আমি ভাবতে শুরু করি সকল যুদ্ধই আসলে অর্থহীন: অক্তাবিও পাস
আজ ৭ সেপ্টেম্বর,বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক, অনুবাদক বিপাশা চক্রবর্তীর জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।
[১৯১৪ সালে মেক্সিকো সিটিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯৯০ সালের নোবেলবিজয়ী কবি অক্তাবিও পাস। পাস ছিলেন এনসাইক্লোপেডিক ব্যক্তিত্বদের শেষ প্রতিনিধি। ইতিহাস, দর্শন, নৃবিজ্ঞান, শিল্পকলা, সাহিত্য, রাজনীতি, এককথায় মানুষের জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রায় সবগুলো শাখাতেই তার ছিল অপরিমেয় পাণ্ডিত্য। পাশাপাশি এসব বিষয়ে তার সুগভীর পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ তাকে করে তুলেছে অনন্য। লাতিন আমেরিকান লেখকদের মধ্যে পাসের তুল্য লেখক খুব কমই আছেন। তার রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ে লেখা ও মতামতের জন্য নিন্দিত হয়েছেন মাঝেমধ্যে কিন্তু অনুপক্ষেনীয় ছিলেন তার সুগভীর ও তীক্ষ্ণ বিচারশক্তির কারণে।
কবি ও প্রাবন্ধিক হিসেবে পাসের বিশ্বব্যাপী পরিচয়ের পাশিপাশি আরেকটি কারণেও তিনি অনন্য: ভারতবীক্ষা। কর্মসূ্ত্রে তিনি দুদফায় ভারতে এসেছিলেন। ভারত ও এর সভ্যতাকে তিনি যে-গভীরতায় দেখেছেন ও বিশ্লেষণ করেছেন তা খুব কম বিদেশি লেখকই করতে পেরেছেন।
প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক বিপাশা চক্রবর্তীর জন্মতিথিতে তাঁর অনুবাদে প্রকাশ করা হলো কবি অক্তাবিও পাসের দীর্ঘ সাক্ষাতকারের অংশবিশেষ যেটি প্রকাশিত হয়েছিল সাক্ষাৎকারের জন্য বিখ্যাত সাহিত্যসাময়িকী প্যারিস রিভিউ পত্রিকায়।]
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডামের সাথে অক্তাবিও পাসের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার
বেটেখাটো এবং বয়সে সত্তর হলেও অক্তাবিও পাসের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির কারণে এখনো তাকে যথেষ্ট যুবকই মনে হয়। তার কবিতা ও গদ্য– উভয় লেখাতেই রাজনৈতিক গভীরতা ও পাণ্ডিত্যের ছোঁয়া আছে। মেক্সিকোতে তার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার ইতিহাস বারবার লেখার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন। বিশেষ করে, যেমনটি দেখা গিয়েছিল আদিবাসী অতীতের প্রেক্ষাপটে; যেখানে তিনি ব্যক্ত করেছেন কিভাবে নিগূঢ় ভালোবাসা মানুষের প্রচন্ড একাকিত্বকে দূর করে। পাস বহুদিন থেকেই বিংশ শতাব্দির দুই বিখ্যাত দক্ষিণ আমেরিকান কবি সেসার বাইয়্যেহো ও পাবলো নেরুদার সঙ্গে বিবেচিত হয়ে আসছেন। ১৯৯০ সালের কলম্বাস দিবসে এক সাক্ষাৎকার দেবার ঠিক তিন দিন পরে পাস সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়ে নেরুদাদের কাতারে শামিল হন।
একজন আইনজীবী বাবার সন্তান ও ঔপন্যাসিকের নাতি, পাস ১৯১৪ সালে মেক্সিকোতে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর বেড়ে ওঠায় এই দু’জনের অপরিসীম প্রভাব ছিল। পাস তার বাবার কাছে থেকে সামাজিক মূল্যবোধের ভিত্তি সম্পর্কে জানতে পারেন যিনি মেক্সিকান বিপ্লবী এমিলিয়ানো সাপাতার পরামর্শক ছিলেন। আর তাঁর পিতামহের লেখা চিঠিগুলি দিয়ে বিশ্বকে জানতে শিখেন। বালক পাস তাঁর পিতামহের বিশাল লাইব্রেরীতে অবাধ বিচরণের সুযোগ পেয়েছিলেন। আর এভাবেই তিনি স্প্যানিশ ও লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের অমূল্য ভান্ডারের স্বাদ নিতে পেরেছেন। তিনি ইউনিভার্সিটি অব মেক্সিকোতে সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনা করেন, কিন্তু ডিগ্রী অর্জনের আগেই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যান।
স্পেনে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথে পাস রিপাবলিকান পক্ষ অবলম্বন করেন; আর তাদের সহযোগিতা করার জন্য ১৯৩৭ সালে স্পেনের উদ্দেশ্যে দেশ ত্যাগ করেন। পরবর্তীতে দেশে ফেরার পর, সাহিত্য পত্রিকা Taller এবং El Hijo Pródigo প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করেন যাতে করে মেক্সিকোতে নতুন প্রজন্মের লেখক সৃষ্টি হতে পারে। পাস ১৯৪৫ সালে মেক্সিকোতে কূটনৈতিক চাকুরিতে যোগদান করেন। তবে এর আগে ১৯৪৩ সালে গগেনহাম ফেলোশিপ অর্জনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যান। পাস ১৯৪৬ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত প্যারিসে অবস্থান করেন। এ সময়েই সার্ত্রে, ব্রেতোঁ, কামু ও অন্যান্য ফরাসী চিন্তাবিদদের লেখা এবং সাক্ষাৎ তার লেখায় ও চিন্তায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। ১৯৫০ এর শুরুতে পাসের কূটনৈতিক দায়িত্ব পালনের সূত্র ধরে জাপান ও ভারতে আসার সুযোগ হয়। আর সেখানেই প্রথম অদ্বয়বাদী বা বৌদ্ধ ও তাওবাদী রচনার সংস্পর্শে আসেন। তিনি বলেছেন, “More than two thousand years away, Western poetry is essential to Buddhist teaching: that the self is an illusion, a sum of sensations, thoughts, and desire ” ১৯৬৮ সালের অক্টোবরে রাজপথে নিরীহ ছাত্রদের উপর মেক্সিকান সরকারের রক্তাক্ত নিপীড়নের প্রতিবাদে পাস তার কূটনৈতিক পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
১৯৩৩ সালে পাসের প্রথম কবিতার বই স্যাভেজ মুন প্রকাশিত হয়। তখন তাঁর বয়স উনিশ । তাঁর সবচেয়ে বহুল প্রশংসিত বইগুলির মধ্যে ছিল – দ্য ল্যাবিরিন্থ অব সলিচ্যুড (১৯৫০), এটি ছিল মেক্সিকান জাতীয় চরিত্রের উপর একটি বিশ্লেষণী গদ্য। তাঁর আরেকটি বইয়ের মতো দীর্ঘ কবিতার নাম হলো সান স্টোন (১৯৫৭); যেটিকে জে.এম কোহেন “পশ্চিমা বিশ্বের সর্বশেষ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কবিতা বলে অভিহিত করেছেন”। কবিতাটিতে ৫৮৪টি লাইন বা বাক্য রয়েছে, যা কি-না ভেনাসের ৫৮৪ দিনের চক্রকে প্রতিনিধিত্ব করে। অন্যান্য লেখাগুলির মধ্যে ঈগল অর সান (১৯৫০), অল্টারনেটিং কারেন্ট (১৯৫৬), দ্যা বো এন্ড দ্যা লায়ার (১৯৫৬), ব্লাঙ্কো (১৯৬৭), দ্যা মানকি গ্রামারিয়ান (১৯৭১), এ ড্রাফট অব স্যাডোজ (১৯৭৫) এবং এ ট্রি উইদিন (১৯৫৭) উল্লেখযোগ্য।
‘আলোকচিত্র: দ্বিতীয় স্ত্রী মারি-হোসের সাথে অক্তাবিও পাস
পাস ও তাঁর স্ত্রী মারি-হোসে, যিনি একজন চিত্রকর, মেক্সিকো শহরে থাকেন। তিনি তার কবিতার জন্য অসংখ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। সেগুলির মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল গ্রান্ড প্রিক্স, দা জেরুজালেম প্রাইজ (১৯৭৭), দা নিওস্ট্যাড্ট প্রাইজ (১৯৮২), দা সের্বান্তেস প্রাইজ (১৯৮১), এবং নোবেল পুরস্কার(১৯৯০) উল্লেখযোগ্য।
নিউইয়র্কের YM-YWHA- এর ৯২ নং রোডের পোয়েট্রি সেন্টারের জনাকীর্ণ শ্রোতাদের সামনে বসে যখন এই সাক্ষাৎকারটি নেয়া হয় তখন পাসকে তাঁর কবিতার মতোই চিরায়ত তেজস্বি ও শক্তিমান দেখাচ্ছিল। অনেকটা সমাজ ও ব্যক্তির মধ্যে সারগ্রাহী যৌন অতিন্দ্রীয়বাদের সেতু তৈরি করে। আলাদাভাবে, পাসকে যেন মনে হচ্ছিল তিনি শ্রোতাদের সাথে যোগাযোগের এই সুযোগকে স্বাগত জানাচ্ছিলেন।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: অক্তাবিও, ১৯১৪ সালে আপনার জন্ম সম্ভবত আপনার মনে আছে…
অক্তাবিও পাস: তেমন ভালো মনে নেই!
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: … কার্যত মেক্সিকান বিপ্লবের মধ্যভাগে ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে বলতে গেলে পুরো শতক জুড়েই আপনি চিরস্থায়ী এক যুদ্ধের রূপ দেখেছেন। সেক্ষেত্রে বিশ শতক সম্পর্কে ভালো কিছু কি বলবেন?
অক্তাবিও পাস: এখনও বেঁচে আছি। মনে হয় এটাই যথেষ্ট। আপনি জানেন, ইতিহাস আর জীবন এক বিষয় নয়। ইতিহাস এক জিনিস আর জীবন ভিন্ন কিছু। আমাদের শতাব্দটি ছিল ভয়াবহ–পৃথিবীর ইতিহাসে করুণতম এক অধ্যায়–তবে আমাদের জীবন কম-বেশী একই রকমের আছে। ব্যক্তিমানুষের জীবন ঐতিহাসিক নয়। ফরাসি বা আমেরিকান বিপ্লবের সময়, অথবা ইরান ও গ্রীসের মধ্যকার যুদ্ধের সময়-অথবা যে কোন মহৎ বৈশ্বিক ঘটনার সময়-ইতিহাস কিন্তু ক্রমাগতভাবে পরিবর্তিত হয়। কিন্তু মানুষ বেঁচে থাকে, কাজ করে, প্রেমে পড়ে, মারা যায়, অসুস্থ হয়, বন্ধুত্ব হয়, হঠাৎ আলোর ঝলকানি বা বিষন্নতার মুহূর্ত–এগুলির সাথে ইতিহাসের তেমন সম্পর্ক নেই বা থাকলেও তা খুবই সামান্য।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: আমরা তাহলে ইতিহাসের ভিতরে আবার বাইরে–দু’জায়গাতেই আছি?
অক্তাবিও পাস: হ্যাঁ, ইতিহাস হলো আমাদের ভূখণ্ড বা প্রেক্ষাপট, আমরা এর ভিতরেই বেঁচে আছি। কিন্তু বাস্তব নাটক, আসল প্রহসনও বলা যায় যেগুলি প্রতিমুহূর্তে আমাদের সাথে রয়েছে। আমি মনে করি, আমরা পঞ্চম শতাব্দিতে যেমন ছিলাম অনাগত শতাব্দিতেও একইরকম থাকবো। জীবন ঐতিহাসিক নয়, তবে অনেকটা প্রকৃতির মতো কিছু।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: চিত্রকলার সাথে আপনার সম্পর্ক নিয়ে দা প্রিভিলেজেস অব সাইট বইতে বলেছেন “আমি বা আমার বন্ধুরা কখনও তিশিয়ান, ভেলাসকেস বা কোন সেজান দেখিনি… যাহোক, আমাদের চারপাশে অসংখ্য শিল্পকর্ম রয়েছে”। আপনি সেখানে মিক্সওয়াকের কথা বলেছেন, যেখানে আপনার শৈশব কেটেছে, আবার বিংশ শতকের শুরুর দিকের মেক্সিকোর শিল্প নিয়ে কথা বলেছেন।
আলোকচিত্র: কিশোর অক্তাবিও পাস
অক্তাবিও পাস: মিক্সওয়াক এখন বরং মেক্সিকো শহরের একটি জঘন্য শহরতলী। আমার শৈশবে এটি একটি ছোট গ্রাম ছিল। প্রাক-কলম্বিয় আমলের পুরোনো একটি গ্রাম। মিক্সওয়াক নামটি দেবতা মিক্সকোয়তল নামানুসারে হয়, নাউয়াতল ভাষায় যার অর্থ আকাশগঙ্গা। এটির আরেকটি অর্থ হলো- “মেঘ নাগ”, যেন আকাশগঙ্গা এক সর্পিল মেঘরাশি ছিল। আমাদের ছোট একটি পিরামিড ছিল, আকারে তা ক্ষুদ্র হওয়া সত্ত্বেও সেটি পিরামিডই ছিল। আমাদের সপ্তদশ শতাব্দির একটি বিহারও ছিল। আমার পাশ্ববর্তী এলাকার নাম ছিল সান হুয়ান। আর ছিল ষোড়শ শতাব্দির একটি গির্জা, এটি ছিল এলাকার প্রাচীনতম। এছাড়া অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দির অনেক ঘর-বাড়িও ছিল, কোন কোনটিতে ঘন বাগান ছিল; কারণ, উনবিংশ শতাব্দির শেষের দিকে মিক্সওয়াক বুর্জোয়াদের গ্রীষ্মকালীন অবকাশ কেন্দ্র ছিল। আদতে আমার পরিবারেরও একটি গ্রীষ্মকালীন আবাস ছিল। তারপর যখন বিপ্লব শুরু হলো, আমরা তখন বাধ্য হলাম আবার খুশিও হলাম ওখানে চলে যেতে হবে বলে। প্রাক্কলম্বীয় ও ঔপনিবেশিক দু’টি যুগেরই ছোট ছোট জীবন্ত স্মৃতি আমাদেরকে ঘিরে ছিল।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: আপনি দা প্রিভিলেজেস অব সাইট বইতে মিক্সওয়াকের আতশবাজি পোড়ানোর কথা উল্লেখ করেছেন।
অক্তাবিও পাস: আমি আতশবাজির ভক্ত। এটি আমার শৈশবের অংশ। শহরের একটি অংশে ছিল আতশবাজি তৈরীর সব মহাকারিগর। সারা মেক্সিকো জুড়েই তাদের খ্যাতি ছিল। Virgin of Guadalupe পার্বণে, অন্যান্য ধর্মীয় উৎসবে আর নববর্ষে আমরা শহরে আতশবাজির উৎসব করতাম। আমার এখনও মনে আছে কিভাবে আতশবাজির অগ্নিময় প্রপাত গীর্জার তোরণের রূপ ধারণ করতো। সত্যিই তা ছিল অসাধারণ। মিক্সওয়াক জীবনের স্পন্দনে যতটা জীবন্ত ছিল তা এখন আর বড় শহরগুলোতে দেখা যায় না।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: আপনাকে মিক্সওয়াকের জন্য স্মৃতিকাতর মনে হচ্ছে, যদিও অল্প কিছু লেখকের মতো আপনিও মেক্সিকো শহরের প্রাণ কেন্দ্রে বাস করেন। শিগগিরই এটি একটা বিশাল ও গতিশীল শহর হয়ে উঠবে, তবে দুষণ, যানজট, দারিদ্রের বিচারে এটি আবার দুঃস্বপ্নও। তাই এরকম একটি শহরে বাস করা কি অনুপ্রেরণা নাকি প্রতিবন্ধকতা?
অক্তাবিও পাস: মেক্সিকো শহরের প্রাণ কেন্দ্রে বাস করাটা অনুপ্রেরণাও নয়, আবার প্রতিবন্ধকতাও নয়। এটি একটি চ্যালেঞ্জ। আর এই চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করার একটাই পথ, মুখোমুখি হওয়া। আমি মেক্সিকোর অন্যান্য শহরেও থেকেছি কিন্তু সেগুকে কতটা মনোরম সেটা গুরত্বপূর্ণ নয়, আমার কাছে বরং অবাস্তব মনে হয়েছে। একটা নির্দিষ্ট সময়ে আমি ও আমার স্ত্রী বর্তমান ফ্লাটে এসে বসবাসের সিদ্ধান্ত নিলাম। আপনি যদি মেক্সিকোতে বাস করতে চান তো বাস করার জন্য মেক্সিকো শহরই পাবেন।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: আমাদেরকে পাস-পরিবার সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?
অক্তাবিও পাস: আমার বাবা মেক্সিকান আর মা স্প্যানিশ ছিলেন। আমাদের এক চাচী আমাদের সাথেই থাকতেন- কিছুটা অদ্ভুত স্বভাবের, চাচীরা যেমনটা হয়ে থাকে আর কি। সে ছিল তার নিজের অদ্ভুত ধরনেই কাব্যিক। আমার পিতামহ আইনজীবী একই সঙ্গে জনপ্রিয় একজন লেখক ও ঔপন্যাসিক ছিলেন। বস্তুতঃ এমনও দিন গেছে যখন তাঁর বেষ্ট সেলার একটি বইয়ের টাকায় অামাদের চলতে হয়েছে। মিক্সওয়াকের বাড়িটি ছিল তাঁর।
আলোকচিত্র: হোর্হে লুইস বোর্হেসের সাথে অক্তাবিও পাস
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: বইয়ের সম্পর্কে কী বলবেন? আমার মনে পরছে বোর্হেস বলেছিলেন যে তিনি কখনই তাঁর পিতার লাইব্রেরী ছেড়ে কোথায়ও যাননি।
অক্তাবিও পাস: এটা একটা অদ্ভুত সাদৃশ্য। আমার পিতামহের সুন্দর একটি লাইব্রেরী ছিল, যা ছিল মিক্সোয়াক-এর বাড়ির এটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। সেখানে প্রায় ছয় থেকে সাত হাজার বই ছিল। তাই বই পড়ার ক্ষেত্রে আমার অঢেল স্বাধীনতা ছিল। আমি যখন বালক তখন গোগ্রাসী পাঠক ছিলাম, এমনকি “নিষিদ্ধ” বইও পড়েছি কারণ কারোর কোনো নজর ছিল না আমি কী পড়ছি। যৌবনে এসে ভলতেয়ার পড়ি, সম্ভবত ভলতেয়ার আমার ধর্মীয় বিশ্বাসে ফাটল ধরায়। যেটি আমাকে ধর্মীয় বিশ্বাস ত্যাগ করতে সাহায্য করেছিল। আমি এমন কিছু উপন্যাস পড়েছি যেগুলো কমবেশি কামোদ্দীপক, তবে সেগুলো পর্নো নয়, বরং বলা যায় যৌনোদ্দীপক।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: শিশুদের কোন বই পড়েছেন?
অক্তাবিও পাস: অবশ্যই। মেক্সিকোতে খুবই জনপ্রিয় ইতালীয় লেখক সালগারির অনেক বই পড়েছি। আর জুল ভার্ণ পড়েছি। আমেরিকান বাফেলো বিল ছিল আমার অন্যতম স্বপ্নের নায়ক। আমি ও আমার বন্ধুরা সামান্যতম বিবেকের দংশন বা ইতিহাসের দিকে ঝুঁকে পড়ার বোধ ছাড়াই আলেকজেন্ডার ডুমা’র থ্রি মাসকেটিয়ারস থেকে কাউবয়-এ চলে এসেছিলাম।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: একটি আঙুর গাছের ডালপালা বাড়ির দেয়ালকে জাপটে আছে-এরকম একটি ছবি দেখে আপনি একসময় বলেছিলেন যে প্রথমবারের মতো একটি পরাবাস্তববাদী চিত্র কর্ম দেখলেন। আপনি একে বাস্তববাদ হিসেবে নিয়েছিলেন।
অক্তাবিও পাস: এটা সত্যি। মিক্সোয়াক-এ আমাদের বাড়িটি চারদিক থেকে ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছিল। ছাদ ও দেয়াল ধ্বসে পড়ার কারণে এক একটি করে কক্ষ আমাদের ছেড়ে দিতে হচ্ছিল।
আলোকচিত্র: যৌবনের শুরুতে অক্তাবিও পাস
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: ১৯৩০ সালে আপনা বয়স যখন ১৬, তখন আপরি ন্যাশনাল প্রিপাটরি স্কুলে ভর্তি হন। আপনি সেখানে কোন বিষয়ে পড়েছিলেন আর স্কুলটিই বা কি রকম ছিল?
অক্তাবিও পাস: স্কুলটি সুন্দর ছিল। সেটি সপ্তদশ শতকের শেষের দিকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, মেক্সিকোর স্থাপত্যের জগতে উচ্চমার্গের বারোকরীতিতে গড়া। স্কুলটি অনেক বড় ছিল–পাথর, থাম ও বারান্দায় আভিজাত্যের ছোঁয়া ছিল। সেখানে একধরণের নান্দনিক আকর্ষণ ছিল। বিশ শতকে সরকার চিত্রশিল্পী ওরোস্কো ও রিভেরাকে দিয়ে বহু দেয়ালচিত্র(Murals) আঁকান। আমাদের স্কুলেই রিভেরা তার প্রথম চেয়ালচিত্রটি আঁকেন।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: আপনি তাহলে তখনই চিত্রকরদের কাজ দেখে আকর্ষণ বোধ করেছিলেন?
অক্তাবিও পাস: হ্যাঁ, আমরা সকলেই তখন শিল্পীদের প্রকাশশৈলীর সাথে একাত্ম বোধ করতাম। কিন্তু সেখানে স্থাপত্য ও চিত্রকলার মধ্যে একটা দ্বন্ধ ছিল। পরে ভাবতে কষ্ট হয়েছিল যে, দেয়ালে আঁকা সেই চিত্রটি আমাদের শতাব্দির ছিল হয়নি।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: আপনাদের পাঠ্যক্রম কেমন ছিল?
অক্তাবিও পাস: এটি ছিল ফরাসী ঐতিহ্যের সাথে আমেরিকান শিক্ষা তত্ত্বের এক বিচিত্র সংমিশ্রন। আমেরিকান দার্শনিক জন ডিউই তখন এক বিরাট প্রভাব হিসেবে ছিলেন। শিক্ষা ব্যবস্থায় “প্রগতিপন্থা”ও ছিল।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: তাহলে বিদেশী যে ভাষায় শিক্ষা নিয়েছিলেন সেটা ছিল ফরাসী?
