| 24 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

মুনিয়া

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
টাইম লাইনে দেখেছিলাম মুনিয়ার প্রথম পোস্টটা। 
খুব ক্ষুব্ধ স্ট্যাটাস সেটা। 
‘আমি ৭৮৫ জনের স্ট্যাটাস দেখতে পাই, আমার স্ট্যাটাস  কি ৫০ জনের কাছেও পৌছে না?’ হয়ত পোস্ট করে প্রত্যাশিত লাইক পায়নি তাই এতো ক্ষোভ। 
মন ভালো থাকলে আমি মাঝে মাঝে তরল আচরণ করি। মনে আছে সেটা ছিল ছুটির দিনের একটা ঝকঝকে সকাল। এতো সুন্দর সকাল দেখে আমার মন খুশি হয়ে উঠেছিল। গোসল করে পাড়ার মোড় পেরিয়ে আমি নদীর ধারের পার্কে বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে এসেছিলাম। বাড়ি ফিরে ফেসবুকে ঢুকে মুনিয়ার এই স্ট্যাটাস দেখে আমি তরল হয়ে কমেন্ট করে বসেছিলাম। বলেছিলাম, আমার স্ট্যাটাস কি আপনার কাছে পৌছায়?
মুনিয়া অনলাইনেই ছিল।  তখনই রিপ্লাই দিয়েছিল, ‘নিউজফিডে প্রথম থেকে পড়া শুরু করি। কারো কারো এড়িয়ে যেতে পারে।’
আমিও পাল্টা রিপ্লাই দিয়েছিলাম, ‘পড়তে হবে, না পড়লে হবে?’ তারপরই আমি অফলাইন হয়ে গিয়েছিলাম। 
সেদিন বিকেলে ফেসবুকে ফের ঢুকে দেখি বিগত বছর দেড়েকের সমস্ত পোস্টে লাইক, রিয়াকশন, কমেন্ট করা। নোটিফিকেশন দেখে আমি ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। কেমন জানি ডেসপারেট ডেসপারেট মনোভাব। ভয়ে ভয়েই যোগাযোগ রাখা শুরু। 
আমার দিক থেকে যোগাযোগ রাখা বলতে ওর কথায় হ্যাঁ, হু সায় দেয়া। মাঝে মাঝে বলত, তুই কি শুধু সায় দিস নাকি এটা তোর নিজের মনোভাব? তখন আবার কিছু কিছু বিষয়ে ছদ্ম মতবিরোধ দেখাতে হতো। কিছুটা উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের পর হার মেনে নিলে খুব খুশি হতো। 
ততদিনে আমি আর ওকে হাইটেম্পারড বা ডেসপারেট ভাবছি না বটে কিন্তু বেশ বুঝতে পারি ওর ভেতর কোন গভীর শূণ্যতা দিনরাত তাড়া করে । সেই শূণ্যতা সেই তাড়নাকে পূর্ণ করার জন্য ফেসবুকের এই বায়বীয় জগতে ওর বিচরণ। প্রথমে কথাবার্তা আলাপ প্রেম ভালোবাসার দিকে নিয়ে যেত, কিন্তু আমি দায়সারা গোছের উত্তর দেয়ার কারণে তেমন আগায়নি। পরে আমাদের কথাবার্তা হতো আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট নিয়ে। আমরা দুজনেই ফেসবুক বোদ্ধাসমাজের সদস্য কি না! তাই রোমান্টিক আলাপের দিকে আমাদের আর কথা যেত না। আর এমন সরল আর প্রাণবন্ত মেয়ের জন্য ফেসবুকে শুভাকাঙ্ক্ষীর কোন অভাব হওয়ার কথা নয়। ফলে ওর মনে প্রেমের নৌকার পালে হাওয়া লাগানোর লোকের অভাব ছিল না। আমি নিতান্ত ভালোবন্ধু হয়েই ছিলাম।  
মুনিয়া প্রাপ্তবয়স্ক একটি মেয়ে, ভালোমন্দ জ্ঞান আছে, আর জীবনকে যেকোন দিকে ধাবিত করার অধিকার ওর আছে বলেই আমি বিশ্বাস করি। শুধু মুনিয়ার ব্যপারে নয়, অন্য সকলের ব্যাপারেও তাই ভাবি। তাই এই অস্থিরমতি মেয়েটির নিত্যনতুন বন্ধুদের সাথে চিল করার ছবি দেখে জাজ করার প্র‍য়াস পায়নি আমার মাঝে। শুধু মনে হতো একটা হালবিহীন, কম্পাস হারানো, দিকবেভুল নৌকা শুধুমাত্র পালের উপর, হাওয়ার গতির উপর ভরসা করে তীরে ভিড়তে চাচ্ছে। 
কিন্তু হাওয়া তো বদল হয়! আর হাওয়ার পালাবদলে মুনিয়া বুঝতে পারে ভুল মানুষের সাথে সে যাত্রা করেছে বা বুঝতে পারে জীবনভর যাত্রার জন্য সঙ্গীটি সঠিক নয়।  একটা এডভেঞ্চার থেকে আরেকটা এডভেঞ্চারে ঝাপিয়ে পড়ার মাঝের সময় মুনিয়া আমার ইনবক্সে, হোয়াটসঅ্যাপে আর বাসায় হানা দিত। 
সেই সব দিনের আড্ডাগুলোতে আমাকে অনবরত ওর কথা শুনে যেতে হতো। কী কারনে এবারের ব্রেক আপ আর ওর কী কী যুক্তি আছে ব্রেক আপ করার তা শুনতে এবং তাতে সমর্থন দেয়া বাধ্যতামূলক ছিল। কিছু বলতে গেলে বলতো, তুই আমার বন্ধু, না ওই পোলার বন্ধু, হু? আমি বলতে বাধ্য হতাম যে, আমি মুনিয়ার বন্ধুই।  তখন আমাকে নসিয়ত করতো যে,  বন্ধুদের কাজ বন্ধুকে সমর্থন করা কারন জাজ করার জন্য সারা দুনিয়া রয়েছে। আমি মনে মনে মুনিয়াকে বলতাম,  মুনিয়া – তুই আমার দুনিয়া। 
কবে থেকে মুনিয়াকে আমি ভালোবাসতে শুরু করি আমি ঠিক জানি না। এবং এই ভালোবাসা কেমন তাও আমি বুঝতে পারতাম না। মুনিয়া যখন অন্য ছেলেদের নিয়ে ব্যস্ত হতো তখন আমার তখন রাগ হতো না, অভিমান হতো না। বরং  আমি চাইতাম মুনিয়া যা চাইছে সেটা ঠিকঠাক ঘটুক, ওদের মধ্যে সুন্দর একটা সম্পর্ক গড়ে উঠুক, যে সম্পর্কটা এই অস্থিরমতি মেয়েকে স্থিরতা দেবে, এই পৃথিবীকে দোষারোপ করা থেকে বিরত রাখবে। মেঘহীন বিকেলের আকাশ দেখতে দেখতে আমি নিজেকে কয়েকবার প্রশ্ন করেছি এই কেউ একজন আমি নই কেন? আমি কি মুনিয়ার সেই একজন হতে পারি না যার মাঝে সে পুরোপুরি ডুবে যেতে পারে, যাদের কাছে সে বারবার ছুটে গেছে মুনিয়া তাদের থেকে আমি মুনিয়াকে অনেক বেশি জানি, অনেক বেশি বুঝি, এমনকি অনেক বেশি ভালোও বাসি। আর অনেক অনেক ভালো চাই ওর।  তাহলে কেন আমি মুনিয়াকে বলে দেব না মনে মনে বলা আমার কথা, ‘মুনিয়া-তুই, তুইই আমার দুনিয়া’? 
আমার স্বচ্ছ এবং  গভীর পর্যন্ত দেখতে সক্ষম মন আমাকে এও বলল যে, মুনিয়া মূলত বার বার আমার কাছেই ফিরে আসে। কিন্তু আমার অপারগতা বা সাহসহীনতা তাকে আবার অন্যদের কাছে ফিরিয়ে দেয়। প্রতিটি দুঃখের জন্য মিলিতভাবে সে এবং সেই ছেলেগুলো যত না দায়ী তার থেকে আমি, এই আমি অনেক বেশি পরিমানে দায়ী। 
প্রতিটি দায় এড়ানো এবং জীবন থেকে পালিয়ে বেড়ানো মানুষের মতো আমারও দারুন প্রতিভা যেহেতু আছে অজুহাত সৃষ্টি করবার মতান্তরে পাল্টা যুক্তি দেয়ার এবং বিবেককে স্রেফ ঘুম পাড়িয়ে দেয়ার –  তাই মনের এ সকল কথা আমি অগ্রাহ্যও করতে পারতাম।
 কিন্তু আবার সেই ধাক্কা খাওয়া প্রতারিত হওয়া মুনিয়া যখন কিছুদিন পরে আমার বন্ধুত্বের উঠোনে ফিরে আসতো আমি ফের অপরাধবোধে ভুগতাম। মনে হতো স্রেফ আমার নিষ্ক্রিয়তার কারনেই তার এই বারবার প্রতারিত হওয়া।
একদিন এমনই বিধ্বস্ত পাখির মতো মুনিয়া আমার ডেরায় এলো। এসেই নতুন কেনা ছোট্ট ফ্রিজ দেখে বলল,  তাহলে আজীবন ব্যাচেলর থাকার প্রস্তুতি নিতে শুরু করছিস?  
সেদিনের কথায় অন্যকিছু ছিল। ছিল আবরনে ঢাকা গোপনকে জেনে ফেলার আত্মবিশ্বাস আর নিজেকে খুঁজে পাওয়ার দৃঢ়তা। 
মুনিয়া বলল, ‘ভালো ভালো। আমিও ঠিক করেছি আর প্রেমের জন্য তাড়াহুড়া করবো না। এতোদিনে বুঝলাম যাকেই দেখি তাকে আসলে আমি তোমার সাথে তুলনা করি। আর কেউ তো কারো মতো হয় না। এই কারনে কারো সাথে আমার হয় না। আর তাদেরকে তাই আমি বিদায় করে তোর কাছে এসে আবার নিজের ‘আমি’কে ফিরে পাই। এবং….’
আমি অস্ফুটে বলে ফেলি, এবং?
‘এবং তুই যেহেতু বলবি না তাই আমিও প্রচুর সময় নিয়ে বসে থাকতে চাই আর দেখতে চাই তুই কতদিনে বলিস বা আদৌ বলিস কি না। কিন্তু নিজেকে আর সেইসব বেচারাদের শুধু শুধু হয়রানি আর দোষারোপ করতে চাই না। হোয়াট ডু ইউ সে?
আমি অবাক হয়ে তাকিয়েই থাকলাম মুনিয়ার দিকে। চঞ্চলা, কেন্দ্র থেকে তীব্রবেগে বৃত্তভেঙ্গে বেরিয়ে পড়ার আকাক্ষায় ছুটে চলা সেই বিন্দুটি আজ অসীম শক্তিধর নিউক্লিয়াসে পরিনত হয়েছে যে তার আত্মবিশ্বাসের আকর্ষণীয় ক্ষমতা দ্বারা আজীবন কেন্দ্রবিমুখী পুরুষকে ঘরের পথে টেনে আনতে সক্ষম।
মুনিয়া আমাকে আবার বলল, হোয়াট ডু ইউ সে?
আমি বললাম, সমগ্র পৃথিবীকে ছেড়ে আমি ফিরতে পারি এমন একটি নীড় আমার হলো। এমন সময়ে আমি কি বলতে পারি? সেই কথাটি আমি তোমাকে বলতে চাই যা আমি আজ এতোটা দিন বলতে পারিনি।
মুনিয়া এতোটা কাছে সরে এলো যে আমি তার নিশ্বাসের উত্তাপ টের পেলাম। ওর মুখে মৃদু হাসি, প্রশ্রয়ের। বলল, বলো।!
আমি বললাম, মুনিয়া—তুই আমার দুনিয়া!
আজ এতোদিন পরেও ভালোবাসাবাসির পরে মুনিয়া আবার আমাকে কাছে টেনে নেই। সেই প্রশ্রয়, সেই হাসি। বলে, বলো!
আমি বলি, মুনিয়া—তুই আমার দুনিয়া!

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত