখলেন ওর পিঠে। অনসূয়া তাকাল উত্তরণের দিকে। নিজের বরের চোখে এমন কিছু দেখল, যার পরে আর কোনও সংশয় থাকে না। আর থাকে না বলেই অনসূয়া উত্তরণের বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করল নিশ্চিন্তে। উত্তরণ জড়িয়ে ধরলেন অনসূয়াকে। জোরে।

তারপর একটা অন্তহীন স্ফুলিঙ্গে বারুদ হয়ে নিজেকে মিশিয়ে দিতে-দিতেও উত্তরণের মাথার ভিতর বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া অসংখ্য মৃতদেহ ভেসে উঠল। উত্তরণ প্রাণপণ চেষ্টায় দৃশ্যটাকে সরিয়ে দিতে চাইলেন।

বাইরের আকাশে ধ্রুবতারাটা তখন জ্বলজ্বল করছে। অনেক মৃত্যুর মধ্যে একটা জীবনের মতো।

২১

হাতে মেহেন্দি করা থাকলে যেমন হাতের আসল রং বোঝা যায় না, সংসারের মধ্যে ডুবে থাকলেও তেমন বড়-বড় চিন্তা কোথায় তলিয়ে যায় নিত্যি ডামাডোলের চাপে। সেই চাপমুক্তির রাস্তা হিসেবে যখন শরীর সামনে এসে দাঁড়ায়, উত্তরণের মতো মানুষের বিস্ময়ের অন্ত থাকে না। যে শরীরকে চিরকাল এড়িয়ে এসেছেন, যার উল্লেখেও অস্বস্তি বোধ করেছেন, সেই শরীর যে আদতে সেতু হয়ে দুটো মানুষকে একটা অচ্ছেদ্য বন্ধনে বেঁধে ফেলতে পারে, সেটাই, প্রায় প্রতিদিন আবিষ্কার করছিলেন আর উত্তরোত্তর অবাক হচ্ছিলেন, উত্তরণ।

অনসূয়া যখন ওঁর কাছে এসে গায়ে হাত রাখত, আলতো করে কামড়ে ধরত গাল, চুমু খেত গলায়, উত্তরণ বইয়ের পৃথিবী থেকে সরে এসে অনসূয়ার সঙ্গে এমন একটা পৃথিবী তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে উঠতেন, সভ্যতার আদিকাল থেকে যে পৃথিবী, কোনও সঙ্গী বা সঙ্গিনী ছাড়া মানুষ একা তৈরি করতে পারেনি। তার জন্য একটা অপরাধবোধ যে মাঝে-মাঝে জেগে উঠত না তা নয়, কিন্তু যৌনতা তো একটা অ্যাডভেঞ্চারও বটে! অ্যাডভেঞ্চারের সামনে কোনও অপরাধবোধ টিকতে পারে?

একদিন রাত্রে ভালবাসাবাসির পর অনসূয়া বলল, “আমি তোমার মধ্যেই ঈশ্বরকে দেখেছি বলে কিনা জানি না, আমি চাই তোমার প্রচুর খ্যাতি হোক। ইন ফ্যাক্ট একটা ক্রেজ় দেখতে চাই তোমায় ঘিরে। অনেক-অনেক মেয়েরা ছুটছে তোমার অটোগ্রাফ নিতে…”

“মানে?”

“মানে, কোনও খেলোয়াড় বা আর্টিস্টের পিছনে যেমন ছোটে।”

“কিন্তু আমি তো এই দুটোর কোনওটাই নই। সবার কথা বাদ দাও, দু’-তিনজন আমার পিছনে দৌড়তে শুরু করলেও ঘাবড়ে যাব আমি।”

“আমার কিন্তু ভাল লাগবে, জানো! সেই যে এক বিখ্যাত শিল্পী বলেছিলেন, “নতুন মেয়েরা নতুন সংগীত সৃষ্টির অনুপ্রেরণা নিয়ে আসে আমার কাছে… নতুন-নতুন সম্পর্ক নতুন সুরের জন্ম দেয় আমার মধ্যে।” তুমিও হয়তো নতুন শীর্ষ ছোঁয়ার উদ্দীপনা পেতে সদ্যযুবতী মেয়েদের সান্নিধ্যে এলে… অবশ্য তাতে শেষমেশ আমারই কপাল পুড়ত।” অনসূয়া হেসে ফেলল।

অনসূয়া ঘুমিয়ে পড়ার পরও কথাটা জেগে রইল উত্তরণের মধ্যে। শেষে সুন্দরী মেয়েরা ওঁর সাফল্যের কারণ হবে? কোন সাফল্য? তিনি তো জানতেন যে সাফল্য মানে রাতের পর রাত জপে পার করে দেওয়া। ‘গু’ শব্দের অর্থ অন্ধকার আর ‘রু’ শব্দের অর্থ বিনাশ। গুরু তিনিই, যিনি অন্ধকার বিনাশ করে শিষ্যকে আত্মশুদ্ধির দিকে এগিয়ে দেন। সেই গুরুর চরণ-বন্দনা করে শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা পার করে দেওয়াই জীবন।

কিন্তু জীবনই তো ওঁকে পূর্বনির্দিষ্ট ধারণা থেকে সরিয়ে নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন করেছে। কীভাবে অস্বীকার করবেন তাকে? সন্ন্যাসী নিজের আগের জীবনকে পুড়িয়ে দিয়ে সন্ন্যাসাশ্রমে ঢোকে, উত্তরণের ক্ষেত্রে সন্ন্যাসটাই পূর্বাশ্রম।

নাকি ভুল ভাবছেন? সন্ন্যাস তো উত্তরণ পাননি। ত্রিকালজ্ঞ গুরু নিশ্চয়ই জানতেন উত্তরণের জীবন কোন রাস্তা নেবে, তাই তিনি সন্ন্যাস নিতে দেননি ওঁকে। এবার যে গার্হস্থ্যে প্রবেশ করেছেন, তাতেই মনোনিবেশ করবেন না কেন? সন্ন্যাসী হতে গিয়ে হেরেছেন। সংসারী হতে গিয়েও হারবেন?

তার থেকে অ্যাকাডেমিকসের রাজনীতি বুঝে এগোবেন, কোন জার্নালে লেখা পাঠাবেন আর কোথায় নয়, কোন সেমিনারে যাবেন আর কোনটায় যাবেন না, সেই সিদ্ধান্তগুলো আরও নিখুঁতভাবে নেওয়ার চেষ্টা করবেন। সাঁতার কাটতে-কাটতে যেমন মাটিতে হাঁটা যায় না, সন্ন্যাসী হয়েও সংসার করা যায় না। মূর্তি গড়তে গেলে হাতে কাদা মাখতেই হবে।

কাদা-ই বা ভাবছেন কেন? এই পুঁজিবাদী দেশটা মানুষকে শিক্ষায়-স্বাস্থ্যে যতটা সুবিধা দেয়, ক’টা সমাজতান্ত্রিক দেশ তা দিতে পারে? নতুন করে ভাবতে শুরু করলেন উত্তরণ। যে পুঁজির বিরুদ্ধে এত চেঁচামেচি হল, সেই পুঁজি নিজেকে মস্ত সব কারখানা থেকে সরিয়ে পরিষেবায় স্থানান্তরিত করতে শুরু করে দিয়েছে। আর সঙ্গে-সঙ্গে মিইয়ে যাচ্ছে বিক্ষোভ। কারখানার শ্রমিকরা স্ট্রাইক করতে পারে, কিন্তু হোটেলের ওয়েটার বা হাসপাতালের নার্স শোষিত হলেও ধর্মঘটের রাস্তায় যেতে পারে না সচরাচর। সমাজ ততটা স্পেস দেয় না তাদের।

উত্তরণ নিজের ক্লাস-থিসিস-লেকচারের মধ্যে ওই স্পেস-এর কথা ভাবতেন। সন্ন্যাসীর আসনটুকু হলেই চলে, কিন্তু সংসারীকে যে নিজের সন্তানের ব্যবস্থা করতেই হয়। অনসূয়া কনসিভ করার পর থেকে ওর শরীরের পরিবর্তনগুলো যত প্রকট হচ্ছিল, আগামীর চিন্তা তত বাড়ছিল উত্তরণের।

হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত কাওয়াই বলে একটা জায়গায় বেড়াতে গিয়েছিলেন উত্তরণ অনসূয়ার সঙ্গে। সেই দ্বীপে অজস্র নারকেলগাছের ভিতর দিয়ে সমুদ্রের দিকে হেঁটে গেলে দেখা যেত একটা লাইটহাউস। তার দিকে তাকিয়ে উত্তরণ প্রার্থনা করতেন, ওঁর আর অনসূয়ার জীবনের চলার পথটা যেন ব্রহ্মচারী ঠাকুর আলোকিত করে রাখেন, যতদূর দেখা যায় ততদূর অবধি।

অনসূয়ার যখন অ্যাডভান্সড স্টেজ, তখন একদিন উত্তরণ জিজ্ঞেস করলেন, “জ্ঞান যদি আপেক্ষিক হয়, মানুষ তার ‘পরম’-এর উপলব্ধি করবে কী করে?”

অনসূয়া উত্তরণকে অবাক করে দিয়ে বলল, “দরকার নেই উপলব্ধির। ‘পরম’-এর সাহায্যে তো জীবন চলে না। প্রতিটা মুহূর্তই যখন ‘চরম’ পরিস্থিতির সামনে এনে দাঁড় করায়, সেটার মোকাবিলা করাই জরুরি।”

‘সবসময় মোকাবিলার মোডে থাকলে আমরা কেবল শরীর হয়েই বেঁচে থাকব। সেটা কি বাঁচা?”

“কে বলল বাঁচা নয়? ওভাবেই তো বাঁচে মানুষ। রক্তে, মাংসে, চেষ্টায়, চরিত্রে। এক-একটা এক্সপেরিমেন্টে অংশগ্রহণ করে। আমরা শুধু পর্যবেক্ষক হতে পারি না, পরীক্ষায় ভাগও নিতে হয়। আর সেই প্রক্রিয়াটা আমাদের এমনভাবে পালটাতে থাকে যে অন্যদের পর্যবেক্ষণের বস্তু হয়ে উঠি আমরা।”

অনসূয়ার বোধের বিস্তৃতি ছুঁয়ে গেল উত্তরণকে। ওর চুলগুলো কপাল থেকে সরিয়ে দিতে-দিতে বললেন, “ঠিকই বলেছ। পর্যবেক্ষক থেকে পরীক্ষার্থীতে উত্তীর্ণ হওয়াটাই জীবনের ধর্ম।”

পরদিন ভোরেই ব্যথা শুরু হল অনসূয়ার। নাইন-ওয়ান-ওয়ান এদেশের ব্ৰহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর, যে কোনও বিপদে ডাকলেই হাজির, কিন্তু উত্তরণ মনস্থির করলেন, নিজেই গাড়ি চালিয়ে অনসূয়াকে নিয়ে যাবেন হাসপাতালে।

এখানে সন্তানের জন্মের সময় বাবার উপস্থিতি ভীষণভাবে কাম্য। বাবা-ও যাতে সন্তানের জন্মের মুহূর্তের সঙ্গে একাত্ম বোধ করতে পারে, সেটা নিশ্চিত করতে, ‘ড্যাডি’স স্ক্রাবস’ বলে বিশেষ একরকম পোশাক বানিয়েছে এরা। অনসূয়া যখন লেবারে, সেই পোশাক গায়ে দিয়ে উত্তরণ ভাবছিলেন পৃথিবীর সেই প্রাচীন দার্শনিকের কথা, যিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, পৃথিবীর সব জিনিস যেরকম, তা আসলে সেরকম কী কারণে? তিনি সারা পৃথিবীর সূত্র হিসেবে জলকে নির্বাচন করেছিলেন। কেন নির্বাচন করেছিলেন? জলের মধ্যে গর্ভস্থ সন্তানের বাস, তাই?

তারপর অন্য একজন দার্শনিক এলেন। তিনি সবকিছু বিচার করে বললেন, জল নয়, বাতাসই পৃথিবীর সবকিছুর সূত্র। এই জল আর বাতাসের মধ্যে সম্পর্ক ঠিক করতে-করতেই দর্শনের কতদিন চলে গেল। গেল, কারণ দর্শন তো কেবল ঈশ্বর আছেন না নেই, ঈশ্বর খাচ্ছেন না ঘুমোচ্ছেন, তার রূপরেখা নয়! দর্শন ধর্মের বিকল্প হয়ে উঠতে চায়নি। বরং ধর্ম আর কিংবদন্তিকে বিজ্ঞানের আলোয় বিশ্লেষণ করার নামই হয়তো দর্শন।

উত্তরণের মনে পড়ছিল সক্রেটিসের আগে জন্মানো গ্রিক দার্শনিক পারমেনিডিস-এর কথা। তিনি চেয়েছিলেন এমন একটা যুক্তির ধারা তৈরি করতে, যেটা ইন্ডিপেন্ডেন্ট অফ অবজারভেশন, যেখানে দেখার দ্বারা বিচার করতে হয় না সবকিছুর। কিন্তু বিশ্বজুড়ে মানুষ যা দেখছে, তার দ্বারাই চালিত হচ্ছে। ওই যে এক রূপসী হেঁটে যাচ্ছে, ব্যস তার পিছনে ছুটল দশজন। ওই যে এক দম্পতি হাত ধরাধরি করে রাস্তা পেরোচ্ছে, সবাই ধরে নিল, তারা ভীষণই সুখী। যা দেখছি তা যে ঠিক না-ও হতে পারে, ‘বেশ’-এর বদলে, ‘ছদ্মবেশ’ হতে পারে, কার সময় আছে তা নিয়ে ভাবার?

উত্তরণের ডাক এল যখন, ভাবনায় বাধা পড়ল। এদেশে যেহেতু কেউ লিঙ্গের ভিত্তিতে গর্ভপাত করায় না, তাই এখানে ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ কোনও অপরাধ নয়। উত্তরণ আর অনসূয়া জানতেন যে একটি কন্যার বাবা-মা হতে চলেছেন। সেই মেয়ের একটি নাম ঠিক করেও অনসূয়াকে জানিয়েছিলেন উত্তরণ।

স্বাভাবিকভাবেই চলছিল সব, কিন্তু মেয়ের জন্ম-মুহূর্তে যখন উত্তরণ নিজেও জন্মাচ্ছেন বাবা হিসেবে, চারপাশটা ঝাপসা হয়ে আসছিল। এরা সহজে সিজ়ার করতে চায় না, কিন্তু অনসূয়ার ক্ষেত্রে যখন লেবার পেন ওঠা সত্ত্বেও কিছু জটিলতার কারণে করতেই হল, উত্তরণ কেবিনে থেকেই দেখলেন পুরো প্রক্রিয়াটা। অনসূয়ার ভিতর থেকে রক্ত-মাংসের পুঁটুলিটা যখন এই পৃথিবীর অংশ হয়ে উঠল, উত্তরণের পা কেঁপে গেল সামান্য।

কিন্তু শুধু পা নয়, সারা পৃথিবী কাঁপতে শুরু করল যখন পরদিন হাসপাতালে যেতেই দু’জন ডাক্তার ওঁকে জানালেন যে খুব সম্ভব কনজেনিটাল আজেনেসিস অফ ভোকাল কর্ড নিয়ে জন্মেছে ওঁর মেয়ে। আর সেই কারণে সে কথা বলতে পারবে না ঠিকঠাক।

“কিন্তু আমি যে ওর কান্নার শব্দ…”

উত্তরণকে থামিয়ে দিয়ে একজন ডাক্তার বললেন, “অস্পষ্ট কিছু শব্দ আপনার বেবি সারাক্ষণই উচ্চারণ করতে পারবে, কিন্তু তার বেশি আশা না করাই ভাল।”

“আজীবনই কি আমার মেয়ের এই অবস্থা থাকবে?”

“আগামী দিনে কী হবে, এখনই বলা যায় না। কিন্তু আজকে দাঁড়িয়ে বিরাট পজ়িটিভ কোনও আশ্বাস দিতে পারছি না।” লম্বা ডাক্তারবাবু বলে উঠলেন।

উত্তরণের চারপাশের পৃথিবী তখন গুটিয়ে ছোট হয়ে আসতে শুরু করেছে। যে মেয়ের নাম রাখবেন ভেবেছেন ‘মন্ত্র’, সেই মেয়ে আদৌ কিছু উচ্চারণ করতেই পারবে না? কীভাবে কথাটা বলবেন অনসূয়াকে?

ঘোর ভেঙে গেলেও আর-একটা ঘোরেই ঢুকে পড়ে মানুষ। উত্তরণ সেই ঘোরের ভিতর থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন, “বোবা? আমার মেয়ে বোবা হয়ে জন্মেছে?”

২২

অনেক বছর কেটে যাওয়ার পর একটা ঘটনার দিকে যখন ফিরে তাকানো যায়, তখন তার অভিঘাত আপনিই মোলায়েম হয়ে আসে। উত্তরণ ভাবছিলেন, হাসপাতাল থেকে মন্ত্রকে আর অনসূয়াকে বাড়িতে নিয়ে আসার কথা। সবকিছু সুন্দর, তবু সবটার গায়েই যেন একটা স্লানচ্ছায়া লেগে আছে। ভোকাল কর্ড অগঠিত থাকলে এমনটা নাকি হয়! অপারেশন করে খুব যে কিছু লাভ হবে তা নয়, তবু একটা চেষ্টা করা যেতে পারে। কিন্তু সে এখন নয়, পরে। কত পরে? প্রতিটা দিন যখন মানুষের নিজেকে ব্যর্থ মনে হতে থাকে, তখন সে কতটা অপেক্ষা করতে পারে অনাগত কোনও তারিখের জন্য? সব ঠিক হয়ে যাওয়ার ক্ষীণ আশায়?

“সবার তো নর্মাল বাচ্চা হয়, আমাদের বাচ্চা এরকম হল কেন?” অনসূয়া মন্ত্রকে কোল থেকে নামিয়ে বলে উঠল একদিন।

“ওর ভোকাল কর্ড ঠিকমতো তৈরি হয়নি কোনও কারণে…”

“তুমি চুপ করো তো, কর্ড-ফর্ডের গল্প শুনিয়ো না। আমাদের মেয়ে বোবা! ওই ল্যারিংক্স আর ফ্যারিংক্স দিয়ে কখন কী উচ্চারণ করবে, তার ভরসায় ওকে সুস্থ, স্বাভাবিক বলে মানাটা চরম ভণ্ডামি। আমার কথা হচ্ছে, আমাদের বংশে তো কেউ বোবা নেই… যতদূর জানি, তোমাদের বংশেও না। তা হলে বেছে-বেছে আমাদের মেয়েটাই এরকম হয়ে জন্মাল কেন?” অনসূয়া কীরকম তীব্র গলায় জানতে চাইল।

অনসূয়ার মনে নিজের মেয়ে সম্বন্ধেই একটা অনীহা জন্ম নিয়েছে, উত্তরণের মনে হল। ও মন্ত্রকে ব্রেস্টফিড করায় তো ঠিকমতো? নাকি বাচ্চার যা প্রাথমিক অধিকার, তার থেকেই ওঁর মেয়ে বঞ্চিত? |

মেয়েকে দেখবেন বলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজ সেরে বাড়ি ফিরে আসতেন উত্তরণ। অনুভব করতেন যে সন্তানের জন্মের পর বাবা-মায়ের জীবন সন্তানের চাহিদা মতো চলে। বাচ্চা ঘুমোলে তারা ঘুমোত পারে, বাচ্চা জাগলেই আবার উঠে পড়তে হয়।

মন্ত্রর দেখভালে কোথাও যে কোনও ত্রুটি রাখত অনসূয়া, তা নয়। এমনকী উত্তরণ খুব কিছু সাহায্য করুন, তাও চাইত না। কিন্তু ভিতরে-ভিতরে একটা যন্ত্রণা লালন করত অহরহ। সেটাই বাস্ট করল সেদিন।

“তুমি চাওনি বলেই এমন হল।”

“আমি কী চাইনি?” অনসূয়ার কথা বুঝতে না পেরে উত্তরণ জিজ্ঞেস করলেন।

“সন্তান, সংসার কিছুই চাওনি। চেয়েছিলে সন্ন্যাসী হতে। কিন্তু পারোনি। সেই না-পারার দীর্ঘশ্বাস আমার সব ধ্বংস করে দিল।”

“কেন আবোল তাবোল বকছ?”

“আবোল তাবোল? তুমি কয়েকদিন আগে ডায়েরিতে লেখোনি এগুলো? এই যে, আমি পাতাটা ছিঁড়ে রেখেছি। তোমায় শোনাচ্ছি, শোনো।”

“তুমি আমার ব্যক্তিগত ডায়েরির পাতা…”।

“স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আবার ‘ব্যক্তিগত’ কী? আমি পড়ছি তোমার লেখা, মন দিয়ে শোনো… “ঠাকুর চাননি আমি সংসারে প্রবেশ করি। চাননি কোনও মহিলার সঙ্গে আমার সংযোগ হোক। ঠাকুর তাঁর মন্ত্রকে আমার মধ্যে দিয়ে প্রচার করতে চেয়েছিলেন। আমি ঠাকুরের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি। তার শাস্তি তিনি আমায় দিলেন। কিন্তু আমার সন্তান শাস্তি পেল কেন? তবে কি আমার সন্তানের মধ্যে দিয়েই আমি প্রতি মুহূর্তে অনুভব করব যে আমি নিজে সন্তান হয়ে কোন যন্ত্রণা দিয়েছি ঠাকুরকে? বাবা না হলে আমি বুঝতাম, বাবার কষ্ট কতটা! তাই কি আমায় বাবা করলেন ঠাকুর? আচ্ছা, বাসে সেই বোবা মেয়েটির পাশে বসিয়ে ঠাকুর কি আমায় একটা ইঙ্গিত দিতে চেয়েছিলেন যে আমি বিয়ে করলেও ওরকম সন্তানের বাবা হতে পারি?

উফ, আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না! বুকটা গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। বাবা হয়েও সন্তানের মুখ থেকে, ‘বাবা’ ডাক শুনতে না পাওয়ার এই ব্যথা…”

“এগুলো আমার মনে উড়ে বেড়ানো কতগুলো কথা। রানডম থটস, তার বেশি কিছু নয় অনসূয়া।”

“না, এগুলোই তুমি। তুমি বিশ্বাস করো যে আমার সঙ্গে জড়িয়েছ বলেই, বিকলাঙ্গ বাচ্চা জন্মেছে তোমার।”

“বিকলাঙ্গ কেন হবে? ও শুধু কথা বলতে পারে না!”

“সেটাই তো সবথেকে বড় পঙ্গুত্ব। তুমি সারা দুনিয়ায় মন্ত্র প্রচার করে ইন্টারন্যাশনাল গুরু হবে ভেবেছিলে… তা না পেরে সেই মন্ত্রের ভার আমার উপর চাপাতে চেয়েছিলে। আমি একটা সাধারণ কামনা-বাসনার মানুষ, আমি সেই ভার বইতে পারব কেন? পারিনি। বোবা বাচ্চার জন্ম দিয়েছি।”

“এসব বোলো না। আমি গুরুর শিষ্য হতে চেয়েছিলাম। গুরু নয়।”

“চেয়েছ, চেয়েছ। অবচেতনে চেয়েছ। আর মনে-মনে আমিও তোমাকে গুরুই ঠাওরেছি। তোমারই দীক্ষা নিতে চেয়েছি, নিয়েওছি মনে-মনে। কখনও তোমাকে বলিনি যে আমাকে ব্রহ্মচারী ঠাকুরের দীক্ষা পাওয়ার ব্যবস্থা করে দাও। তুমিও সেদিকে এগিয়ে দাওনি আমায়। কেন? কত স্বামী-স্ত্রী তো একই গুরুর দীক্ষা নেয়। আমার নিজের পিসেমশাই পিসিকে বিয়ের পরপরই দীক্ষা নেওয়াতে নিয়ে গিয়েছিল। তুমি আমায় নিয়ে যাওনি কেন? আজ আমারও দীক্ষা নেওয়া থাকলে হয়তো এই সর্বনাশ হত না আমাদের…”

“আমি বিশ্বাস করি যে দীক্ষা যদি কারওর পাওয়ার থাকে, তা হলে ঠাকুর নিজেই তাকে ডেকে নেবেন। আমাকে যেমন নিয়েছিলেন। রেফারেন্সে দীক্ষা হয় না। তোমার মনে যদি ঠাকুরের জন্য আকুলতা আসে, তবে ঠাকুর নিশ্চয়ই তোমায় দূরে রাখবেন না।”

“তোমার মনে তো এত আকুলতা ঠাকুরের জন্য! তোমার আশ্রমে ঢাকাই বন্ধ হয়ে গেল কেন?”

“কেউ আমার ঢোকা বন্ধ করেনি। হয়তো আমি কোনও কারণে সংকোচ বোধ করেছি, কিন্তু তাই বলে…”

“কথা ঘুরিয়ো না। তুমি নিজে আশ্রমে যাওয়ার জোর পাও না আর। এবং আমি যে গিয়েছি, মহারাজের সঙ্গে কথা বলেছি, তাতে তুমি খুব খুশি হওনি। মনে-মনে আমায় নিজের ক্রীতদাসী করেই রাখতে চেয়েছ কেবল…”

“উফ, অনসূয়া চুপ করো! এগুলো বলে নিজের পাপ বাড়িয়ো না।”

“পাপ তো করেছি তোমায় ভালবেসে। বাবার যে মত ছিল তা নয়, থাকলে পরে তো কলকাতায় বড় করে রিসেপশন পার্টি দিতেন একমাত্র মেয়ের বিয়ের, কই দেননি তো! বন্ধুরা বারণ করেছিল, কিন্তু আমি অন্ধ ছিলাম তোমার প্রেমে, তাই শুনিনি। সেই না-শোনার শাস্তি পাচ্ছি। সারা জীবন ধরে পেতে হবে, জানি। কারণ তুমি তো কোনওদিন আমায় ভালবেসে আমার কাছে আসোনি। যখন সেক্স চাগাড় দিয়েছে তোমার ভিতরে, তখনও ভেবেছ যে ঠাকুর যখন তোমার বিয়ে করায় রাগ করেননি, এতেও নিশ্চয়ই করবেন না। মনে-মনে একটা কাল্পনিক অনুমতি পেলে আমার দিকে এগিয়েছ, না পেলে এগোওনি। কখনও ভেবেছ যে আমিও একটা মানুষ, আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছা তোমার ভক্তির রিমোটচালিত হতে পারে না চিরকাল?” অনসূয়া চিৎকার করে উঠল।

যেভাবে যন্ত্রে একটা পশুর শরীর টুকরো-টুকরো হয়, অনসূয়ার কথার অভিঘাতে সেভাবেই টুকরো-টুকরো হচ্ছিলেন উত্তরণ। অনসূয়ার বাবা চাননি? অনসূয়ার বন্ধুরা বারণ করেছিল ওকে উত্তরণের কাছে আসতে? কারা বন্ধু ছিল অনসূয়ার? ও তো উত্তরণের মতোই একা ছিল।

তিন বছরের মাথায় মন্ত্রর গলার আওয়াজ ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় একটা অপারেশন হল। কিন্তু ডাক্তাররা যা বলেছিলেন, বাস্তবেও তেমনটাই হল। মানে, লাভ হল না তেমন কিছু।

তারপর যতদিন যেতে লাগল, অনসূয়ার হতাশা বাড়তে লাগল। আর হতাশা বাড়লেই তা ক্রোধের চেহারা নেয়। সেই ক্রোধ সংসারের খুঁটিনাটি সবকিছুতে আছড়ে পড়তে লাগল। উত্তরণের বাড়িতে ফিরতে ভয় করত। আবার না ফিরলেও দায়িত্ব এড়াচ্ছেন, সেই গঞ্জনা শোনার আতঙ্ক তো ছিলই।

“পোস্ট-ডক্টরাল ফেলোশিপ তো পাঁচ বছরের বেশি দেবে না কোনও অবস্থাতেই। তুমি কোথায়-কোথায় অ্যাপ্লাই করবে ভাবছ?”

“ওকলাহোমা, নেব্রাসকা, কিংবা সিয়াটল, সান হোসে… কোথায় গেলে তোমার থেকে সবচেয়ে দূরে যাওয়া যায় বলো, সেখানেই অ্যাপ্লাই করব। তুমিও তো তা-ই চাও। চাও না?” অনসূয়া বলে উঠল।

“চাইলে তো আমি নিজেই চলে যেতাম। অন্য যে কোনও জায়গায়।”

“হ্যাঁ, আমি তো ভুলেই যাই, কত বড় পণ্ডিতের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে আমার। পৃথিবীর সব বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা তার জন্য খোলা, কিন্তু সে শুধু আমায় দয়া করে এই মেরিল্যান্ডে পচে মরছে। তুমি চলে যাও, আইভি লিগ তোমায় ডাকছে, যাও। আমাকে নিয়ে, মেয়েকে নিয়ে ভেবো না। কেন ভাববে, সংসার তো তোমার জন্য নয়?”

“একশোবার আমার জন্য। আমি সংসার করব। সংসারই করব।” বলতে-বলতে অনসূয়ার দিকে এগিয়ে গেলেন উত্তরণ। ওকে জাপটে ধরে নিয়ে যেতে লাগলেন বিছানার দিকে। অনসূয়া নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল। কিন্তু জীবনে প্রথমবার যে বলপ্রয়োগ করে, তার জোর কিছু বেশিই হয় সম্ভবত। তাই জিত উত্তরণেরই হচ্ছিল।

“কী চাও? সব ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর আবার কী চাও?” উত্তরণের কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে-করতে জিজ্ঞেস করল অনসূয়া।

“নতুন করে বাঁচতে চাই।” চুমুর পর চুমুতে অনসূয়ার প্রায় দমবন্ধ করে দিলেন উত্তরণ।

“বাঁচাতে চাও, না?” শ্বাস নেওয়ার জন্য নিজের মুখটা উত্তরণের থেকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য সরিয়ে অনসূয়া জিজ্ঞেস করল।

তখনই কর্কশভাবে বেজে উঠল বাড়ির ল্যান্ডলাইনটা। বাজতেই থাকল।

২৩

বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে দেশে ফিরতে চাইবে না কোন মেয়ে? অনসূয়া তবু প্রথমটা ইতস্তত করছিল, মন্ত্রকে ছেড়ে যেতে। কিন্তু উত্তরণই ওর টিকিটের ব্যবস্থা করে দিলেন। নিজেও সঙ্গে যেতে চেয়েছিলেন, মন্ত্রকে নিয়ে। কিন্তু অনসূয়া চাইল না। কথা বলতে না-পারা মেয়েকে নিয়ে আত্মীয়স্বজনের সামনে দাঁড়াতে অনসূয়ার অসুবিধে আছে, উত্তরণ বুঝতে পারলেন। জোর করলেন না তাই।

“তুমি পারবে তো, এই কয়েকটা দিন ম্যানেজ করতে?” এয়ারপোর্টে ঢোকার আগে জিজ্ঞেস করল অনসূয়া।

“তুমি নিশ্চিন্তে যাও, আমাদের নিয়ে কোনও দুশ্চিন্তা কোরো না।” উত্তরণ জবাব দিলেন।

দেশে ফেরার আগে চার দিনের কাজ উত্তরণ নিজেই করাতে চেয়েছিলেন অনসূয়াকে। কিন্তু অনসূয়া স্থানীয় একটি রাধাকৃষ্ণ মন্দিরে গিয়ে বাবার পারলৌকিক কাজ সেরে এল।

“আমি করালেও শাস্ত্র মেনেই করাতাম।” উত্তরণ বলেছিলেন।

“জানি। কিন্তু শ্বশুরের কাজ জামাই করাচ্ছে, ঠিক দেখায় না সেটা।” অনসূয়া জবাব দিয়েছিল।

“কোনটা ঠিক দেখায় আর কোনটা নয়, কোনটা সাংসারিক আর কোনটা নয়, সেই বোধ আমার কবেই বা ছিল?” উত্তরণ বিড়বিড় করে বললেন উত্তরে।

অনসূয়া শুনতেও পেল না।

মন্ত্রর প্রতিটা আওয়াজ যতই অস্ফূট হোক, শুনতে পেতেন উত্তরণ। হপ্তাদুয়েক ছুটি নিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, প্রায় সারাক্ষণ নিজের মেয়ের সঙ্গেই কাটাতেন। সন্তান এবং পিতার মধ্যে যে মায়ানদী বয়ে চলে, তাতে ডুবতে-ডুবতে নতুন এক তটে ভেসে উঠতেন, যার নাম বন্ধন।

“মায়াই অচ্ছেদ্য। বাকি সব ছেদন করা যায়। এই মায়া থেকেই মহামায়ার উৎপত্তি৷” অনিলদা বলতেন।

মেয়েকে নিজের কোলে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে-পড়তে উত্তরণ ভাবতেন, যে সংসারে সবকিছুই নশ্বর, সেখানে একমাত্র মায়াই অনশ্বর?

অনসূয়ার ফেরার টিকিট ছিল গিয়ে পৌঁছনোর পনেরো দিনের মাথায়। কিন্তু সেই টিকিট দু’বার পিছোনোর পরে শেষে ক্যানসেল হয়ে গেল। উত্তরণ কয়েকবার ফোন করে একই কথা শুনলেন। বাবার টাকাপয়সা এবং সম্পত্তির বিলি-ব্যবস্থা করে আসতে হবে। অনসূয়ার দাদাও নাকি তা-ই চাইছে।

“থাকার মধ্যে তো উত্তর কলকাতার একটা বাড়ি। সেটা বিক্রি করতে হবেই বা কেন?”

“রেখেই বা কী হবে? কে দেখাশোনা করবে?”

“একটা কেয়ারটেকার রেখে দিলেই হয়।”

“কীরকম কেয়ারটেকার? আমি যেমন তোমার ছিলাম?” অনসূয়া অচেনা মানুষের মতো হেসে উঠল ফোনের ওপ্রান্তে।

অবাক হয়ে গেলেন উত্তরণ। আরও অবাক হলেন যখন অচেনা একটা আইডি থেকে নিজের মেল-এ কতগুলো ছবি পেলেন। সঙ্গে একটা দু’লাইনের চিঠি। প্রায় এক মাস মন্ত্রকে একা দেখভাল করার সময় উত্তরণ প্রতিদিন ভাবতেন, কালই হয়তো অনসূয়া ফিরে আসবে। কিন্তু ছবিগুলো বারবার দেখতে-দেখতে কেমন একটা শীত এসে ঘিরে ধরল ওঁকে। তবে কি সেতুর একটা দিক ভেঙেই গিয়েছে? নদী এখন পারাপারহীন?

ঘুমন্ত মেয়েকে চুমু দিয়ে উত্তরণ রাতেই বেরোলেন গাড়ি নিয়ে। একঘণ্টা, অনর্থক ড্রাইভ করে ফিরে এলেন। আবার অনর্থক নয়ও। ওই তীব্র গতি কিছুক্ষণের জন্য হলেও ওঁকে মুক্তি দিল। মাথার ভিতর যে বকরাক্ষসটা যাপিত জীবনের প্রতিটা দিন, প্রত্যেকটি স্মৃতি চিবিয়ে খাচ্ছে, তার থেকে মুক্তি।

“তুমি জেনে যখন গিয়েছ, আমায় জানাওনি কেন?” অনসূয়া স্বাভাবিক গলায় বলল।

“কী জানাব? অভিনন্দন? তুমি এক্সট্রা-ম্যারিটাল করছ বলে?” উত্তরণ চিৎকার করে উঠলেন।

“গলা নামিয়ে কথা বলে। আর কথা বলার আগে, নিজেকে জিজ্ঞেস করো, বিয়ে বলে আদৌ কিছু হয়েছিল আমাদের?”

“তা হলে এতদিন কী করছিলাম আমরা, সার্কাস?”

“এগজ়্যাক্টলি! তুমি সেই সার্কাসের মালিক আর আমি সেখানে বাঘের মুখে মাথা ঢোকানোর খেলাটা দেখাই। সরি, দেখিয়েছি। কিন্তু আর নয়।”

“এগুলো কী বলছ অনসূয়া?”

“যা তুমি শুনছ। কলকাতা থেকে দু’দিনের জন্য মুম্বই এসে রঞ্জিতের সঙ্গে দেখা না হলে আমি আবার হয়তো তোমার মৃত্যুপুরীতে ফিরে যেতাম। কিন্তু ওই দু’দিনে আমি জেনেছি স্বর্গসুখ কাকে বলে। তা পিএইচ ডি করার মধ্যে নেই, পোস্ট-ডক’এ নেই, আছে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পাওভাজি খাওয়ার মধ্যে। বান্দ্রার সি-বিচে যে দোকানগুলো আছে, সেখানে একটা অদ্ভুত শরবত পাওয়া যায় জানো, ‘কালাখোট্টা’ না ‘কালাঘোড়া’ কী যেন একটা নাম। রঞ্জিত বলতে পারবে। শরবতটা খেলে এমন ফুর্তি জাগে, মনে হয় যেন নেশা করেছি। তুমি জীবনে নেশা করেছ?”

“তুমি কি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছ অনসূয়া? তোমার একটা সংসার আছে।”

“কার সঙ্গে সংসার? যে সারা জীবন মনে-মনে গেরুয়া কাপড় পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তার সঙ্গে?”

“একটা মেয়ে আছে তোমার।”

“আমি ওকে তোমায় দিয়ে দিলাম। নিঃশর্ত দান করলাম। তুমি ওকে যেভাবে খুশি মানুষ করো। আর মানুষ না করতে পারলে অনাথ আশ্রমে দান করে দাও।”

“শাট আপ, জাস্ট শাট আপ।”

“ইউ শাট আপ। রঞ্জিত বালকৃষ্ণন কবিতা লেখে। হি ইজ় ওয়ান অফ দ্য লিডিং ইন্ডিয়ান ইংলিশ পোয়েটস অফ আওয়ার টাইম। ওর একটা কবিতা আছে… ‘যে ফসল নষ্ট হয়ে জন্মেছে, তাকে অস্বীকার করে এগিয়ে যাও নতুন শস্যক্ষেত্রের দিকে।’ আমি নতুন পৃথিবীর দিকে এগিয়ে গিয়েছি। তাই তোমাকে আর তুমি রিলেটেড যা কিছু আছে আমার জীবনে, সবটা ডিসওন করতে চাই।”

“নিশির ডাকে সাড়া দিয়ে মানুষ যেমন অন্ধকারে বেরিয়ে পড়ে, তুমি সেরকম বেরিয়ে পড়েছু অনসূয়া। একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবো। আমার আর তোমার কত বছরের সম্পর্ক।”

“সম্পর্ক? আমি তোমার পায়ে-পায়ে ঘুরতাম। এটাই ছিল সেই সম্পর্কের মূল কথা। আর হলই বা সেই ব্যর্থ যোগাযোগ অনেক বছরের। তুমিই বলতে না, হাজার বছরের অন্ধকার ঘর, একটা দেশলাই জ্বালালে মুহূর্তে আলোকিত হয়ে যায়! ধরে নাও, আমার জীবনে সেই দেশলাইটা জ্বলে উঠেছে। রঞ্জিত জ্বালিয়েছে।”

“ভুল করছ, চরম ভুল করছ।”

“তা হলে ভুলই করতে চাই। ভুল করার স্বাধীনতা চাই। রঞ্জিতের আর-একটা কবিতা আছে… ‘পৃথিবী মানুষের কাছে এলে, মানুষকেও পৃথিবীর কাছে আসতে হয়।’ আমি পৃথিবীর কাছে অ্যাভেলেবল হতে চাই। তোমার মতো শাপভ্রষ্ট দেবতা আমার জীবনের অর্ধেকটা খেয়ে নিয়েছে। বাকি অর্ধেকটা আমি মানুষের মতো বাঁচতে চাই।”

“কবে এই ডিসিশনে এলে? রঞ্জিতকে দেখার পর?”

“না। প্লেনে ভারতে আসার সময়। তোমার মনে আছে, বহুদিন আমাদের মধ্যে কোনও স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ছিল না? মন্ত্র হওয়ার পর ক’দিন ক্লোজ় হয়েছি, হাতে গুনে বলা যাবে। কিন্তু সেই রাত্রে আমি প্রথম একটা প্যাশনেট লোককে আবিষ্কার করছিলাম। মনে হচ্ছিল, যতটা খিদে, ততটাই ভালবাসা পাব। কানায়-কানায় উপচে পড়ব একদম। কিন্তু তখনই ফোনে বাবার মৃত্যুসংবাদ এল।”

“সেটার উপর তো আমার কোনও হাত ছিল না।” উত্তরণ প্রায় আর্তনাদের গলায় বলে উঠলেন।

“আমি জানি, ছিল না। কিন্তু কারওর তো হাত ছিল। কে তিনি? তোমার ভগবান? তিনি তা হলে চাননি যে তুমি আর আমি মন্ত্রের জন্মের যন্ত্রণা পেরিয়ে আবারও মিলিত হই! আমাদের বিচ্ছেদটাই তিনি চেয়েছেন। তুমি মিনমিন করে আমাকে যে কথাটা বহুবার বলেছ, আমি সেটা ওই মুহূর্তে বুঝে গেলাম। আমি ভুল, তুমিই ঠিক। ঈশ্বর চাননি তুমি সংসারী হও। আর ঈশ্বর যা চান না তা মানুষ চাইলেও হয় না। সো উই মাস্ট লিভ ইচ আদার।”

“কিন্তু মন্ত্র?”

“ওকে তুমি একা কীভাবে মানুষ কবে, তা-ই ভাবছ তো? আমেরিকার চাইল্ড প্রোটেকশন স্কিম খুব দড়। ওদের জানাও তুমি পারছ না, ওরা মানুষ করার ব্যবস্থা করবে।”

“এটা কি একটা মায়ের কথা? একজন মা চাইছে যে তার মেয়ে অনাথের মতো বড় হোক?”

“একটা মানুষের কথা, যে ক্লান্ত, যে কিছুদিন একটু সুখে বাঁচতে চায়।”

“চায়, শুধু চায়। বাড়িটা চাও না? এত কষ্টে যে বাড়ি…”

“না, চাই না। আমি শুধু ডিভোর্স চাই উত্তরণ। তাড়াতাড়ি দিতে পারো?”

২৪

অনসূয়ার ইচ্ছেতেই ‘ক্রেমার ভার্সেস ক্রেমার’ ছবিটা দেখেছিলেন উত্তরণ। মাঝে-মাঝে হোম থিয়েটারে এক-আধটা ছবি দেখার জন্য জোর করত অনসূয়া। এটাও তেমনই একটা ছবি ছিল। সন্তান নিয়ে বাবার একার লড়াইয়ের গল্প। অনসূয়া যে ওঁর জীবনেই গল্পটা সত্যি করে দিয়ে যাবে, তা কল্পনাও করতে পারেননি তখন। কিন্তু যা কল্পনা করা যায় না, তাও যখন বাস্তব হয়ে যায়, তখন কীভাবে যেন তার সঙ্গে যুঝতে শিখে যায় মানুষ। উত্তরণও শিখলেন। কখনও মন্ত্রকে ক্ৰেশে রেখে, কখনও ওকে নিয়ে ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে… যে জীবন কিছুতেই থেমে থাকবে না, তাতে ভেলা ভাসানোর কৌশল আয়ত্ত করে নিলেন একরকম।

এক-একদিন তার মধ্যেও একটু অন্যরকমভাবে বাঁচতে ইচ্ছে করত। সেই দিনগুলো তিনি নাচ দেখাতেন মেয়েকে, ওকে পিঠে নিয়ে হামাগুড়ি দিতেন মেঝেজুড়ে, মন্ত্রকে নিয়ে খেতেও বেরোতেন। আমেরিকায় এতদিন থেকেও নিরামিষ থেকে আমিষে অভ্যস্ত হননি উত্তরণ। মেয়ের প্রোটিনের অভাব যাতে না হয় তার জন্য ওকে মাছ মাংস সবই বেঁধে খাওয়াতেন। কিন্তু নিজের ঠিক খেতে ইচ্ছে করত না। তাই বাইরে বেরোলে ওঁর গন্তব্য ছিল মূলত একটা গুজরাতি রেস্তরাঁই। সেই দোকানের মালিক হংসরাজ পটেল মাঝে-মাঝে গল্প করতেন উত্তরণের সঙ্গে। শৈশব-কৈশোর কলকাতায় কাটিয়েছেন বলে ভাঙা-ভাঙা বাংলা বলতেন ভদ্রলোক। পুরনো কলকাতার প্রসঙ্গ উঠলে নস্ট্যালজিক হয়ে পড়তেন খানিকটা।

“যেতে ইচ্ছে করে না আর কলকাতায়?” উত্তরণ জিজ্ঞেস করেছিলেন একবার।

“করে তো। গিয়েছিলাম একবার। কিন্তু সকাল থেকে ইয়ং ছেলেদের রাস্তায় বসে তাস খেলতে দেখে বিমার বনে যাচ্ছিলাম। এত লস অফ এনার্জি… হাউ ডু ইউ অ্যালাও দিস?”।

হংসরাজের প্রশ্নটার কোনও উত্তর ছিল না উত্তরণের কাছে। ওঁর নিজের জীবনটাই যে লস অফ লাভ, লস অফ ট্রাস্ট, লস অফ এনার্জি — সবকিছুর যৌথ খামার।

কিন্তু হারিয়ে ফেলার বেদনার ভিতরেই ফিরে পাওয়া থাকে। নইলে একদিন রাতে ওঁর আর মন্ত্রর উলটোদিকের টেবিলে কমলিকাদিকে দোসা খেতে দেখবেন কেন উত্তরণ? প্রথমে বিশ্বাস হচ্ছিল না। কমলিকাদি? আটলান্টা ছেড়ে মেরিল্যান্ড?

উত্তরণের বিস্ময়ের ভিতরেই কমলিকাদি ওঁর সামনে এসে জানালেন যে, ওই হোটেলে সপ্তাহে দু’দিন রান্না করার কাজে বহাল হয়েছেন বলে, ওখান থেকে খাবার সস্তায় পান।

“সঞ্জয়দা কেমন আছেন?”

“নিজেই দেখবে চলো।” কমলিকাদি হাসলেন।

হংসরাজের হোটেল থেকে প্রায় কুড়ি মাইল দূরে মূলত কৃষ্ণাঙ্গদের একটা পাড়ায়, একতলার একটা ঘরে সঞ্জয়দা আর কমলিকাদির সংসারে উত্তরণ যখন পৌঁছলেন, তখন রাত হয়ে গিয়েছে অনেকটাই।

সঞ্জয়দা সম্ভবত চিনতে পারলেন না ওঁকে। চেনার কথা নয়। সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়ে গিয়েছে দুটো। কথা বলতে গেলে জড়িয়ে যায়। যা বলেন তারও অর্ধেক বোঝা যায় না। কিন্তু জীবনের এই অবস্থাতেও লোকটার একটা রক অফ জিব্রাল্টার আছে। তার নাম কমলিকা।

“সারার দোষ নেই। ইউরোপিয়ান হোক বা ইন্ডিয়ান, শেষ পর্যন্ত ও তো একটা মেয়ে! কাঁহাতক সহ্য করতে পারে? কিন্তু ও আমার বিরুদ্ধে যেতেই আমি যদি রুখে না দাঁড়াতাম, যদি না বলতাম যে ওরা আমাকে খাটাতে নিয়ে এসেছে আমেরিকায়, তা হলে এখানকার সরকার আমায় ডিপোর্ট করে দিত।”

“কিন্তু ওদের সংসার সেই জন্যই নষ্ট হয়ে গেল না তো?”