অক্তাবিও পাস: এবং ইংরেজী। বিপ্লবের সময়ে আমার বাবার উপর রাজনৈতিক নির্বাসনে ছিলেন। তাঁকে মেক্সিকো ছেড়ে আমেরিকায় আশ্রয় নিতে হয়। তিঁনি প্রথমে ক্যালিফোর্নিয়ায় যান, তারপরে আমরা সেখানে যাই। সেখান থেকে আবার লস এঞ্জেলেসে। এভাবে প্রায় দু’বছর সেখানে থাকি। সেখানকার স্কুলের প্রথম দিনে আমাকে আমার আমেরিকান সহপাঠীদের সাথে রীতিমত যুদ্ধ করতে হয়। আমি এক অক্ষরও ইংরেজী বলতে পারতাম না। আমি টিফিনের সময় Spoon (চামচ) বলতে পারতাম না; আর তা দেখে তারা হেসে লুটোপুটি খেত। এরপর যখন আবার মেক্সিকোতে ফিরি, তখন শুরু হয় আরেক যুদ্ধ। আমার সহপাঠিরা আমার ইংরেজী শুনে হাসতো। তারা আমাকে বিদেশী ভাবতে শুরু করলো। লক্ষ্য করলাম, দুটি দেশেই আমাকে বিদেশী বলে ভাবতো।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: ন্যাশনাল প্রিপাটরি স্কুলে এমন কি কোন শিক্ষক ছিলেন যিনি আপনাকে প্রভাবিত করতে পেরেছিল?
অক্তাবিও পাস: অবশ্যই। স্কুলে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল মেক্সিকান কবি কার্লোস পেইয়্যিসের-এর সান্নিধ্যে আসার। তিনি আমাদের কবিতা পড়াতেন। তার মাধ্যমে আমি তার সময়কার অন্য কবিদের সাথে পরিচিত হতে পেরেছিলাম। আধুনিক কবিতা সম্পর্কে তারা আমার চোখ খুলে দিয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, আমার পিতামহের গ্রন্থাগারটি বিশ শতকের শুরু পর্যন্ত এসে ঠেকেছে, পরে স্কুলেই ১৯১০ সালের পরে প্রকাশিত বইগুলি সম্পর্কে জানি। প্রুস্তের লেখা আমার কাছে বিস্ময়কর ছিল। আমি ভাবতাম জোলার পরে আর কোন উপন্যাস লেখা হবেনা।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: স্প্যানিশ কবিতা সম্পর্কে কী বলবেন?
অক্তাবিও পাস: আমি ‘১৯২৭ প্রজন্ম’-এর কবি গার্সিয়া লোরকা, রাফায়েল আলবের্তি, হোর্হে গিয়েনকে আবিস্কার করি। এছাড়াও আন্তোনিও মাচাদো এবং তখনকার দিনে কবিতার কুলপতি হুয়ান রামোন হিমেনেসের কবিতা পড়েছি। ঐ সময় বোর্হেসও পড়েছি, উল্লেখ্য যে, বোর্হেস তখন ছোটগল্পকার ছিলেন না। ত্রিশ শতকের শুরুতে তিনি কবি ও প্রবন্ধকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। স্বাভাবিকভাবেই আমার সাহিত্যিক জীবনে সূচনায় পাবলো নেরুদার কবিতার ছিল এক বিস্ময়।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছিলেন, কিন্তু ১৯৩৭ সালে হঠাৎ একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিলেন।
অক্তাবিও পাস: বেশ কিছু সিদ্ধান্তই আমি নিয়েছিলাম। আমি তখন ইউকাতান গিয়েছিলাম। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ করেছিলাম কিন্তু গ্রাজুয়েশন করার আগেই বেরিয়ে আসি। আমি আইনজীবী হতে অস্বীকার করি। আমার পরিবার সেই সময়কার মেক্সিকোর অন্যান্য মধ্যবিত্ত পরিবারের মতোই আশা করতেন সন্তান ডাক্তার বা আইনজীবী হবেন। আমি শুধুমাত্র একজন কবি হতে চেয়েছি, এবং কোনো না কোনোভাবে বিপ্লবী হতে চেয়েছি। সেই সময়ে ইউকাতানে আমার বন্ধুদের সাথে একটি স্কুলে কৃষক ও শ্রমিকদের সন্তানদের শিক্ষা দানের সুযোগ আসে। সেটি ছিল এক মস্ত অভিজ্ঞতা- আমাকে আত্মোপলব্ধি করতে শিখিয়েছে যে আমি একজন শহুরে বালক।্এবং মেক্সিকো সম্পর্কে ওই অভিজ্ঞতা ছিল আসলে মেক্সিকো সিটির অভিজ্ঞতা।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: আপনার তাহলে ভৌগোলিক জ্ঞানও হলো?
অক্তাবিও পাস: নিউ ইয়র্ক বা প্যারিসের মতো শহরের অধিবাসীরা সাধারণত দেশের অন্যান্য জায়গার তুলনায় আঞ্চলিক হয়। মেক্সিকোর দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত খুবই অদ্ভুত এক প্রদেশ ইউকাতানকে আমি আবিস্কার করেছিলাম। এটা মেক্সিকোই কিন্তু খুবই ভিন্ন রকমের; এজন্য মায়া সভ্যতার প্রভাবকে ধন্যবাদ জানাই। আমি লক্ষ্য করলাম মেক্সিকোতে মধ্য মেক্সিকোর ঐতিহ্য ছাড়াও মায়া ঐতিহ্যের শিকড় রয়েছে। ইউকাতান ছিল অদ্ভুত রকমের কসমোপলিটান। এর সাথে কিউবা আর নিউ অরলিনসের সংযোগ ছিল। আদতে, উনিশ শতকে ইউকাতানবাসীরা মেক্সিকো শহরের তুলনায় অনেকবেশী যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপে ভ্রমন করেছিল। মেক্সিকো ঠিক কতটা জটিল–সেই ব্যাপারটা আমি দেখতে শুরু করেছিলাম।
আলোকচিত্র: ১৯৩৭ সালে স্প্যানিশ রিপাবলিকান দলে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে স্পেনের মাদ্রিদে অক্তাবিও পাস
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: তারপর আপনি মেক্সিকো সিটিতে এসে স্পেনের গৃহযুদ্ধে যোগদান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ?
অক্তাবিও পাস: স্পেনের কংগ্রেস আমাকে তখন আমন্ত্রণ জানিয়েছিল; আর যেহেতু আমি স্প্যানিশ রিপাবলিকান দলের প্রতি নিবেদিত প্রাণ ছিলাম তাই সাথে সাথেই সেই আমন্ত্রণ গ্রহন করলাম। ইউকাতান স্কুল ছেড়ে স্পেনে গেলাম। সেখানে বেশ কয়েকমাস থাকলাম। আমি স্পেনের লয়েলিস্ট আর্মিতে যোগ দিতে চেয়েছিলাম-কিন্তু
পারিনি কারণ অামার বয়স তখন ২৩ বছর, স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যোগ দিতে হলে রাজনৈতিক দলের সুপারিশ লাগে । আমি কমিউনিষ্ট পার্টি বা অন্য কোন দলেরও সদস্য ছিলাম না, ফলে কেউই আমাকে সুপারিশ করতে পারেনি। তাঁরা আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিল, কোন কিছুর সদস্য হওয়া খুব বেশী গুরুত্বপূর্ণ না, আমি একজন তরুণ– ওই কংগ্রেসে আমি ছিলাম তরুণতম– সুতরাং আমার মেক্সিকোতে ফিরে গিয়ে স্প্যানিশ রিপাবলিকান নিয়ে লেখা উচিত। এবং সেটাই আমি করেছি।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: রাজনীতির ভেতর ও বাইরের দিক থেকে, সেই সাথে গণতান্ত্রিক স্প্যানিশ রিপাবলিক-এর প্রতিরক্ষা ছাড়াও এই সফরের আর কী অর্থ ছিল আপনার কাছে?
অক্তাবিও পাস: আমি আমার ঐতিহ্যের আরেকটি অংশ তখন আবিষ্কার করি। আমি অবশ্যই স্প্যানিশ সাহিত্যিক ঐতিহ্যের সাথে পরিচিতিও ছিলাম। আমি সব সময়ই স্প্যানিশ সাহিত্যকে আমার দৃষ্টি দিয়ে দেখতাম। কিন্তু বইপুস্তক পড়া এক জিনিস আর নিজের চোখে মানুষ, স্মৃতিসৌধ আর ভূপ্রকৃতি দেখা আরেক জিনিস।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: তার মানে আবারও এক ভৌগলিক আবিষ্কার ঘটলো?
অক্তাবিও পাস: হ্যাঁ, তবে সেখানে রাজনৈতিক ব্যাপারও ছিল, বা আরো সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে এর একটা নৈতিক দিকও ছিল। আমার রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্বাসগুলো ভ্রাতৃত্ব বোধের ধারণায় সন্দীপিত হয়েছিল। আমরা সবাই এ নিয়েই কথা বলতাম। উদাহরণস্বরূপ, বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ভ্রাতৃত্বের অনুসন্ধান চিত্রিত হওয়া আঁদ্রে মালরোর উপন্যাসগুলো আমরা সবাই একসাথে পড়েছি। স্প্যানিশ অভিজ্ঞতা আমার রাজনৈতিক বিশ্বাসকে শক্তিশালী করেনি বরং আমার ভ্রাতৃত্ববোধের ধারণাকে দারুনভাবে বদলে দিয়েছে। একটা ঘটনার কথা বলি। একদিন- স্টিফেন স্পেন্ডার অামার সঙ্গেই ছিলেন এবং তার হয়তো মনে আছে এই ঘটনাটা– আমরা মাদ্রিদের একটি যুদ্ধের ফ্রন্টে গিয়েছিলাম যেটা ছিল বিশ্ববিদ্যালয় শহরের মধ্যে। এটা ছিল এক যুদ্ধক্ষেত্র। কখনো কখনো লয়েলিস্ট ও ফ্যাসিস্টরা একই ভবনের একটি মাত্র দেয়ালের কারণে বিভক্ত হয়েছিল। আমরা অন্য প্রান্তের সৈনিকদের কথা শুনতে পেতাম। সে এক অদ্ভুত অনুভূতি। যাদের আমরা মুখোমুখি হবো-তাদের দেখতে পাচ্ছিনা কিন্তু শুনতে পাচ্ছি। তারা আমার শত্রু। তারাও মানুষের মতো কথা বলে, ঠিক আমি যেমন বলি। তারা র্ঠিক আমারই মতো ছিল।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: এই অভিজ্ঞতা কি আপনাকে শত্রুদের ঘৃণা করার ক্ষেত্রে কোন প্রভাব ফেলেছে?
অক্তাবিও পাস: হ্যাঁ, আমি ভাবতে শুরু করি সকল যুদ্ধই আসলে অর্থহীন। তবে সত্যি যে সেই কথাটা আমি কাউকে বলতে পারিনি। চিন্তা করেছি জানলে তাঁরা আমাকে দেশদ্রোহী ভাবতে পারে, যা আদৌ আমি নই। তখন বা এর পরে হবে হয়তো, যখন আমি এই অস্বস্তিকর ভাবনাটি নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে শুরু করি, আপনার শক্রও আসলে মানুষ–এই সত্যটা আপনাকে অবশ্যই মেনে নিতে হবে। আমি বলছি না যে, আপনাকে অবশ্যই শত্রুর বন্ধু হতে হবে। না, পার্থক্য থাকবেই, তবে আপনার শক্রও একজন মানুষ এবং যে-মুহূর্তে এটি ভাবতে পারবেন তখনই বুঝবেন যে, আপনি আর কোন সহিংসতা মেনে নিতে পাচ্ছেন না। আমার কাছে এটি একটি ভয়ানক অভিজ্ঞতা ছিল। এটা আমার অনেক গভীর বিশ্বাসকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছে।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: ফ্যাসিস্ট সৈন্যরা আপনার ভাষায় কথা বলছে, সেই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকেই কি আপনার মনে এরকম ভাবনা এলো?
আলোকচিত্র: মধ্য বয়সে অক্তাবিও পাস
অক্তাবিও পাস: হ্যাঁ, প্রাচীরের ওপাশের সৈন্যরা হাসছিল আর বলছিল, আমাকে একটা সিগারেট দাও বা এরকম কিছু। আমি নিজেকে বললাম, আচ্ছা, দেয়ালের ওপাশের মানুষগুলোতো আমাদেরই মতো।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: যাহোক, আপনি সেখান থেকে তো সরাসরি তখন মেক্সিকো যাননি।
অক্তাবিও পাস: না, যাইনি। ইউরোপে তখন এটি আমার প্রথম ভ্রমন ছিল। আমাকে প্যারিসে যেতে হয়েছিল। প্যারিস ছিল এক যাদুঘর; এটা এক ইতিহাস, যা ছিল বর্তমান। ওয়াল্টার বেঞ্জামিন বলেছিলেন প্যারিস ছিল উনিশ শতকের রাজধানী। তিঁনি ঠিকই বলেছিলেন। কিন্তু আমি মনে করি, প্যারিস বিশ শতকেরও রাজধানী, অন্তত বিশ শতকের প্রথমার্ধের। নিদেনপক্ষে শতাব্দির শুরুর দিকে তো হবেই। রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক অথবা দার্শনিক রাজধানী হিসেবে বলছি না, এটি ছিল শৈল্পিক রাজধানী; সাধারণত চিত্রকর্ম ও ভাস্কর্যের জন্য, সাহিত্যের জন্যও বটে। সেরা শিল্পী ও সাহিত্যিকরা প্যারিসে বাস করতেন বলেই না, পরাবাস্তববাদ পর্যন্ত বিরাট সব আন্দোলনের জন্যেও।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: আপনাকে আন্দোলিত করার মতো কী দেখলেন?
অক্তাবিও পাস: আমি ইউনিভার্সাল এক্সপোজিশনে গিয়ে পিকাসোর সদ্য আঁকা গুয়ের্নিকা ছবিটা দেখলাম। তখন আমার ২৩ বছর বয়স, আমার জন্য অসাধারণ একটা সুযোগ ছিল স্প্যানিশ প্যাভিলিয়নে গিয়ে পিকাসো ও মিরোকে দেখা। আমি প্যারিসে খুব বেশি লোককে চিনতাম না, এবং একেবারেই ভাগ্যক্রমে একটি এক্সিবিশনে গিয়ে ম্যাক্স আর্ণেষ্ট-এর ইউরোপ আফটার দা রেইন ছবিটি দেখার সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছিলাম, যেটি আমার মধ্যে গভীর ছাপ ফেলেছিল।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: আর মানুষজন কেমন ছিল?
অক্তাবিও পাস: আমি সেখানে একজন কিউবান লেখকের সাক্ষাৎ পাই, পরে যিনি বিখ্যাত হন, আলেহো কার্পেন্তিয়ের। তিনি আমাকে পরাবাস্তববাদী কবি রবেয়ার দেসনোর বাড়িতে এক পার্টিতে আমন্ত্রণ করেন। সেখানে অনেক মানুষের সমাগম ছিল। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ বেশ সুপরিচিতও ছিল–কিন্তু কাউকেই আমি চিনতাম না এবং হারিয়ে গেছি বলে মনে হয়েছিল। আমি তখন খুবই তরুণ। ঘরের আশেপাশে তাকিয়ে আমি অদ্ভুদ কিছু জিনিস দেখতে পেলাম। আমি এক সুন্দরী মেয়েকে জিজ্ঞেস করলাম এগুলো কী। মেয়েটি হেসে জবাব দিলে, তাঁরা জাপানি প্রেমময় উপাদান, অলীকবস্তু, সবাই আমার সারল্যে হেসে উঠলো। আমি তখন বুঝলাম কতটা গেঁও আমি।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: আপনি ১৯৩৮ সালে মেক্সিকো ফিরলেন। আঁদ্রে ব্রেতোঁ ও ট্রটস্কি তখন সেখানে। তাদের উপস্থিতি কি আপনার কাছে কোনো অর্থ বহন করতো?
অক্তাবিও পাস: অবশ্যই। রাজনৈতিকভাবে আমিতো ব্রেতোঁ এবং ট্রটস্কির বিরোধী ছিলাম। আমি ভাবতাম আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু ছিল ফ্যাসিবাদ। স্তালিন ঠিকই বলেছিলেন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। যদিও ব্রেতোঁ ও ট্রটস্কি নাজিদের এজেন্ট ছিলেন না, তারপরও আমি তাদের বিরুদ্ধে ছিলাম। অন্যদিকে, ট্রটস্কির প্রতি আমি মুগ্ধ ছিলাম। আমি গোপনে তাঁর লেখা পড়তাম। অর্থাৎ, ভিতরে ভিতরে আমি প্রথাবিরোধী ছিলাম। আমি ব্রেতোঁর প্রশংসা করতাম। আমি তার L’Amour fou বইটি পড়েছিলাম, এই বইটি সত্যিই অামাকে মুগ্ধ করেছে।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: সুতরাং স্প্যানিশ ও স্প্যানিশ আমেরিকান কবিতা ছাড়াও আপনি ইউরোপীয় আধুনিকতায় মজেছিলেন।
অক্তাবিও পাস: হ্যাঁ, আমি বলব এই সময়টায় তিনটি বই আমার মনে রেখাপাত করেছে: প্রথমটি হল ১৯৩১ সালে মেক্সিকোতে বসে পড়া এলিয়টের দা ওয়েস্ট ল্যান্ড। তখন আমার বয়স সতের বা এর কাছাকাঠি, তাঁর কবিতা আমার মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিল। একটি শব্দও বুঝতে পারছিলাম না। তারপর আমি অসংখ্যবার পড়েছি কবিতাটি, এবং আমি এখনও মনে করি এটি শতাব্দির সেরা কবিতাগুলো একটি। আমার দ্বিতীয় পাঠটি ছিল সাঁ ঝ পার্সের আনাবাস, আর তৃতীয়টি ছিল ব্রেতোঁর ছোট্ট একটি বই, যেটিতে মুক্ত প্রেম, কবিতা আর বিদ্রোহের চূড়ান্ত প্রকাশ (exalted) ঘটেছে।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: তবে প্রশংসা সত্ত্বেও আপনি তার সাথে দেখা করেননি?
অক্তাবিও পাস: একবার আমার এক পরিচিত বন্ধু আমাকে তার সাথে দেখা করতে বললেন, এবং জানালেন যে ব্রেতোঁর রাজনীতি সম্পর্কে আমার ধারণা ভুল। আমি দেখা করতে অস্বীকৃতি জানাই। অনেক বছর পর, তার সাথে আমার দেখা হয় এবং আমাদের মধ্যে ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। তখনকার সময়ে আমার বন্ধু-বান্ধবদের অনেক সমালোচনা সত্তেও আমি ব্রেতোঁ ও ট্রটস্কির লেখা এবং ডিয়াগো রিভারার স্বাক্ষরিত ইশতেহার ‘দা মেনিফেষ্টো ফর এ রেভ্যুলিউশনারি ইন্ডিপেন্ডেন্ট আর্ট’ আগ্রহ সহকারে পড়ি। সেখানে ট্রটস্কি সাহিত্যে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের দাবী ত্যাগ করেন। শিল্পী ও লেখকদের ব্যাপারে বৈপ্লবিক রাষ্ট্র যা করতে পারে তাহলো পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হয়।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: এতে মনে হয় আপনার অন্তর্গত স্ববিরোধ (paradox) এক সঙ্কটের মধ্যে পড়ে।
অক্তাবিও পাস: আমি সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদের বিপক্ষে। আর সেই থেকেই কমিউনিস্টদের সাথে আমার বিরোধের শুরু। যদিও আমি কমিউনিস্ট পার্টির কোন সদস্য ছিলাম না, তবে তাদের সাথে আমার বন্ধুত্ব ছিল। প্রথমেই আমরা যে-বিষয় নিয়ে ঝগড়া করেছিলাম সেটি হল শিল্পের সমস্যা নিয়ে।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: তাহলে মেক্সিকো শহরের ১৯৪০ সালের পরাবাস্তবাদের প্রদর্শনীটা আপনার জন্য একটা সমস্যাই ছিল বলা যায়।
অক্তাবিও পাস: তখন আমি Taller নামের একটি ম্যাগাজিনের সম্পাদক ছিলাম। সেখানে আমার এক বন্ধু প্রকাশিত এক প্রবন্ধে বললো যে পরাবাস্তববাদিরা এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির উন্মোচন করেছে, তবে তারা নিজেরাই নিজেদের বিপ্লবের একাডেমি হয়ে উঠেছে। এটি ছিল ভুল ধারণা, বিশেষ করে ঐ বছরগুলিতে। তারপরও আমরা ঐ প্রবন্ধ প্রকাশ করি।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: প্রকাশ না বিনাশ বলবেন তাকে?
আলোকচিত্র: মেক্সিকো সিটিতে অক্তাবিও পাস
অক্তাবিও পাস: আমাদেরকে অবশ্যই ভুল স্বীকার করতে হবে। সেটি যদি না করি, তাহলে আমাদেরই ক্ষতি। আপনি কি তা মনে করেন না? এই সাক্ষাৎকারটিতো জনসাধারণের কাছে একধরণের স্বীকারোক্তির চর্চা- যে কারণে আমি খুবই শঙ্কিত।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: অক্টাভিও, আপনি কবি ও প্রবন্ধকার হওয়া সত্তেও দেখা যায় আপনার মধ্যে ঔপান্যাসিক প্রবণতা ছিল। আমি আপনার “ডায়েরি অব এ ড্রিমার” -এর কথা বলছি, যেটি আপনি ১৯৩৮ সালে আপনার Taller পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন। এবং ১৯৭০ সালে লেখা ‘দা মান্কি গ্রামারিয়ান’।
অক্তাবিও পাস: আমি ঐ ডায়েরিটাকে উপন্যাস ধরনের বলবো না। অনুধ্যান থেকে গড়ে ওঠা এক ধরনের নোটবুক। আমি সম্ভবত তখন রিলকে ও তাঁর নোটবুকস অব মাল্টে লাউরিডজ ব্রিগ্গে-এ আচ্ছন্ন ছিলাম। আমাকে তখন রিলক ও তাঁর নোটবুকস অব মালতে লুরিডস ব্রিগজ -এর জাদুমন্ত্রে পেয়ে বসেছিল। এটা সত্যি যে উপন্যাস সবসময়ই আমাকে প্রলুব্ধ করতো। কিন্তু তা সত্তেও আমি ঔপান্যাসিক হবার যোগ্য নই। উপন্যাসের শিল্প ভিন্ন দুই জিনিসকে সমন্বিত করে। এটি অনেকটা মহাকাব্যের মতো, বহু চরিত্রে পূর্ণ এক জগত যারা তাদের কর্মকাণ্ডের নির্যাস। তবে মহাকাব্য থেকে এর পার্থক্য হচ্ছে এইখানে যে উপন্যাস হচ্ছে বিশ্লেষণধর্মী। এটি চরিত্রদের কার্যকলাপের কথা বলে আবার একই সময়ে তাদের সমালোচনাও করে। টম জোনস, অদেত্তে ডি ক্রেসি, ইভান কার্মাজোভ বা ডন কিহোতে হচ্ছে এমন সব চরিত্র সমালোচনা যাদেরকে গিয়ে খেয়েছে। হোমার বা ভার্জিলে আপনি সেটা পাবেন না। দান্তের মধ্যেও না। মহাকাব্য মহিমান্বিত অথবা নিন্দা করে; আর উপন্যাস বিশ্লেষণ ও সমালোচনা করে। মহাকাব্যের নায়কেরা হলো একক, খাঁটি চরিত্র; আর উপন্যাসের চরিত্ররা হলো অষ্পষ্ট। সমালোচনা ও মহাকাব্য–এই দুটি মেরু উপন্যাসে এসে একত্রিত হয়।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: দা মান্কি গ্রামারিয়ান সম্পর্কে কি বলবেন?
অক্তাবিও পাস: আমি এটাকে উপন্যাস বলবো না। এটা উপন্যাসের সীমান্তের উপর দাড়িয়ে আছে। যদি এটা কিছু হয়েই থাকে, তাহলে বইটিকে প্রতি-উপন্যাস(Anti-novel) বলা যেতে পারে। আমি যখনই কোন উপন্যাস লিখতে প্রলুব্ধ হই, তখন নিজেকে বলি, কবিরা ঔপন্যাসিক নন। গ্যোঠের মতো কিছু কবি উপন্যাস লিখেছেন-ওগুলো ক্লান্তিকর। আমি মনে করি কাব্যিক প্রতিভা সংশ্লেষণধর্মী। কবি সংশ্লেষণ করে করেন, ঔপন্যাসিক করেন বিশ্লেষণ।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: আমরা যদি যুদ্ধের ঐ বছরগুলিতে মেক্সিকোর দিকে তাকাই, তাহলে পাবলো নেরুদার সাথে আপনার সম্পর্কের ব্যাপারে জানতে চাইবো, ১৯৪০ সালে তাঁকে যখন চিলির কনসাল জেনারেল হিসেবে মেক্সিকোতে পাঠানো হয়েছিল।
অক্তাবিও পাস: আগেই বলেছি যে, যখন আমি ত্রিশের দশকের আধুনিক কবিতা পড়া শুরু করি তখন নেরুদার কবিতা আমার কাছে দৈববাণীর মতো মনে হয়েছিল। যখন আমার প্রথম বই প্রকাশিত হয় তার একটি কপি আমি নেরুদার কাছে পাঠিয়েছিলাম। তিনি কখনও উত্তর দেন নি, কিন্তু তিনিই সে ব্যাক্তি যিনি আমাকে স্পেনের কংগ্রেসে নিমন্ত্রন জানিয়েছিলেন। ১৯৩৭ সালে যখন প্যারিসে যাই, তখন কাউকেই চিনতাম না। কিন্তু ট্রেন থেকে যখনই নামলাম, দীর্ঘদেহী এক ব্যাক্তি অক্টাভিও পাজ! অক্টাভিও পাজ! বলে চিৎকার করতে করতে আমার দিকে দৌড়ে এলেন। সে ব্যাক্তিটি হলেন নেরুদা। তখন তিনি বললেন, আরে, আপনি এত অল্পবয়সী! আমরা পরস্পরকে আলিঙ্গন করলাম। তিনি আমাকে হোটেল খুঁজে দিলেন। তারপর থেকে আমরা ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে গেলাম। তিনিই প্রথম আমার কবিতাকে গুরুত্ব দিলেন এবং সহানুভূতি সহকারে পাঠ করলেন।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: পরে কী হয়েছিল?
অক্তাবিও পাস: যখন তিনি মেক্সিকো এলেন, তখন প্রায়ই তার সাথে দেখা হতো, তবে ওতে কিছু সমস্যা হয়েছিল। প্রথমত: সমস্যাটা ছিল ব্যক্তিগত। নেরুদা খুবই মহৎ-প্রকৃতির ছিলেন, তবে খুব কর্তৃত্বপরায়নও ছিলেন। আমি সম্ভবত নিজের স্বাধীনতার ব্যাপারে খুব দ্রোহী ও ঈর্ষাপরায়ন ছিলাম। তাকে যারা ভালোবাসে তাদের দ্বারা পরিবৃত হয়ে থাকতে ভালোবাসতেন–তাদের মধ্যে কেউ কেউ বুদ্ধিদীপ্ত হলেও, বেশির ভাগ লোকই ছিল মাঝারি মানের। দ্বিতীয় সমস্যাটি ছিল রাজনৈতিক। আমি যখন স্তালিনের মোহ থেকে ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছি, তিনি তখন দিন দিন আরও বেশি স্তালিনবাদী হয়ে উঠতে লাগলেন। শেষমেষ, আমরা ঝগড়ায়–প্রায় হাতাহাতির পর্যায়ে–জড়িয়ে পরি, আমরা পরস্পরে সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেই। তিনি আমার সম্পর্কে খারাপ কিছু কথা লিখেছেন, এমনকি আমাকে নিয়ে একটি খারাপ কবিতাও। আমিও তার সম্পর্কে ভয়ংকর কিছু লিখেছিলাম। ব্যাপারটি এরকমই ছিল।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: পরে মিল হয়েছিল কি?
অক্তাবিও পাস: বিশ বছর আমরা পরস্পরের সাথে কথা বলিনি। অনেক সময় একই জায়াগায়, একই সময় থাকা সত্তেও। আমি জানতাম তিনি আমাদের পারষ্পারিক বন্ধুদের কাছে আমাকে “বিশ্বাসঘাতক” বলে অভিহিত করতো যাতে করে তারা আমাকে ভালো চোখে না দেখে। কিন্তু তারপর যখন স্টালিনের সন্ত্রাস সম্পর্কে ক্রুশ্চেভের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, তখন তার বিশ্বাসগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। এরপর লন্ডনে অনুষ্ঠিত একটি কবিতা উৎসবে আমাদের দেখা হয়। আমি তখন মাত্র দ্বিতীয় বিয়ে করি। নেরুদাও তাই। আমাদের সাথে পাবলোর স্ত্রী মাতিল্দে উররুতিয়ার সাথে যখন দেখা হয় তখন আমার সাথে ছিল আমার স্ত্রী, মারি হোসে। তিনি বললেন, যদি ভুল না হয়ে থাকে, আপনিই অক্টাভিও পাজ, তাই না? প্রত্যুত্তরে আমিও বললাম, আপনি নিশ্চয়ই মেতিল্দে। তিনি বললেন, আপনি কি নেরুদাকে দেখতে চান? অামার মনে হয় আপনাকে আবার দেখতে পেলে সে খুশীই হবে। আমরা পাবলোর রুমে গেলাম, তখন সেখানে এক সাংবাদিক তাঁর সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন। সাংবাদিক চলে যাওয়ার পর পরই তিনি আমাকে “মেরে ইয়ার(mi jito)” বলে সম্বোধন করলেন। ওরকম সম্ভাষণ শুনে আমি একটু বিব্রতও হয়েছিলাম। তাঁর আন্তরিক চিলিয়ান অভিব্যাক্তি-mi jito-ছিল খুবই আবেগপূর্ণ। আমাকে ভীষণ নাড়া দিল। প্রায় কেঁদেই ফেলছিলাম। আমাদের কথাবার্তা খুবই সংক্ষিপ্ত ছিল কারণ তখন তিনি চিলির পথে যাত্রা করছিলেন। তিনি আমাকে একটি বই পাঠিয়েছিলেন। আমিও আমার একটি বই পাঠালাম তাকে। আর এর কয়েক বছর পরই তিনি মারা যান। ঘটনাটা ছিল খুবই বেদনাদায়ক, তবে যে-মানুষটিকে আমি এত ভালোবাসতাম, যাকে এত পছন্দ করতাম তার সাথে আবারও বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার সম্ভাবনাটা ছিল অমাার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার।
আলোকচিত্র: যৌবনের শুরুতে প্রথম স্ত্রী লেখিকা এলেনা গাররোর সাথে অক্তাবিও পাস
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: এটি পরিস্কার যে আপনার জন্য চল্লিশের শুরুর দিকটা কঠিন সময় ছিল, মনে হয় ঐ সময় আপনাকে নির্দিষ্টভাবে নিজের বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থান ব্যাখ্যা করতে হয়েছিল।
অক্তাবিও পাস: সত্যিই তাই। পুরোনো বন্ধুদের সাথে–যাদের মধ্যে নেরুদাও ছিলেন–সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আমি ভীষণ রাজনৈতিক ঝামেলার মধ্যে ছিলাম। নতুন করে অন্যদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে হয়েছিল, এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, ফরাসি-রুশ লেখক, প্রবীন বিপ্লবী ভিক্টর সের্হে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাকে দেশ ছাড়ে নির্বাসনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আমার ভাগ্য ভালো ছিল, ঐ সময় আমি যুক্তরাষ্ট্র থেকে গগেনহেম ফেলোশিপ পাই। যুক্তরাষ্ট্রে দ্বিতীয়বারের মতো যাবার প্রাক্কালে প্রথমে আমি বার্কেলে যাই, তারপর নিউ ইয়র্ক। তখন কাউকেই চিনতাম না, আমার কাছে অর্থ-কড়িও ছিল না। একপ্রকার অসহায়ই ছিলাম। তবুও আমি খুশি ছিলাম। তখনকার ঐ সময়টা আমার জীবনের অন্যতম সেরা সময় ছিল।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: কেন?
অক্তাবিও পাস: আমি আমেরিকার মানুষদের আবিষ্কার করি এবং রোমাঞ্চিত হই। এটা অনেকটা খোলা জায়গায় স্বাধীন ও বুক ভরে নিঃশ্বাস নেবার মতো–নিজেকে উল্লসিত, হালকা ও আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছিল। আমি যখনই এদেশে আসতাম, তখনই এরকম মনে হতো। তবে একই রকম তীব্রতা ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রে ঐ দিনগুলি আমার ভিতর যেমন প্রাণসঞ্চার করেছিল, ঠিক তেমনই রাজনীতি থেকে দূরে গিয়ে কবিতার মধ্যে ডুবে যাই। কনার্ড আইকেনস’র এনথোলজি অব মডার্ণ আমেরিকান পোয়েট্রির মাধ্যমে আমি আমেরিকান কবিতা আবিস্কার করি । ইতিমধ্যে আমার এলিয়ট পড়া ছিল; কিন্তু আমি উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামস বা পাউন্ড বা মারিয়ান মুর সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। হার্ট ক্রেনের কবিতার সাথে আমি কিছুটা পরিচিত ছিলাম-তাঁর জীবনের শেষ কিছু বছর তিনি মেক্সিকোতে কাটিয়েছিলেন। কবিতার চেয়েও তিনি ব্যক্তি হিসেবে অনেক বড় কিংবদন্তী ছিলেন। আমি যখন বার্কলেতে ছিলাম, তখন মুরিয়েল রাকেসের-এর সাথে দেখা হয়। তিনি আমার বেশ কিছু কবিতা খুবই আন্তরিকভাবে অনুবাদ করেছিলেন। আমার জন্য সে মুহূতর্টি চমৎকার ছিল। এর কয়েক বছর পরে, তিনি সেগুলিকে লন্ডনে স্পেন্ডার ও সিরিল কোন্নলির সম্পাদিত Horizon পত্রিকায় পাঠান এবং সেখানে ওগুলো প্রকাশিত হয়। আমার জন্য এটা ছিল…
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: উন্নতি?
অক্তাবিও পাস: খুবই সামান্য উন্নতি। নিউ ইয়র্কে Partisan Review-এর খুব বড় পাঠক হয়ে উঠি, ওখান থেকে পরে আমি প্যারিসে যাই। সেখানে আমি মেক্সিকোতে পরিচিত হওয়া কিছু বন্ধু পেয়ে যাই। যেমন, বেঞ্জামিন পেরেট। তাঁর মাধ্যমে, শেষে দেখা হয় আঁদ্রে ব্রেতোঁর সাথে। আমরা বন্ধু হয়ে যাই। পরাবাস্তববাদ তখন অবক্ষয়ের দিকে , কিন্তু ফরাসী সাহিত্যের জীবনে পরাবাস্তববাদ ছিল সাস্থ্যকর, প্রাণবন্ত এবং দ্রোহী।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: কি বোঝাতে চাচ্ছেন?
অক্তাবিও পাস: ফরাসিরা যা ভুলে গিয়েছিল, যেমন যুক্তির অপর পিঠ, প্রেম স্বাধীনতা ও প্রেম– পরাবাস্তববাদীরা তা মূর্ত করে তুলেছিল। ফরাসীদের মধ্যে যুক্তিবাদী হবার প্রবণতা, সবকিছুকে ধারণায় সীমিত করে সে নিয়ে তর্ক করার একটা প্রবণতা রয়েছে। আমি যখন সেখানে যাই, জাঁ পল সার্ত্রে ছিল প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: কিন্তু অস্তিত্ববাদতো আপনার কাছে তখন পুরানো টুপির মতো।
অক্তাবিও পাস: তা ঠিক। মাদ্রিদে তখন স্প্যানিশ দার্শনিক ওর্তেগা ই গাসেৎ- ও পরে মেক্সিকো শহর এবং বুয়েনস আইরেসে তাঁর শিষ্যরা হুসার্ল থেকে হা্ইডেগার পর্যন্ত ফেনোমেনলোজি এবং অস্তিত্ববাদের প্রধান সব রচনাগুলো প্রকাশ করেছিল। । তাই সার্ত্রে নতুন কিছু করার চেয়ে বরং সেগুলিকে আরো বেশী চতুরতার সাথে রূপান্তর বা বৈচিত্র এনে বর্ণনা করেছিলেন। তাছাড়া আমি সার্ত্রের রাজনীতিরও বিপক্ষে ছিলাম। ফরাসী অস্তীত্ববাদের সাথে যুক্ত যে-মানুষটির সাথে বন্ধুত্ব ছিল এবং যিনি অামার প্রতি মহানুভবতা দেখিয়েছেন তিনি আলবেয়ার ক্যামু। কিন্তু আমি অবশ্যই বলবো যে আমি পরাবাস্তববাদী কবিদের অনেক বেশি কাছাকাছি ছিলাম।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: কিন্তু চল্লিশের শেষের দিকে দুটি পুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশ করেছিলেন একটি হচ্ছে Freedom on Parole আর অন্যটি হচ্ছে The Labyrinth of Solitude। আমি সব সময় আপনার Freedom on Parole শিরোনামটির প্রতি কৌতুহলী ছিলাম। এর সাথে ভবিষ্যবাদী কবি মেরিনেত্তি’র “words on leave”-এর কি কোন সম্পর্ক রয়েছে?
অক্তাবিও পাস: আমি মনে হয় না। মেরিনেত্তি শব্দকে পদবিন্যাস ও ব্যাকাররণর শৃংখল থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন, যেটা ছিল এক ধরনের নান্দনিক ধ্বংসবাদ। Freedom on Parole -এ নন্দনতত্ত চেয়ে বরং নৈতিকতাকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আমি খুবই সহজভাবে বলতে চেয়েছি যে মানুষের স্বাধীনতা শর্তাধীন। আপনি যখন কারাগার থেকে বের হন, তখন ইংরেজীতে একে বলা হয় “on parole,” আর parole মানে হলো ‘বলা’, ‘শব্দ’, ‘সম্মানজনক শব্দ’। তবে আপনি যে-শর্তের অধীনে মুক্ত আছেন, তা হলো ভাষা, মানুষের সচেতনতা।
আলোকচিত্র: মধ্য বয়সে অক্তাবিও পাস
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: তাহলে আপনার কাছে বাকস্বাধীনতার মানে কি মনের কথা বলার অধিকারের থেকেও বেশী?
অক্তাবিও পাস: অবশ্যই। সেই কিশোরকাল থেকেই আমি স্বাধীনতার রহস্যের মধ্যে আটকে যাই। কারণ এটি একটি রহস্য। স্বাধীনতা এমন কিছুর উপর নির্ভর করে যা সীমিত করে বা অস্বীকার করে থাকে যে-কোনকিছুকে, হতে পারে তা ভাগ্য, ঈশ্বর, জৈবিক, অথবা সামাজিক নিয়তিবাদ। সে লক্ষ্য পূরণে, ভাগ্য আমাদের স্বাধীনতার দুষ্কর্মের উপর নির্ভর করে, এবং মুক্ত হওয়ার জন্য আমরা অবশ্যই নিয়তিকে অতিক্রম করবো। স্বাধীনতা ও নিয়তির দ্বান্ধিকতা গ্রিক ট্রাজেডি ও শেক্সপিয়রের মূল বিষয়, যদিও শেক্সপিয়রে নিয়তিকে আবেগ ( প্রেম, ঈর্ষা, উচ্চাশা, পরশ্রীকাতরতা) ও সুযোগ রূপে আবির্ভূত হতে দেখা যায়। স্প্যানিশ থিয়েটারে-বিশেষ করে কাল্দেরন ও তিরসো দে মলিনাতে-স্বাধীনতার রহস্য নিজেকে খ্রিস্টীয় ধর্মতত্তের ভাষায় প্রকাশ করেছে, যেমন: দৈবযোগ ও স্বাধীন ইচ্ছা’ এভাবে। শর্তাধীন স্বাধীনতার ধারণা নির্ভর করে ব্যাক্তিগত দায়-দায়িত্বের উপর। আমাদের প্রত্যেকেই, আক্ষরিক অর্থে, হয় নিজের স্বাধীনতার সুযোগ তৈরী করি অথবা ধ্বংস করি। স্বাধীনতা সবসময়ই অনিশ্চিত। এবং এটি কবিতার শিরোনাম বা নান্দনিক অর্থ তৈরী করে:কবিতা, স্বাধীনতা, এরকম করে বিভিন্ন আঙ্গিকে, ভাষায় চিহ্নিত হয়েছে।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: আপনিতো ১৯৩৫ এবং ১৯৫৭ সালের মধ্যে Freedom on parole লিখেছেন, যা বিশ বছরেরও বেশী সময় ধরে..
অক্তাবিও পাস: আমি অনেকবার বইটি লিখেছি। (লিখেছি আবার পুনর্লিখন করেছি)
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: এটা কি আত্মজীবনী?
অক্তাবিও পাস: হ্যাঁ এবং না দু’টোই। বইটিতে যৌবনের শুরু থেকে পরিণত হওয়া পর্যন্ত আমার নান্দনিক ও ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। একুশ বছর বয়সে আমি প্রথম কবিতা লিখি। আর শেষ কবিতাটি লিখি যখন আমার বয়স ৪৩। ঐসব কবিতার আসল নায়ক কিন্তু অক্টাভিও পাজ নয় বরং বলা যায় আধা-বাস্তব, আধা-পৌরাণিক চরিত্রের কোন এক কবি। যদিও ঐ কবি আমারই বয়সী, আমারই ভাষায় কথা বলে এবং তাঁর মৌলিক বিবরণের সাথে আমার মিল আছে, তবু সে অন্য কেউ। সে ঐতিহ্য থেকে আসা একটি চরিত্র,এক প্রতিমা। প্রত্যেক কবিই ওই ক্ষণস্থায়ী চরিত্রের অবতার।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: দা ল্যবিরিন্থ অব সলিটিউড বইটিতেও কি আত্মজীবনীমূলক মাত্রা রয়েছে?
অক্তাবিও পাস: আবারো বলব হ্যাঁ এবং না। দা ল্যবিরিন্থ অব সলিটিউড আমি প্যারিসে বসে লিখি। আমেরিকা থাকাকালে লস এঞ্জেলসে বসবাসরত সেই সব মেক্সিকানদের–যাদেরকে আজ পাচুকো বা চিকানো বলা হয়–তাদের অবস্থা বিশ্লেষণ করার সময় বইটির ধারণা আসে। আমার কাছে তাদেরকে একধরণের আয়না মনে হতো—আর আত্মজীবনীতে আপনি সেটি দেখতে পছন্দ করবেন। এটি হলো এক দিক্ । অন্যদিকে, আমেরিকা আর মেক্সিকোর মধ্যকার সম্পর্কের বিষয়টিও ছিল। পৃথিবীতে যদি দু’টি ভিন্ন দেশ থাকে, তাহলো সে দুটো হচ্চে আমেরিকা আর মেক্সিকো। কিন্তু অামারা চিরকাল একসাথে থাকার জন্য নিন্দিত। সুতরাং আমাদের পরস্পরকে বোঝার জন্য, নিজেদেরকে জানার জন্য আরো চেষ্টা করা উচিত। এভাকেই দা ল্যবিরিন্থ অব সলিটিউড-এর শুরু হয়।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: বইটিতে অনেক বিষয়েরই অবতারণা করা হয়েছে, যেমনঃ বিবাদ, তিক্ততা, মেক্সিকান মানুষদের দুর্বোধ্য আচরণ, কিন্তু এটা কবির জীবনকে স্পর্শ করেনা।
অক্তাবিও পাস: ঠিক। আমি ওই বিষয়টা “পোয়েট্রি অব সলিটিউড আর পোয়েট্রি অব কমিউনিকেশন” নামক আমার ছোট প্রবন্ধে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। প্রবন্ধটি কিছুটা দা ল্যবিরিন্থ অব সলিটিউড-এর কাব্যিক সমতূল্য, কারণ এটা মানুষ সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে যেটা খুবই সহজ। প্রত্যেক মানুষেরর জন্য দুটি পরিস্থিতি রয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে আমাদের ভূমিষ্ঠ হবার পরে নিঃসঙ্গতার অনুভূতি। আমাদের প্রথম অবস্থা অনাথের মতো, আর কিছুকাল পরে ঠিক এর বিপরীত অবস্থাই শুধু হয়না, সন্তানোচিত বন্ধনেও আবদ্ধ হতে হয়। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, যেহেতু আমরা নিক্ষিপ্ত হয়েছি, হইডেগারের মতে, এই জগতে, আমরা মনে করি যা কিছু খুঁজি তা-ই পাব, বুদ্ধ যেটিকে বলেছেন, “অন্য এক অংশ ”। এটা হলো একটি সম্প্রদায়ের জন্য তৃষ্ণা। আমি মনে করি দর্শন ও ধর্ম এই মূল জায়গা বা দূর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি থেকে আসে। প্রত্যেক দেশ, প্রত্যেক মানুষ এটি সমাধানে আলাদা আলাদাভাবে চেষ্টা করে। কবিতা হলো নিসঙ্গতা ও কমুনিয়নের মধ্যে এক সেতু বন্ধন। কমুনিয়ন, এমনকি সেইন্ট জন অব দা ক্রসের মতো যতই মরমী হোক না কেন, সেটি কখননো পরম হতে পারে না।
আলোকচিত্র: পরিণত বয়সে অক্তাবিও পাস
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: এ কারণেই কি মরমীবাদের ভাষা এত প্রেমময়?
অক্তাবিও পাস: হ্যাঁ, কারণ প্রেমিকরা, যে-কারণে তারা মরমী তারা কমুনিয়নের এক শ্রেষ্ঠতম প্রতিমা নির্মাণ করে। এমনকি এর প্রেমিকদের মধ্যেও নির্জনতা সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়না। বিপরীতভাবে, নির্জনতা কখনো পরম নয়। আমরা সব সময়ই কারোর না কারোর সাথে বাস করি, সেটি আমাদের নিজেদের ছাঁয়াও হয়। আমরা কখনোই একা নই- আমরা সবসময়ই ‘আমরা’। মানব জীবনে এই দুই চূড়ান্ত মেরুর সহাবস্থান।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: সব মিলিয়ে আপনি বিদেশে আট বছর কাটিয়েছেন। প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রে, তারপর প্যারিসে, সেখান থেকে আবার মেক্সিকোর কূটনৈতিক চাকুরিতে। কবি হিসেবে ঐ বছরগুলিকে কিভাবে দেখেন?
অক্তাবিও পাস: আসলে আমি নয় বছর বিদেশে কাটিয়েছি। যদি আপনি ঐ বছরগুলিকে একটি মাস হিসাবে গণনা করেন, তাহলে দেখতে পাবেন যে ঐ নয়টি বছর আসলে কালের গর্ভে নয় মাসের মতো। সান ফ্রান্সিসকো, নিউ ইয়র্ক এবং প্যারিসের থাকাকালীন সে বছরগুলি আমার গর্ভকালীন সময় ছিল। আমার পূনর্জন্ম হয়েছিল। সেই মানুষটি যখন ১৯৫২ সালে মেক্সিকোতে এসেছিল, তখন সে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক কবি, ভিন্ন এক লেখক। যদি ঐ সময় আমি মেক্সিকোতে থাকতাম আমি হয়তো সাংবাদিকতা, আমালাতন্ত্র, অথবা মদে ডুবে থাকতাম। আমি সে জগৎ থেকে দৌড়ে পালাই, হয়তো বা আমার নিজের জন্যেই।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: কিন্তু আপনি যখন ফিরে এলেন তখন উড়নচন্ডী হিসেবে কমই বিবেচিত হয়েছেন…
অক্তাবিও পাস: অল্প কয়েকজন তরুণ ছাড়া আমাকে আদৌ কেউ গ্রহণ করেনি। আমি কর্তৃত্বপরায়ন নান্দিকতা, নৈতিকতা ও রাজনৈতিক ধারণার চাপে ভেঙে পড়েছিলাম এবং সংকীর্ণ মতাদর্শ ও কুসংস্কারে অন্ধবিশ্বাসী এ রকম অনেক মানুষের দ্বারা তাৎক্ষণিকভাবে আক্রান্ত হয়েছিলাম। সেটাই ছিল মতানৈক্যের শুরু যা আজও শেষ হয়নি। এটি নিছক কোন আদর্শগত মতবিরোধ নয়। নিশ্চিতভাবেই সেই বিতর্ক তিক্ত ও কঠিন ছিল। এমনকি কিছু মানুষের অমঙ্গল কামনা, অন্যকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও সংখ্যাগরিষ্ঠের বাকসংযোমেরও কোন ব্যাখ্যা করা যেতনা। আমি হতাশ ও রাগন্বিত হয়েছি, কিন্তু তবুও ওসব গায়ে না-মেখে আবার সামনে এগিয়েছি। এখন ওই বিবাদকে আমার জন্য আশির্বাদ বলেই মনে হয়: যদি কোন লেখক গৃহিত হয়, তাহলে শিঘ্রই তিনি প্রত্যাখ্যাত হবেন বা বিস্মৃত হবেন। আমি তো সমস্যাজনক লেখক হওয়ার লক্ষ্যে শুরু করিনি, তবে সেটাই যদি হয়ে থাকি তাহলে আমি পুরোপুরি অনুতাপহীন।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: ১৯৫৯ সালে আপনি আবার মেক্সিকো থেকে চলে যান।
অক্তাবিও পাস: তারপর ১৯৭১ সালে আগে আর ফিরিনা। এই বারো বছরের অনুপস্থিতি- আরেকটি প্রতীকি সংখ্যা। আমি আবার ফিরে আসি। কারণ, মেক্সিকো আমার কাছে চুম্বকের মতো যার আকর্ষণ আমি ঠেকাতে পারি না। একেবারে খাঁটি আবেগ। পাশাপাশি, গভীর আনন্দ ও আবেগের হতভাগ্য একজন।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: ঐ বারো বছর সম্পর্কে কিছু বলুন। প্রথমে আপনি প্যারিস গিয়েছিলেন, তারপর ভারত গেলেন মেক্সিকোর কূটনৈতিক হিসেবে। পরে আবার ইংল্যান্ড সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে।
অক্তাবিও পাস: আমি যখন Freedom on Parole চূড়ান্ত সংস্করণ শেষ করলাম, আমার মনে হয়েছিল আমি আবার শুরু করলাম। আমি নতুন কাব্যিক জগৎ আবিষ্কার করলাম। অন্য সব দেশ জানলাম। অন্যদের অনুভূতি ও ভাবনার মধ্যে বাস করতে শুরু করি। আমার প্রথম ও শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতা হলো ভারতে। অন্য এক ভৌগলিক স্থান, আলাদা এক মানবতা, আলাদা সব দেবতা- ভিন্ন ধরনের এক সভ্যতা। সেখানে আমি ঠিক ছয় বছরের বেশি সময় কাটাই। আমি উপমহাদেশের বেশ খানিকটা ঘুরে বেরিয়েছি, শ্রলংকা এবং আফগানিস্তান-ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিকভাবে এই দুই স্বতন্ত্র দেশে কিছু সময় কাটিয়েছি । যদি ভারত সম্পর্কে আমাকে একটি মাত্র দৃশ্যকল্পে কিছু প্রকাশ করতে হয়, তাহলে আমি বলবো তার বিস্তীর্ণ সমভূমি, সাদা, ক্ষয়িষ্ণু স্থাপত্য, স্রোতস্বিনী নদী, অতিকায় এক বৃক্ষ, তার ছায়ায় একটি কাঠাম ( ভিক্ষুক, বুদ্ধু আর পাথরের স্তুপ)। এর বাইরে গাছের গ্রন্থি ও শাখাপ্রশাখার মাঝে এক নারীর উত্থান… আমি প্রেমে পড়ি আর ভারতে আমরা বিয়ে করি।
আলোকচিত্র: ষাটের দশকের শেষ দিকে এক ভারতীয়র সাথে দিল্লীতে অক্তাবিও পাস
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: আপনি কখন থেকে এশিয় চিন্তায় গভীরভাবে আগ্রহী হয়ে উঠলেন?
অক্তাবিও পাস:১৯৫২ সালে প্রাচ্যে আমার যাত্রা দিয়েই শুরু হয়েছিল। আমি প্রায় এক বছর ভারত ও জাপানে কাঁটাই। আমি সে সব দেশের শৈল্পিক ও দার্শনিক ঐতিহ্যের মধ্যে খানিকটা প্রবেশ করেছিলাম। আমি সেখানকার নানা জায়গা ঘুরি আর ভারতীয় চিরায়ত চিন্তাভাবনার বই্টই পড়ি। আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল চীন ও জাপানের কবি ও দার্শনিকরা। ভারতে আমার দ্বিতীয়বার থাকাকালে, সেটি ১৯৬২ থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত, তখন আমি প্রচুর দার্শনিক ও ধর্মীয় লেখা পড়ি। বৌদ্ধধর্ম আমাকে গভীরভাবে মুগ্ধ করেছিল।
আলোকচিত্র: ষাটের দশকের শেষ দিকে শ্রীলংকায় এক মন্দিরের সামনে অক্তাবিও পাস
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: আপনি কি ধর্মান্তরিত হতে চেয়েছিলেন?
অক্তাবিও পাস: না, কিন্তু বৌদ্ধধর্ম অধ্যায়ন ছিল আমার কাছে একধরণের মানুষিক ও আধ্যাত্মিক চর্চা যা আমাকে অহং ও ভ্রান্ত আশা সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করতে সাহায্য করেছিল। অহংয়ের অর্চনা মানে আধুনিক মানুষের শ্রেষ্ঠ মূর্তিপূজা। আমার কাছে বৌদ্ধধর্ম হলো অহং ও বাস্তববোধের সমালোচনা। কোন মৌলিক সমালোচনা কখনো অস্বীকৃতির মধ্যে দিয়ে শেষ হয় না, বরং গ্রহণেই শেষ হয়। ভারতে বুদ্ধের বিখ্যাত সব উপসানালয়গুলিতে (হিন্দু মন্দিরগুলোতেও সেরকম আছে, কিন্তু যেহেতু সেগুলি পরে তৈরী করা হয়েছে, সেহেতু একটু বেশী চটকদার ও বিশদভাবে তুলে ধরা হয়েছে) রয়েছে যৌনউদ্দীপক ভাস্কর্য এবং দেয়ালচিত্র। শক্তিশালী কিন্তু প্রশান্ত এক যৌনতার চিত্র। ধর্মীয় ও দার্শনিক ঐতিহ্যের মধ্যে দৈহিক ও প্রাকৃতিক শক্তির চরম আনন্দ পৃথিবী যেভাবে তুচ্ছ করে আর নেতি ও শূণ্যতাকে তুলে ধরে তা দেখে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। ঐ বছরগুলিতে লেখা আমার ছোট্ট বই Conjunctions and Disjunctions-এর মূল বিষয় ছিল এটাই।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: মেক্সিকোর রাষ্ট্রদূত হয়েও ভারতকে আবিস্কারের কাজে ভারসাম্য বজায় রাখা কি কঠিন ছিল?
অক্তাবিও পাস: আমার রাষ্ট্রদূতের কাজ তেমন কষ্টসাধ্য ছিলনা। আমার সময় ছিল, আমি ভ্রমন ও লিখতে পারতাম। এবং তা শুধু মাত্র ভারত সম্পর্কেই নয়। ১৯৬৮ সালের ছাত্র-আন্দোলন আমাকে মুগ্ধ করেছিল। মনে হচ্ছিল যেন নিশ্চিতভাবে আমার নিজ যৌবনের আশা আকাঙ্ক্ষার পুনর্জন্ম লাভ করছে । আমি কখনও আশা করিনি যে বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে সমাজের রূপান্তর ঘটবে। তবে আমি বুঝতে পারছিলাম যে আমি এমন এক নতুন সংবেদশীলতার সাক্ষী হতে যাচ্ছি যার সাথে মিল রয়েছে আমার আগের অনুভূতি ও ভাবনার।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: ইতিহাস পুনারাবৃত্তি হচ্ছে, এরকম কি মনে হয়েছিল?
অক্তাবিও পাস: এক অর্থে তাই। ১৯৬৮ সালের ছাত্র ও পরাবাস্তববাদী কবিদের মধ্যে মনোভাবের কিছু সাদৃশ্য পরিস্কারভাবেই দেখা গিয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম উইলিয়াম ব্লেক ঐ তরুনদের কথায় ও কাজের প্রতি সহনাভূতিশীল হতে পারতেন। আদর্শগত দিক দিয়ে মেক্সিকোর ছাত্র আন্দোলন, ফ্রান্স কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও এগিয়ে ছিল। কিন্ত এরও ন্যায়সঙ্গত উচ্চাকাংখা ছিল। বিপ্লব থেকে জন্ম নেয়া মেক্সিকান রাজনৈতিক ব্যবস্থা বেঁচে থাকলেও তা ঐতিহাসিক জড়ায় আক্রান্ত হয়ে পরেছিল। ১৯৬৮ সালের, ২ অক্টোবর, মেক্সিকোর সরকার ছাত্র আন্দোল দমন করার জন্য সহিংস পথ বেছে নেয়ার সিন্ধান্ত গ্রহণ করে। সেটি এক পাশবিক কাজ ছিল। আমি অনুভব করলাম এ সরকারের জন্য কাজ করা ঠিক হবেনা। আমি কূটনৈকিত পদ থেকে ইস্তফা দিলাম।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: প্যরিস তারপর যুক্তরাষ্ট্র যাবার আগে আপনি ঐ বছর কেমব্রিজে কাটিয়েছিলেন।
অক্তাবিও পাস: হ্যাঁ, সেই মাসগুলিতে আমি মেক্সিকোর সাম্প্রতিক ইতিহাসের প্রতিবিম্ব রচনা করছিলাম। ১৯১০ সালের দিকে মহান গণতন্ত্রের উচ্চাশা নিয়ে বিপ্লবের শুরু হয়। অর্ধ শতাব্দীরও বেশি কাল পরে, জাতি একটি পিতৃতান্ত্রিক স্বৈরশাসক দলের নিয়ন্ত্রণে ছিল। সুতরাং ১৯৬৯ সালে আমি দা The Labyrinth of Solitude-এর জন্য একটা উত্তরভাষ্য(postscript) লিখি। আমি সেখানে রূপক অর্থে মেক্সিকোর স্বৈরতন্ত্রকে (‘ক্রিটিক অব দা পিরামিড’) পিরামিডের সাথে তুলনা করে সমালোচনা করি। আমি সেখানে জানিয়েছি, যে রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক সংকটের মধ্যে দিয়ে আমরা যাচ্ছি, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান যে বিপ্লবের দ্বারা পঙ্গু হয়ে আছে, তা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো গণতন্ত্রের সংস্কার।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: কিন্তু ছাত্র আন্দোলনে দাবির সাথে এটার কোনো আবশ্যকতা ছিল না।
অক্তাবিও পাস: না। ছাত্র নেতারা ও বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি সহিংস সামাজিক বিপ্লবকে সহযোগিতা করেছিল। তাঁরা কিউবার বিপ্লবের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। এমনকি এখনো সেখানে অনেক মানুষ আছেন যারা ফিদেল কাস্ত্রোকে সমর্থন করেন। অামার দৃষ্টিভঙ্গি আমাকে একই সাথে সরকার ও বামপন্থীদের বিরোধী অবস্থানে নিয়ে গেছে। “প্রগতিশীল” বুদ্ধিজীবীরা, যাদের প্রায় সবাই টোটালিটারিয়ান সমাজতন্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল তাঁরা আমাকে তীব্রভাবে আক্রমন করে। আমিও তাদেরকে আক্রমণ করি। বরং বলা ভালো, আমরা পরস্পর লড়াই করি–একটি ক্ষুদ্র তরুণ লেখকগোষ্ঠী আমার কিছু কিছু ভাবনাকে সমর্থন করেছিল। আমরা সকলে শান্তিপূর্ণভাবে ধীরে ধীরে গণতন্ত্রের পথে যাওয়াতে বিশ্বাসী ছিলাম। আমরা Plural নামে একটি ম্যাগাজিন প্রকাশ করতাম যেখানে সাহিত্য, শিল্প ও রাজনৈতিক সমালোচনা থাকতো। এখানেও সংকট সৃষ্টি হলো। তাই আমরা Vuelta নামে আরেকটি ম্যাগাজিন চালু করেছিলাম। যেটি এখনো বেশ শক্তিশালী অবস্থান নিয়ে আছে, এবং পাঠকের আছে এর চাহিদা আছে। মেক্সিকোর পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। আর এখন আমাদের অনেক পুরানো শত্রুরা নিজেদেরকে গণতান্ত্রিক বলে দাবী করেন। আমরা এখন গণতন্ত্রের অন্তবর্তীকালিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। এতে বাধা-বিপত্তি আসতে পারে এবং সে কারণে অগ্রগতি কিছুসময়ের জন্য বাধাপ্রাপ্তও হতে পারে।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: আপনি কি নিজেকে লাতিন আমেরিকান রাষ্ট্রনায়ক-লেখকদের সেই দীর্ঘ কাতারের একজন বলে বিবেচনা করেন যেখানে আমরা দেখতে পাই আর্জেন্টিনার উনিশ শতকের সার্মিয়েন্তো এবং বিশ শতকের নেরুদাকে?
অক্তাবিও পাস: আমি নিজেকে একজন রাষ্ট্রনায়ক-কবি হিসেবে দেখি না। আর সত্যিই আমি সার্মিয়েন্তো বা নেরুদার সাথে তুলনীয় না। সার্মিয়েন্তো একজন সত্যিকারের রাষ্ট্রনায়ক ও বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। সর্বোপরি মস্ত বড় লেখক ছিলেন। নেরুদা একজন কবি ছিলেন। মহান এক কবি। তিনি কমিউনিষ্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। সেটা উদার, আধা-ধর্মীয় কারনে। এটা একটি আসল রূপান্তর ছিল। তাই তাঁর রাজনৈতিক রণমুখীতা( militance) একজন বুদ্ধিজীবি হিসেবে ছিলনা বরং একজন বিশ্বাসী হিসেবে ছিল। দলের ভিতর তিনি মনে হয় একজন রাজনৈতিক প্রয়োগবাদী(pragmatist) ছিলেন। তবে, তিনি একজন সমালোচনাধর্মী বুদ্ধিজীবীর চেয়ে বরং একজন বিশ্বস্ত ধরনের ব্যক্তিত্ব ছিলেন। আর আমি কোন রাজনৈতিক দলের সদস্যপদ গ্রহণ করিনি কিংবা কোন সরকারী দপ্তরও পরিচালনা করিনি। আমি একজন স্বাধীন লেখক হিসেবে প্রান্তিক অবস্থান থেকে রাজনৈতিক ও সামাজিক সমালোচনা করেছি। আমি তক্ষক নই, যদিও অবশ্যই আমার ব্যক্তিগত কিছু পছন্দ-অপছন্দ ছিল এবং আছেও। আমি মারিও ভার্গাস য়োসা থেকে ভিন্ন, যিনি তাঁর দেশের রাজনীতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। মারিও ভার্গাস য়োসা অনেকটা দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পরবর্তী চেকেশ্লোভাকিয়ার হাভেল অথবা ফ্রান্সের মালরোর মতো।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: কিন্তু সাহিত্য বা সংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রাজনীতিকে আলাদা করা তো প্রায় অসম্ভব।
অক্তাবিও পাস: আলোকায়ন(Enlightenment)-এর পর থেকেই সাহিত্য, দর্শন ও রাজনীতি একত্রিত হয়ে একটি অনিবার্য মোহনা হয়ে ওঠে। ইংরেজী ভাষাভাষী জগতে মিল্টন ছিলেন একজন পূর্বসূরী, একই সঙ্গে উনিশ শতকের এক মহান রোমান্টিক ব্যক্তিত্ব। বিশ শতকেও এরকম অনেক উদাহরণ আছে। যেমন, এলিয়ট, যিনি রাজনীতিতে কখনই অংশ নেন নি, কিন্তু তাঁর লেখায় ছিল ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ রক্ষার আবেগ, যে-মূল্যবোধের একটা রাজনৈতিক মাত্রা ছিল। তার সাথে যদিও আমার মতের পুরোপুরি পার্থক্য রয়েছে, তারপরের এলিয়টের কথা বললাম এই জন্য যে তিনি ছিলেন স্বাধীন এক লেখক যিনি কোনো দলে যোগ দেননি। আমি নিজেকে নির্দলীয়(Private) লোক বলে মনে করি যদিও আমি মত প্রকাশের এবং আমার দেশ ও সমকালীন কোন কিছুকে ক্ষতি করতে পারে এরকম বিষয়গুলি নিয়ে লেখার অধিকার রাখি। আমি যখন তরুণ ছিলাম, তখন নাৎসী সর্বগ্রাসী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলাম। পরবর্তীতে সোভিয়েট একনায়কতন্ত্রের বিরোধিতা করেছি। লড়াইয়ে আমার সামান্যতম অনুতাপ নেই্।
আলোকচিত্র: ষাটের দশকের শেষ দিকে আর্জেন্টিনার বিখ্যাত ঔপন্যাসিক হুলিও কোর্তাসারের সাথে দিল্লীতে অক্তাবিও পাস
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: ভারতে আপনার থাকার সময় এবং আপনার কবিতায় এর প্রভাবের কথা ভাবলে, ভারতের প্রভাব সম্পর্কে আপনি কী বলবেন?
অক্তাবিও পাস: আমি যদি ভারতে না থাকতাম তাহলে Blanco অথবা Eastern Slope-এর বেশির ভাগ কবিতাই লেখা হতো না। এশিয়ায় থাকার কালটি ছিল আমার জন্য এক দীর্ঘ বিরতি, যেন সময় থমকে গিয়েছিল আর স্থান প্রসারিত হয়ে গিয়েছিল। কোনো কোনো বিরল মুহূর্তে, আমি সত্ত্বার এমন সব অবস্থার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি যেখানে আমাদের চারপাশের পৃথিবীর সাথে এক হয়ে গিয়েছিলাম, যখন সময়ের দরজাগুলো খুলে গেছে বলে মনে হতো,যদিও খুব সামান্যই। আমরা সবাই ওই মুহূর্তগুলো শৈশবে যাপন করি, কিন্তু আধুনিক জীবন কদাচিৎ আমাদেরকে সেই অভিজ্ঞতা দেয় আমাদের পরিণত বয়সে। আমার কবিতা প্রসঙ্গে বলা যায়, সে সময় আমার Salamander দিয়ে শুরু হয়ে Eastern Slope-এ এসে সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছায় আর The Monkey Grammarian-এ এসে শেষ হয়।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: কিন্তু The Monkey Grammarian ১৯৭০ সালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে থাকাকালীন সময়ে লিখেছিলেন না?
অক্তাবিও পাস: হ্যাঁ। সেটি ছিল ভারত থেকে আমার বিদায়ের পর। ইংল্যান্ডে সেই বছর আমার মধ্যে কিছু পরিবর্তনও হয়। বিশেষভাবে অতি আবশ্যকীয় ইংরেজী ‘ভদ্রতা’ বলে আমরা যা জানি, সেটি। যা খামখেয়ালীর চর্চা ছাড়া আর কিছুই না। সেটি আমাকে কেবল পাশের মানুষকেই সম্মান করতে শেখায়নি বরং আশেপাশের গাছ-পালা, পশু-পাখি সব কিছুকে সম্মান করতে শিক্ষা দিয়েছে। আমি তখন নির্দিষ্ট কয়েকজন কবি সম্পর্কেও পড়ি। চার্লস টমলিনসনকে ধন্যবাদ জানাবো, আমি ওয়ার্ডসওয়ার্থকে আবিস্কার করি। The Prelude আমার অন্যতম একটি প্রিয় বই হয়ে পড়ে। আমার A Draft of Shadows-তে এর কিছু প্রতিধ্বনি থাকতে পারে।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: আপনার লেখার জন্য কি কোন সময়সূচী আছে?
অক্তাবিও পাস: আমি কখনই নির্দিষ্ট সময় মেনে লিখতে পারিনি। বহু বছর যাবৎ আমি অল্প কিছু স্বাধীন মুহূর্তে লিখেছি। ছোটবেলায় আমি বেশ গরিব ছিলাম। তখন জীবিকা নির্বাহের জন্য যে কোন কাজকেই লুফে নিতাম। আমি ন্যাশনাল আর্কাইভের একজন ছোটখাট কর্মচারী ছিলাম; আমি ব্যাংকে কাজ করেছি; সাংবাদিকতাও করেছি। সবশেষে, একটি আরামদায়ক অথচ ব্যস্ততম কূটনৈতিক কাজে যোগ দিয়েছি, কিন্তু কোন চাকুরিই কবি হিসেবে আমার কাজে আদৌ কোনো প্রভাব ফেলেনি।
আলফ্রেড ম্যাক এ্যাডাম: আপনার লেখালেখি কাজের জন্য নির্দিষ্ট কোন স্থানের কি প্রয়োজন হতো কি?
অক্তাবিও পাস: ঔপন্যাসিরেক দরকার টাইপরাইটার। কিন্তু কবিতা আপনি যে কোন সময়, যে কোন জায়গায় বসে লিখতে পারেন। কখনও কখনো আমি বাসে বসে বা রাস্তায় হাটতে হাটতে মনের ভিতর কবিতা রচনা করি। হাঁটার ছন্দ আমাকে কবিতার পংক্তি ঠিক করতে সাহায্য করে। তারপর যখন বাসায় ফিরি, সমস্ত কবিতাটি লিখে ফেলি। অনেক আগে যুবক বয়সে আমি রাতে লিখতাম। ওই সময়টা শান্ত ও নিরব। কিন্তু রাতের বেলায় লেখার কারণে লেখকের নিঃসঙ্গতাকে বাড়িয়ে দেয়। আজকাল আমি সকালে ও বিকেলে লিখি। লিখতে লিখতে যখন রাত নামে তখন বেশ ভালো লাগে।
কৃতজ্ঞতা: বিডিনিউজ২৪.কম