‘ঈশ্বরী’ বিনয় মজুমদার ও তাঁর এক পাঠকের আত্মদাহের আখ্যান
‘ঈশ্বরী’ বিনয় মজুমদার ও তাঁর এক পাঠকের আত্মদাহের আখ্যান ।। আলতাফ পারভেজ
এক.
বিনয় মজুমদারের জন্ম ১৯৩৪ সালে। বর্মায়। দৈহিকভাবে পৃথিবী ছেড়ে গেছেন ২০০৬ সালে; ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। আর পাঠক আমার সঙ্গে তাঁর ‘পরিচয়’ ঢাকায়। সময়ের হিসাবে এ লেখার ছয় মাস আগে! আবেগময় এই পরিচয়পর্ব। তারই খানিকটা টীকা-টিপ্পনী-কৈফিয়ত এ লেখা।
রাজনীতি ও সাংবাদিকতার ভেতর দিয়ে লেখক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার প্রায় ব্যর্থ এক সাধনা ছিল আমার। সচেতনভাবেই রাজনীতিমনষ্ক গবেষণা-সাহিত্যের চৌহদ্দিতে আটকে থেকেছি। এরূপ লেখার বিষয়গত এবং কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা বিস্তর। ব্যক্তিগত আবেগ, পছন্দ, প্রবণতা, আত্মকথা তাতে ঠাঁই পায় সামান্যই। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ও গবেষণা সাহিত্যের এইতো রীতি!
কিন্তু জীবন তো পূর্বনির্ধারিত কাঠামোগত কিছু নয়। কখনো কখনো অচেনা গ্রহণ লাগে তাতে। অকস্মাৎ সুনামিতে ঢেউ বয়ে যায়। রঙধনু ওঠে। সত্তার অনেক রুদ্ধ প্রকোষ্ঠ খুলে যায় কারো প্রভাবে। আয়নায় নিজেকে দেখে চমকে উঠতে হয় তখন। জীবন এত রহস্যময় আর বৈচিত্র্যে ভরা বলেই তা চিরতন্বী। চির অধরা। চির সবুজ। গবেষণা-গদ্যের বাঁধনে ঐ তন্বী সবুজ কিংবা গ্রহণকালের বেদনাকে ধরা যায় কই?
সেজন্যই বোধহয় জন্ম হয়েছিল আদি শিল্পকলা-সঙ্গীত, সুর, খোদাই শিল্প, নৃত্য, কবিতা ইত্যাদি। এর মাঝে জীবনের বিশেষ ঘোর লাগা সময়ের আবেগ ধারণ করার ক্ষেত্রে কবিতাই সবচেয়ে লোকপ্রিয় মাধ্যম। এর আবেদন চিরায়ত। সহজিয়া। লাখো কোটি বছরের প্রার্থনা ও প্রেমের নির্যাস বয়ে চলেছে হাজারো ভাষার মানবিক ভাব-সাহিত্য। আজও তার কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নেই এক্ষেত্রে। যার সমর্থন মেলে মনোবিজ্ঞানেও। ‘মানবিক ইঙ্গিত’[mating signal] বোঝার আকুলতা থেকেই ভাষা ও বর্ণের জন্ম।
একজন গদ্যলেখক হয়েও তাই কবিতার ভেতর নিজেকে সঁপে দিতে হয়েছে অবলীলায়, অনিবার্যতায়। যদিও তা একান্ত ব্যক্তিগত পরিসরে। তবে বিচ্যুতি ঘটেছিল এই-ব্যক্তিগত সেসব কথোপকথনই কিছুকিছু, দু-চারটি যোগাযোগ মাধ্যমেও প্রকাশিত হয়ে পড়ে।
নিজস্ব আবেগের এই প্রকাশটুকুও মানবিক বৈকি। প্রাচীন গুহাচিত্র, লুপ্তপ্রায় ভাষার কোন অচেনা সুর, মাটিখুড়ে পাওয়া প্রত্ন-নিদর্শনের ক্ষয়ে যাওয়া কোন কাঠামো-এরূপ সবকিছুই মানবিক আবেগের ব্যক্তিগত প্রকাশ বৈ তো নয়। যা পুরোপুরি একজনের হয়েও সকলের দৃশ্যগ্রাহ্য হতেও সম্মত। প্রায় পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই বয়সে গদ্যলিখিয়ে আমাকে দিয়ে তাই কবিতা লিখিয়ে নিতে থাকেন অশরীরী কেউ। আর তার অনেক কয়টি আমি যোগাযোগ মাধ্যমেও জমা রেখেছি মহাকালের সাক্ষী হিসেবে। যেমন এ বছরের ১৯ জানুয়ারিতে লিখেছিলাম:
মানুষের বধ্যভূমি পেরিয়ে
কবে থেকে, পরিষ্কার করে বলা কঠিন-
তবে হাঁটতে ভালো লাগে।
ক্লিফটন বিচ থেকে নূরউদ্দীন খান রোড,
তোপখানা-পল্টন হয়ে মোহাম্মদপুর;
মন চাইলে কক্সবাজার রোড ধরে আরও দক্ষিণে।
অনেক কণ্ঠস্বর ভুলে গেছি,
অনেক বারবণিতাকে আর দেখি না-
দল বেঁধে রক্ষিতা হয়ে গেছে তারা;
তাদের মগজের মাপজোখ দেখবো হয়তো
সংবাদপত্রের এডিটরিয়্যালে, বিশেষ সংখ্যায়।
অন্ধকারে সাঁতারের অভিনয় করছে গ্লুকোমা রোগীরা-
অনুবাদ-অসাধ্য বোবাসুখের অভিব্যক্তি নিয়ে।
রেনাল্ট জীপে তাদের ইনসুলিন,
গেরুয়া বাহিনীর ব্যস্ততায় সন্ত্রস্ত সন্ধ্যা।
তবু হাঁটতে ভালো লাগে।
নতুন ব্রিজ পেরোতেই প্রজাপতির ডানায় দেখি
কল্লোলিনী রঙবিলাস;
কুয়াশার দিন শেষ হবে জানি- কোন এক মাঘের শেষে,
ঘুম ভেঙ্গে দেখবে পাখিরা
হাঁটছি আমি আর ঈশ্বরী
মানুষের বধ্যভূমি পেরিয়ে।
১১ মাঘ, ১৪২১
করাচির ক্লিফটন বিচ থেকে কক্সবাজার রোডের নতুন ব্রিজ পর্যন্ত মাত্র এই কবিতার ভোগলিক পরিসর। ইতিহাসের এই সময়টি ‘মানুষের বধ্যভূমি’তে রাজনীতির এমন বোবাসময় পেরোচ্ছিল যে, তাকে আর ‘রাজনীতিমনষ্ক গদ্য’-এর গাথুনিতে ধরা যাচ্ছিলো না। প্রয়োজন ছিল অতিরিক্ত কিছুর। ঠিক একই সপ্তাহে আরেকটি কবিতা লিখিত হয় এরকম:
খাপছাড়া অবরোধের কালে
বসন্তের কাল আসবে কি আর-এসব হিমরাত পেরিয়ে?
ঈশ্বরী বলতো, ‘কবিদের অপেক্ষায় মানায়।’
অগ্রহায়ণ-পৌষ পেরুলো, তার বাংলোর কার্নিশে
কোন উদ্ভিদের আশ্বাস দেখেছো কি-হে দক্ষিণের বাতাস?
বাসের গ্লাস সরিয়ে কবে সে দেখবে
মুগ্ধ আলোয় কর্ণফুলীর জল
কত ভালোবেসে তাকে দেখে।
খবরের কাগজের কথা জানি,
ইকবাল রোডের আড্ডায় রমেন বিশ্বাসও বলেছে একদা-
কালিম্পঙের পাহাড় কেবল রোদের ভেতর দিয়ে
চোখে এসে আদর করে।
স্বপ্নের ঘোরে তাই বসন্তরোদের জন্য জেগে থাকি।
খাপছাড়া অবরোধের কালে এসব ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া
কবি ও কবিতার চির পরম্পরা।
বিশেষ কোন ঋতুশৃঙ্গ জয় করতে
পারে না তারা কোনদিন।
৬ মাঘ ১৪২১
এই দুটি কবিতা এবং আরও কিছু কবিতা প্রকাশের পরই আমার কবি বন্ধুরা মনে করেছেন আমাকে তাদের কিছু বলার আছে। কবিতাগুলোতে প্রকাশিত সাধারণ এক ব্যক্তিমানসের সমকালীন মনোজাগতিক টানাপোড়েন নয়- তাঁদের বিশেষ নজরে আসে ‘ঈশ্বরী’শব্দটি। তারা আমাকে বিনয় মজুমদারের কাব্যকৃর্তির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পাশাপাশি কবিতার রাজ্যে অনুপ্রবেশের জন্যও নীরব প্রশ্ন এবং ঔৎসুক্য ছিল তাদের চোখে-মুখে। আমি তাদের বার্তা বুঝেছি। কারণ সেগুলো নির্দেশের মতোই ছিল।
দুই.
পরিণত বয়সে জীবনানন্দ দাশ প্রায় একচেটিয়াভাবে মনযোগ আটকে রাখলেও ছাত্রাবস্থা থেকে খুঁজে খুঁজে কবিতার বই পড়ছি। কিন্তু এই মধ্যবয়সেও বিনয় মজুমদার ছিলেন আমার অচেনা। অজানা। এটা আমাকে বিস্ময় আর লজ্জার সাগরে ডুবিয়েছে। তাই ২০১৪ সালে কবিবন্ধুদের কল্যাণে আমি বাংলার কাব্যজগতের পুরানো এক ভাব-সমুদ্রের সন্ধান পাই- নতুন করে। এরপর প্রতিদিন বিনয় একটু একটু করে গ্রাস করে নিতে শুরু করেন। এই অধ্যয়ন ও আসক্তিকালে সবসময়ই মনে হয়েছে, বিনয় এই বাংলাদেশে এত কম পঠিত-কম আলোচিত কেন? যে দেশে এত কবি এবং ভাবুকতার এত দাপট, যেখানে গদ্য-পদ্য সর্বত্র কোলকাতাকেন্দ্রিক সাহিত্য-তারকারা প্রায় ঈশ্বরতুল্য; তাদের একজন হয়েও বিনয়কে কেন এই মধ্যবয়সে এসে কেবল পাঠ করতে হচ্ছে আমাকে? এমনকি তার ওপর লেখাজোখাও কেন ঢাকায় এত দুর্লভ? অথচ তরুণ বয়সেও জন্মভূমি ফরিদপুরে এসে থেকে গেছেন কিছু দিন তিনি।
অনেক খুঁজে তাঁকে নিয়ে করা ‘লোক’নামের একটি লিটলম্যাগাজিনের বিশেষ সংখ্যা পেলাম। আর কিছুদিন পর তাঁর কাব্যসমগ্র যোগাড় করে দিলেন আরেক তরুন কবি এহসান হায়দার। তারপর আরেক তরুণ বন্ধু মাসুদ রানা কিনে হাজির করলেন আকাশ বিশ্বাসের লেখা বিনয়ের ওপর রচিত পুরোদস্তুর এক গবেষণাগ্রন্থ। ‘লোক’ব্যতীত আর সবই কোলকাতা থেকে প্রকাশিত।
এসব চটজলদি খোঁজাখুজিতে যা দেখেছি, পুরোপুরি কবিতার জন্য উৎসর্গকৃত এক জীবন বিনয়ের। বিস্ময়করভাবে তাঁর কবি জীবনের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে ব্যক্তিজীবন। প্রায় কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছেন তিনি জীবিত অবস্থাতেই। আবার কিংবদন্তীতুল্য নীরবতার আড়ালও আছে তাঁকে ঘিরে। আজও সেই নীরবতা জারি আছে।
তের বছর বয়স থেকে কবিতা লিখেছেন বিনয়। ১৯৪৭ সালে তাঁর কবিতা প্রথম মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত হয়। সালটি বাংলার জীবনে যেমন ঐতিহাসিক তেমনি বিনয়কে বোঝার জন্যও প্রতীকী। ব্যক্তিজীবনে বিনয় বারবার উদ্বাস্তু হয়েছেন। বার্মা-পূর্ববঙ্গ-পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে যুদ্ধ আর দাঙ্গার স্মৃতি নিয়ে বারবার আবাসস্থল পাল্টাতে হয়েছে মজুমদার পরিবারকে। বর্মায় তাঁর কৈশোর যেরকম নাজুকভাবে শুরু হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে জীবনের শেষদিনগুলো ততোধিক নাজুকতার মধ্যদিয়ে পার করেছেন তিনি। জীবিত অবস্থাতেই তিনি কবিতার ‘সমাহিত আগ্নেয়গিরি’আখ্যা পান এবং তা ছিল যথার্থ। বিনয়ের ডাক নাম ছিল মংটু। বর্মি ভাষায় যার অর্থ ‘বাচ্চা ছেলে।’প্রকৃতই এক বাচ্চা ছেলের মতো জীবনের সকল অধ্যায় ক্ষত-বিক্ষতভাবে পার করে বাংলা কবিতার সবচেয়ে বেদনাদায়ক দীর্ঘশ্বাস হয়ে আছেন তিনি।
স্বভাবত প্রশ্ন ওঠে, কী ছিল বিনয়ের কবিতায় ও জীবনে যা তাঁকে কবিতার শহীদে পরিণত করেছিল এবং কেন আজো তিনি চরমভাবে বিশিষ্ট; কিন্তু মূলধারায় অনেকখানিই অনালোচিত। এর সহজ উত্তর হলো নিজ ব্যক্তিজীবনের এক বাস্তব প্রেম ও বিরহগাথাকে বিনয় ৭৭টি কবিতায় এক মহাকাব্যিক চিত্রকল্পে পরিণত করে নিজেই নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নিজেকে আড়াল করে নিয়েছেন। এই ‘আড়াল’ছিল সাহিত্যের নাগরিক এস্টাবলিশমেন্ট থেকেও।
গ্রাজুয়েশনে প্রথম স্থান পাওয়া গণিতজ্ঞ তিনি। কিন্তু বিরহকে কবিতায় রূপ দেবেন বলে নিজ জীবনকে বাজি ধরেছিলেন অবলীলায়। সে বাজিতে অকল্পনীয় এক সফলতা তাঁর। কিন্তু সেই সফলতা তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল সাফল্য-ব্যর্থতার প্রচলিত হিসাব থেকে বহুদূরে। মধ্য বয়সেই, এক পর্যায়ে ‘সার্টিফাইড লুনাটিক’-এ পরিণত হন বাংলা কবিতার এই কিংবদন্তী।
হ্যাঁ, এও উল্লেখ্য বটে, যার জন্য বিনয়ের জীবনে এতসব ঘটনা-দুর্ঘটনা তিনি গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক। বিনয়ের ‘ঈশ্বরী’ তিনি। ১৯৪২ সালে জন্ম নেয়া এবং প্রেসিডেন্সি কলেজে ইংরেজিতে প্রথম শ্রেণিতে [বিনয় সেসময় শিবপুর থেকে পেয়েছিলেন গণিতে একইরূপ ফলাফল] উত্তীর্ণ এই নারী এখন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের জগত-খ্যাত অধ্যাপক। বর্তমান বিশ্বের অন্যতম ‘ক্রিটিক্যাল থিওরিস্ট’হিসেবে অভিহিত করা হয় তাঁকে। চিন্তারাজ্যে কলোনিয়াল কাঠামোর বিকল্প হাজির করার মধ্যদিয়ে নিজেকে তিনিও বিনয়ের মতোই প্রায় জীবন্ত কিংবদন্তীতে পরিণত করেছেন। ভারত সরকার তাঁকে সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক দিয়েও সম্মানিত করেছে।
এই গায়ত্রীই বিনয়ের কবিতা-প্রেম-বিরহ-আত্মদহনের উৎস ছিলেন। হিন্দু হস্টেলে থাকার সময় বিনয়ের সংগে তাঁর পরিচয়। তখন বিনয়ের বয়স ছিল ১৭ আর গায়ত্রীর ১২-১৩। বিনয়ের শিক্ষক জনার্দন চক্রবর্তীর বাসায় থাকতেন গায়ত্রী। গায়ত্রীর পিতা ছিলেন পরেশ চক্রবর্তী।
গায়ত্রী সম্পর্কে বলতে যেয়ে বিনয় বলেছেন, ‘মাঝে মধ্যে কথা হয়েছে’। মুখ্যত ‘কবিতা নিয়ে।’ হিন্দু বর্ণপ্রথা সেই আলাপ-পরিচয়কে খুব বেশি পাখা মেলতে দেয়নি। জনার্দন চক্রবর্তী শিক্ষকতার পাশাপাশি পুরোহিতের দায়িত্বও পালন করতেন। আর বিনয়রা ছিলেন পূর্ববঙ্গীয় ‘মৃধা’। ‘চক্রবর্তী’ আর ‘মৃধা’র বর্ণ-ব্যবধানটি ছিল অ-নে-ক।
বিনয়ও নিজেও গায়ত্রীকে কোন ‘ব্যাকুলতা’টের পেতে দেননি পারস্পরিক আলাপনে। কিন্তু এইরূপ অবদমিত ব্যাকুলতা স্নাতক পরবর্তী জীবনে এসে যে রক্তপাতের জন্ম দেয় তারই বিবরণ বিনয়ের কাব্যগ্রন্থ ‘ফিরে এসো চাকা’- যা বাংলা কবিতার অমূল্য এক সম্পদে পরিণত হয়েছে। ততদিনে বিঞ্চু দে এবং জীবনানন্দের ছন্দ-ভাষা-মেজাজ থেকে বেরিয়ে বিনয় খুঁজে পেয়েছেন নিজের কাব্যরূপ ও ভঙ্গী। ৪+৪+৪+২ মাত্রায় নিজের আকুলতাই যে তিনি লিখেছেন! স্বয়ং তার সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন, ‘আমি অন্য কাউকে নিয়ে কবিতা লিখিনি। লিখেছি আমাকে নিয়ে। এগুলো আমার দিনপঞ্জি।’
দিনপঞ্জিরূপ কাব্যগ্রন্থ হিসেবে ‘ফিরে এসো চাকা’রও অনেকখানি অদ্ভুত ইতিহাস আছে। যা একাধারে বিরল ও বিনয়রূপী পাগলামিতে অভিনব। ১৯৬২ সালে মাত্র তিন মাসের মধ্যে তিনি লিখেছিলেন এই কবিতাগুলো। তবে গায়ত্রীকে নিয়ে প্রথমে লিখেন তিনি ১৯৬১ সালে। মাত্র ১৪টি কবিতা নিয়ে ‘গায়ত্রীকে’ নামে সেই গ্রন্থটি দুর্গাপর স্টিল প্লান্টে প্রকৌশলীর চাকুরিরত অবস্থাতেই লেখা। বিনয় সরাসরি বলেও নিয়েছিলেন, ‘এই কবিতাগুলো গায়ত্রীকে উৎসর্গকৃত।’ কিন্তু এখানেই থামতে চাইলেন না। ততদিনে বন্ধ হয়নি যে রক্তপাত! পরের বছরই বছর বের হলো একই জনকে নিয়ে লেখা ‘ফিরে এসো চাকা’১৯৬৪ সালে লিখলেন ‘আমার ঈশ্বরীকে’। আবার ১৯৬৫ সালে, ‘ঈশ্বরীর কবিতাবলী।’
এই যে চারটি গ্রন্থ- তাতে কিন্তু অনেক কবিতা পুনঃপুন প্রকাশিত হচ্ছে। কিছুটা সম্পাদিত হচ্ছে। কিছু কিছু বাদও পড়ছে। কিন্তু কবিতার লক্ষ্য একই থাকছে। একজনকে নিয়েই- একই আবেগ, একই বেদনা, একই হাহাকার আর নীরবতাই এসব স্বল্পকালীন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মূল অধ্যায়। যার শুরু বলা যায় ১৯৬১ এবং শেষ ১৯৬৫। অর্থাৎ কোন-এক-‘ঈশ্বরী’কে নিয়ে কোন-এক-বিনয় মজুমদারের রোদনকাল বস্তুত চার বছরের। আর বাংলা কবিতায় এই বিনয়নামার মুখ্য ফলাফল : ‘ফিরে এসো চাকা’[পড়ুন ফিরে এসো গায়ত্রী চক্রবর্তী]। বিনয় নিজে এইরূপ প্রক্রিয়াকে একই কবিতার নতুন নতুন ‘সংস্করণ’ বলেছেন। উপরোক্ত চারটি শিরোনামে প্রায় একই অভিজ্ঞতার আবর্তন দেখবো আমরা। সমালোচকরা একে বলেছেন, বিনয়ের ‘ঈশ্বরী’নামক প্রহেলিকা। আর বিনয় নিজে বলেছেন, ‘এইসব কবিতা ঈশ্বরীর রচিত-আমি লিপিকার মাত্র।’ হেয়ালি করে নয় সিরিয়াসলিই বলেছেন তিনি এ কথা।
১৯৬০-এর ৮ মার্চ মাসে এই পর্যায়ের প্রথম কবিতাটি লিখেন বিনয়।
একটি উজ্জ্বল মাছ একবার উড়ে
দৃশ্যত সুনীল কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে স্বচ্ছ জলে
পুনরায় ডুবে গেলো-এই স্মিত দৃশ্য দেখে নিয়ে
বেদনার গাঢ়রসে আপক্ক রক্তিম হ’লো ফল ।
বিপন্ন মরাল ওড়ে, অবিরাম পলায়ন করে,
যেহেতু সকলে জানে তার শাদা পালকের নিচে
রয়েছে উদগ্র উষ্ণ মাংস আর মেদ ;
স্বল্পায়ু বিশ্রাম নেয় পরিশ্রান্ত পাহাড়ে পাহাড়ে;
সমস্ত জলীয় গান বাষ্পিভূত হ’য়ে যায়, তবু
এমন সময়ে তুমি, হে সমুদ্রমৎস্য, তুমি…তুমি…
কিংবা, দ্যাখো, ইতস্তত অসুস্থ বৃক্ষেরা
পৃথিবীর পল্লবিত ব্যপ্ত বনস্থলী
দীর্ঘ-দীর্ঘ ক্লান্তশ্বাসে আলোড়িত করে;
তবু সব বৃক্ষ আর পুষ্পকুঞ্জ যে যার ভূমিতে দূরে দূরে
চিরকাল থেকে ভাবে মিলনের শ্বাসরোধী কথা ।
প্রেমে পড়েছিলেন বিনয়। কিন্তু সে প্রেম তাঁকে একাকি করে ফেলেছিল। সঙ্গে ছিল উদ্বাস্তু জীবন, বর্ণপ্রথার নীরব আড়াল। লাজুক যুবক পুরোহিত কন্যা গায়ত্রীকে কিছু জানাতে না পারার যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়ে নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন কবিতায়। আর ঈশ্বরীকে নিয়ে কবিতাগুলো লেখা শেষে চাকুরি ছেড়ে পুরোদস্তুর কবি তিনি। সঙ্গে পুরানো, চিরচেনা নিজেকেও হারিয়ে ফেলেন চিরতরে। তাঁকে নিয়ে তখন সর্বত্র ফিসফাস। বিবিধ মিথ। বলা হচ্ছে ‘কল্লোলযুগ’পরবর্তী নতুন এক ঝলক এসেছে- ‘হাংরি জেনারেশন।’ শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার- এরা হলেন যার প্রতিভূ। কিন্তু এসময়টিতে বিনয়কে মাঝে মাঝেই যেতে হচ্ছিলো মানসিক হাসপাতালে। এদিকে গ্রন্থগুলোরও একের পর এক সংস্করণ বের হচ্ছে। কিন্তু নিজের কবিতার রিভিউ দেখে বলে উঠেন, ‘আমার কবিতা বুঝতে পারে কেবল একজনই। যাকে নিয়ে সেগুলো লিখিত।’ কবি এখানে দ্বিধাহীন। কবি স্বীকৃতির জন্য নয়-ব্যক্তিগত দহন সামলাতে সামলাতে‘ঈশ্বরীকে’ যেভাবে আরাধনা করেছেন সেগুলোই আগ্নেয়গিরির উৎসমুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। ‘ফিরে এসো চাকা’র একেবারে শেষে ১৯৬২ সালের ২৯ জুন কবি ‘ঈশ্বরী’র উদ্দেশে বলছেন-
২৯ জুন ১৯৬২
কবিতা বুঝিনি আমি; অন্ধকারে একটি জোনাকি
যত্সামান্য আলো দেয়, নিরুত্তাপ, কোমল আলোক।
এই অন্ধকারে এই দৃষ্টিগম্য আকাশের পারে
অধিক নীলাভ সেই প্রকৃত আকাশ পড়ে আছে-
এই বোধ সুগভীরে কখন আকৃষ্ট ক’রে নিয়ে
যুগ যুগ আমাদের অগ্রসর হয়ে যেতে বলে,
তারকা, জোনাকি-সব; লম্বিত গভীর হয়ে গেলে
না-দেখা গহ্বর যেন অন্ধকার হৃদয় অবধি
পথ ক’রে দিতে পারে; প্রচেষ্টায় প্রচেষ্টায়; যেন
অমল আয়ত্তাধীন অবশেষে ক’রে দিতে পারে
অধরা জ্যোৎস্নাকে; তাকে উদগ্রীব মুষ্টিতে ধ’রে নিয়ে
বিছানায় শুয়ে শুয়ে আকাশের, অন্তরের সার পেতে পারি।
এই অজ্ঞানতা এই কবিতায়, রক্তে মিশে আছে
মৃদু লবণের মতো, প্রশান্তির আহ্বানের মতো ।
না বিনয়ের শেষ পরিণতি প্রশান্তির মতো ছিল না। ছিল করুণ। ‘ঈশ্বরী’ তাঁর ফিরে আসেনি। বিনয়ও হয়তো তেমন কিছু চাননি। নিজের যন্ত্রণাটুকুর প্রকাশই ছিল হয়তো তার মূল এবং একমাত্র লক্ষ্য।
এই সমর্পণ প্রক্রিয়ার একটি অবকাঠামোগত দিকও আছে। তের বছর বয়স থেকে লিখলেও কোলকাতায় তিনি নিজের কাব্যগুণকে পুরো প্রকাশ্যে আনতে দ্বিধান্বিতই ছিলেন শুরুতে। কিন্তু একাধারে নিরন্তর সাহিত্যপাঠ, সাম্যবাদী রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা এবং সমকালীন শ্রেষ্ঠ কবিদের সঙ্গে কফি হাউজে নিয়মিত আড্ডার মধ্যদিয়ে বিনয় কবিতা নিয়ে ঝুঁকি নেয়ার জন্যও যেন তৈরি হচ্ছিলেন। ততদিনে শক্তি বিনয়কে উৎসর্গ করে ফেলেছেন তাঁর একটি কবিতাগ্রন্থ। এও বোধহয় আগাম স্বীকৃতিই ছিল। গণিতজ্ঞ হলেও বিনয়ের অস্থিমজ্জার কাব্যরূপটি আশেপাশের প্রতিভাধর সকল কবির জানা হয়ে গিয়েছিল ততদিনে।
ফলে ব্যক্তিগত আত্মদাহ যখন ১৯৬০-এর দিকে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে ওঠে; আর কবিতার ‘ছন্দে নিজের পথ’ খুঁজে পাওয়ার শক্তি অর্জন করেছেন বুঝতে পারেন- তখনি তিনি ‘চাকুরি-জীবন’ ছেড়ে কবিতায় সমর্পিত হয়ে পড়েন। শক্তি চট্টোপাধ্যায়, উৎপল বসুসহ সমকালীন অন্যদেরও উৎসাহ-উস্কানি-অনুপ্রেরণা ছিল এক্ষেত্রে। কারণ সকলি তাঁরা টের পেয়েছিলেন গণিতজ্ঞ বিনয়ের আত্মদাহের আখ্যান সাহিত্যে কী ঘটাতে যাচ্ছে।
বৃথা যায়নি তাঁদের সেই উস্কানি। কিন্তু কেবল একটি জীবনের অপচয় ঘটলো। বাংলা পাঠক পেয়েছেন ফিরো এসো চাকার মতো চিরায়ত এক কাব্যপৃথিবী। কিন্তু মহাকালের জানা হয়নি কেন ও কীভাবে এভাবে ৭০-৮০টি কবিতা লিখতে লিখতে বিনয় অগ্নিকা- থেকে ভস্ম হয়ে গিয়েছিলেন। এরপর ১৯৬৪ থেকে ১৯৭০; মাসে মাসে পিতার দেয়া এক শত টাকায় চলতেন বিনয়। এরপরের অধ্যায় যে কত করুণ যে কেউ ইউটিউবে [https://www.youtube.com/watch?v=gfDe4NUj7sI] ঢুকে বিনয় মজুমদারকে নিয়ে তৈরি নাতিদীর্ঘ ২-১টি অসম্পাদিত প্রামাণ্যচিত্র দেখলেই বুঝবেন।
বিনয়ের সকল সময়ের বন্ধু জোতির্ময় দত্ত-এর মন্তব্যটুকু এখানে তাই খুবই প্রাসঙ্গিক মনে হয়:
‘একজন বেদনার্ত, সত্যদ্রষ্টা কবি বিনয় মজুমদার- যিনি কবিতায় নিজেকে নিঃশেষ করে দিয়েছেন। তিরিশের কবিদের পর বিনয়ের আবির্ভাব বাংলা কবিতার প্রধানতম ঘটনা।’
আর শক্তি চট্টোপাধ্যায় ‘ফিরে এসো চাকা’র রিভিউতে বলেছেন, বিনয় হলেন, ‘মাটিতে বন্দি বিচ্ছিন্ন গাছের মতো।’
তিন.
বিনয় আসক্তি থেকে জানি উপরের নাতিদীর্ঘ বিবরণে বিনয় সম্পর্কে আসলে কিছুই বলা হলো না বরং শক্তি চট্টোপাধ্যায় ৫টি শব্দে হয়তো অনেকখানি বলে দিয়েছেন- বিনয় হলেন ‘মাটিতে বন্দি বিচ্ছিন্ন গাছের মতো।’ তিনি কবিতা লিখতে জানতেন। কিন্তু ‘ফিরে এসো চাকা’ কী কেবলি কবি হওয়ার কোন প্রচেষ্টার সফলতা? না-কি এ চিরায়ত এক মানবিক হাহাকারের শিশুতোষ প্রকাশ? যে শিশু কোন এক ‘ঈশ্বরী’র ভ্রুক্ষেপহীনতায় অসহায়, পাশাপাশি আত্মরক্ষায় অসমর্থ।
কে বিনয়কে ভূতগ্রস্ত করে তুলেছিল? কবিতার প্রতি দায়বদ্ধতা? নাকি কোন এক মানবী? বিনয় কী পোয়েট; না এন্টি-পোয়েট? এসব প্রশ্ন সাহিত্য ভাবুকদের নিশ্চয়ই ভাবাবে অনাদিকাল ধরে।
কিন্তু আমার মতো পাঠক বিনয়ের মাঝে পায় নিজস্ব টানাপোড়েনের গভীরতর সম্মতি। বিনয়কে তাই তখন আর স্রেফ কবি হিসেবে দেখা যায় না। তাঁকে দেখতে হয় বাংলা সাহিত্যের প্রথম এক প্রকাশ্য প্রেমিক তরুণ হিসেবে। ব্যক্তিক মুক্তির জন্য যিনি কবিতার মাঝে নিজেকে নিক্ষেপ করেছিলেন। কিন্তু তাতে কবিতাই মুক্তি পেয়েছে তিনি নন। পাঠকের ক্ষেত্রেও একইরূপই ঘটে।
জীবনানন্দ দাশ বাংলা কবিতার পাঠককে ‘লাশকাটা ঘর’-এ যে ধূসর পৃথিবীর বিষন্নতায় দাঁড় করান- বিনয় তাকেই বাস্তব জীবনের শূন্যতায় মেলবন্ধন ঘটিয়ে দেখিয়েছেন- জীবন কত বিষন্নতায় ভরা!হায়, নাগরিক যান্ত্রিক জীবন যদি তা জানতো! যদি জানতো- কত প্রেমহীন, নিরাপত্তাহীন তা! আর এ সত্ত্বেও জনস্রোতের মাঝেই সংবেদনশীলদের নিজস্ব নির্জনতা তৈরি করে নিতে হয়। একাকিত্বের এই বলয় ছাড়া বিশুদ্ধতার আজ আর কোন রক্ষাকবচ নেই। এর নামই বোধহয় ‘অস্বাভাবিক আচরণ’! কবিতা সেক্ষেত্রে কি উত্তম কোন সুরক্ষা? উত্তর হলো- হ্যাঁ।
কোন এক ঈশ্বরীর ভাবনাকে নৈব্যক্তিক রূপ দিয়ে বাংলার ভাব-ঐতিহ্যে নিজের ঠাঁই করে নেয়া মোটেই যে বিনয়ের আরাধনা ছিল না সেটা তাঁর কবিতাত্তোর জীবনই সাক্ষী। তিনি খোদ একটি গ্রন্থেরই নাম রেখেছিলেন, ‘আমি গণিতের শূন্য’। প্রেমে যে ব্যক্তির বিনাশ ঘটেছে কবিতায় তাকেই কেবল মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন তিনি সুকোমল পয়ারের অক্ষরবৃত্তে। পৃথিবীর মহত্তম এক প্রেমিক বলা যায় তাঁকে। যিনি ব্যক্তি-অন্তরের প্রচণ্ডতম আবেগকে শব্দ আর ছন্দে জমা রেখেছেন মহাকালের গর্বে। বাংলা কবিতায় এইরূপ রসায়নের এত খুনেরাঙা প্রকাশ আর দেখা যায় কমই। আপাদমস্তক যা আত্মবিলাপ। হার্দিক কন্ফেসন। বিনয়ের ঈশ্বরী তাই তাঁর কোন এক পাঠকের‘ঈশ্বরী’কেও প্রতিস্থাপন করেন অবলীলায়। কারণ চরাচরপ্লাবী আবেগের কামড়টুকু একই রকম-Unconditional selflessness. আসলে ঈশ্বরী একটি বিন্দু। নিশ্চয়ই একজন সত্তাও। কিন্তু মহাপ্রকৃতি জাতীয় কিছু নয়। বিনয় নিজের ‘ঈশ্বরী’কে ইউনিভার্সাল করে কবির মহিমা পেতে ইচ্ছুক ছিলেন না। বরং একে মনে হয়েছে ডানা-কাব্য, মানবিক এক আশ্রয়-অভিপ্সা। আবার তথাকথিত ‘আধুনিক কবিতা’য় নারীদেহের যে ‘মাংসলচিত্র’ থাকে বিনয়ের ‘ফিরে এসো’তে তার কিছুই নেই। আমরা যখন বিনয় মজুমদারকে পাঠ করি তখন আসলে আমরা তাঁর অভিজ্ঞতা ও নিজেকে পাঠ করি। কারণ তাঁর অভিজ্ঞতার বাইরে তাঁর কোন কবিতা নেই এবং কোন–এক–ঈশ্বরীর অভিজ্ঞতাহীন পাঠকের কাছেও বিনয় মজুমদার পূর্ণ নির্জনতায় ধরা দেন না- স্রেফ মহান কবি হয়ে থাকেন। তিনি নিজেই কিন্তু বলেছেন, ‘কবিতা বুঝিনি আমি’। বাস্তবিকই তাঁর সকল পয়ার, ‘অর্ধেক মানবী-কিন্তু বাকি অর্ধেকও কল্পনা নয়’।
বিনয় পাঠের ঘোর লাগা পূর্বাপর সময়টিতে বরাবরই মনে হয়েছে- প্রেম কখনো কখনো- কোন কোন বয়সে- ভিন্ন শ্রেণি আর বর্ণে- অস্বাভাবিক দূরত্বে থাকা কোন কোন মানব-মানবীর হাহাকারের ভেতর যুগপৎ ‘আনন্দ’ ও ‘অভিশাপ’ হয়ে আসে। কিন্তু এই ‘অবয়বহীন সুর’ যখন গভীর ধ্যানে রূপান্তর হয়ে যায়- তখন কী ঘটে? তখন যে উম্মাদনা তৈরি হয়- সেকি কেবলি প্রচলিত পাগলামী? নাকি তা অপ্রকাশযোগ্যতার শারীরিক-মানসিক যন্ত্রণা? কিংবা সে-কি কোন মহাজাগতিক এক ব্যক্তিগত বিশ্বাসে বিভোর থাকা- ‘একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে!’
এসব নিয়ে নিজেকে বিহ্বল দেখেন বহুজন; বহু অভাগা। বিনয় তাদের আশ্রয়- শুধুই কবি নন। তিনি প্রার্থনা ও প্রেমের মুক্তি খুঁজেছেন। চেয়েছেন কোন এক অভিভাবক ওমের আশ্রয়। যা আবার একই সঙ্গে মানবিক অভিজ্ঞতায় অধরা অতিন্দ্রীয়তা বৈ কিছু নয়। চরম সংবেদনশীলতার ‘অসুস্থ’শেষ পরিণতি বোধহয় এটাই।বর্ষণমুখর রাত্রির একাকি বৃক্ষের আর্তির মতো শূন্যতায় ভরা তা। নাকি প্রচলিত সমাজের অপাঠ্য কোন দ্রোহ এ?
আমার কবিবন্ধুদের কাছে তাই আমার কৃতজ্ঞতা যে বিনয়ের মাঝে বিশেষ আশ্বাস ও আশ্রয় দেখার সুযোগ করে দিয়েছেন তারা আমাকে। কখনো কখনো অসামাজিক আলোকছটার মধ্যেই মানুষের তৃষ্ণা তার শেষ চিহ্নগুলো রেখে যায়। কবিতার ‘ঈশ্বরী’ তাই কেবল পাঠ্য হয়ে থাকে না। এটা অভিজ্ঞতায় পাওয়া ও ধারণ করার বিষয় হয়ে ওঠে। মননের গভীর অনুভবের বাইরে কবিতা পাওয়া যায় না। ঈশ্বরীকে তো নয়ই। যে ঈশ্বরী ‘পর্বতমালার পাথুরে শিকড়’হয়েও চিরকালীন এক মাদকতার হাতছানি দেয় তার ডানায়- তার উপেক্ষা আবার বিস্ফোরণও ঘটায়। বিনয়ের কবিতায় সেই বিস্ফোরণের রক্তধারা দেখি আমরা- এবং সংবেদনশীল পাঠক সেখানে নিজের রক্তকণিকাও দেখে। এভাবেই বিনয়ের কবিতা তাঁর, আমার, আমাদের হয়ে ওঠে।
প্রেম-বেদনা-যন্ত্রণা ব্যক্তিগত। সামাজিক বিবেচনাহীন। কিন্তু সংক্রামকও বটে। তাই হয়তো লিখেছি আবারও-
অনন্ত লিপ্সা আমার
একটি ঝড়ের পর কেমন সুস্থতা নেমে আসে,
আকাশ নির্মেঘ হয়ে যায়।
চরাচর জুড়ে
তোমার বাহুর সৌন্দর্য দেখি- ঈশ্বরী,চায়ের কাপেও।
বীজকে কীভাবে প্রাণের কাছে নিয়ে রাখো-
প্রাণের মাঝে রেখেছো অনন্ত লিপ্সা;
উর্বর ভূমি তাই, আবারো ঘটে চলে
ঘাস-লতা-গুল্মের এসব সংক্রমণ।
চির উৎকণ্ঠা নিয়ে প্রজাপতি ওড়ে লীলালাস্যে;
তার ডানায় নরম রোদ, যেন
তোমার আকুল ঠোঁট।
হয়তো মিথ্যা নয়- জীবনের এসব কল্পনা, ইন্ধন
কারণ মানুষ মূলত বাঁচতে চায়
মানুষ রূপকাহিনীতে বাঁচে।
হে বন্ধু আমার,
ঝড়ের রাতে তোমার অলৌকিক আহ্বান
সামলে উঠবো জানি একদিন
কিন্তু না-লেখা ঐ রাত্রির কথা কেউ জানবে না।
কত যে দীর্ঘায়িত হতে থাকে এক একটি রাত।
২ পৌষ, ১৪২১
বিনয়ের কবিতা ‘প্রেমিক’কে শূন্যতায় স্থাপন করে। আর তাঁর জীবন ‘মানুষ’কে আতঙ্কিত করে। মগ্নচৈতন্যের এই টানাপোড়েন ধারণ করে বিস্তৃর্ণ প্রান্তরে দাঁড়িয়ে থাকেন কোন এক ‘ঈশ্বরী’- বিদ্যুত ঝিলিকের মতো। কিন্তু এতো চরম সত্যই যে, ‘প্রায় সব আয়োজনই হয়ে গেছে, তবু কেবল নির্ভুলভাবে সম্পর্ক স্থাপন করা যায় না এখনো।’তবু ‘ঈশ্বরী’র জন্য কবিতা রচিত হয়। কিংবা ঈশ্বরী নিজেই তা রচনা করিয়ে নেয়। এই নারী- কোন কোন মানুষের নিঃসঙ্গ ছায়াপথে রানীরঙ নীহারিকারূপ- ঠিক শরীরী নন। এভাবে হাজারো বিনয় জন্মে, মরে-কিন্তু শুদ্ধতম মৃদু কথাটুকু যেন চিরঞ্জীব..‘ভালোবাসি…ভালোবাসতাম’…জীবনে এবং মৃত্যুর পরও।