“আগেই গিয়েছিল। সঞ্জয়, প্রথম সেরিব্রালের পর মাটিতে পড়ে ছিল সাত ঘণ্টা। সারা কাজে চলে গিয়েছিল, সঞ্জয়কে অসুস্থ দেখেও। তখন আমি ওদের বাড়িতে ছিলাম না। হোমলেসদের শেল্টারে ছিলাম। কিন্তু ঘটনাটা জেনেই আমার মনে হয়, আমি চলে গেলে, সঞ্জয় পচে মরে যাবে। তাই ওকে আঁকড়ে ধরলাম। আটলান্টা ছাড়তে চাইছিলাম। ওখানকার এক মেমসাহেব হেল্প করলেন মেরিল্যান্ডের কাজগুলো পেতে। নইলে সারভাইভ করতাম না। আচ্ছা বলো, দেশে ফিরে গেলেই বা কী ক্ষতি হত আমার? সঞ্জয়কে বাঁচাব বলেই রিস্কটা নিলাম উত্তরণ। যৌবনে ওকে ছেড়ে এসে ইহকালটা নষ্ট করেছি। বার্ধক্যে ওর সেবা করে পরকালটা ভাল করে যাই। যাতে নেক্সট জন্মে অন্তত…” কমলিকাদি চুপ করে গেলেন।

কথা বলতে-বলতেই সঞ্জয়দার বুকে তোয়ালে বেঁধে মানুষটাকে চামচে করে কী একটা ওষুধ খাওয়াচ্ছিলেন কমলিকাদি।

উত্তরণের মনে হচ্ছিল, প্রেমিকা থেকে মায়ে রূপান্তরিত হয়েছেন কমলিকাদি। উলটোদিকে মা থেকে প্রেমিকা হবে বলে সমস্ত বন্ধন ছিঁড়ে অনসূয়া চলে গিয়েছে।

উত্তরণ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “আপনারা আমার বাড়িতে এসে থাকতে পারেন না কমলিকাদি?”

“না, পারি না। যৌবনে তো ওকে আলাদা করে পাইনি। কিন্তু এখন আর কেউ নেই আমাদের মধ্যে। দারিদ্র আছে। আমি আড়াইখানা চাকরি করি। আধখানা তো তুমি দেখলেই। কিন্তু এত পরিশ্রমেও আমার কষ্ট নেই, কারণ এই প্রথম সঞ্জয়কে একদম নিজের করে পেয়েছি। সেই পাওয়াটাকে উপভোগ করতে চাই।”

কে জানে কী বুঝে, সঞ্জয়দা হেসে উঠলেন কমলিকাদির কথা শেষ হতেই।

উত্তরণ কমলিকাদির হাতে পাঁচশো ডলার দিয়ে বললেন, “এটুকু আমি করতে পারি তো?”

কমলিকাদি টাকাটা নিয়ে বললেন, “বালিশের তলায় রেখে গেলে অপমানিত হতাম।”

মন্ত্রকে গাড়ি থেকে নামাননি উত্তরণ। সঞ্জয়দা-কমলিকাদির ঘর থেকে বেরিয়ে যখন গাড়িতে উঠতে যাবেন, কমলিকাদি এগিয়ে এলেন মন্ত্রকে একটু আদর করবেন বলে।

“আপনি রেস্তরাঁয় খেয়াল করেননি কমলিকাদি, রাস্তাতেও নয়, আমার মেয়ে স্পিচ ইমপেয়ার্ড। ও কথা বলতে পারে না। আর ওর মা আমাকে ডিভোর্স দিয়ে আর-একজনের সঙ্গে ঘর বেঁধেছে।”

কমলিকাদি যেন একটা চাপা আর্তনাদ করে উঠলেন।

“রক্তাক্ত হওয়ার জন্যই তো আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে আসি, রক্তাক্ত হতে ভয় পেলে চলবে কেন?” উত্তরণ গাড়িতে উঠতে-উঠতে বললেন।

মন্ত্র তখন হেসে হাত নাড়ছে, কমলিকাদির দিকে তাকিয়ে।

সেই হাসির সঙ্গে সঞ্জয়দার হাসির তেমন কোনও তফাত নেই।

২৫

রক্তাক্ত হলে সহ্য করা যায়। কিন্তু অপমান নেওয়া যায় না একটা বয়সের পর।

নিউ ইয়র্কে একটা সেমিনারে গিয়েছিলেন উত্তরণ। মন্ত্রকে যথারীতি প্রফেশনাল কেয়ারে রেখে। এ-ও তেমন একটা সেমিনার, যেখানে না গিয়ে উপায় ছিল না। কিন্তু এসেও যে ভিতরে খচখচ করছিল। বিকেলের দিকে উত্তরণের পূর্বপরিচিত প্রফেসর হাওয়ার্ড এসেছিলেন হোটেলে। এটা-ওটার ফাঁকে বললেন যে, উত্তরণের ভিতর যত বড় দার্শনিক হওয়ার পোটেনশিয়াল ছিল, উত্তরণ ততটা হচ্ছেন না, সুবিচার করছেন না নিজের প্রতিভার প্রতি।

হাওয়ার্ড চলে যাওয়ার পর উত্তরণ কথাগুলো নিয়ে ভাবছিলেন। হাওয়ার্ড কি জানেন, কথা বলতে পারে না অথচ কাঁদতে পারে, এমন একটা মেয়ের বাবা হওয়ার চ্যালেঞ্জ? আচ্ছা, ব্রহ্মচারী ঠাকুরও কি এমন অনেক সন্তানের বাবা নন, যারা কাঁদতে পারে, কিন্তু নিজেদের কথা বুঝিয়ে বলতে পারে না? তাদের সবার কান্না শুনবেন বলেই কি হিমালয়ে সাধনা বাদ দিয়ে সমতলে নেমে এসেছিলেন ঠাকুর? মা যেমন নিজের হাজার কাজ ফেলে সন্তানের তৃষ্ণা মেটাতে ছুটে যান?

মনটা অস্থির হয়ে ছিল বলে একটু হাঁটতে বেরোলেন উত্তরণ। ওঁর হোটেলটা টাইমস স্কোয়্যারের একদম কাছেই। এই সে-ই জায়গা, যেখানে আলো কখনও ম্লান হয় না। সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল সরণি, যেখানে সারা পৃথিবী নিজের মুখ দেখাতে চাইছে। হাঁটতে-হাঁটতে খানিকটা এগিয়ে এসেছিলেন উত্তরণ, সামনে একজন বাদামবিক্রেতা দেখে একটু দাঁড়ালেন।

লোকটা একদৃষ্টে উত্তরণের দিকে তাকিয়ে থেকে বাংলায় বলল, “মেয়ে লাগবে স্যার? ঘণ্টায় মাত্র চল্লিশ ডলার।”

উত্তরণ হতচকিত হয়ে গিয়ে বাংলাতেই বললেন, “বাদাম লাগবে।”

“সঙ্গে মেয়েও নিন না স্যার। মেক্সিকান, আমেরিকান, চাইনিজ় সব পাবেন। ঘণ্টায় তিরিশ ডলারে করে দেব। কোন হোটেল?”

উত্তরণ লোকটার সামনে থেকে সরে গেলেন দ্রুত পায়ে। লোকটা প্রথমে পিছু ডাকল, তারপর খিস্তি দিল, বাংলাতেই।

উত্তরণের কান জ্বালা করে উঠল।

কান একদম পুড়ে গেল যখন সেমিনার চলাকালীনই মার্ক স্যালট্রিনেরি উত্তরণকে আলাদা করে ডেকে বললেন, “হ্যাভ ইউ বিহেভড ইমপ্রপারলি উইথ এনি ওম্যান? আপনি আমাদের রেসপেকটেড গেস্ট, তাই আলাদা করে জিজ্ঞেস করে নিচ্ছি। ইউ নো হাউ টাফ দ্য ল’জ় আর নাও।”

“হোয়াট আর ইউ সেয়িং?”

“আপনার নামে একটা কমপ্লেন জমা পড়েছে মিস্টার মুখার্জি। আমরা কী করব বলুন?”

“কে নালিশ করল আমার নামে?”

“বৈদেহী শর্মা। ইয়োর এক্স-স্টুডেন্ট।”

“কিন্তু বৈদেহী তো নিজেই এগিয়ে এসে হাগ করল আমাকে। আমি জাস্ট রেসপন্ড করেছি। যেমন এদেশের রীতি। ইমপ্রপার কিছুই ছিল না সেখানে।” উত্তরণ একটা বজ্রাঘাতের পরও সোজা দাঁড়িয়ে থেকে বললেন।

“জানি না। নালিশ এলে আমাদের চুপ করে থাকার নিয়ম নেই। কিন্তু আমরা সত্যিই চাই না, এই ব্যাপারটা নিয়ে কেয়স হোক। সেক্ষেত্রে সেমিনারটা পুরো ঘেঁটে যাবে। প্লাস আপনার রেপুটেশন নিয়েও আমরা চিন্তিত।”

উত্তরণ হেসে উঠলেন, “আমার রেপুটেশন নিয়ে ভাববেন না। সম্ভব হলে, আপনি বৈদেহীকে ডাকুন একবার। আপনার সামনেই দু’মিনিট কথা বুলি মেয়েটার সঙ্গে। তারপর যা আপনাদের ইচ্ছা, করবেন।”

মার্ক বেরিয়ে যেতেই উত্তরণের মনে হল, আজই সেই দিন যেদিন তিনি বিষ খেলেও কেউ বাঁচাতে আসবে না, আর আসবে না বলেই তিনি মুক্ত। দেশটা আমেরিকা… মন্ত্রকে সরকার দেখে দেবে, বাপ-মা না দেখলেও। কিন্তু অপরাধ না করে এত বড় শাস্তি ভোগ করা সম্ভব নয়। নাকি অপরাধ মনে না করলেও, অপরাধ করেছেন তিনি? ঠাকুর যাঁকে সন্ন্যাসী দেখতে চেয়েছিলেন, তাঁর পক্ষে কোনও মেয়েকে জড়িয়ে ধরাই অপরাধ। মেয়েটি নিজের থেকে এগিয়ে এলেও অপরাধ। কেন বৈদেহীকে ঠেলে সরিয়ে দিলেন তিনি? অবচেতনে স্পর্শ চাইছিলেন কোনও প্রখর যুবতীর? তাই আলিঙ্গন করেছিলেন?

মার্ক একাই ফিরে এসেছিলেন কিছুক্ষণ পরে। জানিয়েছিলেন যে বৈদেহী নিজের নালিশ ফিরিয়ে নিয়েছে। তাই ব্যাপারটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি না করাই ভাল।

উত্তরণের মন মানেনি। ওই অপমান মুখ বুজে মেনে নেওয়ার অবস্থায় ছিলেন না বলেই মার্ককে অনুরোধ করলেন, যেভাবেই হোক, বৈদেহীকে একবার ওঁর সামনে এনে দাঁড় করাতে।

কিন্তু মার্ক আবারও একাই ফিরে এসে বললেন, ব্যাপারটা নিয়ে বাদ-প্রতিবাদের আর কোনও অর্থই হয় না। বৈদেহী যখন জলঘোলা করতে চাইছে না, তখন উত্তরণ কেন খুঁচিয়ে ঘা করছেন?

“কিন্তু ও নালিশটা করেছিল কেন?”

“আমি কী করে বলব? শি জাস্ট সেড দ্যাট শি ওয়াজ় নট ইউজ়ড টু হোয়াট ইউ ডিড।” মার্ক খানিকটা বিরক্ত গলায় বললেন।

আমি যা করেছি তার সঙ্গে ও পরিচিত ছিল না? আলিঙ্গন যে করে, সে তো আলিঙ্গনের মধ্যেই থাকে। কীভাবে ইমপ্রপার সেটা? কোথায় ইমপ্রপার? নিজেকে জিজ্ঞেস করছিলেন উত্তরণ, জীবনে প্রথমবার মদে চুমুক দিতে দিতে।

আটলান্টায় সেই রাতেই আসল অভদ্র কাজটা করেছিলেন। দু’জন ইচ্ছুক নর-নারীর ঘরে ঢুকে গিয়ে। জাগতিক সবকিছু সম্বন্ধে নির্বোধ ছিলেন বলে বুঝতে পারেননি। তারই দণ্ড ভোগ করলেন আজ।

সেদিন ঠান্ডার মধ্যে পাবে বসে থাকলেও মদ মুখে তোলেননি। জোরও করেনি কেউ। আজ স্বেচ্ছায় হুইস্কি পান করলেন। কেন করলেন, তা উত্তরণ জানেন না। কিন্তু না করে উপায় ছিল না। একটা জ্বালাকে দূর করতে আর-একটা জ্বালা তো দরকার!

হোক অপরাধ, আরও অপরাধ হোক। পৃথিবীর যত নাস্তিক, যত অবিশ্বাসী সবাই কি অপরাধী? তাদের তো কোথাও কৈফিয়ত দিতে হয় না। উত্তরণের একার মনের মধ্যে কেন সবসময় ঘড়ির কাঁটার মতো একজন ঈশ্বরকে জাগিয়ে রাখতে হবে, আর আচারে-ব্যবহারে তাঁর সমকক্ষ হওয়ার অবাস্তব চেষ্টা করে যেতে হবে আজীবন? কেন একজন নাস্তিকের সীমাহীন স্বাধীনতা উত্তরণ ভোগ করতে পারবেন না ইহজীবনে? কী এত দায় নিজেকে প্রমাণ করার? কী লাভ প্রমাণ করে? কোন পুরস্কার অপেক্ষা করছে?

জীবনভর যা মেনে চলেছেন তার একেবারে বিপরীত একটা চিন্তাস্রোত সুনামির মতো আছড়ে পড়ছিল উত্তরণের সত্তায়। শরীরের ভিতরে বৃশ্চিকদংশনের মতো মদের চলাচল অনুভব করতে-করতে উত্তরণ বারে বসেই চেঁচিয়ে উঠলেন, “অন্ধ ভক্ত হওয়ার চাইতে চোখ-খোলা বিদ্রোহী হওয়া অনেক ভাল। স্যাটান না থাকলে, কোথায় তোমার প্যারাডাইস ভগবান? এসব কথা বলা যদি আমার অপরাধ হয়, তা হলে অপরাধীই হতে চাই আমি। অনেক দূরে সরে যেতে চাই এই ধর্ম আর জপ-তপের দুনিয়া থেকে। এত দূরে চলে যেতে চাই যাতে ঠাকুরের কেউ বলে চিহ্নিত না হই আর, আমার গায়ের নোংরার দাগ যেন ঠাকুরের আসন অবধি না পৌঁছয়।”

“অপরাধী তো আপনি নন, আমি। আমায় ক্ষমা করবেন না?” ইউনিভার্সিটির সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় বৈদেহীকে নিজের পাশে আবিষ্কার করলেন উত্তরণ একদিন।

“মিথ্যে অভিযোগ করা যতটা সহজ, ক্ষমা চাওয়াও বোধহয় ততখানিই, তাই না?”

“আমি জানি আপনি এখন আমায় ঘেন্না করেন। আমার একটা কথাও বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে না আপনার। কিন্তু সেদিন ওই সময়ে আপনার নামে নালিশ না করলে রুচির আমাকে মেরে ফেলত।” বৈদেহী ধরা গলায় বলল।

“কে মেরে ফেলত?”

“আমার এক্স-বয়ফ্রেন্ড স্যার। ও আমায় সিগারেটের ছ্যাঁকা দিয়েছে, মেরেছে। আমি ওর খপ্পর থেকে বেরোতে পারিনি। সেদিন যখন আমি আপনাকে জড়িয়ে ধরেছি, রুচির সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। ওকে দেখে আমি মুখটা কাঁদো-কাঁদো করে ফেলতে বাধ্য হয়েছিলাম। আর মার খাওয়ার ভয়ে ওকে বলেছিলাম যে আপনিই এগিয়ে এসে হাগ করেছেন আমায়। ও-ই আপনার নামে নালিশ করেছিল স্যার, আমি নয়। আমি পরে ওকে অনেক বুঝিয়ে কমপ্লেন উইথড্র করিয়ে নিই, আমার রিসার্চের বাহানা দিয়ে।”

“তুমি যে এখন আমার কাছে এসেছ… ও তো আবার নালিশ করে দিতে পারে আমার নামে? রেপ কিংবা মলেস্টেশন চার্জ দিয়ে দিল হয়তো। বিশ্বাস কী?”

“রুচির হ্যাজ় বিন অ্যারেস্টেড স্যার। হি উইল নট ডিসটার্ব আস এনি মোর, রেস্ট অ্যাশিওরড। দ্য ড্রাগ পেডলার ইজ় বিহাইন্ড দ্য বারস নাও।”

“তুমি একজন ড্রাগ পেডলারের বান্ধবী?”

“আমি জানতাম না স্যার। কিছু জানতাম না। বিলিভ মি।”

“আমার বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাস কোনওটাই করার দরকার নেই বৈদেহী। আমি যদিনা-ও পারি, ঈশ্বর ক্ষমা করুন তোমাকে। তুমি আসতে পারো এখন।”

বৈদেহী সেদিনের মতো ফিরে গেলেও, এক সপ্তাহ পরে ফিরে এল আবার। এবার উত্তরণের বাড়িতে।

বাইরে বেরিয়ে বৈদেহীকে দেখে রেগে গেলেন উত্তরণ, “এখানে কেন এসেছ তুমি?”

“আমার ফিরে যাওয়ার জায়গা নেই স্যার। আইদার আপনি আমায় আশ্রয় দেবেন, নয়তো সুইসাইড করতে হবে আমায়।”

“তুমি নিজের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছ বৈদেহী। প্লিজ় গো অ্যাওয়ে ফ্রম হিয়ার।”

“আপনি তাড়িয়ে দিলে আমি আর কোনওদিন আপনাকে বিরক্ত করব না। কিন্তু আমাকে আপনি ফিরিয়ে দেবেন? বিশ্বাস করুন, আমি থাকার জায়গা হয়তো অন্যত্রও পাব। তবু আপনার কাছে আশ্রয় চাইছি, কারণ আমি শুধু শ্রদ্ধা করি না আপনাকে, ভালবাসি।”

“জাস্ট স্টপ দিস ননসেন্স।”

“নো আই ওন্ট। বিকজ় আই লাভ ইউ। অ্যান্ড দ্যাট টু ফ্রম মাই স্টুডেন্ট ডেজ়। ইউ ওয়্যার দ্য রিজ়ন হোয়াই আই লাভড ফিলোসফি। আমি জানি না, আপনি কেন আমার চোখ দেখে বুঝতে পারেননি।”

“আমি বুঝতে চাই না। আমি বোঝার অবস্থায় নেই।”

“কেন স্যার? জাস্ট বিকজ় ইয়োর এক্স-ওয়াইফ হ্যাজ় ডিভোর্সড ইউ, লাইফ ক্যানট স্টপ। লেটস স্টার্ট আফ্রেশ।”

“আমি একটা কাজে আছি, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। তুমি প্লিজ় এখান থেকে চলে যাও।”

“দেরি হয়ে গিয়েছে বলেই তো আর দেরি করাতে চাইছি না। নতুন করে জীবন শুরু করুন আমার সঙ্গে। আমাকে তাড়িয়ে দেবেন না। ফর হেভেনস সেক।”

উত্তরণের হঠাৎ সত্যসেবী আশ্রমের একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। একটা চোর ভজন-কুটিরে এসে ঠাকুরের পায়ে মাথা রেখে কাঁদতে শুরু করেছে। পিছন-পিছন তিনটে লোক এসে চোরটাকে তাদের হাতে তুলে দিতে বলতেই ঠাকুর বললেন, “আশ্রয় যে চাইছে, তাকে তো আমি তোমাদের হাতে তুলে দিতে পারি না।”

‘যে আশ্রয় চায়, তাকে আশ্রয় দিতে হয়।’ ব্রহ্মচারী ঠাকুরের কথাগুলো মাথার ভিতর বেজে উঠতেই উত্তরণ অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন।

বৈদেহী বোধহয় এটারই অপেক্ষায় ছিল। এগিয়ে এল তাই।

২৬

“সূর্যই আলো। সেই আলোতেই আমরা হাঁটি, চলি, কাজ করি। যখন সূর্য ডুবে যায় তখন চন্দ্র আলো দেয়। যখন চাঁদও ডুবে যায়, তখন আলো মানে আগুন। আর আগুন নিভে গেলে বাক্য আমাদের আলো, কারণ তার আওয়াজ শুনে আমরা এগিয়ে যেতে পারি। যখন সূর্য-চন্দ্র ডুবে গিয়েছে, আগুন নিভে গিয়েছে, কথাও বলছে না কেউ, তখন আত্মাই আলো। সে-ই পথ দেখায়…”

জনক রাজার প্রশ্নের উত্তরে যাজ্ঞবল্ক্য ঋষির উত্তরগুলো ব্যাখ্যা করছিলেন উত্তরণ। ক্লাসের শেষে নিজের চেম্বারে ফিরে এসে ভাবছিলেন, বৃহদারণ্যক উপনিষদের যুগে যা সত্যি ছিল, আজ কি তা মিথ্যে? মিথ্যে না হয়ে উপায় কী? আজ শরীরের প্রবল প্রতাপে আত্মার অস্তিত্ব কোথায়? কে বাঁচিয়ে রাখতে পারে আত্মাকে?

“তুমি নিজেই কি পেরেছ?” গল্পটা শুনতে-শুনতে স্কাইপে জিজ্ঞেস করল অনসূয়া।

“জানি না, পেরেছি কি না। তবে তুমি যা ভাবছ, তা-ও সত্যি নয়। বৈদেহীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক শারীরিক নয়। বা বলতে পারি, তোমার সঙ্গে যে মাত্রায় শারীরিক ছিল, সেই মাত্রায় নয়।” উত্তরণ চোখ সরিয়ে নিলেন ল্যাপটপের স্ক্রিন থেকে।

“তার মানে ইন্টারকোর্স ছাড়া সব হয়?” হেসে উঠল অনসূয়া।

সেই হাসির শব্দ তিরের মতো বিঁধতে শুরু করল উত্তরণকে। শরীরের প্রতিটা অঙ্গে তীক্ষ্ণ, তীব্র ক্ষত তৈরি করতে লাগল, যেখান থেকে রক্ত না বেরোলেও কান্না বেরোয়।

“তোমার মনে আছে উত্তরণ, তিরিশ-চল্লিশটা বাড়ি দেখার পর, এই বাড়িটা পছন্দ করেছিলাম? তখন এটা সদ্য জমির উপর মাথা তুলছে। বাড়িটার পজ়িশন যে খুব কিছু ভাল লেগেছিল, তা নয়। কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছিলাম, সেকেন্ড-হ্যান্ড বাড়িতে তুমি কমফর্টেবল ফিল করবে না কখনওই। তোমার মনে হবে, এই বাড়ির আগের বাসিন্দারা বাড়িটাতে কেমন জীবন কাটিয়ে গিয়েছে…”

“ঠিকই ভেবেছিলে তুমি।”

“শুধু ভেবেই বসে থাকিনি। কোন মর্টগেজ কোম্পানির থেকে কম সুদে, সুবিধাজনক শর্তে লোন পাওয়া যাবে, তাই নিয়ে মারামারি করেছি দিনের পর দিন। তুমি যখন জপে বসে থাকতে, আমি তখন সার্চ করতাম, কীভাবে অ্যাপ্লাই করলে তাড়াতাড়ি লোন স্যাংশন হবে। শুধু কি লোন? ঘর কত বড়, বাথরুম ক’টা, বেসমেন্ট ফিনিশড কি না, কলোনিয়াল না কেপ নাকি ভিক্টোরিয়ান, কোন স্টাইলের বাড়ি হবে… রিয়েল এস্টেট এজেন্টের সঙ্গে যাবতীয় কথাবার্তা আমিই তো বলতাম।”

“কে অস্বীকার করেছে? যে পঞ্চাশটা বাড়ি দেখেছ এটা ঠিক করার আগে, খুব বেশি হলে, তার পাঁচটা দেখার সময় আমি তোমার সঙ্গে ছিলাম। তুমি না থাকলে আমেরিকায় আমার বাড়ি হত না।”

“তোমার বাড়ি, তাই না উত্তরণ? একা তোমার? যেখানে তুমি একটা অন্য মেয়ের সঙ্গে লিভ-টুগেদার করো আর অবলীলায় বলে দাও যে ইন্টারকোর্স ছাড়া সব হয়েছে। ওটাই বা বাকি রেখেছ কেন? আগুনের খাপরার মতো একটা বস্তুকে স্যাটিসফাই করতে পারো না বলে?”

উত্তরণ ফোনটা কেটে দেবেন ভেবেও কাটতে পারলেন না। শুধু জিজ্ঞেস করবেন ভাবলেন, মাঝখানে যে লোকটা থাকে, তার করণীয় কী? বৈদেহীর কথাগুলো এঁর মাথায় ঘুরছিল তখন।

“প্রত্যেকটা মানুষ একটা ঘর। সেই ঘরের একটা নির্দিষ্ট চাবি থাকে। আপনার ঘরের চাবিটা আপনার এক্স-ওয়াইফ সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছেন। আপনি তাই ঠান্ডায় বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে একটা চান্স দিন না স্যার, নতুন চাবি বানিয়ে দিই আপনার।”

না, উত্তরণ সাড়া দিতে পারেননি বৈদেহীর ডাকে। সঙ্গম হয়নি এক ছাদের নীচে বসবাস করা দুই নর-নারীর। কিন্তু বৈদেহী ওঁকে জড়িয়ে ধরলে, চুমু খেলে, সবসময় ধাক্কা দিয়ে সরিয়েও দিতে পারেননি মেয়েটাকে। সেটা কি পাপ, নাকি দুর্বলতা? যদি দ্বিতীয়টা হয়, অনসূয়াকে বোঝাবেন কী করে?

“আমি তো তোমাকে এই বাড়ি থেকে চলে যেতে বলিনি অনসূয়া। তুমি নিজের ইচ্ছায় গিয়েছ। এমনকী নিজের মেয়েকে পর্যন্ত সঙ্গে রাখতে চাওনি।”

“হ্যাঁ, চাইনি। কারণ আমার কাছে তোমার অস্তিত্ব যতটা প্রবল, তোমার কাছে আমার অস্তিত্ব ততটা নয়। মন্ত্র তোমার কাছে একটা বাচ্চার মতোই মানুষ হতে পারবে বলে মনে হয়েছিল, আমার কাছে ও তো তোমার প্রতিভূ হিসেবে জেগে থাকত প্রতিটা মুহূর্ত। সারাক্ষণ আমায় মনে পড়াত যে তুমি নেই, আমার কাছে নেই। আমি পাগল হয়ে যেতাম। কিন্তু আমি তো বাঁচব বলে পালিয়েছিলাম গো।” অনসূয়ার গলা বুজে এল।

“তুমি তো নতুন করে বাঁচছই। তোমার রঞ্জিত তোমাকে ছন্দে, কবিতায় নতুন করে বাঁচাচ্ছে প্রতিনিয়ত। যে সুখ আমি তোমায় দিতে পারিনি, সেই সুখ ও তোমায়…”

“ভুল জাননা, ভুল। রঞ্জিতের সঙ্গে আমি আর নেই।”

“মানে? ওকেও ডিভোর্স করে দিয়েছ?”

“বিয়েই হয়নি আমাদের। আসলে রঞ্জিত আমার শরীর আর পয়সাকে যতটা চেয়েছিল, আমাকে ততটা চায়নি। আদৌ চেয়েছে কি না, তাও জানি না।”

“কিন্তু ও তো কবি?”

“কবিরা কি মঙ্গলগ্রহ থেকে আসে নাকি? তারা একটা পুরস্কারের জন্য এমন অনেক কাজ করে ফেলতে পারে, যা সাধারণ মানুষ ভাবতেও পারে না। শুধু রঞ্জিত নয়, ওর অন্যান্য কবি-বন্ধুদেরও খানিকটা দেখলাম তো আমি। নিজেদের সুবিধার জন্য কেউ-কেউ খুনও করে ফেলতে পারে বোধহয়। আর তা ছাড়া অনেকের সঙ্গে যৌন সম্পর্কে না থাকলে কবিতা লেখা যায় নাকি?”

“তুমি একটু বেশিই নেগেটিভ বলছ।”

“একদম না। রঞ্জিতকে যখন আমি প্রায় হাতেনাতে ধরে ফেলেছিলাম একবার, ও বলেছিল যে শিকলে বেঁধে রাখলে ওর সৃষ্টিশীলতা ধ্বংস হয়ে যাবে।”

“তা হলে এখন তুমি…”

“ভয় পেয়ো না উত্তরণ। আমি তোমার কাছে ফিরতে চাইব না। বরং আমি চাইব তুমি দারুণভাবে বাঁচো।”

“হ্যাঁ, দারুণভাবেই বাঁচছি।” উত্তরণ হাসি চাপলেন।

“আবার সন্তানের বাবা হও। বারবার তো মন্ত্রর মতো কেউ জন্মাবে না।”

বুকে যেন একটা বুলেট ঢুকে গেল। উত্তরণ তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, “একশোবার বাবা হলে, আমি একসোবার মন্ত্রেরই বাবা হতে চাইব।”

“একটা শোভন, সুন্দর, জীবনের অধিকার সবার আছে। কষ্ট পেতে-পেতে কষ্ট ফুরিয়ে যায়। তোমার জীবনের কষ্ট শেষ হয়ে এসেছে বলে আমার মনে হয়। তুমি এবার আনন্দে বাঁচবে। ঐশ্বরিক ঘেরাটোপে আর বন্দি থাকবে না।”

“আমার মধ্যে ঐশ্বরিক কিছু কোনওদিনই বোধহয় ছিল না অনসূয়া। আমি হাজতে রাত কাটিয়েছি, স্ত্রী ছেড়ে চলে যাওয়ার পর অন্য মেয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছি, কোন ঐশ্বরিক বিভা তুমি আমার মধ্যে দেখেছিলে, তুমিই জাননা। আমার এখন মনে হয়, আমি ভগবানের আবর্জনা। আই অ্যাম জাস্ট গড়স গারবেজ। নাথিং এলস। আমি সারা জীবন ভগবানকেই ভালবেসেছি। মানুষের মধ্যে থেকেও, আমার প্রেম-অপ্রেম সমস্তটা নিয়ে ভগবানের কাছে পৌছঁতে চেয়েছি। কিন্তু কোথায় আছেন সেই ভগবান? সেই প্র্যাকটিক্যাল গড, যিনি বিপদে সাড়া দেন? তাঁকে আমি কোথায় খুঁজে পাই অনসূয়া?” কান্নায় ভেঙে পড়লেন উত্তরণ।

“তোমাকে স্কাইপে কল করতে বলে অন্যায়ই করলাম হয়তো। কী করব, তোমার জীবনে নতুন কারও আসার খবর শুনে নিজেকে স্থির রাখতে পারিনি।” বলতে-বলতে অনসূয়াও কেঁদে উঠল।

দুটো কান্নার ভার বইতে না পেরেই হয়তো যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেল দুটো মহাদেশের।

২৭

মেরিল্যান্ডের যেখানে উত্তরণ বাড়ি কিনেছিলেন, সেই সিলভার স্প্রিং বেশ পশ এরিয়া। মূলত হোয়াইট আমেরিকানদেরই বাস এখানে। গুজরাতি ও তামিলদের দৌলতে কিছু উচ্চ-প্রতিষ্ঠিত ভারতীয়ও বসবাস করে। বাঙালি অল্পই, তাই এই মহল্লায় দুর্গাপুজো হয় না। আমেরিকায় বারুইপুর থেকে বেহালা, বর্ধমান থেকে দুর্গাপুরের দুরত্বে যারা থাকে, তারাও প্রতিবেশী। সেরকমই একজনের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ওয়াশিংটনের মেট্রোয়। সন্দীপন গুহ বলে সেই ভদ্রলোক নিজের বাড়িতে দুর্গাপুজো করেন। একবার অন্তত পুজোয় আসার সনির্বন্ধ অনুরোধ জানিয়েছিলেন উত্তরণকে।

বিদেশ-বিভুঁইয়ে মায়ের পুজোর খবর পেয়েও যাবেন না? উত্তরণ তাই বেশ খানিকটা গাড়ি চালিয়ে দুপুর-দুপুর গিয়ে পৌঁছলেন ব্র্যাম্বেলটন বলে একটা ছবির মতো মহল্লায়, সন্দীপন গুহর বাড়িতে। এই জায়গাটা মেরিল্যান্ডের লাগোয়া স্টেট ভার্জিনিয়ায় পড়ে, কিন্তু মায়ের পুজোয় আবার ভৌগোলিক সীমারেখা কীসের?

প্রতিমার সামনে বসে খুব পবিত্র লাগছিল উত্তরণের। কিন্তু মনটা তেতো হয়ে গেল যখন বিকেল না হতেই অঞ্জন পালিত বলে একজন বাড়ির পিছনের একটা ঘরে বারোয়ারি মদ্যপানের আসরে যোগ দেওয়ার জন্য ডাকতে এল উত্তরণকে। আর আসল কথা বলার আগে খানিকটা অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলে নিল যে উত্তরণের নামের সঙ্গে সে পরিচিত।

“পুজোর সন্ধ্যাতেও মদ্যপান?” বিস্ময় আর বিরক্তি মিশিয়েই জিজ্ঞেস করলেন উত্তরণ।

“পুজোয় মদ খাবে না লোকে? আরে এসব অং-বং-চং মানেই তো একটা সোশ্যাল গ্যাদারিং, তাই না? সেখানে ফুর্তি-ফার্তা না হলে চলে?” লোকটা দেঁতো হাসি হাসল উত্তরণের দিকে তাকিয়ে।

“সে করতে চাইলে, এমনিই করুন। পুজোর নামে গ্যাদারিং করতে-করতে পুজোটা না শেষে বরবাদ হয়ে যায়।”

অঞ্জন থমকে গেল এক মুহূর্তের জন্য। তারপর উত্তরণের দিকে তাকিয়ে বলল, “স্যার দেখছি কনজ়ারভেটিভ। আমি তো ভেবেছিলাম আমরা গর্ব করি যাকে নিয়ে সেই লোকটা লিবারাল। তা ছাড়া দু’-দুটো বিয়ে করেছেন… বেঙ্গলি, আবার নন-বেঙ্গলিও…”

উত্তরণ সরে গেলেন লোকটার সামনে থেকে। নাম-কা-ওয়াস্তে প্রসাদ নিয়ে ফেরার পথে ভাবছিলেন, কে ওঁর প্রতিটা আনন্দের ভিয়েন এভাবে ধ্বংস করে দেয়? কোন নিয়তি সে? কোথায় থাকে?

অথচ কী সুন্দরভাবে শুরু হয়েছিল দিনটা।

গত রাতে চমৎকার একটা স্বপ্ন দেখেছিলেন উত্তরণ। সেই স্বপ্নের রেশ নিয়ে ভোরবেলা উঠে মনে হয়েছিল, আমেরিকা হোক বা ভারত, দেবীপক্ষে সর্বত্রই দেবীর আরাধনা হওয়া দরকার। আর মন্ত্র তো কেবল ওঁর মেয়ে নয়, সে যে দেবীর অংশ! পৃথিবীর সব মেয়ের মতোই, দেবাংশী।

স্নান সেরে জপের পর, উত্তরণ মন্ত্রকে স্নান করে আসতে বললেন। কথা বলতে না পারলেও সবই বুঝত মেয়েটা। আর স্বভাবটাও ভারী ভাল, ওর স্পেশাল স্কুলের শিক্ষিকারা উত্তরণের কাছে বারংবার প্রশংসা করতেন ওঁর মেয়ের। গর্বে বুক ভরে উঠত উত্তরণের।

সেদিনও মেয়েকে পাশে বসিয়ে গর্ব হচ্ছিল বাবা হিসেবে। মন্ত্রকে ইশারায় ব্রহ্মচারী ঠাকুরের প্রতিকৃতির দিকে তাকাতে বললেন উত্তরণ।

মন্ত্র তাকাল।

বৈদেহী কোনও একটা কাজে বাইরে গিয়েছিল বলে, নিচ্ছিদ্র শান্তিতে ভরে ছিল ঘরটা। অনসূয়াই এত সুন্দর একটা ঠাকুরঘরের প্রভিশন রেখেছিল বাড়ির প্ল্যানে, তাই অনসূয়ার প্রতিও কৃতজ্ঞ হয়ে উঠলেন উত্তরণ। কৃতজ্ঞতা জন্মাল সারা বিশ্বপ্রকৃতির প্রতি। মানুষ হয়ে জন্মেছেন বলে, ঠাকুরের শিষ্য হতে পেরেছেন বলে, মন্ত্রর বাবা হয়েছেন বলেও। বাইরে কতগুলো পাখি কিচিরমিচির করছিল। ওরাও বোধহয় বিশ্ববিধাতাকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছিল।

উত্তরণ সামনের বাগানে কিছু ফুলগাছ লাগিয়েছিলেন, অনসূয়াও লাগিয়ে গিয়েছিল কয়েকটা। সেই গাছগুলোর ফুলেই নিত্যপূজা করতেন। আজ পুজোর শেষে মন্ত্রর হাতে ফুল তুলে দিয়ে ঠাকুরের পায়ে দিতে বললেন।

বাবার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করল মেয়ে।

উত্তরণ এবার মেয়ের মাথাটা হাত দিয়ে কাছে টেনে, ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে গেলেন। তারপর ঠাকুরের যে বীজমন্ত্র একদিন পৃথিবীর প্রথম শ্লোকের মতো জন্ম নিয়েছিল ওঁর কানে, যে মন্ত্র সারা পৃথিবীতে উত্তরণকেই ছড়াতে হবে বলে বলেছিলেন বিজয়দা, সেই মন্ত্র পৃথিবীর আর-একজনের কানে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন।

হয়তো পাপের ভিতর দিয়ে গিয়েছেন উত্তরণ, ঠাকুরের ইচ্ছা এবং বাক্য লঙ্ঘন করেছেন জ্ঞানত বা অজ্ঞানত, তবু ঠাকুর উত্তরণের কণ্ঠ, ওষ্ঠ, জিভ দিয়েই ওই মহাপরাক্রমী মন্ত্র উচ্চারণ করালেন। এতদিন যাকে নিঃশব্দে উচ্চারণ করেছেন, আজ তা-ই সশব্দে বললেন। একবার-দু’বার-তিনবার বললেন। মন্ত্রের কানে ‘মন্ত্র’ প্রবেশ করল।

মেয়ে অবাক হয়ে তাকাল বাবার দিকে।

দ্রুতবেগে গাড়ি চালিয়ে ফিরতে-ফিরতে উত্তরণ ভাবছিলেন, কেন যেতে গেলেন ওই নেমন্তন্নে? আজকের এত পবিত্র একটা দিনের গায়ে কেন কলুষ লাগতে দিলেন? বাড়িতেই তো থাকতে পারতেন, মেয়েকে কাছে বসিয়ে জপ করে যেতে পারতেন দুপুর পেরিয়ে সন্ধ্যা অবধি।

চাবি খুলে ঘরে ঢুকে উত্তরণ দেখলেন, ধোঁয়ায় ধোঁয়া। তিন-চারটে বিয়ারের বোতল গড়াচ্ছে মেঝেয়। ফিরে এসেছে স্বৈরিণী, আর ফিরেই নরক করে তুলেছে বাড়িটাকে।

“বৈদেহী?” চিৎকার করে উঠলেন উত্তরণ।

হট প্যান্ট পরা বৈদেহী ওঁর সামনে এসে দাঁড়াল।

“আমি তোমায় বলেছি না যে এই বাড়িতে এরকম উদ্ধৃঙ্খলভাবে থাকা যাবে না!”

“আর ইউ ট্রাইং টু প্ৰিচ সামথিং প্রফেসর?”

“নো। আমি শুধু বলছি যে এখানে থাকতে গেলে, কিছু ডিসিপ্লিন মেনে চলতে হবে।”

“আদারওয়াইজ় কী করবে?”

“সিম্পলি বার করে দেব।” উত্তরণ ধৈর্য হারালেন।

“ওসব লেকচার অন্যকে দিয়ো, নট মি। আমায় তাড়ানোর চেষ্টা করলে, তোমার নিজের বাস উঠে যাবে এই বাড়ি থেকে।”

“ভালই তো। আমি মাসে-মাসে লোন শোধ করার ঝক্কি থেকে বেঁচে যাব। তুমি যখন থাকবে, তখন ধারটা তুমিই শোধ কোরো।”

“প্যাঁচ কোষো না আমার সাথে। আমি তোমার এক্স-ওয়াইফ নই যে সুড়সুড় করে বেরিয়ে যাব। আই উইল গো অ্যান্ড কমপ্লেন এগেনস্ট ইউ।”

“সেই যেমন করেছিলে?”

“ইয়াপ। তবে এবার আর উইথড্র করব না। তখন আমাকে সেক্সুয়ালি এক্সপ্লয়েট করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে তুমি জেল খাটবে। আর আমি আরামে…”

“তুমি খামোকা পড়াশোনা করতে এসেছিলে কেন? অভিনয় করতেও তো পারতে?”

“আই ওয়াজ় আ ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। ইউ নো দ্যাট।”

“আমি যা জানি তা হল, তোমার ফ্যামিলি টাকা খরচ করে পড়তে পাঠিয়েছিল তোমায়। তুমি একজন স্পনসর্ড স্টুডেন্ট ছিলে।”

“বাট স্টিল ইউ প্যাম্পার্ড মি।”

“তুমি আমার দেশের মেয়ে বলে …”

“ঝুট মত বোলো। অন্যদের মতো তুমিও হেলে গিয়েছিলে আমায় দেখে।”

“তুমি মরতে এলে কেন, আমার কাছে?”

“বিকজ় ইউ আর দ্য লিস্ট হার্মফুল অফ দেম… আর আমার নিজেকে লুকিয়ে রাখাও দরকার!” হেসে উঠল বৈদেহী।

বৈদেহী প্রলাপ বকছে ভেবে উত্তরণ সরে গেলেন ওর সামনে থাকে। মেয়ের ঘরে ঢুকলেন। দেখলেন মন্ত্র নির্জীব হয়ে শুয়ে আছে মেঝেয় আর ওর কপালের কাছটায় অনেকটা কেটে গিয়েছে। রক্ত চুইয়ে পড়ছে সেখান থেকে।

উত্তরণ ঘর থেকে বেরিয়ে এসে উন্মত্তের মতো চিৎকার করে উঠলেন বৈদেহীর নাম ধরে।

বৈদেহী পালটা চেঁচিয়ে উঠল, “কী মেয়ে হয়েছে তোমার! মানুষকে টলারেট করতে পারে না। আমাকে ঘর থেকে বার করে দিতে চাইছিল, তখন আমিও একটা ধাক্কা দিয়েছি। জাস্ট গিভ হার সাম ফার্স্ট-এড। শি উইল বি অলরাইট।”

উত্তরণ মন্ত্রর কাছে ফিরে গিয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন। জীবনে এই প্রথম শারীরিক হিংসার প্রয়োজন বোধ করছিলেন। আর একই সঙ্গে নিজের প্রতি অসম্ভব ধিক্কারে নুয়ে পড়ছিল সারা শরীর। মনে হচ্ছিল, ওঁর তো চাতকের মতো শুধুমাত্র বৃষ্টির জলের অপেক্ষায় থাকা উচিত ছিল। অথচ নর্দমার জলকেও চিনতে না পেরে তৃষ্ণা মেটাতে গিয়েছিলেন। কেন ওই মেয়েটাকে অ্যালাও করলেন বাড়িতে! কেন?

অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করে উত্তরণ বললেন, “আমি আমার মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছি। ফিরে এসে তোমাকে যেন আর এখানে না দেখি।”

“আমাকে না দেখতে চাইলে, তুমি নিজেকেও এখানে দেখবে না। বিকজ় আই নো হোয়াট টু ডু।” বৈদেহী ঘরের মধ্যেই থুতু ছেটাল।

উত্তরণ ওর দিকে একটা আগুনে দৃষ্টি হেনে, বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। সিট-বেল্ট বাঁধা মেয়েটাকে পাশে বসিয়ে ড্রাইভ করতে-করতে ভাবছিলেন, এই মেয়েটাই তো ঈশ্বরী। আহত-অসুস্থ অবস্থাতেও বাবার দিকে তাকিয়ে হাসছে। কিন্তু এই ঈশ্বরকে বিস্ময় হিসেবে গ্রহণ করলে, বিস্ময় যখন কেটে যাবে, ঈশ্বরও তামাদি হয়ে যাবেন।

ভুবনেশ্বর আশ্রমের স্বামী মাধবানন্দ বলতেন, ঈশ্বরকে নেওয়া উচিত চরম শূন্যতাকে ভরিয়ে রাখার শক্তি হিসেবে। তিনি না থাকলে এই শূন্যতা জ্যান্ত কামড়ে খেত আমাদের সবাইকে। কথাটাকে ধ্রুব সত্য মনে হল উত্তরণের। সেই মুহূর্তে।

হাসপাতালের পার্কিং লটে গাড়ি দাঁড় করিয়ে উত্তরণ সর্বশক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন নিজের মেয়েকে। তারপর মন্ত্রকে গাড়ি থেকে কোলে করে নামিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, “মাই ডটার নিডস হেলপ। ইমিডিয়েটলি।”

২৮

ঠাকুর যে কোথায় কাকে দাঁড় করিয়ে রাখেন, মানুষ জানতে পারে না। নইলে পনেরো বছরের উপর যার সঙ্গে কোনও যোগাযোগই নেই, সেই সোমনাথ ওই হাসপাতালে থাকবে কেন, সেই রাত্রেই?

ভার্জিনিয়ায় থাকা ভাইয়ের বউয়ের লেবার পেন ওঠায় হাসপাতালে এসেছিল সোমনাথ। কিন্তু পরের চার দিন, ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী, তাদের সদ্যোজাত সন্তানকে এককম বিস্মৃত হয়ে, উত্তরণের সঙ্গেই লেগে রইল লোকটা।

“তুই আমাকে ভুলে গেলেও, আমরা কেউ ভুলতে পারিনি তোকে। তুই রত্ন ছিলি আমাদের ব্যাচের। কোহিনূর ডায়মন্ড। কেজি ম্যাডাম বলতেন। আর কোহিনুর কি দেশে থাকে?

এত আন্তরিকভাবে কথাগুলো বলত সোমনাথ, নিজের জীবনের সব দোষ-ত্রুটির কথা এমন সরলতায় স্বীকার করত যে ওকে দূরে ঠেলা যেত না। ‘তুমি’ করে ডাকা যেত না ‘তুই’এর উত্তরে।

কিন্তু আমেরিকার নিয়মকানুন, বিশেষ করে বাচ্চা প্রতিপালনের ক্ষেত্রে, সরল নয়। যথেষ্ট জটিল এবং কঠিন। বাচ্চা খাট থেকে পড়ে যাওয়ার কারণে কিংবা মা বাচ্চাকে একটা চড় মেরে বসায় কত শিশুকে যে মা-বাবার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে গিয়ে ফস্টার কেয়ারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।

“এই সিপিএস, চাইল্ড প্রোটেকশনের নাম করে ছাগলের মতো একটা সিস্টেম চালু করে রেখেছে দেশজুড়ে। গার্জিয়ানকে টাইট দিয়ে বাচ্চার ভাল করা যায়?” সোমনাথ বলত।

কিন্তু সোমনাথের বলায় কী আসে-যায়? কী আসে-যায় উত্তরণের আবেদন-নিবেদনে? মন্ত্র সুস্থ হয়ে যাওয়ার পরও তাই চার মাস মেয়েকে ফেরত পেলেন না উত্তরণ। বারচারেক জেরার সম্মুখীন হতে হল ওঁকে। আর প্রতিবারই সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিলেন উত্তরণ, বৈদেহী সম্পর্কে একটিও কথা না বলে।

মহানুভবতা থেকে যে উত্তরণ এমন করলেন, তা নয়। হাসপাতাল থেকে ফেরার পরে যখন অপরিসীম ঘৃণা চেপে ঘটনাটা ব্যক্ত করছেন, বৈদেহী ভয় পেয়ে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মাথা ঠুকছিল। জেরার ভয়ে কান্না, জেলে যাওয়ার ভয়ে কান্না। সেই কান্না শুনতে-শুনতে উত্তরণ বুঝতে পারছিলেন, অভিনয়ের অংশ বাদ দিয়েও মেয়েটার ভয়ের মধ্যে যতটুকু সত্যি আছে, আমেরিকার আইনরক্ষকদের মোচরে সেটা এলে, কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরোবে আর অধিকতর ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে হবে উত্তরণকেই।

বৈদেহীর আসল নাম শালিনী শর্মা। কানপুরে মস্ত বাড়ি ওদের। বাবা বড় ব্যবসায়ী। কিন্তু পড়াশোনায় মোটামুটি ভাল মেয়েটিকে বাড়ি থেকে একরকম জোর করেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় এক রাজনীতিবিদের ছেলের সঙ্গে। সেই ছেলেটি মদ্যপ অবস্থায় জিন্দা জ্বালিয়ে দেওয়ার হুমকি দিত, প্রায় রোজ। রিভলভার বার করে বউয়ের মুখে, বুকে, গলায় বোলাত। সেই রিভলভারে আবার চুমু খেত নিজে। ওইসব খেলা দেখাতে গিয়েই একদিন নিজের রিভলভারের গুলি ছেলেটার গলায় গিয়ে লাগে। সেফটি ক্যাচ খোলা ছিল সেটা খেয়াল করেনি, তাই অন্যকে নিয়ে তামাশা করতে গিয়ে নিজের মৃত্যু ডেকে এনেছিল গুন্ডাটা।

“এই গল্পটাও যে সেই বয়ফ্রেন্ড রুচিরের গল্পের মতো বানানো নয়, কী করে বুঝব?”

“ছেলেটার নাম রুচিরই ছিল স্যার।” বৈদেহী একটা হলুদ হয়ে আসা হিন্দি খবরের কাগজ এগিয়ে দেয় উত্তরণের দিকে।

“কিন্তু তুমি খুন করোনি, তা তো কোথাও লেখা নেই। অবশ্য আমি হিন্দি খুব ভাল বুঝি, তাও নয়।” উত্তরণ সামান্য চোখ বুলিয়ে কাগজটা ফিরিয়ে দেওয়ার সময় বললেন।

“ধরে নিন, আমিই খুন করেছি। কিন্তু আত্মরক্ষার্থে খুন কি অন্যায়? ছেলেটার নামেই তো তিন-তিনটে খুনের মামলা ছিল।”

“এমন ছেলের সঙ্গে তোমার বিয়ে দিল কেন তোমার বাড়ির লোক?”

“ইউপি-এমপি-রাজস্থানের ব্যাপার আপনারা ঠিক বুঝবেন না। ওখানে পলিটিশিয়ানদের মুখের উপর ‘না’ বলা যায় না সবসময়। ওই ছেলেটা মারা যাওয়ার পর, আমার বাবা প্রায় এক কোটি টাকা খরচ করেছে…”

“তোমাকে আমেরিকায় পাঠাতে?”

“শুধু আমাকে পাঠাতেই নয়। অনেককে নিষ্ক্রিয় করতেও।”

“এখন কী চাইছ তুমি?”

“জাস্ট টু স্টে ইন দিস কানট্রি! আমি দেশে ফিরলেই রুচিরের রিলেটিভরা আমাকে মার্ডার করিয়ে দেবে। ফ্যামিলি প্রাইডের জন্য। অবশ্য এখানেও ওদের একজন আমাকে ফলো করছিল। সেটা টের পেয়েই আপনার কাছে গিয়েছিলাম।”

সামান্য তালগোল পাকিয়ে গেল উত্তরণের। গুছিয়ে নিয়ে বললেন, “আমার নামে নালিশটা তা হলে ভুয়ো? সম্পূর্ণ পূর্বপরিকল্পিত?”

“আই অ্যাম রিয়েলি সরি ফর দ্যাট। তবে একটা ধাক্কা না দিলে, আপনার জীবনে এন্ট্রিও তো নেওয়া যেত না। কিন্তু বিলিভ মি, শুধু শেল্টারের জন্য আপনার কাছে যাইনি। আই হ্যাড সামথিং ফর ইউ, হিয়ার।” বৈদেহী নিজের বুকের বাঁদিকে হাত রাখল।

নাটকই মনে হল উত্তরণের। কিন্তু নাটকও কি সময়ে কাঁদায় না মানুষকে?

“আপনি চাইলে আমার ঘাড়ে দোষ চাপাতে পারেন। কিন্তু ওরা আমার অ্যাফিডেভিটের কাগজপত্র ধরে টান মারলেই আমি জলে পড়ে যাব। তখন এই দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে, নয়তো জেলে পচতে হবে।” বৈদেহীর গলা চোক করে এল।

“তোমাকে কিচ্ছু ছাড়তে হবে না। জেলেও যেতে হবে না। মন্ত্রকে যতক্ষণ ফিরে না পাচ্ছি, তুমি এই বাড়িতে থাকতে পারো।”

“আর ফিরে পাওয়ার পর?”

“বাড়িটা থাকবে। যতদিন লোন শোধ দিয়ে যেতে পারব, তোমাকে কেউ তুলে দেবে না।”

“কান্ট উই স্টে টুগেদার?”

“না। কারণ আমি আর এখানে থাকছি না।”

“ইউ আর লিভিং ইউএস?” বৈদেহী হতবাক হয়ে তাকাল উত্তরণের দিকে। বৈদেহীকে উত্তরে যা বলেননি, রাতদিন নিজেকেই তা বলতে শুরু করেছিলেন উত্তরণ। যে আমেরিকায় এসে সব হারিয়েছেন, কেন পড়ে থাকবেন সেখানে? এখানে এসে উত্তরণ হারিয়েছেন সন্ন্যাস, হারিয়েছেন সংসার, হারিয়েছেন স্বপ্নও। আর এই পুরো সময়টার মধ্যে যখনই যে ক’দিনের জন্য দেশে এসেছেন, দেখেছেন যে ওঁর ‘মানুষ’ পরিচয়টাও হারিয়ে গিয়েছে আমেরিকায় থাকেন বলে। দেশের লোক ওঁর কাছ থেকে আশা করেছে আমেরিকার সাবান, শ্যাম্পু, ঘড়ি, কসমেটিকস, চকোলেট। যে জ্ঞানের মাধ্যমে উত্তরণ মানুষের কাছে পৌঁছতেন, সেই জ্ঞান গুরুত্বহীন হয়ে গিয়েছে। মানুষ তাকিয়ে থেকেছে একটা ডলার উগরোনো মেশিন কখন বমি করবে, তার অপেক্ষায়। আর তাই, আবারও ওঁকে ফিরে এসে চড়ে বসতে হয়েছে প্রাণহীন অর্থোপার্জনের নাগরদোলায়।

মন্ত্রকে এই চক্রের মধ্যে তিনি থাকতে দেবেন কেন? মন্ত্রর এমন একটা জায়গায় থাকা দরকার যেখানে কখনও-সখনও ঘণ্টাধ্বনি কিংবা আজান অথবা সংকীর্তনের সুর ওর কানে ঢুকতে পারে। এখানে কোথাও ঈশ্বরকে নিজের মধ্যে মিশিয়ে নেওয়ার বা নিজেকে ঈশ্বরের মধ্যে বিলীন করার তাগিদ নেই। এই যান্ত্রিকতায় কে থাকে?

ভারতের সরস্বতীই তো বৌদ্ধ সংস্কৃতির সূত্রে চিনে মঞ্জুশ্রী নামে পূজা পান। জাপানে তিনিই বেঞ্জাইতেন। নদী, সংগীত, কবিতা — যা কিছু বহমান তারই দেবী সরস্বতী। তা হলে সরস্বতীর চরণ ছুঁয়ে যিনি জীবন কাটাতে চান, তিনিই বা এক জায়গায় আটকে থাকবেন কেন? নায়াগ্রা জলপ্রপাত থেকে কলোরাডোর গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন, মালিবু থেকে মেইন, আমেরিকার সবকিছুর পরিচয় পাওয়া হয়ে গিয়েছে, এবার নতুন তৃণভূমির লক্ষ্যে বেরিয়ে পড়তে হবে।

অধিকাংশ প্রাচীন সভ্যতায় জ্ঞানের দেবতা মাত্রেই নারী। মিশরীয় সভ্যতায় নেইথ আর সেশাত, সুমেরীয় সভ্যতায় নিসাবা, রোমান সভ্যতায় প্রভিদেন্তিয়া আর মিনার্ভা, গ্রিকদের অ্যাথিনা, প্রাচীন পারস্যের আনহিতা… উত্তরণের জীবনে মন্ত্রই বা জ্ঞানের দেবী হবে না কেন? কথা না বলেও, নিজের দুটো চোখ দিয়েই বাবাকে ও এগিয়ে দেবে জ্ঞানচর্চার এ প্রান্ত থেকে ওই প্রান্তে।

তবে সবকিছুর আগে দেশে ফিরে একবার অন্তত মন্ত্রকে ঠাকুরের মুখোমুখি নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাতে হবে। তারপর উত্তরণের জীবন যেদিকে বাঁক নেয় নেবে…

মন্ত্রকে ফেরত পাওয়া আর ওকে নিয়ে দমদমে নামার মধ্যে মাত্র সাত দিন-আট রাত্রি অতিবাহিত হল। হয়তো আরও একটু সময় নিতেন উত্তরণ, কিন্তু সোমনাথ ওঁর আসার পরিকল্পনার কথা জেনে নিজের বইপ্রকাশের অনুষ্ঠানে ওঁকেই প্রধান অতিথি হিসেবে ঘোষণা করে বসল। ব্যাপারটা অপছন্দ হলেও মুখ ফুটে কিছু বললেন না উত্তরণ। যে করে, সে তো কিছু চাইবেও। পুরো জীবনটা তো আর নিজের ইচ্ছায় বাঁচা যায় না। বাঁচা উচিত নয়।

এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে উত্তরণের মনে হল, এত-এত মানুষ মরছে কি শুধু মরবে বলেই? জীবনের একমাত্র ভূমিকা কি মৃত্যুতে শেষ হয়ে যাওয়া? এমনও তো হতে পারে, সেটাই শুরু?।

২৯

প্লেনে বসে ‘উইল টু বিলিভ’ নামে একটা বই পড়ছিলেন উত্তরণ। সবাই একটা বিশ্বাস করার ইচ্ছে নিয়েই এগিয়ে যায়। কিন্তু বিশ্বাস করবে কাকে? অন্ধ যখন রাস্তায় হাঁটে, তার লাঠি লাগে। বধির যখন কিছু শুনতে চায়, তার শক্তিশালী মেশিন লাগে। সেই শক্তি পাওয়া যায় কোথায়? কোন ঈশ্বরের মধ্যে? নাস্তিকদের কথা মতো, সবটাই যদি পরিকল্পনাহীন, ঘটনা-পরম্পরার উপর নির্ভরশীল হয়, তা হলে সেই ঘটনাবলির ভিতর শক্তি সঞ্চয়ের ব্যবস্থাও থাকতে হবে। কোথাও থেকে রিচার্জড না হয়ে তো মানুষ বাঁচতে পারে না।

প্রাথমিকভাবে মানুষের মানুষকে দরকার। যে লোকটা মানুষকে মানুষ হিসেবে পাশে পায় না, সে-ই আরও বেশি করে আশা করে যে ঈশ্বর মানুষের চেহারায় আবির্ভূত হবেন। ঈশ্বরকে মানুষের চেহারায় চায় বলেই হয়তো মূর্তির থেকে গুরু জরুরি হয়ে ওঠেন মানুষের জীবনে। যখন স্কুলদেহে ছিলেন, তখন ব্রহ্মচারী ঠাকুরকেই ঈশ্বর ভাবতেন উত্তরণ। কিন্তু যখন স্থূলদেহে নেই, তখনও তো ঠাকুরই ওঁর ঈশ্বর। থাকা আর না-থাকার মধ্যে তফাত কী ভাবে?

কলকাতায় পা দিয়ে খুব ইচ্ছে হল, মন্ত্রকে নিজের হোটেলে নিয়ে যান, কাছে রাখেন। কিন্তু উত্তরণ আগামী কয়েকদিন চরকিপাকে ঘুরবেন, হোটেলে কে দেখভাল করবে, কথা বলতে না-পারা একটি মেয়ের? ভগবান না করুন, আবার যদি কোনও দুর্ঘটনা ঘটে? জন্মসূত্রে আমেরিকান সিটিজেন মন্ত্রর জন্য ওঁকে জবাবদিহি করতে হবে আমেরিকান সর্বেশ্বরদের কাছে। খুশি না হলে হয়তো আবারও চার মাস বা ছ’মাসের জন্য মন্ত্রকে কেড়ে নেবে ওরা। আর প্রত্যেকটা মুহূর্ত অকল্পনীয় উৎকণ্ঠা আর আতঙ্কে কাটাতে হবে উত্তরণকে। যদি না দেয়, আর কখনও ফেরত না দেয়? তার চেয়ে সোমনাথের ঠিক করে দেওয়া চাইল্ড-কেয়ারেই থাক মেয়েটা। প্রফেশনালদের কাছে রাখার নিশ্চিন্তি অনেক। আবেগের জোয়ারে সেই নিরাপত্তা পাওয়া যায় না।

উত্তরণ যখন বৈদেহীকে জানিয়েছিলেন যে আর ও বাড়িতে থাকছেন না, তখন বৈদেহী ভেবে নিয়েছিল যে দেশটাই ছেড়ে চলে যাচ্ছেন উত্তরণ। তেমনটা ভেবেই হয়তো মন্ত্র ফিরে আসার আগেই আমেরিকার দক্ষিণতম প্রান্তে টেক্সাসের সান অ্যান্টনিয়ো-তে চলে গেল মেয়েটা। কার কাছে, কোথায় গেল, উত্তরণ জানার চেষ্টা করেননি। মেয়েটা ওঁকে মুক্তি দিয়ে যাচ্ছে… এটাই বেশি স্বস্তির কারণ হয়েছিল। পাশাপাশি একটা কৃতজ্ঞতাও জন্ম নিয়েছিল বৈদেহীর প্রতি। মন্ত্র যে সময়টা ফস্টার-কেয়ারে, সেই সময় একদিনের জন্যেও বৈদেহী বিরক্ত করেনি উত্তরণকে। কোনওরকম চেষ্টা করেনি কাছে আসার বা ছুঁয়ে দেখার। বরং নিজেকে পুরো পালটে ফেলে বাড়িটায় একটা ছায়ার মতো থেকেছে। যাকে দেখা গেলেও, যার শব্দ শোনা যায় না।

বৈদেহী চলে যাওয়ার পর তাই একটু শূন্যতাও যেন অনুভব করেছিলেন উত্তরণ। ‘মনের ভিতর কত মনের খেলা। আজ যে পুতুল কাল সে মাটির ঢেলা/ লালন আমার সাঁই, আমি তার চেলা’। বহুদিন আগে ট্রেনে শোনা ভিখিরির গানই সত্যি হয়ে উঠেছিল তখন।

মনে-মনে উত্তরণও আমেরিকা ছাড়তেই চাইছেন তখন। কিন্তু ছেড়ে চলে আসার আগেই, ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভেনিয়া, ‘ইউ-পেন’ নামেই যার খ্যাতি গোটা বিশ্বে, ডাক পাঠাল ওঁকে। সেই ডাক ফিরিয়ে দেবেন উত্তরণ? নাকি আইভি লিগের অংশ হওয়ার যে গৌরব ওঁর প্রাপ্য, তাকে গ্রহণ করবেন? প্রশ্ন ঘাই মারতে থাকল, উত্তরের খোঁজে।

আমেরিকার স্বাধীনতা এবং সংবিধানের ঘোষণা এই ফিলাডেলফিয়ার লিবার্টি বেল ইন্ডিপেন্ডেন্স হলেই হয়েছিল। উত্তরণের সত্যিকারের স্বাধীনতাও কি এই শহর থেকে শুরু হবে? কত আর্ট মিউজ়িয়ম, পাবলিক গার্ডেন, কত ওপেন এয়ার মার্কেট ফিলাডেলফিয়ায়। সিম্ফনি অর্কেস্ট্রা আর খাওয়া-দাওয়ার জন্য এর সুনাম দুনিয়াজোড়া। যে আমন্ত্রণ উত্তরণ পেয়েছেন, তার জন্য তিন জন্ম হা-পিত্যেশ করে থাকে লোকে। মেলের শেষ লাইনে ছিল, ‘উই ইনভাইট ইউ টু দ্য সিটি অফ ব্রাদারলি লাভ।’ দেশে তো ভাইকে হারিয়ে ফেলেছেন উত্তরণ। বিদেশে যদি পান ক্ষতি কী?

পটোম্যাক নদীর পাশ দিয়ে যখন এয়ারপোর্টের দিকে যাচ্ছিলেন উত্তরণ মন্ত্রকে নিয়ে, তখনও সূর্য ওঠেনি ভাল করে। ওঁর মনে হচ্ছিল, অন্ধকারেই আমেরিকা ছেড়ে চলে যাবেন, নতুন সূর্যোদয় ভারত কিংবা জাপানে হবে। সেখানকার দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ও তো চাইছে উত্তরণকে। কিন্তু ইউ-পেনের আমন্ত্রণ নতুন পরিকল্পনা আর পুরনো বিতৃষ্ণা ঘেঁটে দিয়ে আবারও আঁকতে শুরু করেছিল ভবিষ্যতের ছবিটা। আরও একবার আমেরিকাতেই কি শুরু করবেন জীবন? সেটাই কি ঠাকুরের ইচ্ছা? ভাবতে-ভাবতে ওয়াশিংটন ডিসি থেকে প্লেনে উঠেছিলেন মন্ত্রকে নিয়ে। দমদমে নামার পর জার্নি শেষ হলেও, ভাবনা শেষ হয়নি। কী করবেন? কী করণীয়?

কলকাতায় পা রাখার দ্বিতীয় দিনে এত মানসিক আর শারীরিক শ্রম হল, এতবার অতীত থেকে বর্তমানে আর বর্তমান থেকে অতীতে যেতে হল, মনে-মনে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলেন উত্তরণ। সেই ক্লান্তিতে একটু তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়লেন। স্বপ্নে দেখলেন এক মহাপ্রলয়। আকাশ কাজল-কালো। ঘন বিদ্যুতের চমকে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে সবকিছু। সমুদ্র নিজের ঢেউয়ে-ঢেউয়ে পৃথিবীকে গ্রাস করে নিচ্ছে। আর সেই ভয়ংকর বিপর্যয়ের মধ্যে উত্তরণ দাঁড়িয়ে আছেন একা। চতুর্দিকে হিংস্র সব জলজন্তু। যে কোনও মুহূর্তে আক্রমণ করতে পারে তারা। কিন্তু সেই অন্ধকারের মধ্যে একটি শিশু আপন আলোয় উদ্ভাসিত। সেই শিশুর মুখের আভায় ধীরে-ধীরে ফর্সা হয়ে যাচ্ছে সারা পৃথিবী। উত্তরণ স্বপ্নের মধ্যে দেখলেন, শিশুটি হাঁ করল। তার মুখের ভিতরে প্রলয় পূর্ববর্তী পৃথিবীর পুরোটা। আর আলজিভের কাছে সত্যসেবী আশ্রমের প্রবেশদ্বার।

শিশুটি উত্তরণের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল। পরিষ্কার বাংলায় জিজ্ঞেস করল, “আসবে না?”

৩০

সকালে উঠে স্নানের পর জপ-ধ্যান সেরে মন্ত্রর কাছে যাবেন বলে বেরোবেন, উত্তরণ টের পেলেন যে ওঁর কিছু খেয়ে নেওয়া দরকার। ব্রেকফার্স্টের সময়ই অনসূয়ার ফোনটা এল।

“কাগজে তোমার ছবি দেখে সোমনাথদার থেকে তোমার ইন্ডিয়ার নম্বর নিয়ে ফোন করছি। আমি এখন দিল্লিতে।”

“হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটিতে জয়েন করেছ শুনলাম।”

“আমার খবর রাখো তা হলে।”

“ভুল খবর?”

“না ঠিকই। কিন্তু জার্মানি আমার পোষাচ্ছে না। আমি স্টেটসে ফিরে যেতে চাই।”

“কে বারণ করেছে?”

“বারণ না করলেও, ব্যবস্থাও তো করে রাখেনি কেউ। যে বাড়িটা আমার ছিল, সেখানে অন্য একটা মেয়ে…”।

“সেই মেয়েটা বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছে। তুমি চাইলে মেরিল্যান্ডে ফিরতেই পারো। তোমার বাড়ির দরজা কেউ বন্ধ করে রাখেনি তোমার জন্য।”

“ছেড়ে চলে গিয়েছে? তা হলে তোমার জীবনে এখন…”

“কেউ নেই। কেউ ছিলও না। ঘাসের উপর এসে বসলেই ঘাসটা পতঙ্গের হয়ে যায় না।”

“তোমাকে আমি যতটুকু চিনি, তাতে তোমার পক্ষে অন্য কারওর সঙ্গে থাকা কতটা সম্ভব, তাই নিয়ে আমার সংশয় আছে। তাই ভাবি, জীবন তো একটা কোনও মুহূর্তে, তোমাকে আমাকে আবার মিলিয়েও দিতে পারে। যে বাড়িটা দু’জনে মিলে তৈরি করেছি, সেখানে দু’জনেই আবার…”

“তুমি ঠিক কী বলার জন্য ফোন করেছ অনসূয়া?”

“আমি এটা বলার জন্য ফোন করেছি যে মন্ত্রর মা হিসেবে আমি মন্ত্রর বাবার সঙ্গে যখন খুশি কথা বলতে পারি। দরকারে-অদরকারে কাছেও যেতে পারি।”

“অবশ্যই পারো। কিন্তু জীবন আমাকে কখন, কোথায় রাখবে আমি জানি না।”

“কেন, ফিলাডেলফিয়া তো ভাল জায়গা। সেখানে কোনও অসুবিধে হওয়ার তো কথা নয়।”

“ফিলাডেলফিয়ার কথা কে বলল তোমায়?”

“ব্যক্তিগত ব্যাপার-স্যাপার তুমি না জানালে জানতে না-ও পারি। কিন্তু এইসব খবর কি চাপা থাকে?”

“আমি এখনও নিশ্চিত নই, জয়েন করব কি না। মনের মধ্যে একটা দোলাচল চলছে।”

“অবশ্যই জয়েন করবে। তোমার বয়স এখন পঁচিশ নয়। সামনের মাসেই তুমি বাহান্নয় পা রাখবে ভুলে যেয়ো না। সিকিয়োরিটিটাই প্রাইম কনসার্ন এখন।”

“প্রাণীজগতে কারওর কিন্তু কোনও নিরাপত্তা নেই অনসূয়া। বাঘ থেকে হরিণ, কেউ শুয়ে বা বসে থাকলে খেতে পায় না। প্রতিটা দিন প্রতিটা প্রাণীর জন্য অনিশ্চিত। সিকিয়োরিটি মানুষের তৈরি করা একটা মিথ, একটা মিথ্যে। তার পিছনে জীবনভর দৌড়ে মরব কেন বলো তো?”

“তুমি সেই একইরকম পাগল রয়ে গেলে মনে হচ্ছে। তবু একটা কথা আবারও না বলে পারছি না। তোমাকে দেখার পর থেকে প্রতি ক্ষণ আমি শুধু তোমাকেই ভালবেসেছি। এমনকী, রঞ্জিতের সঙ্গে থাকতে-থাকতেও। ফিলাডেলফিয়ার খবরটা কানে আসা ইস্তক আমি খুব এক্সাইটেড। তোমার সাফল্যে নিজের থেকে অনেক বেশি খুশি হতাম চিরকাল। আজও হই। প্লিজ় রিফিউজ় কোরো না অফারটা। অ্যাকসেপ্ট অ্যান্ড জয়েন। আমাকেও কাছাকাছি যেতে হেলপ করো। একটা কাগজে সই করেছি বলে কিচ্ছু বদলায় না। মন্ত্র-আমি-তুমি এক সুতোয় বাঁধা। ছিলাম, আছি, থাকব।”

মন্ত্রকে হাসপাতালে ভর্তি করেই যখন ফোন করেছিলেন উত্তরণ, অনসূয়া ফোনটা ধরতে পারেনি। মন্ত্র যে চার মাস ফস্টার কেয়ারে ছিল, সপ্তাহে একদিন করে খোঁজ নিত। হয়তো বৈদেহী ছিল বলে… হয়তো রঞ্জিতের সঙ্গে সম্পর্কটার চিতা পুরোপুরি জ্বলে ওঠেনি তখনও। হয়তো উত্তরণের অপারগতায় ওঁর প্রতি সঙ্গত ক্ষোভ জমে ছিল অনসূয়ার অন্তরে। হয়তো উত্তরণকেই দায়ী ভাবত, নিজের জীবনের সব দুর্বিপাকের জন্য।

উত্তরণ আর কারওর বিচার করতে চান না।

কারওর বিচারের পরোয়াও করেন না।

ঠাকুর ছাড়া।

৩১

মেয়ের হাত ধরে সত্যসেবী আশ্রমে ঢোকার মুহূর্তে উত্তরণের মনে হল, পরিবর্তন বাদ দিয়ে কিছুই চলতে পারে না, কোনও আশ্রমও নয়। তবু তার ভিতরেই থেকে যায় অনেক কিছু, যা অপরিবর্তনীয়। ওই তো সেই ছাতিমগাছটা, এখনও একইরকম। সারা গায়ে মানতের সুতো নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মানত যাদের পূর্ণ হয়, তারা এসে সুতোগুলো খুলে দিয়ে যাবে, এমনটাই নিয়ম। কিন্তু খুলতে যদি কেউ আসেও, সে কি নিজের বাঁধা সুতো নিজে চিনতে পারে? নাকি যার মানত পূর্ণ হয়েছে, সে মানত পূর্ণ না হওয়া একটা লোকের সুতো খুলে দিয়ে চলে যায়? এই পূর্ণ, অপূর্ণ, পাওয়া, না-পাওয়ার মধ্যেই সবাই বেঁধে রেখেছে ভগবানকে। তাঁরই বা মুক্তি কোথায়? চাইলেও কাকে সরিয়ে দিতে পারবেন তিনি নিজের থেকে? একাত্ম হবেনই বা কার সঙ্গে?

ভজন-কুটির আজ আশ্চর্য ফাঁকা। বহুদিন পর ধুতি-পাঞ্জাবি পরা উত্তরণের শিহরন জাগছিল সেখানে প্রবেশ করতে। ওই রত্নবেদিতেই তো বসতেন ঠাকুর, যেখানে তাঁর জ্যোতির্ময় প্রতিকৃতি রাখা এখন। গলায় রজনীগন্ধার মালা ঝুলছে। স্বয়ং ঠাকুরই যেন বসে আছেন। সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন উত্তরণ, পাদুকায় মাথা রেখে। আমেরিকায় থাকতেই বাবার দেখাদেখি প্রণাম শিখে গিয়েছিল মন্ত্রও। প্রণাম করে উঠে সে-ও উত্তরণের পাশে বসল। অনসূয়ার হাত ধরে যে ভজন-কুটিরে এসে প্রণাম করে যেতে পারেননি, আজ অনসূয়া আর এঁর মেয়ে, মন্ত্রকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে আসতে পেরেছেন উত্তরণ। না-পাওয়ার মধ্যে দিয়েই তো পাওয়া। আনন্দের ভিতর যন্ত্রণা জেগে না থাকলে, সে কেমন আনন্দ?

বেশ কিছুক্ষণ জপ করার পর উত্তরণের মনে হল, আজ ওঁর কণ্ঠস্বর যেমন ঠাকুর অবধি পৌঁছয় না, মেয়েটার আওয়াজও তেমনই পৌঁছয় না নিজের বাবার কাছে। পৌঁছলে সে তো বলতই, চার মাস অন্যের বাড়িতে কেমন ছিল। উত্তরণের মতোই ওঁর মেয়েটাও অসহায়, এই যোগাযোগ অসম্ভব বিশ্বসংসারে।

ভাবনায় ছেদ পড়ল একটি শব্দে। কোথা থেকে এল শব্দটা? উত্তরণ চমকে গিয়ে দেখলেন, ওঁর পাশে বসে মন্ত্র উচ্চারণ করছে, ব্রহ্মচারী ঠাকুরের বীজমন্ত্র। নিখুতভাবে। যে মন্ত্র, উত্তরণ, বিন্দুমাত্র আশা ছাড়া নিজের মেয়ের কানে দিয়েছিলেন এক সকালে, সেই মন্ত্রই ঠাকুরের ভজন-কুটিরে বসে ফিরিয়ে দিচ্ছে ওঁর বোবা মেয়ে। আপাতভাবে এতে অলৌকিক কিছুই নেই। বীজমন্ত্র তো একাক্ষরা; আর বোবারাও এক-দেড় অক্ষর দিব্যি উচ্চারণ করতে পারে। কিন্তু আজ এখানে ওই একটি অক্ষরের উচ্চারণ যেন মহাপৃথিবী আর মহাপ্রকৃতিকে মিশিয়ে দিচ্ছে।

উত্তরণের রোম খাড়া হয়ে উঠল। শরীরের ভিতর দিয়ে চারশো চল্লিশ ভোল্ট বিদ্যুৎ দৌড়তে লাগল। যে মেয়ে কপাল কেটে রক্ত গড়ালেও স্পষ্ট করে বলতে পারেনি কিছু, সে আজ নির্ভুল উচ্চারণ করছে ওই মহামহিম মন্ত্র! ওই বীজমন্ত্র যেন বেদ-উপনিষদের সবক’টা স্তোত্রের অধিক হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে হাওয়ায়। যা উচ্চারণ করা নিষেধ, বাকশক্তিরহিত কন্যার কণ্ঠে তা-ই হয়ে উঠেছে পরম প্রার্থনা। জীবনে আর কী দেখা বাকি রইল উত্তরণের?

ক্ষমা করেছেন ঠাকুর ওঁকে। সব অপরাধ, সমস্ত ভুল, অবান্তর উচ্চাশা, অপ্রয়োজনীয় নেশা, সব ক্ষমা করে দিয়েছেন। আবারও একবার প্রতিষ্ঠার গরাদ ভেঙে জামিন করিয়ে এনেছেন। আর এনেছেন যখন, তখন আবারও সত্যসেবী আশ্রমেই থাকার অনুমতি চাইবেন উত্তরণ। গোয়ালে গোবর সংগ্রহ করবেন, উঠোনের পাতা কাচাবেন, আশ্রমে আসা ভক্ত-শিষ্যদের জুতো সামলে রাখবেন, স্বপনে-শয়নে-জাগরণে নাম করবেন। নাম, তাঁর নাম। নামই শক্তি, নামই মুক্তি।

মন্ত্র, বীজমন্ত্র উচ্চারণ করল আবার। আবারও। উত্তরণ ঠাকুরকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন ফের একবার। তারপর মেয়ের হাত ধরেই উঠে দাঁড়ালেন। দু’জনে ধীর পায়ে একসঙ্গে ভজন-কুটিরের বাইরে বেরোলেন।

‘সিটি অফ ব্রাদারলি লাভ’ ফিলাডেলফিয়া নয়, তা এই সত্যসেবী আশ্রম। এখানেই তো সম্পূর্ণ অপরিচিতরা গুরুর আশ্রয়ে এসে পরস্পরের ভাই হয়ে ওঠে। ঠাকুরও তাই কৈশোরেই এখানে আসা বুবাইকে আবার ফিরিয়ে নেবেন, নিজের রাতুল চরণে। মেয়েটাকে উত্তরণ এখানকার কোনও স্পেশাল স্কুলে পড়াবেন, তারপর বড় হয়ে সে নিজের জন্য কোন দেশ বেছে নেবে, সেটা সে আর তার ঈশ্বর মিলে ঠিক করবে।

গায়ক যেমন নিজের সবথেকে জনপ্রিয় গান রোজ গায় আর রোজই হাততালি পায়, ঈশ্বরের কৃপাও তেমন বারবার করে উত্তরণের জীবনে সত্যি হয়েছে। ওঁর দুঃখ আর অপমানে ঈশ্বর নিজের স্বাক্ষর রেখে গিয়েছেন। সেই স্বাক্ষরে শুধু ইনিশিয়াল নয়, পূর্ণতাও দেখতে পেলেন উত্তরণ আজ। যদি কোনও আঘাত ঠাকুরকে দিয়ে থাকেন, ঠাকুর তাকেও ভালবাসায় বদলে ফিরিয়ে দিলেন। তাই কি ওঁর জীবনে শব্দই হয়ে উঠল মন্ত্র?

কাল সকালে এসে উত্তরণ কথা বলবেন আশ্রমের বর্তমান সভাপতির সঙ্গে। আজকের সন্ধ্যাটা ঠাকুর আর মন্ত্রেরই থাক। ভাবতে-ভাবতে মেয়ের হাত ধরে আশ্রমের গেট পেরোতেই উত্তরণের খেয়াল হল, আজ কোনও প্রণামী ছাড়াই এঁরা দু’জন প্রণাম করে এসেছেন ব্রহ্মচারী ঠাকুরকে। একদম খালি হাতে।

তবে কি আবার ফিরে যাবেন?

তখনই বিদ্যুতের মতো মাথায় ঝিলিক দিল, ঠাকুরেরই একটা কথা।

“আত্মোৎসর্গের থেকে বড় কোনও নিবেদন হয় না, তা জেনো।’

মেয়ের হাতটা শক্ত করে ধরলেন উত্তরণ।

সন্ধ্যার শাঁখ বেজে উঠল চরাচরে।

 

 

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত