Irabotee.com,শৌনক দত্ত,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,iraboti,irabotee.com in

দুটি গল্প

Reading Time: 3 minutes

আজ ০৬ জানুয়ারি কবি, কথাসাহিত্যিক বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়ের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।


 

ঘরের ভেতর ঘর

আমার ঘরের ভেতর একটা ঘর আছে।পাতালঘর।দিব্যেন্দু সেই ঘরটা দেখতে চেয়েছিল। বলেছিল- ‘ এত ঘুরলাম স্বপ্না, তবু তোমার বাড়ি তো দেখালে না?’ আমি পাত্তা দিইনি।জানি আল্লাদ দিলেই মাথায় উঠবে। তবু দিব্যেন্দু একদিন গরজ দেখিয়ে ওর বাইকে চাপিয়ে ঘুরিয়েছিল সন্ধ্যানদীর তীর। আমি ওর খেয়ালখুশি হাতে ছেড়ে দিয়েছিলাম নিজেকে। উপর উপর। ঘর খুঁজে পায় নি দিব্যেন্দু। শরীর সাড়া দেয়নি আমারও। এরপর নানা অছিলায় সে আমাকে নিয়ে গেছে গুলবাগের ফাঁকা মাঠে অথবা মোহনপুরের উদোম প্রান্তরে। এত নির্জনতা আমার হজম হয় না। বলেছিলাম- পেলে? বাড়ি খোঁজা এত সহজ নয়। জিওগ্রাফি পেরিয়ে ঢুকতে হবে সাইকোলোজির ভেতর। অন্তর্গূঢ় উগ্র লালসায় সে তখন অধীর থেকে অধীরতর। তার ধৈর্য নেই।বুক জুড়ে শুধু নিঃশ্বাস আর রক্তের তুমুল দাপাদাপি। বরফের নদী পেরিয়ে সেই দেশ সেই মানচিত্র আর খুঁজে পাওয়া হয়নি দিব্যেন্দুর।
অঞ্জুকে পেয়েছিলাম কলেজে। কলেজ হোস্টেলে। আমার বন্ধু। দিনরাতের বন্ধু। একসাথে ওঠা বসা, শোয়া। লোকে বলত- মাণিকজোড়। আড়ালে আরও অনেককিছু। আমি ওসব পরোয়া করিনি। আমাদের বাড়িতে এসেছিল অঞ্জু। দুর্গাপুজার আগেই সম্ভবত।
আমার বাড়িটা দেখেছিল। সেই পাতালঘর। কেউ দেখেনি, দিব্যেন্দুও না।
কী সুন্দর! আমার চোখ জুড়িয়ে গেল। শরীর জুড়িয়ে গেল।নিজেকে তছনছ করতে করতে অঞ্জু বলেছিল মায়া জড়ানো গলায়।
আমি বললাম- এ আর এমন কি। এই তো আমি।
অঞ্জু বলেছিল- বাইরে থেকে কিছুই বোঝা যায় না বল, পলেস্তারা খসে যাওয়া দেওয়াল।শ্যাওলার দাগ।এত নকশা। কে বলবে ভেতরে ভেতরে এই…
আমি মুখ ঘুরিয়ে নিই অন্যদিকে। বাইরেটাই সব নয় রে। ঘরের ভেতরে থাকে আরেকটা ঘর। সবাই সেখানে আসতে পারে না। তুই পেরেছিস। বাইরে শ্যাওলা ধরা দেওয়ালে মেয়ের মুখ। ভেতরে আমি। আমার নিজস্ব আমি।
অঞ্জু বলল- স্বপ্না নোস, তুই আমার স্বপন।

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

 

মনকোঠা

সন্ধ্যে নেমে এসেছে হঠাৎই। মেঘলাদিনের সন্ধ্যে যেভাবে আসে। স্টেশনে ফিরতে হবে দ্রুত। হোটেল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় দাঁড়াল সুদীপ। একটা টোটো কিংবা রিক্সা হাতের সামনে যা পাওয়া যাবে নিয়েই দৌড়তে হবে সোজা স্টেশনে। মফস্বলের রেলস্টেশনে সন্ধ্যের দিকে তেমন লোকজন হয় না। ফলে অগ্রিম টিকিট কাটা না থাকলেও কোন অসুবিধে হবে না।এক সপ্তাহ আগে যে পথ ধরে সে এসেছিল, সেই পথের দিকে তাকিয়ে থাকল ।পরপর অনেকগুলো বাড়ি, তারপর ফাঁকা শুনশান প্রান্তর।খেত, জমি, কালো হয়ে আসা আকাশ।
‘সুদীপ’। কেউ যেন ডাকল পিছন থেকে।
অবাক চোখে তাকাল পিছনে। এখানে তাকে চেনার মতো কেউ নেই। পরিচিত জায়গা নয়। সে একটা জরুরি কাজ নিয়ে এসেছিল। মানুষের শরীরের রহস্য জগত। মন ও হরমোনের প্রযুক্তি তার গবেষণার বিষয়। মিঃ সন্দীপন হালদার পাশে না থাকলে এতসব জানাই হত না কোনদিন। প্রয়োজনীয় তথ্যগুলি কম্পিউটারে বন্দী হয়ে আছে। ব্যাগের ভেতর বইপত্তর, নোটস। কালো কালো অক্ষরে জীবনের কথা। আবার হয়তো আসতে হবে মাস খানেক পর। এক সপ্তাহের অভিজ্ঞতা তাকে সত্যিই জীবন শিখিয়েছে। যাকে এতদিন সেও ভেবে এসেছিল অসুখ ও বিকৃতি। সন্দীপনদা খুব সহজে বুঝিয়েছেন বাইরের জেন্ডার নয়,ভেতরের আর্তনাদটাই আসল।
সুদীপ অবিশ্বাসী চোখে তাকাল পিছনে।কেউ নেই। অনেকটা পথ হেঁটে সে যখন স্টেশনে পৌঁছাল তখন ট্রেন চলে গেছে। বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ঘন্টা চার তাকে এখানেই বসে থাকতে হবে। শেডের নিচে বৃষ্টির ছাঁট আসছিল। এর থেকে বাঁচার জন্য সে ওয়েটিং হলের দিকে পা বাড়াল। ফাঁকা ওয়েটিং রুমে দূরের কোণায় কয়েকটা ছেলে বসে আছে। একজন চোখটা অদ্ভুত কায়দায় নাচিয়ে তাকে ডাকল। সোজা বাংলায় যাকে বলে চোখ মারা। ছেলেটির কপালে কাটা দাগ, একে সে কখনও দেখেছে, মনে পড়ল না। হৃদপিন্ডের ছবি আঁকা একটা টি শার্ট প্যান্টের সাথে গুঁজে পরা। ওর মুখের উপর এসে পড়ছে কম পাওয়ারের বাল্বের মৃদু আলো।পাশে নীল জামার ছেলেটিকে দেখে মনে হল লিলকি। ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে এক আশ্চর্য সংকেতে। সুদীপ কান খাঁড়া করে শব্দগুলো শুনতে লাগল।
কপালে কাটা দাগ ছেলেটা ফিসফিস করে বলল- বাট্টু শরিফ? তারপর আঙুলের এক অশ্লীল ইশারা করল, অন্য সময় হলে সুদীপ মুখ ঘুরিয়ে নিত। কিন্তু এখন পারল না। কম্পিউটারের ভেতরে যে জীবন বন্দি আছে তাকে আলোর নিচে দেখতে হবে। ছেলেদের ঠেকে দু একজন মেয়েও রয়েছে। দেখে মেয়ে মনে হলেও ওরা ঠিকমতো মেয়ে নয়। ইলু। বানানো সৌন্দর্য নিয়ে এরকম অনেক মেয়ে আজকাল দেখা যায়।শরীরে পুরুষ অঙ্গ আছে অথচ মনে মনে মেয়ে। হাতের ব্যাগ থেকে একটা লিপস্টিক বের করে ঠোঁটে ঘসল মেয়েটি তারপর সোজাসুজি এগিয়ে এল সুদীপের কাছে।
ভদ্রতা বশত সুদীপ সামান্য জায়গা ছেড়ে বলল- বসুন।
মেয়েটি বলল- বসতে আসিনি, ঠেক রেডি আছে, যাবে?
না, না। এক বিক্ষুব্ধ ধিক্কারে হাতটা ছাড়িয়ে নিতে গিয়েও দ্বিধাহীন ভঙ্গিতে পা দুটো অনুসরণ করে মেয়েটিকে। ভাঙা দেওয়ালের একটা ঘর। হিমশীতল স্মৃতির কফিন বেয়ে উঠে আসে একটা শরীর।সারা গায়ে, হাতের তেলোয়, সীমাহীন উত্তাপ আর প্রদাহ। কপালের পোস্তুদানার মতো ঘাম।বুকের ভেতর বয়ে যায় একটা মালগাড়ি। তার গুমগুম শব্দ শোনা যায়। মেয়েটি সংকোচের কোন রকম বালাই না করেই ঠোঁটে ঠোঁট ঘসতে থাকে।
আপনি ভুল করছেন।
অসম্ভব। তোমাকে যেদিন সন্দীপনদার বাড়ি যেতে দেখি সেদিনই বুঝেছিলাম বাট্টুখোর আছো ।
লজ্জায় লাল আরক্তিম হয়ে উঠে মুখ।বারান্দায় ছায়া পড়ে।একজোড়া হাত এগিয়ে আসতে আসতে দখল নেয় তার শরীরের।সুদীপ নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার আগেই দেখল তার উরুসন্ধির সংযোগস্থলে নেমে এসেছে একটি হাত। স্থান কাল বিচার না করেই মেয়েটি ঝাপিয়ে পড়ে তার বুকে। এক আশ্চর্য আবেগে ফুলে উঠে সারা অবয়ব। তার সাথে সঙ্গতি রেখে একজোড়া শরীর ছায়া হয়ে দুলতে থাকে ভাঙা ঘরের দেওয়ালে। বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে শরীর।
উৎসারিত কান্নার বিলোল কম্পাঙ্কে থরথর করে কেঁপে উঠে সুদীপের মনকোঠা।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>